গল্প গগন চন্দ্র গড়গড়ি দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী শরৎ ২০২০

দ্বৈতা হাজরা গোস্বামীর আগের গল্প  -লিলিয়া আর চার পুতুলের গল্পতালপাতার সেপাই

এক গ্রামে এক পন্ডিত থাকত। তাকে সবাই বলতো বাঁকা পন্ডিত। তার ভালো নাম ছিল বঙ্কিমচন্দ্র বাক্যবাগীশ।

 পন্ডিত মশায়ের বাড়ির উঠোনে চাঁদের আলোয় একদিন একটা ছোট্ট ছেলে গড়াগড়ি দিচ্ছিল। তাই দেখে পন্ডিত শুধোলেন, “এই যে বাপধন কী করছ এখানে?”

সে হেসে বলল, “দেখছ না চাঁদের আলো গায়ে মাখছি!”

সেই দেখে পন্ডিত তার নাম দিলেন গগনচন্দ্র গড়গড়ি। ভারী মায়া পড়ে গেল তাঁর গগনের ওপর। গগনের কেউ ছিল না। গগনকে তিনি নিজের ছেলের মতো মানুষ করতে শুরু করলেন। গগনও তাঁকে বাবা বলে ডাকত।

পন্ডিতের এক ছেলে ছিল। তার নাম ছিল জগন্নাথ। জগন গগনকে মোটেও দেখতে পারত না। একে তো তাদের নিজেদের এতো কষ্ট করে সংসার চলে তার ওপর এসে জুটেছে এই অকম্মার ঢেঁকি। গগন ছিল খুব বোকা আর সরল সোজা।

জগন একদিন বলল, “ভাই গগন, আমি দূরের দেশে যাচ্ছি। কাজ খুঁজতে। তুই যাবি?”

গগন বলল, “হ্যাঁ দাদা যাবো।”

দুজনেই সঙ্গে চিঁড়ে আর গুড় নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়ল।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ পার হল। জগন-এর খিদে পেলেই সে খেয়ে নেয়। তার অর্ধেক চিঁড়ে দু দিনে প্রায় শেষ। কিন্তু গগন খায় কম। বাবা বলেছিল, “বেশি খাবি তো কম খা।”

পথে পড়ল এক মস্ত জঙ্গল। গগন ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করল ভয়ে কারণ সন্ধে হয়ে এসেছে। সে বলল, “বাবা বলে, ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয় ।’”

জগন হেসে বলল, “বীরপুরুষ হতে হবে। ভয় পেলে কী চলে নাকি?”

জঙ্গলের মধ্যে একজায়গায় গগনকে দাঁড় করিয়ে জগন বলল, “শোন, তুই এখানে দাঁড়া। আমি কিছু ফল নিয়ে আসি।”

গগন বলল, “দাদা যেও না আমার ভয় করছে।”

জগন হেসে বলল, “দূর বোকা ভয় কীসের?”

বাবা বলেছে, “লজ্জা ঘেন্না ভয় তিন থাকতে নয়।”

গগন অনেকক্ষণ জঙ্গলের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে। জগন তো ততক্ষণে পগার পার।

গগন শুনেছিল, ‘আগে গেলে বাঘে খায়।’

দাদাকে নিশ্চয় বাঘে খেয়েছে, এই ভেবে সে কাঁদতে শুরু করল।

রাতে জঙ্গলেরই একটা গাছের ওপর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল গগন।

সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই তার খুব খিদে পেল। চিঁড়ে গুড় তার ফুরিয়ে যায়নি। বাবা ঠিকই বলে, “বেশি খাবি তো কম খা।”

সে হাঁটতে শুরু করে দাদার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে।

সেই সময় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে এক রাজ পেয়াদা যাচ্ছিল। সে গগনকে দেখতে পেয়ে বলল, “এই তুই কে? তোর নাম কী?”

সে ভয়ে ভয়ে বলল, “গগন চন্দ্র গড়গড়ি। আমি জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছি। বাইরে যাওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছি না।”

লোকটা হেসে গড়াগড়ি, “এতো বড়ো জোয়ান চেয়ে আবার হারায় নাকি? চল আমার সঙ্গে।”

রাজামশাই জলখাবার খেয়ে সবে এসে বসেছিলেন। গোঁফ জোড়ায় তা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ” তুমি কী কাজ পার?”

গগন কোনো কাজই পারত না। কিন্তু বাবা বলত, “নেই কাজ তো খৈ ভাজ।”

তাই সে বলল, “আমি খৈ ভাজি।”

পরের দিনই ছিল রাজকন্যার বিয়ে। রাজা বললেন, “এই কে আছিস খৈ ভাজার কাজে একে লাগিয়ে দে।”

গগন খৈ ভাজে আর মনের আনন্দে গান করে

“খৈ চিটপিট খৈ চিটপিট

চিটাং চিটাং গুড়

রাজকন্যে কাল সকালে

যাবে অনেকদূর”

রাজকন্যের ঘুম হচ্ছিল না। সে জানলা দিয়ে দেখলো ভারী মিষ্টি দেখতে একটা ছেলে মনের আনন্দে গান গাইছে। সে এসে গগন কে বলল, “তোমার গান থামাও। আমি যে পালিয়ে যাব সে কথা আর গেয়ে গেয়ে সবাইকে জানাতে হবে না।”

“এ বাবা তুমি পালিয়ে যাবে সত্যি সত্যি? এক্ষুনি গিয়ে রাজামশাইকে বলছি।”

“না কিচ্ছুটি বলবে না। এই নাও এই আংটিটা রাখো।”

গগন অমনি আংটিটা হাতে পরে নিল।

সকাল বেলা সারা রাজ্যে হৈহৈ পড়ে গেল যে রাজকন্যে পালিয়েছে। গগনের হাতে রাজকন্যের আংটি দেখে পেয়াদারা তাকে ধরে এই মারে তো সেই মারে। রাজার কাছে নিয়ে গিয়ে বলে, “এই ব্যাটা রাজকন্যেকে মদত দিয়েছে। এ সব জানে হুজুর।”

 রাজামশাই পড়েছেন মহা মুশকিলে। এই নিয়ে সপ্তমবার রাজকন্যা পালাল। রাজ্যের লোক হাসাহাসি করে। রাজকন্যার শর্ত সে যদি পালিয়ে যায় তবে এক দিনের মধ্যে তাকে যে খুঁজে আনবে তাকেই সে বিয়ে করবে।

রাজমশাই গগনকে বললেন, “তুমি যদি সত্যিই জানো রাজকন্যা কোথায় গেছে আর আজকে সূর্য ডোবার আগে রাজকন্যাকে খুঁজে আনতে পারো, তাহলে আমি রাজকন্যার সঙ্গে তোমার বিয়ে দেব আর যদি খুঁজে না আনতে পারো তাহলে তোমাকে পেয়াদারা আবার গভীর জঙ্গলেই ছেড়ে আসবে।”

গগন পড়ল মহাবিপদে। সে সত্যিই জানে না রাজকন্যা কোথায় গেছে। পথে বেরিয়ে সে ঘুরতে লাগল সারাদিন। খিদে তেষ্টায় মুখ শুকিয়ে গেছে।

এমন সময় রাজ্যের একদম শেষ প্রান্তে দেখে একটা লোক রংবেরঙের গামছা বিক্রি করছে। বাবা মাঝে মাঝে জগনকে বলত, “সবজান্তা গামছাওয়ালা।”

গামছাওয়ালারা সব জানে। তাই সে জিজ্ঞেস করল, “ও ভাই , কোনো রাজকন্যেকে এদিক দিয়ে পালাতে দেখেছ?”

গামছাওয়ালা বলল, “বলব কিন্তু আগে আমার একটা গামছা কেন দেখি।”

গগন বেচারা খৈ ভেজে যা পয়সা পেয়েছিল সেটা লোকটাকে দিয়ে একটা গামছা কিনল।

লোকটা মনে মনে হাসল। ভাবল্‌, “কী বোকাই না ছেলেটা!”

কিন্তু মুখে বলল, “ওইদিকে একটা কচুরিপানা ভর্তি পুকুর আছে তার জলের মধ্যেই রাজকন্যে লুকিয়েছে।”

গগন তো মহানন্দে পুকুরের দিকে পা বাড়াল। পুকুরে ছিল বেজায় কাদা, পা পিছলে কাদায় পড়ে একেবারে ভূত হয়ে গেল সে। পুকুরের জলে ডুব দিয়ে কোথাও রাজকন্যেকে দেখতে পেল না।

কিন্তু জল থেকে ওঠার পর দেখল, তার হাতে রাজকন্যের যে আংটিটা ছিল সেটা কৌটোর মতো খুলে গেছে। তার মধ্যে একটা চিরকুটে লেখা আছে, “চিলেকোঠার ঘর।”

তারপর তো চিলেকোঠার ঘর থেকে রাজকন্যেকে পাওয়া গেল।

রাজামশাই খুব খুশি হয়ে ধুমধাম করে গগনের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে দিয়ে দিলেন। আর গগনকে একটা গোটা রাজ্যই দিয়ে দিলেন।

গগন রাজকন্যেকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি আমার সঙ্গে থাকতে পারবে তো? আমাকে তো সবাই বোকা বলে।”

রাজকন্যে হেসে বলল, “আংটিটা তো আমি ইচ্ছে করেই তোমায় দিয়েছিলাম বুদ্ধুরাম।”

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প-উপন্যাস

2 thoughts on “গল্প গগন চন্দ্র গড়গড়ি দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী শরৎ ২০২০

  1. তোমার এই সুন্দর রূপকথার গল্প পড়লাম। রোদ-ঝলমল সুন্দর সকালটা আরও সুন্দর মনে হতে লাগল ! এমন মিষ্টি ছোঁয়া আছে গল্পটার মধ্যে যে, পড়লেই শুধু ছোটদের নয়, আট থেকে আশি সবারই ভালো লাগবে । তুমি এই রূপকথার গল্পে অভিনবত্ব এনেছ একের পর এক বাংলা প্রবাদ -বাক্য এনে এবং সেজন্যেই আমি বলব এটি একাধারে রূপকথার এবং মজার গল্প । তোমাকে এমন শারদ উপহারের জন্যে জানাই ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা এক আকাশ ।

    Like

  2. তোমার এই সুন্দর রূপকথার গল্প পড়লাম। রোদ-ঝলমল সুন্দর সকালটা আরও সুন্দর মনে হতে লাগল ! এমন মিষ্টি ছোঁয়া আছে গল্পটার মধ্যে যে, পড়লেই শুধু ছোটদের নয়, আট থেকে আশি সবারই ভালো লাগবে । তুমি এই রূপকথার গল্পে অভিনবত্ব এনেছ একের পর এক বাংলা প্রবাদ -বাক্য এনে এবং সেজন্যেই আমি বলব এটি একাধারে রূপকথার এবং মজার গল্প । তোমাকে এমন শারদ উপহারের জন্যে জানাই ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা এক আকাশ ।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s