গল্প গল্প হলেও সত্যি চুমকি ভট্টাচার্য বর্ষা ২০২০

 

রবিবারের সন্ধ্যায় সদ্য কেনা বিখ্যাত একটা বই হাতে নিয়ে গা এলিয়ে দিয়েছি নরম সোফায়। বইটার নাম, ‘দ্য ম্যান হু নেভার ওয়াজ’, যার লেখক বিখ্যাত স্পাই চরিত্র জেমস বন্ডের স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিং। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। আমি সোফা ছেড়ে উঠে দরজা খুলে দেখি সূর্যকাকু দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের পাশের পাড়াতেই থাকেন সূর্যকাকু, আমার মা-বাবাকে বৌদি ও দাদা বলে ডাকেন। সূর্যকাকু আর্মি-ম্যান, বেশ হাসিখুশি দিলদরিয়া স্বভাবের মানুষ। কলকাতায় যখন ছুটি নিয়ে আসেন তখন প্রায়ই আসেন আমাদের বাড়িতে। সূর্যকাকু মানেই যেন এক সিন্দুক গল্প! যুদ্ধের গল্প তো বটেই, দেশবিদেশের আরও কত গল্প।

আমার পিছন থেকে মায়ের গলা শুনলাম, “সূর্য ঠাকুরপো এসেছ? অনি, দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

আমিও তাড়াতাড়ি দরজার একপাশে সরে দাঁড়ালাম। সূর্যকাকু ঘরে ঢুকে সোফায় বসার সময় দেখতে পেলেন সেন্টার টেবিলের উপরে রাখা বইটা। বইটা হাতে তুলে নিয়ে বলে উঠলেন, “আরে, এটা তো সেই বিখ্যাত বই যা প্রকাশের পরপরই বেস্ট সেলার হয়! বই প্রকাশের বছর দুই পরে এই একই নামে একটি সিনেমাও মুক্তি পেয়েছিল।” সূর্যকাকু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই গল্প, জানো তো?”

আমি মাথা হেলিয়ে বললাম, “হ্যাঁ জানি, তবে গল্পটা সবে পড়া শুরু করেছি।”

সূর্যকাকু গম্ভীর হয়ে বললেন, “ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন, মাই চাইল্ড! তখন ১৯৪৩ সাল। মিত্রশক্তি তখন সিসিলি আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল। তারা জানত যে তারা সিসিলি আক্রমণ করলে তাদের মুখোমুখি হতে হবে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর। তাই সিসিলি আক্রমণের জন্য ব্রিটিশরা কিছু কৌশলের আশ্রয় নেয়। আর এই জন্যই সাজানো হল মিথ্যে এক নাটক।” এইটুকু বলে সূর্যকাকু আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “এখানেই থামলাম। আর তোমায় বোর করব না, মাই সুইট লেডি।”

আমি তখন গল্পের গভীরে সবে ঢুকতে শুরু করেছি। তাই সূর্যকাকুর কথায় প্রায় আঁতকে উঠে বললাম, “না না কাকু, তুমি বলো প্লিজ!”

মা এই সময় চায়ের পেয়ালা ও ডালমুটের প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বাবাও এই সময়ই তাঁর স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তিনিও আমার কথার সূত্র ধরেই বললেন, “আমি আর তোমার বৌদি ও শুনব। সূর্য, বলো বলো। চেনা গল্পও তোমার বাচনভঙ্গির গুণে আলাদা মাত্রা পায়।”

সূর্যকাকু সলজ্জ হেসে বললেন, “কী যে বলেন দাদা!”

সূর্যকাকু আবার বলতে শুরু করেন, “এই নাটকের ধারণা সাহিত্যিক ইয়ান ফ্লেমিংয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত, যিনি সৃষ্টি করেছিলেন বিখ্যাত চরিত্র জেমস বন্ড। এ গল্পেও একটা বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে গুপ্তচরবৃত্তি। নাটকের প্লট অনুসারে মিত্র বাহিনী গ্লিনডোর মিশেল নামের এক ভবঘুরের মৃতদেহ খুঁজে বের করে। মিত্র বাহিনী মৃতদেহটির নামকরণ করে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম বিল মার্টিন।”

আমি বলে উঠলাম, “মৃতদেহের আবার নামকরণ?”

বাবা বললেন, “হ্যাঁ মৃতদেহের নামকরণ, আর সেই মৃতদেহই ছিল গল্পের প্রধান ভূমিকায়।”

সূর্য কাকু বলে চললেন, “উইলিয়াম বিল মার্টিন নামক এই কাল্পনিক চরিত্রটির জন্ম সাল বানানো হয় ১৯০৭ সালকে আর জন্মস্থান ওয়েলসের কার্ডিফে। মার্টিন নামটা পছন্দ করা হয়েছিল কারণ, তখন ব্রিটিশ রয়েল মেরিন বাহিনীতে ক্যাপ্টেন বা মেজর পদে মার্টিন নামের অনেক সেনা ছিল। এই কাল্পনিক চরিত্রটির পরিচয়পত্রে যে মানুষটির ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল তিনি ছিলেন এম আই-ফাইভ অফিসার রনি রিড, যার চেহারার সঙ্গে অনেকটাই মৃতদেহটির চেহারার সাদৃশ্য ছিল। মৃতদেহটিকে মিত্র বাহিনীর পোশাক পরিয়ে দেওয়া হয় এবং তার কোমরের বেল্টের সঙ্গে একধরনের বিশেষ শিকলের সাহায্যে একটি ব্রিফ-কেস বেঁধে দেওয়া হয়। এই ব্রিফ-কেসে ছিল গ্রিসে মিত্র বাহিনীর আক্রমণের নকশা। তারা একটি নষ্ট প্যারাসুট মৃতদেহটির গায়ে লাগিয়ে দিয়ে মৃতদেহটিকে সমুদ্র-স্রোতের সঙ্গে ভাসিয়ে দিল, যাতে হিটলারের নাৎসি বাহিনী তা খুঁজে পায়।”

আমি বলে উঠলাম, “সে কি! নিজেরাই নিজেদের মূল্যবান নকশার তথ্য শত্রুর হাতে তুলে দিল!”

সূর্যকাকু হেসে বললেন, “এখানেই তো মস্ত চালাকিটা, যা হিটলারের নাৎসি বাহিনীকেও বোকা বানিয়েছিল। কারণ, ওই নকশাটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা।” তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, “ব্রিটিশ বা মিত্র বাহিনী যেমন আশা করেছিল ঠিক সেইরকমই ঘটল। নাৎসিরা মৃতদেহ সহ ব্রিফ-কেসটি খুঁজে পায়। তারা ভাবল, কোনও বিমান দুর্ঘটনায় মিত্র বাহিনীর এই সৈনিকটি মারা গিয়েছে এবং আক্রমণের নকশাটিকে আসল ভেবে বসল। ফলস্বরূপ জার্মানরা তাদের সেনাবাহিনীর এক বড়ো অংশকে এই মিথ্যা আক্রমণের জায়গায় পাঠিয়ে দিল। সেই সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় নব্বই হাজার। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল মিত্র বাহিনী। তারা খুব সহজেই সিসিলি আক্রমণ করে বসল কারণ, সেখানে সৈন্য সংখ্যা একেবারেই কমে গিয়েছিল এবং বাইরে থেকে তৎক্ষণাৎ সৈন্য আনার মতো অবস্থাও ছিল না নাৎসিদের। যার ফলে মিত্র বাহিনীর হাজার হাজার সৈনিকের প্রাণ বেঁচে যায়। ব্রিটিশদের এ আক্রমণের আরও দু-সপ্তাহ পর পর্যন্ত জার্মানরা বিশ্বাস করে বসেছিল যে মূল আক্রমণটি গ্রিসেই হবে, যদিও সেই আক্রমণ আর কখনোই হয়নি।” এক নিঃশ্বাসে বলে চলেন সূর্যকাকু, “এই ঘটনাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এ ঘটনার ফলে জার্মানরা পরবর্তী সময়ে অনেক আসল ঘটনার তথ্যসমূহ কাকতালীয়ভাবে আগে জেনে যাওয়ার পরও ব্রিটিশদের পাতা ফাঁদ ভেবে এড়িয়ে গিয়েছিল এবং ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল।” সূর্যকাকু আমার দিকে ফিরে বললেন, “তবেই ভেবে দেখো, দুই পক্ষেরই ইন্টেলিজেন্স বাহিনীর কতখানি সক্রিয় ভূমিকা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।”

আমি এতক্ষণ যাকে বলে প্রায় গিলছিলাম এই রুদ্ধশ্বাস কাহিনি।

সূর্যকাকু খানিক থেমে বললেন, “আসলে ইয়ান ফ্লেমিং নিজেই ব্রিটিশ নৌ-সেনার গুপ্তচর বিভাগের অফিসার ছিলেন। তাই এই বৃত্তির প্রতিটি সূক্ষ্ম বিষয় ছিল তার নখদর্পণে। তিনি গল্পচ্ছলে এই বন্ধুদের বলেছিলেন, ‘এমন গুপ্তচরের গল্প লিখব, যা বাকি সব গুপ্তচরের গল্পকে হার মানিয়ে দেবে।’ কথা রেখেছিলেন ফ্লেমিং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েকবছর পরই লিখে ফেলেছিলেন ক্যাসিনো রয়েল। ১৯৫৩ সালে প্রকাশের সঙ্গে-সঙ্গেই যাকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। উপন্যাসের নায়ক সেই ব্রিটিশ গুপ্তচর জেমস বন্ডের নানা রোমাঞ্চকর কার্যকলাপে আজও মজে আছে গোটা বিশ্ব।”

মা বলে উঠেন, “ঠাকুরপো, জেমস বন্ডের গল্পগুলো বড্ড আজগুবি ঘটনায় ভরা।”

সূর্যকাকু বললেন, “বৌদি, সম্প্রতি পশ্চিম লন্ডনের জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রাপ্ত কিছু গোপন নথি বলছে, জেমস বন্ড ‘গল্প হলেও সত্যি’! এই নথিপত্রেই সন্ধান মিলেছে ইয়ান ফ্লেমিংয়ের সমসাময়িক ইয়ো টমাস নামের এক বৃটিশ গুপ্তচরের। যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘হোয়াইট র‍্যাবিট’ ছদ্মনামে কাজ করতেন এবং যার চলন-বলন ও বিভিন্ন অভিযানের সঙ্গে আশ্চর্য মিল রয়েছে জেমস বন্ডের গল্পের। ফ্লেমিংয়ের কলমে টমাস যেন মিশে গিয়েছেন বন্ডের সঙ্গে।” সূর্যকাকু মাকে বলেন, “আর বৌদি, বিজ্ঞানের অগ্রগতি যেভাবে হচ্ছে, আজ যা আজগুবি, অযৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে তাই বাস্তব রূপ নেবে না, তা কে বলতে পারে?”

মা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, ঠাকুরপো তুমি ঠিকই বলেছ। আমি অজ্ঞ মেয়েমানুষ, পৃথিবীর ক’টা খবরই বা জানি।”

এই শুনে সূর্যকাকু হা হা করে বলে উঠলেন, “অজ্ঞ বলে নারী জাতিকে খাটো করবেন না, বৌদি। নারীরা আজ কোন ক্ষেত্রে পিছিয়ে একটু বলুন তো? অনেকেরই এমন ধারণা, যে এমন অনেক কাজই আছে যা শুধু পুরুষের পক্ষে সম্ভব, কোনও নারী তা করতে পারে না, অথচ এমন ভাবনা একেবারেই ভুল। গুপ্তচরবৃত্তিতে নারীদের অবদানও কিছু কম নয়।”

এবার আমার দিকে সূর্যকাকুর প্রশ্ন উড়ে এল, “প্রিন্সেস, তোমার তো এই বিষয়ে বেশ আগ্রহ দেখছি। তা মহিলা গুপ্তচরদের বিষয়ে কোনও ধারণা আছে কি তোমার? নাম জানো তাদের?”

আমি অতি উৎসাহে বলে উঠলাম, “মাতাহারি, জোসেফিন বেকার আর…”

সূর্যকাকু বললেন, “হ্যাঁ, ওঁরা তো আছেনই। ওঁরা ছাড়াও এমন কয়েকজন নারী গুপ্তচর আছেন যাদের জীবন কাহিনি নিঃসন্দেহে চমক সৃষ্টিকারী।”

আরও কিছু গল্পের সুলুক পেয়ে আমি বলে উঠলাম, “বলো না, কাকু।”

সূর্যকাকু হেসে বললেন, “বলছি। তবে গলাটা বড্ড শুকিয়ে গেছে। আরেক কাপ আপনার হাতের স্পেশাল চা পেতে পারি, বৌদি?”

মা খুব লজ্জিত হয়েই বললেন, “এ মা, ছিঃ ছিঃ ঠাকুরপো, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। সেই তখন থেকে তোমায় বকিয়েই চলেছি আমরা। আমি এখনই চা বানিয়ে আনছি।” এই বলেই মা রান্না ঘরে চলে গেলেন।

বাবা এবার কাকুকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এইবার কতদিনের ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছ, সূর্য?”

কাকু বললেন, “ভেবেছিলাম আরও মাস খানেক এখানে থাকতে হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এবার কলকাতা ছাড়ার সময় হয়েছে।”

আমি দেখলাম বাবার চোখে কৌতূহলের চিহ্ন। জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে থাকতে হবে মানে?”

সূর্য কাকু বললেন, “মানে, এবার কলকাতায় ঠিক ছুটি কাটাতে আসিনি। এসেছিলাম একটা বিশেষ কাজ নিয়েই। আজ সেই কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। এইবার যেকোনও সময় উপরমহল থেকে তলব এলেই বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে কলকাতাকে বিদায় জানাতে হবে।”

বাবা অবাক হয়ে বললেন, “সে কি! এই তো দিন সাতেক হল এলে, এর মধ্যেই চলে যেতে হবে? আর আজ কোনও কাজের সমাপ্তি কথা বলছ?”

সূর্যকাকু এবার হাতজোড় করে বললেন, “দোহাই দাদা, আর কোনও প্রশ্ন করবেন না। আপনি তো জানেনই আমি এক্ষেত্রে উত্তর দিতে অপারগ। শুধু এটুকু বলতে পারি যে কলকাতার মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে সেই কাজ সেরে সোজা আপনাদের বাড়ি চলে এলাম একটু গল্প করব বলে। আপনাদের মতো নিপাট ভালো মানুষ আজকাল তো বড়ো একটা দেখে যায় না…”

সূর্যকাকু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। মা এর মধ্যেই একটা বড়ো ট্রেতে করে চা আর ফিশ ফ্রাই নিয়ে ঘরে এলেন। বললেন, “আজ রাতে কিন্তু আমাদের এখানেই দুটি খেয়ে যাবে, ঠাকুরপো।”

সূর্যকাকুর পেটানো চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে উনি বেশ ভোজনরসিক। মার কথা শুনেই উনি কৌতুক করে বলে উঠলেন, “বেশ বেশ, তাই হবে বৌদি। এসব ব্যাপারে আমি আবার কাউকে না করতে পারি না।”

সূর্যকাকু একবার চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, “এবার ফেরা যাক সেই প্রমিলা গুপ্তচরদের প্রসঙ্গে যাদের মধ্যে কেউ ছিলেন ক্রীতদাসী, কেউ নার্স, কেউ রানি আবার কেউ বা রাজকুমারী।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “রানি আর রাজকুমারীও গুপ্তচর হতে পারে?”

সূর্যকাকু বললেন, “হ্যাঁ, কেন পারবে না? গুপ্তচর হবার জন্য প্রয়োজন দেশের প্রতি ভালোবাসা, অসীম সাহস ও সহ্যশক্তি, ক্ষুরধার বুদ্ধি আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব।”

সূর্যকাকু বললেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের নারী গুপ্তচরদের তালিকায় যে পঞ্চকন্যার নাম প্রথম সারিতে উঠে আসে তাদের মধ্যেও ওপরের দিকে থাকবে নূর এনায়েত খানের নাম। ভারতীয় বংশোদ্ভূত দ্য প্রিন্সেস স্পাই নূর এনায়েত খান ১৯১৪ সালে রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ভারতের মহীশূরের শাসক টিপু সুলতানের সরাসরি বংশধর ছিলেন নূর এনায়েত খান। তাঁর বাবা হজরত এনায়েত খান ছিলেন টিপু সুলতানের প্রপৌত্র, আর মা ছিলেন আমেরিকান পন্ডিত পিয়ার বার্ণাডের আপন বোন। তিনি পিরানি আমেনা বেগম নাম নিয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন হজরত এনায়েত খানের সঙ্গে।

“রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করলেও নূর বেড়ে ওঠেন যুক্তরাজ্য। ফ্রান্সের সোরবোনে শিশু মনোবিজ্ঞান ও প্যারিস কনজারভেটরিতে সঙ্গীত শেখেন নূর। পরবর্তীকালে সুফিবাদ নিয়ে গবেষণাও করেন নূর। তাঁর জীবন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তাঁর চরিত্রের একটা অদ্ভুত বৈপরীত্য গবেষকদের দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি ছিলেন ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী। পন্ডিত জহরলাল নেহেরু ও মহাত্মা গান্ধীর ভীষণ ভক্ত ছিলেন এই নারী।

“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর পূর্বে নূরের জীবন ছিল কবিতা ও শিশুদের উপযোগী গল্প লেখার মধ্যে আবদ্ধ। ১৯৩৯ সালে তাঁর রচিত শিশুদের উপযোগী গল্পের বই Twenty Jatak Tales প্রকাশিত হয়।

“ফ্রান্স তার দ্বিতীয় নিবাস হলেও নূর ফ্রান্সকে মাতৃভূমির তো ভালোবাসতেন। ১৯৪০ সালের ফ্রান্স সরকার জার্মানির কাছে আত্মসমর্পণের ঠিক আগে নৌকাযোগে মা ও বোনকে নিয়ে নূর পালিয়ে যান যুক্তরাজ্যে। সেখানে যাওয়ার পরপরই তিনি উইমেন্স অক্সিলিয়ারি এয়ারফোর্সে যোগ দেন। সেখানে ওয়ারলেস অপারেটর হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় নূরকে। এরপর খুব তাড়াতাড়ি নজর কাড়েন এসওই-র।”

এই সময় মা প্রশ্ন করলেন, “এসওই কী?”

সূর্যকাকু উত্তরে বলেন, “এসওই হল স্পেশাল অপারেশন এক্সিকিউটিভ। অবশেষে ১৯৪২ সালে নোরা বেকার নাম নিয়ে নূর এনায়েত খান যোগ দেন যুক্তরাজ্যের অভিজাত গোয়েন্দা বাহিনীতে। এর পরপরই এসওই-র হয়ে ফ্রান্সে যান নূর। সেখানে তাঁর সাংকেতিক নাম হয় ‘মেডিলিন’।” সূর্য কাকু আরও বলেন, “সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় কী জানেন, বৌদি? নূরের নম্র ভদ্র ও কোমল ব্যবহারের জন্য তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও ধারণা হয়েছিল, যে নূর স্পাই হিসেবেও খুব একটা ভালো হবেন না। কিন্তু দেশের প্রয়োজনে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেরি করেননি নূর।

“নাৎসি কবলিত প্যারিসে যখন সব ওয়্যারলেস অপারেটরদের একের পর এক গ্রেপ্তার করা হয়, তখন নূরই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি জার্মানদের সঙ্গে মিশে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে লন্ডনের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে যান। বিভিন্ন পার্টিতে, সমাবেশে নূর এতটাই সাবলীল ছিলেন যে জার্মানরা কোনোভাবেই বুঝতে পারেনি এক গুপ্তচরকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে তারা। একজন নারী যে কতখানি সাহসী হতে পারেন তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ নূর এনায়েত খান।

“তবে জার্মানরা একসময় তাঁর আসল পরিচয় জানতে পেরে তাঁকে গ্রেফতার করে। তাদের কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হয়েছিলেন নূর অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে। একটি তথ্যও তাঁর কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি নিষ্ঠুর জার্মানরা। কিন্তু অতি সর্তকতাবশত লন্ডনে পাঠানো প্রতিটি ম্যাসেজের একটি প্রতিলিপি নূর লিখে রেখেছিলেন একটা নোটবুকে। তিনি ভেবেছিলেন, কোনও কারণে যদি আগের মেসেজটি না পৌঁছায় তবে পুনরায় তা পাঠাতে নোটবুকটা তাকে সহায়তা করবে। কিন্তু নোটবুকটি জার্মানদের হাতে কোনোভাবে চলে যায়। এর ফলে জার্মানরা বন্দি নূরকে দিয়ে বলপূর্বক একটি মেসেজ পাঠায় লন্ডনে, যার ফলে ধরা পড়ে মিত্রশক্তির তিন সদস্য। কয়েদখানায় বন্দি নূরের ওপর চলে অমানুষিক অত্যাচার। একসময়ের কোমল নূর তখন এতটাই কঠোরভাবে সব মুখ বুঝে সহ্য করেন যে নাৎসিরা তাকে ‘ভয়ংকর বিপদজনক’ শ্রেণীভুক্ত করে।

“হাতে পায়ে বেড়ি পরানো নূরের ওপর চলে পাশবিক অত্যাচার। নূর সহ আরও তিনজনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ডাকাও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। জার্মানরা এতটাই সতর্কতার সঙ্গে তাঁকে জার্মানিতে পাঠায় যে ইন্টেলিজেন্সের তালিকায় তাঁর ফাইলের উপরে Nacht und Nebel (Condemned to Disappearance without trace ) সিল দেওয়া হয়।

“কুখ্যাত ডাকাও ক্যাম্পের নির্জন সেলে নূরের ওপর চলে অমানুষিক মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার। বর্বরতম মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত সত্ত্বেও স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহা তাঁকে বিন্দুমাত্র ভেঙে পড়তে দেয়নি। ১৯৪৪ সালে মৃত্যুদণ্ডের দু’মাস আগেও আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসে নিজের খাবার পাত্রে আঁচড় কেটে লিখে দেন, ‘ভিভ ল্য কাত্র জুইয়ে’ (৪ জুলাই দীর্ঘজীবী হোক)। আর চৌদ্দই জুলাই ফ্রান্সের ‘বাস্তিল দিবসে’ লেখেন ‘ভিভ ল্য ফ্রঁস লিব্রে’ অর্থাৎ স্বাধীন ফ্রান্স দীর্ঘজীবী হোক। সেই আঁচড় কাটা পাত্র অন্যান্য বন্দীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় স্বাধীনতার উন্মাদনা। ১৯৪৪ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর তাঁর উপর নেমে আসে নাৎসি বর্বরতা।

“১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ সালে ভোরবেলা ওই চারজন স্পাইকে মাথার পিছনে গুলি করে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘লিবার্তো’ বা স্বাধীনতা। হত্যার সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁদের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। মাত্র তিরিশ বছর বয়সে চলে গেল একটা তাজাপ্রাণ।

“১৯৪৯ সালে নূর মরণোত্তর George Cross সম্মানে সম্মানিত হন। পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত মাত্র চারজন নারী এই সম্মান পেয়েছেন। এর সঙ্গে সঙ্গে Croix de Guerra , Mentioned in Dispatches সম্মান ও প্রদান করা হয় তাঁকে। ২০১২ সালে তাঁর সম্মানে লন্ডন স্কোয়ার গার্ডেনসে নূরের একটি আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করা হয়।”

ঠিক এই সময়ই সূর্যকাকুর সেল ফোনটা বেজে উঠল। লক্ষ করলাম, ফোনের অপর প্রান্তের কথা খুব মন দিয়ে শুনে সূর্যকাকু শুধু ‘ইয়েস স্যার’ বললেন।

ফোনালাপ শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই সূর্যকাকু তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “সরি বৌদি, আজ আর আপনার হাতের রান্না খাওয়া হল না, ডাক এসেছে দিল্লি থেকে। এখনই বাড়ি ফিরে সব গুছিয়ে এয়ারপোর্টে ছুটতে হবে।” একথা বলেই মানি ব্যাগ থেকে একটা দু’হাজার টাকার নোট আমার হাতে দিয়ে বললেন, “এবার কাজের চাপে কিছু কিনে দিতে পারলাম না প্রিন্সেস, তুমি বরং তোমার পছন্দের কিছু কিনে নিও।”

“আসি দাদা।” বলে বাবাকে প্রণাম করার উদ্দেশ্যে খানিকটা ঝুঁকতেই ওর বুক পকেট থেকে পাসপোর্টের মতো কিছু একটা কার্পেটের ওপরে পড়তে দেখে আমিও খুব স্বাভাবিকভাবেই সূর্যকাকুকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে সেটাকে তোলার জন্য নিচু হয়ে হাত বাড়াতেই সূর্যকাকু বিদ্যুৎগতিতে সেটি তুলে নিয়ে পকেটস্থ করার সময় আমায় ‘থ্যাঙ্কস’ বললেন। কিন্তু ততক্ষণে আমার চোখে পড়ে গিয়েছে যা পড়ার—দুটি ধানের শীষের মাঝে অশোক স্তম্ভের নিচে লেখা ‘সত্যমেব জয়তে’ আর উপরে লেখা RAW।

সূর্যকাকু আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরও উদ্দেশ্যহীনভাবে আমি বসে রইলাম বাইরের ঘরে। আমার চিন্তাপ্রক্রিয়া বুঝি স্তব্ধ হয়ে গেছে। তবে কি সূর্যকাকুও…

সারা সন্ধে বাড়িতে একবারও টেলিভিশন চলেনি এমন ঘটনা বড়ো একটা দেখা যায় না। মা বিভিন্ন টেলি-সিরিয়াল দেখেন আর বাবা নিউজ চ্যানেলগুলো দেখেন রাতের দিকে। কিন্তু আজ সূর্যকাকু আসায় সারা সন্ধ্যা গল্পে-গল্পেই কেটে গেল। এইবার বাবা একটা বাংলা নিউজ চ্যানেল খুলে বসলেন টিভির সামনে। সেখানে সংবাদ পাঠিকা বলে চলেছেন কীভাবে কলকাতা মেটিয়াবুরুজ এলাকার একটি বাড়ি থেকে তিন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয় আজ। তিনি এও বলেন, বাস্তবের এই ঘটনা যেকোনও হলিউড অ্যাকশন মুভিকেও হার মানিয়ে দিয়েছে। অতি সাধারণ সাদা পোশাকের কেন্দ্রীয় বাহিনীর সশস্ত্র জওয়ানদের একটি দল প্রথমে পুরো এলাকাকে ঘিরে ফেলে, তারপর নাটকীয়ভাবেই যবনিকার পতন ঘটিয়ে গ্রেপ্তার করেন ওই তিন ভিনদেশি আতঙ্কবাদীকে। সংবাদ পাঠিকা জানান, ছোট্ট এক কামরার ঘরে মিলেছে অতি আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও আরডিএক্স। এই পুরো ঘটনার সাফল্যের মূলে রয়েছেন র-এর এক এজেন্ট, যার কাছ থেকে এদের সন্ধান পাওয়া যায় এবং যিনি গত সাতদিন ধরে এক ভিখারির ছদ্মবেশে এই তিন আতঙ্কবাদীর গতিবিধির উপর নজর রাখছিলেন এবং তাদের খবর সরবরাহ করে চলেছিলেন সেনাবাহিনীকে। এমনকি আজও তিনি তাঁর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন আতঙ্কবাদীদের ডেরায়। চারতলার ছাদ থেকে দড়ি বেয়ে নেমে এসেছিলেন তিনি দোতলার বারান্দায়, সঙ্গে আরও তিনজন সেনা অফিসার। বারান্দা দিয়ে ঘরে ঢুকেই জঙ্গিদের একজনের পায়ে ও আরেকজনের হাতে গুলি করা হয়। আর একজনকে জাপটে ধরে ফেলে দড়ি দিয়ে দ্রুত বেঁধে ফেলা হয় তার দুই হাত ও পা। এর মধ্যে এক জওয়ান ঘরের বাইরে যাওয়ার দরজা খুলে দিলে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে বাইরে অপেক্ষারত বাকি জওয়ানরাও। ঘটনার আকস্মিকতায় সারা এলাকার মানুষ স্তব্ধ, বিস্মিত।

সংবাদ পাঠিকা আরও বলেন, পুরো ঘটনার কৃতিত্বই দেওয়া যেতে পারে র-এর সেই এজেন্টকে এবং তাঁকে সম্মান জানাতেই এই অভিযানের নাম ‘Operation SUN’।

আমার কাছে এবার সূর্যের আলোর মতোই স্বচ্ছ হয়ে উঠল গোটা বিষয়। আমি অস্ফুটে বলে উঠলাম , “SUN, সূর্য, সূর্যকাকু!”

ছবিঃ সায়ন মজুমদার

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s