গল্প গোবরবাবুর আমসত্ত্ব হারুন অল গুপ্ত বসন্ত ২০২০

হারুন অল গুপ্তের আগের গল্প –মন্ত্র

টাপুর-টুপুর ঘুরুং-ঘুরুং—টাপুর-টুপুর ঘুরুং-ঘুরুং

শব্দটা কোনদিক থেকে আসছে দেখতে গিয়ে গোবরবাবু দিশেহারা হয়ে পড়ল। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ঘন জঙ্গলে টাপুর-টুপুর বাজনাটা বোধহয় বৃষ্টিরই। কিন্তু ঘুরুং-ঘুরুং?

হঠাৎ শব্দটা জোরসে বেজে ওঠায়, পিছনে তাকিয়ে পিলে চমকে গেল গোবরবাবুর। ওরেব্বাস, জঙ্গল ভাগ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বোল্ডারের মতো বিশাল এক জ্যান্ত হাতি! যেমন দাঁত, তেমনি কান, গায়ে জুতোর ব্রাশের মতো খাড়া খাড়া নীলচে লোম। সামনের দুটো পায়ে আবার ঘুঙুর বেঁধেছে। ঘুরুং-ঘুরুং আওয়াজটা ওই ঘুঙুরেরই। মুখ ঘুরিয়ে আঁতকে উঠে যেই না ছুটতে যাবে, অমনি যেন পা পিছলোল গোবরবাবু। ভিজে মাটিতে কিছুতেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, হাত-পায়ের সমস্ত জোর যেন নিঃশেষ। অথচ পালাতেই হবে বাঁচতে গেলে!

ঘুরুং-ঘুরুং শব্দটা এবার মাদলের মতো বেজে উঠল, আর হাতির তীব্র বৃংহণ ঘাড়ের পাশে এসে গোবরবাবুর কান ফাটিয়ে দিতে লাগল। অসহায়ভাবে সেদিকে তাকিয়ে গোবরবাবু দেখল, হাতির চোখদুটো কী অসম্ভব রকমের হিংস্র আর দাঁতগুলো যেন রক্তমাখা ভল্ল হয়ে তার দিকে ধেয়ে আসছে। শেষ মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে মনে হল চোখদুটো বড়ো চেনা। কার যেন, কার যেন চোখ, ভাবতে ভাবতেই হাতির মুখটা বদলে গিয়ে তার অফিসের বড়ো সাহেবের মুখ হয়ে গেল। চেহারাটা হাতিরই রইল, কিন্তু কোট-টাই পরা একটি পাহাড়ের বনবাদাড় ভেঙে দৌড়ে আসার শব্দে এক লহমায় আতঙ্কে চোখ বুঁজে ফেলল গোবরবাবু। বড়ো সাহেবের বীভৎস অট্টহাসি এবার পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে।

এপাশ ওপাশ কুঁকড়ে দুমড়ে, চোখ মেলতেই গোবরবাবু হাঁফ ছাড়ল। ওহ্‌! কী সাংঘাতিক স্বপ্ন! ঘামে ভিজে গেছে সমস্ত শরীর। ওপাশে বাবলাগাছের ফাঁক দিয়ে সকালের রোদ এসে পড়েছে গায়ের উপরে। ঘড়িতে সাতটা বাজে। চোখ বুজে গোবরবাবু আরও কিছুক্ষণ পড়ে রইল বিছানায়। স্বপ্নটা ভয়াল হলেও উপভোগ করতে লাগল তারিয়ে তারিয়ে। অন্যদিন হলে এতক্ষণে সে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। তারপর মুখ ধুয়ে পাশের পুকুরে দু-তিনখানা ডুব দিয়ে, পিসির হাতের গরম ভাত-ডাল-আলুসেদ্ধ খেয়ে অফিসের জন্য দৌড় লাগায়। তবে আজ কোনও তাড়া নেই; আজ কিছুতেই সে অফিসে যাবে না। কালও যাবে না, কোনোদিনই যাবে না আর।

মনটা তেতো হয়ে আছে। কাল থেকেই। অফিসে ওই বজ্জাত বড়ো সাহেব কাল তাকে যা অপমান করেছে বলার নয়। ঘাড়ধাক্কা দিতে শুধু বাকি রেখেছিল, তাও আবার সকলের সামনে! চাকরির নিকুচি করেছে! চাকরি সে আর করবেই না। পুকুরে মাছ আছে, চার বিঘে ধানি জমি আছে, চারটে হাঁস আছে, একটা গরু আছে আর বাড়ির লাগোয়া জমিতে টুকটাক শাকসবজি তো আছেই। খাইয়ের মধ্যে তো সে আর পিসি—দিব্যি চলে যাবে দু’জনার। নিকুচি করেছে চাকরির।

এমন সময় পিসি এল চা নিয়ে। বলল, “উঠতে এত দেরি করলি গোবরা, অফিসে যাবি নে নাকি?”

গোবরবাবু গম্ভীর মুখে বলল, “নাহ্‌।”

শুনে পিসি একগাল হাসল। বলল, “সেই ভালো। ঘরে শুয়ে বসে আরাম কর। রোজ রোজ অপিসে যাওয়ার যে কী দরকার আমি বুঝি না বাপু।” বলে পিসি চলে যাচ্ছিল। তারপর কী যেন মনে হতে গোবরবাবুর কাছ ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মিষ্টি করে বলল, “তা বলছিলাম কী গোবরা, অপিসে যখন যাচ্ছিসই না, আমার একটু উবগার কর না বাবা!”

গোবরবাবু চোখ কুঁচকে তাকাতেই পিসি বলল, “না না, তেমন কিছু বড়ো কাজ নয়। এই মানে, ক’টা আম চটকে থালায় একটু আমসত্ত্ব দিয়েছিলাম তো, তা ছাতে যখন রোদে দেব, তুই একটু বসে বসে পাহারা দিস না বাবা! জানিস তো কাক-চিলে ঠোকরায়, আর আমি এক খ্যানখ্যানে বুড়ি কতদিকে যাই!”

গোবরবাবু মনে মনে হাসল। বুড়ি মতলবটা ভালোই ফেঁদেছে।

লক্ষ্মীপুজোর খই-মুড়ির মোয়া আর এক গ্লাস দুধ খেয়ে, হাতে একটা লম্বা প্যাঁকাটি আর বগলে ত্রৈলোক্যনাথের ভূতের গল্পের বই নিয়ে চিলেছাদের ছায়ায় এসে বসল গোবরবাবু।

পিসি আমসত্ত্বের বিরাট থালাটা সামনের ঝকঝকে রোদে নামিয়ে দিয়ে বলে গেল, “দেখিস বাবা, ঘুমিয়ে-টুমিয়ে পড়িস নে যেন আবার।”

এমন সময় একটা দাঁড়কাক ওদিকের নিমগাছের ডাল থেকে ক্ব-ক্ব করে ডেকে উঠতেই পিসি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে প্রথমে ‘দূর হ, দূর হ’, তারপর ‘রামনাম বল, রামনাম বল’ বলতে বলতে নিচে নেমে গেল।

গোবরবাবু দাঁড়কাকটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল। বিনা কারণে কেমন গালাগাল খেতে হল বেচারিকে। ঠিক যেমন বড়ো সাহেব কালকে ওকে গালাগাল দিল। দাঁড়কাকটাকে তবুও পিসি পরে আদর করে রামনাম বলতে বলল, কিন্তু তার বেলা? উলটে সকাল সকাল একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখতে হল। যাক গে, চাকরি যখন করবেই না, তখন আর এতশত ভেবে কী লাভ! তার চেয়ে বরং একটা দু’ভাঁজ করা শতরঞ্চি বিছিয়ে, চিলে ছাদের দরজার ফ্রেমে মাথার বালিশে হেলান দিয়ে বেশ জুত করে বসে গোবরবাবু ত্রৈলোক্যনাথের বইটা নিয়ে পড়ল।

কতবার যে পড়েছে বইখানা, পড়ে পড়ে আর আশ মেটে না। লুল্লু ভূতের ঠিকুজি-কুলুজি তার মুখস্থ হয়ে গেছে। থেকে থেকে বইটার পাতাগুলো হলদে—কবেকার বই! সারা জীবনে গল্পের বই বলতে গোবরবাবু ওই একখানাই পড়েছে, বারবার পড়েছে। এক্কেবারে নিজের বই কিনা!

সেই যখন ক্লাস সেভেনে পড়ত, দুম করে স্কুলের হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষায় এক্কেবারে সেকেন্ড হয়ে গেল। আগে আর কখনও হয়নি। স্কুলের সেকেন্ড পজিশনটা বাঁধা ছিল দেবু আচার্য্যির। তো সে ব্যাটা সেবার পা ভেঙে কাহিল। ফাঁকতালে গোবরচন্দ্র যে কী করে সেকেন্ড হয়ে গেল! ক্লাস টিচার শিশিরবাবু, যিনি কিনা অঙ্ক না পারার জন্যে নিয়মিত মাথার পেছনের চুলে খামচা মেরে পাঁচ-ছ’টা চুল তুলে দিতেন, আর চুলের তেল হাতে লাগায় আবার তারই জামায় তেলো হাতটা মুছে নিতেন, বিস্ময়ে একেবারে হাঁ হয়ে গেলেন। দিন দুয়েক পরে ওই ত্রৈলোক্যনাথের ভূতের গল্পটা নিয়ে এসে বললেন, “এটা তোর। তুই সেকেন্ড হয়ে একটা আশ্চর্য কাজ করেছিস।”

গোবরবাবুর জীবনে আশ্চর্য কাণ্ড আর ঘটেনি। কিন্তু বইটা তার আজীবনের বন্ধু হয়ে গেছে। যদিও গোবরবাবুর দৃঢ় বিশ্বাস, তার জীবনে আশ্চর্য কাণ্ড একটা ঘটবেই।

এলোমেলোভাবে বইটার পাতা নাড়তে নাড়তে আমসত্ত্বর থালার দিকে তাকিয়ে ছিল গোবরবাবু। মিঠি মিঠি হাওয়া দিচ্ছে। ওপাশের পুকুরপাড়ের খেজুরগাছে বসে একটা ডাহুক পাখি অনবরত ক্যাঁ ক্যাঁ করে চলেছে। একটা কাক পায়ে পায়ে হেঁটে থালার থালার কাছাকাছি এসে আবার ভয়ে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। গোবরবাবুকে প্যাঁকাটিটাও নাড়তে হচ্ছে না। বেশ মজা লাগছিল। একটু আরাম করে টানটান হয়ে পাদুটো আমসত্ত্বের থালার কাছাকাছি বিছিয়ে দিতেই কাকটা উড়ে পালিয়ে গেল।

বইটা বুকের কাছে খোলা, একটা পাতাও পড়া হয়নি। নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ বুজল গোবরবাবু। আর চোখ বুজতেই টুকরো টুকরো স্বপ্ন যেন ভিড় করে এল। কোনওটাই তেমন বোঝা যাচ্ছে না, আবার ভালোও লাগছে।

হঠাৎ টং করে একটা ধাতব আওয়াজ আর গায়ে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কিছু লাগতে ধড়মড় করে উঠে বসল গোবরবাবু। দেখেছ! আমসত্ত্বের থালায় এত্ত বড়ো একটা পাথর! চারদিকে আমের মণ্ড ছিটকেছে, তার গায়েও লেগেছে।

নিশ্চয়ই পাড়ার ওই বদ ছেলেগুলোর কাজ, আম পাড়তে গিয়ে ঢিল ছুড়েছে!

“অ্যায়, কে রে? অ্যায়, কে রে?” করতে করতে দৌড়ে ছাতের পাঁচিলের দিকে গেল গোবরবাবু। কিন্তু কোথায় কে? আমতলা শুনশান। জনপ্রাণীও নেই। আশ্চর্য হল গোবরবাবু। ছোঁড়াগুলো নিশ্চয়ই রকেটের গতিতে দৌড়য় না। কারণ, এত বড়ো বাগানটা পার করতেও তো কিছু সময় লাগে! অথচ কাউকে দেখা গেল না!

ভাবতে বসল গোবরবাবু। তার মানে পাড়ার বদ ছোঁড়াগুলো পাথর ছোড়েনি। তাহলে কে ছুড়ল?

কারণ খুঁজে না পেয়ে একটু ভয় ভয় করতে লাগল গোবরবাবুর। ত্রৈলোক্যনাথ বলেছেন, জল জমে যেমন বরফ হয়, অন্ধকার জমে তেমনি ভূত হয়। এতকাল এই কথাটাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করত গোবরবাবু। অন্ধকারে তার ভারি ভয়। কিন্তু এই কটকটে আলোয় চারদিকে তাকাতে তাকাতে সন্দিহান গোবরবাবুর মনে হল, আলো জমে ভূত হলেই বা আটকাচ্ছে কে!

যেই ভাবা, অমনি মন বলল, একছুটে নিচে যাই। আর নামতে গিয়েই খামোখা চোখটা আটকে গেল আমসত্ত্বের থালায়। পাথরটা আমের রসে প্রায় অর্ধেকটা ডুবে আছে, আর তাকে ঘিরে নিরন্তর বুদবুদ উঠছে অপ্রস্তুত আমসত্ত্বে। প্রথম যখন দেখেছিল, পাথরটার রঙ্গ ছিল বাদামি, কিন্তু এখন কেমন আশ্চর্য সবুজ আভা ছড়াচ্ছে। এ তো ভূতপ্রেতের কাণ্ড নয়! নিশ্চয়ই কোনও রহস্য আছে এর পেছনে। গোবরবাবু চারদিক থেকে সাহস জোগাড় করে একদম ঝুঁকে পড়ল থালার উপরে। ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা দরকার। কিন্তু গবেষণার কপাল কি আর গোবরবাবুর! মনোযোগটা সবে ঘন হয়েছে, অমনি নিচ থেকে পিসির গলা শোনা গেল। “একটা লোক তোকে ডাকছে রে গোবরা, নিচে আয় বাবা।” সিঁড়িতে পিসির উঠে আসার থপ থপ শব্দটা সাথে সাথে এগিয়ে আসছে।

এ তো মহা কেলেঙ্কারি! আমসত্ত্বে পাথর দেখলে তো আর রক্ষে নেই। অমনি শান্ত পিসি তখন সাক্ষাৎ রক্ষেকালী হয়ে দাঁড়াবে। ভাবতে আর সময় নিল না গোবরবাবু। এক লহমায় পাথরটা তুলে ছুড়ে ফেলে দিল ছাতের কোনায়। তারপর পিসির পাশ কাটিয়ে তড়িঘড়ি নিচে নেমে লম্বা হাঁপ। না, হাঁপ ছাড়তে পারল না। কারণ, ‘একটা লোক’ বলে পিসি যার কথা বলল, সে মামুলি লোক-টোক নয়, একেবারে সাক্ষাৎ হাতকাটা দোপেবাবু। লম্বা জুলপি, ঝোলা গোঁফ, লিকলিকে গলায় মোটা সোনার চেন আর হাসল যখন, হাঙরের মতো দাঁতের পাটিও দেখা গেল।

ওকে দেখেই দম আটকে গেছে গোবরবাবুর। শুনেছে হাতকাটা দোপেবাবু নাকি কচু শাক কাটার মতোই কুচ করে মানুষের গলার নলি কেটে দেয়। পাটকাঠির মতো ভেঙে ফেলে জেলখানার ইয়া ইয়া গরাদ! এই লিকপিকে চেহারাতেই যদি এত খেল-কুঁদ দেখাতে পারে, তো তার মতো গোবরগুর্বো লোকের কী দশা করবে সহজেই অনুমেয়। নাহ্‌, আজ আর নিস্তার নেই গোবরবাবুর। এক্ষুণি বুঝি ছুরি-কাঁচি, পিস্তল-টিস্তল বার করবে দোপে।

কিন্তু হাতকাটা দোপে দিব্যি অভয়-শান্ত হাসি দিয়ে বলল, “নমস্কার গোবরবাবু, পাড়ায় মহাবিপদ পরিত্রাণ যজ্ঞ হচ্ছে জানেন তো! অবিশ্যি নিশ্চয়ই জানবেন, আপনাদের মতো জ্ঞানীগুণী লোক না জানলে আর কে জানবে?”

আকাশ থেকে পড়ল গোবরবাবু। ভেঙে ভেঙে উচ্চারণ করল, “মহা–বিপদ–পরিত্রাণ–”

“হ্যাঁ, যজ্ঞ।” পাদপূরণ করল দোপে।

গোবরবাবু এই মুহূর্তে নিজের মহাবিপদ থেকে পরিত্রাণ হবে কি না ভাবছিল। বলল, “আশ্চর্য! আমি তো কিছুই জানি না।”

দোপে আরও অবাক। বলল, “সে কী! আপনি গ্রহরাজের ভেঙে পড়ার খবর জানেন না? এই যে কাগজে এত হইচই হচ্ছে, পৃথিবীটা যেকোনও মুহূর্তে পুটুস করে মরে যেতে পারে, আপনি জানেন না?”

খবরের কাগজ পড়তে ভালো লাগে না গোবরবাবুর। সেই কথাই বলল হাতকাটা দোপেকে।

হাতকাটা দোপে সংক্ষেপে বৃহস্পতি গ্রহে ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, আর আর কোন সব অগ্রহ-কুগ্রহর সঙ্গে ঠোকাঠুকির কাহিনি বলে বলল, “এই মহাবিপদ থেকে পৃথিবীকে, মানে আপনাকেও রক্ষা করতে এই যজ্ঞের আয়োজন করছি আমরা। কিছু ডোনেশন লাগবে স্যার।”

চাঁদার বিলখানা দোপের হাতে বাড়িয়ে ধরা। আগে থেকেই সেখানে টাকার অঙ্ক বসানো। গোবরবাবুর মাথা ঘুরতে লাগল, কথা আটকে গেল। বলল, “অ্যা–অ্যা–অ্যা–অ্যাক হাজার–টাকা!”

দোপেবাবু মধুর হেসে বলল, “বেশি বললাম নাকি? আচ্ছা ন’শো এক টাকাই ফাইনাল।”

শেষ কথাগুলোর এতো হুকুমজোর ছিল যে, গোবরবাবুর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “যে আজ্ঞে।”

ন’শো টাকার বিনিময়ে কী করে অমূল্য জীবন রক্ষা পেল, সেকথা ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই পিসির উল্লাস শুনতে পেল গোবরবাবু। তাকে দেখে একেবারে আহ্লাদে আটখানা হল পিসি। “দেখেছিস গোবরা, আজকাল রোদের কেমন তেজ বেড়েছে! দেড়-দু’ঘণ্টাতেই টাইট হয়ে গেছে আমসত্ত্ব। আর যা রঙ আর ঘেরান ছেড়েছে না! এই না, খেয়ে দেখ এট্টুখানি।” বলে খানিকটা আমসত্ত্ব একেবারে ঠেসে ঢুকিয়ে দিলেন গোবরবাবুর মুখে।

গোবরবাবু আতঙ্কে কেঁপে উঠল। হয়ে গেল এবার। পৃথিবীর শেষ দিন হোক বা না হোক, তার যে শেষ দিন সমাগত, সন্দেহ নেই। পিসি তো জানে না, কোন হতচ্ছাড়া পাথরের গুণে দেড় ঘণ্টায় আমসত্ত্ব প্রস্তুত হয়েছে। আর কী কী বিষক্রিয়া হয়েছে ওই বুড়বুড়ি কেটে, তাই বা পিসি জানবে কোত্থেকে!

পিসিকে এখন বোঝায় কী করে? আমসত্ত্ব পুরে পিসি যে মুখখানা একেবারে বন্ধই করে দিয়েছে! তার উপর সেই বন্ধ মুখে, জিভে স্বাদ যা লাগছে, আর গন্ধখানা যেমন মস্তিষ্কে বারবার মধুর প্রলেপ দিচ্ছে, গোবরবাবুর মুহূর্তে মনে হল, জীবনে এমন আমসত্ত্ব কখনও খায়নি। এখন মুখ থেকে ফেলে দেওয়া তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন।

নাহ্‌, যজ্ঞের জন্যে একশো টাকা কমানোটা মনে হচ্ছে ঠিক কাজ হয়নি। ঠাকুরদেবতার ব্যাপার, পুরো হাজার দিলে নিশ্চয়ই এরকম প্রাণসংশয় হত না। আমসত্ত্বে গ্রহরাজের টুকরো পড়েছে নির্ঘাত। অগত্যা গোবরবাবু আমসত্ত্বের টুকরোটা তারিয়ে খেতে খেতে দূর আকাশের দিকে চেয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় রইল।

পিসি আমসত্ত্বের থালা নিয়ে চলে গেছে। গোবরবাবুও নীল আকাশের দিকে উদাসভাবে চেয়ে ছিল। অনেকক্ষণ চেয়ে থাকার পর নিজের কড়ে আঙুলে কামড় দিয়ে গোবরবাবু টের পাল সে রীতিমতন জ্যান্তই আছে। পেট-টেট ফোলেনি, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলাও বেরোচ্ছে না। বরং ওই সুদূর নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভীষণ ভালো লাগছে। শরীর জুড়ে অদ্ভুত আরাম। ওই তো ঝকঝক করছে সূর্যদেব। তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতেও চোখে কোনও কষ্ট হচ্ছে না। অনেকরকম রঙের বিস্ফোরণ দেখতে পাচ্ছে সূর্যের শরীর জুড়ে।

মুহূর্তে সূর্যের রং কেমন বাদামি হয়ে গেল। হঠাৎ সমস্ত আকাশটায় যেন আলোড়ন উঠেছে। অসংখ্য ভাঁজে কুঁকড়ে দুমড়ে ক্রমশ ছোটো হচ্ছে আকাশ। গোবরবাবু চারপাশে তাকিয়ে পরিচিত কোনও কিছুই আর দেখতে পেল না। কোথায় সেই নিমগাছ, কোথায়ই বা তাদের চির চেনা দোতলার ছাদ! মাথার উপরে চারধারে কেবল দলা পাকানো আকাশ। ছোটো হতে হতে অবশেষে এত্তটুকু একটা কালো বিন্দুর আকার নিল। তারপর সেই টিপের মতো বিন্দুকে শীর্ষ ধরে একটা কালো অন্ধকার, সানাইয়ের চোঙার আকার নিয়ে নেমে এল গোবরবাবুর উপরে। তাকে আর হাঁটতে হল না, ভেসেই হারিয়ে গেল অন্ধকার চোঙার অপার গহিন পথে।

তারপর ওই অন্ধকার চোঙের মধ্যে দিয়ে কোথায় পৌঁছল কে জানে! ক’টা মাত্র মুহূর্ত, কত কোটি তারার ঝাঁকের মধ্যে দিয়ে হল সে ভ্রমণ। মোমবাতির শিখার মধ্যে দিয়ে হাত চালালে যেমন ছ্যাঁকা লাগে না, অসম্ভব গতিতে একেকটা আগুনের পিণ্ডর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সামান্য উত্তাপই সে টের পেয়েছিল। শেষপর্যন্ত ওই কালো গ্রহের পিঠ, আগাগোড়া কালো রঙের কাদা, কোনও গন্ধ নেই।

নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখল গোবরবাবু। আশ্চর্য! কোনও অনুভূতিই হচ্ছে না! আরও অবাক হয়ে গেল, যখন দেখল, তার বুকের হাপরখানা যেন বন্ধ হয়ে আছে। কোনও ওঠানামাই নেই। অর্থাৎ শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ। চমকে উঠে বাঁহাতের কবজি চেপে ধরল দু’আঙুলে। নাহ্‌!

এইবার ভীষণ ভয় পেয়ে গেল গোবরবাবু। তবে কি তার মৃত্যুই হল? এই যে, জীবনের লক্ষণ বলে যা যা সে জানত, তা তো শরীরে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তবে কি এটা শরীরই নয়, নিছক একটা আত্মা? আর এই কালো গ্রহ! মুনি-ঋষিরা একেই কি নরক বলত সে যুগে? হায় রে! পুরাণ-টুরাণ যে কোনও কালেই পড়া হয়নি। এর তার মুখে যতটুকু শুনেছে। নইলে নরকের চেহারা সম্বন্ধে পরিষ্কার একটা ধারণা অন্তত থাকত।

মরেই গেছে ধরে নিয়ে এদিক সেদিক চাইল গোবরবাবু। নরকের দু-চারজন পুরনো বাসিন্দাকে যদি দেখা যায়। তাঁরা অবশ্য আত্মাই হবেন। তবে এখন আর তার ভূতে ভয় কীসে? সাড়ই নেই, যে গলা টিপলে লাগবে। শ্বাসই পড়ে না তো আবার দম আটকানো!

কিন্তু নরকের বাসিন্দারা বোধহয় তেমন আলাপী নয়, বা নতুন লোককে চট করে মেনে নিতে চায় না। কাজেই চোখজোড়া এদিক ওদিক ঘুরিয়েও কারোর দেখা পেল না গোবরবাবু।

মাথার উপরে নিকষকালো আকাশে সূর্যের চেয়েও দশগুণ বড়ো মাপের একটা নক্ষত্র। তার মানে নরকে এখন দিন। কিন্তু চারপাশে নিঃসীম অন্ধকার। গোবরবাবু সেই অন্ধকারে হেঁটেই চলেছে, হেঁটেই চলেছে। ভয়ও হচ্ছে না, পিসির কথা মনেও পড়ছে না। কোথায় সেই বুনো হাতির মতো বড়োবাবু, কোথায়ই বা হাতকাটা দোপেবাবুর ধারালো দাঁত। গোবরবাবুর একটাই ভাবনা, আরও একটু এগিয়ে দেখি কী আছে ওই অন্ধকারের ওদিকে। খিদে নেই, তেষ্টা নেই, গোবরবাবু হেঁটেই চলেছে।

হঠাৎ মাথার উপর নক্ষত্রটা ঘোলাটে হয়ে গেল। বহুদূর থেকে যেন অভ্রকুচির মতো তারা বৃষ্টি হচ্ছে, দূর প্রান্তের তারারা যেন পরস্পরের কাছে চলে আসছে দূরন্ত বেগে। গোবরবাবুর ভয় হল এবার, যদি অসংখ্য তারা পরস্পরের গায়ে ধাক্কা খায়! কী হবে, কী হবে তখন!

“অ গোবরা, ধ্যান কচ্চিস নাকি! বাক্যিহারা হয়ে গেলি যে!”

পিসির ধাক্কায় ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়াল গোবরবাবু। এই তো তাদের ছাদ, ওই তো নিমগাছ, সেখানে কাকটা এখনও কা-কা করছে। তবে? পিসির হাতে আমের মণ্ড বিছানো থালা, আগেরটার চেয়েও বড়ো। তার মানে আমসত্ত্বের দ্রুত প্রস্তুতি, পিসিকে যারপরনাই বেপরোয়া করেছে। অর্থাৎ আগের থালাটা স্বপ্ন নয়। তবুও যাচাই করতে বলল, “পিসি, এখন থালাটা যে আনলে বড়ো! এই রোদে আমসত্ত্ব তৈরি হবে?”

পিসি বলল, “হবে না মানে? তুই শুধু একটা পর্যন্ত কাক তাড়িয়ে যা, তারপর দেখ না কী হয়! এমন আশ্চর্য আমসত্ত্ব আমি কখনও খাইনি।”

পিসি চলে গেল থুপথুপিয়ে।

একলাফে উঠে পড়ল গোবরবাবু। ধীরপায়ে হেঁটে গেল ছাদের পাঁচিলের কোনায়। নিচু হয়ে টবের তুলসীগাছটার পিছনে হাত বাড়াতেই পেয়ে গেল পাথরখানা। আমের রসের চিহ্নও নেই পাথরের গায়ে। সেই বাদামি রঙ, যেন কিছুই হয়নি। শুধু একটু ভারী ভারী ঠেকল যা।

মুচকি হাসি খেলে গেল গোবরবাবুর মুখে। বাজিয়ে দেখা যাক ভেবে ঝনাৎ করে পাথরটা আমসত্ত্বের থালার মাঝখানে বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিক! সবজেটে ভাব চলে এল পাথরের গায়ে, আর তার সঙ্গে বুড়বুড়ি।

কাজ হয়ে যাবে নিশ্চয়ই। এক ঝটকায় পাথরটা উঠিয়ে নিল গোবরবাবু। এবার আর ফেলল না। থালার মাঝখানে অপসারিত আমের মণ্ড ধীরে ধীরে পূর্ণ করে ফেলল শূ্ন্যস্থান। তারপর রঙ বদলাতে লাগল। মুচকি হাসিটা এবারে চওড়া হল গোবরবাবুর। নিকুচি করেছে চাকরির। মালদায় গিয়ে এবারে গোটা একখানা আমের বাগানই লিজ নিয়ে নেবে সে। ট্রাকভর্তি আম আসবে। বড়ো বড়ো বারকোশে সার দিয়ে ছাদের উপর ঢালা হবে আমের মণ্ড। তৈরি হবে আমসত্ত্ব, অ্যাত্তো অ্যাত্তো। গোবরবাবু শুধু একবার করে ম্যাজিক পাথর ছুঁইয়ে দেবে তাতে।

তারপর? তারপর স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় গোবরবাবু্র আমসত্ত্বের নাম দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে, রফতানি হবে জাহাজ ভরে ভরে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে প্রণাম করল গোবরবাবু, জয় বাবা গ্রহরাজ, ভেঙে পড়ো, আরও খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙে পড়ো তুমি! কোনও ক্ষতি হবে না এ পৃথিবীর।

ছবিঃ জয়ন্ত বিশ্বাস

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে