শুভময় মিশ্রের আগের গল্প– দুই বুড়ির গল্প , দূর আকাশের দোসর, হরেনদাদুর অঙ্ক, বিল্বমঙ্গল, উচ্ছের ভু-গোলমাল
বাড়ির দরজার সামনে পৌঁছে হাতে ধরা রঙিন কাগজগুলোর দিকে আড়চোখে একবার দেখলেন গোলোকবাবু। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালেন মনে মনে। বেড়াতে যাওয়ার জন্য বেশ গুছিয়ে প্ল্যান করেছেন এবারে। হাজারো ভাবনাচিন্তা করে, অনেক ঘোরাঘুরির পরে, সবদিক বুঝেশুনে এক জবরদস্ত প্ল্যান বানিয়ে আজ একজায়গায় কথাবার্তা পাকা করে এসেছেন। মুচকি হাসিটায় একটা যুদ্ধ জয়ের ভাব মিশিয়ে দরজার কড়া নাড়লেন। মনের মধ্যে কাড়ানাকাড়া বেজে উঠল। যুদ্ধ জয়ের ঘোষণা না করা পর্যন্ত স্বস্তি নেই। খুট করে একটা শব্দের অপেক্ষায় বন্ধ দরজার বাইরে ওত পেতে রইলেন গোলোকবাবু।
নাম যাই হোক না কেন, স্বভাবে গোলোকবিহারীবাবু মার্কামারা ‘দী-পু-দা’। এযাবৎ বেশ কয়েকবার দীঘা, বার কয়েক পুরী আর দার্জিলিং বার দুয়েক বেড়িয়ে এসেছেন তিনি। এর বাইরে ফ্যামিলি নিয়ে পা ফেলার কথা ভাবলেই বুক কেঁপে ওঠে তাঁর। চারদিকের হালহকিকত দেখে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছেটাই যেন চলে যায়। তার ওপর যোগাড়যন্ত্র আছে, খরচ আছে, পরিশ্রম আছে। ‘দী-পু-দা’ হলে সব ঝামেলা-ঝক্কি অনেক কম। কত সুবিধা! জানাশোনা হোটেল, চেনা রাস্তাঘাট, কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয় না থানা-পুলিশ-ডাক্তারখানা কোন দিকে। চাট্টি ভাত-ডালের জন্য কান্নাকাটি করতে হয় না। সন্ধেবেলা পুরীর বীচ বা দার্জিলিংয়ের ম্যালে বাংলায় কলবল শুনলে বেশ একটা ‘হোম, অ্যাওয়ে ফ্রম হোম’ ফিলিং আসে।
কিন্তু বাকিদের এসব বোঝানো মুশকিল। মেয়ে দীঘা শুনলেই নাক সিঁটকায়। ওয়াটার স্পোর্টসের কোনওরকম ব্যবস্থা নেই বলে ছেলের আবার পুরী না-পসন্দ। গিন্নি দার্জিলিংয়ের নাম শুনে একদিন এমন রেগে গেলেন যে চা খাওয়াই হল না। একদিন গোলোকবাবু একটু পাণ্ডিত্য দেখিয়ে ‘দেয়ার আর মেনি থিংস…’ বলে কিছু একটা বলতে শুরু করেছিলেন। মাঝপথেই গিন্নি মুখ ঝামটে ‘হেভেন’ থেকে টেনে নামিয়ে ছিলেন মাটিতে। “এদিকে দার্জিলিং, ওদিকে দীঘা; পুরীর পরে পৃথিবীটা গোল না চৌকো তাই জানা হল না, উনি নরওয়ে চললেন যুদ্ধ করতে!”
কথাগুলো হয়তো কিছুটা ঠিক। কিন্তু অন্য দিকগুলোও তো ভাবতে হবে! আর ভাবতে গেলেই সব জট পাকিয়ে যায় গোলোকবাবুর। ছুটির মরসুমে ট্রেনে রিজার্ভেশনের সমস্যা আছে। কোনওরকমে টিকিট কনফার্ম হলেও খাবারদাবার নিয়ে ট্রেনে ঝামেলা লেগেই আছে। কোথাও গিয়ে ভালো হোটেল পাওয়া মুশকিল। যেখানে ঘর খালি, সেখানকার বিছানা-বালিশের দিকে তাকানো যায় না। বিছানা ঠিক তো বাথরুমের গ্যারান্টি নেই। এরপর এদিক ওদিক ঘোরার জন্য গাড়ি চাই, গাড়ি ঠিকঠাক গড়ায় তো ড্রাইভার গড়াগড়ি খায়। ‘শোফার’ যদি ‘সোবার’ হয়ও, গাড়ি চালানোর সময় ‘সেফার সাইডে’ থাকে কি না ভগবান মালুম। চুরি ছিনতাই তো আছেই। খবরের কাগজ খুললেই এসব খবর পাওয়া যায়। চার লাইনের একটা খবরের ভেতর চল্লিশটা খবর লুকিয়ে থাকে। কেউ বুঝলে তো!
তবুও সবার চাপে পড়ে গোলোকবাবু এবারে পুজোয় কোথাও একটা বেড়াতে যাওয়ার ভাবনা-চিন্তা শুরু করলেন নববর্ষ পেরোতেই। শুধু ভাবা নয়, একেবারে কাজে নেমে পড়লেন গোলোকবাবু। খবর কাগজের বিজ্ঞাপন আর ট্রাভেল গাইড ধরে ধরে টালা থেকে টালিগঞ্জের মাঝে সমস্ত ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কথা বললেন। অফিসে বসে ফাঁক বুঝে ফোনে খোঁজখবর নিলেন চেনাজানাদের কাছে। কোনও ওয়েবসাইট খুলতে বাকি রইল না। মোটকথা, নিউ ইয়ারে পাওয়া ডায়েরি ভরে গেল তথ্য আর কাটাকুটিতে, কিন্তু মনের মতো কোথাও কিচ্ছু খুঁজে পেলেন না।
হাল প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন, এমন সময় একদিন বিনা কিছু আশা নিয়ে এক ট্রাভেল এজেন্সিতে পৌঁছলেন গোলোকবাবু। দরজাটা কাচের হলেও চিনের প্রাচীর আর বরফ ঢাকা হিমালয় দৃষ্টি আড়াল করে রেখেছে। ভেতরে রঙিন পোস্টারে ঠাসা দেওয়াল, কাঞ্চনজঙ্ঘা, প্যাংগং লেক, ঢেউ খেলানো বালি, চারমিনার, ইন্ডিয়া গেট, ধুঁয়াধার ফলস, বিবেকানন্দ রক, কুতুবমিনার, তাজমহল, আরও অনেক কিছু। উলটোদিকটায় বিদেশ, কুলকুচিরত সিংহ, পাঁপড়ি খোলা সভাঘর, বিশ্রামরতা মৎস্যকন্যা, পাল তোলা হোটেল, চিলেকোঠার ঘড়ি, মূর্তিমান মুক্তি, আরও কত কী। এদিকটা আবার ওয়াইল্ড লাইফ, ডোরাকাটা বাঘ, শুঁড় তোলা হাতি, পিঠে বক নিয়ে গণ্ডার, পাখা মেলা চিল, উট, ঘোড়া, ধনেশ, রাজহাঁস ইত্যাদি সব। ওদিকটায় আবার সমুদ্রের নিচে সাঁতার, স্কীইং-স্কেটিং, বিলাসবহুল ক্রুজ আর প্যারাস্যুট। একটা টকটকে লাল রঙের ডিসপ্লেতে পাঁচ-ছ’টা জায়গার সময় আর ডলার-ইউরো-পাউন্ডের হিসেব দেখাচ্ছে। একেবারে ঝাঁ-চকচকে অফিস। এ.সি.র ঠাণ্ডা হাওয়ায় কম্পিউটারের সামনে বসে কয়েকজন স্মার্ট সুন্দরী মহিলা খদ্দের সামলাচ্ছেন। এক ভদ্রমহিলা হেসে ইশারা করায় গোলোকবাবু চেয়ারটা টেনে বসলেন।
গোলোকবাবু একটু ধাতস্থ হয়ে বসার পর মিষ্টি হেসে ভদ্রমহিলা বললেন, “ক’জন যাবেন?”
“হাম দো, হামারা দো।” গোলোকবাবু স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করলেন।
“জায়গা কিছু ঠিক করেছেন, স্যার?”
“না! ওসব ঠিক করতেই তো আসা।” পয়সা যখন দিতেই হবে তখন ওরাই ঠিক করুক বেড়ানোর জায়গা, ভাবলেন গোলোকবাবু।
“নো প্রবলেম, স্যার। কোথায় যাবেন বলুন, দেশ, না বিদেশ?”
“আগে দেশটাই হোক।” স্মার্টনেস বজায় রাখতে ‘ধানের শীষ’, ‘শিশিরবিন্দু’ এসব একটু বিড়বিড় করলেও বিদেশ যাওয়া যে কী ঝামেলা তা গোলোকবাবু ভালোই জানেন।
“একদম ঠিক, স্যার। একটা আন্দামান প্যাকেজ আছে আমাদের, ‘নীল সাগরে সবুজ দ্বীপ’। এই যে, কাগজটা দেখুন।”
হাতে নীল রঙের একটা কাগজ এল গোলোকবাবুর। পাঁচ-ছ’দিনে আন্দামান বেড়ানোর ফিরিস্তিতে সেলুলার জেল, ঘন নীল সমুদ্রের নিচে রঙিন প্রবাল, মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে থাকা নিল, রস, হ্যাভলক ইত্যাদি রহস্যময় ছোটো ছোটো জঙ্গল ঢাকা দ্বীপ, ইত্যাদি সব আছে কাগজে। কাগজটা একটু সময় নিয়ে উলটেপালটে দেখলেন গোলোকবাবু। ভদ্রমহিলা মুখে হাসি ঝুলিয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাঁকে জরিপ করতে করতে বললেন, “বুক করে দিই?”
“আন্দামানটা এবারে থাক। ওই জেল-টেল দেখলে খুব মনখারাপ লাগে। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা কী চাইলেন, আর কী পেলাম আমরা!” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আন্দামানটা বাতিল করলেন গোলোকবাবু। আসলে বোটে করে সমুদ্রে ঘোরাঘুরির দুশ্চিন্তাটা বিদায় করলেন। তাছাড়া যাত্রীসহ পুরো একটা প্লেন নিখোঁজ হয়ে গেল এই সেদিন, আন্দামানের ওদিকেই তো!
“তাহলে একটা কাজ করুন স্যার, ‘কম দামে চার ধাম’ প্যাকেজে একটা বড়ো পার্টি যাচ্ছে কেদার-বদ্রী-গঙ্গোত্রী-যমুনোত্রী। ভালো ব্যবস্থা থাকবে, সস্তাতেই হয়ে যাবে।” আরেকটা লিফলেট বাড়িয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা।
ভয়ংকর বন্যায় গড়িয়ে আসা পাথরের ছবিগুলো মনে করে শিউরে উঠলেন গোলোকবাবু। আমতা আমতা করে বললেন, “ওদিকের রাস্তাঘাট ঠিকঠাক আছে তো?”
“নাহলে কি পার্টি নিয়ে আমরা যাই, স্যার?” এমনভাবে বললেন ভদ্রমহিলা যেন দাঁড়িয়ে থেকে নতুন রাস্তা উনিই তৈরি করেছেন। “ঘোড়া, ডান্ডি সব ব্যবস্থা থাকবে। দলবেঁধে গেলে অনেক সুবিধাও আছে; বেশ বড়ো ফ্যামিলির মতো একসঙ্গে যাওয়া-থাকা-খাওয়া, কত নতুন চেনাশোনা হয়ে যায়!”
এই রে, এ আবার ‘ভ্রমণের উপকারিতা’ রচনা কপচাচ্ছে! গম্ভীর মুখে আপত্তি জানালেন গোলোকবাবু, “দলের সবাই তো একরকম হয় না। কেউ চা পেলে উঠতে চায় না, কেউ পাহাড় দেখলে দাঁড়িয়ে যায়। তারপরে ওরকম হাঁটাহাঁটি এই বয়েসে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।”
“ওকে। তাহলে কাশ্মীরের দিকটায় চলুন—শ্রীনগর, গুলমার্গ, পহেলগাঁও। কাটরা, বৈষ্ণোদেবী সহ ‘ভোলাভালা ভূস্বর্গ’ প্যাকেজ।” কাশ্মীরের লম্বা ফিরিস্তি আর ছবি সহ কাগজ বাড়িয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা।
“ওদিকটা তো আবার ডিস্টার্বড এরিয়া। যখন তখন কার্ফু। গুলিগোলাও তো চলে।”
“ও নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না, স্যার। মাস খানেক আগে আমাদের একটা পার্টি শ্রীনগর পৌঁছনোর পর হঠাৎ ঝামেলা শুরু হল। সবাইকে গেস্ট হাউসের ভেতরেই আটকে রেখেছিলাম। অনেকেই বাইরে বেরোতে চাইছিলেন, কিন্তু নো…. নো…. নিরাপত্তার সঙ্গে নো কম্প্রোমাইজ।” যেন তর্জনী নেড়ে ভদ্রমহিলা গোলোকবাবুকেই বাইরে যেতে মানা করলেন।
গোলোকবাবুও মাথা নেড়ে বললেন, “না না, বেড়াতে গিয়ে ওরকম ঘরে আটকে থাকলে না হয় মজা, না হয় পয়সা উশুল।”
“বেশ তো, সিমলা-কুলু-মানালি-রোটাং চলে যান। খুব ভালো প্যাকেজ আছে স্যার, ‘সিমলা সিলসিলা’।” বরফের স্তূপের মতো লিফলেটের স্তূপও বাড়তে থাকে টেবিলের উপর।
চমকে উঠলেন গোলোকবাবু। “রোটাং! শুনেছি ওখানে শ্বাসকষ্ট হয়, আর মাঝপথে অসুস্থ হয়ে পড়লে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে আসা যায় না।” একটু থেমে স্বগতোক্তির ঢঙে বললেন, “মেয়েটার একটু হাঁপানির ধাত আছে তো, তাই চিন্তা।”
“তাহলে স্যার পুরো পনেরো দিনের জন্য রাজস্থান চলে যান—জয়পুর, যোধপুর, জয়সলমীর, চিতোর। কেল্লা-দুর্গ-বালি-উট সব হয়ে যাবে। এই যে, এই প্ল্যানটা, ‘রাজা-রেগির রাজস্থান’।”
“বলেন কী! পনেরো দিন!” চোখ কপালে তুলে গোলোকবাবু বললেন, “ফিরে এসে দেখব বাড়ির ভেতরটা বেশ সাফসুতরো করে গেছে কেউ, এক কণাও বালি রেখে যায়নি।”
“ওটা ভাববেন না স্যার, সব ব্যবস্থা আছে আমাদের। যদি ক্লায়েন্ট চায়, বেড়াতে যাওয়ার সময়টুকুর জন্য আমরা বাড়িতে সিকিউরিটি সার্ভিসের লোক পাঠিয়ে দিই, বাড়ির জিনিসপত্রের বীমাও করে দিতে পারি। খুব সামান্য চার্জ, স্যার। এই যে, এটায় সব ডিটেল আছে।” আরেকটা কাগজ এল সামনে।
গোলোকবাবুর কাছে এই নতুন আইডিয়াটা বেশ ভালো লাগল। কিন্তু মুখে বললেন, “শুনেছি রাজস্থানে বেড়ানোর জায়গাগুলো অনেক দূরে দূরে, গাড়িতেই বেশি সময় কেটে যায়। পনেরো দিন ধরে এত ধকল কি সহ্য হবে! তাছাড়া বাচ্চাদের পড়াশুনো আছে। হবে না।”
“এক কাজ করুন স্যার, কোনও জঙ্গলে, এই ধরুন বান্ধবগড় চলে যান। সকাল-বিকেল একটু বেড়ানো, বাকিটা আরামসে বাংলোর বারান্দায় বসে জঙ্গল দেখা। বাংলোর সামনেই হরিণ আর ময়ূর ঘুরে বেড়ায়, পুরো শকুন্তলার তপোবনের মতো। এই দেখুন না, ‘দঙ্গলে জঙ্গলে’র ডিটেলটা।” আবার লিফলেট বেরোল। “করবেট প্যাকেজও আছে, ‘কম রেট, করবেট’। ‘বিলং টু হলং’ আছে, ‘বাহবা তড়োবা’ আছে, আরও অনেক আছে। সব প্যাকেজেই বাঘ দেখার গ্যারান্টি আছে।”
বাঘ! সাধ করে বাঘের মুখে যায় নাকি কেউ! জঙ্গল মানেই মশা-মাছি-পোকামাকড়, ফিরে এসেই ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গু। যুক্তি দেখিয়ে এটাও বাতিল করলেন গোলোকবাবু।
একটু ভেবে নিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, “স্যার সাউথে ঘুরে আসুন, চেন্নাই-পন্ডিচেরি-মহাবলীপুরম নিয়ে ‘দেখে নিন দক্ষিণ’ বলে সাতদিনের একটা প্যাকেজ আছে। খুব ভালো হবে।” ভদ্রমহিলা বলে চললেন, “বিন্দুতে সিন্ধু’ প্যাকেজে আছে রামেশ্বরম-কন্যাকুমারী-কোভলম। কন্যাকুমারীতে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে তিনটে সমুদ্র দেখার মজাই আলাদা। কোভলমের সূর্যাস্ত, জবাব নেই। রামেশ্বরমে সমুদ্রের ওপর ট্রেন লাইন, জানালা দিয়ে জলের ছিটে, এ-জিনিস আর কোথাও নেই। খুব ভালো হবে, স্যার।”
গোলোকবাবুর চোখে ভেসে উঠল সুনামি আর বন্যার ছবি। তারপর সমুদ্রের ওপর ব্রীজ! তার ওপর ট্রেন! ঠিকঠাক মেন্টেনেন্স হয় কি না কে জানে! তার ওপর, আজকাল তো লোকে দক্ষিণে যায় ডাক্তার দেখাতে। বেড়াতেও যায় নাকি! মুখে বললেন, “ওদিকে খাওয়াদাওয়াটা একটু অন্যরকম তো, মানে এই বয়েসে ঠিক ওই ইডলি-ধোসা-কারিপাতা-তেঁতুল হজম হবে না। ভাষাটাও খুব সমস্যা। এবারটা ছেড়ে দিন ম্যাডাম, পরে আবার যোগাযোগ করব, অনেক ধন্যবাদ।” কথা না বাড়িয়ে নমস্কার করে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লেন গোলোকবিহারীবাবু।
খদ্দের লক্ষ্মী। ছাড়ুন বললেই ছাড়া যায় নাকি! ফোনে দু’কাপ কফির কথা বলে ম্যাডাম বললেন, “বসুন না স্যার, কফি খেতে খেতে আরেকটু দেখা যাক।”
কফির টানে বসে পড়লেন গোলোকবাবু।
গরম ধোঁয়া ওঠা কফি এসে গেল একটু পরেই। কাপে চুমুক দিয়ে ম্যাডাম আবার শুরু করলেন, “স্যার, আপনার ঠিক কেমন প্যাকেজ চাই খুলে বলুন তো! দরকার হলে ডিজাইনারস প্যাকেজ বানিয়ে দেব।”
গরম কফিতে ফুঁ দিতে দিতে গোলোকবাবু একটু গুছিয়ে নিয়ে বললেন, “প্রথম কথা হল, দিন চার-পাঁচের বেশি বাড়ির বাইরে থাকা সম্ভব নয়। কাজকর্ম আছে, পড়াশুনো আছে। নাম্বার টু, বেশি দৌড়োদৌড়ি করা মুশকিল, একটু ধীরেসুস্থে রয়ে-বসে বেড়ানোই ভালো।”
ম্যাডামের মুখে হাসি দেখে গোলোকবাবু বলে গেলেন, “বারবার গাড়ি বদলানো, মালপত্র নিয়ে ওঠানামা যত কম হয় ভালো। অজানা জায়গায় অচেনা ড্রাইভারের গাড়িতে চড়াটাও ঠিক পছন্দ নয় আমার। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটা, কিছু দেখতে যাওয়ার জন্য ঠেলাঠেলি—এসব আবার একদম পোষায় না।”
“কিচ্ছুটি ভাববেন না স্যার, ওগুলো আমাদের ওপরে ছেড়ে দিন।” অভয় দিলেন ম্যাডাম।
“যাওয়া-আসাটা এ.সিতে হলেই ভালো, বেশি হই-হট্টগোল চেঁচামেচি থাকবে না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হোটেল চাই। বয়, ওয়েটাররা যেন ভদ্র সভ্য হয়। খরচটা একটু কমের দিকে থাকলেই হবে।”
একটু দম নিয়ে আরও কিছু বলতে গিয়ে গোলোকবাবু বুঝতে পারলেন আর তেমন কিছু বলার নেই। তাই উপসংহার টানলেন, “মানে, ওই ফ্যামিলি নিয়ে যেতে গেলে আজকাল যেমনটা দরকার তেমন হলেই হবে।” হেঁ হেঁ করে হেসে কফি শেষ করলেন গোলোকবাবু।
ম্যাডাম এতক্ষণ মুখে হাসি ঝুলিয়ে হুঁ হাঁ করছিলেন। এবার বললেন, “একটা এক্সক্লুসিভ প্যাকেজ করে দেব স্যার, একদম ফিট করে যাবে। আপনাকে দুটো মিনিট একটু বসতে হবে, আমি একটু বসের সঙ্গে কথা বলে আসি।”
ম্যাডাম একটা কাচ-ঘেরা কেবিনে গিয়ে ঢুকলেন। ইশারা পেয়ে আরও দুয়েকজন উঠে গেলেন। গোলোকবাবু আড়চোখে নজর করে বুঝলেন, আলোচনার ফাঁকে সবাই ঘুরে ফিরে তাঁকেই দেখছে। একটু খুশিই হলেন মনে মনে।
একটু পরে হাসিহাসি মুখে নিজের জায়গায় ফিরে হাতের কাগজগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে ম্যাডাম বললেন, “সরি স্যার, আপনাকে বসিয়ে রাখলাম। তবে একেবারে নতুন ধরনের একটা প্যাকেজ আপনাকে দিতে পারি। প্রথম কাস্টমার হিসেবে একটা স্পেশাল ডিসকাউন্টও পাবেন, সঙ্গে গিফট।”
একেবারে নতুন প্যাকেজ! তিনিই প্রথম! ভাবা যায়! তার ওপর ডিসকাউন্ট-গিফট! খুঁজে খুঁজে ঠিক জায়গাতেই এসেছেন বুঝে বেশ একটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করলেন গোলোকবাবু। ব্যাপারটা সমঝে নিতে খুশিয়াল গলায় বললেন, “ম্যাডাম ডিটেলটা…”
“হ্যাঁ, এই যে। প্রথমবার তো, তাই ছাপা লিফলেট দিতে পারলাম না। দেখে নিন একটু, অসুবিধা হলে বলবেন।” প্রিন্টগুলো বাড়িয়ে দিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, “প্যাকেজটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভাবাবেশে ভ্রমণ’। স্যার মনে করছেন প্যাকেজটা খুব পপুলার হবে। আপনার জন্যই তৈরি করা বলে স্পেশাল ডিসকাউন্ট আর গিফটের কথা বলে দিয়েছেন আমাদের স্যার।”
কাগজগুলো হাতে নিয়ে একনজরে বেশ ভালো লাগল গোলোকবাবুর। প্রথমদিন বিকেলে রাজধানী এক্সপ্রেসে যাত্রা শুরু, টু টিয়ারে। চাইলে এ.সি ফার্স্ট ক্লাসেও হতে পারে। শুধু ট্রেনের খাবার নয়, এজেন্সির লোক বিভিন্ন জায়গায় খাবারের প্যাকেট দিয়ে যাবে, ‘উইথ আ লোকাল ফ্লেভার’। ভদ্রমহিলা বিশদে বুঝিয়ে দেন, “ধরুন বর্ধমানের মিহিদানা আর সীতাভোগ, ট্রেন না দাঁড়ালেও প্যাকেট পেয়ে যাবেন। মোগলসরাই পৌঁছলেই কাশীর প্যাঁড়া, মালাই আর মিষ্টি পান। কানপুরে আবার লখনৌয়ের কাবাব, ব্রেকফাস্টে কাবাবটা যদিও ঠিক জমে না, তবে চাইলে পাওয়া যাবে। টুন্ডলায় হাতে আসবে আগ্রার পেঠা, আর দিল্লি পৌঁছলেই ‘ওয়েলকাম কিট’-এ ‘দিল্লিকা লাড্ডু’।”
ট্রেন বদলের ঝুটঝামেলা একদমই নেই, রাজধানীতে যাওয়া, ওতেই ফেরা। শুধু নিউদিল্লিতে নামতেই হবে। সামনে যাত্রীনিবাসে বিশ্রামের ব্যবস্থা থাকবে। আবার ওই নিউদিল্লি থেকেই ফিরতি ট্রেন। গাড়ি-ঘোড়া, ড্রাইভার, পার্কিং, টোল, বখশিস কোনও ঝামেলা নেই। স্টেশনে রিসিভ করা আর ট্রেনে তুলে দেওয়ার জন্য এজেন্সির লোক থাকবে, তারাই মালপত্র বয়ে দেবে।
সত্যি-সত্যিই যেমনটি চাইছিলেন গোলোকবাবু, ব্যাপারটা আরও ভালো করে বুঝে নেওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলেন, “সাইট সিয়িং কী হবে? বেশি ঝামেলা-টামেলা হবে না তো!”
ভদ্রমহিলা প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন, “একবিন্দু ঝামেলা নেই, স্যার। অন দা ওয়ে সবকিছু দেখার ব্যবস্থা থাকবে। টিকিটের লাইন নেই, ঠেলাঠেলি নেই, যেটা যেমন ইচ্ছে যতক্ষণ খুশি দেখতে থাকুন, কেউ তাড়া দেওয়ার নেই। তাড়াহুড়ো করে বেড়ানোতে আমরাও ঠিক বিশ্বাস করি না। আপনি পয়সা দেবেন, পুরোটা আপনার মনের মতো করে দেখবেন, স্যার।”
গোলোকবাবুর মুখের অবস্থা দেখার মতো। এমনটাও হয়! একটু সময় দিয়ে ভদ্রমহিলা আবার বিশদে বলতে শুরু করেন, “যেমন ধরুন বর্ধমানের কার্জন গেট, রাজবাড়ি। ওগুলো দেখতে কি আর আলাদা করে কেউ বর্ধমান যায়? কিন্তু এই প্যাকেজে ওটা থাকবে। আসানসোলের কাছে মাইথন, ধানবাদের তোপচাঁচি লেক, পরেশনাথের মন্দির, ছোটো ছোটো, কিন্তু ভীষণ সুন্দর জায়গাগুলো সব দেখতে পাবেন। তারপরে ধরুন হাজারিবাগের জঙ্গল, গয়ার বিষ্ণু মন্দির, ফল্গু নদী। বুদ্ধগয়ার প্রতিটা মন্দির, বোধিবৃক্ষ। আবার মোগলসরাই দিয়ে যাবেন, মাত্র আধঘণ্টার রাস্তা বেনারসটা কি বাদ পড়বে?”
গোলোকবাবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। ভদ্রমহিলা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “বেনারস, আহা! গঙ্গার ঘাট, গোধুলিয়া, বিশ্বনাথের মন্দিরে আরতি, ওদিকে সারনাথ। তারপরে আসবে এলাহবাদ, প্রয়াগ, নেহরুদের বাড়ি। আবার কানপুর থেকে লক্ষ্ণৌ মাত্র দেড় ঘণ্টার রাস্তা, তাই বাদ দেওয়ার কোনও মানে হয় না। লক্ষ্ণৌ মানেই ‘পহলে আপ’, ঠুমরী, কাবাব আর চিকন। ভুলভুলাইয়া, রেসিডেন্সি, রুমি গেট, ছোটা ইমামবাড়া তো আছেই। ভাবতে পারছেন, স্যার!”
গোলোকবাবুর মাথা এবার ভোঁ ভোঁ করছে। তিনি কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু ভদ্রমহিলা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, “দিল্লিতেও কিচ্ছুটি বাদ যাবে না, স্যার। কুতুবমিনার, লালকেল্লা, লোটাস টেম্পল, ইন্ডিয়া গেট, রাষ্ট্রপতি ভবন, পার্লামেন্ট, অক্ষরধাম, রাজঘাট, শান্তিবন, লোদী গার্ডেন, পুরানা কিল্লা, হুমায়ুন টোম্ব, আরও যা কিছু আছে দিল্লিতে।”
এবার সাহস করে ভদ্রমহিলাকে থামালেন গোলোকবাবু। আমতা আমতা করে বললেন, “এতকিছু দেখতে তো একমাসেরও বেশি সময় লেগে যাবে। চার-পাঁচদিনের বেশি সম্ভব নয় সে তো আগেই বলেছি।”
ভদ্রমহিলা আবার খেই ধরলেন, “স্যার, নিশ্চিন্তে থাকুন। পুরোটা শুনলেই বুঝতে পারবেন আপনার টাইম লিমিটটা মাথায় রেখেছি আমরা। এতকিছু দেখতে আপনাকে ট্রেন থেকে একবারও নামতে হবে না। আমরা আপনাদের তিনজনকে একটা করে ইলেকট্রনিক ফটো-ফ্রেম দিয়ে দেব, তাতেই ছবিগুলো দেখে নেবেন। একটা ফটো ফ্রেমে প্রায় দু’হাজার ছবি ধরে। একেবারে স্পষ্ট, প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার দিয়ে তোলা। আর আপনার সব মিলিয়ে মোট তিনদিন হচ্ছে। ধরুন শুক্রবার বিকেলে ট্রেনে চড়লেন, শনিবার দিল্লি পৌঁছলেন দশটা নাগাদ। ওখানে ট্রেন থেকে নামতেই হবে স্যার, রেল কোম্পানির নিয়ম, কিছু করার নেই। সামনেই যাত্রীনিবাসে গিয়ে বিশ্রাম আর দিল্লির ছবি দেখা। বিকেলে আবার রাজধানী এক্সপ্রেসে ফেরার টিকিট, রবিবার দুপুরের মধ্যে বাড়ি। সোমবার থেকে আবার স্কুল-কলেজ-অফিস যেমন কে তেমন চলল। তিনদিনে বিনা ছোটাছুটিতে এমন বেড়ানোর প্যাকেজ আর পাবেন না, স্যার। যদি বলেন, তাহলে রাজধানীর বদলে কালকা মেলে কালকা পর্যন্ত বুক করে দিতে পারি। ওতেও এ.সি ফার্স্ট ক্লাস আছে। দু’দিন বাড়বে বটে, কিন্তু পানিপথ, কুরুক্ষেত্র চণ্ডীগড়ও কভার হয়ে যাবে। আর কালকাতে প্রায় আঠারো-উনিশ ঘণ্টা সময় পাবেন। আরামসে সিমলা, কুলু-মানালি, মণিকিরণ, সাংলা-কল্পা, লাহুল-স্পিতি—পুরো হিমাচলটাই সেরে নিতে পারবেন। বিনা শ্বাসকষ্টে রোটাংপাস দেখাও হয়ে যাবে।”
দরদাম না করলে কেমন দেখায় যেন, তাই গোলোকবাবু একটু খরচ কমানোর কথা তুললেন। ম্যাডাম বললেন, “এর চেয়ে সস্তা করতে গেলে অনেক কাটছাঁট করতে হবে। তাতে বেড়ানোর মজাটাই মাটি হয়ে যাবে। যেমন ধরুন, অনেকটাই কমে হয়ে যাবে যদি ফটো-ফ্রেমের বদলে ছাপা ছবির অ্যালবাম নিয়ে যান। আবার ওটাই যদি ট্যাব নিয়ে যান এক লাফে অনেকটা বেড়ে যাবে। আর দরাদরি করবেন না, স্যার। প্রথম কাস্টমার আপনি, যতটুকু সম্ভব সস্তা করে দিয়েছি।”
মনে মনে তারিফ না করে পারলেন না গোলোকবাবু। মুখে বললেন, “ওই গিফট আর ডিসকাউন্টটা…”
ভদ্রমহিলা ঝটিতি জবাব দিলেন, “ওই ফটো-ফ্রেমগুলো রেখে দেবেন স্যার, ভালো কোম্পানির জিনিস, ফেরত দিতে হবে না। ওটাই গিফট হিসেবে দেওয়া হল। চাইলে পরেরবারেও ব্যবহার করতে পারেন। তখন অনেক কমে হয়ে যাবে। লোকাল খাবারগুলোর কোনও চার্জ লাগবে না, ওটা কমপ্লিমেন্টারি। এখন শুধু আপনি ডেট আর ডেস্টিনেশনটা বললেই বাকি কাজগুলো সেরে নিই। ফিফটি পার্সেন্ট এখন দিলেই হবে, বাকিটা যাওয়ার আগে আপনার সুবিধেমতো দিয়ে দেবেন।”
একেবারে মনের মতো প্যাকেজ পেয়ে গোলোকবাবু প্রচণ্ড খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলেন। বিনা ঝামেলায় নিরাপদে বেড়ানো একেই বলে। সস্তাও বটে। রসিদ নিয়ে লিফলেটগুলো গুছিয়ে উঠে পড়লেন গোলোকবিহারীবাবু। বিনা ঝামেলায় অল্প খরচে বেড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ তাঁর হাতের মুঠোয়, আর বিপদ-আপদের আশঙ্কা নেই বললেই চলে। বহুদিন আগে কী একটা গান শুনেছিলেন তিনি, ‘চাওয়ার মতো চাইলে পরে সবই মেলে আহারে’। গানটা গুনগুন করতে করতে টাকা গুনে দিলেন অ্যাডভান্স হিসেবে।
হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি নিয়ে বেল বাজালেন গোলোকবিহারীবাবু। মনের মতো বেড়ানোর প্যাকেজ খুঁজে পাওয়ার সুখবরটা দেওয়ার জন্য আর তর সইছিল না।
ছবিঃ সায়ন মজুমদার
ধন্যবাদ জয়ঢাককে, বিশেষ ধন্যবাদ শ্রী সায়ন মজুমদারকে ছবির জন্য।
LikeLike
একনিশ্বাসে ঘুরে এলুম নিখরচায়। গিফ্ট হিসাবে ভাল লাগাটা রেখে দিলুম।
LikeLike