ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়
কিছুক্ষণ থেকেই পাশের ঘরে খুটখাট আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন জ্যোতিপ্রসাদ। আচমকা শুনলে মনে হবে ইঁদুর দৌড়চ্ছে বুঝি। কিন্তু জ্যোতিপ্রসাদ জানেন, ও-ঘরে ইঁদুর নেই। খানিক আগেই পুরনো দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বেজেছে। রাতে ভালো ঘুম হয় না তাঁর। বয়সের কারণে ঘুম কমে গেছে অনেক। দু’দিন আগে পূর্ণিমা ছিল। সেদিন থেকেই বাতের ব্যথাটাও বেশ বেড়েছে। আজও রাত্রে ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন জ্যোতিপ্রসাদ। রাতে শোবার আগে খাস চাকর শিবু তেল মালিশ করে দিয়ে গেছে। তাতে সাময়িক উপশম হলেও আবার বাড়ছে ব্যথাটা। সেই কারণেও আরও ঘুম আসছিল না জ্যোতিপ্রসাদের। তাই খুটখাট আওয়াজটা তাঁর কানে এসেছে প্রথম থেকেই। কাজের লোকজনদের মধ্যে শিবুই একমাত্র রাতে থাকে এ-বাড়িতে। তার আবার আফিঙের নেশা আছে। রাত্রে তাই অঘোরে ঘুমোয়। এসব ছোটোখাটো আওয়াজ তার কানে পৌঁছবে না।
ক’দিন ধরেই একটা অচেনা অল্পবয়সী ছেলেকে বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখছিলেন। সন্দেহ হওয়ায় খোঁজখবরও নিয়েছিলেন। শিবুই খবর এনেছিল, গ্রামের প্রান্তে কামারপাড়ায় বাড়ি ছেলেটির। ছোটো থেকেই বখে যাওয়া। কামারপাড়ার মানুষজন খুবই সৎ এবং পরিশ্রমী। জীবিকার সন্ধানে এই প্রজন্মের কিছু ছেলে লেখাপড়া শিখে এদিক ওদিক ছিটকে গেলেও অনেকেই তাদের জাত-ব্যাবসা ধরে রেখেছে এখনও। কামারপাড়ায় ঢুকলেই এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে ঠুকঠাক আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু এ ছেলেটা না করেছে লেখাপড়া, না শিখেছে বাপ-ঠাকুরদার হাতের কাজ। কীই বা বয়স! এর মধ্যেই ছিঁচকে চুরির দায়ে বার দুই হাজতবাস হয়ে গেছে। সেই ছেলেকে তাঁর বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখে আন্দাজ করেছিলেন, হয়তো এ-বাড়িতেই চুরির মতলব করছে ছেলেটি।
এই সেদিন অবধি ওই পাশের ঘরটাই ছিল তাঁর শোবার ঘর। ইদানীং আর রাতে ও-ঘরে ঘুমোন না জ্যোতিপ্রসাদ। পুরনো দিনের বাড়ি। বাথরুম ছিল শোবার ঘর থেকে দূরে বারান্দার এককোণে। আজীবন তাতেই অভ্যস্ত ছিলেন জ্যোতিপ্রসাদ। শুধু তিনি কেন, তাঁর পূর্বপুরুষেরা সকলেই এই বাথরুমই ব্যবহার করেছেন। একদম অথর্ব শয্যাশায়ী হয়ে যাবার পর অবশ্য ঘরেই বাথরুম সারার ব্যবস্থা করা হত। এখন দিনকাল বদলেছে। ছেলেরা বাবার জন্য অ্যাটাচড বাথরুম বানিয়ে দিয়েছে। তবে ওই বড়ো শোবার ঘরটির লাগোয়া বাথরুম তৈরি করা সম্ভব হয়নি জায়গার অভাবে। ঠিক তার পাশের ছোটো ঘরটির সঙ্গে যে একচিলতে বারান্দা ছিল সেটাকেই ঘিরে নিয়ে বাথরুম বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত জ্যোতিপ্রসাদ রাতে সে ঘরেই ঘুমোন। কিন্তু সারাদিনের অনেকটা সময় তাঁর কাটে ওই বড়ো ঘরেই। পুরনো সিন্দুকটা, জিনিসে ঠাসা বড়ো বড়ো গোটা চারেক আলমারি ও-ঘরেই রাখা আছে।
পূর্বপুরুষদের জমিদারি ছিল। জ্যোতিপ্রসাদের প্রপিতামহের আমলে তৈরি হয় এই বিখ্যাত চৌধুরীবাড়ি। দাদুর আমল পর্যন্ত ভালোই রমরমা ছিল জমিদারির। অবস্থা পড়ে এসেছে তাঁর বাবার আমল থেকেই। এখন তো দৈন্যদশা বলা চলে। সারাজীবন নানারকম সমাজসেবামূলক কাজ করেছেন জ্যোতিপ্রসাদ, ছাত্র পড়িয়েছেন। রোজগার তেমন কিছু করেননি, বরং দেদার খরচের হাত ছিল। ফলে পূর্বপুরুষের সঞ্চিত অর্থ তলানিতে এসে ঠেকেছে। এত বড়ো বাড়ির অনেকটাই এখন ধীরে ধীরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। সারানোর সাধ্যি নেই। বাড়ির একটা ছোটো অংশ সাফসুতরো করে সেখানেই বসবাস করেন জ্যোতিপ্রসাদ। পুরনো শৌখিন আসবাব, বাসনপত্র, ঘর সাজানোর হরেক জিনিস অনেক কিছুই বিক্রি করে দিতে হয়েছে। তবে সান্ত্বনা একটাই, ছেলেরা পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে বছর দুই আগে। ছেলেরা কর্মসূত্রে দূরে দূরে থাকে। ছুটিছাটায় আসে। এ-বাড়িতে জনা তিনেক কাজের লোকের সঙ্গে একাই থাকেন জ্যোতিপ্রসাদ। সারাজীবন এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাদের জন্য ভেবেছেন, দান-ধ্যানও করেছেন অনেক। তাই এলাকার লোক সম্ভ্রমের চোখে দেখে তাঁকে। আপদে বিপদে ছুটে আসে।
পাশের ঘরে খুটখাট আওয়াজ হয়েই চলেছে। ইচ্ছে করে দু’বার কাশলেন জ্যোতিপ্রসাদ। শব্দ থেমে গেল। মনে মনে হাসলেন জ্যোতিপ্রসাদ। ভাবলেন, দেখি বাছাধন, কতদূর তোমার দৌড়! মিনিট দশেক চুপচাপ থাকার পর আবার শুরু হল আওয়াজ।
ছেলেটার রকমসকম দেখে বিরক্ত হচ্ছিলেন জ্যোতিপ্রসাদ। চুরি করতে এসেছে বলে নয়। চুরি তো আর এই প্রথম হচ্ছে না চৌধুরীবাড়িতে। চিরকালই চোর-ডাকাতদের নজর ছিল এ-বাড়ির ওপর। বাবার কাছে গল্প শুনেছেন, একসময় আগাম চিঠি দিয়ে এ-বাড়িতে ডাকাতি করে গেছে বীরু ডাকাত। বাড়ির মহিলাদের মা বলে ডেকে প্রণাম করে, পুরুষদের হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে যথাসর্বস্ব বস্তায় বেঁধে নিয়ে গেছে। তার ভয়ংকর চেহারা আর তাগড়াই লেঠেল দলের সামনে টুঁ শব্দটি করার ক্ষমতা ছিল না কারও সে যুগে। এ তো শোনা কথা। কিন্তু স্বচক্ষেও চুরি অনেকবার দেখেছেন জ্যোতিপ্রসাদ। সিঁদ কেটে সিন্দুক ফাঁকা করে নিয়ে গেছে চোর। মোটা দেওয়াল কেটে গোল সিঁদ, ঠিক একটি মানুষ গুঁড়ি মেরে ঢুকতে পারে এমন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমান, মসৃণ। নিঃশব্দে খোঁড়া হয়েছে এক রাতে। বাড়িভর্তি লোক, টেরও পায়নি কেউ। তাকে চোর না বলে শিল্পী বলাই ভালো।
এহেন শৈল্পিক চুরির অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ জ্যোতিপ্রসাদ তো বিরক্ত হবেনই এই অর্বাচীন চোরের নির্বুদ্ধিতায়! একে তো দিন দুই আগে পূর্ণিমা গেছে, আকাশে ফটফটে জ্যোৎস্না। তার ওপর গৃহস্বামী ডায়াবেটিক এবং বাতের ব্যথায় কাতর। রাতে ভালো ঘুম হয় না, বারবার উঠতে হয়। এসব বাড়িতে চুরি করতে হয় অমাবস্যায় এবং শেষরাতে, যখন সারারাত এপাশ ওপাশ করার পর কিছু সময়ের জন্য ঘুমে জড়িয়ে আসে গৃহস্বামীর চোখের পাতা। এসব খবরাখবর না নিয়েই কি চুরি করতে আসে আজকালকার চোরেরা? এত নিষ্ঠার অভাব তাদের? একে তো চোর না বলে ছ্যাঁচড় বলাই ভালো। নাকি এ চোরটাই বোকা? জ্যোতিপ্রসাদের ধারণা ছিল বোকা লোকেরা, আর যাই হোক, চোর হতে পারে না। হওয়া সম্ভবই না। তাঁর আজীবনের ধারণা ধূলিস্যাৎ হবার উপক্রম হয়েছে এই চোরটির নির্বুদ্ধিতায়। এ চোরটা বোকা তো বটেই, যথেষ্ট হোমওয়ার্কও করেনি।
আওয়াজ শুনে এবং সময় আন্দাজ করে জ্যোতিপ্রসাদ বুঝতে পারলেন চোরের চুরি শেষের পথে। এবার ভাগলবা হবার কথা। চোর ঢোকার রাস্তা এ-বাড়িতে একটাই হতে পারে। পিছনের বাগানে নামার যে খিড়কির দরজা, সেটার ছিটকিনিটা একটু আলগা। বহুবছরের পুরনো দরজা। সারানো হয়নি। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। বাঁদিকের পাল্লাটা চেপে ধরলে দুই পাল্লার মাঝামাঝি একটা ইঞ্চি খানেকের ফাঁক তৈরি হয়। সেই ফাঁক দিয়ে ছুরি বা চ্যাপ্টা কোনও পাত ঢুকিয়ে চাপ দিলে হুক সমেত ছিটকিনিটা খুলে আসতে পারে। কাঠের খিলটাও একই কায়দায় খোলা যেতে পারে। ব্যাপারটা জেনেও যে জ্যোতিপ্রসাদ এতদিন কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার আগ্রহ অনুভব করেননি, তার কারণ, এটা বাইরের লোকের চোখে সহজে পড়ার কথা নয়। তাছাড়া তাঁর বাড়িতে আছেই বা কী যে চোর আসবে? দেখা গেল তাঁর ধারণার গোড়াতেই গলদ।
পাশের ঘরে হালকা পায়ের আওয়াজে বুঝলেন, তার পলায়নের সময় হয়ে এসেছে। এবার সাড়া না দিলেই নয়। বামাল ধরতে হবে তো চোরকে! হাঁটাচলার সুবিধার জন্য মাঝে মাঝে একটা স্টিলের লাঠি ব্যবহার করেন জ্যোতিপ্রসাদ। সেটা হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে যথাসম্ভব নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দেখলেন, পাল্লাদুটো তখনও ভেজানো। চট করে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিলেন জ্যোতিপ্রসাদ। ছোট্ট একটু ধাতব শব্দ হল। ভিতরে কিছুক্ষণ আর কোনও আওয়াজ নেই। একেবারে স্তব্ধ। তারপর বোঝা গেল দরজাটা ভেতর থেকে ঠেলাঠেলি করছে কেউ। ইঁদুরকলে ধরা পড়েছে চোর। জ্যোতিপ্রসাদ জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, রোসো! তাড়া কী? পুলিশ আসুক! তারাই দরজা খুলবে।”
ভিতর থেকে মিনমিনে গলায় শোনা গেল, “আমাকে ছেড়ে দিন। কিছু নিইনি আমি। আপনার কোনও ক্ষতি হয়নি। দয়া করে ছেড়ে দিন!”
“সে আমি জানি। আমার ঘরে কী আছে না আছে তোমার থেকে আমি ভালো জানি। আর তোমার এলেমও জানা আছে আমার। তবে ছেড়ে দেওয়ার মালিক তো আমি নই। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে। তারাই ঠিক করবে তোমাকে ছেড়ে দেবে, নাকি হাজতে পুরবে। ভালো চাও তো সঙ্গে ছোরাছুরি যা আছে ওই জানালা গলিয়ে বাগানে ফেলে দাও।”
“না না, বিশ্বাস করুন, আমার কাছে ওসব কিচ্ছু নেই!”
“তুমি বললেই আমি বিশ্বাস করব? কামারপাড়ার ছেলে তুমি, সঙ্গে কোনও ছোরাছুরি নেই?”
“না, সত্যি নেই। বিশ্বাস করুন! আপনি জানলেন কী করে যে আমি… আপনি আমাকে চেনেন?”
“না চিনে উপায় কী বলো? দিন পনেরো ধরে সকাল বিকেল আমার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করছ! আমাকে কি তোমার মতো বোকা পেয়েছ যে এটুকুও বুঝব না?”
“এই লাঠি আর এই একটা নরুন ছিল সঙ্গে, এই ফেলে দিলাম জানালা দিয়ে। এবারে ছেড়ে দিন। ক’টা কাঁসার বাসন ছাড়া আর কিছু তো পাইনি! ভাবলাম, বনেদি ঘর, মরা হাতি লাখ টাকা। তখন কি আর জানি, একেবারে আয়নার মতো লেপা পোঁছা ঘর!”
মরা হাতি! ছোকরার সাহস তো কম নয়! তাঁর মুখের ওপর… দাঁড়াও দেখাচ্ছি বাছাধন, মরা হাতির জোর কত। পুলিশের ভয়টা সত্যিই পেয়েছে মনে হচ্ছে। আশা করা যায় বাড়াবাড়ি কিছু করবে না। বয়সকালে এক চড়ে ধরাশায়ী করতে পারতেন ওকে। এখন বয়স হয়ে শরীরের জোর কমে এলেও মনের জোর এখনও কিছু কম নেই জ্যোতিপ্রসাদের। আর এসব ক্ষেত্রে মনের জোরটাই আসল। তার ওপর হাতের লাঠিটাও একটা বাড়তি কনফিডেন্স এনে দেয়। লাঠিটা বাগিয়ে ধরে ছিটকিনিটা খুলে দরজার পাশের সুইচ বোর্ড হাতড়ে আলোটা জ্বেলে দিলেন জ্যোতিপ্রসাদ। ছেলেটা করুণ মুখে হাতজোড় করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তাঁর সামনে।
ছোঃ! এই নাকি চোর! সে এক সময় ছিল যখন চোর-ডাকাতেরা নিয়মিত শরীরচর্চা করত। পালোয়ানের মতো মুশকো দুয়েকটা চোর তো নিজের চোখেই দেখেছেন জ্যোতিপ্রসাদ। ধরা পড়ে গেলে একা পাঁচটা লোকের মহড়া নিতে পারত। এ তো চোর সমাজের কলঙ্ক! শরীরের জোর তো নেইই, মনের জোরও এতটুকু নেই।
তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে কাঁদো কাঁদো গলায় চোর বলল, “বাসন ক’টা জায়গামতো রেখে দিচ্ছি, আমাকে ছেড়ে দিন! পুলিশে বড্ড মারে, জানেন!”
“তা এসব কথা আগে মনে হয়নি? দু-দু’বার শ্রীঘর বাস করেও শিক্ষা হয়নি?”
“আপনি… আপনি তো সব খবরই রাখেন! গতবার দারোগাবাবু বলেছিল, আবার যদি ধরা পড়ি, তাহলে সদরে চালান করে দেবে। প্রথম প্রথম ভয় পেয়েছিলাম, তারপর দু-তিনটে কেস ঠিকঠাক উতরে যেতে সাহস পেলাম। আজকের মতো ছেড়ে দিন! আর কক্ষনও এ-বাড়ির দিকে ফিরেও তাকাব না।”
একে আর মারবেন কী, এ তো আগে থেকেই মরে আছে ভয়ে! চেহারা দেখে তো মনে হয় ঠিকমতো ভাত জোটে না অনেকদিন। আর যা দিনকাল পড়েছে! মনটা কেমন নরম হয়ে আসছিল জ্যোতিপ্রসাদের। “বেশ, যাও। চলে যাও।”
“কিন্তু… পুলিশ?”
“পুলিশ-টুলিশ নেই, যাও।”
“নেই? সত্যি বলছেন? পুলিশে খবর দেননি আপনি?”
“না, দিইনি। তোমার মতো একটা ছুঁচোর জন্য পুলিশকে ব্যতিব্যস্ত করার পক্ষপাতী আমি নই। তাদের আরও অনেক জরুরি কাজ থাকে। তোমাকে শায়েস্তা করতে আমার মতো একটা বুড়োই যথেষ্ট।”
“হে হে… তা যা বলেছেন। একটু জল খাব, দাদু?”
“খাও। ওই তো কোনার টেবিলে জলের বোতল।”
ঢকঢক করে প্রায় পুরো এক বোতল জল শেষ করে ফেলল ছেলেটা। যেন কতদিনের তৃষ্ণা জমিয়ে রেখেছিল। বড়ো মায়া লাগল জ্যোতিপ্রসাদের। বললেন, “তোমার নামটা কী হে? চোর বলে তো আর কাউকে ডাকা যায় না!”
“হে হে! তাও ডাকে কেউ কেউ। হে হে!”
আচ্ছা বেহায়া চোর তো! বিরক্ত হয়ে বললেন, “বাপ মা তো একটা নাম রেখেছিল, নাকি? সেটা কি ভুলে মেরে দিয়েছ?”
“আজ্ঞে, বুধন। আমি তাহলে যাই?”
“দাঁড়াও! চৌধুরী বাড়িতে চোর এসে খালি হাতে ফিরে গেছে, এমন আগে কখনও ঘটেনি। এ-বাড়ির তো একটা প্রেস্টিজ আছে হে! এই যে তুমি বললে, কয়েকটা কাঁসার বাসন ছাড়া আর কিছু পাওনি, একথাটা আমার পক্ষে কতখানি লজ্জার, অপমানের, বোঝার মতো বুদ্ধি তোমার নেই।”
উদাস মুখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন জ্যোতিপ্রসাদ। ছেলেটাও কী করবে বুঝতে না পেরে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
একটু পরে জ্যোতিপ্রসাদ আবার কথা শুরু করলেন। “বইয়ের আলমারির ওপরের তাকে একটা বড়সড় অ্যালবাম রাখা আছে, দেখতে পাচ্ছ?”
“ওই লাল মলাট দেওয়া খাতাটার কথা বলছেন?”
“খাতা নয়, ওটাকে বলে অ্যালবাম। আমার স্ট্যাম্পের অ্যালবাম। তোমার বোঝার কথা নয়। ওর মধ্যে এমন দুটো দুর্মূল্য স্ট্যাম্প আছে বাজারে যার দাম কয়েক লক্ষ টাকা।”
“বলেন কী!” বিস্ময়ে চোখ বিস্ফারিত হল বুধনের।
“ওই যে শোকেসের ভেতর মূর্তিদুটো দেখছ, একটা নটরাজ আর একটা যক্ষিণী মূর্তি, ও দুটো ব্রোঞ্জের। ওগুলোর অ্যান্টিক ভ্যালুও আছে। ওদের বাজারদর জানো? তুমি কল্পনাই করতে পারবে না। আর ওই যে ওপরের শেলফে একটা সাদা হাতির দল দেখতে পাচ্ছ, ওটা কীসের তৈরি জানো? আইভরি। হাতির দাঁত। অসম্ভব দামি জিনিস। এই একটা ঘরেই ফেলে ছড়িয়ে কোটি টাকার জিনিস আছে। জিনিসই চেন না, চুরি করতে এসেছ! বলে দিলে ক’টা কাঁসার বাসন ছাড়া আর কিছু নেই! এ সমস্তই অবশ্য ইন্সিওর করা। বছরে কত টাকা প্রিমিয়াম দিতে হয় জানো? তুমি চুরি করলেও আমার ক্ষতি কিছু ছিল না। ইন্সিওরেন্স কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দিত। তবে হ্যাঁ, সেই দাদুর বাবার আমল থেকে জিনিসগুলো এ-বাড়িতে আছে। তার একটা সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু তো আছে! সে তো আর কোনও ইন্সিওরেন্স কোম্পানি ফেরত দিতে পারবে না।”
ছেলেটা বিস্ফারিত চোখে দেখে চলেছে জিনিসগুলো। একেবারে বাক্যিহারা। জ্যোতিপ্রসাদ আবার বললেন, “দেখো, দেখে নাও! এসব জিনিস চোখে দেখার সৌভাগ্যও বেশি লোকের হয় না। এসব চুরি করে কোথাও বিক্রি করতে পারবে ভেবেছ? সব লিস্টি করে থানাতে জমা দেওয়া আছে। এমন সব চোরাই মাল কেনার লোক কি সব জায়গায় থাকে? তার জন্য যা কাঠখড় পোড়াতে হবে, তোমার মতো চোরের কম্ম নয়।”
“আজ্ঞে না না, কী বলছেন! এসব কি আমার মতো লোকের কাজ? আমি আপনার বাড়ির ত্রিসীমানায় আর কখনও আসব না দাদু। এখন তাহলে যাই?”
“একটু দাঁড়াও।”
পাশের ঘর থেকে একটা একশো টাকার নোট নিয়ে এসে ছেলেটার হাতে দিলেন জ্যোতিপ্রসাদ। বললেন, “ওই যে বললাম, চৌধুরীবাড়ি থেকে চোর খালি হাতে ফিরে গেছে এমনটা কখনও হয়নি!”
বিগলিত হেসে একটা প্রণাম ঠুকে বিদেয় হল চোর। ওই বাগানের দিকের দরজাটা দিয়েই। ওর পিছু পিছু দরজা পর্যন্ত গেলেন জ্যোতিপ্রসাদ। দেখলেন বাইরের চাঁদের আলোয় যতক্ষণ দেখা যায়। তারপর আলগা ছিটকিনিটা বন্ধ করে আবার ফিরে এলেন বড়ো ঘরে। বন্ধ কাচের আলমারির সামনে গিয়ে দেখতে লাগলেন জিনিসগুলো।
হ্যাঁ, এককালে স্ট্যাম্প জমাতেন বটে। ওটা স্ট্যাম্পেরই অ্যালবাম। তবে যেমন বললেন, তেমন দুর্মূল্য কিছু নেই ওর মধ্যে। সবই খুব সাধারণ স্ট্যাম্প। ওই অপূর্ব নটরাজ আর যক্ষিণী মূর্তি। মাস্টারপিস বলা যেতেই পারে। তবে ব্রোঞ্জের নয়, পোড়া মাটির। ব্রোঞ্জ পালিশ দেওয়া হয়েছে। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীর অপূর্ব শিল্পকলার নিদর্শন। মূল্য যা কিছু, সবটাই নান্দনিক। আর ওই হাতির দঙ্গল আসলে সাদা মার্বেলের। ধুলো জমে জমে একটা লালচে ভাব এসেছে। দাম খুব বেশি হলে দু’শো টাকা।
চোর ছেলেটা ঠিকই বলেছিল। নেওয়ার মতো ওই ক’টা কাঁসার বাসনই ছিল তাঁর ঘরে। চৌধুরীবাড়ির আজ এমন অবস্থা হয়েছে যে তালপুকুরে ঘটি ডোবে না। কিন্তু সেকথা যদি বাইরে জানাজানি হত, তাহলে কি মানসম্মান কিছু থাকত? জ্যোতিপ্রসাদ তা কিছুতেই হতে দিতে পারেন না।
চোখের সামনে ভাসছিল কবেকার হারিয়ে যাওয়া চৌধুরীবাড়ির ছবি। পালাপার্বণে জমজমাট, উৎসবে আলো ঝলমলে চৌধুরীবাড়ি!
আজ বোধহয় আর ঘুম আসবে না সহজে। তবুও চেষ্টা তো করতে হবে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশের ঘরে ঘুমোতে গেলেন জ্যোতিপ্রসাদ।
জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে