বিভাবসু দে-র অন্যান্য গল্প– আনন্দের পাখি, দাবা কিংবা একটি না বলা গল্প, ভেম্পিগড়ের রূপকথা, ছায়ার কায়া, পাতালপুরীর দরজা
জুকুইজো ও ভোতনের পরীক্ষাতঙ্ক
বিভাবসু দে
ঢং ঢং করে তিনবার বেজে উঠল ঘণ্টাটা। সময় শেষ। ভোতনের পেটের ভেতরটাও সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেমন যেন গুড়গুড় করে উঠল। ওর খাতা যে এখনও ধবধবে সাদা! একটা বর্ণও লেখা হয়নি আর এদিকে কিনা সময় শেষ! কী হবে এখন? ওই তো মিহির স্যার তেড়ে আসছেন খাতা কেড়ে নিতে!
“স্যার, স্যার, প্লিজ আর পাঁচটা মিনিট স্যার। বিশ্বাস করুন স্যার, আমি সব পারি। প্লিজ স্যার। একটু…”
“খাতাটা ছাড় ভোতন, বাড়াবাড়ি করিস না। পারলে কি আর তিন ঘণ্টা ধরে বসে বসে আকাশের তারা গুনতি!” লাল লাল চোখ করে ধমকে উঠলেন মিহির স্যার।
ভোতনের গলাটা কাঁদো কাঁদো হয়ে এল, তবুও খাতা ছাড়ল না সে। একেবারে মরণপণ লড়াই!
কিন্তু এদিকে স্যারের মেজাজ তো ক্রমশ সপ্তমে চড়ছে। খাতা ধরে একদিকে স্যার টানছেন, একদিকে ভোতন। ভোতন যত বলে, ‘স্যার, আর পাঁচটা মিনিট,’ স্যারের চোখদুটো তত রক্তজবার মতো লাল হয়ে ওঠে! কিন্তু এই ভীষণ টানাপোড়েনটা বেশিদূর এগোল না। মাঝপথেই দমাস করে ভোতনের পিঠে এসে পড়ল মিহির স্যারের সেই কুখ্যাত গাট্টা। উফ্, গাট্টা তো নয় যেন বজ্রপাত! একঘায়ে সব কেমন যেন ঝাপসা হয়ে এল ভোতনের চোখের সামনে। ক্লাসরুম, মিহির স্যার, ওর ফাঁকা খাতা—সব। ভয়াল অন্ধকারের এক অতল সমুদ্রে যেন ডুবে যেতে লাগল সে। আর তখনই হঠাৎ কড়-কড়-কড়াৎ!
হকচকিয়ে উঠে বসল ভোতন। এতক্ষণ কি তবে স্বপ্ন দেখছিল! উফ্, কী ভয়ানক স্বপ্ন! ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে গেছে। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। কাছেপিঠেই কোথাও বাজ পড়েছে বোধহয়, তারই শব্দ। কিন্তু সেটা চিন্তার ব্যাপার নয়, ভোতনের আসল চিন্তা হল কালকের পরীক্ষা নিয়ে। কাল থেকে স্কুলের অ্যানুয়েল পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। আর পরীক্ষা মানেই ভোতনের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। কী ভাবছ? ভোতন সারাবছর পড়ে না? মোটেই না। সত্যি বলতে গেলে ভোতনই হয়তো ওদের ক্লাসে সবচেয়ে বেশি পড়ে। ফার্স্ট বয় অমিতের থেকেও বেশি। পরীক্ষার জন্যে যা যা পড়তে হয় সবই ভোতনের কণ্ঠস্থ, এমনকি পরীক্ষায় অধিকাংশ প্রশ্নই ওর কমন পড়ে। তবুও শুধু এই একটা কারণে কোনওদিন ভালো নম্বর পায় না ভোতন। পরীক্ষাতঙ্ক! পাগলা কুকুরে কামড়ালে যেমন জলাতঙ্ক হয়, ভোতনের তেমনই পরীক্ষাতঙ্ক! পরীক্ষার নাম শুনলেই সব তালগোল পাকিয়ে কেমন যেন জগাখিচুড়ি হয়ে যায়। পরীক্ষার হলে ঢুকলেই মনে হয় বুকের ভেতর কেউ যেন তবলা পেটাচ্ছে, প্রশ্নপত্র হাতে পেলেই দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকে কপাল বেয়ে। অথচ কী আশ্চর্য, সব প্রশ্ন তো ওর জানা! কিন্তু লিখতে গেলেই হাত কাঁপে। মনে হয় এই বুঝি ঘণ্টা পড়ে গেল, এই বুঝি স্যার তেড়ে এলেন খাতা কেড়ে নিতে। কেন যে এই অকারণ ভয়, ভোতন কিছুতেই ভেবে পায় না। এই ভয়ের কারণে সারাবছর মন দিয়ে পড়াশুনো করেও পরীক্ষায় ওর নম্বর থাকে একেবারে তলানির দিকে। গতবার তো অঙ্ক পরীক্ষায় আরেকটু হলেই ফেল করত ভোতন। অথচ কেল্টু, যে কিনা সারাবছর ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ফুটবল খেলে বেড়ায় সেও ভোতনের চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করল। কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না যে ভোতন মন দিয়ে পড়াশুনো করে। মা-বাবা কিংবা স্যারেরা সবাই ভাবে সে পড়ার টেবিলে বসে বসে ঝিমোয় আর পড়ায় ফাঁকি দেয়! এই পরীক্ষা-ভীতির কথা যাকেই বলেছে ভোতন, তার সেই একই জবাব, সব পারলে মিছিমিছি ভয় পাবি কেন পরীক্ষায়? হক কথা। কিন্তু ভোতনের ভয় যে এসবে একফোঁটাও কমে না। বছর বছর এই একই ঘটনা—পরীক্ষা দিতে ঢুকলেই সারাটা শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে, যেন ম্যালেরিয়া!
কাল কী হবে কে জানে! উহ্, ভাবলেই কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে ওর। “ঠাকুর, প্লিজ এবার সামলে দাও। এবার যেন…” সবে ঠাকুরের সঙ্গে এবছরের বোঝাপড়াটা করতে যাচ্ছিল ভোতন, ঠাকুরকে আরও অনেক কিছু বলারও ছিল ওর কিন্তু তখনই হঠাৎ ঘরের ভেতর কীসের যেন একটা খচমচ শব্দে চমকে উঠল ও। শব্দটা যেন মেঝের কাছাকাছি কোথাও থেকে আসছে। তবে কি বিছানার তলায় সাপখোপ কিছু ঢুকল? ভয়ে ভয়ে মাত্র টর্চটা ফোকাস করতে যাচ্ছিল ভোতন, আর তখনই ঘটল সেই তাজ্জব ঘটনাটা।
বিছানার সামনে মেঝে ফুঁড়ে একটা সবজেটে আলোর দলা যেন ঠেলে বেরিয়ে এল হঠাৎ। বুকটা ধড়াস করে উঠল ভোতনের। ভয়ে হাত-পা হিম হয়ে আসছিল। এতটাই ঘাবড়ে গেছিল ও যে গলা দিয়ে চিৎকারটাও বেরোল না। কী হচ্ছে এসব? ভূত? নাকি… ভোতন একেবারে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে তাকিয়ে ছিল ওই মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা আলোটার দিকে। এমনকি চিৎকার করতেও বোধহয় ভুলে গেছিল।
কিন্তু এ কী! এ তো আলো নয়! হাত দেড়েক লম্বা একটা আজব জীব। গায়ের রং উজ্জ্বল সবুজ, আলো বেরোচ্ছে। ড্যাবা ড্যাবা কালো দুটো চোখ, দেখলে মনে হয় যেন পালিশ করা কষ্টিপাথর। মানুষের মতো দুটো লিকলিকে হাত, দুটো পা, নাকের বদলে দুটো আর মুখের জায়গায় একখানা ফুটো, মাথায় কচুর ডাঁটার মতো সরু কী একটা যেন এদিক ওদিক নড়ছে। কান বলে কোনও বস্তুই নেই!
“ক-ক্কে, কে?” ভয়ে গলাটা যেন জড়িয়ে আসছিল ভোতনের।
সেই অদ্ভুত দেখতে জীবটা কিছুক্ষণ চুপটি করে তাকিয়ে রইল ভোতনের দিকে। তারপর খসখসে গলায় একেবারে দিব্যি পরিষ্কার বাংলায় বলল, “ভয় পেয়ো না, আমি কিছু করব না। তোমার নাম ভোতন?”
ভোতন এখনও কথা বলার মতো অবস্থায় নেই, শুধু মাথা নাড়ল।
“আমি জুকুইজো ১০৭৮। হুকুসিয়াস গ্রহ থেকে আসছি। মানে তোমাদের ভাষায় বললে ভিনগ্রহী।”
চোখদুটো আরও গোল গোল হয়ে উঠল ভোতনের। “মা-মানে এলিয়েন!”
“হ্যাঁ। তোমাদের গ্রহের ইংরেজি ভাষায় বোধহয় ওটাই বলে। আসলে একটু আগে যে বাজ পড়ার শব্দ পেয়েছিলে সেটা আমারই মহাকাশযানের শব্দ ছিল। পৃথিবীর আয়নোস্ফিয়ার দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ এই ঘরের ভেতর থেকে কিছু উচ্চ কম্পাঙ্কের তরঙ্গ এসে আমার অ্যান্টেনায় ধরা পড়ল। এধরনের তরঙ্গ সাধারণত আমাদের গ্রহে কেউ যখন বিপদে পড়ে তখন সাহায্যের জন্যে অন্যকে ডাকতে ব্যবহার করে।”
একটু থেমে সেই ভিনগ্রহী আবার বলতে লাগল, “কিন্তু তখন বেশ অবাকই হয়ে গেছিলাম। এখানে এই ঘরের ভেতর আমাদের গ্রহের কেউ কোত্থেকে আসবে! এলে তো আমার জানার কথা। তাই তাড়াতাড়ি মাটিতে নেমে সোজা ঢুকে পড়লাম এখানে। দরজা বন্ধ ছিল, অগত্যা মাটি ফুঁড়ে…”
“কি-কিন্তু এখানে তো আমি ছাড়া আর কেউ নেই!” এতক্ষণে আস্তে আস্তে নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছিল ভোতন।
“হুম, জানি। ব্যাপারটা প্রথমে আমিও ঠিক ধরতে পারছিলাম না। তবে কিছুক্ষণ তোমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর সবটা খোলসা হয়ে গেল। মনটা পড়ে ফেললাম তোমার। তুমি ঘুমের মধ্যে কিছু একটা দুঃস্বপ্ন দেখছিলে, তাই তো?”
“হ্যাঁ, কিন্তু মানে ইয়ে তুমি কী করে…”
“তোমার ভয়ের মানসিক তরঙ্গ এত চড়া ছিল যে সেটা প্রায় আমাদের যোগাযোগ তরঙ্গের সঙ্গে মিলে গেছিল। আর তাই আমিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিলাম।” বলতে বলতে সেই সবুজ ভিনগ্রহীর গলা দিয়ে খুকখুক করে একটা বিদঘুটে আওয়াজ বেরিয়ে এল। সম্ভবত হাসল ও। তারপর একটু সময় ভোতনকে আবার ভালো করে দেখে নিয়ে বেশ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “যদি কিছু মনে না করো, তবে জানতে পারি কি যে কী এমন ভয়ানক স্বপ্ন দেখছিলে যে একেবারে আমাদের কম্পাঙ্কে পৌঁছে গেলে?”
ভোতনের মন থেকে আস্তে আস্তে এই সবুজ মানুষটার প্রতি ভয়-ভয় ভাবটা আপনা থেকেই যেন সরে যাচ্ছিল। লোকটা ভিনগ্রহী হলেও মন্দ নয়, বেশ মিশুকে। ভোতন ওর দিকে সামান্য এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “পরীক্ষা!”
“পরীক্ষা! কীসের?”
“স্কুলের। অ্যানুয়েল। কাল থেকে শুরু।”
“তো? পড়োনি বুঝি?” সেই ভিনগ্রহীটা এমনভাবে ঘাড় বেঁকিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করল যে ভোতনের একেবারে মিহির স্যারের মুখটা মনে পড়ে গেল।
“মোটেই না। সব পড়েছি।”
“তাহলে?”
“জানি না। পরীক্ষায় বসলেই আমার কেমন যেন ভয়-ভয় করে। সব এলোমেলো হয়ে যায়। তখন জানা প্রশ্নগুলোও লিখে আসতে পারি না। মনে হয় সব যেন হিব্রু-ল্যাটিন ভাষায় লেখা! অথচ জানো, প্রতিটা প্রশ্ন আমার কমন।”
“হুম।” তিড়বিড় করে ডাইনে-বাঁয়ে দুলে উঠল ভিনগ্রহীর মাথার অ্যান্টেনাটা। “বুঝলাম, সবই বুঝলাম। আচ্ছা, একটা খেলা খেলবে?”
“খেলা! এখন? কী খেলা?” সেই ভিনগ্রহীর আরও কাছ ঘেঁষে এগিয়ে গেল ভোতন।
“পরীক্ষা-পরীক্ষা খেলা।” এক লাফে বিছানায় চড়ে বসল সেই সবজেটে মানুষটা। একেবারে ভোতনের মুখোমুখি। “কী হল, বুঝতে পারলে না?”
ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দু’পাশে ঘাড় নাড়ল ভোতন।
“বলছি, শোনো। তেমন কঠিন কিছু নয়, আমি তোমাকে খাতা আর প্রশ্নপত্র দেব, তুমি বসে পরীক্ষা দেবে। ঠিক স্কুলে যেমনটা দাও। তিন ঘণ্টা সময়।”
একটু অবাক হলেও বেশ মজাই লাগছিল ভোতনের। কোন এক নাম-না-জানা গ্রহের এক সবুজ মানুষ মাঝরাতে ওর ঘরে এসে বলছে কিনা স্কুলের মতো বসে পরীক্ষা দাও! পরীক্ষার নাম শুনলেই ভোতনের বুক ধড়ফড় করে ঠিকই, কিন্তু এটা তো আর সত্যিকারের পরীক্ষা নয়। নিজের ঘরে বসে পরীক্ষা-পরীক্ষা খেলা।
“ঠিক আছে, আপত্তি নেই। দেখি কেমন খেলা।” বলতে বলতে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে টেবিলে গিয়ে বসল ভোতন। হাতে কলম নিয়ে তৈরি। আসল পরীক্ষাগুলোও যদি এমন খেলা হত!
সেই ভিনগ্রহী জুকুইজো কিছুক্ষণ চুপ করে ওপর দিকে তাকিয়ে রইল। ওর মাথার অ্যান্টেনাটা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ভোতন অবাক হয়ে দেখল যে জুকুইজোর হাতে ম্যাজিকের মতো কোত্থেকে যেন হুঁশ করে একটা খাতা আর প্রশ্নপত্র এসে হাজির হল।
“আরিব্বাস! এ যে একেবারে আমাদের স্কুলের পরীক্ষার খাতা আর কোশ্চেন পেপারের মতো! ওপরে স্কুলের নামটাও লেখা!” জিনিসদুটো হাতে নিতে গিয়ে আপনা থেকেই যেন কথাগুলো বেরিয়ে এল ভোতনের মুখ দিয়ে।
“হ্যাঁ। এটা বাংলার প্রশ্ন। কাল তো তোমার বাংলা পরীক্ষা, তাই না? নাও, এবার শুরু কর। ঠিক তিন ঘণ্টা পরে আমি খাতা নিয়ে নেব। ধরে নাও, আমিই এখন তোমার মিহির স্যার।” জুকুইজো এমন সুরে কথাগুলো বলল যে ভোতন বেচারা আর হাসি সামলাতে পারল না।
যাই হোক, এবার পরীক্ষা-পরীক্ষা খেলা শুরু হল। যথারীতি এখানেও ভোতনের সব প্রশ্নই জানা। তরতর করে উত্তর লিখে চলেছে সে। প্রথমে ছোটো প্রশ্ন, তারপর মাঝারিগুলো, আর সব শেষে ব্যাখ্যামূলক। দু’বার জুকুইজোর কাছ থেকে কাগজও চেয়ে নিয়েছে ভোতন। খেলাটা সত্যিই ভারি মজার! পরীক্ষার হল নেই, চারপাশে কেউ নেই, ঘণ্টার ঢং ঢং নেই, স্যারদের তর্জন গর্জন নেই… উফ্, এটাই যদি আসল পরীক্ষা হত তবে এবার ভোতনের ফার্স্ট হওয়া আটকায় কে!
লেখা শেষ করে সবে কথাগুলো ভাবছিল ভোতন, তখনই হঠাৎ একটা পরিচিত গলা শুনে যেন চমকে উঠল ও। “এই ভোতন, সময় কিন্তু প্রায় শেষ। এক্সট্রা শিটগুলো বেঁধে ফেল ঝটপট। ঘণ্টা বাজলে একমিনিটও বাড়তি দেব না আমি।”
এ যে মিহির স্যার! খাতা থেকে মুখ তুলতেই ভোতনের পায়ের তলার মাটিটা যেন এক ঝটকায় সরে গেল। এ কিছুতেই সত্যি হতে পারে না! ও নিজের স্কুলে পরীক্ষার হলে বসে আছে, চারপাশে ওরই সব বন্ধুবান্ধব, পরীক্ষা দিচ্ছে। আর সামনে মিহির স্যার। বাইরে রোদ্দুরমাখা ঝলমলে দিন।
“আ-আমি তো নিজের ঘরে ছিলাম। রাতের বেলা। এখন দিন… এখানে… স্কুলে… মানে…” বোকার মতো এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বিড়বিড় করে উঠল ভোতন। তবে কি সেসব স্বপ্ন ছিল? কিন্তু তা কী করে হয়? ও তো ভয় না পেয়ে আস্ত একটা পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছে আজকে! জীবনে প্রথমবার।
এমনসময় হঠাৎ কে যেন বারান্দা থেকে শিস দিয়ে উঠল। বাইরে তাকাতেই আবার চমকে গেল ভোতন। সেই ভিনগ্রহী জুকুইজো। তড়িঘড়ি খাতা জমা দিয়েই সোজা ওর সামনে এসে দাঁড়াল সে। “এসব কী হচ্ছে? আমি তো নিজের ঘরে ছিলাম। এখানে কী করে…”
খুক খুক করে হাসল জুকুইজো। “ম্যাজিক!”
“ম্যাজিক?”
“হ্যাঁ, ভয় না পাওয়ার ম্যাজিক। তুমি পরীক্ষাকে ভয় পাও না ভোতন, তুমি ভয় পাও নিজের চারপাশটাকে। একই পরীক্ষা, একই প্রশ্ন যখন বাড়িতে বসে লিখছিলে একফোঁটা ভয় ছিল না তোমার মনে। অথচ এই একই জিনিস স্কুলে বসে করবার বেলায় তুমি অকারণে ঘাবড়ে যাও।”
“হ্যাঁ, মানে, সেটা ঠিক। আজ জীবনে প্রথমবার পুরো প্রশ্নের উত্তর করলাম পরীক্ষায়।”
ভোতনের মুখজোড়া তৃপ্তির হাসিটা চোখ এড়াল না জুকুইজোর। মাথার অ্যান্টেনাটা দু’পাশে দুলিয়ে বলল, “আমাদের চারপাশে আমরা যা দেখতে পাই সবই আমাদের মনের খেলা। রাতের অন্ধকারে যাকে সাপ ভেবে ভয় পাও, দিনের আলোতে দেখা যায় যে সেটা আসলে একটা সামান্য দড়ি। তেমনই ভয়টা পরীক্ষা বা পরীক্ষার হল নিয়ে নয়, ভয়টা তোমার মনে। আজ থেকে সেই ভয়কেই জয় করার ম্যাজিক শিখিয়ে গেলাম তোমাকে। যখনই পরীক্ষা দিতে হলে ঢুকবে, মনে মনে ভাববে তুমি তোমার নিজের ঘরে বসে আমার সঙ্গে পরীক্ষা-পরীক্ষা খেলছ। দেখবে চারপাশ থেকে সব উধাও হয়ে সত্যি সত্যি সেই দৃশ্যই ভেসে উঠবে তোমার চোখের সামনে। মনেই হবে না যে পরীক্ষা দিচ্ছ!”
“কিন্তু তুমি…”
“এই ভোতন, ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস? আজ আবার ফাঁকা খাতা দিয়ে এলি বুঝি?” হঠাৎ অমিতের ডাকে থতমত খেয়ে পেছন ফিরল ভোতন। পরীক্ষা শেষ। ঘণ্টা বেজে গেছে। এক এক করে বেরিয়ে আসছে সবাই।
“না না, কিছু না। এই একটু জুকুইজোর সঙ্গে…” কিন্তু সামনে তাকাতেই থমকে গেল ভোতন। কেউ তো নেই! কোথায় জুকুইজো? এদিক ওদিক তাকাল, কিন্তু কোত্থাও চোখে পড়ল না। শুধু ওর মনের ভেতর থেকে কে যেন ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘ম্যাজিক!’
অলঙ্করণঃ মৌসুমী
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস