দ্বৈতা হাজরা গোস্বামীর আগের গল্প -লিলিয়া আর চার পুতুলের গল্প
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
এক যে ছিল তালপাতার সেপাই।
যুদ্ধে যাওয়ার বড্ড ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু তার গড়ন দেখে কেউ তাকে যুদ্ধে নিয়ে যেত না। পাহারাতেও রাখত না।
সবাই ছড়া কেটে বলত
-“তালপাতার সেপাই
কাক-পক্ষী ঠুকরে খাবে
বাতাস দিলেই উড়ে যাবে
আগুন দিলে পুড়েই হবে ছাই”
মনের দুঃখে তালপাতার সেপাই বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। অনেকদূর হেঁটে হেঁটে তার একটা পা আলগা হয়ে খুলে গেল। সেই পা বগলদাবা করে যেতে যেতে একটা বড় পাথরে হোঁচট খেয়ে সে মাটিতে পড়ে গেল।
মনে হল তার শেষদিন ঘনিয়ে এসেছে। চোখে অন্ধকার দেখল সে।
সেইসময় জঙ্গলে এক ঘুঁটেকুড়ুনি, কাঠকুড়ুনি বুড়ি যাচ্ছিল। তার খুব মায়া হল তালপাতার সেপাইকে দেখে। সে তাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে মোটা ছুঁচ সুতো দিয়ে আবার আগের মতো সেলাই করে দিল।
কিছুদিনের মধ্যে তালপাতার সেপাই দিব্যি চাঙ্গা হয়ে উঠল। হাওয়ায় হাত পা নাড়িয়ে সে আনন্দে নাচ করতে লাগল। বুড়ি বলল, “রয়েসয়ে বাপু , খানিক সবুর করো রোজ ছাতু মাখা ভাত খাও , দুধ , ডিম্ খাও। তার পর।”
বুড়ি তাকে রোজ কাঁচা পেয়াঁজ , কাঁচা লঙ্কা ছাতুমাখা পান্তা খাওয়ায়।
বুড়ি বলে, “লঙ্কা খেলে সাহস মেলে
পেঁয়াজে তেজ বাড়ে
রোজ সকালে পান্তা খেলে
সকল ব্যারাম সারে “
আর তালপাতার সেপাই বুড়ির ঘর পাহারা দেয়। যাতে শেয়াল না ঢোকে , চোর ডাকাত না আসে।
অবশ্য বুড়ির ঘরে সে-রকম কিছু নেই।
একটা কাঠের বাক্স আছে। তার মধ্যে কী আছে, জিজ্ঞেস করলেই বুড়ি ফোকলা দাঁতে হেসে বলে অরূপ রতন ধন আছে গো আমার রূপনগরের নাতনীর।
একবার বুড়ি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ল। তালপাতার সেপাই কে ডেকে বলল, “শোনো বাছা আমার হাতে বেশিদিন সময় নেই মনে হচ্ছে। তুমি একটা কাজ করে দেবে আমার জন্য? আমার নাতনীকে ওই কাঠের বাক্সটা দিয়ে আসবে?”
তালপাতার সেপাই বলল,”আমি চলে গেলে তোমাকে কে দেখবে?”
“আমি ঠিক থাকব। কিন্তু নাতনীকে এটা না দিলে আমি শান্তি পাব না।”
সেপাই তখন বাক্স বগলে হাঁটতে শুরু করল। তিনদিন তিনরাত্রির পথ। পথে পড়ল একটা জঙ্গল। সেখানে থাকত ভয়ঙ্কর সব ডাকাতেরা। ওই কাঠের বাক্স বগলে সেপাইকে যেতে দেখে তারা দল বেঁধে তাড়া করল তাকে।
তাদের হাতে জ্বলন্ত মশাল। শেষ পর্যন্ত আগুন ধরিয়ে দিল সেপাই এর পায়ে। সেই আগুন নিয়ে ছুটতে ছুটতে অন্ধকারে একটা পাহাড়ি নদীর জলে ঝাঁপ দিল তালপাতার সেপাই।
জলের স্রোতে ভাসতে ভাসতে চলল অনেকদূর। তবু বাক্সটা হাতছাড়া করেনি সে।
সকালবেলা একটা জায়গায় তার ঘুম ভাঙল। বাক্সটা খুলে গিয়েছে। তার মধ্যে শুধু খেলনাপাতি ছাড়া কিছুই নেই। এই বুঝি অরূপরতন ধন! তবু বুড়িমা কে যখন কথা দিয়েছে তখন সে কথা রাখতেই হবে। পোড়া পা দুটোয় চলতে কষ্ট। তাই বাক্সটা পিঠের সঙ্গে বেঁধে হামাগুড়ি দিয়ে অনেক পথ পার হল সে।
শেষ পর্যন্ত রূপনগরে এসে পৌঁছল সে। রংবেরঙের একতলা দোতলা বাড়ি , রাস্তাগুলো ঢেউখেলানো। ফুলের ভারে নুয়ে পড়ছে গাছ।
সেপাইকে ওই ভাবে হামাগুড়ি দিতে দেখে সেখানকার লোকজনের ভারী কষ্ট হল। তারা তাকে সেখানকার রাজবাড়িতে পৌঁছে দিল। রাজবাড়িতে গিয়ে তো তার চক্ষুস্থির। সেই জঙ্গলের বুড়িমা এখানে কী করে এলো? বুড়িমা হেসে বলল, “এটা মায়ানগরী। আমরা সবাই এখানে জাদু বিদ্যা জানি। আমি, আমার ছেলে , আমার নাতনী। তোমাকে জঙ্গলের মধ্যে দেখে আমার খুব মায়া পড়ে গিয়েছিল তাই তোমাকে সুস্থ করে তুলে একটু পরীক্ষা করছিলাম। দেখছিলাম তুমি কত সাহসী। এখন আমি নিশ্চিন্ত। শরীরের জোরের থেকে অনেক বড় হলো মনের জোর বুঝলে বাছা।”
এই বলে বুড়িমা সেপাইয়ের পোড়া পাগুলো ঠিক করে দিল মন্ত্র পড়ে। কাঠের বাক্সটা খুলে বুড়িমা পুতুলগুলো বের করে তাদের জীবন্ত করে দিল। আরও যত হাতি ঘোড়া ছিল সেই বাক্সের মধ্যে সব কিছু। তার পর বলল, “এই নাও তোমার সেনাবাহিনী। আর তুমি আজ থেকে সেনাপতি।”
তারপর তো ডুম ডুম করে বাদ্যি বেজে উঠল , সবাই হাততালি দিল। সবাই গেয়ে উঠল,
“কেমন বীর , কেমন বীর
তালপাতার সেপাই
ভয় নেই মনে একরত্তি
বুক ফুলিয়ে হাঁটছে সত্যি
বাঘ-ভাল্লুক দানো বা দত্যি
সবাই ভয় যে পায়।”
———————————————-
সঙ্গের ছবির তালপাতার সেপাই সম্পাদকের বাড়ির বাসিন্দা। বহু বছর আগে একবার সে জয়ঢাকের মলাটে এসেছিল। আজ ফের তার ডাক পড়ল জয়ঢাকের পাতায়।–সম্পাদক
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প-উপন্যাস
বাহ্ বাহ্…এরকম লেখা দ্বৈতাদিই লিখতে পারে
LikeLike