এক
মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে ডানদিকে বড়ো কাপড়ের দোকানটা পেরোতেই দেবাংশু দেখলেন, শরবতওয়ালার ঠেলাগাড়ির সামনে আজও কিছু অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের জটলা। লোকটা প্ৰতিদিনই হরেক কিসিমের শরবত আর প্লাস্টিকের গ্লাস নিয়ে বসে। তিরিশ বছর ধরে এই অঞ্চলে তার একাধিপত্যে অন্য কোনও সফট ড্রিঙ্ক থাবা বসাতে তো পারেইনি, বরং অদ্ভুতভাবে বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে।
কিন্তু কালের নিয়মে দু’চাকা-চার চাকার বিদঘুটে হর্নের শব্দে মিলিয়ে যায় ছোট্ট ঠেলাগাড়ির টিং টিং ধ্বনি। রাস্তার ধুলো ঢেকে দিয়ে যায় বৃদ্ধের মুখ। তবুও পাড়ার আরও অনেকের মতোই ওই অমৃতসমান শরবতের টানে বারবার ছুটে যান দেবাংশু। গিন্নি ক্রমাগত ব্লাড সুগারের ভয় দেখিয়ে যান, কিন্তু সেসবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শরবতওয়ালার পকেট ক্রমশ ভারী হতে থাকে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে লোকটার মতো একইরকম দেখতে একটু কমবয়সী একটা ছেলেকে শরবত নিয়ে বসতে দেখা যাচ্ছে। ওর ছেলে হবে হয়তো। তারপর থেকে এই ছেলেমেয়েগুলোর ভিড়টা বেড়েছে। অন্যদিন হলে তিনিও খেতেন। কিন্তু আজ বাড়ি ফিরতে দেরি হবে বলে দেবাংশু আর ওদিক মাড়ালেন না।
এখন বেলা তিনটে। নিউজে দেখিয়েছে, আজ তেতাল্লিশ ডিগ্রি টেম্পারেচার! গত দশদিন ধরে বরুণদেবের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সূর্যদেব শহরবাসীকে নরক দর্শন করিয়ে ছেড়েছেন। শহরবাসী মনে মনে প্রার্থনা করছে, বৃষ্টি নামা, নইলে কিচ্ছু মিলছে না।
কলিং বেল বাজাতেই মেয়ে শিঞ্জিনী এসে হাসিমুখে দরজা খুলল। তার কলেজে সেমিস্টার শেষ হওয়া মাত্রই সে তার ছেলে চিরন্তনকে নিয়ে বাপের বাড়ি এসেছে৷ বড্ড বিচ্ছু সে। আসামাত্রই বাড়িতে হইচই ফেলে দিয়েছে। সন্ধে হলেই দিদুনকে টিভির সামনে থেকে তোলা যায় না কেন, দাদানের আলমারির মোটা মোটা বইয়ে কী লেখা আছে, মামাই তাকে সিনেমার হিরো করে না কেন, সব তার জানা চাই। দেবাংশু ফিরতেই সে একেবারে লাফ দিয়ে উঠল, “দাদান, তুমি হোমওয়ার্ক জমা দিতে গিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ গো টিটোবাবু, সেই কাজ সেরেই আসছি।” কপালের ঘাম মুছে বললেন তিনি।
“আমিও তোমার মতো হোমওয়ার্ক করেছি৷ এই দেখো।” বলে আঁকার খাতা খুলল টিটো ওরফে চিরন্তন৷
শিঞ্জিনী রেগে গিয়ে বলল, “এখন দাদানকে ছাড়ো, টিটো। বাবা, আগে স্নান করে এসো তো। যা গরম!”
টিটোকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শিঞ্জিনী ছেলের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল৷ অমনি একটা দড়াম করে শব্দ! এই রে, আবার কী ভাঙল? সুরশ্রী তো তুলকালাম করে ছাড়বেন এবার!
“দেখ মিমি, তোর বাবার কাণ্ডজ্ঞানটা একবার দেখ! টেবিলের কোনায় ফুলদানি রাখলে ভাঙবে না? যতসব হাবিজাবি জিনিস ফুটপাত থেকে কিনে এনে ডাঁই করে রেখেছে! লোকের বাগানের শখ হয়, গান শোনার শখ হয়, আর এঁকে দেখো! শখ কী? না, ফুটপাতের জিনিস কেনা। মানুষ পর্যন্ত থাকার উপায় নেই এই বাড়িতে৷ উফ্ ভগবান, কেমন মানুষকে নিয়ে ঘর করি আমি!”
দূর থেকে গিন্নির বক্তৃতা শুনতে লাগলেন দেবাংশু, সামনে যাবার ঠিক সাহস জোগাল না। ভাবলেন, সুরশ্রী সপ্তমে সুর চড়াবার আগেই মানে মানে বাথরুমে ঢুকে যাওয়া ভালো।
দুই
বাঙালি কিশোর বয়সে কিছু করুক বা না করুক, সাহিত্যচর্চা করবেই। অনেকের ক্ষেত্রে সেটা হয়তো যুবা বয়স পর্যন্ত গিয়ে পড়াশোনা বা অন্নসংস্থানের চিন্তায় বন্ধ হয়ে যায়, আবার কেউ শত বাধা সত্ত্বেও মনের তাগিদে চালিয়ে যান৷ তাঁদের মধ্যে খুব কম মানুষ স্বীকৃতি পান জীবনের একটা অধ্যায়ে। দেবাংশুও সেই বাদ পড়া মানুষের ভিড়ে থেকে যেতেন যদি না গিরীশ বসাকের মতো এক দুর্লভ প্রজাতির স্বার্থহীন মানুষ আসতেন তাঁর জীবনে।
তখন তিনি মধ্য তিরিশ। ছেলেমেয়েরা স্কুলপড়ুয়া। আর পাঁচজনের মতো ইংলিশ মিডিয়ামে পাঠাননি তাদের। তাঁর ইচ্ছে ছিল, জীবনের শুরুটা মাতৃভাষা দিয়েই হোক। তাই শিঞ্জিনী-মল্লারের স্কুল-ব্যাগের বোঝাও ছিল হালকা। রাত্রে খাবার পরে বাবার কাছে বসে শিকার, রহস্য, ভূতের গল্প শুনতে শুনতে চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যাওয়া, তারপর আস্তে আস্তে ঘুমের দেশে হারিয়ে যাওয়া, পরের দিন বই কাড়াকাড়ি করে গল্পের শেষটুকু পড়ে নেওয়া, এসবই ছিল তাদের রোজকার রুটিন।
এভাবে গল্প শোনাতে শোনাতে একসময় নিজেই বানিয়ে গল্প বলা শুরু করেন দেবাংশু৷ তেমনই একদিন অফিসের টিফিন আওয়ারে একটা গল্পের প্লট মাথায় এল। হাতের কাছে একটা কাগজ পেয়ে তাতেই প্লটটা ছকে রাখলেন। ঘটনাটা ঘটল ঠিক তার দিন তিনেক বাদেই।
বড়সাহেবের চেম্বার থেকে বেরিয়ে গিরীশ দেবাংশুর ডেস্কে এলেন। দু’জনের একই পোস্টে চাকরি, সেই সুবাদে সহকর্মীর থেকেও হৃদ্যতার সম্পর্ক বেশি। সোজাসুজি তাঁর দিকে তাকিয়ে গিরীশ বললেন, “আজ আরেকটু হলেই তোর জন্য স্যারের কাছে বকুনি খেতাম, জানিস?”
“কেন? আমি তো সব ঠিক সময়েই জমা দিয়েছি। তাহলে?” একটু অবাক হলেন দেবাংশু।
“এটা যদি ফাইলটার সঙ্গে যেত, কী হত বল তো?” বলে গিরীশ পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করলেন।
“এটা তো সেই…” দেবাংশুর কথা কেড়ে নিয়ে বললেন গিরীশ, “একটা গল্পের খসড়া। ফাইলের সঙ্গে কোনোভাবে চলে এসেছিল। ভাগ্যিস ওটা আমার চোখে পড়েছিল। তোর হাতের লেখা গোটা অফিস চেনে। বড়সাহেবের চোখে পড়লে কী হত ভাব!” তারপর একটু হেসে বললেন, “চুলকানি, ভুঁড়ি আর প্রতিভা লুকিয়ে রাখা যায় না, বুঝলি? কোনও ম্যাগাজিনে এবার লেখাগুলো পাঠা।”
“পাগল নাকি? পাঠালেই হল? ছেলেভোলানো গল্প এক, পত্রিকায় লেখা অন্য জিনিস।”
“বেশি কথা না বলে যা বললাম শোন। ড্রাফটটা পড়েই বলছি, এ-জিনিস ছাপা উচিত। তুই লেখ, পাঠানোর দায়িত্ব আমার।”
বলা যায়, এরপর গিরীশের উৎসাহেই একের পর এক লেখা। পছন্দ হত না, ছিঁড়ে ফেলতেন, আবার লিখতেন। কখনও নিজের মনের মতো হলেও সম্পাদক রিজেক্ট করতেন। বারবার হতাশ হয়ে ছেড়ে দিতেন খাতা-কলম। সে সময় গিরীশ এসে হাল ধরতেন। আবার তাঁর কলম জন্ম দিত নতুন এক গল্পের।
বহু প্ৰতীক্ষার পর একদিন শিকে ছিঁড়ল। ছোটোদের বিখ্যাত পত্রিকা ‘হাসিরাশি’-তে প্রথম তাঁর একটি গল্প ছাপা হল। আজ অনেক বছর হল, দেবাংশু বিশ্বাসকে কিশোর সাহিত্যের পাঠকরা একডাকে চেনেন। কিন্তু যাঁর চেষ্টায় এত কিছু সেই গিরীশ বইপাড়ায় দেবাংশুর রাজত্ব সাজিয়ে দিয়ে দু’বছর আগে তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন।
এই বছর চারখানা পত্রিকা পূজাবার্ষিকীর লেখা চেয়েছিল৷ বরাবর মেট্রোয় করে কলেজ স্ট্রিটে পত্রিকা দপ্তরে লেখা জমা দিতে যান তিনি। আজও গিয়েছিলেন। মল্লার আপত্তি করে, “মেল করে দাও না কেন? আর যদি গিয়েই দিতে হয়, ক্যাব ডেকে নিও।”
সে-সবের ধার ধারেননি দেবাংশু। যেদিন তাঁর নাম কেউ জানত না, সেদিনের মতোই নিজেকে রাখার চেষ্টা করেন। কিছু স্বঘোষিত সাহিত্যিকের অহংকারের চেয়ে তাঁর অহংকারের মাত্রাটা তুলনামূলকভাবে কম। এজন্য খ্যাতির স্বাদ পেতে বেশ অনেকটাই দেরি হয়েছে। তবুও সমসাময়িক লেখকদের চেয়ে বইপাড়া দেবাংশু বিশ্বাসের মুখ একটু বেশিই চেনে।
তিন
একই সঙ্গে কল্পবিজ্ঞান, ভূত, অ্যাডভেঞ্চার আর হাসির গল্প লেখা কি চাট্টিখানি কথা! এর মধ্যে কল্পবিজ্ঞানটা লিখতে সবচেয়ে বেশি পড়াশোনা করতে হয়েছে। মস্তিষ্কের পরিশ্রমও হয়েছে অনেক। এবার মনে হচ্ছে কোথাও একটা ঘুরে আসা দরকার। আপন মনে ভাবতে ভাবতে শাওয়ার খুললেন তিনি। কৃত্রিম ঝরনার ঝিরঝিরে জলে শান্ত করতে চাইলেন সূর্য-তাপে দগ্ধ শরীর।
কোথায় যাওয়া যায়? সুরশ্রীর জোরাজুরিতে পুরী, হরিদ্বার, বৃন্দাবন ইত্যাদি বেশ কিছু ধর্মস্থানে সপরিবারে বেড়ানো হয়েছে। কিন্তু আর নয়। এবার তিনি পাহাড়ের কাছে ফিরবেন। মনের সমস্ত ময়লা ফেলে আসবেন সেখানে। দেবাংশু দেখেছেন, যখনই পাহাড়ে ছুটে গেছেন, শান্তির আশ্রয় দিতে এতটুকু কার্পণ্য করেনি সে।
এসব ভাবতে ভাবতে ঘাড়ের কাছে হাত ঠেকালেন দেবাংশু। আঙুলে যেন কী একটা লাগল। ওই সাবানমাখা হাতই চোখের সামনে এনে দেখলেন, ঘন নীল রঙের চামড়ার মতো কিছু একটা লেগে আছে। এ কী! নীল রঙের জিনিসটা আবার কোত্থেকে এল! বাড়ি রঙও তো করা হয়নি যে গায়ে লেগে যাবে। তাছাড়া ওই রং সাবানে যাবার নয়। এক তার্পিন তেল ছাড়া কারোর সাধ্য নেই যে ওই রং তুলবে। নিজেকে বোঝালেন দেবাংশু, ‘একটু রঙই তো লেগেছে। ও ধুলেই চলে যাবে।’
কিন্তু না, একটু নয়। সারা গায়ে যত সাবান বোলাতে লাগলেন তিনি, ততই মাছের আঁশের মতো ছোটো ছোটো নীল রঙের চামড়া উঠতে লাগল। এবার সত্যি সত্যি তাঁর ভয় করতে লাগল। কোনও চর্মরোগ হল না তো! এখন যত অচেনা অজানা রোগ হচ্ছে বিশ্ব জুড়ে, বিজ্ঞানী বা ডাক্তাররা যার নামই শোনেননি। কিন্তু এসব হলে তাঁর ট্রিটমেন্টই বা হবে কীভাবে? এরকম অদ্ভুত রোগ সারানোর জন্য কোন ডার্মাটোলজিস্ট আছেন? শীতকালে অনেক সময় চামড়া ওঠে, কিন্তু তা তো বাতাসে জলীয় বাষ্পের অনুপস্থিতির কারণে। আর এটা তো জুনের মাঝামাঝি। বাতাসে আর্দ্রতার জন্যই এত গরম। তাহলে?
স্নান সেরে চুল আঁচড়াতে গিয়ে দেবাংশু আর নীল চামড়া দেখতে পেলেন না। হয়তো এখন দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু পরে তো দেখা যেতেই পারে।
হঠাৎ তাঁর মনে হল, শরবতের দোকানে আগে কমবয়সীরা এত ঘন ঘন যেত না। নতুন ছেলেটা দোকানের দায়িত্ব নেবার পর থেকে ভিড়টা বেড়েছে। তাহলে কি সে শরবতে কোনও রং মেশাচ্ছে, যার জন্য স্বাদও বদলে গেছে আর ওরা তাতে আকর্ষিত হচ্ছে? হয়তো সেই রঙের প্রভাবেই তাঁর এমন অবস্থা। তিনি তো অনেকদিনের খদ্দের। তাহলে তাঁর ওপর এই এফেক্ট সবচেয়ে বেশি পড়বে। ভাবতে ভাবতে ড্রয়িংরুমে এসে বসলেন তিনি।
শিঞ্জিনী টিভিতে নিউজ দেখছিল। সে বলল, “বাবা বোসো। আমি একটু ভেতরে গিয়ে দেখি টিটোটা আবার কী করছে।”
‘নমস্কার, আপনারা দেখছেন খবর এখন। আপনাদের সঙ্গে আমি ধীমান। আজ গড়পারে ইপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাষট্টি বছরের এক বৃদ্ধ তপন বসুর মৃত্যু হয়েছে। মৃতের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, কিছুদিন ধরে তাঁর ত্বকে কালচে দাগ দেখা যাচ্ছিল। তপনবাবু তাতে কোনও ব্যথা অনুভব করেননি। দুইদিন আগে প্রবল জ্বরের কবলে পড়ে আজ বেলা দশটায় তাঁর মৃত্যু হয়।’
দেবাংশুর বুক কাঁপতে লাগল। গায়ে কালচে ছোপ? হয়তো ওরা সেভাবে খেয়াল করেনি। গাঢ় নীলকে কালচে ভেবে ভুল করেছে। আজ ‘সব ভূতুড়ে’-এর সম্পাদক তাঁকে তার বাড়ি গড়পারে নিয়ে গিয়েছিল। তখন দেখেছিলেন একটা বাড়ির সামনে বেশ ভিড়। তারপর থেকেই শরীরটা যেন একটু জ্বর জ্বর লাগছিল। তবে কি…
‘বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ইপা একপ্রকার বায়ুবাহিত ভাইরাস। আক্রান্ত ব্যক্তির দুশো মিটার দূরত্বের মধ্যে যে কেউ, বিশেষত শিশু ও বৃদ্ধরা থাকলে সংক্রমণের প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে। এই রোগে মৃত্যুর হার প্রায় সত্তর শতাংশ। এখনও এর কোনও প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি।’
“টিটো!” বিদ্যুৎচমকের মতো ছোট্ট প্রাণোচ্ছল মুখটা ভেসে উঠল দেবাংশুর মনে।
“কী হল? এত জোরে চিৎকার করলে কেন?” সুরশ্রী বেরিয়ে এসে আতঙ্কিত মুখে স্বামীর দিকে তাকালেন।
উত্তেজনায় দেবাংশুর ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠল। ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে লাগলেন। কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছেন তিনি। বাবার চিৎকারে শিঞ্জিনীও ছুটে এল। “কী হয়েছে তোমার?”
সুরশ্রী দেবাংশুকে ধরে সোফায় বসালেন। শিঞ্জিনী বাবাকে জলের গ্লাস এগিয়ে দিল।
সবটুকু জল খেয়ে একটু ধাতস্থ হলেন তিনি। হঠাৎ সুরশ্রী বলে উঠলেন, “এ কি, তোমার যে গা গরম!”
দেবাংশু স্ত্রীর দিকে নিষ্প্রভ হয়ে তাকিয়ে বললেন, “সেটা তো হবারই ছিল।” বলে গড়পার যাওয়া, নীল চামড়া, টিভির খবর সব বিস্তারিতভাবে জানালেন। মেয়ের হাত ধরে বললেন, “দেখ মিমি, ছেলেটাকে নিয়ে সবেমাত্র পরশু এলি। দাদু হয়ে আমি কী করে টিটোকে ফিরে যেতে বলি বল? আমরা তো তোদের আশাতেই বসে থাকি কবে আসবি। তাও বলতে বাধ্য হচ্ছি রে মা, ওকে নিয়ে তুই ফিরে যা।”
সুরশ্রীর চোখ ছলছল করে উঠল৷ নাতি অন্ত প্রাণ তিনি। দেবাংশু যা বলছেন তা শুনলে টিটো বেঁচে যাবে, কিন্তু ওকে তিনি কীভাবে বোঝাবেন? মাত্র তিন বছরের ছেলে। তার স্কুল নেই, টিউশন নেই। ফিরতে চাইবে কেন? মেয়ের মুখের দিকে অসহায়ভাবে তাকালেন তিনি। ওর মাথা বরাবরই ঠাণ্ডা। নিশ্চয়ই কোনও উপায় বের করতে পারবে সে।
এবার মুখ খুলল শিঞ্জিনী, “আমার কথাটা শোনো। আগে অনীকের কাছে চলো। ও কী বলছে শুনি, তারপর দেখা যাবে। আজ সন্ধেয় আমি নিয়ে যাব তোমায়।” তারপর মায়ের দিকে ফিরে বলল, “এখনই ভাইকে বা প্রিয়জিৎকে কিছু বলার দরকার নেই। আমি এসে ফোন করব ওদের।”
মেয়ের জোরাজুরিতে ডক্টর অনীক সেনের বাড়ি গেলেন দেবাংশু। স্কুলের সহপাঠী অনীকের চিকিৎসার ওপর শিঞ্জিনীর অগাধ বিশ্বাস। লম্বা, শ্যামবর্ণ, রিমলেস ফ্রেমের চশমা পরা অনীক তাদের দু’জনকে দেখে হইহই করে উঠল, “আরে শিঞ্জিনী, পথ ভুলে হঠাৎ আমার বাড়িতে?”
“না রে, বাবার একটা প্ৰবলেম হয়েছে। সেই কারণে তোর কাছে আসা।”
“তা তো বটেই। প্রবলেম হলে তবেই না আমার ডাক পড়ে।” অনীক হাসল। “কাকু, এত লেখার চাপে সুগারের সঙ্গে প্রেশারটাও বেড়েছে নাকি? একটু রেস্ট দিন মনটাকে। আমার বৌ আবার আপনার গল্প পেলে সব ভুলে যায়। আপনাকে লিখতে মানা করেছি শুনলে সে আমায় কেটে ফেলবে!”
শিঞ্জিনী একটু সিরিয়াস গলায় বলল, “শোন, আজ বাবা কলেজ স্ট্রিট গিয়েছিল। ওখানে…”
অনীক হাত তুলে তাকে থামিয়ে বলল, “দাঁড়া। কাকুর কাছে গোটা ব্যাপারটা শুনতে চাই। বলুন কাকু, কী সমস্যা।”
দেবাংশু দ্বিতীয়বার সবকথা খুলে বললেন। মন দিয়ে শোনার পর অনীক কিছু রুটিন চেক-আপ করল৷ তারপর বলল, “নীল চামড়ার যে কথাটা বললেন, সেটা ঠিক করে দেখেছেন তো?”
“চশমাটা ছিল না। কিন্তু রং চিনতে ভুল করব না।”
অনীক একটু চিন্তিত হয়ে বলল, “ঠিক আছে। ইপা ভাইরাস হলে জ্বর কমা-বাড়া হয়, বডির সেল কালো হয়ে স্পট পড়ে। টেম্পারেচার খুব বেশি হয়ে গেলে অবশ্য একটা লাইফ রিস্ক থেকে যায়। কিন্তু চামড়া ওঠার ব্যাপারটা তো… সে যাক। ওটা হলে ব্লাড টেস্টে ধরা পড়বে। আমার বাড়ির পেছনে যে প্যাথোলজি ক্লিনিকটা আছে, ওখানে আজ ব্লাড দিয়ে দিন, কাল দুপুরে রিপোর্ট পেয়ে যাবেন। আমি প্রেসক্রিপশন লিখে দিচ্ছি।”
ক্লিনিক থেকে বাবা-মেয়ে একটু উদ্বিগ্ন মুখে বাড়ি ফিরল। সুরশ্রী জিজ্ঞাসা করলেন, “কী বলল অনীক?”
শিঞ্জিনী বলল, “প্যারাসিটামল দিয়েছে। কাল ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট আনতে যেতে হবে।”
চার
পরদিন দেবাংশুর জ্বর বেশ কিছুটা নেমে গেল। কিন্তু তিনি মনে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না৷ জ্বর তো কমল, আবার যদি আসে? অনীক তো বলল, ইপা ভাইরাসের আক্রমণ হলে জ্বর কমা-বাড়া হয়।
দুপুরে খেতে বসে সুরশ্রী বললেন, “মিমি, কুটুন আর প্রিয়জিৎকে তোর বাবার কথা বলেছিস?”
শিঞ্জিনী বলল, “জ্বর তো কমেছে। ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট হাতে পাই, তারপর বলব।”
সত্যি বলতে কী, শিঞ্জিনী যে খুব শান্ত মনে আছে, তা কিন্তু নয়৷ তবে বাবা-মাকে বুঝতে দিলে তো চলবে না৷ ওঁরা উলটে আরও টেনশন করবেন। সুতরাং এ ব্যাপারে তাকে চুপচাপ থাকতে হচ্ছে।
শুকনো মুখে ক্লিনিকের দিকে রওনা দিল সে। বাবার যদি সত্যিই কিছু হয়, মা-ভাই দু’জনেই খুব ভেঙে পড়বে। আর শিঞ্জিনী? সে কীভাবে নিজেকে সামলাবে? মায়ের ইচ্ছে ছিল সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক। বাবাই তার পছন্দমতো ফিজিক্স পড়তে পাঠিয়েছিলেন। জীবনের এত বড়ো একটা অবলম্বন থাকার জন্যই সে আজ সসম্মানে কলেজের অধ্যাপিকা। ভাইয়ের ফিল্ম নিয়ে পড়া, সেও তো বাবারই কারণে। ছোটো থেকে সত্যজিৎ রায়ের অন্ধ ভক্ত মল্লার। তার ফিল্ম মেকিংয়ে আগ্ৰহ শুনে মা রাগ করে মামাবাড়ি চলে গিয়েছিলেন। বাবার সাপোর্ট পেয়ে সে এস.আর.এফ.টি.আই-এর উজ্জ্বল ছাত্র হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে। এখন মুম্বইয়ের বাসিন্দা। পুরনো কথা মনে পড়ে গিয়ে চোখে জল চলে এল শিঞ্জিনীর। এতটা অসহায় সে আগে বোধ করেনি।
প্রিয়জিৎ কাল ফোনে বলেছিল, অসুবিধা হলে সে এখানে চলে আসবে। ওকে একটা কল করলে কেমন হয়?
ফোনে চোখ পড়তেই শিঞ্জিনী দেখল, আড়াইটে বাজে। না, কর্তা এখন মিটিংয়ে। ফোন সুইচড অফ থাকবে।
ক্লিনিকে পৌঁছে সে দেখল, কেউ বসে আছেন রিপোর্ট নেবার জন্য, আবার কেউ বসে আছেন টেস্ট করানোর জন্য। টেনশনের পারদ ক্রমশ চড়ছে। কী জানি রিপোর্টে কী বলা আছে!
কাউন্টারের ছেলেটিকে সে বলল, “দেবাংশু বিশ্বাসের রিপোৰ্টটা হয়েছে?”
“একটু ওয়েট করুন, ম্যাডাম। দেখছি।”
কিছুক্ষণ বাদে ল্যাবরেটরি থেকে সাদা খাম হাতে বেরিয়ে এল ছেলেটি। ওই খামই ঠিক করে দেবে এরপর তাদের জীবনে ঠিক কী অপেক্ষা করছে। মনে মনে একবার ঈশ্বরের নাম নিল শিঞ্জিনী। তারপর একবুক আশঙ্কা নিয়ে খামটা শেষমেশ খুলেই ফেলল।
পাঁচ
ডিং ডং! ডিং ডং!
বেল বাজতেই তড়িঘড়ি গিয়ে দরজা খুললেন সুরশ্রী। কোনওরকমে নিঃশ্বাস চেপে বললেন, “কী আছে রিপোর্টে?”
“আগে এক গ্লাস জল দাও তো, তারপর বলছি। উফ্, বাইরে কী রোদ!” ছাতা আর সানগ্লাস খুলে রাখল শিঞ্জিনী।
পুরো জলটা এক চুমুকে খেয়ে ফেলল সে। তারপর মায়ের উদ্বিগ্ন মুখের দিকে চেয়ে খামটা বাড়িয়ে ধরল। থমথমে মুখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ কাঁপা হাতে খামটা খুললেন সুরশ্রী। পড়তে পড়তে আনন্দের হাসি ছড়িয়ে পড়ল তাঁর মুখে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “যা, বাবাকে গিয়ে বল। মুখে না বললেও চিন্তায় অর্ধেক হয়ে যাচ্ছে মানুষটা।” বলে মা দুর্গার ছবিতে প্রণাম করলেন তিনি।
দেবাংশু খবরটা শুনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। শিঞ্জিনী বলল, “জ্বরটা সম্ভবত বারবার স্নান করার জন্য হয়েছে। ও নিয়ে ভেবো না। তবে প্রেশার আর সুগারটা কন্ট্রোলে রাখতে হবে। লেখার চাপটা এবার একটু কমাও।”
মেয়েকে কিছু বলতে যেতেই কপালে ভাঁজ পড়ল দেবাংশুর। “কিন্তু ওই চামড়া ওঠার ব্যাপারটা?”
ঠিক তখনই বাইরে চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা গেল।
“এই এক শুরু হল। কতবার বলি, অত জোরে চেঁচিও না, পিলে চমকে যায়! কে কার কথা শোনে?” বলে মাথা নাড়ল শিঞ্জিনী।
দু’জনে বেরিয়ে এসে দেখল, বাড়ির কাজের জন্য যে ঠিকে মেয়েটি আসে, বিনি, সে বালতি নিয়ে আর সুরশ্রী একটা পাঞ্জাবি হাতে ধরে তুমুল চিৎকার করছেন।
“এটা কী করলি বিনি? বাবুর নতুন পাঞ্জাবি এমন কাচলি যে রং উঠে গেল!”
“আমার দোষ? বাবু নিচ্চয় জামাখানা ফুটপাত থেকে কিনে এনেচে। এই দ্যাকো, আমার হাতে সুদ্ধু ডেলা ডেলা নীল রং!”