অনুষ্টুপ শেঠ-এর আরো গল্পঃ… ওলটপালট, মেডেল, দোকান, যাত্রা বিশ্বসেরা
সে অনেককাল আগের কথা বুঝলে! যার গল্প বলতে যাচ্ছি, তার তখন চাল নেই চুলো নেই, ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়। খুচখাচ কাজ করে করে টাকা পয়সা জুটেও যায় যাহোক, ট্রেনে ট্রেনে গান গায়, মালপত্তর বয়ে দেয়, মুদি দোকানে ফাইফরমায়েশ খাটে, একা মানুষ বলে লোকে টুকটাক কাজ দেয়ও ডেকে – মোদ্দা, একটাই তো পেট – সে চলেই যায়। ট্রেনের প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে রাতে ঘুমোয়, ভুণ্ডুবাবুর দোকানে দুবেলা খায়।
কোথায়? সে অত জেনে কী করবে! ধরে নাও বাংলার কোনো একটা ষ্টেশন, নাম ধরো তিরিন্তিনগর।
একদিন অমন, এক ভাঁড় ধোঁয়া ওঠে চায়ে আয়েস করে লেড়ো বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছে – খেয়েছ কখনো অমন? অম্রেত! স্রেফ অম্রেত! কামড় দিয়ে আনন্দে ওর চোখ বুঁজে এসেছে আরামে, এমন সময়ে খপাং করে কে যেন ওর কাঁধ খামচে ধরে বলল, “এইও!”
বেচারা অমন আচমকা ধাক্কায় তো বিষম টিষম খেয়ে একাকার। সে লোকটা মানুষ খারাপ নয় দেখা গেল, পিঠে থাবড়া টাবড়া দিয়ে, নিজের ব্যাগ থেকে বোতল বার করে জল খাইয়ে ওকে সাব্যস্ত করল। তারপর একটা অরেঞ্জ ক্রিম বিস্কুটের প্যাকেট বার করে ওকে দিয়ে বলল, “কাজ করবি? ঠিক তোর মত একটা ছেলে খুঁজছি অনেকদিন ধরে।“
ও তো খুব অবাক হল। কাজ? সে তো ও পেলেই করে, টাকা পাওয়া যায়, খাবার পাওয়া যায়, করবে না কেন!
তবু, অচেনা লোক বলে কথা! একটু বাজিয়ে দেখে নিতে হয় বইকি।
“করতে পারি। কিন্তু কী কাজ, ব্যাবস্থাপত্তর কী আগে বলতে হবে।”
লোকটা খুব হাসল ওর কথা শুনে। তার কাঁচাপাকা মেশানো ফুরফুরে গোঁফটা হাসির তালে তালে নেচে উঠল।
“নিশ্চয়! সব না বললে কী করে হবে! তা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বলব, নাকি ক্যান্টিনে ঢুকে একটু টোস্ট অমলেট খেতে খেতে বললে হবে?”
অমলেট শুনেই না, ওর জিভে জল এসে গেছিল। গরম ভাপ ওঠা অমলেট, কাঁচালঙ্কা কুচি দেওয়া মুখে দিলে কেমন একটা মাখনে ডুবে যাবার মত আরাম হয় না?
মুখে অবশ্য গম্ভীর ভাব বজায় রেখে, ভ্রূ কুঁচকে বলল, “বেশ, চলুন।”
তা, লোকটা, না এখন তো নাম জানে, রণজয়দা, খুব ভালো করে কাজটা বুঝিয়ে দিল বটে। ঝক্কির কাজ কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং। ওর তো খুব মজা লেগেছে শুনে। তাছাড়া পাঁচদিন ধরে কলকাতায় থাকা যাবে, সেও একটা কথা বইকি!
সব পই পই করে বুঝিয়ে, কোথায় যেতে হবে সে ঠিকানা লিখে, রাস্তার ছবি এঁকে দিয়ে, এত এত টাকা অ্যাডভান্স করে, টিকিট কবে কিভাবে কাটবে সেটা দেখিয়ে দিয়ে রণজয়দা ট্রেনে উঠে টা টা করে চলে গেল। আরো কাদের সঙ্গে নাকি কথা বলতে যাবে।
তিনদিন পর, যেমন শিখিয়ে গেছিল তেমনি টিকিট কেটে ও কলকাতার ট্রেনে উঠে পড়ল।
—
উফ, কী ভিড় ছিল রে বাবা! এই এতক্ষণে ও একটু বসতে পেল একটা সিটের একদম ধারে। এতক্ষণ নিজের ছোট্ট ঝোলাব্যাগটা সামলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধাক্কা খাচ্ছিল খালি।
হেলান দিয়ে বসে ইতিউতি চোখ চালায়। সব সিট ভর্তি, ইতিউতি কিছু লোক দাঁড়িয়েও আছে। ওর ঠিক সামনে একজন চশমা পরা কাকু মন দিয়ে ফোনে গেম খেলছে। কাটাকুটি খেলছে, এ বাবা! এত ধেড়ে লোক…খুব হাসি পায় ওর দেখে। কাকুর পাশে একটা ছেলে, ওরই বয়েসী হবে। ভারি মিষ্টি দেখতে, কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। হালকা করে গোঁফ উঠেছে, এই ব্যাপারে অবশ্য ও এগিয়ে। নিজের সরু চিকন গোঁফটায় একটু হাত বুলিয়ে নেয় ও। ছেলেটার পাশে আর জানলার ধারের দুজন ওর দিদি মনে হয়। কোঁকড়া চুলের লম্বা বিনুনি, মুখেরও মিল আছে খুব। দুজনেই জানলা দেখছে আর নিজেদের মধ্যে নীচু গলায় কীসব বলে হাসাহাসি করছে মাঝে মাঝে।
এদিকের সিটে তিনজন দাদু। তিনজনেই ঘুমোচ্ছে।
ওরও হাই উঠছে এবার। সেই ভোরে উঠে আসা, তারপর এতক্ষণ দাঁড়িয়ে…
আস্তে আস্তে পিঠটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজেই ফেলল ও।
—
“এই ছেলে, টিকিট দেখাও!”
অঘোর ঘুম থেকে ধড়ফড় করে উঠে পড়ল ও।
সামনে কালো কোট পরা, মোটাসোটা চেকারকাকু।
পকেট ফাঁক করে টিকিট বার করতে গিয়েই মাথা ঘুরে গেল ওর।
কিচ্ছুটি নেই। ফাঁকা।
অথচ, টিকিট, আর লোকটার দেওয়া টাকাগুলো পকেটেই রেখেছিল ও, স্পষ্ট মনে আছে।
বেকুবের মত ফ্যালফ্যাল করে চেকারকাকুর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল ও।
“আমার টিকিট… আমার টাকা… চুরি করে নিয়েছে গো কাকু! ও কাকু, আমি কী করে পৌঁছব গো?”
চেকার এসব নাটক বহু দেখেছেন চাকরিজীবনে, একটুও পাত্তা দেন না তাই। প্রথমেই গলা বড়ো করে এক ধমক লাগান, “চোপ্!”
ও ভয়ে কোঁৎ করে কান্নাটা গিলে ফেলে। চোখ দিয়ে জল পড়া থামে না যদিও।
“টিকিট ফাঁকি দেবার জন্য গল্প ফেঁদেছ, না? চ এবার জেলে বসে গল্প বলবি! চ, ওঠ বলছি!”
এবার ও সত্যি সত্যি ভয়ে কুঁকড়ে যায়। জেল? পুলিশ? হে ভগবান! কেন এল ও ওর চেনা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে কাজের লোভে! চেষ্টা করেও কান্নার আওয়াজ থামাতে পারে না ও, হিক্কা তুলতে থাকে এত আকুল কাঁদে।
“না কাকু না, সত্যি বলছি, আমি টিকিট রেখেছিলাম পকেটে, আমার আরো টাকা ছিল, কে তুলে নিয়েছে টের পাইনি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কেন যে… আমায় জেলে দিও না কাকু প্লিজ… আমার কেউ নেই আর…”
চেকারকাকু কিচ্ছু না শুনে ওর চুলের মুঠি ধরে টেনে তোলে। উঃ, কী ব্যথা লাগে!
“কাকু পুলিশে দিও না গো… খুব মারে, খুব লাগবে… কাকু প্লিজ ছেড়ে দাও… “
কাকু বলার জন্য কিনা কে জানে, চেকার আরো রেগে যায়। “চল ব্যাটা চল!” বলে এক ধাক্কা মারে ওকে।
ধাক্কা খেয়ে প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ার দশা হয় ওর। একহাতে সিট ধরে সামলে নিলেও, মাথাটা জোরসে ঠুকে যায় পাশে।
“দাঁড়ান!”
একটা ভারি গম্ভীর, তেজী গলায় হাঁক এল পিছন থেকে।
একটা মাসিমণি উঠে এসে দাঁড়িয়েছেন ওদের পিছনে। ওদের প্ল্যাটফর্মে রেলক্যান্টিনে রান্না করা শিখাপিসির মত লম্বা, শক্তপোক্ত পেটানো চেহারা, লাল-সাদা ডুরে শাড়ি পরা, শিখাপিসির মতই আঁচলটা কোমরে গুঁজে এসেছেন। তফাতের মধ্যে এই লম্বা একটা বিনুনি, আর কপালে বড়ো লাল টিপ একটা।
“কী হয়েছেটা কী? মারছেন কেন বাচ্চাটাকে?”
চেকারকাকু একটু ঘাবড়ে গেছে মনে হল।
“দেখুন না! বাচ্চা না আরো কিছু, এরা ধুরন্ধর ম্যাডাম। টিকিট ছাড়া যাচ্ছে… মিথ্যা গল্প বানাচ্ছে আবার…”
“আপনি জানেন মিথ্যে? দেখেছেন ট্রেনে ওঠার সময়ে টিকিট ছিল না?”
গটগট করে এসে ওর হাত ধরে সরিয়ে আনেন উনি। ও এত অবাক হয়ে যায়, কী বলবে ভেবেই পায় না। কিছু বলার আগেই ওর কপালের ব্যথা জায়গায় আলতো আঙুল ছোঁয়ান, তাতেও ওর যন্ত্রণা হয়, শিউরে ওঠে।
“ঈশ! কীভাবে মেরেছেন দেখুন, কালশিটে পড়ে গেল! ছিঃ!”
“কিন্তু … ম্যাডাম… টিকিট…”
“ওর টিকিট ছিল মা। ষ্টেশন থেকে ওঠার সময়ে হাতে নিয়ে উঠেছিল, আমি দেখেছি। ভিড় ছিল খুব, টিকিটটা পকেটে রেখে দিয়ে হ্যান্ডেল ধরেছিল।“
এটা সেই ছেলেটা বলল, সেই সুন্দরপানা ছেলেটা যে ওর সামনে বসে ছিল। ও-ও উঠে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের পাশে। মাসিমণিটা এটা শুনেই বাঘের মত ঘুরে তাকাল চেকারকাকুর দিকে।
“শুধু শুধু একটা বাচ্চাকে এইভাবে মারলেন! আপনাকেই তো পুলিশে দেওয়া উচিত!”
আরো কত কী বলল! বাবা রে! মাসিমণিটা রেগে গেলে এমন বকুনি দিতে পারে! শিখাপিসি পারে না কিন্তু, ওকে জগনকাকু বাজে কথা কিছু বললে খালি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে! চেকারকাকু পুরো ফ্যাকাশে হয়ে গেল, তারপর অনেক সরি টরি কীসব বলে, হাত জোড় করে প্রায় ছুটেই পালিয়ে গেল কামরা থেকে।
“আয়, এদিকে এসে বোস্। চেহারাখানা যা হয়েছে! বাবু, বড়দি ঐ রুমালটা দিচ্ছে দ্যাখ, ওটা একটু জলে ভিজিয়ে দে তো।“
বাবু বলে ছেলেটা ওর বয়সীই হবে মনে হচ্ছে। রুমাল ভিজিয়ে এনে নিজেই ওর কপালে চেপে ধরল।
খুব লজ্জা করছিল ওর। ইশ, এরা কেমন একটা ভাল বাড়ির লোকজন সব, ওর মত একটা প্ল্যাটফর্মে থাকা এলেবেলে ছেলের জন্য এত করছে, ভাবা যায়!
“লাগবে না, লাগবে না, আমি ঠিক আছি!”
“এই ছেলে, বেশি পটপট করবি না! দেখতে পাচ্ছি আলু হয়ে উঠছে, আবার বলে ঠিক আছি! নাড়ু খাবি?”
ছোট দিদিটাও মাসিমণির মতই মুখ করে বকে যে!
অগত্যা একহাতে রুমাল চেপে ধরে রেখে অন্য হাত বাড়িয়েই ফ্যালে সে, “দাও!”
অমনি আরেকটা কচি, লাল লাল হাতও ওর পাশে বাড়িয়ে দেয় কে যেন। রিনরিনে গলায় বলে, “দ্দে!”
ওমা, একে এতক্ষণ দেখেইনি ও? ঘুমোচ্ছিল মনে হয়, মাসিমণির সিটের ওপাশে। তাই চোখে পড়েনি। নাদুসনুদুস শরীর, ফুলো ফুলো গালে লালচে আভা, কুট্টি কুট্টি চোখে দুষ্টু দুষ্টু চাউনি, আর ফোকলা দাঁতের ঝিলমিলি হাসি – এত মিষ্টি খোকা দেখলেই কোলে নিতে ইচ্ছে করে যে!
দিদিটা ওকে একটা, আর খোকাকে একটা নাড়ু দেয় প্লাস্টিকের কৌটো থেকে। ও একটু একটু করে খায়, খোকা টপ করে পুরোটা খেয়ে নিয়ে আবার হাত পাতে, “দ্দে!”
দিদি দেয় না, হাসতে হাসতে বলে,
“না আর না, অসুখ করবে, পেটে ব্যথা হবে আবার।”
খোকা মানতে চায় না,কলরব করে বলে, “দ্দে দ্দে দ্দে!”
এবার মাসিমণি খোকাকে কোলে তুলে নেয়। খোকা হাত পা ছুঁড়তেই থাকে, নেমে পড়তে চায়।
“ডাক্তারবাবু আবার তেতো ওষুধ দেবে, ভাল হবে? এখন আর খাসনি, একটু পরে খেতে দেব তো! ঐ দেখ কেমন নারকেল গাছগুলো পালিয়ে যাচ্ছে হুশ হুশ করে…”
মায়ের আদরে একটু পরেই খোকা নাড়ু ভুলে হাঁ করে জানলা দিয়ে বাইরের বাড়িঘর গাছপালা আকাশ দেখতে থাকে। ওদের দেখতে দেখতে বুকের মধ্যে বড্ড চিনচিন করে ওর। কে জানে কেমন লাগে এমন মায়ের কোলে গুটিসুটি হয়ে বসে আদর খেতে!
“এই, খেলবি আমাদের সঙ্গে?”
নাড়ু দেওয়া দিদিটা ডাকছে। ব্যথার জায়গায় রুমাল ঠিক করার ছলে চোখটা মুছে নিয়ে ও উঠে যায় ওদের কাছে, একটু ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে ওরা চারজন। তাসের খেলা, ও জানত না, বড়ো দিদিটা শিখিয়ে দেয়। বা রে, বুঝতে একটুও অসুবিধে হল না তো! তবে যে হারুদা খালি খালি ওকে মাথামোটা বলে!
খেলা বেশ জমে গেছিল, হাসি মজা করতে করতে ও ভুলেই গেছিল সব। খেয়াল হল মাসিমণির ডাকে।
“খাবারের ব্যাগটা বার কর মা, খোকা ঘুমিয়ে পড়বে এবার নইলে।”
দিদিরা তাড়াতাড়ি সিটের নিচ থেকে ব্যাগ বার করতে লেগে যায়। ওরা খাবে এবার। ওর কি আর এখানে বসে থাকা উচিত?
গুটি গুটি পালানোর ধান্দা করছিল। ঠিক চোখে পড়েছে মাসিমণির।
“অ্যাই! তুই উঠলি কেন? বোস চুপ করে। কলকাতায় নামা অবধি আমার চোখের আড়াল হলে খুব খারাপ হবে কিন্তু!”
কাগজের থালায় টিফিন ক্যারি থেকে বার করা লুচি-আলুর দম। একটা করে লাড্ডু। বাবু যে গম্ভীর গলায় “আমায় মিষ্টি দিবি না, ভালো লাগে না” বলল, সেটার কারণটা বুঝতে পেরে আবার চোখ ঝাপসা হল একটু।
“কোথায় বাড়ি রে? কে আছে আর?”
খেতে খেতেই, এসব নানা প্রশ্ন করে মাসিমণিটা ওর সব জেনে নিয়েছিল। ও-ও দ্বিধা না করে, ওর প্ল্যাটফর্মের জীবন, তারপর রণজয়দা, কাজের কথা, কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কত টাকা চুরি হয়ে গেল, সব বলে দিয়েছিল একে একে।
কাজের কথাটা বলতে ভারি লজ্জা করছিল অবশ্য। একটু অদ্ভুত কিনা! কিন্তু সেটা শুনে মাসিমণি তো বটেই, বাবু আর তার দিদিরা কেউই অবাক হল না দেখে ও একটু আশ্চর্যই হয়েছিল। মাসিমণি একটু মুখ টিপে হেসে যে বলল, “ও আচ্ছা, তুই তাহলে এই জন্য কলকাতা যাচ্ছিস! তা বেশ, ভালই হল তাহলে। আমি তো চিন্তা করছিলুম নইলে পৌঁছে তোর কী করে কী হিল্লে করব।“
কিছুই বোঝেনি তখন ও কথাটার। সারাদিন বাবু আর দিদিদের সঙ্গে গল্প করে করে কেটে গেছিল। লেট করে, সন্ধ্যা পেরিয়ে বেশ রাতের দিকেই ট্রেন শিয়ালদা ঢুকেছিল, মাসিমণির হুকুমমত বড়োদি ওর আর ছোড়দি বাবুর হাত ধরে নেমেছিল ট্রেন থেকে। খোকা মাসিমণির কোলে, ব্যাগপত্তর সবার কাঁধে ভাগাভাগি করে। এর বেলা কথা শোনেনি ও, সবচেয়ে ভারি ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়েছিল অক্লেশে।
“হিঁঃ! হারুদার দোকানে মাল আসে যখন বস্তা বস্তা, এর চেয়ে কত ভারি বলে! তুলি না আমি?!”
তারপর অবশ্য একটু কষ্ট হয়েছিল, চুপি চুপি বলতে গেলে। অনেকটা রাস্তা হাঁটতে হল তো! ট্যাক্সিতে নিশ্চয় অনেক ভাড়া, তাছাড়া এতজন মিলে উঠবেই বা কী করে! সে যাক, বড়ো রাস্তা, তারপর গলি, আরো গলি পেরিয়ে এসে পৌঁছল একটা রোগামত তিনতলা বাড়ির সামনে।
বেল বাজাতে দরজা খুলে এক বুড়োমত লোক একগাল হেসে বলল, “এই তো মা ঠাকরুণ? রাত হচ্ছে দেখে চিন্তা হচ্ছিল তো…এসো এসো। সবাই মিলে এয়েছ দেখছি, বেশ বেশ!”
দুটো ঘর রাখা ছিল নিচে ওদের জন্য। তক্তাপোশে চাদর পাতা। হাত পা ধুয়ে, ওই বুড়ো লোকটির এনে দেওয়া খিচুড়ি পাঁপড় ভাজা খেয়ে বালিশ ছাড়াই কী ঘুম কী ঘুম!
পরদিন সকালে উঠে চোখে মুখে জল দিয়ে বাথরুম সেরে এসে দেখে এঘরে খোকা আর বাবু তখনো ঘুমোচ্ছে, দিদিরা ঘরের সামনে ধাপিতে চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে গল্প করছে, আর ওঘরে মাসিমণি কার সঙ্গে যেন খুব হেসে হেসে কথা কইছে।
কৌতূহলে দরজার আড়াল থেকে মুণ্ডুটা আস্তে করে বাড়িয়ে দেখেই ও থ হয়ে গেল।
রণজয়দা! কোথথেকে এল?!
রণজয়দাও ওকে দেখে ফেলেছে তক্ষুণি। হই হই করে উঠল, “এই ব্যাটা, আয় আয়, ভিতরে আয়! কী কাণ্ডই না বাধিয়েছিলি, ভাগ্যিস দিদি ছিল!”
ওর সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। লজ্জা লজ্জা মুখে ভিতরে যেতেই রণজয়দা একদম জড়িয়ে ধরল ওকে।
“আমারই ভুল। তোকে অমন একা আসতে বলা খুব ভুল হয়েছিল। জোর বেঁচে গেছি রে!”
তারপর? আবার কী! বলেছিলুম না পুজো আসছে? বলেছিলুম না ওর কাজটা ভারি অন্যরকম?
মিতুলদের পাড়ার পিছনের গলি দিয়ে সো-ও-জা চলে গেলে যে প্যান্ডেলটা পাবে, “অগ্রগতি ক্লাব” ব্যানার টাঙানো? তারা এবার জীবন্ত ঠাকুর করেছে যে! রণজয়দা এ বছর ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। ওইখানেই তুমি ওকে দেখতে পাবে এবার, সবুজ রং টং মেখে, মাথায় শিং লাগিয়ে, ইয়া বড়ো খাঁড়া হাতে নিয়ে লড়াই করছে। মাসিমণিকে তো এমনিই দুর্গার মত সুন্দর, অমন লালপাড় গরদের শাড়িতে চুল খুলে ত্রিশূল হাতে যা লাগছে না, পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে ওর নিজেরই ভয় করছে একটু একটু। তোমরা গেলে, এপাশে সাদা শাড়িতে বাজনা হাতে ওর বড়দি, তার পাশে লাল ধুতি আর গয়নাগাটি পরা বাবু হাতে তির ধনুক নিয়ে, আর অন্যদিকে কমলা শাড়ি পরে ছোড়দি আর তারও পাশে একটা কী সুন্দর হাতির মুখোশ পরা খোকাকেও মন দিয়ে দেখে আসতে ভুলো না কিন্তু!