পিয়ালি গাঙ্গুলীর আগের লেখা– ফোচনের কীর্তি , ফোচনের আরেক কীর্তি মিঠে প্রতিশোধ
চিকেনটা ম্যারিনেট করে রাখতে গিয়ে একটাও কৌটো খুঁজে পেল না তিন্নি। এতগুলো কৌটো ছিল রান্নাঘরের ড্রয়ারে, কোথায় গেল সব কে জানে। সরস্বতীর স্বভাব আছে এদিক ওদিক গুছিয়ে রাখার, কিন্তু তাই বলে একটাও চোখে পড়বে না? শেষে একটা বোন চায়নার বড়ো বাটি পেয়ে সেটাতেই চিকেনটা ঢেলে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিল। পেঁয়াজ-রসুনের খোসাগুলো প্লাস্টিকে ভরে ফেলে দেবে ভাবল, একটা প্লাস্টিকও চোখে পড়ল না। কত প্লাস্টিক তো জমিয়ে রাখে ময়লা ফেলার কাজে লাগে বলে। দরকারে একটাও পাওয়া গেল না। কী যে হচ্ছে কে জানে। সারাবছর তো ঠিক করে বাড়ির দিকে তাকানোর সময় পায় না, এখন নেহাত স্কুলের ছুটি চলছে তাই টুকিটাকি একটু রান্নাবান্না করার সুযোগ পাচ্ছে। আজ বছরের শেষদিন, একটু ভালোমন্দ রান্না না করলে হয়?
এদিকে মাইক্রোওয়েভ পিক পিক করে আওয়াজ করে জানান দিল, পুডিং রেডি। টিনটিন পুডিং খেতে খুব ভালোবাসে। ওপরে জেমস-টেমস দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়েছে তিন্নি। ভাবল গিয়ে ছেলেকে সারপ্রাইজ দিয়ে আসি। ও মা, ছেলের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখল দরজা ভেতর থেকে লক করা। ক’দিন ধরেই দেখছে ছেলে নতুন কায়দা শিখেছে। এত কীসের প্রাইভেসি পুচকে ছেলের? দরজায় ঠকঠক করায় খানিক বাদে বাবু দরজা খুললেন। মন দিয়ে কম্পিউটারে কীসব করছিল। একগাদা প্রিন্ট আউট ছড়ানো আশেপাশে। কাছে যেতেই প্রায় লাফিয়ে উঠল, “যাও যাও, আমায় ডিস্টার্ব করো না, আমি খুব ইম্পরট্যান্ট কাজ করছি।”
“তাহলে পুডিংটা তুমি খাবে না তো?” বলে তিন্নি চলে যাওয়ার উপক্রম করতে উঠে এসে পুডিংটা হাত থেকে নিল বটে, কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো অত উৎসাহ বা আনন্দ দেখা গেল না। সারাক্ষণ কী যে ওর মাথায় চলতে থাকে কে জানে। আর বেশি মাথা না ঘামিয়ে তিন্নি রান্না শেষ করতে গেল।
আজ ৩১শে ডিসেম্বর, বছরের শেষদিন। রাতে নিচে কমিউনিটি হলে বর্ষবরণের পার্টি। হুল্লোড় চলবে সারারাত। তিন্নি বেশি রাত অবধি জাগতে পারে না। বারোটা বেজে গেলে টিনটিনকে নিয়ে শুতে চলে আসবে।
সন্ধে থেকেই গানের গুঁতো শুরু হয়েছে। একেবারে কান ঝালাপালা। এবেলা রান্নাবান্নার ঝামেলা নেই বলে তিন্নি আরামসে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে একটু গল্পের বই পড়ছিল। এই সুযোগ তো বিশেষ পাওয়া যায় না। টিনটিন বলল, তুতুনদাদা আর পাপাইদাদার সাথে নাকি কী বিশেষ দরকার আছে, তাই ওদের ফ্ল্যাটে যাচ্ছে। পাপাই আর তুতুন ওপরের ডাক্তারবাবুর দুই ছেলে। একজন ডাক্তার হয়ে গেছে, অন্যজন ডাক্তারি পড়ছে। পড়াশুনো বা স্কুলের কোনও প্রোজেক্টের কাজে টিনটিন অনেকসময়ই ওদের সাহায্য নেয়। পাশের ফ্ল্যাটের রিষভদাদাও অনেক সাহায্য করে। রাত ন’টা নাগাদ বেলের পর বেল। বই ছেড়ে ধড়মড়িয়ে উঠে দরজা খুলতেই টিনটিনের গলা, “কী গো, তুমি আর বাবা নিচে যাবে না? সবাই তো চলে গেছে।”
টিনটিনের সাথে ফ্ল্যাটের বাকি কচিকাঁচাগুলোও ছিল। তারাও বলল, “আন্টি, তাড়াতাড়ি এসো।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, আসছি।” বলে তিন্নি রেডি হতে গেল।
নিচে নেমে তো চক্ষু চড়কগাছ। প্রত্যেকবারই খুব সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে পার্টির পরিবেশ তৈরি করা হয়, কিন্তু এবারে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। সামনে ল্যাপটপ, প্রোজেক্টর এসব রাখা। বড়ো ছেলেমেয়েগুলো সেসব নিয়ে কীসব খুটুরখুটুর করছে। কীসের প্রস্তুতি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একটু পরে টিনটিন আর রণ এসে মাইক নিয়ে দাঁড়াল সামনে। ঘোষণা করল ওরা নাকি কী একটা স্পেশাল প্রেজেন্টেশন তৈরি করেছে বড়োদের জন্য, সবাই যেন মন দিয়ে দেখে। বাড়তি আলো সব নিভিয়ে দেওয়া হল। পাপাই ল্যাপটপের সামনে বসল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক বিশাল তিমি মাছের ছবি। কিছুদিন আগে ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে ভেসে উঠেছিল ৩১ ফুটের এই বিশাল স্পার্ম হোয়েলের মৃতদেহ। পেট থেকে বেরিয়েছিল ৮ কিলো প্লাস্টিক। প্লাস্টিক ব্যাগ, প্লাস্টিকের কাপ, প্লাস্টিকের চটি ইত্যাদি। ছবিটা দেখে মনে পড়ল। ভাইরাল হয়েছিল সেই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
পার্টির পরিবেশ একটু গম্ভীর হয়ে উঠল। টিনটিন আর রণ ততক্ষণে পালা করে অনেককিছু বলে চলেছে প্লাস্টিক পলিউশন সম্বন্ধে। সবাই খুব মন দিয়ে শুনছে। সত্যিই তো, এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়, অথচ তা নিয়ে আমরা মাথাই ঘামাই না। এই প্লাস্টিকের মধ্যে কত কার্সিনোজেনিক পদার্থ আছে, তা কীভাবে আমাদের শরীরের ক্ষতি করছে, কীভাবে ক্যানসার আরও ছড়িয়ে পড়ে মহামারীর আকার ধারণ করছে সেই নিয়ে বিশদে অনেকগুলো স্লাইড দেখাল কমপ্লেক্সের নবীন প্রজন্ম। একদম ছোটোগুলো তখন হাতে হাতে লিফলেট বিলি করছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা কীভাবে প্লাস্টিক বর্জন করতে পারি সে বিষয়ে। যেমন ফ্রিজে প্লাস্টিকের বদলে কাচের বোতলে জল রাখা, প্লাস্টিকের টিফিন বক্স জলের বোতলের পরিবর্তে স্টিলের টিফিন কৌটো বা মেটালের ওয়াটার বোতল ব্যবহার করা, মাইক্রোয়েভে কাচের পাত্রে খাবার রান্না বা গরম করা। প্লাস্টিকের পেট বটলে কোল্ড ড্রিঙ্ক না কেনা এবং সর্বোপরি দোকান-বাজারে জিনিস কিনতে প্লাস্টিকের পরিবর্তে জুটের বা কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করা। এটুকু মেনে চলা সত্যিই এমন কিছু দুঃসাধ্য নয়।
ছোটোদের এই প্রেজেন্টেশন দেখে বড়োরা নড়েচড়ে বসলেন। এই বর্ষবরণের হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যেও কত দামি একটা কথা ছোটোরা তাদের মনে করিয়ে দিল। নিজেরা সুস্থভাবে বাঁচলে, পৃথিবীটা সুন্দর আর সুরক্ষিত থাকলে তবেই তো জীবনে আনন্দ। এইসবের মাঝে দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁলো। সঙ্গে সঙ্গে সমবেত কন্ঠে হ্যাপি নিউ ইয়ার ধ্বনি। তবে শুধুই গানবাজনা, বাজি পোড়ানোর কোনও ঘটা নেই। বাজি থেকে কত দূষণ হয় জেনেও বাজি পুড়িয়ে উৎসব করার কোনও মানে হয় না। তিন্নি এবার দুয়ে দুয়ে চার করতে পারছে। এই প্লাস্টিক নিয়ে চিন্তাভাবনা তাহলে ছোটোদের মাথায় অনেকদিন ধরেই আছে। তাই টিনটিন কিছুদিন আগে বায়না করে নিজের আর তিন্নির জন্য স্টিলের টিফিন বক্স আর জলের বোতল কিনিয়েছিল। বাড়ি থেকে প্লাস্টিকের প্যাকেট আর প্লাস্টিকের কন্টেনার উধাও হওয়ার পেছনেও তাহলে টিনটিনেরই হাত। ছোট্ট ছেলেটা কতকিছু ভেবেছে। এসব নিশ্চয়ই স্কুল থেকেই শিখেছে। মনে মনে তিন্নি স্কুলের টিচারদের ধন্যবাদ না জানিয়ে পারল না। নতুন প্রজন্মকে সচেতন করা আর তাদের মাধ্যমে এক সুস্থ, সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলায় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভূমিকা সত্যি অনস্বীকার্য।
একে অপরকে হ্যাপি নিউ ইয়ার উইশ করার পর্ব মিটলে ওরা ঘোষণা করল যে আগামীকাল, নতুন বছরের প্রথমদিন ওরা কমপ্লেক্সে প্লাস্টিক ফ্রি ক্যাম্পেন চালাবে। অর্থাৎ সকলের বাড়ির যাবতীয় প্লাস্টিকের জিনিস বর্জন করা হবে। সাধু উদ্যোগ। বছরের শুরুটা সুন্দরভাবে হবে।
খাওয়াদাওয়া, হৈ-চৈ পর্ব মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে টিনটিন বলল, “মা, তোমার জন্য একটা গিফট আছে।” এই বলে মায়ের হাতে ধরিয়ে দিল একটা সুন্দর জুটের ব্যাগ। “এটা আমি নিজের টাকায় তোমার জন্য কিনেছি। এবার থেকে তুমি এটা নিয়েই দোকান-বাজার যাবে।”
তিন্নির চোখ তখন চিকচিকে। “আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ।” বলে ঠোঁটদুটো বসিয়ে দিল ছেলের গালে।
অলংকরণঃ স্বীকৃতি ব্যানার্জি
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে