গল্প পাসওয়ার্ড কল্যাণ সেনগুপ্ত বর্ষা ২০২০

কল্যাণ সেনগুপ্তের আগের গল্প বংশীধরের বিপদ, শুধু কথা,  

পাসওয়ার্ড

কল্যাণ সেনগুপ্ত

দুটো চিরকুট, লম্বা ফিরিস্তি। দুটো দুরকম। একটায় এক কেজি আলু, পাঁচশো ঝিঙে, পাঁচশো বিনস, লেবু, ধনেপাতা, লঙ্কা আর হলুদ একশো গ্রাম। আরেকটায় টেলিফোন বিল জমা, নিজের ও কমলার হরিদ্বারের টিকিট কাটা, কর্পোরেশনের ট্যাক্স জমা দেওয়া, বাড়ির ইলেকট্রিক বিল জমা দেওয়া। মেয়ে কণার কল্যাণে দ্বিতীয় লিস্ট নিয়ে কোনও চিন্তাই নেই। কিছুদিন আগেও ব্যাঙ্কের টাকা তোলা, ইলেকট্রিক বিল দেওয়া, ট্রেনের টিকিট কাটা একেকদিনের কাজ ছিল। এখন ওটা বাড়ি বসেই সেরে ফেলেতে পারেন দু-ঘণ্টায়। ইন্টারনেটের যুগে এটা কোনও ব্যাপারই নয়। ছোটো মেয়ে কণা কম্পিউটার পড়েছে, জানে ও ভালো। ওই বাবাকে বুঝিয়েছিল, এটা কোনও ব্যাপার নয়। প্রথমটায় একটু অসুবিধাই হয়। তারপর সবই নিয়ম মেনে আস্তে আস্তে আয়ত্তে এসে যায়। শুধু এত এত পাসওয়ার্ড মনে রাখাই মুশকিল। রোজ রোজ যোগ হচ্ছে পাসওয়ার্ডগুলো। কয়েকবার পাসওয়ার্ড ভুল করলেই সর্বনাশ, সব কারিকুরি সাময়িক বন্ধ। তবে সাবধানে থাকলে কোনও অসুবিধা নেই। একেকটা অ্যাপ ধরে ডাউনলোড করো আর পাসওয়ার্ড দিয়ে খুলে ফেল বিশ্বের সব পেয়েছির বাজার। মাছ, মাংস, জামাকাপড় সবই পাওয়া যাবে এবং সস্তায়।

চিরকুট দুটো মাথার কাছে বইচাপা দিয়ে বালিশে মাথা রাখলেন কালী রায়। দোতলার এই ঘরটা যেন বাড়িতে আছি অথচ নেই ভাবে আছে। রিটায়ার করার পরে  তৈরি করেছিলেন। আলো-বাতাসে ভরপুর। ঘর আর বাথরুম বাদ দিলে বাকিটা ছাদ। গরমকালে একটু গরম থাকবে দিনেরবেলা। সন্ধে হলে বাতাসে তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এখন তো ঘুম কমে গেছে, তাই রাত্রে কোনও কোনও সময় ঘুম না এলে ছাদে এসে দাঁড়ান। পুরো পাড়াটা নিস্তব্ধ রাস্তায় কুকুরগুলো ছাড়া কেউ জেগে নেই, মাথার ওপর তারাভরা আকাশ আর সেই সময় ছাদে পায়চারি করতে যে কী ভালো লাগে সে বলার নয়। ওঁর খালি মনে হয় কলকাতা দিনেরবেলা একটু একটু করে পালটে গেলেও রাত্রে কিন্তু তেমন পালটায়নি। মাঝরাতে পাড়াটা যেন একইরকম আছে। রাতের কলকাতা সময়কে কেমন বেঁধে রেখেছে। চাঁদনি রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে কেমন রাজা ভাব জেগে ওঠে। পুরো পাড়াটা তখন পায়ের তলায় ঘুমাচ্ছে। কমলাকে একবার বলেছিলেন এমনই মাঝরাতে ছাদে আসতে, নিজের চোখে দেখতে। কমলা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। “ও তোমার পাগলামি। আমার খেয়ে আর কাজ নেই যে মাঝরাতে রানি হতে ছাদে যাব।” নিচে বসার ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম বাদ দিলে দুটি শোবার ঘর। একটায় আগে কমলা মেয়েদের নিয়ে শুতো। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবার পর এখন কমলা একাই শোয়। দুটি মাত্র মেয়ে কণা আর কলি, বিয়েও দিয়ে দিয়েছেন সময়মতো। ওদের পড়াশুনো অবশ্য কমলাই দেখেছে বরাবর। অফিস অফিস করে সারাটা জীবন প্রাণপাত করেছেন। বাড়িতে কী হচ্ছে, কেমনভাবে মেয়েরা স্কুল-কলেজ পার হছে তাকিয়েও দেখেননি। এখন ভাবলে খারাপই লাগে। কমলা সেই যে একমুখ হাসি নিয়ে সংসারের ভার তুলে নিয়েছিল, সেই হাসি মুখে রেখেই মেয়েদের মানুষ করা, অতিথি আপ্যায়ন, সামাজিকতা সামলে গেছে। কোথায় কোনও ত্রুটি রাখেনি। কমলার কোনও রাগও নেই, কিছুতে অসন্তুষ্ট ভাব নেই। তাই কমলার ওপর রাগও করা যায় না। আজকাল একা বসে থাকলে বড়ো আফসোস হয় সারাজীবন শুধু নিজেরটুকুই খালি দেখেছেন। কমলার পাশে আরও বেশি করে থাকলে হয়তো আরও গুছিয়ে সংসারটা করতে পারতেন।

চিরকুট লিখে বাজার যাওয়া মন থেকে একেবারেই অপছন্দ। কিন্তু ইদানীং কিছু কিছু অপ্রস্তুত অবস্থা বাধ্য করেছে চিরকুট লিখতে। মনে আছে, দাদু রোজ লিস্ট করে বাড়ির চাকরকে নিয়ে বাজার যেতেন। মাঝে মাঝে দিদিমা দাদু চলে যাবার পরেও কালীবাবুকে পাঠাতেন, “কালী, ও কালী, যা বাবা তোর দাদুকে দিয়ে আয় এই লিস্টটা, ভুলে গেছেন নিতে।” অনেক পরে বুঝেছেন, ওটা দিদিমা আগে ভুলে গিয়ে আবার কিছু আনতে দ্বিতীয় লিস্ট পাঠিয়েছেন। দাদু কোনোদিন কিন্তু ফিরে এসে কিছুটি বলেননি। এই ক’দিন আগেও পাঁচ-সাতটা জিনিস কমলা বললে ঠিক গুণে গুণে এনে ফেলতেন। কই, ভুল তো তেমন হতই না। অফিসে এতগুলো ফাইলের আদানপ্রদান এদিক ওদিক হবার উপায় ছিল না। কোন ফাইলে কার সাইন বাকি আছে, কোথায় আছে, প্রত্যেকটা ফাইল তাঁর জানা। কেউ কোনও ফাইল খুঁজে না পেলেই কালীদার স্মরণ। অনেকদিনের চেষ্টায় অনেক অভ্যেসে এগুলো মনের কুঠুরিতে জমা রাখতেন। প্রথম প্রথম বড়বাবু হবার পর একটু-আধটু গুলিয়ে যেত। কিন্তু লেগে থেকে, অফিস টাইমের পরে সময় দিয়ে কালী রায় সমস্ত ফাইলের যাতায়াত নিয়মের বেড়াজালে বেঁধেছেন মনের খুপরিতে। একসময় চোখ বুজে বলে দিতে পারতেন কোন ফাইল কোথায় আছে। এটা তো একদিনে হয়নি। গর্ব একটা ছিলই। একশো দেড়শো স্টাফ থেকে ডিপার্টমেন্টের আন্ডার সেক্রেটারি অবধি সবার কালীদা ছাড়া চলত না। মাথা গুঁজে নিজের কাজ করেছেন। দেরি করে আসা নয়, রাজনৈতিক দলে নাম লেখাননি, কর্মী হিসাবে সুনাম নিয়ে অবসর নিয়েছেন। পরিশ্রম আর সততা এই নিয়েই অফিস জীবন কাটিয়েছেন। শারীরিকভাবে যথেষ্ট শক্ত আছেন। অবসর নেওয়া ওঁকে একটুও দুর্বল করে দেয়নি। মনে একটা গর্বও আছে আর আছে নিজের মানসিক শক্তির ওপর ওঁর অটল বিশ্বাস। ট্রামে-বাসে, পাতালরেলের সিনিয়র নাগরিকদের রাখা সিটের কাছে গিয়ে দাঁড়ান না। রোজ নিয়ম করে দুই মাইল হাঁটেন। দু-পাঁচ কেজি বাজার রোজ বয়ে আনেন। ব্যস্ত রেখেছেন। অবসর নেবার তিন বছর বাদেও বন্ধুরা বলে, “কালী, তুমি তো দেখেছি দিন দিন ইয়ং হয়ে যাচ্ছ। একইরকম আছ।” বলেন না কিছুই। নিজেকে নিয়ে মনে বেশ গর্ব হয়। নিয়ম মেনে চললে, আরও বেশি পরিশ্রম করলে বার্ধক্যকে দূরে ঠেলে রাখতে পারবেন। বেশি বয়সেও মাথা উঁচু করে, গটমট করে দাপিয়ে হেঁটে যাছেন, এর থেকে আর আনন্দের কী আর আছে? একটা নেশার মতন আরও নিজেকে কর্মঠ দেখানোর জন্যে, নিজেকে প্রমাণ করার জন্যে নিরলস চেষ্টা।

কিছুদিন যাবত কালীবাবু দেখছেন কমলা কিছু আনতে বললে চারটে পাঁচটা জিনিসের বেশি একসঙ্গে মনে রাখতে পারছেন না। কিছুদিন আগেও বাজারে দাঁড়িয়ে অনেক চেষ্টায় মনে করে ঠিকঠাক বাজারের জিনিস এনে ফেলেছেন। ক’দিন যাবত এই মনে রাখার ব্যাপারটায় কেমন যেন ঠকে যাচ্ছেন। আজ বাড়িতে মনে করে নিয়েছেন কী কী আনতে হবে, কিন্তু বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিমলবাবুদের বাড়ির সামনে এসে ঝালিয়ে নিতে গিয়ে আবার হোঁচট। কী যেন, কী যেন… কিছু দিব্যিই মনে পড়ল, দু’কেজি আটা, এক কেজি পেঁয়াজ, পাঁচশো ঝিঙে অবধি মনে আছে, কিন্তু শেষটা কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভেবে ঠিক করলেন, আবার বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার শেষ যেখানে দাঁড়িয়ে মনে করেছিলেন সেখানে ফিরে যাবেন কি না। অনেক সময় সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালে ওঁর মনে পড়ে যায়। এমন সময় বাজারের ব্যাগ হাতে কাজলবাবু এক গাল হাসি দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। “কী কালীবাবু, শরীর ঠিক আছে তো? এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন?”

এটা কোনও প্রশ্ন হল? এই গায়ে পড়া প্রশ্ন উনি একদমই পছন্দ করেন না।

কাষ্ঠ হাসলেন কালীবাবু। “না না, ভালোই তো আছি।”

কাজলবাবু একধরনের মানুষ যিনি বাজারে বড়সড় একটা মুদির দোকানের মালিক। একটি ছেলে, বড়ো হয়ে ওঁর দোকানেই বসে। মুদির দোকান আর ওঁর ফুলের বাগান—এই নিয়েই কাজলবাবুর পৃথিবী। বড়ো বাস্তববাদী। কিছুদিন যাবত ছেলের হাতে দোকান ছেড়ে দিয়ে বিকেলের দিকে একটিবার করে যান দোকানে টাকাপয়সা বুঝে নিতে। আর বাকি সারাদিন নিজের জমিতে সারাদিন বাগানে মাটি কোপাচ্ছেন, জল দিচ্ছেন, আগাছা কাটছেন। কিছু একটা নিয়ে থাকেন। দুটি ছেলে একজন ওঁর কাছে, অন্যজন বাইরে থাকে। কিন্তু একটু গায়ে পড়া ভাব। বিশেষত কালীবাবুকে দেখলে একমুখ হাসি নিয়ে এসে দাঁড়াবেন। আর অনর্থক প্রশ্ন। এটাই ওঁর ভালো লাগে না। দেখা হলেই একথা সেকথা। মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি কেমন হল, জামাইরা কেমন, কোথায় চাকরি করে, পাড়াটা দিন দিন কেমন খারাপ হয়ে যাচ্ছে—এইসব আজেবাজে সব প্রশ্ন। পছন্দ না হলেও কিছু বলেন না সামনাসামনি। দেখা হলেই একগাল দাঁত বার করা হাসি লেগেই আছে।

কাজলবাবু নাছোড়। “ওপরের বারান্দা থেকে দেখছি আপনি একবার বাজারের দিকে এগোলেন, আবার একটু এগিয়ে ফিরেও এলেন। আবার আমাদের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কী যেন বিড়বিড় করছেন। তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম।”

কালীবাবু আর দাঁড়ালেন না। “ও কিছু না। সেরকম কিছু নয়। বাজার থেকে আর কিছু আনতে হবে কি না ভাবছিলাম।”

হাসতে হাসতে কাজলবাবুর সঙ্গেই বাজারের দিকেই চললেন। ভাবলেন, যেতে যেতে ঠিক মনে পড়ে যাবে।

আজ কিন্তু পুরো বাজার চষে ফেলেও তিনি মনে করতে পারলেন না পুরো লিস্টটা। শেষে হার স্বীকার করে ফিরে এলেন আর সব নিয়ে। বাড়ি ঢুকতেই কমলা হাত থেকে ব্যাগটা নিয়েই বলে, “দেখলে! রান্না তো বসিয়েছি, আর হলুদ কই?”

কালীবাবুর সেই মাথা চুলকে কাঁচুমাচু হলেন। “ইশ ইশ, দেখেছ! এটাই এত চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না।”

কমলা হাসলেন। “লিখে নিয়ে গেলেই ও পারো। তাহলেই আর ভুলবে না।”

কালীবাবু এরকম নিজের কাছে নিজের হার মেনে নিতে বেশ কষ্টই হল। এই থেকে চিরকুটের শুরু।

আরও আরেকটা ঘটনা কমলাকে বলতেই পারেননি। গত পরশু সকালবেলা জলখাবারের পর কাগজ পড়ছেন, এমন সময় কমলা বললে মা কালীর প্রসাদটা মেয়েকে পৌঁছে দিতে। রাস্তায় বেরিয়ে কাজলবাবুদের বাড়ি অবধি এসে মনে হল, প্রসাদ তো নিয়ে বেরিয়ে এলেন, কিন্তু কাকে যেন, কাকে যেন দিতে হবে? চোখ পড়তেই দেখলেন কাজলবাবু বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে। দাঁড়ানো নয়। হনহন করে হেঁটে বড়ো রাস্তায় এসে পড়লেন। কার জন্যে প্রসাদ দিল কমলা? একবার ভাবলেন কমলাকে ফোন করেন। কিন্তু লজ্জায় করতে পারলেন না। শেষে নিজের মাথা খাটিয়ে মনে হল নিশ্চয়ই ছোটো মেয়ে কণার কথাই বলেছে। অনেকদিন আসে না, নিশ্চয়ই ওর কাছেই পৌঁছে দিতে বলেছে। এই ভেবে বড়ো রাস্তায় এসে বরিশার বাস ধরলেন। কিন্তু কণার বাড়ির কাছে এসে ওঁর মনে হল খুব বড়ো ভুল করে ফেলছিলেন। আরে কলির ছেলের তো সামনে মাধ্যমিক! ইশ, ভাগ্যিস কণার বাড়ি ঢুকে পড়েননি। ঢুকে পড়লে কেলেঙ্কারির একশেষ হত। ওখান থেকেই সোজা বাস ধরে হাওড়া, সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে হিন্দমোটর। বাবাকে হঠাৎ দেখে কলি ভীষণ খুশি। কিন্তু প্রসাদ দিতে গিয়েই হোঁচট খেলেন। “বাবা, কালীবাড়ির প্রসাদ তো আমি গত পরশুই নিয়ে এসেছিলাম। এটা আবার কার প্রসাদ? আসলে মা আমাকে বলেছিল কণাকে প্রসাদটা দিয়ে দিতে। আমার আর হয়নি বাড়ি ফেরার তাড়ায়।” কালীবাবু ভীষণভাবে নড়ে গেলেন। বরিশা অবধি গিয়েওছিলেন। কেন যে গেলেন না ওদের বাড়ি! এরকম ভুল উনি করলেন কী করে? কলিকে অনেককিছু এদিক ওদিক বলে ব্যাপারটা সামলালেন। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হতে থাকল। এরকম তো উনি ছিলেন না। কেন বারবার ভুলে যাচ্ছেন? এটাই কি বার্ধক্যের ইঙ্গিত? অনেকদিন ধরেই বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজনের নাম ভুল হত, সেটা সবারই হয়। কিন্তু আজকাল বারবার নিজের কাছে নিজে হেরে যাচ্ছেন। বিশ্বাস টলে যাচ্ছে। বয়স তো হবেই, কেউ আটকাতে পারবে না। কালীবাবু তাই নিয়মের বেড়াজাল দিয়ে বেঁধেছেন সব। নিয়ম মানলে মনে করা সোজা।

সকালে যেমন ওঠেন তেমন রোজকার নিয়ম মেনে গাছে জল দেওয়া, চা খাওয়া, কাগজে চোখ বোলানো—সবই পরপর সারলেন। এরপর সামনের মুদির দোকানের কিছু মুদি-সদাই এনে বসে ডেস্ক কম্পিউটারের নব অন করলেন। এটা শিখে খুবই সুবিধে হয়েছে। কণার জন্যে কিনেছিলেন। কনাই শিখিয়েছিল। এর আগে ইলেকট্রিক বিল, টিকিট কাটা, কলেজের ফি জমা—এগুলো একদিনে করা অসম্ভব ছিল। ইন্টারনেটের যুগে এগুলো বয়স্ক মানুষদের দারুণ সুবিধা করেছে সন্দেহ নেই। মাঝে মাঝে কানেকশন গণ্ডগোল করে, তবুও প্রচুর সময় বাঁচে।

কম্পিউটার খুলতে গিয়ে দেখলেন পাসওয়ার্ড চাইছে। কাল তো চায়নি! তবে আজ কেন? মনে পড়ল, গতকাল মিস্ত্রি এসেছিল কম্পিউটার সারাতে। আজ কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল, উনি তো একটা পাসওয়ার্ড দিয়েছিলেন কম্পিউটার খোলার জন্যে। কোথায় যেন লিখেও রাখলেন। আশেপাশের কাগজগুলো আগাপাশতলা খুঁজলেন, কিন্তু পেলেন না। মাঝে মাঝে মানিব্যাগে রাখেন, না তাও নেই। নিচে নেমে কমলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, না কমলাও জানে না। আবার কোথায় গেল? কমলাও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। দু-চারটে চেনা শব্দ দিয়ে দেখলেন। না, খুলছে না। তাহলে উপায়? মেকানিক যে কাল এসেছিল তাকে ডাকবেন, না কলি বা কণাকে জিজ্ঞাসা করবেন? নিজেকে শান্ত করলেন, নার্ভাস হলে হবে না। ভয় পায় বুড়ো লোকে। উনি কেন পাবেন? কীভাবে টিকিট কাটবেন, বিল জমা দেবেন? নিমেষে ঠিক করে নিলেন অটো করে ইলেকট্রিক অফিসে যাবেন, ওখানেই সাইবার কাফে আছে, সেখানে গিয়ে বসে নিজেই অনলাইনে টিকিট কেটে তবে ফিরবেন। ওখানে তো আর কম্পিউটারের খোলার জন্যে পাসওয়ার্ড লাগবে না।

যা ভাবা তাই কাজ। বাড়ির গলি দিয়ে এসে বড়ো রাস্তায় এসে অটো ধরে ইলেকট্রিক অফিসে পৌঁছে অনেকদিন বাদে রীতিমতো লাইন দিয়ে বাড়ি থেকে আনা টাকা দিয়ে বিল জমা দিলেন। এইবার পরের কাজ সাইবার কাফেতে। কিন্তু ট্রেনের টিকিট কাটতে গিয়ে আবার তার পাসওয়ার্ড চাইছে। আজকাল সব ওয়েবসাইটে এত এত পাসওয়ার্ড লাগে সেটা মনে রাখাও কঠিন। হারিয়ে গেলে আবার কেলেঙ্কারি বলে বন্ধু সলিল দু’দিন আগে কালীবাবুকে একটা ফাইলে রেখে সেটা পাসওয়ার্ড প্রটেক্ট করে দিয়েছেন, আর কেউ ওঁর পাসওয়ার্ডগুলোর নাগাল পাবে না। একটা পাসওয়ার্ড মনে রাখলেই হবে। এখন সেটাও মনে পড়ছে না। আস্তে আস্তে হতাশ হয়ে পড়ছেন। মানিব্যাগে ছিল মনে হচ্ছে। কিন্তু ব্যাগ হাতড়ে আজেবাজে অনেক কাগজ বেরোলো, কিন্তু সেই পাসওয়ার্ড  পেলেন না। উদ্বিগ্ন মুখে ভাবতে লাগলেন, কোথায় গেল? এমন তো হবার নয়। একবার দু’বার ব্যাগ খুঁজে সব কাগজ উপুড় করে ফেললেন টেবিলের ওপর। এসির ঠাণ্ডায়ও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠছে। দুটো কাগজ উড়ে টেবিলের নিচে চলে গেল, গোটাকয়েক সিকি আধুলি গড়িয়ে সামনের টেবিলের তলায় চলে গেল। সামনের টেবিলে বসা ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কালীবাবু তাড়াতাড়ি অন্যের সিটের তলায় হাতড়াচ্ছেন। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে এই দেখে যে একটা বয়স্ক লোক হঠাৎ মাটিতে হামাগুড়ি দিচ্ছেন। হলটা কী?

মালিক চলে এসেছে। “দাদু, আপনি কি কিছু খুঁজছেন? কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? আমি কিছু হেল্প করব?”

কাষ্ঠ হাসলেন কালীবাবু। “না, তেমন কিছ নয়। ওই পয়সা পড়ে গেছে।”

মালিক খুঁজে দিয়ে গেল পয়সা আর কাগজ। কিন্তু সব পাসওয়ার্ড লেখা কাগজটাই খুঁজে পেলেন না। পরিষ্কার বুঝলেন হাতের আঙুলগুলো হালকা কাঁপছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। গলা কাঁপছে। এবার তাহলে উপায়? নিজেকে বোঝালেন, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। ঠিক আছে, ট্রেনের টিকিট কাটতে না পারলেও বাড়ির ট্যাক্স তো দিতে পারবেন। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ট্যাক্স তো জমা দিতে পারবেন। ওখানে তো অসুবিধা হবার কথা নয়। মেশিনে কলকাতা মিউনিসিপ্যালের ওয়েবসাইটে ঢুকে পড়লেন। কিন্তু টাকা জমা দিতে গিয়ে দেখলেন ওখানেও তো পাসওয়ার্ড লাগবে এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলেন সেটাও মনে পড়ছে না। ঠাণ্ডা ঘরে বসে রীতিমতো ঘেমে উঠেছেন। চারদিক সব টেবিলে সবাই ব্যস্ত, কিন্তু কালীবাবু এদিক ওদিক তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করলেন। একবার নিজের, একবার কলির, কণার নাম, জন্মদিন বসাতে বসাতে গিয়ে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টটাই আটকে গেল। এবার অবস্থা ঘোরালো হয়ে গেল। পকেটে বেশি টাকা নিয়েও বের হননি। একবার ভাবলেন কমলাকে ফোন করবেন, কিন্তু ভাবলেন না থাক, চিন্তা করবে বাড়িতে, একা আছে। কিন্তু কণাটা কম্পিউটারটা ভালো জানে ভেবে ওকেই ফোন করতে গেলেন। অদ্ভুতভাবে রোজ যে ফোনে বহুবার এদিক ওদিক ফোন করেন তার পাসওয়ার্ড তাও মনে পড়ল না। এত সহজ, রোজ ফোন খুলছেন, কিন্তু হল না। অনেকবার আঙুল ঘুরিয়েও খুলল না। কী করবেন? মানিব্যাগে কাগজ, টাকা গুছিয়ে তুলতে গিয়ে ভীষণভাবে আঙুলগুলো কাঁপছে। শরীর অবশ অবশ লাগছে। মাথাটা দপদপ করছে। এমন অবস্থায় আগে কখনও পড়েননি। নিজের উপর ভীষণ রাগ হতে লাগল। কাগজটা ব্যাগ থেকে কোথায় পড়ে গেল বুঝতেই পারছেন না। আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এখন কী করবেন? কাজগুলো পড়ে রইল। নিজেকে বোঝালেন, আমাকে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না। সাইবার কাফে থেকে টাকা মিটিয়ে ফুটপাথে এসে দাঁড়ালেন। স্থির হয়ে ভেবে দেখলেন, এখনও তো ওঁর কাছে এটিএম কার্ড আছে। কুছ পরোয়া নেই। সামনের এটিএম-এ ঢুকে টাকা তুলবেন। তারপর লাইন দিয়ে অন্তত ইলেকট্রিক বিল তো দিতে পারবেন। কিন্তু এবারও কালীবাবু বিফল। রোজ টাকা তোলেন, রোজ যে পাসওয়ার্ড দেন, এটাও পরপর তিনবার ভুল দিলেন। চতুর্থবার আটকে গেল পাসওয়ার্ড ভুল দেওয়ার জন্যে। আজ আর ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলাও যাবে না। কী মুশকিল! আর বাড়ি গিয়ে বলবেনই বা কী? পুরো ঘটনা শুনলে কমলা এরপর তো একাই ছাড়বে না। অথচ এসব কাজ অন্য কাউকে দেওয়াও যায় না। পাসওয়ার্ড লেখা কাগজটা না হারালে তো এমন হত না। আগে দু-চারটে পাসওয়ার্ড অনায়াসেই মনে রাখতেন। শেষে এত পাসওয়ার্ড অজান্তেই হয়ে গেল যে মনে রাখাই দায়। মুশকিল আরও যে তিনবার ভুল দিলেই সর্বনাশ। আটকে যাবে সব সুবিধা। তাই এটা চিরকুটে লিখে মানিব্যাগে রেখে দিতেন।

এবার কার্যত ভেঙেই পড়লেন কালীবাবু। জুন মাসের দুপুর বারোটায় মাথাটা আর কাজ করছে না। জবজবে ঘেমে উঠেছে, জলতেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। পায়েও কোনও জোর পাছেন না। সামনে একটা শেড দেওয়া রক পেয়ে বসেই পড়লেন। কালীবাবু ভেবেই পাছেন না কেন এমন হল। একটাও কাজ করতে পারেননি। বন্ধু সলিলের ওপর ভীষণ রাগ হতে লাগল যে ওঁকে একটা ফাইলে সবকিছু রেখে প্রটেক্ট করে রাখতে বলেছিলেন। তাহলে এখন কী করা? পাসওয়ার্ডগুলো তো পেতে হবে। সেটাই বা কী করে ফিরে পাবেন? হঠাৎ এক অজানা আতঙ্ক মনকে ভাবিয়ে তুলল। যদি কেউ ঐ চিরকুটটা পায় তাহলে কী হবে? তাহলে তো সব অ্যাকাউন্ট সে দেখতে পাবে, টাকাপয়সাও তো গেল তাহলে। আর ভাবা যাচ্ছে না। একটাই সান্ত্বনা, ওখানে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলো জানতে পারবে না। পাশে পাশে অ্যাকাউন্ট নাম্বার উনি চালাকি করে লিখে রাখেননি।

নিজের ওপর রাগে, অসহায়তায় চোখদুটো জলে ভরে এল। পারছেন না পেরিয়ে যাওয়া সময়কে ধরতে। ঘামে ভেজা মুখ আর চোখের জল পকেটের রুমালটা দিয়ে মুছে ফেললেন। নাহ্‌, এই বয়সে চোখের জল আর মানায় না। কমলা, কণা এরা তো কালীবাবুর চোখে জল এটা ভাবতেই পারবে না। এটা যে বাড়ির বাইরে ঘটেছে সেটাই মঙ্গল। নাহলে কমলারা কী ভাবত? জিভটা শুকিয়ে আসছে। কাছাকাছি কোনও কলও নেই একটু জল খাবেন। ভয় করছে, বাড়ি ঠিকমতো যেতে পারবেন তো? পকেট হাতড়ে যা উঠে এল তা দিয়ে অটোর ভাড়াও হবে না। এতটা দূর যে এই দুপুরে হেঁটেও যেতে পারবেন না। কোনও দরকার ছিল না তাই বেশি টাকাপয়সা নিয়েও বের হননি।

হঠাৎ মনে হল, কোথায় একটা ফোন বাজছে। পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন ওঁর ফোনটাই বাজছে। তুলে দেখলেন কণা ফোন করেছে।

“হ্যালো কণা, শুনতে পারছি?” নিজের গলা নিজের কাছেই অপরিচিত মনে হল। জোরে জোরে বললেন, “আমি বাবা বলছি। শুনতে পারছিস? আমি বাবা।”

রাস্তার গাড়ির শব্দে মনে হল কনা বোধ হয় কিছু শুনতে পারছে না। উদ্বিগ্ন গলায় কণা বলে, “তোমার গলা এরকম লাগছে কেন, বাবা?”

কালীবাবু ফোনটা আসাতে একটু আশান্বিত হন। এখন তো ফোন কথা বলা যাবে, কোনও অসুবিধা নেই। আর্তস্বরে চেঁচিয়ে ওঠেন, “সর্বনাশ হয়ে গেছে আমার, কণা!”

“কী সর্বনাশ! কী হয়েছে খুলে বলো, বাবা। তুমি এখন কোথায়? তোমার শরীর ঠিক আছে তো? এমন করছ কেন?”

“কণা, আমি ভালো আছি রে, আমার কিছু হয়নি। কিন্তু আমি সব পাসওয়ার্ড হারিয়ে ফেলেছি। কী হবে এখন?”

শান্ত স্বরে কণা বলে, “তাতে কী বাবা? আবার করে দেব আমি তোমাকে। এত চিন্তা কোরো না, এটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো, মা চিন্তা করে আমাকে ফোন করেছে।”

“সব পাসওয়ার্ড হারিয়ে আমার এমন অবস্থা যে ব্যাগে টাকা নেই যে বাড়ি ফিরে আসব ট্যাক্সি ধরে। তার টাকাও তুলতে পারছি না।”

কণা হেসে ফেলে। “এটা কোনও ব্যাপার নয়, বাবা। তুমি এত চিন্তা কোরো না।”

“তুই হাসছিস?” কালীবাবু কিছুটা অবাকই হন।

কণা বলে, “তুমি ঠিক কোথায় আছ একটু বলবে? আমি তোমাকে ওলা বুক করে পাঠিয়ে দিচ্ছি, একটু অপেক্ষা করো।”

যাক বাবা! সব তাহলে ঠিকঠাক ই আছে। শরীরে একটা ঠাণ্ডা ফুরফুরে বাতাস বয়ে গেল। যাক শরীরটা হালকা হল, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

“বাবা, জায়গাটার নাম বলো। এবার কিন্তু বাবা…” কণা হাসতে থাকে।

আজ কালীবাবু আর কিছু বলতে পারেন না।

কণা ওলা ডেকে দিয়েছে। দরজা খুলে বসতে গেলে আবার কালীবাবুর মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেল। ড্রাইভার ওটিপি চাইছে। বিপদ যেন আজ কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। কণা এটা মনে হয় দিতে ভুলে গেছে। ড্রাইভারকে অনুরোধ করেও কিছু হল না। ওটিপি ছাড়া যাবে না। কোনও অনুরোধ চলবে না।

এমন সময় পিঠে চাপড়। কাজলবাবু দাঁড়িয়ে সেই বত্রিশ পাটি দাঁত বার করে। স্কুটার নিয়ে সাক্ষাৎ দেবদূত দাঁড়িয়ে আছেন। “দাদা চলুন, বাড়ি যাবেন তো? ওলাগুলো ভীষণ বদমাইশ, ছাড়ুন ওসব। চলুন, আমি তো বাড়িই যাচ্ছি। পিছন থেকে দেখছিলাম আপনাকে। মনে হল কিছু একটা প্রবলেম হচ্ছে আপনার।”

শরীর আর দিচ্ছে না। হাত দিয়ে ঘাম মুছে, ধন্যবাদ জানিয়ে স্কুটারের পিছনেই উঠে বসলেন। কাজলবাবু যেতে যেতে কত কথা বলে চললেন, কিন্তু কালীবাবু অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতেই থাকেন কী যে হল আজ। তিনি সত্যি হেরে গেছেন আজ। নিজের এমন করুণ অবস্থা আগে তো কোনোদিন হয়নি। আজ কাজলবাবুকে ততটা খারাপ লাগছে না। মানুষটা খারাপ নয়।

শেষ হারটা নিজের কাছে এখনও যা বাকি ছিল সেটা পরিপূর্ণ হল বাড়ি এসে দরজার কাছে লেটার বক্সে চোখ পড়বার পর। তাই তো! ইস, এতক্ষণ মনে পড়ল না! ওই তো জ্বলজ্বল করছে ওঁর পাসওয়ার্ড দুটো। কাল কণাই বলেছিল সোজা কিছু রাখো। তাই ‘কালীরায়’ আর ‘কমলারায়’—এ দুটো মনে পড়ল না? এখন কমলাকে কী বলবেন উনি?

দরজা খুলে কমলা চেয়ে আছে। মনে হয় একটা হেরো মানুষকেই দেখছে।

অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s