অপর্ণা চৌধুরী
পিকলুর ভালো নাম প্রিয়াংশু, প্রিয়াংশু সেন। ও ক্লাস টুতে পড়ে। ওদের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা সবাই কম্পিউটার বা ভিডিও গেম খেলতে খুব ভালোবাসে, কিন্তু পিকলুর একদম ভালো লাগে না। ও ভালোবাসে গাছপালা, পশুপাখি, খোলা আকাশ। স্কুল থেকে ফিরেই ও একবার ওদের বাগানটায় ঘুরে আসে। বাগানে ওর অনেক বন্ধু। বাগানের সব গাছেরা, চড়ুই পাখি, শালিক পাখি, কাঠবিড়ালি সবাই ওর বন্ধু। ও সবার সঙ্গে কথা বলে, সবার খবর নেয়। দুপুরবেলায় এটাই ওর কাজ। বিকালবেলায় ও ওর সাইকেলটা নিয়ে বেরোয় ওদের বাড়ির সামনের রাস্তাটায়। ওদের পাড়াটা খুব সুন্দর। রাস্তার দু’ধারে বড়ো বড়ো গাছ। বেশিরভাগ বাড়ি বাংলো প্যাটার্নের, চারদিকে বাগানঘেরা। এখন অবশ্য কয়েকটা বাড়ি ভেঙে বহুতল হচ্ছে, তবুও এখনও বেশ ফাঁকা ফাঁকা। এই বাংলো বাড়িগুলোতে বেশিরভাগই বুড়ো-বুড়িরা থাকে। এদের ছেলেমেয়েরা সব বিদেশে থাকে, মাঝে মাঝে এসে দেখে যায়। এই কারণে পাড়াটা খুব শান্ত আর গাড়ি চলাচলও খুব কম। পিকলুর সমবয়সী এ পাড়ায় কেউ নেই। তাই ও একা-একাই সাইকেল চালায়। তারপর সন্ধ্যা হলেই মা ডাকেন, “পিকলু, পড়তে বস।” তখন ও চলে যায় ওর হোম-ওয়ার্ক করতে।
ইদানীং পিকলুর একটা নতুন বন্ধু হয়েছে, একটা কাঠবিড়ালি। এটাকে ও ওদের বাগানে দেখেনি। ও যখন সাইকেল নিয়ে বেরোয় তখন ওই কাঠবিড়ালিটা ওর সঙ্গে সঙ্গে চলে। সেদিন ও বেরোনোর সময় একটা বিস্কুট পকেটে পুরে নিল। গেটের বাইরে বেরিয়ে দেখে কাঠবিড়ালিটা রাস্তার ওপারের গাছটার গায়ে বসে আছে। ও হাতের বিস্কুটটা কাঠবিড়ালিটাকে দেখাল, তারপর সেটাকে ছোটো ছোটো টুকরো করে মাটিতে ছড়িয়ে দিল। পিকলু একটু দূরে সরে যেতেই কাঠবিড়ালিটা এসে ওই বিস্কুটের টুকরোগুলো খেতে লাগল। ওর খাওয়াটা দেখতে খুব মজা লাগে পিকলুর। প্রথমে মুখ দিয়ে টুকরোটা তুলে নেয়, তারপর সামনের দুটো পা দিয়ে টুকরোটাকে ধরে পিছনের পায়ের উপর সোজা হয়ে বসে সেটাকে খায়। আর ওর ল্যাজটা কখনও সোজা হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে বা ইংরাজি ‘এস’ অক্ষরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। পিকলু ওর সাইকেল নিয়ে চলে যায় রাস্তার অন্যদিকে, চালাতে থাকে এ-মাথা থেকে ও-মাথা অবধি।
এই রাস্তার উপরেই একটা বাড়ি আছে যার নাম ‘এভারগ্রিন ভিলা’। এই বাড়িটার বাগানে সব বড়ো বড়ো গাছ, মনে হয় যেন জঙ্গল। গেট থেকে অনেকটা ভিতরে বাড়িটা। গেট থেকে পিচে বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে বাড়িটা অবধি। বাড়িটা অনেক পুরনো। তেকোনা টালির ছাদ, কাঠের জানালা। পিকলু সবসময়ই জানালা-দরজাগুলো বন্ধ অবস্থায় দেখেছে। বাড়িটায় কে থাকে কে জানে। তবে একটা বড়ো বাঘের মতো কুকুর আছে। সেই কুকুরটা ঘুরে বেড়ায় সারা বাগানে। পিকলুর এই কুকুরটাকে একটু ভয় লাগে। তাই ইচ্ছে থাকলেও বাড়িটার ভিতরে কখনও যাওয়া হয়নি।
একদিন যখন ও এভারগ্রিন ভিলার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ দেখল, সেই ছোট্ট কাঠবিড়ালিটা ওই বাড়ির গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকল। পিকলু ওই কাঠবিড়ালিটাকে দেখলেই চিনতে পারে, কারণ ওর লেজটা একটু সরু।
পরেরদিন রবিবার, স্কুলের ছুটি। রবিবার পিকলু একটু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করতে করতে ও বারান্দায় এল। দেখল, বারান্দার গ্রিলের সামনে কাঠবিড়ালিটা বসে আছে। ও তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে একটা বিস্কুট নিয়ে বারান্দায় এল। তখনও কাঠবিড়ালিটা ওখানেই বসে আছে। পিকলু বিস্কুট ভেঙে ভেঙে দিতেই ও এসে খেতে শুরু করল। একটা অদ্ভুত জিনিস পিকলু খেয়াল করল, সেটা হচ্ছে কাঠবিড়ালিটা ওকে ভয় তো পাচ্ছেই না বরং খেতে খেতে মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকাচ্ছে। পিকলু ওদের বাগানের অনেক কাঠবিড়ালিকে দেখেছে, তারা কেউই খুব একটা কাছে আসে না। সবচেয়ে বড়ো কথা কেউই ওর দিকে তাকায় না। ওর বেশ মজা লাগল। ও জিজ্ঞাসা করল, “তোমার ভালো লাগছে?”
ওকে অবাক করে দিয়ে কাঠবিড়ালিটা মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। পিকলু ভাবল, ও নিশ্চয়ই ভুল দেখেছে। ও চোখটা ভালো করে কচলে নিয়ে আবার দেখল। কাঠবিড়ালিটা চুপচাপ বিস্কুট খাচ্ছে। তারপর কী মনে হতে ও আবার জিজ্ঞাসা করল, “ভালো?”
এবারও ও পরিষ্কার দেখল যে কাঠবিড়ালিটা মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। দু-দু’বার ভুল দেখবে ও? নাহ্, তা হতে পারে না। কাঠবিড়ালিটা খাওয়া শেষ করে যাবার সময় তার সামনের হাতটা টাটা করার ভঙ্গিতে নাড়াল, তারপর এক দৌড়ে ওদের বাগান পেরিয়ে বাইরের রাস্তায় বেরিয়ে গেল।
পিকলুও একছুটে মায়ের কাছে গেল। মা রান্নাঘরে সকালের জলখাবার তৈরি করছিলেন। ও চিৎকার করে মাকে বলল, “মা, মা, জানো! এখুনি একটা কাঠবিড়ালি এসেছিল। আমি ওকে বিস্কুট খাওয়াচ্ছিলাম, ও আমাকে টাটা করল।”
মা রান্না করতে করতে হেসে বললেন, “তাই? বাহ্! বেশ।”
“আমি সত্যি বলছি, মা!”
“আমি কখন বললাম তুই মিথ্যা বলছিস! তোর তো বাগানের সব পশুপাখিদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব, তা আরও একটা বাড়ল।”
ওদের কথাবার্তা শুনে বাবা ঘর থেকে রান্নাঘরে এলেন। “কী, হয়েছেটা কী?”
মা মুচকি হেসে বললেন, “তোমার ছেলেকে একটা কাঠবিড়ালি টাটা করেছে।”
ওর এই প্রকৃতিপ্রেমী স্বভাবটা বাবাও জানেন। তিনি ওকে কোলে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন আর বললেন, “পিকলু সোনা, আমাকে বল তো দেখি কী হয়েছে।”
পিকলু অভিমানী সুরে বলল, “কী হবে বলে, তুমিও বিশ্বাস করবে না।” বলে ও সেই যে চুপ করে গেল, ওর বাবা হাজার চেষ্টা করেও ওকে দিয়ে আর কিছু বলাতে পারলেন না।
পিকলুর সঙ্গে কিন্তু ওই কাঠবিড়ালিটার বন্ধুত্ব বাড়তেই লাগল। ও জানে পিকলু কখন স্কুল থেকে ফেরে। ও ঠিক সেই সময়টায় ওদের গেটের সামনেটায়, নাহলে বারান্দার পাশের মাধবীলতা গাছটাতে বসে থাকে। রোজ পিকলু ওকে বিস্কুট খাওয়ায়।
একদিন ওকে বিস্কুটটা দিয়ে ও বাড়ির ভিতরে গেছে। ফিরে এসে দেখে একটা শালিক পাখি বিস্কুটের টুকরোগুলো খেয়ে নিচ্ছে আর কাঠবিড়ালিটা ভয়ে মাধবীলতার উপরে চড়ে চুপচাপ দেখছে। পিকলুকে আসতে দেখেই কাঠবিড়ালিটা গাছ থেকে নেমে এসে পিকলুর সামনে দু’পায়ে দাঁড়িয়ে ওর একটা হাত কোমরে রেখে আরেকটা হাত দিয়ে শালিকটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওর নিজের ভাষায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নালিশ জানাতে লাগল। এদিকে শালিকটা পিকলুকে দেখে ভয়ের চোটে গিয়ে বসেছে পেয়ারাগাছের ডালে। পিকলু ওর কাণ্ডকারখানা দেখে এত অবাক হয়ে গেছে যে ওর মুখ দিয়ে কোনও কথাই বেরোল না। ওকে এরকম বোকার মতন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাঠবিড়ালিটা খানিকক্ষণ চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মাথাটা ডানে বাঁয়ে এমনভাবে নাড়াল যে পিকলুর মনে হল ও বলছে, ‘তোমার দ্বারা কিসস্যু হবে না।’ তারপর ছোঁ মেরে বাকি বিস্কুটটা মুখে নিয়ে ছুটে চলে গেল রাস্তার ওপারের কাঠবাদাম গাছটার উপরে।
পিকলু অনেকক্ষণ চুপচাপ বারান্দায় বসে রইল। ভাবল, ব্যাপারটা কি মা-বাবাকে জানাবে? তারপর ভাবল, ওরা তো বিশ্বাসই করবে না। তাই ঠিক করল, মা-বাবাকে জানাবে না।
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। ওর সঙ্গে কাঠবিড়ালিটার মাঝেমাঝেই কথা হয়। ও কোনও কথা বললে কাঠবিড়ালিটা বসে বসে শোনে। পিকলুর কেন জানি না মনে হয়, ওর কথা কাঠবিড়ালিটা কিছু কিছু বুঝতেও পারে।
একদিন বিকালে পিকলু সবে ওর সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়েছে, দেখল কাঠবিড়ালিটা ছুটতে ছুটতে ওর দিকে আসছে। ও একটু দাঁড়িয়ে গেল। কাঠবিড়ালিটা ওর সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে ওকে অনুসরণ করতে বলল। পিকলু ওর পিছন পিছন চলতে লাগল। কাঠবিড়ালিটা সেই এভারগ্রিন ভিলার গেটের মধ্যে ঢুকে পড়ল। গেটের সামনে এসে পিকলু ভাবছে ঢুকবে কি ঢুকবে না, ওর চোখের সামনে ওই বিরাট কুকুরটার চেহারাটা ভাসছে। ওকে দোনোমনা করতে দেখে কাঠবিড়ালিটা আবার ওকে ইশারা করল। তখন পিকলু সাহস করে বড়ো লোহার গেটটা খুলে ভিতরে গেল। কাঠবিড়ালিটা বাড়ির খিড়কির দরজার দিকে নিয়ে গেল ওকে। ও দেখল, সেই দরজাটা খোলা আছে। ও সাইকেলটা দরজার পাশে রেখে ভিতরে ঢুকল। দরজার ভিতরে একটু খোলা চাতাল আর বাড়িটা তার চারদিকে ঘোরানো। ও চাতালটা পেরিয়ে খোলা বারান্দায় উঠল, তারপর ঢুকল ঘরে। কাঠবিড়ালিটা ওকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঘরটা বেশ বড়ো আর ছাদটা অনেক উঁচু। ঘরটা পুরনো দিনের আসবাবে ভরা। ঘরের মাঝখানে একটা খাট, আর সেই খাটের সামনে সেই বড়ো কুকুরটা মাটিতে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। পিকলু ঘরে ঢুকতেই কুকুরটা একবার চোখ তুলে দেখল, কিন্তু কিছু বলল না। খাটের উপর একজন বৃদ্ধা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, যে তার শরীর খুব খারাপ। বৃদ্ধা পিকলুকে দেখে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু বলতে পারলেন না, জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। পিকলু আর সময় নষ্ট না করে তক্ষুনি ছুটল মাকে ডাকতে।
পিকলুর মা শিলালিপি নিজে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ফোন করে দিলেন পিকলুর বাবা মৃগাঙ্ক সেনকে। উনি বললেন, “তুমি যাও। আমি একটা অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করে দিচ্ছি, আর আমিও চলে আসছি।”
মিনিট দশেকের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স এসে ওঁকে তুলে নিয়ে গেল হাসপাতালে। পিকলু আর ওর মাও সঙ্গে গেলেন। পিকলুর বাবা সোজা পৌঁছালেন হাসপাতালে। ডাক্তাররা ওঁকে পরীক্ষা করে বললেন যে একদম ঠিক সময়ে আনা হয়েছে, আর দেরি হলে ওঁকে বাঁচানো যেত না। জানা গেল, ভদ্রমহিলার নাম মিসেস অনিতা বিলিমোরিয়া। উনি একাই ওই বাড়িটাতে থাকেন। ওঁর ছেলে আদিল আমেরিকায়ে থাকে। পিকলুর বাবা আদিলের ফোন নম্বর নিয়ে ওঁকে ফোন করে দিলেন। আদিল মৃগাঙ্কবাবুকে অনেক ধন্যবাদ দিলেন আর জানালেন যে উনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসছেন।
মিসেস বিলিমোরিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে ওঁরা যখন বাড়ি ফিরছিলেন তখন পিকলুর মা পিকলুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যাঁ রে! তুই কী করে জানলি যে উনি অসুস্থ?”
পিকলু ধীরে ধীরে বলল, “আমি এমনিই ওই বাড়িটা দেখতে গিয়েছিলাম। তখন দেখলাম উনি অসুস্থ।” ও কাঠবিড়ালির কথা আর বলল না।
পিকলুর মা ও বাবা একসঙ্গে বলে উঠলেন, “তুমি খুব ভালো কাজ করেছ। আমরা খুব খুশি হয়েছি।”
মা পিকলুর কপালে একটা চুমু খেলেন।
তিনদিন বাদে মিসেস বিলিমোরিয়াকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল। ওঁর ছেলে আদিলের আসতে আরও দু’দিন সময় লাগবে। পিকলুরা ওঁকে বাড়ি নিয়ে এল। কিন্তু এখনও উনি খুবই দুর্বল। পিকলুর মা দু’বেলা ওঁর জন্য খাবার রান্না করে পৌঁছে দিয়ে আসেন। বাবা ওষুধপত্র আর বাকি দরকারি জিনিসপত্র কিনে এনে দেন আর পিকলু স্কুলের সময়টা ছাড়া বাকি সময়টা ওঁর সঙ্গেই কাটায়। এখন ওই বিরাট কুকুরটার সঙ্গেও ওর বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ওর নাম টমি। মিসেস বিলিমরিয়াকে পিকলু অনু-আন্টি বলে ডাকে। অনু-আন্টিও ওকে খুব স্নেহ করেন।
সেদিন পিকলু অনু-আন্টির বাড়িতে ঢুকেই দেখল যে উনি বারান্দার বড়ো ইজি চেয়ারটাতে বসে আছেন। পিকলুকে দেখতে পেয়ে উনি হাতছানি দিয়ে ওকে কাছে ডাকলেন। পিকলু কাছে যেতেই উনি পিকলুকে নিজে চেয়ারের হাতলের উপর বসিয়ে নিলেন। তারপর ধীরে ধীরে ইংরাজি ও হিন্দি মিলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওই যে ছোট্ট কাঠবিড়ালিটা তোমাকে আমার শরীর খারাপের খবরটা দিল, তুমি কি ওর বন্ধু?”
পিকলু চমকে উঠল। অনু-আন্টি কাঠবিড়ালির কথা জানল কীভাবে? ওর মুখের অবস্থা দেখে অনু-আন্টি মৃদু হেসে বললেন, “আমি কাঠবিড়ালির কথা কী করে জানলাম তাই ভাবছ তো? ও-ই আমাকে বলেছে। তুমি যেমন ওর বন্ধু, আমিও ওর বন্ধু। ওর নাম ডোরা। তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি কাউকে বলবে না তো?”
পিকলু মাথা নেড়ে জানাল যে সে কাউকে বলবে না।
“আমি পশুপাখি, গাছপালার ভাষা বুঝতে পারি।”
পিকলু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “গাছপালারাও কথা বলে?”
অনু-আন্টি হেসে বললেন, “বলে তো। কিন্তু কেউ বুঝতে পারে না। শুধু ওরাই ওদের নিজেদের ভাষা বোঝে। ওরা গানও গায়, আর গান শুনতেও খুব ভালোবাসে। তুমি ওদের কথা শুনতে চাও?”
পিকলু বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু কীভাবে?”
উনি বললেন, “তুমি এখানে চুপটি করে চোখ বন্ধ করে বসে থাকো। আমি যতক্ষণ না বলব তুমি চোখ খুলবে না।”
পিকলু চোখ বন্ধ করল। অনু-আন্টি ওঁর একটা হাত দিয়ে পিকলুর একটা হাত ধরলেন আর ওঁর আরেকটা হাত পিকলুর মাথায় রাখলেন। তারপর চোখবন্ধ করে বিড়বিড় করে কীসব মন্ত্র পড়লেন। তারপর হাত সরিয়ে নিয়ে পিকলুকে বললেন, “এবার তুমি চোখ খুলতে পারো।”
পিকলু চোখ খুলল। তারপর চারদিকে তাকিয়ে দেখল, কিন্তু কোনও তফাত বুঝতে পারল না। হঠাৎ দেখল, ডোরা ছুটে আসছে ওদের দিকে। পিকলু পরিষ্কার শুনল ও বলছে, “অনু-আন্টি, তোমার বাড়িতে কেউ আসছে।”
সঙ্গে সঙ্গে অনু-আন্টির কুকুর টমি বলল, “তোমার ছেলে আদিল আসছে।”
পিকলু অবাক হয়ে গেল। ও সত্যি সত্যি ওদের কথা শুনতে পাচ্ছে!
অনু-আন্টি পিকলুর দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললেন, “তুমি সত্যিই ওদের কথা শুনতে পাচ্ছ? কিন্তু সেকথা তুমি কাউকে বোলো না। লোকে তোমায় পাগল ভাববে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, জীবজন্তুরা মিথ্যা কথা বলে না। তাই ওদের কথা তুমি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারো।”
এমন সময় আদিল ঢুকল বাড়ির ভিতরে আর অনু-আন্টি কথা থামিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আদিল এসে অনু-আন্টিকে জড়িয়ে ধরল। আন্টি পিকলুর সঙ্গে আদিলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আদিল বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, পিকলু! তোমার জন্যেই আজ আমার মা বেঁচে আছেন। আমি তোমাদের বাড়ি আসব বিকালে, তোমার মা ও বাবার সঙ্গে দেখা করতে।”
বিকালবেলায় আদিল এল পিকলুদের বাড়িতে। মা অনেকরকম মিষ্টি আর নোনতা সাজিয়ে খেতে দিলেন। আদিল অনেকক্ষণ পিকলুর বাবা-মায়ের সঙ্গে গল্প করল। বলল যে ও অনেকদিন থেকেই ওর মাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু অনু-আন্টি এই বাড়িটা ছেড়ে যেতে চান না। কিন্তু এবার ও আন্টিকে নিয়ে চলে যাবে। আন্টিও রাজি হয়েছেন যাবার জন্য। পরেরদিনই ওরা রওনা হবে।
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা বাড়িটার কী করবে?”
আদিল বলল, “আপাতত তালা দেওয়াই থাকবে। পরে ভেবে দেখব কী করা যায়।”
“আর টমি?”
“ওকে নিয়ে যাব। মাম্মি ওকে ছাড়া থাকতে পারবেন না।”
কয়েকমাস হল অনু-আন্টি আমেরিকা চলে গেছেন। অনু-আন্টি চলে যাবার পর থেকে পিকলু যেন আরও একা হয়ে গেছে। ওই বাড়িটার সামনে দিয়ে গেলে এখনও ওর মনকেমন করে। মাঝে মাঝে ডোরার দেখা পায়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সে দূর থেকে ওকে হাত নাড়ে আর নিজের একজন সঙ্গীর সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। এদিকে পিকলুর পরীক্ষাও কাছে এসে গেছে। এখন ও খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। বাইরে বেরোনোর আর খুব একটা সময় পায় না। পিকলুর পড়ার টেবিলটা জানালার সামনে। সেই জানালা দিয়ে বাইরের বাগানটা দেখা যায়। পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে মুখ তুলে পিকলু বাগানের দিকে চেয়ে থাকে।
একদিন এরকম ও বাগানের দিকে চেয়ে আছে, হঠাৎ দেখে ডোরা। ও হাতছানি দিয়ে ডাকতেই ডোরা ওর জানালার উপর উঠে এল। পিকলু জিজ্ঞাসা করল, “কী ব্যাপার, তুমি এখানে?”
“তোমাকে একটা খবর দিতে এসেছি।”
“কী খবর?”
“অনু-আন্টির বাড়িতে কিছু লোক ঢুকেছে কাল রাত্রে।”
“অনু-আন্টি এসেছে?” খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল পিকলু।
“না, অন্য লোক। মনে হয় লোকগুলো ভালো নয়। ওদের কাছে ছুরি আর বন্দুক আছে। ওরা কাল অনেক রাতে পিছনের ভাঙা পাঁচিল দিয়ে ঢুকেছে।”
পিকলু গম্ভীর হয়ে শুনল। তারপর বলল, “ঠিক আছে, আমি দেখছি। তুমি যাও।”
সেদিন বিকালবেলায় পিকলু ওর সাইকেলটা নিয়ে একবার গেল এভারগ্রিন ভিলার সামনে। সামনে থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ও দুয়েকবার চক্কর মেরে বাড়ি ফিরে এল। সন্ধ্যাবেলায় যখন বাবা অফিস থেকে এলেন তখন ও বাবার কাছে গিয়ে বসল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “বাবা জানো, আজ সাইকেল চালাতে গিয়ে আমি দেখলাম ওই অনু-আন্টিদের বাড়িতে কারা যেন ঢুকেছে। অথচ ওদের গেটের সামনের তালাটা লাগানোই রয়েছে।”
বাবা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। “তুই ঠিক দেখেছিস?”
“হ্যাঁ গো!”
“শোন, আমি যা ব্যবস্থা করার করব। তুই কিন্তু ওই বাড়িটার আশেপাশে আর যাবি না।”
“ঠিক আছে, বাবা।” বলে পিকলু পড়তে চলে গেল। ঘর থেকে ও শুনতে পেল বাবা অধীরকাকুর সঙ্গে কথা বলছেন। অধীরকাকু বাবার স্কুলের বন্ধু, পুলিশে চাকরি করেন।
“তোকে আমি জানিয়ে রাখলাম, এবার তুই যা ভালো বুঝিস কর। যদিও পিকলু ছেলেমানুষ, কিন্তু ও কখনও ভুলভাল কথা বলে না।”
তারপর বাবার আরও অনেকক্ষণ কথা হল অধীরকাকুর সাথে। অধীরকাকুর ফোনটা কেটে দিয়ে বাবা আদিলদাকে আমেরিকায় ফোন করলেন। সব শুনে আদিলদা বলল, “আপনি একদম ঠিক করেছেন। প্লিজ গো অ্যাহেড অ্যান্ড কিপ মি পোস্টেড।”
পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে পিকলু দেখে হৈ হৈ ব্যাপার। মা ওকে মুখ ধুইয়ে, জামা ছাড়িয়ে বসার ঘরে নিয়ে এলেন। বসার ঘরে অনেক লোক। তাদের বেশিরভাগ লোককেই পিকলু চেনে না। শুধু কোণের দিকে সোফায় বাবা অধীরকাকুর পাশে বসে হেসে হেসে গল্প করছেন। ও ঘরে ঢুকতেই সবাই হৈ হৈ করে উঠল, “আরে এসো এসো, পিকলুবাবু!”
ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলতে লাগল কয়েকজন লোক। বাবা ওকে ডেকে নিজের কোলে বসালেন। তারপর বললেন, “এরা হচ্ছে খবরের কাগজের রিপোর্টার। তোর দেওয়া ইনফর্মেশন অনুযায়ী পুলিশ কাল এভারগ্রিন ভিলাতে রেইড করেছে, আর একটা চেন স্ন্যাচিং গ্যাংকে ধরে ফেলেছে। এই বদমাইশগুলো বহুদিন ধরে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে ছিল। এতদিনে ওরা তোর জন্য ধরা পড়ল।”
“তো পিকলুবাবু, তুমি এখন আমাদের হিরো।” হেসে বললেন অধীরকাকু।
তারপর খবরের কাগজের রিপোর্টাররা পিকলু, পিকলুর মা, বাবা আর অধীরকাকুর ইন্টারভিউ নিয়ে চলে গেল। অধীরকাকু যাবার সময় বলে গেলেন, “পিকলু, তোমার একটা পুরস্কার পাওনা হয়েছে। খুব শীঘ্রই পুলিশ বিভাগের তরফ থেকে আমরা তোমাকে একটা পুরস্কার দেব।”
পরেরদিন খবরের কাগজে পিকলু, পিকলুর বাবা মা আর অধীরকাকুর ছবি দিয়ে খবর ছাপা হল। পিকলুর মা আর বাবা খুব খুশি। পিকলু খবরের কাগজটা নিয়ে ওর পড়ার ঘরে বসে দেখছে, এমন সময় ডোরা এল। ও আসতেই পিকলু বলে উঠল, “থ্যাঙ্ক ইউ ডোরা, তুমি জানো, তোমার দেওয়া খবরে একটা দুষ্টু লোকেদের দল ধরা পড়েছে?”
ও বলল, “জানি। কিন্তু তুমি আমার কথা কাউকে বলনি তো? আমার বাচ্চাগুলোর সবে এক সপ্তাহ বয়স। যদি কেউ জানতে পারে, যে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলি, তাহলেই এসে সারা বাগান তোলপাড় করে আমাকে খুঁজতে আরম্ভ করবে। এই খবরের কাগজে লোকেদের বিশ্বাস নেই। এরা সব জায়গায় পৌঁছে যায়। তখন আমার বাচ্চাগুলোর কী হবে?”
পিকলু হেসে বলল, “তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। তোমার কথা আমি কাউকে বলব না। গড প্রমিস।”
জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে