গল্প পুনর্বাসন পৃথা মণ্ডল শীত ২০১৯

পৃথা মণ্ডলের আগের গল্প ছাতা

পুনর্বাসন

পৃথা মণ্ডল

এক্স-৩২ কাচের ভিতর দিয়ে বাইরে দেখলেন। প্রেসিডেন্ট রাজি হননি। হওয়ার কথাও নয়, এতগুলো মানুষকে পুনর্বাসন দেওয়া তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। তাঁদের গ্রহ অর্থাৎ ‘রেনবো-৭৬’-এ সবকিছুই কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করতে হয়। নদীনালা, গাছপালা, এমনকি শ্বাস নেওয়ার অক্সিজেনটাও সেখানে উৎপাদিত হয়। প্রতিদিন একজন নাগরিক কতটা জল বা অক্সিজেন ব্যবহার করতে পারবেন, তার একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে। কোনও কারণে কোনও ব্যক্তি যদি সীমার অতিরিক্ত অক্সিজেন ব্যবহার করতে চান, তবে লিটার প্রতি ধার্য দাম আছে। এর মধ্যে ১৫২ জন বাস্তুহারা মানুষকে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান দেবার সামর্থ্য এ রাষ্ট্রের নেই।

দেশের সংগৃহীত করের বেশি ভাগটাই যায় প্রতিরক্ষা এবং কৃত্রিম অক্সিজেন উৎপাদনে। এই কাচের আস্তরণের বাইরে ১৫২টা প্রাণ, যার মধ্যে অধিকাংশই নারী এবং শিশু—অপেক্ষা করছে মৃত্যুর। ওদের কাছে যা অক্সিজেন আছে, তা দিয়ে বড়োজোর বাহাত্তর ঘণ্টা চলবে। জল কাল সকাল হবার আগেই ফুরিয়ে যাবে। আগামীকাল থেকে ওদের একটা নিষ্ঠুর উপায় অবলম্বন করতে হবে বেঁচে থাকার জন্য। ওদের মধ্যে যে সবচেয়ে বৃদ্ধ, তার অক্সিজেন মাস্কটা খুলে নেবে ওরা। কয়েক মুহূর্তে তার সব শেষ। তারপর তার পরের জনের পালা। এভাবে যতক্ষণ পারবে ওরা জল আর অক্সিজেনের রেশনিং করতে চাইবে।

মাথার রগদুটো দপদপ করছে এক্স-৩২-এর। তাঁদের দেশের জনসংখ্যা ১৮১৫। এর মধ্যে ৭০০ পুরুষ, ৬৬৫ জন মহিলা, বাকি ৪৫০ জনের বয়স এক থেকে আঠারোর মধ্যে। দেশের হিসাবে তারা শিশু। এই ১৫২ জনকে আনলে দেশে নারী-পুরুষের বৈষম্য আসবে। তাছাড়া, শিশুদের শিক্ষা এবং অন্যান্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। মাত্র তিয়াত্তর বছরের দেশের এই চাপ নেবার ক্ষমতা নেই। বছর বাইশ আগে চুয়াল্লিশ জন রিফিউজিকে গ্রহণ করেছিল তৎকালীন সরকার। এক্স-৩২ তখন সদ্য চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। সরকার গদিচ্যুত হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। খাদ্যসংকট, অক্সিজেনের অভাব, পানীয় এবং অন্যান্য ব্যবহার্য জলের রেশনিং, বড়ো কারখানাগুলোর জল ব্যবহারে রাশ টানা—কত কী করে দেশটার হাল ধরতে হয়েছিল।

বাইশ বছরে দেশ অনেকটাই এগিয়েছে, কিন্তু ১৫২ জনের চাপ সহ্য করতে পারবে না। বিরোধীপক্ষ যে সেকথা জানে না তা নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে মনুষ্যত্বের দোহাই দিয়ে। প্রেসিডেন্ট এক্স-৩২কে বলেছেন মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে যাতে শ্যামও থাকে, কুলও। কিন্তু এক্স-৩২ কোনও উপায়ই দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁর একশো বিয়াল্লিশ তলার অফিস থেকে কাচের ঘেরাটোপের বাইরে ওদের উদ্বাস্তু শিবির দেখা যাচ্ছে। এই কাচের ভেতর সমস্ত এলাকা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হলেও এক্স-৩২ জানেন, বাইরে ভয়ানক গরম। চামড়া পুড়ে ঘা হয়ে যায়। গত সাতদিনে ওদের মধ্যে এই চামড়ার অসুখ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাচ্চাগুলো। এই মধ্যপন্থা সন্ধানের জন্যেই ডব্লিউ-৭৩৮কে ডেকে পাঠিয়েছেন এক্স-৩২। ডব্লিউ-৭৩৮ অক্সিজেনের ইনচার্জ।

“আমাদের কত অক্সিজেন বাড়তি উৎপাদন হয়?”

এক্স-৩২-র প্রশ্নে ভুরু কুঁচকালেন ডব্লিউ-৭৩৮। সিনিয়র অফিসারের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পারা যায় না। বিশেষত সেই সিনিয়র যখন গুপ্তচর প্রধান। দেশের লোক জানে, দেশে বাড়তি অক্সিজেন উৎপাদন হয় না। হয় না বলেই লিটার পিছু দাম দিতে হয় বাড়তি খরচা করতে হলে। হয় না বলেই খেলোয়াড় বা নৃত্য-সঙ্গীতশিল্পীদের আলাদা রেজিস্ট্রেশন নিতে হয়।

সমস্যা হচ্ছে, গুপ্তচর প্রধানকে মিথ্যে বলে কোনও লাভ নেই। তিনি জানেন কতটা অতিরিক্ত অক্সিজেন উৎপাদিত হয়। প্রশ্নটা ভদ্রতামাত্র। ডব্লিউ-৭৩৮ বলেন, “দিনে ৩৬৩ লিটার।”

“এই মুহূর্তে আপনাদের স্টকে কত লিটার স্টোর করা আছে?”
“২২,৬৮৩ লিটার।”
“১৫২ জনকে কতদিনের জন্যে অক্সিজেন দেওয়া যাবে এই অনুপাতে?”
“আজ্ঞে, পনেরো থেকে কুড়ি দিনের বেশি নয়।” জানান ডব্লিউ-৭৩৮।
“কতজন রিফিউজিকে আমরা আশ্রয় দিতে পারি আপনার হিসেবে বলুন।” জিজ্ঞেস করেন এক্স-৩২।

ডব্লিউ-৭৩৮ পড়েন মহা ফাঁপরে। এই অতিরিক্ত উৎপাদিত অক্সিজেনের চাহিদা থাকে বড়োলোকদের ডান্স পার্টিতে। সেখানে একেক লিটারের দাম তিন থেকে চারগুণ পাওয়া যায় এবং সেই পয়সা আসে বেআইনি উপায়ে। ফলে ওই পদ্ধতির কথা অফিসিয়ালি বলা যায় না। এখন ওই অক্সিজেন যদি উদ্বাস্তুদের জন্য ব্যবহার করতে হয়, তাহলে ছেলেমেয়েকে যে মার্স নিয়ে যাওয়ার কথা দিয়েছিলেন ডব্লিউ-৭৩৮, সেকথা কিছুতেই রাখা যাবে না। স্ত্রীকে রক্তমুখী নীলাও দেওয়া হবে না। স্ত্রী অসন্তুষ্ট হবেন, ছেলেমেয়ে নিয়ে যদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান কেলেঙ্কারি হবে। এদিকে গুপ্তচর প্রধানকে মিথ্যে কথা বলার বিবিধ বিপদ। চাকরি যেতে মুহূর্তমাত্র লাগবে না। তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললেন, সঠিক মূল্যায়ন করে তিনি পরেরদিন জানাবেন।

সেলাম ঠুকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন ডব্লিউ-৭৩৮, এমন সময় এক্স-৩২ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “এখন আপনাদের গোডাউন চেক করলে ২২,৬৮৩ লিটার অক্সিজেনই পাব তো?”

২০ ডিগ্রি নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়াতেও মনে হল -২০ ডিগ্রির হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল ডব্লিউ-৭৩৮-এর শিরদাঁড়া বেয়ে। এক্স-৩২ জানেন! সবটাই জানেন! জেনেও না জানার ভান করছেন। কাল যদি সঠিক উত্তর দিতে না পারেন মার্স দূরস্থান, ছেলেমেয়েদের স্কুলের মাইনে দিতে পারবেন না—চাকরিটাই চলে যাবে।

পরদিন ডব্লিউ-১২ এল জলের খবর নিয়ে। তার সিনিয়র ডব্লিউ-৩৬৭ অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে নিজেই এসেছে। এসে জানায়, “আমরা গোটা ৮০ থেকে ৮২ জনের জলের ব্যবস্থা করতে পারব। আমাদের যা উপরি উৎপাদন হয়, তার কিছুটা হাসপাতালগুলোর জন্য রেখে বাকিটা আমরা দিতে সক্ষম। তবে তা হলে আগামী বছরের মধ্যে আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমাদী উৎপাদন কেন্দ্রে লোকের অভাবে বেশ কিছু কাজ আটকে রয়েছে। আশা করি উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান হলে আমরা কিছু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করতে পারব।”

আরও দুই দলের সঙ্গে বৈঠকে বসতে হবে এক্স-৩২কে দফায় দফায়। অথচ তাঁর একশো বিয়াল্লিশ তলার জানালা থেকে আজ তিনি তিন বৃদ্ধের ও এক প্রৌঢ়ের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছেন গত কয়েক ঘণ্টায়। মানুষকে রক্ষা করার ব্রত নিয়েছিলেন তিনি। চারটে মানুষ চোখের সামনে দমবন্ধ হয়ে মারা গেল, তিনি কিছু করতে পারলেন না।

ডব্লিউ-৩৪২ আসবে জমির ব্যাপারে কথা বলতে। তার আগে তিনি নিজের অতি বিশ্বস্ত এ.আই বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সমৃদ্ধ রোবোকে পাঠালেন ওদের বাস্তব হালহকিকত জানতে। অনুচরটি তাঁর নিজের আবিষ্কার। নাম টুনটুনি। ওর অসম্ভব আই.কিউ, যেকোনও ধরনের আবহাওয়া ও সহ্য করতে পারে এবং ওর আরও বহু অত্যাশ্চর্য গুণ আছে। দোষের মধ্যে ও বেশি বকে।

ডব্লিউ-৩৪২ এবং তাঁর সদস্যবৃন্দ জানালেন, সত্তর জনের বেশি লোকের থাকার ব্যবস্থা তাঁরা কোনওমতেই করতে পারছেন না। গ্রহের উত্তর-পূর্বদিকে যে নতুন কাচের ডোম বানানোর কাজ চলছে, তা সম্পূর্ণ হলে ওরা এদের সকলকেই হয়তো থাকতে দিতে পারেন, যদি অবশ্য অক্সিজেন ও পানীয় জল উৎপাদন সঠিকভাবে হয়। কিন্তু সেই কাজ শেষ হতে আরও বছর খানেক লাগবে। তারপর শুরু হবে উৎপাদন। ততদিন ওদের রাখা যাবে না।

ডব্লিউ-৩৪২ এবং তাঁর অনুচরবৃন্দ বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টুনটুনি প্রবেশ করে। “জল প্রায় শেষ, এখন ছোটোদের জন্য জল সংরক্ষিত হচ্ছে। তাপমাত্রা ৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অধিকাংশ লোকের চামড়ায় ঘা হয়ে পচে গিয়েছে। ওদের সংখ্যা এখন ১৪০। যে চারজন আজ শহীদ হয়েছে, তারা ছাড়া আরও আটজন ঘায়ের জন্যে মারা গেছে। এর মধ্যে পাঁচটিই শিশু।”

এক্স-৩২ মুখ ঢাকলেন।

ডব্লিউ-১৮২ জানালেন, খাদ্যের সমস্যা তেমন নেই। নারী এবং শিশু হলে অনায়াসে তাঁরা ৬০ থেকে ৬২ জনের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। ৬২ জনকে তাঁরা আপ্যায়ন করতে প্রস্তুত।

সবাই চলে যাওয়ার পর চেয়ারে শরীর এলিয়ে দেন এক্স-৩২। আরও দু’জন শহীদ হয়েছেন ইতিমধ্যে। রইল বাকি ১৩৮। এর মধ্যে যদি ৬০ জনকে রেনবো-৭৬ রিফিউজ দিতেও পারে, তবে বাকি ৭৮ জনের কী হবে?

“ওদের আমরা ওদের গ্রহে ফেরত পাঠাতে পারি না?” টুনটুনির বহু ক্ষমতার মধ্যে একটা মানুষের অব্যক্ত চিন্তার উপলব্ধি।

“ডিলান-৪৬৮-এর অবস্থা জানিস তুই? বিত্তবানরা অক্সিজেনকে একচেটিয়া করে নিয়েছে। যাদের দু’বেলা খাওয়া জোটে না তাদের বলছে অক্সিজেন কিনতে। গ্যালাক্সি-১৮০-র সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছে ওরা। ওদের পুরুষদের নির্বিচারে যুদ্ধে পাঠাচ্ছে প্রশিক্ষণ ছাড়াই। কাতারে কাতারে লোককে ওরা ইচ্ছে খুশিমতো মেরে ফেলেছে, দেশ থেকে বার করে দিয়েছে। আর এরা দেশ থেকে অক্সিজেন, জল মায় একটা গোটা স্পেস ক্রাফট চুরি করে এনেছে। এরা দেশদ্রোহী। এদের এখানে মেরে ফেলাও যা, দেশে ফিরিয়ে দেওয়াও তা। মাঝখান থেকে আমাদের লক্ষ লক্ষ টাকার জ্বালানি নষ্ট।”

“ডব্লিউ-৩৪২ মিথ্যে কথা বলছে। ওরা ৭৫ থেকে ৮০ জনকে খাদ্য প্রদানে সক্ষম। কিন্তু যা বেশি ফসল উৎপাদন হয়, তার অনেকটাই অন্যান্য জায়গায় চড়া দামে বেচা হচ্ছে। যেমন, ডব্লিউ-৭৩৮ পিছনের দরজা দিয়ে রাত্রিকালীন নানা আসরে অক্সিজেন সাপ্লাই করছে এবং সেই টাকা দিয়ে সে ছেলেমেয়েকে মার্সে নিয়ে যাবে বলে কথা দিয়েছে।” টুনটুনি একটানা বলে থামল।

আসলে ‘ডব্লিউ’ একটি প্রশাসনিক স্তর। যাকে বলে মিডল ম্যানেজমেন্ট। ‘এক্স’ হচ্ছে আপার ম্যানেজমেন্ট। একমাত্র প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ‘জেড’ এবং তাঁর পরিবারবর্গ হচ্ছেন ‘ওয়াই’।

ডব্লিউরা জানেন না মিটিংয়ের সময় কেন টুনটুনি সর্বদা ঘরের মধ্যে উপস্থিত থাকে। তাঁরা জানেন না তাঁদের মস্তিষ্কের প্রতিটা ওঠাপড়া নিখুঁতভাবে বন্দী হয়ে যায় টুনটুনির মেমরিতে। তাঁরা বোঝেন না এক্স-৩২ তাঁদের সব খবর কোথা থেকে জোগাড় করেন।

“বেশ, ৮০ জনকে আমরা গ্রহণ করব। কিন্তু এদের গ্রহণ করার পর যদি ‘ডিলান-৪৬৮’ আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে? আমাদের জল বা অক্সিজেন রিজার্ভে তখন টান পড়বে কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য আমাদের উদ্বৃত্ত বলে এই কিছুই থাকবে না। আমাদের ওপাশের ব্যবস্থাও তো অসম্পূর্ণ।”

পরদিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন এক্স-৩২। টুনটুনি নোটস নেওয়ার অছিলায় থেকে গেল। গত চব্বিশ ঘণ্টায় উদ্বাস্তু সংখ্যা হয়েছে ১০২। চামড়ার ক্যান্সারেই মৃত্যু হচ্ছে বেশি। জল শেষ। এই চব্বিশ ঘণ্টা মাত্র। প্রেসিডেন্ট সব শুনে বলেন, “৫০ জনকে আমরা প্রবেশাধিকার দেব বিরোধীপক্ষের দাবী মেনে নিয়ে।”

“বাকি ৫২ জনের কী হবে ম্যাডাম?” জানতে চান এক্স-৩২, “৫২টা জলজ্যান্ত প্রাণ চোখের সামনে শেষ হয়ে যাবে!”

“আমাকে যে আমার দেশের মানুষগুলোর কথা ভাবতে হবে এক্স-৩২। আশা করি তুমি উপলদ্ধি করতে পারছ কত বড়ো ঝুঁকি আমি নিচ্ছি। আমার পদমর্যাদা, আমার দেশের সুরক্ষা, সব আমি তুচ্ছ করছি। ৫০ জনের বেশি আমি কোনওমতেই প্রবেশাধিকার দেব না। বাকিদের অন্যত্র পাঠাতে হবে। ব্যবস্থা করো।”

এক্স-৩২ উদ্বাস্তুদের কাছে নিজে গিয়ে জানান প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত। বয়সে যারা সবথেকে ছোটো এবং জীবিত তাদের ৫০ জন নিঃশব্দে ঢুকে আসে কাচের এপারে। এক্স-৩২ বোঝেন, অধিকাংশের পরিবারের অন্যান্যরা রয়ে গেল বাইরে।

যখন তিনি ফিরে এলেন, তখন বাইরে উদ্বাস্তু সংখ্যা ৪২-এ নেমেছে। উদ্বাস্তু বস্তির কিছুটা পিছনে সারি দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তাদের, শেষকৃত্যের অভাবে। প্রখর রোদে এবং তাপে অধিকাংশের শরীরে মাংস বলে কিছু নেই। স্পেস-শিপের ব্যবস্থা করতে আরও একদিন সময় লাগবে। ততক্ষণে ওদের সংখ্যা কোথায় নামবে কে জানে। তাছাড়া ওরা কেউ ফিরে যেতে চায় না। শুধু যদি ওপাশের ডোমটা তৈরি হয়ে যেত! শ্রমিকের বড়ো অভাব দেশে। কাজ তাই শুরুই হয়েছে, শেষ আর হচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট ‘রোবো-৯৯’ থেকে শ্রমিক আনবার কথা বলেছেন, কিন্তু খরচের দিকটা ভেবে অর্থমন্ত্রক এখনও প্রস্তাবটি অনুমোদন করেনি।

রাত্রে বিছানায় শুয়ে নানা কথা ভাবছিলেন এক্স-৩২। ঘুম আসছে না। তাঁর ঘর ঘুমের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তারই চাহিদা মতো। অথচ নিদ্রাদেবী নিপাত্তা।

টুনটুনি বলে ওঠে হঠাৎ, “আইডিয়াটা মন্দ নয়। কাল সকালেই প্রেসিডেন্টকে বলো। অর্থমন্ত্রকও খুশি, প্রেসিডেন্টও, বিরোধীপক্ষও। এক ঢিলে তিন পাখি। আর তোমারও নিজের অনুতাপ থেকে মুক্তি।”

আরও কী কী বক্তৃতা পেশ করতে যাচ্ছিল টুনটুনি। মাথার লাল বোতামটা টিপে ওকে অকেজো করে দিলেন এক্স-৩২।

পরেরদিন বসল জেনারেল বডি মিটিং। এনার্জি, জল, বিদ্যুৎ, খাদ্য, কর, অর্থ সবার সদস্য সেখানে উপস্থিত। উপস্থিত বিরোধীপক্ষ। বহু বাকবিতণ্ডার পর এক্স-৩২ উঠে দাঁড়িয়ে নিজের প্রস্তাব পেশ করলেন। সারা ঘরে ভয়ংকর নীরবতা। পিন পড়লেও বুঝি কানে বাজবে। অর্থমন্ত্রক এবং কর বিভাগ সাধুবাদ জানাল সবার আগে। বিরোধীপক্ষ ‘মানবতার জয়’ বলে টেবিল চাপড়াল। বিদ্যুৎ, জল, খাদ্য ও অন্যান্য বিভাগের বিপুল সমর্থনের চাপে এনার্জি এবং অক্সিজেন বিভাগের মিনমিনে প্রতিবাদ শ্রুতিগোচর হল না।

৩৭ জন উদ্বাস্তু মানুষ রেনবো-৭৬-এর উত্তর-পূর্বদিকে কাচের ডোম বানানোর কাজে নিযুক্ত হল। চুক্তি হল, নির্মাণের পর তাঁরাই হবেন উত্তরপূর্বের প্রথম স্থায়ী বাসিন্দা। যতদিন না নির্মাণ সম্পূর্ণ হচ্ছে, রেনবো-৭৬-এর মূল ডোম থেকে সবরকম সাহায্য পাবেন তাঁরা। টুনটুনি বলল, “বলেছিলাম না, নিজেকে প্রকাশ করলে বহু সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়? এই যেমন ধরো আমি…”

এক্স-৩২ আবার বোতাম টিপে ওকে অকেজো করে দিলেন। 

অলঙ্করণ  শিমুল

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s