এই ‘রূপকথা’ আবাসনের ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে প্রতিবেশীদের অনেকের সঙ্গেই আকাশের আলাপ হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু আকাশদের উপরতলার দেবকুমার সরখেল। ভদ্রলোকের বয়স বোধহয় তিরিশের মধ্যেই হবে। উনি আকাশের আসার মাস খানেক পরে এসেছেন। কিন্তু উনি এসে থেকে অবধি না কোনোদিন কারও ঘরে গেছেন, না কাউকে ওঁর ঘরে আসতে বলেছেন। রাস্তায় দেখা হলেও ভালো করে কথা বলতে চান না। আকাশের কেন জানি মনে হয় যে উনি কিছু একটা লুকোচ্ছেন।
দেবুবাবুর ফ্ল্যাট থেকে রোজ সন্ধ্যা নামলেই শোনা যায় কোনও বুড়ো মানুষের গোঙানি। আকাশ একদিন রাতে উপরে ডক্টর রায়ের ফ্ল্যাটে গেছিল। বেরোতে গিয়ে দেখে এক বৃদ্ধ দেবুবাবুর ঘরে ঢুকলেন। ও ভাবল হয়তো ওঁর বাবা হবেন, কয়েকদিনের জন্যে থাকতে এসেছেন। অসুস্থতার জন্যে তিনিই হয়তো গোঙান। একদিন রাস্তায় দেবুদাকে জিজ্ঞাসাও করেছিল, “আপনার বাবা এসেছেন বুঝি? কাল দেখলাম।”
ভদ্রলোক একটু চমকে উঠলেও কেমন যেন একটা পাশ কাটানো উত্তর দিয়ে হনহন করে চলে গেলেন। ওঁর এই ব্যবহার দেখে আকাশের বেশ খটকা লাগল। দেবুদা কী লুকোচ্ছেন, আর কেনই বা লুকোচ্ছেন? তবে কৌতূহল থাকলেও কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে ও আর মাথা ঘামাতে চাইল না। দেবুদার পাশের ফ্ল্যাটের ডক্টর রায়ও এই ব্যাপারে আকাশের সঙ্গে একমত।
কিন্তু বিকাশবাবু চুপ করে থাকতে চাইলেন না। দেবুবাবুর ফ্ল্যাটটা তো ওঁর উপরেই। একদিন উনি আকাশের ফ্ল্যাটে এসে বললেন, “মশাই, আর তো থাকা যায় না। রোজ সন্ধ্যায় এমন চিৎকার, গোঙানি কে করে বলুন তো? দেবুবাবু তো একলা থাকেন! রীতিমতো রহস্যময় ব্যাপার। আমার তো ভয় হয় যে ওখানে কোনও অসামাজিক কাজকর্ম হচ্ছে না তো? তাহলে কিন্তু প্রতিবেশী হিসেবে পুলিশ আপনি, আমি কাউকেই বাদ দেবে না। চলুন একদিন ওঁর সঙ্গে কথা বলি এই ব্যাপারটা নিয়ে।”
আকাশ একটু দোনোমনা করেও রাজি হল কথা বলতে।
পরদিন ছিল রবিবার। ছুটির দিনে ওরা দু’জনে হাজির হল দেবুবাবুর ফ্ল্যাটে। বেশ কয়েকবার কলিং বেল বাজাবার পর দরজাটা খুলে দেবুবাবু বেরিয়ে এলেন। আকাশ বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বিকাশবাবু ওকে থামিয়ে নিজেই শুরু করলেন। অভিযোগ ক্রমে বদলে গেল তর্কাতর্কিতে। দেবুদা যেখানে জোর দিয়ে বললেন যে ওঁর ঘরে উনি কী করবেন তা সম্পূর্ণ ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার, সেখানে বিকাশবাবু পুলিশে কমপ্লেন করার হুমকি দিয়ে রাখলেন।
ওখান থেকে বেরিয়ে আসার পর আকাশের খারাপ লাগছিল। এরকম ঝগড়া না হলেই ভালো ছিল। আসলে বিকাশবাবু লোকটির মাথা গরম, তাই আকাশই আগে কথা বলতে গিয়েছিল। কিন্তু বিকাশবাবুই দিলেন না। ব্যাপারটা একটা সুস্থ আলোচনার মাধ্যমে মিটমাট হওয়া দরকার ছিল। হাজার হোক, প্রতিবেশী তো! আকাশ ঠিক করল, দেবুদার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলে ক্ষমা চেয়ে নেবে।
সেদিন রাস্তায় দেবুদাকে দেখে আকাশ এগিয়ে গেল। “দেখুন, ওইদিন যা হল তার জন্যে দুঃখিত। আসলে…”
আকাশকে কথা শেষ করতে না দিয়ে দেবুবাবু বলে উঠলেন, “ঠিক আছে। আসলে যে যন্ত্রণা আমাকে সহ্য করতে হয় তার তুলনায় ওই চিৎকার তো এমন কিছুই নয়। ওটা কাউকে বলে বোঝাবার নয়।”
আকাশ হতভম্ব। যন্ত্রণা! কীসের যন্ত্রণা? কে দিচ্ছে দেবুদাকে? আকাশকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি বলে উঠলেন, “সামনের শনিবার আমার ঘরে আসুন। তবে দিনের আলো থাকতে-থাকতেই আসবেন। সব জবাব পেয়ে যাবেন।”
শনিবার সকাল থেকেই আর অন্য কিছুতে আকাশের মন বসছিল না। বিকেলে হাজির হল দেবুবাবুর ঘরে। ভদ্রলোক দরজা খুলে বসতে বললেন। চা আর তেলেভাজা দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। যে মানুষটা কোনোদিন কাউকে ঘরে ঢোকাল না তার এই আপ্যায়ন আকাশকে অবাক করল।
“আমার বয়স কত হবে আন্দাজে বলতে পারেন?”
আচমকা দেবুদার এহেন প্রশ্ন শুনে আকাশ ঘাবড়ে যায়। তবুও বলে, “কত আর হবে? বড়োজোর তিরিশ।”
ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, “যদি বলি ষাট পেরিয়ে সত্তরের দিকে চলেছি?”
হতভম্ব আকাশের উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি বললেন, “আপনাকে আর ধাঁধায় রাখব না। আসল ঘটনাটা শুনলে সব বুঝতে পারবেন। বিশ্বাস-অবিশ্বাস পুরোটাই আপনার উপর ছেড়ে দিলাম। তবে নিজের চোখকে আশা করি অবিশ্বাস করবেন না।”
আকাশের কৌতূহল আর না বাড়িয়ে দেবকুমারবাবু বলতে শুরু করলেন, “দেখতেই পাচ্ছেন আমি একা মানুষ, বিয়ে থা করিনি। আসলে কোনও বন্ধনের মধ্যে আমি আটকে থাকতে পারি না। একটা ভালো চাকরি করতাম, দিব্যি দিন কাটছিল। কিন্তু মাথায় যে কী ভূত চাপল!” এই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেবুবাবু আবার শুরু করলেন, “হঠাৎ একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে পড়ল কালো চুলের মাঝে ইতিউতি সাদা চুলের গোছা। মুখের বলিরেখাগুলোও যেন অনেক স্পষ্ট। খেয়াল করলাম, বাইরের ডাকগুলো দাদা থেকে ক্রমে কাকু এমনকি জেঠুতে পরিণত হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বিভিন্ন জায়গায় অনেক ধরনের চিকিৎসা করিয়েও কিছুই হল না। মনমরা হয়ে থাকতাম সারাক্ষণ। ভাবলাম কোথাও বেরিয়ে আসি, মনটা হালকা হবে। সেইমতো চলে গেলাম হরিদ্বার, হৃষীকেশ, কনখল। চারপাশের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনটা ভালো করে দিল। একদিনে এরকম ঘুরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় দেখি এক সাধু আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। ভীষণ অবাক হয়ে কাছে যেতে বললেন, ‘তোর তো খুব যুবক হবার সাধ, তাই না?’
“আমি হতচকিত। আমার মনের ভাব এই সাধু জানলেন কোথা থেকে? আমি কোনোক্রমে ঘাড় নাড়তে একটা কালো রঙের গোল ফল বার করে আমার হাতে দিলেন। ফলটা দেখতে অনেকটা রুদ্রাক্ষের মতো। হাতে দিয়ে বললেন, ‘ফলটা ফাটিয়ে রোজ একটা করে বিচি খালি পেটে খাবি। তাহলেই তোর মনোবাসনা পূর্ণ হবে। তবে যতক্ষণ সূর্যের আলো থাকবে এটা ততক্ষণ কার্যকর হবে। দিনের আলো নিভলেই তুই আগের অবস্থায় ফিরে যাবি।’
“আমি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে দুলতে দুলতে ফলটা নিয়ে বললাম, ‘কিন্তু শুধু দিনেরবেলা যুবক হয়ে কী হবে? আমি তো লোকের মাঝে যেতেই পারব না। আমার চিরস্থায়ী যৌবন চাই।’
“প্রথমে শৈশব, তারপর যৌবন আর শেষে বার্ধক্য—এই হল বিধির বিধান। একে কেউ অস্বীকার করতে পারে না।’ সাধু রেগে গেলেন। উপরে আঙুল তুলে বললেন, ‘এই নিয়ম শুধু তিনিই ভাঙতে পারেন।’ এই বলে উনি চলে যাবার উপক্রম করতেই আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে সাধুর পা জড়িয়ে ধরলাম। উনি যতই পা ছাড়িয়ে চলে যেতে চান, আমি ততই আঁকড়ে ধরি। শেষে আমাকে নাছোড়বান্দা দেখে উনি বললেন, ‘তুই যখন ছাড়বি না তখন শোন। উপায় একটা আছে, তবে তার জন্যে তোকে একটা বিশেষ সাধনা করতে হবে। এই সাধনার ফলে তুই একটা বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হবি। যার ফলে কোনও তরতাজা যুবকের জীবন্ত দেহের উপর বসে এই বিশেষ পদ্ধতিতে সাধনা করে তার প্রাণবায়ু নিষ্কাশন করা যায়। তাহলেই সেই যৌবন তুই লাভ করতে পারবি। তবে ওই জে বললাম, এটা চিরস্থায়ী নয়! এর মেয়াদ হবে দশ বছর। আর মেয়াদ শেষের দিন কিন্তু তোরও জীবনের শেষদিন হবে।’
“আমি তিনমাস ওই সাধুর আশ্রমে থেকে ওই বিশেষ বিদ্যাটি শিখেছি। ফিরে এসে ফলটা ভেঙে রোজ সকালে একটা করে বিচি খেতাম। বেশ কিছুদিন পর থেকে লক্ষ করলাম, পাকা চুলগুলো আবার কালো হচ্ছে। বলিরেখাগুলোও মিলিয়ে যাচ্ছে। গায়ের চামড়ার সেই টানটান ভাবটাও ফিরে এসেছে। যারা আগে দেখেছিল সেইসব লোকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করল এই যৌবন ফিরে পাবার রহস্য কী। আমি হেসে বলতাম পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া আর যোগব্যায়ামের কথা। কেউ বিশ্বাস করত, কেউ করত না। আমি বুঝতে পারলাম যে এই রূপান্তরের কারণে আমি অফিসে, পাড়ায় লোকের আলোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছি। রোজকার এই বিড়ম্বনার হাত থেকে বাঁচতে আমি অফিস ছাড়লাম আর আমার বাসস্থানও পালটালাম। এখন একটা ছোটোখাটো চাকরি করি যাতে দিনের আলো থাকতে থাকতে বাড়ি ফিরতে পারি। কারণ, ওই সাধুর কথামতো সূর্য ডুবলেই আমি আবার বৃদ্ধাবস্থায় ফিরে যাই। তখন প্রচণ্ড কষ্ট হয়, তাই আপনারা ওই চিৎকার শোনেন। রোজকার এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। তবে আপনাকে দেখে মনে হয় এবার আমার এই যন্ত্রণার অবসান হতে চলেছে।” নিজের কাহিনি শেষ করে দেবুদা একটু মুচকি হাসলেন।
আকাশ এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেবুদার কথা শুনছিল। এবার হেসে বলল, “আপনার গল্প শুনলাম। চায়ের সঙ্গে দিব্যি জমেছে। তবে এই আষাঢ়ে গল্প বলতেই কি আপনি আমায় ডেকেছিলেন? আর আপনার ওই শেষের কথাটা তো বুঝলাম না।”
দেবুবাবু হেসে বললেন, “ওই সাধু আমাকে বলেছিলেন যে যুবকের থেকে প্রাণবায়ু নিষ্কাশন করতে হবে তার কতগুলো শারীরিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা, যেগুলো পুরোপুরি আপনার সঙ্গে মিলে যায়। এবার তো বুঝলেন আপনাকে ডাকার কারণ।”
আকাশ রীতিমতো বিরক্ত হয়ে বলল, “দেখুন দেবুবাবু, আপনার এই আষাঢ়ে গল্প তবুও সহ্য করলাম। কিন্তু তা বলে এইসব বদ রসিকতা কিন্তু আমি…”
আকাশের কথা শেষ হবার আগেই দেবুবাবু বুকে হাতচাপা দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগলেন। আকাশ হতভম্ব হয়ে গেল। কী হল ভদ্রলোকের? স্ট্রোক নাকি? “আমি ডাক্তার ডাকছি,” বলে আকাশ বেরিয়ে যাবার উপক্রম করতেই দেবুবাবু ওকে ইশারা করে দাঁড়াতে বললেন। আকাশ বিস্ফারিত চোখে দেখল দেবুদার শরীরের চামড়া কুঁচকে যাচ্ছে, মাথায় চুল প্রায় পুরোটাই সাদা হয়ে গেছে। কোনও যুবক নয়, এক বৃদ্ধ ওর সামনে পড়ে কাতরাচ্ছে। পুরো ঘটনায় আকাশ এতটাই হতচকিত হয়ে পড়েছিল যে ও বুঝতে পারছিল না এটা কি সত্যি, না কোনও স্বপ্ন দেখছে।
পুরোপুরি বৃদ্ধ মানুষে রূপান্তরিত হবার পর দেবুবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “কী আকাশবাবু, বিশ্বাস হল? নাকি এখনও এটাকে একটা আষাঢ়ে গল্প বলে মনে হচ্ছে?”
আকাশ যেন কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। ও কোনোক্রমে মাথা নাড়ল।
“এবার আরেকটি কথা শুনুন। আপনার ওই চায়ে ঘুমের ওষুধ মেশানো আছে। তার কাজ শুরু হল বলে।” দেবুদা মুচকি হাসলেন।
আকাশ পালাতে চাইল। কিন্তু ও লক্ষ করল ওর পা দুটো শুধু নয়, মাথাও প্রচণ্ড ভারী হয়ে গেছে। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসছে। বেরোনোর দরজার সামনে গিয়েই ও মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
পরদিন ফ্ল্যাটে হুলস্থুল কাণ্ড। আকাশ সেন বলে যে ছেলেটি দোতলায় থাকত তাকে নিজের ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ডাক্তার দেখে বলেছে দেহে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। মনে হয় কোনও কিছু দেখে প্রচণ্ড ভয় পাওয়াতে হার্টফেল করেছে। সুস্থ সবল ছেলেটার রাতারাতি কী হল কেউ ভেবেই পেল না। পুলিশ এসে ফ্ল্যাটের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনও ক্লু বের করতে পারেনি। আরেকটা আশ্চর্যের ব্যাপার, এই ঘটনার পর থেকে দেবুদার ঘর থেকে সন্ধ্যায় আর কোনও আওয়াজ পাওয়া যায় না। ওঁর স্বভাবেও আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। আগের মতো লুকিয়ে না থেকে উনি এখন সকাল-সন্ধ্যা পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিশছেন।
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে