গল্প বংশীধরের বিপদ কল্যান সেনগুপ্ত শীত ২০১৯

এক

বংশীধর থানাতে যতই ডাকসাইটে সিংহ মার্কা দারোগা হোক, বাড়িতে কিন্তু মিউ মিউ মিনি বেড়াল। ঠাকুর ঘরে চটি পরে ঢুকলে, কোনওদিন ছোটো মাছ না খেতে চাইলে, করলা সেদ্ধ থালার তলায় রেখে দিলে বা ঠাকুর নমস্কার করে না বাড়ি থেকে বেরোলে ক’দিন আগেও দু-চারটে কানমলা, চাঁটি, হাতপাখার ধপাধপ পড়তই। কুচুটে লোকে বলে, কিছুদিন আগেও বংশীধরকে বারান্দায় এক পায়ে বা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে—সেটা যোগ ব্যায়াম না শাস্তি কেউ জানে না। দুর্জনে বলে সন্ধেবেলা আবছায়াতে দেখেছে, কেউ নাকি নিল-ডাউন হয়ে বারান্দায়। ঠিক এই কারণেই থানার কাছে কখনও বাড়ি নেননি। থানার লোকজন, চোর-বদমাশ দেখলে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা মুশকিল হত। দু-চার বার পছন্দ না হলে হাত কচলে, মাথা চুলকে কিছু বলার চেষ্টা করে দেখেছেন, কোনও ট্যাঁ ফুঁ চলবে না বাড়িতে, মায়ের কথাই শেষ কথা। মার সর্ব সময় একই কথা, ‘আমি না থাকলে ঠ্যালা বুঝবি। সংসার খুব কঠিন জায়গা খোকা, প্রতি পদে বিপদ। শক্ত হাতে ধরে রাখতে হয়।’ তবে আসতে যেতে বংশীধরের মায়ের সুরেলা, মিঠে গানের গলা শোনা যেত রাস্তা থেকে। খাসা গলা, লোকের ভর সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার সময় গানের সুরে মোহিত হয়ে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া আস্তে হয়ে যেত অনেকের।

মা-ছেলের সংসার দিব্যি চলছিল, হঠাৎ গোল পাকালো যখন হঠাৎ দু’দিনের জ্বরে মা চলে গেলেন বংশীধরকে পথে বসিয়ে। ক’দিন হা-হুতাশ করে কাটানোর পরে একবার ভাবলেন দারোগাগিরি ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয়ে চলে যাবেন। কিন্তু বন্ধুরা বাধা দিল। আজকাল নাকি আর সেই দিন নেই যে পছন্দমতো গুহা দেখে বসে পড়া যাবে। ভীষণ ভিড়, কোনও গুহা খালিই পাওয়া যায় না, তার ওপর ফলমূলও তেমন মেলে না। ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফল পেড়ে খেতে হয়। তার চেয়ে থানাই ভালো। একজন ভালো কাজের লোক দেখে নিলেই হবে।

থানাতে ডিউটি জয়েন করেছেন, কিন্তু মন মাঝে-মাঝেই পথহারা হচ্ছে। কী যে হয়ে গেল বুঝে উঠতে পারছেন না। কী যে হচ্ছে উনি নিজে বুঝতেই পারছেন না। মা চলে যাওয়ার পর মায়ের স্মৃতি হঠাৎ হঠাৎ করে কাজে অকাজে চলে এসে ওঁর প্রেস্টিজ একেবারে হালুয়া করে দিচ্ছে। ঝুনঝুনি গ্রামে বংশীধরের প্রবল প্রতাপে বাঘে মানুষে কাঁপতে কাঁপতে হাপুসহুপুস করে একঘাটে জল খেত সকালবিকেল। সেখানে মাঝে-মাঝেই তাল কেটে যাচ্ছে। আগে ভাবটা ছিল এমন যে মাকে ছোড়কে কোই নেই ডরনে কে লিয়ে। আর এখন মায়ের স্মৃতিই ভয়ের কারণ হয়ে তাড়া করে ফিরছে। মা চলে গিয়ে ঘরে টেকাটাই মুশকিল। মায়ের অস্তিত্ব সমস্ত ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তার সঙ্গে প্রিয় হারমোনিয়াম। সবসময় কানে বাজে মায়ের গাওয়া গানের সুর। আহা! আহা! মন যেন জুড়িয়ে যেত। আর এইটাই কাল হয়েছে। মা যে কীভাবে ল্যাজেগোবরে করে দিচ্ছেন সে তো হাতেনাতে প্রায়ই দেখতে পাচ্ছেন। এই সেদিন সন্ধের বাজারে যাত্রার মাঝে হাতেনাতে ধরেছেন এক পকেটমারকে, হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে থানায় নিয়ে যাচ্ছেন বুক ফুলিয়ে। সবে বাজারের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন, আর তখনি বিনোদিনী দাসী গান ধরেছে স্টেজে-

“আমি ভবে একা, দাও হে দেখা,
প্রাণ ও সখা রাখো পায়ে,
হরি মন মজায়ে লুকালে কথা।”

আসলে এই গানটার জন্যেই দাঁড়িয়েছিলেন যেতে যেতে। কী গান, আর কী সে সুর! শুনতে শুনতে বংশীধরের প্রাণ হু হু করে উঠল। তাই তো! উনি তো একাই এখন সংসারে। এসব কী করছেন? হায় হায়, শুধু শুধু সময় চলে যাচ্ছে। এইসব বাজে কাজ ফেলে সবে প্রভুর পায়ে কীভাবে নিজেকে সমর্পণ করবেন ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছেন, অমনি হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল পকেটমার। ব্যাটা বোধহয় ভেবেছিল, দেখি একটা চান্স নিয়ে। এমন সময় পাশের কনস্টেবলটা একটু পিছিয়ে এসে ধরে ফেলে বলে, “স্যার চলুন, দাঁড়াবেন না। এখানে দাঁড়ালে এদের দলবলও চলে আসতে পারে।”

ছলছল চোখে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে লাঠি মাটিতে ঠুকে গটমট করে থানার পথ ধরেন। কিছুটা লজ্জা পেয়ে পকেটমারের ওপর রাগটা চড়ে যায়। “চল, তোর আঙুলগুলো সোজা করি। পকেট মারা তো ছার, বাকি জীবনটা তোকে খাইয়ে দিতে যদি না হয় আমার নামে কুকুর পুষিস।”

আর নিত্যহরির ব্যাপারটা একটা বিশ্রী লজ্জাজনক কেস। থানাতে বসে ক্যামেরা রেকর্ডিংয়ে নিত্যহরিকে পরিষ্কার দেখা গেছে শাবল দিয়ে দোকানের তালা ভাঙছে। শাটার তুলে বাজারের দোকানে ঢুকছে এক সাগরেদ নিয়ে। নিত্যহরির নিত্য চুরির ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত করতে বাড়িতে সাতসকালে হানা দিয়েছেন। পুলিশ দেখে বাড়ির লোকজন সন্ত্রস্ত। নিত্যহরির মা-বাবা-ভাইয়ের অনেক কাকুতি মিনতি কিছুই টিকল না। আজ ব্যাটাকে গরাদের ওপারে না পাঠালেই নয়। উঠোনে দাঁড়িয়ে বাজখাঁই গলায় হাঁক পাড়েন বংশীধর, “বেরো নিত্য, আমার মাথাগরম হবার আগে বেরিয়ে আয়। ব্যাটা ছুঁচো, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। তুই না বেরোলে আমি কিন্তু দরজা ভাঙব।”

কে যেন ফুট কাটে, “ভিতরের ঘরে গান শুনছে দাদা।”

পাড়া কাঁপানো হুঙ্কার ছাড়েন বংশীধর, “এই সাতসকালে গান শুনছে? চালাকি হচ্ছে? গান বার করছি। শালা চোর ছিলি, এখন ডাকাতিতে নাম লেখানো হয়েছে?” ব্যঙ্গ করে বলেন, “গান তো এবার আমি গাইব। তোরা সবাই শুনবি। শুনবি আর কাঁদবি।” ভাইকেই দাবড়ান, “ডাক, ডাক আমার মটকা গরম করিস না।” শেষমেশ নিত্যহরির উদ্দেশ্যে বলেন, “আয় আয়, চলে আয়। আমাকে আর দরজা ভাঙতে বলিস না।”

শেষমেশ বংশীধর উঠে পড়েন দাওয়ায়।

হালকা গুনগুন সুর একটা ভেসে আসছিল। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই গানের সুর ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। নিত্যহরি খাটে বসে। চোখ বুজে গান শুনছে ও গাইছে গলা ছেড়ে—

‘মন চল নিজ নিকেতনে

সংসার ও বিদেশে, বিদেশির বেশে ভ্রম কেন অকারণে…’

খানিক দাঁড়িয়ে প্রথম মনে হল, এটা কে? এটাই কি আমাদের নিত্যহরি? হায় হায়, কাকে উনি ধরতে এসেছেন? দাঁড়িয়েই পড়লেন। আহা, গানটির সুর ভারি সুন্দর! গলাটিও বেশ মিঠে। কোথায় যেন শুনেছেন? কোথায় যেন শুনেছেন? মনে পড়েছে, এ তো সেই গান। তাই কেমন অবশ ভাব লাগছে। মা কি গাইত গানটা? চোখ বুজলে মনে হত স্বামীজি নিজেই গাইছেন। প্রথম বুক ভার, পরে গলা ভার। এই খাকি প্যান্ট, জামা, টুপি বেশ তো বিদেশিরই বটে। এসব কী করছেন এখানে? কবে এসব থেকে মুক্তি হবে? পাঁজর মুচড়ে গলা ধরে চোখে খানিক জলও এসে গেল। শেষপর্যন্ত টেবিল ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন গানের শেষ অবধি।

বেশিক্ষণ দাঁড়ালে একদম ল্যাজেগোবরে মাখামাখি অবস্থা হত। দরজা থেকেই চলে এসেছিলেন বংশীধর। ভাগ্যিস থানার কেউ দেখেনি। তাহলেই চিত্তির হত। নিত্যহরিও জানতে পারেনি। কিন্তু কী করে যেন বংশীধরের দুর্বলতা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে চোর-ছ্যাঁচড় মহলে। ঠিক করে ফেলেন, আর কোনও ধর্মীয় সভা, যাত্রার কোনও অনুমতি দেবেন না। এমনকি পালা কীর্তন অবধি বন্ধ। কিন্তু তাতেও গ্রামের ভক্তি-ভাব এড়ানো গেল না।

কেলেঙ্কারিটা শেষে থানাতেই ঘটল একদম সবার সামনে। গঙ্গাধর ডাকাতকে ধরে থানার গরাদে পুরেছেন। বাকি স্যাঙাতদের খবর বার করার জন্যে সবে দরজা খুলে সেলের সামনে দাঁড়িয়েছেন একটু পেড়ে ফেলে গামছা-কাচা করতে। বংশীধর গঙ্গাধরের সেলে ঢোকার পর থানার কনস্টেবলরা তটস্থ হয়ে ওঠে—আজ গঙ্গাধরের গঙ্গাপ্রাপ্তি আর কে আটকায়? কোণঠাসা হয়ে ইষ্টনাম জপতে থাকে গঙ্গাধর চোখ বুজে, আর ঠিক তখনই থানার এক সিপাইয়ের টেবিলের সামনে রাখা রেডিওতে ৯২.৭ এফ.এম-এ বেজে উঠল—

দোষ কারও নয় গো মা

আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা…

আবার সেই মায়ের গাওয়া গান। এ যেন প্ল্যান করে ডোবানো। কেমন অবশ হয়ে এল শরীর। মার বড়ো প্রিয় ছিল গানটা। মায়ের স্মৃতি আবার বিপদ ডেকে আনে। দাঁড়িয়ে পড়েন বংশীধর, গানের সুরে অবশ হয়ে আসেন। বংশীধরকে দেখে গঙ্গাধরও থতমত। দারোগা হবে হাবেভাবে সিংহ। চলাফেরায় হবে রাজার ভাব। এক হুঙ্কারে প্যান্ট হলুদ করে দেবে, আর এ কি উদাস ভাব? এ তো সন্ন্যাস ভাব। একটু পরে দারোগার ভক্তিরস পাগলপারা ভাব দেখে শেষে সাহস করে চোখে চোখ রেখে বলেই ফেলে গঙ্গাধর, “স্যার, আপনার কি শরীর ঠিক আছে? মারবেন না? খারাপ লাগছে?”

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রুল নামিয়ে নিজের চেয়ারে ফিরে যান। গঙ্গাধরের সে-যাত্রা আর গঙ্গাযাত্রা হয় না। বংশীধর সেদিনই ঠিক করে ফেলেন, এখানে আর নয়। এখানে মায়ের স্মৃতি সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে, তাই পদে পদে সেই স্মৃতি বারে বারে বিপদ ডেকে আনছে। পরদিনই ট্রান্সফারের আপিল করবেন।

দুই

হৃদয়পুর গ্রামটা এমনিতে বেশ শান্ত। কেউ কক্ষনও বলতে পারবে না এখানে দু-চারটে ছিঁচকে চোর ছাড়া বড়ো কোনও ডাকাতি হয়েছে ইদানীংকালে। বংশীধর আগেই খবর নিয়েছেন। ওটা কোনও ব্যাপার নয়। গ্রাম থাকলে দু-চারটে চোর থাকবেই। আর চোর ধরার ব্যাপারে ওঁর ব্যাপক হাতযশ। হৃদয়পুর নাম শোনা থেকে উনি আসবার জন্যে মুখিয়ে আছেন। নামটাও বেশ হৃদয়ের কাছাকাছি। একটু শান্তিতে কাটবে এখানে। কাল বাদ দিয়ে পরশু জয়েন করবেন। নিজের বাক্স-বিছানা, খাট, আলমারি নিয়ে আসবার সময় হৃদয়পুর থানার হেড কনস্টেবল দ্বারিকবাবু বার বার আয়না দিয়ে বংশীধরকে দেখছেন দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী দেখছেন বলুন তো? আমাকে চেনেন নাকি?”

দ্বারিকবাবু  বলেন, “স্যার, আপনার সাথে এ গ্রামের কার যেন খুব মিল আছে। কিন্তু বুঝতে পারছি না।”

গাছগাছালির ছায়ায় ঢাকা পথ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। চাঁদি ফাটা গরমেও বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাসে হৃদয় জুড়িয়ে উদাস হয়ে হয়ে গেল। বুঝদার গাম্ভীর্য এনে বলেন, “হয় হয়। বুঝলে, অনেকে বলে সবারই নাকি ডুপ্লিকেট হয় সংসারে। কোনও কোনও সময় শোনা যায় একই রকম তিন-চারজন মানুষ নানা দেশে ছড়িয়ে থাকে।”

দ্বারিকবাবু চুপ করে যান।

প্রথমদিন হৃদয়পুরকে ভালোভাবে দেখেশুনে নিতে হবে, তাই বংশীধর ঠিক করেন আজ সম্রাট আকবরের মতো পরিচয় বিনা গ্রাম ঘুরে দেখবেন। তবেই তো মানুষজনকে জানা যাবে, তাদের প্রয়োজন বোঝা যাবে। নিজের বুদ্ধিকে নিজেই তারিফ করে বিকেল বিকেলে রাস্তায় নেমে পড়লেন।

সরু সরু মেঠো রাস্তা, প্রচুর খাল-বিল-গাছগাছা্লিতে ভর্তি। আশেপাশে দেখা যাচ্ছে প্রচুর ধানক্ষেত। প্রথমদিন রাস্তায় নেমে বিশেষ লোকজনও রাস্তায় দেখতে পান না। কিন্তু গ্রামটাকে বেশ ভালোই লেগে গেল। বেশ চেনা চেনা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন বংশীধর। এবার আর দিনভর চোর-ডাকাত পিটিয়ে কাটাতে হবে না। তবে এবার ঠিক করে নিয়েছেন, প্রথম থেকে শক্ত হতে হবে। ধর্মীয় কোনও যাত্রাপালা নয়, গান-আসরও বেছে বেছে। কতকিছু গান আছে, বাউল আছে, রবীন্দ্রসঙ্গীত আছে, কালোয়াতিও চলবে, প্রাণ খুলে এগুলো গা, কিন্তু স্বদেশী গান, শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন এসব চলবে না। যে করে হোক রুখবেন। আর তাহলেই কেল্লাফতে। হৃদয়পুরের হৃদয় তিনি জয় করবেনই। হঠাৎ করে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল এই ভেবে যে হৃদয়পুর জানেই না ওঁর নিজের হৃদয়পুরের দুর্বলতাটা।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার মুখে। ‘ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, সামনে উতল ধরণী তল’ আবৃত্তি করতে করতে রাস্তায় চলেছেন। কিছুদূর আসতে আসতে রাস্তায় এক লাঠি হাতে কুঁজো বুড়ির সাথে দেখা। টুকটুক করে রাস্তা পার হচ্ছিল, কাছে এসে চোখমুখ কুঁচকে বংশীধরকে আগাপাশতলা দেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “কতকিছু দেখাবি তুই? এত জামাকাপড় কোথা থেকে হাতালি?”

“দিদিমা, আপনি আমাকে চেনেন?” খানিক অবাক হন বংশীধর।

“ও বাবা, তোকে চিনব না তা কি হয়? তোকে তো চিনে রাখতেই হবে। তবে এমন বেশে তো আগে দেখিনি তোকে।” বুড়ি আর দাঁড়ায় না। বলতে বলতে যায়, “যাই দেখি, বাইরের দাওয়ায় কী কী পড়ে আছে।”

বংশীধর দাঁড়িয়ে পড়েন। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। এই সন্ধের মুখে রাস্তায় আলো কম, অন্য কারুর সাথে গুলিয়ে ফেলেছে বুড়ি এই ভেবে সামনে পা বাড়ান। পুকুর আর রাস্তার মাঝে কিছু না জানিয়েই গাছ থেকে চড়াইয়ের মল জামায় এসে পড়ে। জামার হাতাটা এক নিমেষে হলুদ হয়ে যায়। জামাটা খুলে ঘাটে রেখে হাত ধুয়ে আঁজলা করে জল এনে হতভম্ব হয়ে যান। গেল কই জামাটা? এদিক-ওদিকে কাউকেই দেখা যায় না। একটু এগিয়ে দেখেন, দূরে একটা মানুষ জামা হাতে রাস্তায় বাঁক নিয়ে মিলিয়ে যাছে। “অ্যাই! অ্যাই!” করতে করতে পড়ি কি মরি করে দৌড় লাগান। চিৎকার করেন, “দে দে ব্যাটা, জামা দে। সাহস বলিহারি!”

কিছুটা এগিয়ে আর খুঁজে পান না। আচমকা আঁতিপাতি করে দৌড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে হাতে পায়ে মাটি লাগে। চুল উসকোখুসকো হয়ে যায়, গেঞ্জি পরা শরীর ঘেমে-নেয়ে একশা হয়। মনে মনে ‘পাজি, ছুঁচো, উজবুক’ নানা গালি দিতে থাকেন।

ক্লান্ত বংশীধর রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ান। ওঁকে দেখে দোকান-মালিক রাধু বিরক্ত হয়। “দেখছিস ভর সন্ধেতে ধূপধুনো দিচ্ছি, আর এখুনি এসে দাঁড়ালি অপগণ্ড? কোনও কি কাণ্ডজ্ঞান হবে না আর? যা যা, পরে আসিস।”

বংশীধর আবারও অবাক হন। এও চেনে? কিন্তু কী করে? এই গ্রামে তো তিনি কখনও আসেনইনি। যদিও গ্রামটা চেনা চেনা লাগে। ব্যাপারটা বুঝতে হচ্ছে। বেশ রহস্যর গন্ধ পান।

“চা হবে দাদা?”

রাধু মুখ বেঁকায়, “বাবা! কী হোল রে তোর? দাদা বলছিস? পয়সা দিবি?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, দেব।” বংশীধর নরম স্বরে উত্তর দেন।

“তোকে কিছু বিশ্বাস নেই। ঘাড় ঘোরালেই পয়সা না দিয়ে পালাতে পারিস।” কেটলিতে জল বসিয়ে ধুনো দিতে দিতে রাধু বলে, “খুব দাঁও মেরেছিস মনে হচ্ছে! তা কার কপাল পুড়ল রে?”

লজ্জার ভাব দেখিয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে বলেন, “না না, তেমন কিছু না। খতিয়ে দেখতে হবে কাল থানাতে জয়েন করে।”

চা করতে করতে রাধু বলে, “কী রে, ছেড়ে দিলি নাকি তোর লাইন? এই ভর সন্ধেতে দোকানে বসে চা খাছিস? এইভাবে আর কতদিন চলবে রে? নিজের ঘরের থেকে শ্রীঘরেই তো তোর দিন কাটে বেশি। ছেড়ে দে, ছেড়ে দে। বয়েসও তো হচ্ছে।”

বসার টেবিলে চায়ের ভারটা রেখে উঠে রাস্তায় নামেন বংশীধর। রাধু ঝাঁটা হাতে উঠান ঝাঁট দিতে দিতে বলে, “বেশ গম্ভীর ভাব এনেছিস দেখছি। দিনের বেলা তো বেশ আছিস, কিন্তু রাত্রি হলে তোর যে কী হয় কে জানে।”

একটু এগোতেই, “আরে! আরে! লেগে যাবে তো। চোখের মাথা খেয়েচ নাকি? একটু দেখে চলো।” গলির মোড় ঘুরতেই লোকটার সাথে ভুঁড়িতে ভুঁড়িতে ধাক্কা লাগে।

লোকটাও ট্যারা-বাঁকা। খেঁকিয়ে ওঠে, “আপনিও তো কিছু কম নন।”

এবার মুখের দিকে তাকিয়ে বংশীধর তাজ্জব। মনে হয় কেউ একটা আয়না সামনে রেখে গেছে। শুধু প্রতিবিম্বর গায়ে ওঁরই জামা। আর নিজের গায়ে গেঞ্জি।

“অ্যাই, কে তুই?” নিজের থতমত ভাবটা লুকোতে হাঁক পাড়েন বংশীধর।

লোকটারও ভ্যাবলা কার্তিক অবস্থা। এত মিল? একইরকম দেখতে সামনে দাঁড়িয়ে আরেকজন বলে, “আজ্ঞে আমি পাঁচু।”

বংশীধর আগাপাশতলা মেলাতে গিয়ে অবাক। ভুঁড়িটাও প্রায় একইরকম। গালের আঁচিলটাও। শুধু মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। চোখটা কোটরে ঢুকে গেছে। হাতে জামা, নিচে আধময়লা ধুতি। ধরা পড়ার ভয়ে সিঁটিয়ে আছে।

চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “ওটা কী?”
পাঁচু বলে, “কী আর? শার্ট।”
“নিচে ওটা?”
হাস্যরস আছে বলতে হবে। মাথা চুলকে হেসে বলে, “ওটা শুনেছি বাবারও ছিল।”
হেসে বংশীধর বলেন, “ভুঁড়িওয়ালা চোর আমি আগে দেখিনি।”
“হ্যা! হ্যা! কী যে বলেন।” আস্তে করে বংশীধরের নোয়াপাতির দিকে আঙুল দেখায়।
এবার কঠিন স্বরে বলেন, “জামা দে।”
“এটা আমার জামা।”
“জামাটা তোর?”

গর্জে ওঠেন বংশীধর, “ব্যাটা চোর! আমার জামা চুরি করে এখন বলছিস তোর?” প্রায় মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছিল, ‘আমি কে জানিস?’ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলেন, “দিবি কি না বল।”

পাঁচু এদিক ওদিক চেয়ে পালাবার পথ খোঁজে। এই ফাঁকে পাঁচুকে ধরে ফেলে এক জুজুৎসু প্যাঁচে চিৎপাত করে মাটিতে ফেলেন। তারপর সেই নিজের আবিষ্কৃত নরম ধোলাইটা প্রয়োগ করেন। কাতুকুতুতে যখন মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে পাঁচু তখন অনায়াসে জামাটা খুলে নেন। মাটিতে পড়ে হাসতে হাসতে পাঁচু চিৎকার করে, “এটা ভালো হল না, ভালো হচ্ছে না কিন্তু।”

কিন্তু জামা ততক্ষণে বংশীধররের হাতে।

“ব্যাটা চোর। তুই আমার জামা চুরি করেছিস? যা যা, আজ প্রথমদিন বলে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু যদি শুনেছি তুই আর কোথায় দাঁও মেরেছিস তাহলে এতকিছু নয়, তোকে ধরে বেঁধে বিছুটি পাতা ঘষে দেব সারা শরীরে। সারাজীবন জেলের ঘানি টেনে টেনে তোর আঙুল বেঁকে যাবে, হাত খুলে আসবে।”

ধুলো ঝেড়ে পাঁচু উঠে পড়ে। কঠিন দৃষ্টিতে বংশীধরকে তাকিয়ে বলে, “দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা। বাটপাড়ি করে বাঁচবি তুই? দ্যাখ তাহলে।” বলে সুরুত করে মাথা নিচু করে সরে যায়। তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োতে থাকে ‘চোর চোর, ধর ধর’ বলতে বলতে।

বংশীধর থতমত খেয়ে যান। হল কী ব্যাপারটা? ব্যাপারটা বুঝতে বুঝতে আশেপাশের বাড়ি থেকে হুড়মুড় করে কাকা, পিসে, খুড়ো এক এক করে চড়াও হয়। কিছু বলতে দেবার আগেই অনেকগুলো হাতের চড় থাপ্পড় পিঠে, মাথায়, হাতে পড়তে থাকে। কেউ কেউ আবার বলতে থাকে, ‘অনেক জ্বালিয়েছে। আজ মেরেই ফ্যাল পাঁচুকে।’

বংশীধর কোনওরকমে উবু হয়ে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে যুঝতে থাকেন। হাটুরে মারের কোনও আগল নেই। যা যার হাতের সুখ করতে থাকে। কেউ বলে ওঠে, ‘এই তো আমার হারিয়ে যাওয়া জামা! ক’দিন তাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’ এই বলে ভিড়ের মধ্যে জামাটা কেউ সুরুত করে টেনে নেয়।

প্রথম চোট কেটে যাবার পর কিছু জ্ঞানবৃদ্ধ মানুষের সহায়তায় উঠে দাঁড়ান বংশীধর। ওঁকে দেখে এগিয়ে আসে থানার দ্বারিকবাবু। “স্যার, এ কী হাল হয়েছে আপনার!”

ব্যথায় কিছুই বলতে পারেন না। দ্বারিকবাবু এদিক সেদিক চেয়ে ‘থানাতে নিয়ে যাচ্ছি’ বলে সরিয়ে নিয়ে আসেন। বংশীধর বেঁচে যান সে যাত্রা।

দ্বারিকবাবু কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “এখানে কী করে স্যার আপনি? আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। কী হয়েছিল একটু বলবেন?” বংশীধর চুপ দেখে বলেন, “চলুন চলুন, আগে হাসপাতালে যাই।”

“দরকার হবে না। চলুন, থানার দিকে যাই।”

মুখটা মারের চোটে কেমন ফুলে লাল কালো চকরা-বকরা হয়ে গেছে। হাত-পা ভালো করে নাড়তে পারছেন না। আঙুলগুলো ব্যথায় নীল হয়ে গেছে। অবসাদ আর অপমান মিলেমিশে তালগোল পাকিয়ে গেছে। দ্বারিকবাবু পিছন পিছন বারবার বলতে বলতে আসছেন, “এটা কী হল বলুন তো? স্যার, আপনি কেন নিজের পরিচয় দিলেন না? তাহলেই তো আর কোনও সমস্যা হত না। ছি ছি, প্রথমদিন হৃদয়পুরে আপনার, কী বিশ্রী কাণ্ড ঘটল।”

বংশীধর চুপ। বলতে পারছেন না উনি সম্রাট আকবর হতে গেছিলেন।

হাঁটতে হাঁটতে বারবার থামতে হচ্ছে। উপায় নেই, পা টেনে টেনে হাঁটতে হচ্ছে। রাস্তার ধারে একটা বড়ো মাঠ। সেখানে দাঁড়িয়ে বংশীধর জিজ্ঞাসা করেন, “এটা কি তোমাদের খেলার মাঠ?”

“না স্যার, এটা হৃদয়পুরের মেলার মাঠ।”

আবার বুকে হাতুড়ির আঘাত। “কী বললে?” আর্ত চিৎকার করে ওঠেন সব ব্যথা ভুলে।

অবাক হয়ে যান দ্বারিকবাবু। “হ্যাঁ স্যার, হৃদয়পুরের মেলার মাঠ। কী হল আবার আপনার?”

হাউমাউ করে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। এবার কী হবে আমার? কী কুক্ষণে এখানে এসে পড়লাম! মনে পড়ে গেছে। মা বলেছিলেন, ছোটোবেলায় যে হৃদয়পুরের মেলার মাঠেই যমজ ভাই হারিয়ে গিয়েছিল। মেলার ভিড়ে কেউ হয়তো চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। অনেক খুঁজেও তখন তাকে পাওয়া যায়নি। পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকেন বংশীধর, “আমার খুব বিপদ, দ্বারিকবাবু। ভীষণ বিপদ। কে বাঁচাবে আমাকে?”

আফসোস হতে থাকে কেন মার এই কথাটা মনে পড়ে গেল? এখন কী হবে? চোখ দিয়ে দু-চার ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ে। আধা অন্ধকার গ্রামের রাস্তায় দ্বারিকবাবু সরল মনে হাঁটতে হাঁটতে সান্ত্বনা দিতে বলতে থাকেন,  “স্যার, এখানে কোনও বিপদই নেই। আপনি একদম  চিন্তা করবেন না। কিছু হলে তো আমরা আছি। চোর-ডাকাত তো তেমন কিছুই নেই। আপনি হাতের সুখ করবেন যে তেমন ছিঁচকেও চোখে পড়ে না।”

বংশীধর তো কাউকেই বলতে পারবেন না ভীষণ বিপদটা কী। আর তাকে সামলাবেনই বা কী করে। সারা পুলিশ জীবনে এমন বিপদে কেউ পড়েছে বলেও শোনেননি। কাঁদো কাঁদো স্বরে বিড়বিড় করতে থাকেন, “ওরে পাগলা, তোদের কী করে বোঝাই কোথায় মা আমাকে কী বিপদে ফেলে গেছেন। এখন হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদা ছাড়া আর কিছু করার নেই।”

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে