গল্প ভজন কথা কাজল মুখার্জি বর্ষা ২০২০

কাজল মুখার্জী

পরিষ্কার করে একটা কথা বলে নিই শুরু করার আগে। এই লেখা কিন্তু কোনও গানবাজনা নিয়ে লেখা নয়। নিতান্তই এক বেসুরো ছেলের গল্প।

ছোটো থেকেই ভজনের জীবনে বড়ো দুঃখ। সেভাবে ভাবলে দুঃখের কোনও কারণ তার জীবনে থাকতে পারে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। সেটাই হয়েছে মহা জ্বালা। কবে থেকে ঠাকুমার কাছে শুনেছে যে দুঃখ নাকি অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিলে কমে যায়, আর আনন্দ যায় বেড়ে। তা সে ভালো কথা। কিন্তু দুঃখের কথা কাউকে বলতে গেলে সে যদি খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে ওঠে আরও দুঃখ দেয় বাড়িয়ে, তার বেলায় কী হবে সেকথা কোথাও বলা নেই। তার ওপরে আছে আরও উপদ্রব। সেদিন পাশের বাড়ির জগাকাকুকে দুঃখের কথা বলতে গিয়ে আবার নতুন বিপদে পড়েছিল। ভজনের দুঃখের কাহিনি শুনে জগাকাকু তো নিজে হাসলই হে হে করে, তার ওপরে আবার সেই কথা সাতকাহন করে বলে দিল বিশুকে। উহ্‌, তারপর কী যন্ত্রণা ক’দিন! বিশু তো উঠতে বসতে পিছনে লাগে আর ভয় দেখায় বলে দেবে সবাইকে স্কুলে। শেষমেশ ক্রিকেট টিমে বিশুকে জায়গা দিয়ে তারপর রফা।

যদিও পরে ভেবে পায়নি সে এত হাসির কী আছে তার দুঃখের গল্পে। বাড়িতে তাকে তো কেউ পাত্তাই দেয় না। বড়োদের কথা ছেড়েই দিক, এমনকি গজা যে গজা, যার নাকি মূল দায়িত্ব ভজনের সঙ্গে খেলাধুলা করা, সে পর্যন্ত ভজনের দিকে নজর না দিয়ে মা বা জেঠিমার ফাইফরমাশ খাটতে ব্যস্ত। ভজন যদি একবার তাকে ডেকে বলে পেন্সিলটা কেটে দে, বা মোজাটা খুঁজে দে তাহলেই সে ব্যস্ততার দোহাই দেয়। আর নালিশ করেও কোনও লাভ নেই। নবাব খাঞ্জা খাঁকে কেউ কিছু বলবে না, বরং ভজনকেই একগাদা উপদেশ শুনতে হবে নিজের কাজ নিজে করার জন্য। আর সঙ্গে আছে ছোটো কাকার বিদ্যাসাগরের গল্প। আরে বাবা, ঐসব গল্প সবাই ছোটোদের ওপরেই ঝাড়ে। ছোটো কাকার বয়সে বিদ্যাসাগর যে বিধবা বিবাহ আইন পাশ করিয়েছিলেন, সেকথা যদি ভজন বলে? তবে ভজন জানে যে সেকথা বললে কাজের কাজ কিছু হবে না, কিন্তু নিজের সাধের কানের ওপর অত্যাচার হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।

নিজে যে যথেষ্ট নিরীহ সে বিষয়ে ভজনের কোনও সন্দেহ নেই। শুধু এক-আধ সময় একটু-আধটু নিজের খুশিমতো কাজ করে ফেলে। তা সে আর কী এমন কথা! বড়োরা তো সারাক্ষণই নিজেদের খুশিমতো কাজ করে, সে বেলায় তো কেউ কিছু বলে না! এই যে বাবা রোজ সন্ধ্যাবেলায় অনুপমকাকুদের সঙ্গে তাস খেলতে যায়, মেজো কাকা বসে গানের নামে সকাল হতেই সবার কানের পোকা বের করে, তখন তো কেউ কিছু বলে না! এমনকি বাড়ির সবার ছোটো ছোটো-কাকার মেয়ে খেয়াল যে ইচ্ছে হলেই পরিত্রাহি চিৎকার করে কাঁদে তখন তো সবাই তাকে বকার বদলে সামলানোর জন্য দৌড়ে আসে। সব দোষ শুধু ভজনের! সে বসে যদি মেজো কাকার তানপুরাটা নিয়ে একটু প্র্যাকটিস করতে গিয়ে একটা তার ছিঁড়েই ফেলে বা বাবার দাঁত মাজার ব্রাশ দিয়ে একবার নিজে দাঁত মাজার চেষ্টা করে তখন বুঝি সবার সমস্যা?

কিছু না করলেও, বাড়িতে কোথাও কিছু হলেই সবার আগে যেন জলদগম্ভীর স্বরে আওয়াজ ওঠে—এটা ভজনের কাণ্ড নয় তো? এটা যদি অপমান না হয়, তবে আর অপমানের বাকি কী থাকে? তার ডাকনামটাই একটা বিরাট জ্বালা। ঠাকুমা যে অত সুন্দর একটা ডাকনাম রেখেছেন খোকন, সে নাম তো সবাই ভুলতে বসেছে! কবে ছোটো কাকা কী খেয়ালে গজার সঙ্গে মিলিয়ে নাম রেখেছিল ভজা, সেই নামটাই গেল টিকে। পরে আবার তাতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করে পিসিমণি নাম রাখল ভজন। যদিও রাগ হলেই সবার মুখে ভজন ছেড়ে ভজা, ভজু কিনা সব সুমধুর ডাক। ঠাকুমা বলেন বটে নামে কী যায় আসে, গোলাপের নাম যাই হোক না কেন, সে গোলাপই থাকে। তবে ভজন ভেবে দেখেছে, এ নেহাত কথার কথা। গোলাপের নাম ঘেঁটু ফুল হলে দেখ তো সবার কেমন লাগে!

দুর্গাপুজোর সময় ভজনের দিনকাল ভালো কাটে। একে তো বাড়ির সামনেই অগ্নিবীণা ক্লাবের পুজো। মহালয়ার আগে থেকেই সেই পুজো নিয়ে বাপ্পাদা, সায়নদা, অর্কদাদের সঙ্গে পাড়ার কাকুদের কত প্ল্যানিং চলতে থাকে। তার সঙ্গে আবার আজকাল জুড়েছে থিম পুজো নিয়ে ভাবনা। যদিও দাদু এইসব থিম পুজো মোটেও পছন্দ করেন না। আগেরবার মা দুর্গার মুখ নাকি বিদ্যা বালনের আদলে হয়েছিল বলে দাদুর কী রাগারাগি! পুজোর মাঝে একদিন তো পুজোর প্রেসিডেন্ট তোতনকাকুকে ধরে দাদু ধমকেই দিলেন। ঠাকুমা অবশ্য বেশ আধুনিক। ঠাকুমা আড়ালে গজগজ করছিলেন যে বুড়ো হয়ে নাকি দাদুর ভীমরতি ধরেছে। তাই আধুনিক কোনোকিছুই তাঁর ভালো লাগে না।

দাদু ছিলেন স্কুলের অঙ্কের টিচার। রিটায়ার করার পরে তাঁর এখন সব মাস্টারি ভজনের ওপর। তবে পুজোর বাজারে ঠাকুমার ভয়ে দাদুর আর অত পড়ানোর তাড়া থাকে না। ভজনের এখন শুধু জ্বালা খাওয়ার সময়। সে যা খায়, তার অর্ধেক ফেলে উঠে যায়। মাছ তো তার দু’চক্ষের বিষ। মাছ দেখলেই কোনোমতে এপাশ ওপাশ দেখে সুবিধেমতো জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা তার থাকে। পাশের বাড়ির টুকিদের হুলো বেড়ালটা তো ভজনের ফেলে দেওয়া মাছ খেয়েই গুণ্ডার মতো চেহারা বানিয়ে ফেলল। খেয়েদেয়ে মোটা হয়ে বেড়ালটা সারাদিন টুকিদের ছাদে বসে এক চোখ বুজে আরাম করে শুয়ে থাকে। টুকিদের বাড়িতে ইঁদুরের উপদ্রব হতে টুকির দাদু বেড়ালটা এনেছিলেন। তা তাকে দিয়ে কাজের কাজ সেরকম কিছু হয়নি। ভজনের হাসি পায় টুকির মা যখন দুঃখ করেন যে বাড়ির ইঁদুরগুলো হুলোর সঙ্গে পারলে বোধ হয় এবার এক্কাদোক্কা খেলতে শুরু করবে।

এবার পুজোর আগে দাদুর বাবা এসেছেন দেশের বাড়ি থেকে। তাঁর শরীর খুব ভালো নয় বলে কীসব চিকিৎসা হবে কলকাতায়। দাদুদের দেশের বাড়ি সুন্দরবনের ভিতরে এক গ্রাম। তার নাম ভারি সুন্দর—ভুবনেশ্বরী। ভজন কখনও যায়নি সেখানে। তবে গল্প শুনেছে অনেক। তিনি এসেই ভজনকে বললেন যে তাঁকে ডাকতে হবে বড়ো দাদু বলে। বুড়ো দাদু নামে আবার তাঁর বড়ো আপত্তি। বিরানব্বই বছর বয়সেও তিনি নাকি এখনও সেরকম বুড়ো হননি। বোঝো কাণ্ড একবার!

ঘটনাটা শুরু হল এই বড়ো দাদুকে নিয়েই। ষষ্ঠীর দিন সকালে ভজন ঘুম থেকে উঠেই দৌড়েছে প্যান্ডেলে। গিয়ে দেখে তার বয়সী এক ছেলে ঢাকির পাশে দাঁড়িয়ে একটা কাঁসি বাজাচ্ছে। তোতনকাকুর কাছে শুনল যে ছেলেটা নাকি ঘনশ্যামকাকু ঢাকির ছেলে প্রহ্লাদ, সেবারই প্রথম এসেছে বাবার সঙ্গে। তার ডাকনাম হল পেলো।

একটু বেলা হতে বড়ো দাদু গেছেন প্যান্ডেলে। হঠাৎ ভজন দেখে বড়ো দাদু ঢাকি আর তার ছেলের সঙ্গে গল্প শুরু করেছেন। বড়ো দাদু বললেন যে ওরা নাকি সুন্দরবনের লোক। আইলাতে নোনাজলে চাষের সব জমি নষ্ট হয়ে যেতে এখন পুজোর সময় কলকাতা এসে তারা কিছু রোজগার করে নিয়ে যায়। গল্প হতে হতে ভজন শুনে অবাক হয় যে ছেলেটা নাকি গত একবছর মাছ খায়নি অথচ তারা থাকে নদীর পাড়ে। অবাক হওয়াটা কষ্ট হয়ে গেল যখন ঘনশ্যামকাকা বলে যে তারা মাছ খায় না কারণ, ঐ মাছ বিক্রি করেই তাদের চাল কিনতে হয়। তাতেও তারা অর্ধেক দিন আধপেটা খেয়ে থাকে।

বাড়ি এসে বলতেই ঠাকুমার চোখ ছলছল। কিন্তু দশমী পর্যন্ত তারা আটকানো পুজোয়। বিসর্জনের পরেই ঠাকুমা তাদের ডেকে আনলেন বাড়িতে খাওয়াতে। সেখানে তাদের তৃপ্তি করে খাওয়া দেখে সবাই খুব খুশি। ভজন খেতে বসেছে ছেলেটার পাশে। যথারীতি মাছ নিয়ে ভজনের সমস্যা শুরু। অথচ মাছ দেখেই ছেলেটার চোখ চকচকে। ঠাকুমা হঠাৎ দেখেন, ছেলেটা মাছ নিয়ে একটা কাপড়ে বাঁধছে। জিজ্ঞেস করতে সে বলে, মাছ দেখে হঠাৎ তার ছোটো বোনের কথা মনে পড়েছে। বাবা আর সে না থাকায় তার মা ছোটো ভাইবোনকে নিয়ে পুজোয় সময় বোধ হয় আধপেটা খেয়ে আছে। ওরা ফিরে গেলে তারপর এখানে পাওয়া টাকা দিয়ে বাজার হবে ভালো করে।

ভজন তো অবাক। সেদিনই তো ছেলেটা বলল যে ও মাছ খেতে এত ভালোবাসে। তাহলে না খেয়ে বাড়ির জন্য নিচ্ছে কেন? ভজন যা খেতে ভালোবাসে তা তো সে নিজেই খায়। কখনও তো সে এমনকি ছোট্ট খেয়ালের জন্যও কিচ্ছু আনে না! ছেলেটা বলে যে ওর নাকি অনেক বেশি ভালো লাগবে যখন দাদার আনা খাবারদাবার ওর ছোটো ভাইবোন আনন্দ করে বসে খাবে।

একথা শুনেই ভজনের চোখ জ্বালা করে ওঠে। ওর থেকে ছোটো এক ছেলে তার মা-ভাইবোনের কথা ভেবে কাজ করতে এসেছে বাবার সঙ্গে, তাদের কথা ভেবে সে নিজে না খেয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে ভালো খাবার। আর সে নিজে বাড়িতে ভালোমন্দ খাবার খেয়ে সবাইকে যেন উদ্ধার করে। ভজন আর এরকম থাকবে না। সেও সবার কথা ভাববে, সবাইকে ভালো করে রেখে সেই আনন্দে নিজে ভালো থাকবে।

ছবিঃ স্বীকৃতি ব্যানার্জি

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে