গল্প বাঘমামার বিয়ে পিয়ালী গাঙ্গুলি বসন্ত ২০২০

পিয়ালি গাঙ্গুলীর আগের লেখা–  ফোচনের  কীর্তি , ফোচনের আরেক কীর্তি  মিঠে প্রতিশোধ , বেলুন দাদু , দুটি অণুগল্প , নতুন বছর             

পিয়ালী গাঙ্গুলি

আলিপুর চিড়িয়াখানায় রীতিমতো হইহই। বাঘিনী রানি আর পায়েলের বিয়ে। পাটনা থেকে একজন বর আসছে। আরেকজন বর শুভাশিস অবশ্য আলিপুরেরই। এর আগে নাক উঁচু বাঘিনী রাবিশাল নামের এক বাঘকে নাকি পাত্তা দেয়নি। চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ খুব চিন্তায় আছে। এবারেও যদি তাদের মেয়েদের পাত্র পছন্দ না হয়! বাঘেদের বিয়ে হবে, তাও আবার কলকাতায়, শ্রীমান আরণ্যক গাঙ্গুলির নেমন্তন্ন হবে না তা কি হতে পারে? চিড়িয়াখানার অধিকর্তা বেশ সুন্দর একটা কার্ড পাঠিয়েছেন টিনটিনের নামে, সঙ্গে অবশ্য মা-বাবা ফাউ। কার্ড হাতে পেয়ে টিনটিনের তো উত্তেজনার সীমা নেই। কবে বিয়েবাড়ি, কখন বিয়েবাড়ি, আমরা কী গিফট দেব, বিয়েতে বাঘেরা টোপর পরে কি না—কত্ত চিন্তা ছোট্ট মাথায়। নেহাত মোটে পাঁচ বছর বয়স, অতশত জানে না, আরেকটু বড়ো হলে নির্ঘাত আমায় বলত বাঘেদের নেমন্তন্ন করে আইবুড়ো ভাত খাওয়াতে।

স্কুলের এখন সেশন ব্রেক। শ্রীমান সারাদিন বাড়িতে। বাঘের বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামানোর দেদার সময়। মা-ছেলেতে অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম, বিয়েতে রেয়াজি পাঁঠাই গিফট করব। ওদের তো আর আমাজন বা ফ্লিপকার্টের গিফট ভাউচার ধরিয়ে দেয়া যায় না! শাড়ি, গয়না, বেড-শিট বা ক্রোকারিও না। বান্ধবগড়ের জঙ্গলের গাইড নারায়ণভাই বর্মন বলেছিল, বুনো শুয়োর হচ্ছে নাকি বাঘেদের কেক। বড্ড ভালোবাসে ওরা খেতে। কিন্তু আমরা মা-ছেলে বুনো শুয়োর আর কোথায় পাব? আমরা বড়জোর ছাগল জোগাড় করতে পারি। লেক মার্কেটের শাহীর মাংসর দোকানে টিনটিনের বাবার খুব খাতির। ওর বাবাকে দিয়ে তাহলে কিলো দশেক রেয়াজি পাঁঠা কিনে নিয়ে আসতে হবে। তারচেয়ে বেশি পারব না। পাঁঠার অনেক দাম আজকাল। কিন্তু একটা চাপ আছে। ওদের বিয়েবাড়িতে তো নিশ্চয়ই ওদের মতো কাঁচা মাংসই খাওয়াবে। কী করা যায়? আইডিয়া! আমরা বলব, আমাদের মা-ছেলের পেটটা একটু খারাপ, ওষুধ খাচ্ছি, তাই এই ক’দিন বাইরের খাওয়া বন্ধ।

বাঘের বিয়ের নেমন্তন্ন পেয়ে টিনটিনের তো দারুণ খাতির বেড়েছে বন্ধুদের কাছে। তারা কেন নেমন্তন্ন পায়নি সেই দুঃখের ঠ্যালা সামলাতে তাদের মায়েদের প্রাণ বেরোচ্ছে। এদিকে দেখতে দেখতে বিয়েবাড়ির দিন এগিয়ে এল। পাটনা থেকে বর এসে গেছে ক’দিন আগেই। এতটা পথ এসেছে কষ্ট করে, তাই পৌঁছানোর পরেই তাড়াতাড়ি করে বরের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে। ডাক্তারবাবুরা সার্টিফিকেট দিয়েছেন বর একদম সুস্থ আছে, চিন্তার কোনও কারণ নেই। বিয়ের দিন টিনটিনের বাবা শাহী থেকে মাংস কিনে সুন্দর প্যাক করিয়ে এনেছে। টিনটিনের বায়নায় সেটার ওপরে আবার র‍্যাপিং পেপার দিয়ে মোড়ানো হয়েছে। বেশি জমকালো রঙে পশুপাখিদের কষ্ট হয়। সেকথা মাথায় রেখে সবুজ ঘেঁষা জামাকাপড় পরেছে ওরা। টিনটিনের জন্য একটা ওরকম ছোপ ছোপ ক্যামাফ্লেজ ড্রেস কিনে দিয়েছি। সেটা পরে সে আনন্দে আত্মহারা।

চিড়িয়াখানার গেটে সকলে টিনটিনকে দারুণ অভ্যর্থনা করলেন, সঙ্গে আমাদেরও। বিশেষ অতিথি হিসেবে আমাদের গাড়িটা ভেতরে ঢোকানোর অনুমতিও দিলেন ওঁরা। নইলে ওই দশ কিলো মাংসর বক্স নিয়ে রীতিমতো বেকায়দায় পড়তে হত। বাঘের খাঁচার বেশ দূরে লাইট লাগানো। চড়া আলোয় পশুদের চোখে কষ্ট হয়। তাই মানুষের বিয়েবাড়ির মতো একগাদা আলো আর শব্দের উৎপাত নেই এদের বিয়েবাড়িতে। একে একে হেলেদুলে হাতি, গণ্ডার, জিরাফ, জেব্রা, হরিণরা সবাই এসে হাজির হল। সন্ধেবেলায় এখন ভিড় নেই, তাই ওদেরও নিশ্চিন্তে খাঁচার বাইরে বেরোতে দেয়া গেছে। বাঁদর আর পাখিরা গাছে গাছে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। টিনটিন আর ওর মতো আরও কয়েকটা ক্ষুদে মহা আনন্দে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। তবে খুব বেশি কাছে যাচ্ছে না, ছোট্ট ছোট্ট প্রাণে ভয়ও তো আছে।

যথাসময়ে শুভাশিস আর বিক্রমকে ছেড়ে দেওয়া হল পায়েল আর রানির খাঁচায়। একে অপরকে খানিকক্ষণ মাপজোপ করার পর মনে হল খানিক ভাব হল ওদের। ক্ষুদেরা অবশ্য বেশ আশাহত। ওরা ভেবেছিল মানুষের মতো বেনারসি পরা বাঘিনী, টোপর পরা বাঘ আর মন্ত্রপড়া পুরোহিত থাকবে। একটু পরে আমাদের আনা গিফট ওদের পরিবেশন করা হল। নবদম্পতিরা নিমেষের মধ্যে সেটা চেটেপুটে সাফ করে দিল। দেখে আমরাও তৃপ্ত। বিয়ের অন্যান্য অতিথিদের জন্য তাদের পছন্দমতো ঘাস, পাতা, ফলমূল ইত্যাদি পরিবেশন করা হল। এবার আমাদের ভয়ের পালা। আমাদের জন্য কী জানি কী খাবার আসবে! চটপট কেটে পড়াই ভালো।

আমরা ওঠার তোড়জোড় করতেই চিড়িয়াখানার অধিকর্তা স্বয়ং এসে বললেন, “আরে এ কী, চললেন কোথায়? বিয়েবাড়ি এসে কেউ না খেয়ে যায় নাকি? আসুন আসুন, আমাদের সঙ্গে আসুন।”

আমাদের তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। বললাম, “না, আমাদের না পেটের একটা ইনফেকশন চলছে, তাছাড়া আমাদের একটু তাড়াও আছে। আজকে আমরা বেরোই, অন্য একদিন না হয় আসব।”

“না না, না খাইয়ে আমরা অতিথিদের ছাড়ব না।”

বুক ঢিপঢিপ করতে করতে আমরা চললাম পিছু পিছু। চিড়িয়াখানার রেস্তোরাঁর সামনে এসে দরজা ঠেলে বললেন, “আসুন, ভেতরে আসুন। এসো টিনটিন, এসো।”

দুরু দুরু বুকে ঢুকলাম ভেতরে। টেবিলের দিকে তাকিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। রীতিমতো মানুষের বিয়েবাড়ির মতো পোলাও-কালিয়া সাজানো টেবিলে। দেখে জিভে জল আসছে। খিদেও পেয়ে গেছে। কিন্তু বলেছি তো পেটখারাপ। কী করি এবার? অধিকর্তা ভদ্রলোক এবার হেসে ফেললেন। “কী ভেবেছিলেন, বাঘের বিয়েতে বাঘেদের মতোই মেনু হবে? আরে দূর মশাই, অতিথিদের আমরা তাঁদের পছন্দমতোই খাওয়াই। কথায় বলে না, অতিথি দেব ভব! নিন নিন, এবার শুরু করুন, ওসব পেটখারাপের গল্প দেয়ার আর দরকার নেই।”

অলঙ্করণঃ মৌসুমী

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s