আয়োনার আগের গল্প বাচিক শিল্পী
আয়োনা মণ্ডল
বাঁশলৈ নদীর ধারে যেখানটায় আমড়াপাড়া গ্রাম, সেখান থেকে পশ্চিমদিকে একটা লাল মেঠো রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে অনেকদূরে একটা লাল রঙের পাহাড়ের কোল ঘেঁষা ছোটো গ্রামে। গ্রামের নামটা ভারি মজার, দধিমুখী। সেই গ্রামে একটা ছেলে ছিল। তার নাম ছিল নীল্টু। হ্যাঁ, তুমি ঠিকই শুনেছ, নীল্টু ওর ভালো নামই ছিল। সে ওই গ্রামে তার বাবা, মা আর ভাইয়ের সাথে থাকত। নীল্টুর ছিল পেল্লাই শরীর, আর ছিল ক্ষুরধার বুদ্ধি। আর তার বুদ্ধি নিয়েই আমাদের এই গল্প।
সবে দু’দিন হল নীল্টুর বত্রিশ বছরের জন্মদিন পালিত হল। মায়ের হাতের পায়েস, আর পাড়ার মোহন ময়রার দোকানের রসগোল্লা, জিলিপি, সন্দেশ, ল্যাংচা খেয়ে নীল্টু হল আরও পুরুষ্টু, আরও নিটোল। কিন্তু বত্রিশ বছরের নীল্টুর জন্য তার মায়ের চিন্তায় রাতের ঘুম নেই। আর সব বাঙালি মায়েদের মতো নীল্টুর মায়েরও একটাই চিন্তা, ছেলের বিয়ে হবে কবে। নিটোল নীল্টু বৌ পাবে কী করে?
অন্যদিকে নীল্টুর ভাই ছিল খুব রোগা-পাতলা। বয়সে ছোটো হলেও ওর অনেকদিন আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। পাড়ার লোকজন সুযোগ পেলেই নীল্টুর পেছনে লাগে। বলে, ‘ওই দেখ নিটোল নীল্টু। বয়স কতকাল আগে তিরিশ পার হয়ে গেছে, কিন্তু ওর আর বিয়ে হল না!’ এই নিয়ে নীল্টুর বাবা-মায়ের তাই ঘোর অশান্তি। নীল্টুরও খুব কান্না পেত।
একদিন নীল্টুদের গ্রামে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন হল। বামুনপাড়ার রায়দিঘির ধারে যে বিশাল উঁচু পুব বাঁধের ঢিবি আছে, সেই ঢিবি থেকে কে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে রায়দিঘিতে ঝাঁপ দিতে পারবে। প্রতিবারই এমন কিছু অদ্ভুত প্রতিযোগিতার আয়োজন হয় সেখানে। এবারে আবার বিশু পালোয়ান বলেছে, যে প্রতিযোগিতায় প্রথম হবে তাকে সে বিনে পয়সায় তার ব্যায়ামের আখড়ায় একবছরের জন্য ভর্তি করে নেবে। সব শুনে নীল্টু ভাবল, এই সুযোগ! বিশু পালোয়ানকে সে কত অনুরোধ উপরোধ করেছিল, কিন্তু মোটা বলে বিশু পালোয়ান তাকে সুযোগ দেয়নি কখনও। একবার যদি প্রথম হওয়া যায়, তাহলে বিশু পালোয়ানের আর কিছুই বলার থাকবে না, ভর্তি নিতে সে বাধ্য। আর তাহলেই ওর ওজন কমবে।
কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় জিততে গেলে একটু তো প্রস্তুতির দরকার! একটু তো শারীরিক কসরতের প্রয়োজন! সে রোজ ভাবে ব্যায়াম করবে। কিন্তু কোথায় কী? সে রোজই আরও মিষ্টি খেয়ে বসে, আরও ওজন বাড়িয়ে চলে।
অবশেষে এল প্রতিযোগিতার দিন। নীল্টু ভয়ে ঘামতে আরম্ভ করল। শরীর তার অসাড় হয়ে এল। এই ভারী চেহারা নিয়ে সে কী করে জিতবে প্রতিযোগিতা? শুধু শুধু লোক হাসিয়ে আর নিজের লজ্জা বাড়িয়ে কি কোনও লাভ আছে? কিন্তু শরীর মোটা হলেও নীল্টু ছিল খুব ধীর স্থির, আর বুদ্ধিমান। ও দু’মিনিটের জন্য দুটো চোখ বন্ধ করে চিন্তা করে নিল। সরু গোঁফের নিচে পাতলা ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসির রেখা। তার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। যা নিয়ে লোকে এত হাসাহাসি করে, সেটা কাজে লাগিয়েই সে এই প্রতিযোগিতা জিতবে।
প্রতিযোগিতা শুরুর জায়গায় তখন খুব হৈ-হট্টগোল। একটা ছোটোখাটো মেলা বসে গেছে। সব প্রতিযোগীরা তখন গা ঘামাতে ব্যস্ত। তারা সবাই নীল্টুর থেকে অনেক পেশীবহুল। তাদের পাশে নীল্টু যেন একটা আস্ত রসগোল্লা। সবাই ওকে দেখে হাসাহাসি করছে। কিন্তু নীল্টু ঠিক করেছে, সে জিতবেই। লোকে তার শরীরটাই দেখে এসেছে এতদিন, আজ দেখবে নীল্টুর বুদ্ধি। ঠিক সেই মুহূর্ত এসে গেল। রেফারি বাঁশি বাজিয়ে সব প্রতিযোগীকে ডেকে নিল স্টার্টিং লাইনে। তারপর বলে উঠল, “রেডি… সেট… গো…!”
এইবার শুরু হল নিটোল নীল্টুর ক্ষুরধার বুদ্ধির খেলা। ও যে মোটা, আর অন্যসব প্রতিযোগীদের থেকে যে ওজনে অনেক ভারী, সেটাই ওর হয়ে গেল এই প্রতিযোগিতায় সুবিধের দিক। অন্য সবাই দৌড়ে ঢিবি থেকে নিচে নামছে, আর নীল্টু একটু দৌড়েই মাথা নিচু করে নিজের ভারী শরীরটাকে ঢিবির ওপরে গড়িয়ে দিল। বাবা-মা চিৎকার করল, “এই নীল্টু, কী করছিস!”
সবাই তো প্রথমে নীল্টুর কাণ্ডকারখানা দেখে হাসিতে ফেটে পড়ল। সেই হাসিতে কোনও কোনও প্রতিযোগী আবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গেল কী হচ্ছে। একে নীল্টুর ভারী শরীর, তার ওপরে পুব বাঁধের ঢিবি ছিল বেশ খাড়াই। জীবন পণ করে সব আঘাত সহ্য করে নীল্টুর শরীর নিচে নামতে থাকল দ্রুত। অন্যদিকে সব প্রতিযোগীরা একটু সাবধানে দৌড়ে নামতে থাকল।
একে একে সে অনেক প্রতিযোগীদের ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল। প্রথমদিকে যারা নীল্টুকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল, তারাই এখন ‘নীল টু… নীল টু…’ বলে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ওকে উৎসাহ দিতে থাকল। নীল্টুর সামনে এখন মাত্র একজন প্রতিযোগী। এদিকে হয়েছে কী, পুব বাঁধের ঢিবির ঢাল তখন রায়দিঘির প্রায় এক সমতলে এসে গেছে। গড়ান আর প্রায় নেই বললেই চলে। তাই গড়িয়ে আর বিশেষ কাজ হচ্ছে না। দর্শকরা কিন্তু উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। সামনের প্রতিযোগী দর্শকদের আওয়াজে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গেল, নীল্টু কতদূরে আছে। ব্যস, এই সুযোগটাই কাজে লাগাল নীল্টু। তার গম্ভীর গলায় সমস্ত তেজ নিয়ে গড়াতে গড়াতে হঠাৎ উঠে বসে চিৎকার করে উঠল, “হুম… বা-আ-আ-আ…”
সেই অদ্ভুত আওয়াজে ভড়কে গিয়ে সেই প্রতিযোগী সামনের দিকে পড়ে গেল হোঁচট খেয়ে। নীল্টুর শরীরে তখন সারা পৃথিবীর সব দত্যিরা ভর করেছে। উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে থাকল প্রাণপণ রায়দিঘির দিকে। আর মাত্র দশ পা। এদিকে ওই প্রতিযোগী উঠে দাঁড়িয়ে ল্যাংচাতে থাকল। আর নীল্টু রায়দিঘির পারে পৌঁছে ঝাঁপ দিল তার কাচের মতো স্বচ্ছ জলে।
নীল্টুর নামে চারদিকে উঠল জয় জয়কার। তার বাবা-মা কাঁদছে অঝোরে। আর নীল্টু? সেও জলের তলায় ডুবে থেকে একটু কেঁদে নিল কেউ যাতে না দেখতে পায়।
তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ, গল্পের এখানেই ইতি? না না, মোটেই না। নীল্টু উঠে এল জল থেকে। রেফারির মুখ শক্ত। সে বলে উঠল, “এটা নিয়ম বিরুদ্ধ। নীল্টুকে জয়ী ঘোষণা করতে পারব না।”
কিন্তু দর্শকরা তা শুনবে কেন? তারা একযোগে স্লোগান দিয়ে উঠল, “রেফারির অন্যায় দাবি মানছি না, মানব না। আজকের প্রতিযোগিতায় জিতল কে? নীল্টু ছাড়া আবার কে?”
ওই হৈ-হট্টগোলের মধ্যে গ্রামের মুরুব্বি সেনবাবু রেফারি আর নীল্টুকে সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে দিলেন। আর রেফারিকে বললেন, “বলো হে রেফারি, কেন নীল্টুকে তুমি জয়ী ঘোষণা করতে পারবে না?”
রেফারি বলল, “অন্য সবাই দৌড়ে নেমেছে ঢিবি থেকে। নীল্টু গড়িয়ে কেন নামল?”
অমনি নীল্টু বলে উঠল, “কিন্তু সেনজ্যাঠা, প্রতিযোগিতাটা ছিল কে তাড়াতাড়ি ঢিবির মাথা থেকে নামতে পারবে। দৌড়েই যে নামতে হবে, তা তো আগে থেকে বলা হয়নি!”
ব্যস। সেই শুনেই সেনবাবু বলে উঠলেন, “আলবাত! একদম ঠিক! নীল্টুই প্রথম।”
দর্শকরা আনন্দে ফেটে পড়ল। সেই চিৎকারে রেফারির আর কিছুই বলার ছিল না। বিশু পালোয়ান নীল্টুর মুখে একটা রসগোল্লা ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, “আগামী শনিবারে মা কালীকে প্রণাম করে লেগে পড়বি আমার আখড়ায়।”
তিনদিন পর সেনবাবু বিকেলবেলায় পরিষ্কার ধুতি-পাঞ্জাবি পরে হাতে ছড়ি নিয়ে দেখা করতে এলেন নীল্টুর বাবার সাথে। বললেন, “রায়বাবু, নীল্টুর যা বুদ্ধি, আমার একটা প্রস্তাব আছে। আমার মনে হয়, আমার মেয়ে পুতুলের সাথে ওর বিয়ে হলে শুধু বুদ্ধির জোরেই ও পুতুলকে খুব সুখে রাখতে পারবে।”
রায়বাবু বললেন, “কিন্তু পুতুল কি রাজি?”
সেনবাবু বললেন, “আলবাত রাজি!” এই বলে রায়বাবুর কানে কানে কিছু বললেন। নীল্টুর মা শুধু শুনতে পেলেন সেনবাবুর এই কথা, ‘আমার মেয়ে খুব ভালো নাচ জানে। ও বলেছে, নাচ শিখিয়ে ও নীল্টুকে একদম রোগা করে দেবে।’ নীল্টুর মায়ের আনন্দ তখন দেখে কে?
শুভদিন দেখে নীল্টু আর পুতুলের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পিঁড়িতে বসে নীল্টু আড়চোখে পুতুলকে দেখল। খুব ছিপছিপে চেহারা, তার একদম উলটো।
বিয়ের পরে যেই না নীল্টু একটা রসগোল্লা মুখে পুরেছে, পুতুল বলে উঠল, “আজকের মতো খেয়ে নাও, কাল থেকে তোমার নাচের মহড়া শুরু। একবছরে তোমাকে নাচিয়ে রোগা করে দেব।”
বিয়ের পর নীলটুর আর বিশু পালোয়ানের আখড়ায় যাওয়া হল না। কারণ কী জানো? পুতুল খুব কঠোর। সে রোজ তাদের বাড়ির ছাদে নীল্টুকে নাচ শেখায়। হাঁফিয়ে গেলেও ছাড়ে না।
এদিকে হল কী, নীল্টুর মিষ্টি খাবার নেশা পুতুলকেও ধরেছে অল্প অল্প। অনেকদিন এইভাবে একসঙ্গে চলতে চলতে নীল্টুর ওজন একটু কমল, আর পুতুলের একটু বাড়ল। দু’জনেই এই ওজন বাড়া-কমার হিসেবের মধ্যে না গিয়ে যেমন চলছে সেইভাবেই সুখে দিন কাটাতে লাগল।
ছবিঃ সায়ন মজুমদার
বাহ্..ভারী মিষ্টি গল্প..একদম নিটোল
LikeLike