অর্পণ পালের আগের গল্প আমার মেয়ে রাই
অর্পণ পাল
এক
সকালবেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে ছিলেন পান্নালাল মান্না। এমন সুন্দর একটা সকাল, গাছে গাছে এসে বসেছে নানা বয়সের রঙবেরঙের পাখি, তাদের কলকাকলিতে ভরে উঠছে উঠোন-বারান্দা-রাস্তাঘাট সমেত সমস্ত পরিবেশের চালচিত্র, আর সেই সঙ্গে নীল আকাশের গায়ে চরে বেড়ানো গাভীর মতো মেঘপুঞ্জ—এই সবকিছুই মিলিয়ে যে অপূর্ব দৃশ্য, সেটাই বারবার উদাস করে দিচ্ছিল পান্নালালকে। অবশ্য শুধুই পরিবেশের এই স্বাভাবিক সৌন্দর্যের জন্য পান্নালাল মুগ্ধ হয়ে উঠেছেন, এটা ঠিক নয়। তিনি কবি মানুষ, তাঁকে মাঝেমধ্যেই চরিত্রগত কারণেই উদাসীন হয়ে উঠতে হয়, আর এমন একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় সকালে তাঁর মতো একজন স্বভাব-কবি উদাস হবেন না তো কি পাড়ার জলধর ধোপার দোকানে ফাইফরমাস খাটে যে রামু নামের ছেলেটি, সে উদাস হবে?
এই মুহূর্তে বাংলা কাব্য-সাহিত্যের আঙিনায় তেমন কেউ না জানলেও পান্নালাল মান্না নিজে কিন্তু নিজেকে মনে করেন একজন বেশ উঁচু দরের কবিই। আর কেনই বা তিনি মনে করবেন না? এ পর্যন্ত এক ডজন বিভিন্ন সাইজের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে তাঁর, আর সেই কবিতা-বইগুলোর পিছনে পিছনে সাত-সাতটি সাহিত্য সম্মানও এসেছে তাঁর পকেটে। ড্রয়িংরুমের শেলফে সাজানো রয়েছে ছোটোবড়ো হরেক সব মানপত্র, যে কেউ গিয়ে দেখে আসতে পারে। আর তাছাড়া নিত্য বিভিন্ন জেলার হরেক সাহিত্য আসরে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ যে তিনি পান, এটা বলাই বাহুল্য। সেইসব আসরে কবিতা বা অন্য সাহিত্য বিষয়ক যে সমস্ত বক্তব্যগুলি তিনি রাখেন, খুব শিগগিরই সেগুলি একত্রিত করে একটি বাণী-সমগ্র প্রকাশের খুব ইচ্ছে আছে তাঁর।
তবে তাঁর একটাই আক্ষেপ—এই চক-সীতাপুর গ্রামের তেমন কেউ তাঁকে বড়ো একটা শ্রদ্ধাভক্তি করে না, অনেকে তো তাঁকে চেনেই না। তিনি আশা করেন, রাস্তায় বেরোলে অন্তত দু-চারজন তাঁর দিকে ধেয়ে আসবে সই নেওয়ার খাতা বাগিয়ে বা নিদেনপক্ষে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতার কিছু লাইন তুলে জানতে চাইবে সে সবের অর্থ। নাহ্, এর একটাও আজ পর্যন্ত তাঁর জীবনে ঘটল না! তবে গ্রামের লোককে আর দোষ দিয়ে লাভ কী, গুণীর কদর আজকাল সারা পৃথিবীতেই কমে আসছে, এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেন পান্নালাল। এই সান্ত্বনার জোরেই তিনি আজ পর্যন্ত টিকে আছেন, লিখে চলেছেন এক দুর্মর আশা নিয়ে। তাঁর একটাই আশা—একদিন গ্রামের লোক ঠিক তাঁকে চিনবে, তাঁকে নিয়ে গর্ব করবে, তাঁর সম্মানে অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে। তবে সেই দিনটা খুব শিগগিরি আসবে, নাকি তাঁর মৃত্যুর পর, সেটা নিয়ে মাথা ঘামান না পান্নালাল। বা ঘামাতে চান না। কবি-মহলে তাঁর যে স্থান সেটা আস্তে আস্তে পোক্ত হচ্ছে, এই আনন্দেই আপাতত তিনি মশগুল। বাড়ির সামনের চায়ের দোকানদারটি তাঁকে চিনল কি চিনল না, তাঁর কবিতা পড়ল কি পড়ল না, এটা নিয়ে তাঁর আপাতত মাথাব্যথা নেই।
কবিরা স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতির বিচিত্র সাজে উদ্ভাসিত হতে দেখে নানা রংয়ের কবিতা লিখে ফেলেন, প্রকৃতিই তাদের বাস্তব অনুপ্রেরণা। আজ সকালে প্রকৃতির অপরূপ রূপ দেখে পান্নালালেরও খুব জোরে কবিতা পেয়ে গেল (বমি পাওয়ার মতোই ব্যাপারটা আর কী)। তিনি সাত তাড়াতাড়ি লেখার খাতা বাগিয়ে ধরে লিখে ফেললেন একটি (তাঁর মতে) ‘অসাধারণ’ কবিতা—
‘এই সকালে প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে মনে করায় কিশোরবেলার কথা। মাঠের পাশে তেঁতুলগাছে উঠে বসে থাকার কথা। আরও অনেক কথা, যা সহজে মুখে না বলা গেলেও মনে থেকে যায় সমস্ত জীবন।
সুতরাং আলো-বাতাসময় সকাল দেখে কেউ হতাশ হয়ো না। এই সকালের পিছনেই লুকিয়ে আছে এক ঝড়ঝঞ্ঝাময় মেঘ-মাতোয়ারা দুর্যোগ-দিন।
বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় এই আলোকিত সকাল আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছে দুঃখময় এক বিকেলে কথা। যে বিকেলে আমার কাঁধে চেপে বসেছিল কবিতার ভূত।’
ভূত কথাটা লিখে সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিলেন। না, কবিতার মধ্যে ভূত থাকা কোনও কাজের কথা নয়। তাঁর ভারি ভূতের ভয়। বরং ‘কবিতার পোকা’ কথাটা অনেক বেশি কাজের। হ্যাঁ, ‘কবিতার পোকা’, এটাই লেখা থাক।
একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে, আরেকবার সামনের বাগানের গাছপালার দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুটা সূর্যালোক সারা মুখে মেখে নিয়ে আবার লিখে যেতে লাগলেন তিনি। লিখতে লিখতে একসম তিনি এতটাই বিভোর হয়ে গেলেন যে খেয়ালও করলেন না, তাঁর বাড়ির সামনে লোহার গেট খুলে ভিতরে ঢুকছে এক গাঁট্টাগোট্টা যুবক, আধুনিক শহুরে পোশাক আর সানগ্লাস—দুটোই যার দেহে সুন্দর শোভা পাচ্ছে, আর যার ভালো নাম পিনাকী ঘোষাল আর ডাকনাম ‘ন্যাপা’। পান্নালালের একমাত্র ভাগনে।
আজ পান্নালাল একাই রয়েছেন বাড়িতে। তাঁর স্ত্রী আর মেয়ে গতকাল গিয়েছে রামজীবনপুরে, তাঁর শ্যালিকার বিয়েতে। ওরা ফিরবে তিনদিন পর। তিনিও যাবেন কাল, অর্থাৎ বিয়ের দিন। তবে এইসব আনন্দ অনুষ্ঠান তাঁকে বিশেষ টানে না। তিনি পছন্দ করেন ঘরের এককোণে বসে একমনে কাব্য চর্চা করতে। কিন্তু কী আর করা, শ্যালিকার বিয়ে বলে কথা, না গিয়েও পারা যায় না।
একটু বাদে তাঁর বারান্দায় উঠে এল পিনাকী। নিবিষ্ট মনে তখন কবিতার সাগরে ডুবে আছেন পান্নালাল। হঠাৎ পিছন থেকে ‘মামাবাবু কেমন আছেন’ শুনে তাঁর তো পিলে চমকে গেল। “কে? কে? সকালবেলা আবার কে এল!” বলতে বলতে পিছন ফিরে পিনাকীকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে হেসে ফেললেন পান্নালাল। আর হেসেই তাঁর খেয়াল হল, মাথা থেকে সদ্য ভাবা কবিতার দুটো লাইন বেমালুম হাওয়া হয়ে গিয়েছে!
পিনাকী সম্পর্কে পান্নালালের ভাগনে, আগেই বলেছি। সে কলকাতায় থাকে, কলেজে পড়ে। ছোটো থেকেই তার শরীরটা মারাত্মক রকমের সুগঠিত, সেই সঙ্গে নিয়মিত জিম করে করে দেহটাকে এখন মন্দির বানিয়ে ফেলেছে। ওটাই ওর ধ্যানজ্ঞান, নিজের দেহকে সবসময় আলোচনার বিষয়বস্তু করে রাখা। সে মামার কাছে খুব একটা আসে-টাসে না, নেহাত দরকার পড়লেই শরণাপন্ন হয়। পান্নালাল আত্মবিভোর মানুষ, পিনাকীর নানারকম আবদার যথাসম্ভব মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, নইলে সে লেখার কাজে বড়ো ব্যাঘাত ঘটায়। আজ যেমন এসেই সে বলল, “মামা, একজায়গায় যাবে?”
একে হঠাৎ চমকে যাওয়ার ফলে মাথা থেকে কবিতার লাইনগুলো পালিয়ে যাওয়ার শোক, তার উপর এই সময় যখন সামনের কলকাতা বইমেলায় তাঁর কবিতার নতুন বই বের করার পরিকল্পনার চূড়ান্ত পর্যায় চলছে, তখন একজন ব্যস্ত এবং বিখ্যাত কবিকে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়াটা নির্বুদ্ধিতা নয়?
খুব রেগে পান্নালাল বললেন, “তোর আক্কেল তো কম না হে পিনাকী! তুই জানিস না, সামনে বইমেলা, আমার এখন নাওয়া খাওয়ার সময় নেই? এইসময় আমায় বেড়াতে যাওয়ার কথা বলিস কোন মুখে?”
পিনাকী একটুও লজ্জিত বা অনুতপ্ত হওয়ার ভাব দেখাল না। বরং সে মামার সামনের একটা খালি চেয়ারে বেশ জুত করে বসল। সে জানে, তার মামা কোনওদিনই তাকে বসতে বলবে না। এইসব সামাজিক সৌজন্যবোধ পান্নালালের কোনওকালেই নেই। তিনি বাড়িতে কেউ এলে খাতির-টাতির করার ধারও ধারেন না।
চেয়ারে বসে টেবিল থেকে একটা জলের বোতল নিয়ে ঢক ঢক করে খানিক জল খেয়ে পিনাকী বলল, “শোনো মামা, তোমায় আমি এমনি এমনি কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা বলছি না। আমি যেখানে যাওয়ার কথা বলতে এসেছি, সেখানে গেলে তোমার লেখালিখিরই সুবিধা হবে। লেখার অনেক খোরাক পাবে। আমি তো জানি তুমি খুবই ব্যস্ত মানুষ, তোমার সময় নষ্ট করতে আমার কি মন চায়, বলো?”
পান্নালাল বললেন, “তুই কোনও প্রাকৃতিক পরিবেশে গিয়ে দু-চারদিন থেকে আসার কথা বলছিস তো? না রে। আমার এখন সেরকম কোনও প্রাকৃতিক পরিবেশে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। এই বারান্দায় বসেই আমার যথেষ্ট প্রকৃতি দেখা হয়ে যাচ্ছে, কবিতাও বেরোচ্ছে মন্দ নয়। তাছাড়া তোর মামি আর অদ্রিজা গিয়েছে বিয়েবাড়ি। এখন তিনদিন মনের সুখে আমি লিখতে পারব ঘরে বসেই। কোনও ঝঞ্ঝাট বা উপদ্রব নেই।”
পান্নালাল কবিতার খোরাক পাওয়ার জন্য প্রকৃতির কাছে যেতে পছন্দই করেন। এর আগে বেশ কয়েকবার সেরকম গিয়েওছেন, তবে তিনি আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বড়ো একটা যান-টান না।
পিনাকী হাসতে হাসতে বলল, “মামা, তুমি পুরোটা শোনো না, তার আগেই মতামত দিয়ে ফেলো, এটা তোমার একটা বড়ো দোষ। আমি কোনও প্রাকৃতিক পরিবেশে যাওয়ার কথা বলছি না। আমি তোমায় জল্লাদমারির চরে নিয়ে যেতে চাইছি। সেখানে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে এক ভদ্রলোকের সামনে। সেই ঘটনাটা আমরা আর একটু বিস্তারিত জানতে যাব। আর আমার মনে হয় সেই ঘটনাটা জানলে তোমার কবিতা লেখার কাজেই লাগবে। বলা যায় না, হয়তো তোমার আগামী কাব্যগ্রন্থের সবকটা কবিতা হয়তো ওই ঘটনা শুনেই লিখে ফেললে, এমনও হতে পারে।”
পান্নালাল এবার আরও বিরক্ত হলেন। পিনাকী সক্কালবেলা এসে ভালোই জ্বালাতন শুরু করেছে। তিনি কবি মানুষ, গোয়েন্দা কাহিনি লেখক তো নন। আশ্চর্য ঘটনা জেনে তিনি কী করবেন? পিনাকী কি তাঁকে গোয়েন্দা কাহিনির লেখক মনে করছে নাকি? আর গোয়েন্দা কাহিনি তিনি মোটেই পছন্দ করেন না। যতসব আজগুবি গাঁজাখুরি। বিকৃত মনের প্রকাশ। কবিতাই হচ্ছে আসল সাহিত্য। বিশুদ্ধ সাহিত্য। সেখানে কোনও আজগুবি, অসত্য, অপ্রাকৃতিক কিছু ঠাঁই পায় না। সুতরাং তাঁর মতো একজন প্রতিষ্ঠিত কবিকে আশ্চর্য ঘটনা শুনিয়ে কী লাভ? আশ্চর্য ঘটনা কি তাঁকে কবিতা লিখতে সাহায্য করবে?
মামার মুখে এখনও অবিশ্বাসের ছাপ আর বিরক্তি দেখে পিনাকী চেয়ারটা মামার চেয়ারের আরও কাছে আনল এবং ধীরে ধীরে বলল, “দ্যাখো মামা, তুমি কবিতা লেখো এটা আমি ভালোমতোই জানি। অনেক বিখ্যাত কবিদের চেনো, তাঁদের সঙ্গে ওঠাবসা করো, তাও জানি। আমি জল্লাদমারির চর তোমায় এমনি এমনি নিতে চাইছি না। সেখানে তোমাকে আমি যার সঙ্গে আলাপ করাব বলছি তিনি একজন কবি। হয়তো তাঁর কথা তুমি শোনোইনি। আর আমি না জানালে ভবিষ্যতে শুনবে বলেও আমি মনে করি না। তাঁর বাড়ি সেখানে। ঘটনাটা তাঁর সঙ্গেই ঘটেছে। আমি নিশ্চিত, তুমি তাঁর সঙ্গে আলাপ করলে আফসোস করবেই, এতদিন কেন বল্লভবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়নি এই বলে। এই যাহ্, নামটা বলে ফেললাম।”
পান্নালাল মাথা নাড়লেন। নাহ্, বল্লভবাবু বলে কোনও কবির নাম তিনি অন্তত আজ পর্যন্ত শোনেননি।
পিনাকী বলছিল, “আচ্ছা শোনো, তোমায় ঘটনাটা খানিকটা বলি তাহলে। যদিও আসল ব্যাপারটা বাদ দিয়েই। ভদ্রলোকের পুরো নাম বল্লভকান্তি বারিক। থাকেন জল্লাদমারির বাজার যেখানে শেষ, তার পরে একটা মাঠ আছে, সেই মাঠের ধারে। নিজস্ব পৈতৃক বাড়ি, এখন একাই থাকেন। বয়স বেশি নয়, এখনও বিয়ে থা করেননি কবিতা লেখার অসুবিধা হবে বলে। ভদ্রলোকের নাকি কবিতা জগতে বেশ নাম হচ্ছে ইদানীং। তা ইনি গত সপ্তায় এক অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন, বাইরের কেউ সেটা এখনও জানে না। আমার এক বন্ধু আছে প্রলয়, ও ওই বল্লভবাবুর ভাইপো। গত পরশু ও জল্লাদমারির চরে গিয়েছিল, তখন ঘটনাটা জেনে এসেছে কাকার কাছ থেকে। ও-ই আমাকে বলল, ‘তোর মামা তো কবিতা লেখেন ওঁকে একদিন কাকার কাছে নিয়ে আয়, এই ঘটনাটা শুনলে তোর মামারও কিছু সুবিধা হতে পারে।’ তাই তোমাকে যেতে বলছি। তুমি চলো ওঁর কাছে একদিন, ভালোই লাগবে। কাজও হবে, ঘোরাও হবে, এক কবির সঙ্গে আলাপও হবে।”
“তা তোর এই বন্ধু, কী নাম বললি, হ্যাঁ প্রলয়। ও কি আমাদের সঙ্গে যাবে?”
পিনাকী বলল, “প্রলয় যাক না যাক তুমি আর আমি যাচ্ছি এটাই ফাইনাল, ঠিক আছে?”
পান্নালাল একটু ভাবলেন। কবিদের সঙ্গে আলাপ করতে তাঁর ভালোই লাগে। তবে এই বল্লভকান্তি বারিক নামে কোনও কবির লেখা তিনি কোথাও পড়েছেন বলে এখনও মনে পড়ছে না। বাংলা সাহিত্যের প্রায় নব্বই শতাংশ জীবিত কবিকেই তিনি চেনেন বা নাম জানেন। কিন্তু এমন হতে পারে এই বল্লভকান্তি হয়তো ছদ্মনামে লেখেন, তাই নাম শোনেননি। আর পিনাকী এত করে বলছে যখন, একদিন ঘুরে আসাই যাক। কবি, অথচ রহস্যময় একটা ঘটনা ঘটে গেছে তাঁর সঙ্গে… নাহ্, একবার যাওয়া যেতেই পারে।
ঠিক হল, আগামী পরশু সোমবার, সেইদিন সকালে যাওয়া হবে। তবে ফিরে আসতে হবে পরেরদিনই, কারণ মঙ্গলবার কলেজ স্ট্রিটে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তাঁর কবিতাপাঠ রয়েছে। তখনও পান্নালাল জানতেন না, এই যাওয়ার ফলে তাঁর জীবনে একটা বড়ো রকমের পরিবর্তন ঘটে যাবে!
দুই
প্রথমে বাস, তারপরে ট্রেন, তারপর আবার বাস এবং সবশেষে নৌকো—সব মিলিয়ে চার ঘণ্টার যাত্রা শেষে দুপুর এগারোটা নাগাদ পিনাকী আর পান্নালাল পৌঁছলেন জল্লাদমারির চরে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার এক প্রান্তে এই গ্রাম। এরপরেই সুন্দরবনের শুরু।
তখন মাথার উপরে রোদ্দুর গনগন করছে, আর পেটের মধ্যে খিদের দাউ দাউ আগুন। ছোটো একটা গঞ্জ এলাকা—একটা বাজার, অল্প কিছু দোকান আর এদিকে সেদিকে কয়েকটি বাড়িঘর, এই নিয়েই জল্লাদমারি। আর মাঠটা এই বাজারটা পেরোলেই, এমনটা জানা গেল।
বাজারে একটা চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা আর পাঁচটা বিস্কুট খেয়ে নিলেন পান্নালাল। পিনাকী রাস্তায় তেমন কিছু খায় না, সে একটা দোকান থেকে এক প্যাকেট ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট কিনে রেখে দিল। ভাগ্যিস বল্লভবাবুকে আগে থেকে জানিয়ে রাখা ছিল, তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, দুপুরে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা থাকবে।
চা-টা খেয়ে তারপর হাঁটা শুরু। মামা-ভাগনে ছাতা মাথায় অন্তত আধঘণ্টা হাঁটতে তবে মাঠের পাশে এসে পৌঁছলেন। বেশ বিশাল মাঠ, একদিকে কয়েকটা বটগাছও আছে। একটা বটগাছের নিচে বসে ছিল এক কমবয়সী ছোকরা। সে একটা মোবাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। পান্নালাল আর পিনাকীকে দেখে উঠে সোজা হয়ে বলল, “দাদা, আপনারা কোথায় যাবেন?”
পান্নালাল অচেনা কারও সঙ্গে বড়ো একটা কথা বলেন না নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে। তিনি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। সুতরাং পিনাকী এগিয়ে এসে বলল, “এই আমরা এখানে বল্লভবাবুর বাড়ি যাব। তুমি চেনো ওঁর বাড়ি?”
ছেলেটি একটু যেন চমকাল। তাদের দু’জনের দিকে দেখল ভালো করে। তারপর মোবাইলে চোখ রেখেই বলল, “অ। বল্লভবাবুর বাড়ি? তা যান, ওই যে ওদিকে পরপর দুটো বটগাছ, ওই গাছদুটোর ঠিক পিছনে একতলা বাড়ি। যাচ্ছেন ভালো কথা, সাবধানে থাকবেন।”
পান্নালাল ছেলেটির কথায় তেমন আমল দিলেন না। কবি লোকেদের স্থানীয়রা চিরকালই অমন বাঁকা চোখে দেখে, মন্তব্য করে। তাঁর সঙ্গেও এমন দুয়েকবার হয়েছে। এই তো গতমাসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত কবি হিমাচল সরকার। তা তাঁর বাড়ির কাছাকাছি এসে হিমাচলবাবু পাড়ার এক ছোকরাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেন পান্নালাল মান্নার বাড়িটা কোথায়। সেই ছোকরা পান্নালালের নাম শুনেই বলে, “পান্নালাল? মানে সেই পাগলা কবিটা? ও তো এই কাছেই থাকে।” বলে ঠিকানা বলে দিয়েছে বটে, তাও পরে জানা গেল সেটা আবার দুটো গলি পেরিয়ে একটা বাড়ি পরের ঠিকানা। হিমাচলবাবু অনেক কষ্টে সেদিন তাঁর বাড়ি আসতে পেরেছিলেন। শত্রুপক্ষে দেশ ছেয়ে গিয়েছে, তো এখানেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন?
আরও সাত মিনিট পরে অবশেষে বল্লভবাবুর বাড়ির সামনে এলেন তাঁরা। বাড়ি চিনতে কোনও অসুবিধাই হল না, কারণ বাড়ির সামনে বাহারি নামের প্লেট লাগানো—
বল্লভকান্তি বারিক
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি
(জাতীয় কথাটা বেশি বড়ো অক্ষরে লেখা)
জল্লাদমারি
তিন
চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর বয়স হবে ভদ্রলোকের। কাঁচা-পাকা একমাথা চুল, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, একটা সাদা বারমুডা আর গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা বল্লভকান্তি এসে তাঁদের জন্য দরজা খুলে দিলেন। দেখা গেল তাঁর হাতে একটা কবিতার বই রয়েছে। তাছাড়া পান্নালালেরা ঘরে ঢুকে দেখলেন ঘরভর্তি কবিতার বইয়ে ঠাসা, একটা কম্পিউটারও আছে ঘরের এককোণে।
তাঁরা চেয়ারে বসার পর বল্লভবাবু বললেন, “তা আপনারা খেয়েদেয়ে এসেছেন তো?”
দু’জনেরই চমকানোর শুরু। এই ভদ্রলোকই তো ফোনে বলেছিলেন কাল যে রান্নাবান্না করে রাখবেন। আজ সেটা ভুলে গেলেন? কবি মানুষ বলে এটাও মনে থাকবে না? পিনাকী আর পান্নালালের পেটে তখন খিদে আরও জাঁকিয়ে বসেছে। এই দুপুরে বাজারে গিয়েই কি আর খাবারদাবার মিলবে?
পিনাকী কায়দা করে বলল, “খাওয়া নিয়ে আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমাদের জন্য সামান্য দুটো ডাল-ভাতের আয়োজন করলেই চলবে।”
বল্লভবাবু মাছি তাড়ানোর মতো হাত-টাত নেড়ে বললেন, “আচ্ছা আচ্ছা, সে হবে’খন। তা আপনিই তো পান্নালাল মান্না? আপনি কবিতা লেখেন? কোন কোন কাগজে লিখেছেন বলুন তো।”
শচীন তেন্ডুলকরকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কোন কোন মাঠে ক্রিকেট খেলেছেন বলুন তো, তাঁর মুখের অবস্থা নিশ্চয়ই এইরকমই হবে, যেমন মুখ করলেন পান্নালাল। তিনি এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবিদের একজন, তাঁকেই কিনা এক অজ পাড়াগাঁয়ের অখ্যাত কবি জিজ্ঞেস করছে কোন কোন কাগজে লিখেছেন! নেহাত পিনাকীর বন্ধুর কাকা, তাই রাগ না দেখিয়ে একটু হেসে বললেন, “না না, সে তেমন কিছু না। ওই আর কী টুকটাক এদিকে সেদিকে লিখেছি।”
“আচ্ছা, তা আমার লেখা পড়েছেন? আপনি তো আমার চেয়ে অনেক সিনিয়র। আমি অবশ্য অনেক পরে এই লাইনে এসেছি।”
পান্নালাল একটু অপরাধী অপরাধী মুখ করে বললেন, “না, আসলে সেরকম কিছু পড়া হয়নি। কলকাতার কাগজে আপনার লেখা খুব একটা চোখে পড়েনি তো, তাই হয়তো। আজ কিছুটা পড়ে নেব।” কথাটা বলে তিনি মনে মনে একটু আনন্দ পেলেন। দেখো, তোমার কবিতা যে এই মফস্বলে সীমাবদ্ধ, সেটা কেমন কায়দা করে বুঝিয়ে দিলাম।
“ভালো ভালো। এসেছেন যখন তখন পড়বেন তো নিশ্চয়ই। তা পিনাকী, তুমি তোমার মামাকে আমার ব্যাপারে সব বলেছ তো?”
পিনাকী একটু থেমে থেমে বলল, “হ্যাঁ… মানে… ওই ঘটনাটা তো? সেইজন্যেই তো মামাকে এখানে নিয়ে এসেছি। আপনার মুখ থেকেই… ইয়ে… ব্যাপারটা আর একটু বিস্তারিত শুনলে পারলে ভালো হয় আর কী।”
“না না, সে তো আমি বলবই। তবুও তুমি একটু হিন্ট দিতে পারতে। আসলে হয়েছে কী পান্নালালবাবু, আমি এই বাড়িতে একাই থাকি জানেন তো। তা গত সপ্তায়, এই বুধবার আমার এখানে এক বিশেষ ঘটনা ঘটে। সেটা আমি কাউকে তেমন এখনও বলিনি, শুধু প্রলয়কেই একদিন বলছিলাম। ও-ই তখন পিনাকী আর আপনার কথা বলে। আমি অবশ্য আপনাকে হয়তো আসতে বারণই করতাম, কিন্তু আমার মন বলল অন্তত আরেকজন কবিকে ব্যাপারটা বলাই যেতে পারে। তাই আপনি এসেছেন, ভালোই হয়েছে। সাফল্যটা দু’জনে মিলে ভাগ করে নেওয়া যাবে, কী বলেন?”
পান্নালাল এই কথা শুনে ভাবলেন, নির্ঘাত কোনও কবিতা উৎসবে যাওয়ার ডাক-টাক আসতে চলেছে। এক কবি আরেক কবির কথা ভাবছে, তাকে সাফল্য পেতে সাহায্য করতে চাইছে—এটা আজকাল তো বড়ো একটা ঘটে না। তিনি বেশ আনন্দই পাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎই তাঁর মনে পড়ে গেল, পিনাকী তাঁকে বলেছিল, এখানে এসে ঘটনাটা শুনলে তাঁর নাকি কবিতা লেখার হাত খুলে যাবে। সেটা কী করে সম্ভব? কবিতা উৎসবে ডাক পেলে কি কবিতা লেখার হাত খুলে যায়? তাহলে কি অন্য কোনও ব্যাপার? আরও বড়ো কোনও সুযোগ আসতে চলেছে?
“আচ্ছা, ব্যাপারটা আরও একটু খুলেই বলি, নাকি?”
এইসময় পাশ থেকে পিনাকী একটু উসখুস করতে লাগল। তারপরে বলেই ফেলল, “ইয়ে, মানে ভাতটা চাপিয়ে এসে ব্যাপারটা বলা শুরু করলে হত না? মানে, বেলা তো অনেক হয়েছে…”
বল্লভবাবু এতক্ষণে আবার হাসলেন। তারপরে বললেন, “আরে আমি তো শুরুতে রসিকতা করছিলাম। আমার রান্নাবান্না সকালেই সব শেষ। আচ্ছা চলো, আমরা তবে খাওয়াটা সেরেই নিই। তারপরে জমিয়ে বসে কথাবার্তা বলা যাবে’খন।”
পান্নালাল আর পিনাকী দু’জনেই এই কথা শুনে হেসে উঠলেন। আর মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
চার
খাওয়াদাওয়া হল বেশ জব্বর। কবি মানুষের রান্নার হাত যে এত ভালো হয়, এই প্রথম জানলেন পান্নালাল। তারপরে আবার সেই ঘরটায় এসে সকলে বসার পর বল্লভবাবু শুরু করলেন তার কাহিনি—
“এই গত সপ্তার কথা। আমি সেদিন রাতে যথারীতি খাওয়াদাওয়া সেরে এই ঘরটায় বসে কবিতা লিখতে শুরু করেছি। আমি রোজ তখন রাতে দুটো করে কবিতা লিখতাম, নিয়ম করে। আর এক-দেড় ঘণ্টা বিভিন্ন বই পড়তাম। তা সেদিন…”
এই অবধি শোনার পর পান্নালাল ফুট কাটলেন, “তা এখন কি আপনার সেই অভ্যেস চলে গিয়েছে?”
“না না, এখন আমার অভ্যেস কী হয়েছে, সেসবই বলব। একটু ধৈর্য ধরে সবটা শুনুন।”
পান্নালাল চুপ করে গেলেন। তারপরে বল্লভবাবু আবার বলতে লাগলেন, “হ্যাঁ, যা বলছিলাম। সেদিন রাতে আমি তখন কবিতা লিখছি, রাত সাড়ে এগারোটা বাজে, এইসময় বাইরে একটা খসখস আওয়াজ শোনা গেল। কিছু একটা যেন মাটির উপর দিয়ে ঘষে ঘষে এগিয়ে চলেছে, এইরকম মনে হল। আওয়াজটা আসছিল আমার ঘরের ঠিক বাইরে থেকেই। তা আমার ভূতের ভয়-টয় একটু কমই চিরকাল, কবিদের অত ভূতের ভয়-টয় পেলে চলে না, আমি দরজা খুললাম।”
এইসময় পান্নালাল ভাবছিলেন, হুঁহ্, কবিদের নাকি ভূতের ভয় পেলে চলে না! তিনি তো ভয় পান, আবার কবিতাও লেখেন, তা তাঁর কবিতা কি ছাপা হয় না?
বল্লভবাবু বলছিলেন, “দরজা খুলে প্রথমে তো আমি কিছুইই দেখতে পাইনি। তারপর আমার মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে এদিক সেদিক ঘোরাতেই দেখতে পেলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য!”
পান্নালাল একটু নড়েচড়ে বসলেন। এ তো পাক্কা ভূতের গল্প হতে চলেছে!
“আমি দেখলাম, মাটির উপরে একটা অদ্ভুত জিনিস, কালো রঙের, অনেকটা রেডিওর মতো, তবে একটু আঁকাবাঁকা। জিনিসটার একদিকের কোণ থেকে একটা প্যাঁচালো তার বেরিয়ে আছে, সেই তারটা আবার নড়ছে। বাক্সটার গায়ে বিভিন্ন জায়গায় নানারকম ফুটো। সেই ফুটো দিয়ে মাঝে মাঝে আবার কীসব নাড়িভুঁড়ির মতো বেরিয়ে আসছে, আবার ঢুকে যাচ্ছে। আর বাক্সটা মাটির উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে, সোজা।”
“আমার টর্চের আলো সেটার গায়ে গিয়ে পড়ার একটু বাদে জিনিসটার চলন থেমে গেল। তারপর দেখি সেটা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমি একটু ভয় পেলাম, যদি ফাটে! আমি বুঝতেই পারছিলাম না এটা কোথা থেকে এল, আর জিনিসটাই বা কী। তবুও কৌতূহলের বশে ফিরে এলাম না, দেখতে লাগলাম কোথায় যায়।
“একটু বাদে সেটা আমার ঠিক সামনে এসে স্থির হল, আর আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে তার মধ্যে থেকে আওয়াজ ভেসে এল একদম পরিষ্কার গলায়, ‘বল্লভকান্তি, আমায় একটু ঘরে নিয়ে যাবে?’
“তখন অবশ্য শুরুতে বুঝিনি আওয়াজটা ওই বাক্স থেকেই আসছে। ভেবেছিলাম কাছেপিঠে কেউ হয়তো বলছে। আমি এদিক সেদিক ভালো করে দেখেও কিছু বা কাউকে দেখতে পেলাম না। তখন বুঝলাম, কথাটা বলছে ওই বাক্সটাই। এটা কোনও রিমোটচালিত যন্ত্র নয় তো, যেটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে অন্য কেউ আড়াল থেকে? এই ভেবে আমি শুরুতে কিছুক্ষণ যন্ত্রটার কাছেই গেলাম না। তখন দেখি আবার সেটার মধ্যে থেকে কথা বেরোচ্ছে, ‘কী হল, বল্লভকান্তি? ভয় পাচ্ছ? কিচ্ছু ভয় নেই, আমাকে তুমি ঘরে নিয়ে চলো, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে। সব বলছি।’‘
“তারপর তো কোনওরকমে শুঁড়-টুড়ে হাত না লাগিয়ে জিনিসটাকে ঘরে এনে টেবিলের উপরে বসালাম। জিনিসটার নিচে একটু একটু কাদা আর জল লেগে ছিল। টেবিলে সেই কাদা লেগেও গেল একটু। আমি দেখলাম, বাক্সটা টেবিলে রাখতেই বেশ জোরে সেটা কেঁপে উঠল। আর বলল, ‘বাহ্ বল্লভকান্তি, তুমি আমার প্রাণটা বাঁচালে সত্যি সত্যি। ওই অন্ধকারে আমি আর খানিকক্ষণ থাকলেই রাস্তা হারিয়ে ফেলতাম, আর আমার শক্তিও যেত শেষ হয়ে।’
“আমি বললাম, ‘তুমি… তুমি কে? কোথা থেকে এলে?’
“যন্ত্রটা বলল, ‘আমার নাম আপাতত ধরে নাও কন্দর্প। আমি থাকি অনেক দূরে, তুমি শুনলে হয়তো চমকাবে।’
“আমিই বললাম, ‘না চমকাব না। বলো তুমি কে বা কী, আর আসছ কোথা থেকে।’
“এবার যন্ত্রটা যা বলল, সত্যিই চমকানোর মতোই। সে নাকি আসলে কোনও যন্ত্রই নয়, একটা প্রাণী। খুব উন্নত জাতের বলেই ওইরকম যন্ত্রের চেহারা নিয়েছে। তাদের গ্রহে সবাইকে ওইরকমই দেখতে। আমাদের সৌরমণ্ডল থেকে একশো কোটি আলোকবর্ষ দূরের এক অন্য সৌরমণ্ডলের পৃথিবীর মতো আকারেরই এক গ্রহ থেকে সে আসছে। সেই গ্রহের প্রায় সমস্ত কিছুই আমাদের মতোই, শুধু তারা আমাদের সভ্যতার থেকে অন্তত এক লক্ষ বছর এগিয়ে আছে সবদিক থেকে, পরে জেনেছিলাম। সে তার মহাকাশযান নিয়ে রাতের বেলা পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে বলে সহজে কোনও যন্ত্রে বা কোনও মানুষের চোখে তাকে দেখতে পাওয়া যায়নি। আর সে নাকি ইচ্ছে করলেই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে, মানে তাকে সহজে কোনও যন্ত্রের সাহায্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। তা এই প্রাণীটি এসে নেমেছিল জল্লাদমারির চরায়, তারপর সে রাস্তা হারিয়ে ফেলে। মানে আসলে তার এনার্জির উৎস হঠাৎ ডি-অ্যাক্টিভেট হয়ে যায় কী কারণে। তারপর সন্ধে নেমে আসে, রাস্তা হারিয়ে সে এই মাঠে ঘুরতে থাকে। কিন্তু কেন তার শক্তির উৎস হঠাৎ কমে এল, সেটা সে এখনও বোঝেনি। এখন কোনওভাবে নিজেকে চার্জড না করতে পারলে সে তার মহাকাশযানে সিগন্যাল পাঠাতে পারছে না।
“এরপর আমরা আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকি। আর সে, তার নাম এখন কন্দর্পই, আমি তাকে ওই নামেই ডাকি এখনও, সে আমার টেবিলের ইলেকট্রিক প্লাগ থেকে এনার্জি নিতে থাকে। আমার একটা পুরনো মোবাইলের চার্জার ছিল, সেটাকে সে শুঁড় দিয়ে নানাভাবে পেঁচিয়ে কীভাবে যেন তার পিছন দিকে কোনও একটা জায়গায় লাগিয়ে নিয়েছিল। খানিক বাদে আমি কথায় কথায় জানতে পারি, সে-ও তাঁদের গ্রহের একজন কবি এবং বেশ বিখ্যাত!
“হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। তাদের গ্রহেও কবিতা লেখা হয়, তাদের বই প্রকাশ পায়, আর আমাদের মতো তারাও বিভিন্ন পুরস্কার পায়, কবিদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও আছে বিলক্ষণ। শুনে আমার যে কী আনন্দ হচ্ছিল, আপনাকে কী বলব। তা আমি কবিতা লিখি শুনে আমার সঙ্গে বেশ খানিকক্ষণ ছন্দ ভাষা শব্দ এইসব নিয়ে আলোচনা করল, আর আমার কবিতা লেখার প্রসেসটা শুনে সে তো ভারি অবাক হয়ে গেল।”
পান্নালাল বললেন, “কেন, অবাক হল কেন? তাঁদের গ্রহে কীভাবে কবিতা লেখা হয়?”
বল্লভবাবু বললেন, “আরে শুনুনই না, সেটাই তো আসল মজা। তা সে বলতে লাগল, তাঁদের গ্রহে কবিতা নাকি মাথা খাটিয়ে লিখতেই হয় না। ওসব এখন থেকে এক লক্ষ বছর আগে লেখা হত ওখানে। তারপরে ওখানকার বিজ্ঞানীরা আর কিছু বিশেষ কবি, যারা আবার বৈজ্ঞানিকও, তারা একসঙ্গে মিলে আলোচনা আর গবেষণা করে বানিয়ে নিয়েছে এক আজব কল।
“আমাকে সে বলেছে সেই কলের কায়দাকানুন। সে কলের সামনে বসে খুব ঠাণ্ডা মাথায় চুপচাপ ভাবতে হবে কী ধরনের কবিতা তুমি লিখতে চাও, মানে দুঃখের, নাকি আনন্দের, নাকি প্রেমের, নাকি বিরহের। সেই চাহিদা অনুসারে খানিক বাদেই সেই যন্ত্র থেকে গরম গরম প্রিন্ট আউট হয়ে সাদা সাদা কাগজে বেরিয়ে আসবে কবিতা! প্রতিবার অন্যরকম, বিভিন্ন আকারের। তবে এই যন্ত্র থেকে যে কবিতা বেরোবে, সেগুলোর মান হত প্রায় সবই একইরকম। তাই প্রথমদিকে সকলের কবিতাই পড়লে একই মানুষ লিখেছে বলে মনে হত। পরে ওরা সেই কবিতাকল যন্ত্রটাকে আরও উন্নত করেছে। এখন আলাদা আলাদা যন্ত্রে আলাদা টাইপের, আলাদা ধরনের লেখা তৈরি হয়। আর সেইসব কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করে ওরা। কেউ এরপর প্রাইজ-টাইজ পেয়ে গেলে সেই প্রাইজের টাকা কাজে লাগিয়ে নিজেদের যন্ত্রকে বারবার আপডেট করে নেয়। তাহলে আরও ভালো মানের কবিতা তারা প্রকাশ করতে পারে। তা আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তাহলে তোমাদের ওখানে তো যার যত টাকা, সে তত ভালো মানের যন্ত্র কিনে ততই ভালো ভালো কবিতা লিখে ভালো ভালো পুরস্কার সব বাগিয়ে নেবে!’ শুনে সে হেসে বলল যে, না, সেটা হওয়ার উপায় নেই, কারণ ওদের গ্রহে ছোটো থেকে সরকারিভাবে ঠিক করে দেওয়া হয়, কে বড়ো হয়ে কবি হবে, কে ব্যাবসা করবে, কে মাস্টারি করবে, আর কে-ই বা করবে ডাক্তারি। এক পেশার মানুষের অন্য পেশায় যাওয়ার সুযোগই নেই। অবশ্য এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি শুনে। কিন্তু কী আর করা যাবে, যেখানে যেমন নিয়ম।”
পান্নালাল যত শুনছিলেন, ততই অবিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, এইসব আবার হয় নাকি? কিন্তু অবিশ্বাসটা মুখে প্রকাশ করতে পারছেন না, পাছে ভদ্রলোক কাহিনি থামিয়ে দিয়ে রেগে যান। তিনি চুপ করে শুনতে লাগলেন।
বল্লভবাবু বলতে লাগলেন, “এইসব শুনে আমি কন্দর্পের কাছে আবদার করলাম, ওইরকম যন্ত্র আমার দুটো চাই। ইদানীং আমার কবিতা বড়ো একটা কেউ ছাপছে না। যন্ত্রটা পেলে আমার কিছু সুবিধা হতে পারে। কন্দর্প ফিরে গিয়ে আমায় দুটো যন্ত্র পাঠিয়েও দিয়েছে গত পরশু। আমি ভেবেছিলাম, একটা আমার শালা রজনী—ও আমার মতোই কবিতা-টবিতা লেখে, ওকে দেব। কিন্তু ও-ব্যাটা কন্দর্পের আসার কথা বিশ্বাস করেনি বলে পরে রাগে ওকে আর দিইনি। ভালোই হয়েছে, আজ আপনি এসেছেন, আপনাকে একটা কবিতা লেখার কল দেব। জানেন তো, এখন আমি প্রতিরাতে কলের সামনে বসে অন্তত আট থেকে দশটা বিভিন্ন মুডের কবিতা লিখে ফেলি! খুব শিগগিরই আমার এই কবিতাগুলো ছাপাও হতে শুরু করবে খবর পাচ্ছি।”
পান্নালাল এতক্ষণে বুঝলেন, পিনাকী কেন তাঁকে এখানে আসার জন্য এত পীড়াপীড়ি করছিল। নাহ্, যতটা তিনি আসবার আগে খারাপ খারাপ সম্ভাবনার কথা ভেবে এসেছিলেন, ততটা খারাপ পরিস্থিতি নয়। এসে তাঁর লাভই হয়েছে। এইরকম একটা কল পেলে তাঁর লেখালিখি তো মাত্রাছাড়া রকমের গতিতে ছুটবে। ভাগনের জন্য এতদিনে প্রথম তিনি গর্বিত বোধ করলেন।
বল্লভবাবু উঠে গেলেন ‘দাঁড়ান, আপনাকে জিনিসটা এনে দেখাই’ এই কথা বলে। আর সেই সময় সামনের খোলা দরজায় এসে দাঁড়াল এক যুবক। তাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল, “বল্লভবাবু কোথায় গেলেন? আর আপনারা কারা?”
পিনাকী বলল, “উনি তো একটু ভিতরে গেলেন। আমরা ওঁর কাছেই এসেছি। উনি আমাদের একটা বিশেষ জিনিস… উহহহ!”
পান্নালাল পাশে বসা পিনাকীর পায়ে চিমটি কাটতে সে চুপ করল। কবিতা লেখার কলের কথা আবার বলে বসলে মুশকিল হয়ে যাবে, সকলে দেখতে আসতে চাইবে তখন।
ছেলেটি হেসে বলল, “ও বুঝেছি, উনি সেই কবিতা লেখার কল আনতে গিয়েছেন, তাই তো? আপনারা জানেন না, উনি গত তিনদিনে অন্তত সাত থেকে আটজনকে ওই কল দেখিয়েছেন।”
পান্নালাল চমকে উঠলেন মারাত্মক। মানে? বল্লভবাবু এর মধ্যে সাত-আটজনকে দেখিয়ে ফেলেছেন? ওহ্ হো, ব্যাপারটা আর তাহলে তো চাপা রইলই না। এবার কী হবে? সকলে জেনে গেলে তো তাঁদের কবিতা ছাপাই বন্ধ হয়ে যাবে।
ছেলেটি ভিতরে এসে বলল, “কল দেখতে এসেছেন যখন দেখেই যান কীভাবে একটা প্লাস্টিকের বাক্সকে কল বানিয়ে উনি গত তিনদিন ধরেই সবাইকে দেখাচ্ছেন। তবে একটু বাদে ওঁর সঙ্গে আবার মাঠে ওই আজব অন্য গ্রহের প্রাণীটিকে দেখতে যাবেন না যেন। পরশু তো এক কবিকে উনি মাঠে নিয়ে গিয়ে গলা চেপে প্রায় মেরেই ফেলতে যাচ্ছিলেন। নেহাত ঠিক সময়ে প্রলয়দা এসে পড়ায়… তা সে কই, দেখছি না তো!”
পিনাকী বলল, “প্রলয় আসছে একটু পরে। আমরা আগে চলে এসেছি।”
“ও, তবে ঠিক আছে। আসলে বল্লভদা যে এইভাবে পাগল হয়ে যাবেন…”
পান্নালাল তাকে থামিয়ে বলে উঠলেন, “পাগল মানে? সুস্থ লোককে তুমি পাগল বানিয়ে দিচ্ছ? আচ্ছা মানুষ তো তুমি! উনি আমাদের কত যত্ন করে খেতে দিলেন, সেই আজব প্রাণীটার কথা শোনালেন…”
ছেলেটি তাঁর কথা থামিয়ে বলে উঠল, “সে কি, আপনারা জানেন না? শোনেননি কিছু? প্রলয়দা কিচ্ছু বলেনি আপনাদের? আরে এই গত সপ্তাতেই তো কে এক পত্রিকার সম্পাদক ওঁকে চিঠি দিয়ে জানান যে ওঁর এক কবিতার বই এবারে কী এক পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল, সেটা বিশেষ কারণে পাবে না। সেই চিঠি, তাতে আর কীসব লেখা ছিল জানি না, সেটা পেয়েই উনি আস্তে আস্তে পাগল হয়ে যান। তবে কবি মানুষ তো, তাই ওঁর পাগলামিটাও একটু অন্যরকমের। রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে করছেন, শুধু সকাল আর বিকেল বাড়িতে কবিদের ফোন করে ডাকছেন, আর ওই উদ্ভট গল্প শোনাচ্ছেন। কী নাকি এক অন্য গ্রহের প্রাণী ওঁকে কবিতা লেখার কল দিয়ে গিয়েছে। কাউকে কাউকে আবার আক্রমণও করছেন। কবিরাও সেরকম, ফিরে গিয়ে কাউকে জানাচ্ছেও না ওঁর কথা। সবাই বেশ মজা পাচ্ছে বোধহয়। আমরা পাড়ার ছেলেরা মাঝেমধ্যে সময় পেলে একটু নজরে রাখি। ডাক্তারও দেখিয়েছি বটে, তবে শুনছি কলকাতায় না নিয়ে গেলে ওঁকে সুস্থ করা যাবে না। প্রলয়দা ওঁর দেখাশোনা করে, আমরাও মাঝেমধ্যে আসি।”
পান্নালাল ভাগনের দিকে তাকালেন। দেখলেন, সে মুচকি মুচকি হাসছে। ব্যাটা তার মানে সব জানত!
পাঁচ
নাহ্, পান্নালাল কবিতা লেখা ছেড়েই দিয়েছেন বল্লভবাবুর পরিণতি দেখার পর। তিনি এখন মাছচাষ বিষয়ক কয়েকটি বই কিনেছেন, খুব শিগগিরই মাছ চাষে নেমে পড়বেন। পিনাকী মামার এই উদ্যোগে পাশে থাকবে বলে জানিয়েছে। তাতে পান্নালাল যে বিশেষ আনন্দিত হয়েছেন, এমনটা মোটেই নয়। তিনি যথেষ্টই উদ্বেগে আছেন।
শীর্ষচিত্রঃ স্বীকৃতি ব্যানার্জি