গল্প মাখনলালের খাঁড়া আর মরকত মণি অপর্ণা গাঙ্গুলী শীত ২০১৯

অপর্ণা গাঙ্গুলীর আরো গল্প- ছেলে আর দয়ালু কুমির   বোতলের ভূতুয়া    কেজো ভূতের গল্প,  রাক্ষসের বন্ধুরা, মাখনলালের ম্যাজিক ডায়েরি

মাখনলালের খাঁড়া আর মরকত মণি

অপর্ণা গাঙ্গুলী

ক চ ট ত পের কথা

পালকের এখন একটা অদ্ভুত রোগ হয়েছে। তোমাদের কাছেই বলছি, ওকে বলে দিও না যেন। বলছি, কারণ চিন্তায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি ওকে দেখে শুনে। হয়েছে কী, পালক প্রায়ই আজকাল ওর দিদিমশাইয়ের ওই পেল্লায় বেলজিয়াম কাচের আয়নার ভেতরটায় ঢুকে পড়তে চেষ্টা করছে। আয়নার ভেতরে নাকি এক আজব দুনিয়া। আমাকেও একদিন নিয়ে যাবে বলেছে, আর সেই ভেবেই আমার হাত-পা পেটের ভেতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বলেছে যখন, তখন আমাকে নেবেই, কারণ ও ঐরকমই। ভারি জেদি আর একগুঁয়ে। আর মাখনলালের ডায়েরি হাতে পাবার পর থেকে ও এমন অদ্ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে যে আমি, ক চ ট ত প, ওর এতদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং সহচর ওকে কেমন চিনে উঠতে পারছি না।

মাখনলাল হল গিয়ে ওর দাদুর দাদু যিনি ছিলেন এক অত্যাশ্চর্য জাদুকর। এক ভয়ংকর ঘটনার মধ্যে দিয়ে ওই ম্যাজিক ডায়েরি পালকের হাতে এসে পড়ায়, আমার বিশ্বাস, ওর মধ্যে এক ভয়ংকরী শক্তি বাসা বেঁধেছে। আর তার ফলে ও যে তিলকে তাল বানিয়ে ফেলছে, তা, যে না দেখেছে সে বিশ্বাস করবে না। মুশকিলের কথা, ও আর আমি ছাড়া ওই ম্যাজিক ডায়েরির কথা কেউ জানে না। আর জানে হরিমতী বিড়ালনি, পালকের আদুরে-গোবরে এক বোম্বা সাইজের সাদা মিনি বেড়াল যার একমাত্র কাজ মাছটুকু দুধটুকু খাওয়া আর ঘুমিয়ে কাটানো। তা আমাদের নিয়ে পালকের ভয় নেই, কেননা, আমরা তো আর মানুষের মতো কথা বলতে পারি না। তবে পালক আমাদের কথা সব বুঝতে পারে, কারণ, ওই যে বললাম না ওই মেয়ের এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। ও তাই আমাদের সঙ্গে আমাদের ভাষায় কথা-টথা বলে আর আমরা সব দিব্য বুঝেসুঝে যাই।

তা এখন যা বলছিলাম। পালকের দিদিমশাই ওকে বারংবার বারণ করা সত্ত্বেও কেন যে দিদিমশাইয়ের বাবার দেওয়া ওই বেলজিয়াম কাচের আয়না এমন জবরদস্তভাবে ওর ঘাড়ে চেপে বসল কে জানে। পালকের বয়স এখন তেরো পেরিয়ে চোদ্দ, আর এখনই ওর যত কায়দা কানুন বেড়েছে। এসব আমার জানার কথা নয়, কিন্তু ওর মা আর ঠাকমাকে হরবখত বলতে শুনি কিনা, ‘ওরে মেয়ে, চুল খুলে ছাতে পথে যাস না, উলোতে ধরবে, হুতুমথুমোতে ধরবে, হোনোলুলুতে ধরবে, হোঁদলকুতকুতে ধরবে। তখন বুঝতে পারবি।’ তা সে মেয়ে সেসব বাক্যি কানে নিলে তো। সে দুপুরবেলা চিলেকোঠার ঘরে ওঠে, আয়নার ভেতর ঘপ করে যখন তখন সেঁধিয়ে যায়, সিঁড়ির দেয়ালে লাগানো ছবির ভেতর ঢুকে পড়ে রাজ্যি ঘুরে আসে। আর ফিরে আসার পর ওর ডেমির ঘরের ছোট্ট খুল্লিটাতে ঢুকে পড়ে আমাকে যত্ত রাজ্যের আষাঢ়ে গপ্পো শোনায়। খুব যে আষাঢ়ে তাও ঠিক বলতে পারি না, কারণ, সেইসব গপ্পের ফলাফল যখন হাতেনাতে পাওয়া যায়, অবাক হয়ে যাই। ওই যে যেমন সেই ‘সত্যি বলানো কেক’ বানিয়ে কত্তজনকে সত্যি বলিয়ে ছেড়েছিল! কিন্তু সে তো আরেক কাহিনি, তোমরা পরে জেনে নিও ’খনে। যেদিন ওই আয়নাটা প্রথম পালককে আকৰ্ষণ করেছিল, সেদিনের কথা বলি।

সে ছিল এক ঝড়বাদুলে রাত। পালকদের দাদুদিদুর এই প্রকাণ্ড বাড়িটা পাঁচশো বছরের পুরনো। এই তো সেদিন পালকের বাবা মস্ত ছুটি নিয়ে মিস্ত্রি ডেকে বাড়িটা সারাল। হলে কী হবে, এই বাড়িটার সব জায়গায় একটা খুব পুরনো বাড়ির গন্ধ লেগে থাকে। বিরাট বিরাট কড়িবরগার ছাদ, বিশাল বিশাল জানালা-দরজা, এলাহি ব্যাপার সব। মানদা মাসি, ননী আর কালীচরণ সবাই এ-বাড়ির পুরনো লোকজন। তারা প্রায়ই বলে, ‘এ বাড়িতে যত না বেশি জানালা-দরজা খোলে সক্কালে, সাঁঝের বেলায় তার চেয়ে অনেক বেশি জানালা-দরজা বন্ধ করতে করতে পরাণ যায়।’ কী জানি বাপু, সারাদিনে কত্ত নতুন জানালা-দরজা গজায় এই বাড়িতে। এই বাড়িতে হাওয়ায় হাওয়ায় কথা হয়, তাই সারাদিন ফিসফিস গুজগুজ শোনা যায় এধারে ওধারে। দিদিমশাই বলেন, ‘ও অজানারা কথা কইছে, ওতে সব কান দিও না। ওরা বিরক্ত হয়।’ তা সেই ঝড়বাদুলে রাতে পালক আর আমি দিদিমশাইয়ের ঘরে। রাতে আমরা এখানেই থাকি। দিদিমশাই ঘুমুলে পালক মন্ত্র পড়ে আমাকে ডেকে নেয়—

রিন টিন সিন
ক চ ট ত প কিম?
আয় খাটে আয়…
দিদিমশাই ঘুমায়
ইউ আর নেভার টু বি সিন।

তখন আমি টুপটুপ করে ওই দশাসই পালঙ্কের সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়ে পালকের বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ি। তখন আমাদের কানে কানে কথা হয়। পালক এই অন্যরকম ভাষার নাম দিয়েছে ‘গজডদপ’, আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে। এই নাম সে স্বপ্নে পেয়েছে। পালকের একটা স্বপ্নের খাতা আছে। প্রতিরাতের স্বপ্ন ও লিখে রাখে সেখানে। স্কুলে ন্যারেটিভ রাইটিংয়ের ক্লাসে সেসব নাকি বহুত কাজে লাগে।

যাক গে, সেই ঝড়বাদুলে রাতে আমার চোখটা সবে একটু লেগেছে, দেখি পালক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের নীল আলোয় দেখছি দিদিমশাই ঘুমে অচেতন। পালক ওর গোলাপি রাতপোশাক পরে কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে। যেন ও এইখানেই নেই, যেন ওকে পরিতে পেয়েছে, জিনে পেয়েছে। আমি নিশ্চুপ হয়ে দেখতে থাকি। ও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আয়নার দিকে আর ঠিক তখনি ও যেন আয়নার মধ্যে ঢুকে পড়তে যাচ্ছে। আমি ‘পালককককককক’ বলে চিল-চিৎকার পাড়ি। আর পালক ছিটকে বেরিয়ে আসে আয়না থেকে। এরপর ও এক লাফে খাটে উঠে আসে। ফিসফিসিয়ে অথচ ধমক দিয়ে বলে, “তোমার কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই? ওই অবস্থায় আমাকে ডাকতে হয়? বেশ ঢুকে পড়েছিলাম আয়নার ভেতরে, শুধুমুদু সবকিছুর বারোটা বাজিয়ে ছাড়লে!”

আমার গলা দিদিমশাই পায় না। আমি যে এক মনগড়া, অদ্ভুতুড়ে ম্যাজিকাল জীব, তাই। পালক যখন সবে-সবে বুঝতে শিখেছে তখন থেকে ওর বন্ধু আমি। পালকের এইসব বকুনিতে আমার ঢের অভ্যাস আছে। তাই মুখে কিছু বলি না। এরপর আমি আর পালক দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়ি।

ওই বেলজিয়াম আয়নায় ঢোকার কারসাজি পালক কোত্থেকে আয়ত্ত্ব করল? এর মূলেও ওই মাখনলালের ম্যাজিক ডায়েরি নয় তো?

পালকের কথা

সেদিন দুপুরে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেছে। দাদুর দাদু মাখনলালের ম্যাজিক ডায়েরি হাতে পাবার পর আমার জীবনটাই কেমন বদলে গেছে, সত্যি বলছি তোমাদের। এর মধ্যে স্বপ্নে দেখেছি মাখনলালের খাঁড়া, যার উল্লেখ ডায়েরিতেও আছে। আয়নার ভেতর নাকি তার সমাধান রয়েছে। তাই না জানতে পারা অবধি স্বস্তি পাচ্ছি না। আর তাই যেদিন ম্যাজিক ডায়েরির পাতা আয়নার ম্যাজিকে খুলে গেছে সেদিন থেকে স্থির থাকতে পারছি না। ডায়েরিতে লেখা আছে—

যদি আয়নার ভেতরের সন্ধান চাও,
তবে ধাঁ করে আয়নাতে সোজা ঢুকে যাও।
পাবে সিধে এক রাস্তা, তারই বাঁয়ে
যেদিকে দু’চোখ যায়, আলতো পায়ে
গিয়ে পড়বে মন্ত্র জোরে, হট্টিনটর
হয়ূনহুম! দেখো ফুসমন্তর।
ব্যস ঐটুকুই।

আমি ম্যাজিকটা মাথায় আওড়ে আওড়ে নিজের করে নিয়েছি। ঠিক যেমন ইংরিজির দিদিমণি বলেন, ‘নতুন কোনও শব্দ পেলে তার মানে-বানান-উচ্চারণ-বাক্যরচনা-উৎস সবকিছু মাথার মধ্যে আওড়ে আওড়ে আপন করে নেবে যতক্ষণ না শব্দটা তোমার পোষা হয়ে যায়। ব্যস, তারপর আর কী, দেখবে শব্দ তোমার কাজ করে দেবে, তোমার হয়ে কথা বলবে।’

মন্ত্রটা যতবার আওড়াচ্ছি মাথার মধ্যে, যেন এক এক করে অনেক কিছু আমার চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে। আমি আপন মনে কথা বলছি দেখে মা আমাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছেন, বাবা, দিদিমশাই, দাদামশাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করছেন। আমি মনে মনে হাসি। আরও কত কী আমার ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে যে মা ভয় পাবেন, কে জানে। এমনিতে আমি একজন স্লিপ ওয়াকার, ঘুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করি। ডাক্তারজেঠু বলেছেন, এসব বড়ো হলেই সেরে যাবে। তবুও বাবা-মা ভয়ে থাকেন। আমাকে কাছে নিয়ে শুতে চান, কিন্তু আমি দিদিমশাইয়ের কাছেই শোব। কারণ, ওই সিঁড়ি দেওয়া উঁচু পালঙ্কে শুলে আমি রোজ দারুণ সব স্বপ্ন দেখি। নিচু খাটে শুলে সেসব স্বপ্ন আসে না।

তো কী হল, সেইদিন দুপুরে সুযোগ ঘটে গেল। রাঙাপি আর ভালোপি এসেছে বাড়িতে। আমার পিসিমারা। ওদের ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে গেছে, কলেজ-অফিস করে এখন, তাই দুই বোনে মায়ের কাছে চলে আসে মাঝেসাঝে। সেদিন দিদিমশাই বলল, “পালক সোনা, তুমি আজ দুপুরে এই ঘরে চুপটি করে ঘুমোও, কেমন? আমরা মায়ের দক্ষিণের বড়ো ঘরে বসে গপ্পোগাছা করি। বড়োদের কথায় তুমি নাই বা থাকলে। অভিমান কোরো না যেন।”

আগে হলে করতাম, তবে আজ নয়। আজ আমার ভালোই হল। আর ওদের বড়োদের কথা যে কী আমি জানি। রাঙাপির বড়ো ছেলে মানে টুবাইদাদার বিয়ে। আর সে নিজে মেয়ে পছন্দ করেছে, তারই সাত-সতেরো আলোচনা। বড়োদের এমন সোজা জিনিস জটিল করে ফেলার কাণ্ডকারখানা না! আমার দেখেশুনে হাসি পায়। আমি মুখে বলি, “হ্যাঁ গো দিদিমহাশয়া (নতুন শেখা শব্দ), তোমরা গপ্পো করে গে, আমি একটুক্ষণ ছবি এঁকেই ঘুমোব, কেমন?”

দিদিমশাইয়ের গোলগাল ফর্সা মুখটা খুশি খুশি হয়ে উঠল। মায়ের দিকে চোখ ঠেরে দিদিমশাই বলল, “ওগো বৌমা, মেয়ে আমাদের বড়ো হয়ে গেল গো। সব বোঝে।”

আমি বেলজিয়াম কাচের আয়নায় নিজের দিকে নিজে চোখ টিপলাম। এটা নতুন শিখেছি। ইস্কুলে নতুন আসা মেয়ে কমলিনীর থেকে। মাকে বলতে মা আঁতকে উঠেছে। শুধু মুখে বলেছে, “যার যা ভালো, তাই নিও। ওসব ভালো নয়। ওসব শিখো-টিখো না।”

সরি মা, কিন্তু এখন তো কেউ দেখছে না, তাই ইটস ওকে।

ঠিক দুপুরবেলা। মা, দিদিমশাই, পি’রা দক্ষিণের ঘরে। হরিমতীও দিদিমশাইয়ের কোলের কাছে ঘুমুতে গেছে। আমি দিদিমশাইয়ের খাটের ওপর বসে চিলেকোঠার গপ্পো নিয়ে ছবি আঁকছি আর ক চ ট ত প আমার ঘাড়ের ওপর বসে আঁকাজোকা দেখছে। এমন সময় হঠাৎ ম্যাজিকের ডায়েরি খুলে গেল ওই আয়নার মন্ত্রের পাতায়। এইসব জাদুর চিহ্ন, হঠাৎ করে কোনও পাতায় ডায়েরি খুলে যাওয়ার মানে আমার বোঝা হয়ে গেছে আগেই। আজই সেই দিন। ভাবতেই বুকের ভেতর বুম্বুটি বুম্বুটি ব্যাং ব্যাং ব্যাং। অগত্যা পালঙ্ক থেকে লাফ দিয়ে নামলাম। পরে নিলাম নীল জিন্স আর পোলোনেক টি-শার্ট। ক চ ট ত প আর থাকতে না পেরে বলল, “কোথায় চললে?”

আমি হাত নেড়ে বললাম,
“টা টা বাই বাই,
ক চ ট ত প-এর জুড়ি নাই,
সেঁধোও গিয়ে খাটের তলায়,
ফিরব দেখো সন্ধেবেলায়।”

আয়নায় ঢুকে পড়বার মন্ত্র বলতেই চিচিং ফাঁক। ওই তো রাস্তা। ব্যস, দড়াম করে পড়লাম ঢুকে। কী হয় না হয়, তাই এবারে কচুকে নিলাম না সঙ্গে। ফিরতে পারব তো?

লেখকের কথা

সাহসী মেয়ে বটে আমাদের ওই পালক। শুধু মাথায় সবসময় ম্যাজিক ঘোরে এই যা। তা এসব জিনবাহিত, মানে ওর দাদুর দাদু ম্যাজিশিয়ান ছিলেন কিনা। ইলুশনিস্টও বলতে পার। পালকও অমন কত ইলুশন তৈরি করে বাহবা পায়। তা বলে, ওর কিন্তু একটুকুও গুমোর নেই যাই বলো। আসলে মেয়েটার সিক্সথ সেন্স ভারি ভালো কাজ করে। এই তো যেমন সেদিনই পালকের অঙ্কের ক্লাস চলছে। টিচার বোর্ডে টাইম অ্যান্ড ডিসটেন্স বোঝাচ্ছেন, কিন্তু পালকের মন চলে গেছে ম্যাজিকে। ও ভাবছে, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ডাইমেনশন নিয়ে তো স্পেস আর তারপর চতুর্থ এক ডাইমেনশন হল টাইম। তাই এখন ডাইমেনশন বলতে গেলেই টাইম অ্যান্ড স্পেস বলা হয়। পালক তার ছোট্ট ট্যাবে এইসব নিয়ে অনেক পড়াশোনা করে। কিন্তু তারও পরে যদি কিছু থেকে থাকে, কোনও পঞ্চম ডাইমেনশন, তার খবর কে রাখে? বলতে-বলতেই পালকের কী হল, পালক দেখতে পেল ওর মা রিক্সা করে কোথায় যেতে যেতে হঠাৎ রিক্সাটা উলটে যাচ্ছে। কী বেয়াদব লোকটা, তালকানা একেই বলে হয়তো। ফট করে একটা অটোতে গিয়ে ধাক্কা মারল আর মায়ের রিক্সাটা উলটে যাচ্ছে! গাড়িগুলো ভাগ্যিস সিগনালে দাঁড়িয়েছে, না হলে কী হত বলা যায় না। মা বেশ সামলে নিয়েছে, মানে প্রাণপণে মা রিক্সার হাতল চেপে ধরে রেখেছে হাতে। আর পালক যেন উড়ে গিয়ে মায়ের মাথার তলায় হাত রাখল। আর ব্যস, একেবারেই বেশি লাগল না মায়ের। এটা কেন দেখল, ভেবে পেল না পালক। মনখারাপ হয়ে গেল।

সেদিন বাড়ি ফিরে দেখল, মা বেশ আছে, বেরোয়ইনি। তো পালক ব্যাপারটা ভুলে গেল। কিন্তু তার তিনদিন পর মা ঠিক রিক্সায় ঐভাবেই উলটেছিল। ঐভাবেই। আর মা বলেছিল, মা যখন উলটে পড়ে যাচ্ছে তখন কে যেন মায়ের মাথার তলায় হাত রেখে মাথাটা বাঁচিয়ে দিল।

যাক গে সেসব। পালক জানে, ও একজন টাইম ট্রাভেলার। তবে এসব কথা ও কাউকেই বলে না, বলতে নেই বলেই। চুপ থাকে।

আয়নার ভেতরে যে মায়ারাজ্য আছে পালক তা জানতে পেরেছিল। মাটিতে পা রাখতেই পালক দেখতে পেল সবটাই যেন বাতাস বাতাস, সলিড মাটি নয়। তবুও সে অমনভাবেই ভেসে চলল, প্রথমে বাঁয়ে, তারপর সোজাসুজি, মন্ত্রে যেমন শিখেছে। আরও একটা স্পেল সে শিখে এসেছে, দরকার হলে কাজে লাগাবে আরকি।

হাঁটতে হাঁটতে পালকের মনে হতে লাগল ও স্বর্গে পৌঁছে গেছে। কেমনতর সব গাছগাছড়া আর জন্তুজানোয়ার চারদিক। পালক অনেক ভেবে বুঝতে চেষ্টা করল কী সেসব গাছ, জন্তুগুলোই বা কারা সব। ওর বোধ যেন কেমন চলে গেছে। চারদিকে ওই মায়াবী গাছপালার গন্ধে ওর ভারি ভালো লাগতে লাগল। অনুভবে বুঝল, অদ্ভুত সব মানুষের আকারের কারা যেন এই গাছ থেকে, ওই ঝোঁপ থেকে পালককে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে লাগল। কিন্তু পালক একেবারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আয়নার ভেতরের রহস্য তাকে খুঁজে পেতেই হবে। তাই সে গনগন, হনহন, মসমস, খসখস করে এগিয়ে যেতে লাগল।

খানিকটা পথ যেতে যেতে পালক লক্ষ করল ওর পিছে পিছে প্রায় সাত-আটজন বামনজাতীয় জীব চলেছে। পালককে কোনও বিরক্ত না করে ওরা অনুসরণ করছে ওকে। পালক ঘুরে দাঁড়াল। আর তখনি প্রথম বামনটা পালককে এগিয়ে দিল একটা লাঠি। পালক তো অবাক। “থ্যাঙ্ক ইউ” বলে হাত বাড়িয়ে লাঠিটা নিয়েই পালক বুঝতে পারল ওটা কী। জাদুদণ্ড। ব্যস, এইটারই যা অভাব ছিল পালকের। বামন বলল, “আমরা জাদুকরী হারিকিরির অনুচর। আপনাকে উনি এটা পাঠিয়ে দিলেন।” বলেই ঘুরে ঘুরে সেই অদ্ভুতুড়ে, আদরকাড়া বামনের দল নাচতে লাগল আর বলতে লাগল,

“মেফিস্কস ক্যালেকটিস
পালক পেল জাদুর স্টিক
হজেনগেট, টোজেনট্যান
সামলে রেখো দণ্ড খান
‘হউনথাম’ এটাই স্পেল
উধাও হয়ে দেখাও খেল।”
পালক জাদুদণ্ডটি তিনবার ওর মাথার ওপর ঘোরাতেই চমৎকার হল।
হটিনটটহয়ূনহ্যামমেফিস্কসটোযেনট্যানহুলিবিলিমেফিস্টোফিলিসইয়াকিয়াক
যাহ্‌! এক্কেবারে উধাও হয়ে গেল পালক।

পালকের কথা

আমি আছি অথচ নেই। এ কী! ভারি মজা তো! মনে মনে হারিকিরি জাদুকরীকে মেনি মেনি থ্যাঙ্কস জানাই। আমি খুব হালকা হয়ে গেছি। কিন্তু আমি অদৃশ্য। কারণ, বামনগুলো আগুপিছু করতে গিয়ে দেখছে না আমাকে, আমার গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে। শেষকালে সবথেকে বড়ো যে বামন, যাকে আমি মনে মনে নাম দিয়েছি জম্বুক, সে আমার নাম ধরে একটা হিলহিলে গলায় চেঁচাতে লাগল। সে যা রাম চেঁচানি! হারিকিরি ওদের আমার নাম বলে দিয়েছেন। তাই ‘পালক, ও পালক, ও পালক, ও ও ও ও ও ও ও পালক গো’ বলে এমন তিমিঙ্গিল সে চেঁচানি যে আমি সাড়া দিতে বাধ্য হলাম। বললাম, “উফ্‌, কী যে করো তোমরা, এই তো আমি!”

ওরা বলল, “প্রকাশ হও, প্রকাশ হও, প্রকাশ হও।”

আমি আগেই মাখনলালের ম্যাজিক ডায়েরিতে শিখেছি প্রকাশ হওয়া। তাই মাথার ওপর তিনবার ওয়ান্ড ঘুরিয়ে ওই হুলিবিলিমেফিস্টোফিলিস জাতীয় মন্ত্র পড়ে প্রকাশ হলাম। আবার একদফা নাচাগানা শুরু হয়ে গেল।

এমন সময়ে কিছু দূরে একটা আলো জ্বলতে দেখে আমি থমকে থেমে গেলাম। দূরে অনেক মশাল জ্বলছে। আর দৈত্যের মতো চেহারার কারা যেন মশাল হাতে এগিয়ে চলেছে উত্তরদিকে। আমরা দক্ষিণদিক থেকে আসছি। আমি বললাম “ওরা কারা?”

জম্বুকের কোনও সাড়া নেই। পেছনে তাকিয়ে দেখি, কেউ নেই আমার পেছনে। জাদুদণ্ড দেবার কাজটুকু করেই ওরা ভ্যানিশ। তাই তো! আমি এখন কী করি? মনের ভেতর থেকে ভসভসিয়ে কথাগুলো উঠে এল

মাখনলালের আজব ডেরায়
ডাকাত রাজা দেয় পাহারা
চাও যদি মরকত মণি
ওদিক পানে যাও এখনই।

তার আগে মনে হল, মন্ত্র যখন আছেই আর জাদুদণ্ডও, তখন অদৃশ্য হয়েই নেওয়া যাক। যেই বলা, সেই কাজ।

তিনবার মাথার ওপর,
বাই বাই সাই সাই
আমি ভাই আর নাই

এরপর আলতো পায়ে পৌঁছে গেলাম সেই ডেরায়। গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে দেখি, দৈত্য নয়, ডাকাতের দল এক ভাঙা প্রাসাদের দিকে রণ-পা লাগিয়ে এগোচ্ছে। আমি ‘বাংলার ডাকাত’ পড়েছি। বাবার কিনে দেওয়া। তাই ডাকাতরা তাড়াতাড়ি পালানোর জন্যে রণ-পা ব্যবহার করে জানাই ছিল। ইংরিজিতে বলে স্টিল্ট ওয়াকিং। আমাদের টাইম ট্র্যাভেলও তো মনে মনে স্টিল্ট লাগিয়ে হাঁটা, কখনও সামনে কখনও পেছনে, খুব তাড়াতাড়ি। আসল কথা, প্রাসাদের হলঘরে ঢুকেই টের পাওয়া গেল। যা দেখলাম তাতে আর একটু হলেই চিৎকার করে ফেলতাম আর কী। খুব জোর সামলে নিয়েছি। বাড়ির পুরনো ছবিতে দেখা দাদুর দাদু মাখনলাল এক অদ্ভুত সিংহাসনে বসে আছেন। লম্বা সাদা চুল আর ইয়া এক সাদা গোঁফ বুক অবধি ঝুলছে। তাঁর চারপাশে অনেক লোকজন। মনে হল ওঁর ম্যাজিকের স্তাবকের দল। তা হতেই পারে, মস্ত মাপের ম্যাজিশিয়ান উনি। ওঁর গলায় এক মরকত মণি, যা ডাকাতরা হরণ করতে এসেছে। মণিটি খুবই দুষ্প্রাপ্য মনে হল। তার ওপর মশালের আলো পড়ে এমন এক মায়াময় সবুজ রঙ বেরুচ্ছে যেন মনে হচ্ছে ইন্দ্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। আমি থামের পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে চোখের সামনে সিনেমা দেখছি। আমি অদৃশ্য, কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু মাখনলাল এদিকেই বারবার তাকাচ্ছেন। আচ্ছা বিপদ তো! এদিকে ডাকাতের রাজা ওঁর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, মরকত মণি ছিনিয়ে নিল বলে। আই বাপস! এমন সময় উনি তেড়েফুঁড়ে হঠাৎ পাশে রাখা একটা ভয়ংকর রকমের খাঁড়া দিয়ে এক কোপ বসাতে গেলেন সেই ডাকাতের রাজার গলায়। জাদুদণ্ড উঁচিয়ে আমি মন্ত্র পড়লাম, “তিষ্ঠ, ইহ তিষ্ঠ।” আর পাথর হয়ে গেলেন মাখনলাল আর ডাকাতসর্দার।
ইতিহাস বদলে গেল।
জাদুদণ্ডের জবাব নেই, জবাব নেই, জবাব নেই।
স্পেল সরিয়ে নিতেই হা হা হা হা হা অট্টহাস্য করে উঠলেন মাখনলাল, আর আমি দেখলাম যেন নাটকের দৃশ্যের মতো ডাকাতের রাজাও হা হা হা হা হা করে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। যাক, মাখনলাল একজন জাদুকর, একজন শিল্পী, উনি কি কাউকে মারতে পারেন?

ততক্ষণে মাখনলাল এসে পৌঁছে গেছেন আমার পাশেই। কানে কানে বলছেন, “কী দিদি, কেমন ভেলকি দেখালে গো? এমনটা তুমিই পারো!”

আমি অদৃশ্য। তাহলে উনি কীভাবে আমার অস্তিত্ব টের পেয়ে গেলেন?

আমার অদৃশ্য হাতে উনি গুঁজে দিলেন কী একটা। তাকিয়ে দেখি সেই মরকত মণিটি!

তারপর?

তারপর যেই মনে ভেবেছি ‘দিদিমশাইয়ের ঘর’, অমনি পৌঁছে গেছি সেখানে। হাতে ধরা জাদুদণ্ড আর মরকত মণি।

ক চ ট ত পে-র কথা

কাল পালকের জন্যে ভেবে ভেবে আমি যখন প্রায় মরেই যেতে বসেছি তখন আচমকা আয়না ফুঁড়ে বেরিয়ে এল ওই মেয়ে। বিকেল পাঁচটা হবে হয়তো। সময়ের জ্ঞান নেই আমার। এসেই হাতের একটা ঝকঝকে পাথর দেখিয়ে আমাকে বলল, “যাও খাটের তলায় তোমার গর্তে রেখে এস এটা। কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়। সময়মতো বের করব।”

তারপরে আমাকে নিয়ে স্রেফ গিয়ে ঢুকল দাদামশাইয়ের ঘরে। আমাকে দাদামশাই দেখতে পান না। কারণ, আমি পালকের মনগড়া। অদৃশ্য। দাদামশাই তখন সবে জুত করে মানদামাসির দেওয়া চায়ে চুমুক দিয়েছেন কি দেননি, পালক দাদুকে বলে বসল, “আচ্ছা দাদামশাই, মাখনলাল যে খাঁড়া দিয়ে ডাকাত মেরেছিলেন সে গপ্পোটা জানো?”

শুনে তো দাদুর নাকে মুখে চা ঢুকে গিয়ে গসাগু লসাগু অবস্থা। সামলে নিয়ে দাদামশাই বললেন, “অ। তা তোমাকে এ গপ্পো কে করলে দিদিভাই?”

পালক বলে উঠল, “আর সেই মরকত মণি? ডাকাত রাজা যেটি চুরি করতে এসেছিল?”

এবার দাদামশাই বিষম গেলেন ভয়ানক। অনেক কষ্টে সামলে-সুমলে দাদামশাই ভয়ংকর বোকা বোকা হাসলেন।

পালক বলল, “কে আবার? তোমার দাদুর সঙ্গে আমার ম্যাজিকাল কনেকশন আছে যে!”

দাদামশাই দুঃখ করে বললেন, “আহা গো, ফ্যামিলি এয়ারলুম ছিল সেই মরকত মণি।”

পালক দাদুর দিকে চোখ টিপে বলল, “চিন্তা নেই, সে আছে। যথাসময়ে পাইবে এখনি।”

অলঙ্করণ: মৌসুমী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

2 thoughts on “গল্প মাখনলালের খাঁড়া আর মরকত মণি অপর্ণা গাঙ্গুলী শীত ২০১৯

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s