গল্প মাম্বোর শুঁড় পিয়ালী গাঙ্গুলি বর্ষা ২০২০

পিয়ালি গাঙ্গুলীর আগের লেখা–  ফোচনের  কীর্তি , ফোচনের আরেক কীর্তি  মিঠে প্রতিশোধ , বেলুন দাদু , দুটি অণুগল্প , নতুন বছর , বাঘমামার বিয়ে            

মাম্বোর শুঁড়

পিয়ালী গাঙ্গুলী

মাম্বোর দু’চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। ক’দিন ধরে না হয় কালারিং বুকের জন্য ঘ্যানঘ্যান করছিল মায়ের কাছে, তাই বলে মা এত জোরে মারবে? ছোট্ট নরম শুঁড়টা প্রায় খসে ঝুলছে। টনটন করে ব্যথা করছে জায়গাটা। কিন্তু ব্যথার জন্য মাম্বো কাঁদছে না। মাম্বো কাঁদছে ভয়ে, দুঃশ্চিন্তায়। ওর শুঁড়টা যদি খসে পড়ে যায়, ও কী করে স্কুলে যাবে? কী করে সবার কাছে মুখ দেখাবে? শুঁড় ছাড়া কি হাতি হয়? সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। হয়তো টিফিন টাইমে বন্ধুরা বোর্ডে ওর ছবিও আঁকবে। উফ্‌, এসব ভেবে মাম্বোর চোখ দিয়ে মোটা মোটা জলের ফোঁটা পড়তে লাগল।

ছেলের অবস্থা দেখে মাম্বোর মায়ের চোখেও জল এল। এত জোরে মারতে উনিও চাননি। মারতে গিয়ে নিজের দাঁত লেগে যে এভাবে ছেলেটার শুঁড়টা কেটে যাবে তা ভাবতে পারেননি। কিন্তু উনি কড়া মা, ছেলের সামনে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করেন না। কোনও কথা না বলে ছেলেকে বগলদাবা করে চললেন ডাক্তারের কাছে। পেডিয়াট্রিকের চেম্বারে বেশ ভিড়। কচিকাঁচাদের নিয়ে বেশিরভাগ মায়েরাই এসেছেন। কেউ বা না বুঝে শুনে উলটোপালটা ঘাসপাতা খেয়ে পেটখারাপ বাধিয়েছে। কোনও-কোনওটা আবার ওস্তাদি করে অচেনা বনে জঙ্গলে ঢুকে শুকনো ডালপালার খোঁচা খেয়ে হাত-পা কেটেকুটে এসেছে। কেউ কেউ আবার মারপিট করে মাথা ফাটিয়েছে।

ক্রমে মাম্বোর পালা এল। ডাক্তারবাবু দেখে গম্ভীর মুখে বললেন, “এ তো সাংঘাতিক অবস্থা! অনেকগুলো সেলাই করতে হবে। তাতেও কাজ না হলে বড়ো অপরেশন করতে হতে পারে।”

শুনে মাম্বোর মায়ের মুখ শুকিয়ে গেল। এদিকে সেলাইয়ের নামে মাম্বো ছুটে পালাতে যায়। তৎক্ষণাৎ ডাক্তারবাবু আর সিস্টার মিলে চেপে ধরে উঁচু টেবিলে শুইয়ে দিলেন মাম্বোকে। ডাক্তারবাবু মাম্বোর মাকেও বললেন সাহায্য করতে। সিস্টার আর মা মিলে মাম্বোকে চেপে ধরে রাখলেন, আর ডাক্তারবাবু শুরু করলেন সেলাই করতে। মাম্বোর করুণ চিৎকারে সারা জঙ্গল কেঁপে উঠল। মাম্বোর মা অনেক চেষ্টা করে চোখের জল ধরে রেখেছেন। মনে মনে নিজেকে দুষছেন। কী এমন হত ছেলেটাকে আরেকটা কালারিং বুক কিনে দিলে? সবাই বলে, কী সুন্দর আঁকে ছেলেটা! কাগজপত্র না পেলে গাছের গুঁড়িতে, নদীর ধারে পাথরের গায়ে কতকিছু এঁকে রাখে। আজকাল তো হাতিদের আঁকা মানুষেরাও তাদের ঘরবাড়িতে সাজিয়ে রাখে।

একঘণ্টা যুদ্ধ করে অবশেষে মাম্বোর শুঁড় জোড়া লাগানো গেল। মাম্বো ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়েছে। ছেলেটাকে দেখে মায়া হচ্ছে। মা মাম্বোকে নিজের পিঠে চড়িয়ে বাড়ি নিয়ে গেলেন। মাম্বোর বাবাও ততক্ষণে বাড়ি ফিরে এসেছেন। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে প্যাট্রোলিংয়ের কাজ করেন মাম্বোর বাবা। খুব দায়িত্বের কাজ। জঙ্গলে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না, কোথাও কোনও চোরাশিকারির দল ঢুকল কি না অথবা গ্রীষ্মকালে জঙ্গলে কোথাও আগুন লাগল কি না সব নজর রাখতে হয়। মাম্বোর মায়ের মনটা খুঁতখুঁত করছে। বাড়ি ফিরেই ছেলেটাকে ব্যানানা শেক করে দিয়েছেন। বড্ড ভালোবাসে ছেলেটা কলা খেতে। টিফিনেও ক’দিন ব্যানানা স্যান্ডউইচ, ব্যানানা পিৎজা এসব করে দেবেন ভেবেছেন।

পরদিন মাম্বোর চিৎকারে ওর মায়ের ঘুম ভাঙল। উঠে দেখেন ছেলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছে।

“কী রে কাঁদছিস কেন, ব্যথা করছে?”

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাম্বো উত্তর দিল, “কত বড়ো বড়ো সেলাইয়ের দাগ, কী বিচ্ছিরি দেখতে লাগছে আমায়। আমার আর জাম্বোদাদা, ডাম্বোদাদার মতো সিনেমা করা হবে না।”

এতক্ষণে বোঝা গেল আসল দুঃখটা কোথায়। মাম্বোর এক জেঠতুতো দাদা জাম্বোকে নিয়ে কয়েকবছর আগে একটা সিনেমা তৈরি হয়েছিল। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল সেই সিনেমা। আর সাম্প্রতিককালে আরেক দাদা ডাম্বোকে নিয়েও একটি সিনেমা তৈরি হয়েছে। সেটিও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। তাই  মাম্বোরও ইচ্ছা ও আরেকটু বড়ো হলে ও-ও সিনেমা করবে।

মাম্বো খুব বনেদি পরিবারের ছেলে। ওর ঠাকুরদাদার ঠাকুরদাদা ছিলেন উলি ম্যামথদের দলপতি। কী বিশাল চেহারা, কী লম্বা লম্বা দাঁত! ওঁর ছবি ওদের ঘরের দেয়ালে টাঙানো আছে। মাম্বো ছোটোবেলা থেকে ওই দাদুর ছবি দেখত আর ভাবত ওর কবে ওরকম চেহারা আর দাঁত হবে। আর এখন এই সেলাই করা শুঁড় নিয়ে ও কী করবে? এইসব মায়ের জন্য। মায়ের ওপর খুব রাগ হচ্ছে, অভিমানও। ইচ্ছা করছে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, অনেক দূরের কোনও জঙ্গলে। মা যেন আর কোনোদিন খুঁজে না পায়। কিন্তু মাকে ছেড়ে বেশিদিন থাকতেও তো পারবে না ও। খিদে পেলে বা ভয় করলে সবচেয়ে আগে তো মায়ের কথাই মনে পড়বে।

অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়েও মাম্বোকে স্কুলে পাঠানো গেল না। যতদিন না স্টিচ কাটা হচ্ছে ততদিন ও স্কুলে যাবে না বলেই দিয়েছে। স্কুলে কেন, মাম্বো তো বাড়ি থেকে বেরোনোই বন্ধ করে দিয়েছে। এতদিন স্কুলে না গেলে পড়াশুনোর কত ক্ষতি হবে তাই ভেবে মাম্বোর মা শঙ্কিত। অবশ্য টিচাররা ই-মেলে অ্যাসাইনমেন্ট পাঠিয়ে দিচ্ছেন আর মাম্বোও সেগুলো কমপ্লিট করে মেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে। মাম্বো পড়াশুনোয় ভালো, তাই মাম্বোর পড়াশুনো নিয়ে ওর বাবা-মাকে বেগ পেতে হয় না।

একদিন মাম্বো বাড়িতে একা। মা-বাবা দু’জনেই কাজে বেরিয়ে গেছেন। মাম্বো ভাবল দেখি নতুন কী হোম-ওয়ার্ক এল। মেল চেক করতে করতে হঠাৎ একজায়গায় গিয়ে মাম্বোর চোখটা আটকে গেল। বিবিসি থেকে ওকে মেল! ব্যাপারটা কী? তাড়াতাড়ি করে মেলটা পড়ে যা বুঝল তা হল এই মাম্বোর আঁকা ছবি দেখে ওঁরা মুগ্ধ। মাম্বো নাকি দারুণ প্রতিভাবান। তাই মাম্বোকে নিয়ে ওঁরা একটা তথ্যচিত্র তৈরি করতে চান।

আগেরদিন থেকে মাম্বোদের বাড়িতে দারুণ তোড়জোড়। মাম্বোর মা অনেক নারকেল আর অন্যান্য ফল পেড়ে এনেছেন। তা দিয়ে নানারকম সুস্বাদু খাবার বানিয়েছেন অতিথিদের জন্য।

পরদিন সকাল-সকালই ওঁরা এসে হাজির হলেন। কত লোক, কত লাইট, ক্যামেরা আরও কত সব সরঞ্জাম! মাম্বোর বন্ধুরা আর অনেক প্ৰতিবেশীও এসে জড়ো হয়েছেন শুটিং দেখতে। মাম্বোর বাবাও আজ কাজে যাননি। কিন্তু এসবের মাঝে নায়ক শ্রীমান মাম্বোর মুখে হাসি নেই। কয়েকদিন আগেই মাম্বোর স্টিচ কাটা হয়ে গেছে। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় সেলাইয়ের দাগ বোঝা যাচ্ছে। মাম্বোর মনটা খুব খারাপ। সারাজীবন ওকে এই দাগ নিয়ে থাকতে হবে। আর ধুত্তোর ডকুমেন্টারি! ক’টা লোক দেখবে? ডাম্বো আর জাম্বোদাদাকে কী সুন্দর দেশসুদ্ধু লোক দেখেছে!

অনেকগুলো ক্যানভাস সাজিয়ে রাখা হয়েছে মাম্বোদের বাড়ির সামনে, খোলা আকাশের নিচে। মাম্বোকে রং, তুলি সব দিয়ে বলা হয়েছে নিজের ইচ্ছামতো ছবি আঁকতে। মাম্বো আঁকছে আর ওঁরা ওর ছবি তুলছেন। তার আগে ওঁরা মাম্বোর আর ওর মা-বাবার ইন্টারভিউ নিয়েছেন। মাম্বোর ছোটোবেলার ছবি, ছোটোবেলা থেকে মাম্বোর আঁকা যেসব ছবি ওর মা সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন, সেসবেরও ছবি তুলেছেন ওঁরা। দিন কয়েক শুটিংয়ের পর ওঁরা ফিরে গেলেন। বলে গেলেন, তথ্যচিত্রের কাজ শেষ হলেই ওঁরা মাম্বোকে ডেকে তা দেখাবেন।

‘মাম্বো দ্য ওয়ান্ডার এলিফ্যান্ট’ নামের বিবিসির ডকুমেন্টারি সারা পৃথিবীতে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে। কোনও হাতি যে মানুষের মতো এত সুন্দর আঁকতে পারে তা দেখে সকলে হতবাক। বিবিসির দেখাদেখি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক আর অ্যানিমেল প্ল্যানেটও মাম্বোকে নিয়ে প্রোগ্রাম করেছে। কাগজেও মাম্বোর ছবি বেরিয়েছে। মাম্বো এখন রীতিমতো তারকা।

মাম্বোর আঁকা ছবি দিয়ে নানান পণ্যসামগ্রী বিক্রি হচ্ছে বাজারে। মাম্বো মার্চেন্ডাইজ। থাইল্যান্ড সরকার তাঁদের এক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে মাম্বোকে আমন্ত্রণ করেছেন। তাঁদের পাঠানো এক সুদৃশ্য জাহাজে চেপে মাম্বো বাবা-মাকে নিয়ে আজ থাইল্যান্ড যাচ্ছে। আজ ও খুব খুশি। কিন্তু একটা কথা কিছুতেই ওর মাথায় ঢুকছে না।

“মা, বিবিসি জানল কী করে যে আমি ছবি আঁকি?”

মা মুখ টিপে হেসে বললেন, “কে জানে বাবা!”

মাম্বোর আঁকাগুলো যে তিনিই বনবিভাগের একজন উচ্চপদস্থ অফিসারকে দেখিয়েছিলেন আর বাকি যোগাযোগটা তিনি করেছেন, সেকথা মাম্বো নাই বা জানল। মায়েরা তো চিরকাল নিঃশব্দেই ভালোবেসে যান।

ছবিঃ স্বীকৃতি ব্যানার্জি

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s