গল্প রহস্যময় সিগন্যাল এবং বুবাই শুভাশিস দাশ বর্ষা ২০২০

শুভাশিস দাশ

বুবাই এখন কেমন জানি আনমনে বসে থাকে পড়ার টেবিলে। টেবিলের পাশের জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। বুবাইর মা মালতীদেবী এটা কিছুদিন ধরে লক্ষ করছেন। ছেলে আবার রহস্য গল্প পড়ে। লেখাপড়াতে বরাবরই ভালো বুবাই, তাই তার গল্পের বই পড়তে কোনও বাধ সাধেন না তাঁরা।

খেতে বসে মালতীদেবী বুবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে বুবাই, সামনে টেস্ট পরীক্ষা অথচ তুই পড়ার টেবিলে বসে একদৃষ্টিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকিস কেন?”

বুবাই হেসে উত্তর দেয়, “কিছু না। খোলা আকাশের দিকে তাকালে মন ভালো থাকে।”

মালতীদেবী বললেন, “কাল যে তোর বন্ধু মৃদুল বলল তুই নাকি মঙ্গলগ্রহের প্রাণীদের ডাক শুনেছিস!”

“দূর! তুমিও পারো! তোমাকে এমনি বলেছে মৃদুল। ওর তো একটু নাড়ুর প্রতি লোভ আছে। কাল নাড়ু বানাবে শুনেছে, ব্যস! আমি ওসব নিয়ে কেন চিন্তা করব বলো তো? সামনে আমার ফাইনালের টেস্ট পরীক্ষা।”

বুবাই ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম, আর পাঁচটি ছেলের মতো নয়।

রাতের খাওয়া শেষ হলে বুবাই ওর পড়ার ঘরে চলে যায়। মালতীদেবী শোবার আগে একবার বুবাইকে দেখে যান। জেগে থাকলে বলেন, ‘ঘুমিয়ে পড়।’

আজও তেমনি এসে বলে গেলেন। মা চলে যেতেই বুবাই পুবদিকের জানালাটা খুলে দিল। নিজের আবিষ্কার করা সিগন্যাল যন্ত্রটি জানালার কাছে রেখে দিল। আজ টিভিতে দেখেছে আবার ভিনগ্রহের প্রাণীরা পৃথিবীতে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে। বছর দুই আগেও এরকম সিগন্যাল এসেছিল ভিনগ্রহ থেকে। এই সিগন্যালকে বলে ‘ফাস্ট রেডিও বাস্টার্স’। ইদানিং বিজ্ঞানীরা এই সিগন্যাল পাচ্ছেন। কানাডার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ভিনগ্রহের এরকম রেডিও সিগন্যাল আসছে পৃথিবীতে। কয়েক যোজন অলোকবর্ষ দূরে থাকা কোনও ছায়াপথ থেকে এই রেডিও সিগন্যাল আসছে ক্রমাগত। মহাকাশে ব্যবহৃত শক্তিশালী টেলিস্কোপে তা ধরা পড়েছে। ওই ছায়াপথে কোনও গ্রহে প্রাণীর অস্তিত্ব আছে বলেও বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।

বুবাই নিজের তৈরি যন্ত্রটি জানালার কাছে রেখে প্রতিদিনের মতো রিমোটটা টিপতেই এক অদ্ভুত সিগন্যাল লক্ষ করল যা সম্পূর্ণ আলাদা।

দু’বার সিগন্যাল এসেই থেমে গেল।

বুবাইর ছোটো থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ। স্কুলের জয়ন্ত-স্যার ওকে উত্সাহ দেন এসব ব্যাপারে। একবার বিজ্ঞান মডেল প্রদর্শনীতে রাজ্যে প্রথম হয়েছিল সে। তারপর থেকে একটি নেশা ওকে পেয়ে বসেছে। সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা, তাই উদ্যমে একটু ভাটা পড়েছিল, কিন্তু গতকালের টিভিতে এই সিগন্যাল রহস্য তাকে আবার জাগিয়ে তুলেছে।

প্রায় ঘণ্টা দুই চুপচাপ। বুবাই ভাবল আজ আর কিছু হবে না। বিছানায় শুয়ে পড়ল, কিন্তু ঘুম আসছে না। দূরের কোথাও রাত দুটো বাজার ঘণ্টা পড়ল। আরেকবার সিগন্যাল যন্ত্রটির দিকে দেখে নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

***

ক্লাসে জয়ন্ত-স্যার বললেন, “কী বুবাই, কিছু পেলে?”

বুবাই বেঞ্চ থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “না স্যার, তবে কাল রাতে দু’বার একটা অন্যরকম আওয়াজ আসছিল। তবে আজকে সিগন্যালের গেইনটা বাড়িয়ে দিতে হবে। মনে হচ্ছে যন্ত্রটি কিছু রিসিভ করতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মহাকাশের টেলিস্কোপের যে পাওয়ার তা তো আর আমি দিতে পারব না, তবে আমি যে সিগন্যাল মিটার করেছি তাতে রিসিভারের পাওয়ারকে আরও দ্বিগুণ করতে হবে।”

জয়ন্ত-স্যার ক্লাসের সবাইকে বললেন, “শোনো, তোমরা জানো কি বুবাই একটি বড়ো আবিষ্কার করতে চলেছে? ভিনগ্রহের প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে ওর একটা কাজ হচ্ছে, হয়টো কিছুদিনের মধ্যে আমরা সেটি দেখতে পারব।”

মৃদুল বলল, “আমি জানি, স্যার!”

টিফিন পিরিয়ডে বন্ধুরা সবাই ওকে ঘিরে ধরল। বলল, “আমাদের একদিন নিয়ে যাবি তোর বাড়িতে, দেখব তোর সিগন্যাল যন্ত্রটির কাজ।”

বুবাই বলল, “আগে সফল হই, তারপর তোদের সবাইকে দেখাব।”

রমেন বলল, “আমাকে তোর অ্যাসিস্ট্যান্ট করবি? আমারও ইচ্ছে রে একটু কিছু করার।”

বুবাই বলল, “তোরা যে কী আরম্ভ করলি!”

স্কুল থেকে মোটামুটি কথাটা চাউর হয়ে গেল।

গোপালপুর থানার ওসি সাহেবের কানে কথাটি গেল। ইতিমধ্যে থানার ওয়ারলেস অপারেট দত্তবাবু ওসি সাহেবকে বলেছেন এই থানার সীমানার মধ্যে একটি গোপন যন্ত্র বসানো আছে যা থেকে মাঝে মাঝে কেমন বিদঘুটে সিগন্যাল আসে। বুবাইর কথাটি কানে যেতেই ওসি সাহেব দত্তবাবুকে ডাকলেন। বললেন, “আপনি সেদিন কী একটা সিগন্যালের কথা বলছিলেন না? আজ খবর পেলুম উকিলপাড়ায় একটি ছেলে কী একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছে ভিনগ্রহে প্রাণী আছে কি না তা বুঝবার জন্য। তা মশায় চলুন তো ছেলেটির বাড়ি।”

থানার গাড়ি ছুটে চলল উকিলপাড়ার উদ্দেশ্যে। গাড়ি গিয়ে থামল উকিলপাড়ার চৌরাস্তার মোড়ে। ওসি সাহেব এক দোকানিকে জিজ্ঞেস করতেই দোকানি বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব চিনি আমাদের ক্ষুদে বিজ্ঞানীগো। আপনি স্যার বাঁহাতের রাস্তা দিয়ে গিয়ে সোজা ছয় নম্বর বাড়িটা।”

দোকানির নির্দেশমতো গাড়ি গিয়ে থামল বুবাইদের বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে ওসি সাহেব গেটের কলিং বেলে চাপ দিলেন। বুবাইর মা এসে গেট খুলতেই চমকে উঠলেন পুলিশ দেখে। বললেন, “কী ব্যাপার?”

“না না, ভয়ের কিছু নেই। আমরা একটু আপনার ছেলের সঙ্গে কথা বলব।”

“আসুন, ভিতরে আসুন।” বলে বুবাইর মা ওঁদের ভিতরে নিয়ে গেলেন।

বুবাই ঘরেই ছিল। ওঁরা সোজা বুবাইর ঘরে গেলেন। সাধারণ ঘর। একটি পড়ার টেবিল আর বিছানা, পাশে একটি কাঠের আলমারি তাও পুরনো আমলের। কিন্তু ঘর দেখে তো মনে হচ্ছে না এই ঘরে কোনও যন্ত্র-টন্ত্র আছে!

ওসি সাহেব এবার বলেই ফেললেন, “তুমি নাকি একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছ?”

বুবাই বলে, “তেমন কিছু নয়। খেলার ছলে একটা সিগন্যাল যন্ত্র করেছি। ওটার গুরুত্ব নেই।”

ওসি সাহেবের পাশে বসা গোপালপুর থানার ওয়ারলেস অপারেটর দত্তবাবু। বললেন, “তুমি তো হাসালে হে ছোকরা! তোমার যন্ত্র থেকে আমাদের থানায় প্রতিদিন সিগন্যাল যায়, তবে সেই সিগন্যালের মানে আমরা বুঝি না। একটু দেখাবে তোমার যন্ত্রটি?”

বুবাই ভয়ে ভয়ে যন্ত্রটি আলমারির ভিতর থেকে নিয়ে এল। ওসি এবং দত্তবাবু সেটি দেখলেন। বললেন, “একটু বুঝিয়ে দাও তো এর ফাংশনটা।”

বুবাই দুয়েকটি সিগন্যাল বুঝিয়ে দিল এবং বলল, “এখনও এর কাজ বাকি আছে।”

বুবাইকে আশ্বস্ত করে ওঁরা চলে গেলেন।

ওঁরা যেতেই মা ঘরে এলেন। বললেন, “তুই কী করছিস, বাবা? একেবারে পুলিশ-টুলিশ সব বাড়ি আসছে!”

“আমি একটা যন্ত্র বানিয়েছি যার মাধ্যমে ভিনগ্রহের প্রাণীর সন্ধান কখনও পাওয়া যেতে পারে। এই যন্ত্র যখন চালু থাকে তখন এর আওতার মধ্যে থাকা কোনও সিগন্যাল টাওয়ারে তা সিগন্যাল দেয়। আমাদের এলাকার থানাটি এই সিগন্যাল যন্ত্রের আওতার মধ্যে পড়ে এবং সেখানে সিগন্যাল দিলে ওঁদের অপারেটর টের পান। তাই তাঁরা এসেছিলেন ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে।”

মালতীদেবী বলেন, “এসব এখন রেখে দে বাবা, আগে মাধ্যমিক পরীক্ষাটা ভালো করে দে।” এই বলে তিনি চলে যান।

রাতে সবাই যখন শুয়ে পড়ল তখন বুবাই ওর কাজ আরম্ভ করল। আজ একটা বিহিত করেই ছাড়ব, নিজের মনেই বলে বসল বুবাই।

সিগন্যালের পাওয়ার বাড়াবার জন্য অনেক কাজ করল। রাত শেষে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

বুবাই দেখল, আজ স্পষ্ট করে দুটো সিগন্যাল আসছে, কী যেন সংকেত দিচ্ছে। এই সংকেত ছোট্ট বুবাই বুঝতে পারে না। কেমন বিদঘুটে সব মুখ ভেসে আসছে সিগন্যাল যন্ত্রের ছোটো স্ক্রিনে। বুবাই আনন্দে চিত্কার করে ওঠে। “পেরেছি! ও মা, আমি পেরেছি! আমাদের পৃথিবীর মতো আরও এরকম গ্রহে প্রাণী আছে। এখনই তারা আমার সঙ্গে কথা বলল।”

বুবাইর চিত্কারে মালতীদেবী ছুটে এসে দেখেন, বুবাই ঘুমোচ্ছে, পাশে যন্ত্র থেকে একটি লাল বাতি জ্বলছে আর নিভে যাচ্ছে।

ভোর হয় হয়। মালতীদেবী ছেলের পাশে বসে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “পাগল ছেলে!”

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

Leave a comment