গল্প রুমমেট রাজকুমার রায়চৌধুরী বসন্ত ২০২০

এক

ভবতারণ ভাদুড়ি একটা সমস্যায় পড়েছেন।

ওঁর কথা সবাই উড়িয়ে দিচ্ছে। উড়িয়ে দেবারই কথা। একটা লোক যদি বলে তার বাড়িতে একটা লোক বাস করছে যার চেহারা ভবতারণবাবু দেখেননি, ছায়া পর্যন্ত না, কোনও কন্ঠস্বর এখনও পর্যন্ত শোনেননি, লোকে তো বলবেই এটা ওর মানসিক বিকার।

ভবতারণবাবু নিতান্তই সাধারণ মধ্যবিত্ত লোক। সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন। সরকারি চাকরি। গেজেটেড অফিসার ছিলেন। ষাট পেরোবার একবছর আগেই স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন। পেনশন ছাড়াও ভালো রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট পেয়েছেন। ঘুরে বেড়ানো, বই পড়া, বিশেষ করে কল্পবিজ্ঞান, ফ্যান্টাসি আর হরর বই পড়তে আর এসব বিষয়ে সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন।

একমাত্র সন্তান মেয়ে বৃষ্টি হায়দ্রাবাদে থাকে। স্ত্রী গতবছর মারা গেছেন। লিভারে ক্যানসার হয়েছিল। ভবতারণ উত্তর কলকাতার এক শহরতলিতে ছোটো একটা বাড়ি কিনেছেন। একতলায় একটা ছোটো ঘর আর রান্নাঘর ছাড়াও একটা হলঘর আছে। দোতলায় দুটি শোবার ঘর। একচিলতে বারান্দা আর ছোটো একটা ড্রইংরুম। এক বন্ধুর বাড়ি ছিল এটা, তাই সস্তায় পেয়েছেন। মেয়ে একা কলকাতায় এলে দোতলায় একটা ঘরে থাকে।

ভবতারণবাবু খুব গোছালো লোক। তিনদিন অন্তর বিছানার চাদর, বালিশ, ঘরের পর্দা পালটান।

উনি মেয়েকে এ বিষয়ে এতদিন কিছু বলেননি।

দুই

বৃষ্টি আজই কলকাতায় এসেছে অফিসের কাজে। দু’দিন থাকবে। বৃষ্টি তো ভবতারণবাবুর সন্দেহ শুনে হেসেই উড়িয়ে দিল। বলল যে দিনরাত ফ্যান্টাসি আর আজগুবি গল্পগুলো যে সব গাঁজাখুরি কল্পবিজ্ঞানের নামে চলছে, ওগুলো পড়ে ওঁর মাথায় এসব ঢুকেছে।

ভবতারণবাবু বললেন যে উনি একটা এইরকম একটা গল্প পড়েছেন সত্যি, কিন্তু সেই গল্পে লোকটা নিজের একটা ডুপ্লিকেটকে নিজের ঘরে দেখতে পেত।

“তুমি তো এসব কিছু দেখনি। কী করে বুঝলে আরেকটা লোক তোমার ঘরে বাস করছে? তুমি তো বাউলদের ওই গানটা শুনেছ, ‘তোমার ঘরে বাস করে কয় জনা’। তুমি তো বলবে দুইজনা।” বৃষ্টি নিজের রসিকতায় নিজেই হাসে।

ভবতারণবাবু বললেন, “শোন, আমার ব্যাপারটা এত সূক্ষ্ম যে কেউ বিশ্বাস করবে না কেন আমার মনে হচ্ছে এই বাড়িতে আরেকজন বাস করছে।”

“কী সূক্ষ্ম ব্যাপার, শুনি?”

“শোন, তুই যে ঘরে আজকে থাকবি, কালই সে ঘরের বিছানার চাদর পালটাতে গিয়ে দেখেছি চাদরটা টান টান নেই। কেউ যেন শুয়েছিল আর উঠে বিছানা গুছিয়েছে। কিন্তু আর আগের অবস্থায় আনতে পারেনি।”

“বাপ রে, আজ আমার বিছানায় আরেকজন শোবে!” বৃষ্টি কপট ভয়ের ভান করে।

“শোন, এটা হাসিঠাট্টার ব্যাপার নয়। তুই বরং আমার ঘরে শো। আমি নিচে শোব।”

“তা না হয় শুলাম। কিন্তু আর কী সূক্ষ্ম ব্যাপার দেখেছ, শুনি?”

“কাল মাঝ রাত্রে উঠে ফ্রিজ থেকে একটা জলের বোতল বার করেছি জল খাব বলে, দেখি বোতলের জলের লেভেল আধ ইঞ্চি কমে গেছে। তুই তো জানিস এ ব্যাপারে আমি কীরকম পিটপিটে। তোর মা কতবার এই নিয়ে আমায় কথা শুনিয়েছে।”

বৃষ্টি এবার হো হো করে হেসে উঠল। “এবার থেকে হোমিওপ্যাথির ঔষধের মতো বোতলে লেবেল মেরে রেখো। সিরিয়াসলি বাবা, তোমার একজন সাইক্রিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত। আমার এক বন্ধুর বাবা ডঃ নবপ্রসাদ নন্দী খুব নামকরা ডাক্তার। আমার মনে হয় তোমার একবার ডঃ নন্দীর কাছে যাওয়া দরকার। বলো তো কালকেই দেখা করার ব্যবস্থা করতে পারি।”

ভবতারণ বৃষ্টির কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মেয়ের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। ওঁর মনে পড়ে গেল বেশ  কিছুদিন আগের কথা। বৃষ্টির তখন বয়স ছয় বছরের মতো। প্রত্যেকদিন রাত্রে বাবা গল্প না বললে মেয়ে ঘুমোবে না। ভবতারণবাবুর স্টকে খুব বেশি গল্প ছিল না। আর ছ’বছরের মেয়ের পড়ার মতো বইও বাড়িতে বেশি ছিল না। উনি প্রত্যেক মাসে বাচ্চাদের জন্য লেখা প্রচুর কমিকস, ফ্যান্টাসি আর ভূতের গল্প কিনে আনতেন। বৃষ্টির সবচেয়ে পছন্দ ছিল টিনটিনের কমিকস। ভবতারণবাবু নিজে বইগুলি পড়ে বৃষ্টি যাতে বুঝতে পারে সেভাবে গল্পগুলি বলতেন। গল্প শুনতে-শুনতেই বৃষ্টি ঘুমিয়ে পড়ত। ওঁর স্ত্রী নন্দিতা বলতেন, আদর দিয়ে দিয়ে উনি বৃষ্টিকে বাঁদর করে তুলছেন। ভবতারণবাবু জানতেন, এসব কথার কথা। নন্দিতা কখনওই যা ভাবেন তা বলতেন না। তিনি আসলে পছন্দই করতেন ভবতারণবাবু রোজ বৃষ্টিকে গল্প শোনান বলে। নন্দিতা গান আর বই, দুটোরই পোকা ছিল।

বৃষ্টি মেধাবী ছাত্রী ছিল। কম্পিউটার সায়েন্সে এম.টেক করে একটা বড়ো আই.টি কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে হায়দ্রাবাদে চলে যায়। ওখানেই ওর সুন্দর বলে একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়। পরে বৃষ্টি বাবা-মার সঙ্গে সুন্দরের পরিচয় করে দেয়। সুন্দরকে ভবতারণবাবু ও নন্দিতার ভালো লাগে। ফলে বৃষ্টির সঙ্গে সুন্দরের বিয়ে হওয়াতে কোনও জটিলতা হয়নি। সুন্দরও কম্পিউটার সায়েন্সে এম.টেক করে। পরে বৃষ্টির কোম্পানিতে কিছুদিন চাকরি করে আমেরিকাতে পি.এইচ.ডি করে একটা বিদেশি ব্যাঙ্কে চাকরি পায়। কিছুদিন ব্যাঙ্গালোরে ছিল, তারপর বৃষ্টির সঙ্গে বিয়ের পর হায়দ্রাবাদের একটা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিতে চাকরি পায়। ওদের কোনও ছেলেমেয়ে এখনও হয়নি। ভবতারণবাবুর আশা, মরবার বেশ কিছুদিন আগেই নাতি-নাতনির  মুখ দেখতে পারবেন।

তিন

ভবতারণবাবুর সন্দেহটা বেশ দানা বেঁধেছে। বৃষ্টি যাবার সময় বাবাকে একটা কিন্ডল দিয়ে গেছে। বেশ কিছু আধিভৌতিক, প্যারানর্মাল, হররের বই বৃষ্টি আপলোড করে দিয়েছিল। এর মধ্যে একটা গল্পের নাম শুনে ভবতারণবাবুর পড়বার ইচ্ছে হল। গল্পটির নাম আ্যবানডনড বা পরিত্যক্ত।

ভবতারণবাবু অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করেন না। নিজে বিজ্ঞানের ভালো ছাত্র ছিলেন। ইচ্ছে ছিল বায়োকেমিস্ট হওয়ার। কিন্তু পারিবারিক অবস্থার জন্য ওঁর একটা চাকরির দরকার ছিল। কেন্দ্রীয় একটি সংস্থাতে সহজেই মোটামুটি একটা ভালো চাকরি পেয়ে যান। কিছুদিন ভূপালে থাকার পর ভুবনেশ্বরে বদলি হন। ভুবনেশ্বরে থাকার সময়ে নন্দিতার সঙ্গে ওঁর বিয়ে হয়। বৃষ্টির জন্মও ভুবনেশ্বরেই হয়। বৃষ্টি উড়িয়া ও তেলেগু ভালোই জানে।

ভবতারণবাবুর বই পড়ার নেশা আছে। নানা বিষয়ের উপর পড়াশুনা করেছেন। তবে হালকা কিছু পড়তে ইচ্ছে করলে রহস্য, রোমাঞ্চ ও অলৌকিক, বিশেষ করে প্যারানর্মাল বিষয়ের উপর লেখা গল্প-উপন্যাস পড়েন। রোল্ড ডাল ও জর্জ সিমেননের লেখা ওঁর খুব পছন্দ। নিছক ভূতের গল্প ওঁর অত ভালো লাগে না। কিন্তু abandoned গল্পটা পড়ে ওঁর মনে হল, লেখায় মুন্সিয়ানা থাকলেও মূলত এটি ভূতের গল্প। ক্যারেলিনা বলে একটি মেয়ে লস এঞ্জেলেসে থাকে। একটা ছোটো কোম্পানিতে কাজ করত। কিন্তু সে ছাঁটাই হয়। যে ফ্ল্যাটে সে থাকত তার ভাড়া না দিতে পারায় ফ্ল্যাট ছাড়তে বাধ্য হয়। ওর এক বন্ধু ওকে একটা খুব সস্তায় থাকার জায়গার সন্ধান দেয়। ক্যারোলিনা ওখানে থাকতে শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারে বাড়িটা ভূতুড়ে। রোজ রাত্রে ও দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করে। প্রচুর লোকজনের আসাযাওয়ার শব্দ, একটি মেয়ের আর্তনাদ। রোজই একই স্বপ্ন দেখে। একদিন ক্যারোলিনা বাড়িটা ছেড়ে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু তখন জানতে পারে, এ-বাড়ি সে কোনওদিন ছেড়ে যেতে পারবে না, কেননা সেও একজন অশরীরী বাড়ির বাসিন্দা হয়ে গেছে।

এরকম একটা গল্প ভবতারণবাবু লিখেছিলেন কলকাতার একটি মেস বাড়ি নিয়ে। কিন্তু ছাপাননি, মনে হয়েছিল যথেষ্ট মৌলিক নয়। অবশ্য ভবতারণবাবুর অভিজ্ঞতার সঙ্গে এইসব গল্পের কোনও সম্পর্ক নেই। ভবতারণবাবু গল্পটা পড়া শেষ করে কিন্ডলটা ওঁর একটা বইয়ের তাকে একশো এক আর একশো দুই নম্বর বইয়ের ফাঁকে রেখে দিয়েছিলেন এটা ওঁর স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু পরদিন কিন্ডলটা খুঁজতে গিয়ে দেখলেন ওটা একশো দশ আর একশো এগারো নং বইয়ের মাঝখানে আছে। ভবতারণবাবু বৃষ্টির কথা ভাবলেন। সত্যিই কি ওঁর ডিমেনশিয়া হয়েছে?

কিন্তু ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস, বাড়িতে আরেকজন বাস করছে। হয়তো তার শারীরিক কোনও উপস্থিতি নেই, কিন্তু মানসিক উপস্থিত আছে। কেউ ওঁর পার্সোনালিটি বদল করার চেষ্টা করছে।

এরপর যা ঘটল তাতে ভবতারণবাবুর সন্দেহ আরও ঘনীভূত হল। উনি একটি অনুষ্ঠানে যাবার জন্য  আলমারি  থেকে  সাদা পাঞ্জাবি বার করেছিলেন। চান করে ফিরে এসে দেখেন বিছানার উপর একটা হলুদ পাঞ্জাবি রাখা। এটা উনি ধরেই নিয়েছিলেন, ওঁরই ভুল, সাদা ভেবে হলুদ পাঞ্জাবিটাই আলমারি থেকে বার করেছিলেন। কিন্তু হলুদ পাঞ্জাবি দেখে হঠাৎ ওঁর শৌভিকের কথা মনে পড়ে গেল। হলুদ রং শৌভিকের খুব প্রিয় ছিল। শৌভিক ছিল ওঁর মামাতো ভাই। ভবতারণবাবুদের ও শৌভিকদের বাড়ি ঘটনাচক্রে একদম পাশাপাশি ছিল। দু’জনে একই সঙ্গে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়তেন। দু’জনে ছিলেন হরিহর আত্মা। অথচ বাইরের দিক থেকে দেখতে গেলে দু’জনে দুটি ভিন্ন চরিত্র। শৌভিক প্রায় সবরকম খেলায় পারদর্শী ছিল। হলিহুডের মারপিটের ছবি দেখতে ভালোবাসত। আর ভবতারণ ছিলেন কিছুটা অন্তর্মুখী। তাস-দাবা খেলতেন, বিদেশি উপন্যাস পড়তেন। ওঁর আরেকটা শখ ছিল থিয়েটার দেখার। শৌভিক ওঁকে জোর করে খেলার মাঠে  নিয়ে যেত। আমেরিকান ডিটেকটিভের গল্গ পড়া, হরর ছবি দেখাও উনি রপ্ত করেছেন শৌভিকের কাছ থেকে। আবার শৌভিককে উনি ধরেবেঁধে থিয়েটার দেখতে নিয়ে যেতেন।

মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় শৌভিকের মৃত্যু হয়। ভবতারণ ও শৌভিক দু’জনেই একই সঙ্গে এক কামরায় ছিলেন। দু’জনেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে হাজারিবাগ গিয়েছিলেন। শৌভিক একটা বিদেশি ব্যাঙ্কে কাজ করত। ওই ব্যাঙ্কের একটা হলিডে হোম আছে হাজারিবাগে। ওঁরা দু’জনে ওখানেই উঠেছিলেন। কয়েকদিন খুব মজাতেই কেটেছিল। ফেরবার সময়ে একজায়গায় ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। পাঁচজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। তার মধ্যে শৌভিক একজন। প্রায় কুড়ি জন গুরুতরভাবে আহত হয়। ভবতারণ গুরুতর আহত হয়ে প্রায় একমাস হাসপাতালে ছিলেন। শৌভিকের মৃত্যু ভবতারণবাবুকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। পরে কলকাতার নাম করা সাইক্রিয়াটিস্ট ডাঃ পরিমল রায়চৌধুরীর চিকিৎসাতে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেন।

শৌভিকের একটা ভালো প্রমোশন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মৃত্যু এসে সব তছনছ করে দিল। শৌভিকের বাবা প্রণববাবু খুব শক্ত মনের মানুষ। এত বড়ো শোকেও চোখের জল ফেলেননি। কিন্ত শুভুর মা (ওটাই শৌভিকের ডাক নাম ছিল) প্রতিমা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। ভবতারণবাবু না থাকলে বোধহয় সত্যি উন্মাদ হয়ে যেতেন। শৌভিকের মৃত্যুর পর ভবতারণবাবুকে উনি আঁকড়ে ধরে ছিলেন।

শৌভিকের বোন রত্না তখন কলেজে সবে ঢুকেছে। রোজ রাত্রে শৌভিকদের বাড়িতে ভবতারণ খেতেন। মাঝে মাঝে রাতও কাটাতেন। ভবতারণ ও রত্নাকে শৌভিকের মা চোখে হারাতেন। শৌভিকের মৃত্যুর পর কোনওরকমে আরও দশ বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু ছেলের শোক ভিতরটাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। হয়তো রত্লার একটা ভালো বিয়ে দেওয়া অবধি বেঁচে ছিলেন।

রত্নাও বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে। কেমিস্ট্রিতে এম.এস.সি পাশ করে একটি সরকারি স্কুলে চাকরি পায়। পরে ভবতারণবাবু ও শৌভিকের সহপাঠী রণিতের সঙ্গে রত্নার বিয়ে হয়। রণিত ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটি বিদেশি কোম্পানিতে জয়েন করে।

কতদিনকার কথা। রত্না এখন একটা সরকারি স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। রণিত চাকরি থেকে অবসর নিয়ে  কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে একটা কনসাল্টিং ফার্ম খুলেছে। ওদের একমাত্র সন্তান অনন্যা ব্রাসেলসে থাকে। একটা ডাচ কোম্পানিতে কাজ করে। বাবার মতো অনন্যাও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। এখনও বিয়ে করেনি।

হলুদ পাঞ্জাবিটা দেখে ভবতারণবাবুর মনে পুরনো স্মৃতিগুলো যেন সিনেমার ফ্ল্যাশ-ব্যাকের মতো ফিরে এল আর শৌভিকের স্মৃতি ক্ষতচিহ্নের মতো চাড়া দিয়ে উঠল।

চার

ভবতারণবাবু ভাবলেন, বৃষ্টি হয়তো ঠিক কথাই বলেছে। উনি ওঁর এক বন্ধুর কাছ থেকে ডঃ নন্দীর ফোন নাম্বারটা নিয়ে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টও করে ফেললেন।

বৃষ্টি মিথ্যে বলেনি। ডঃ নন্দীর সত্যিই খুব নামডাক। ওঁর এক বন্ধুর ছেলে একবার গভীর অবসাদে ভুগছিল। ডঃ নন্দীর  চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠে। এখন দিল্লীতে একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরি করে।

সোমবার সকাল ন’টায় ভবতারণবাবু ডঃ নন্দীর চেম্বারে হাজির হন। এর আগে বৃষ্টির সঙ্গে ফোনে কথা হয়। বৃষ্টি বলেছে, উনি যেন সবকিছু খুলে বলেন। বৃষ্টি জন্মানোর অনেক আগেই শৌভিকের মৃত্যু হয়। কিন্তু বাবাকে দেখে বৃষ্টি বুঝতে পারত, বাবা এখনও ওই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

বৃষ্টি বোধহয় ডঃ নন্দীর মেয়েকে বাবার কথা বলে রেখেছিল। ভবতারণবাবুকে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হল না।

ডঃ নন্দীর চেম্বারটা বেশ আধুনিক। বসবার চেয়ারগুলো খুবই দামি মনে হয়। ঘরে দুটো পেন্টিং আছে। একটা যামিনী রায়ের, আর একটা গণেশ হালুইয়ের। দুটোই অরিজিনাল, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।

সিনেমায় যেরকম দেখায় পেশেন্ট শুয়ে আছে আর ডাক্তার প্রশ্ন করে যাচ্ছে, সেরকম কোনও কিছু ডঃ নন্দী করলেন না।

ঘরে সব চেয়ার গদিওয়ালা। ডঃ নন্দী নিজে এরকম একটা চেয়ারে বসে উলটোদিকের চেয়ারে ভবতারণবাবুকে বসতে বললেন। দু’জনের মাঝখানে একটা মাঝারি সাইজের আয়তাকার আকারের টেবিল। ডঃ নন্দী বললেন যে ওঁর মেয়েকে বৃষ্টি ভবতারণবাবুর সমস্যা শুনিয়েছে। কিন্তু উনি ভবতারণবাবুর মুখ থেকে সব শুনতে চান। ভবতারণবাবু সমস্ত খুলে বলেন। হলুদ পাঞ্জাবিটা দেখার পর শৌভিকের শোকটা যে আবার চাড়া দিয়ে উঠল সেটাও বললেন।

“এই পাঞ্জাবিটা কত পুরনো?”

ডঃ নন্দী যে প্রশ্নটা করবেন ভবতারণবাবু তা আন্দাজ করেই এসেছিলেন। বললেন, “শৌভিক মারা যাওয়ার বেশ কয়েকদিন আগেই কেনা। শৌভিক অবশ্য হাজারিবাগ যাওয়ার আগে আরেকটা হলুদ পাঞ্জাবি কিনেছিল। এটা ও আমায় জন্মদিনে গিফট দিয়েছিল। আমি হলুদ রং খুব একটা পছন্দ করি না, তবুও ওর পাল্লায় পরে একটা বিয়েবাড়িতে এটা পরে গিয়েছিলাম। ও খুব খুশি হয়েছিল।

“কিন্তু কেন আপনার মনে হচ্ছে আপনার বাড়িতে আরেকজন থাকছে অথচ আপনি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না? বিছানায় সূক্ষ্ম ভাঁজ বা জলের বোতল থেকে অতি সামান্য জল উধাও হওয়া এগুলি সামান্য ঘটনা। আপনি যতই গোছানো লোক হন, এরকম ভুল এই বয়সে খুব স্বাভাবিক। আর হয়তো শৌভিকের স্মৃতি আপনাকে হলুদ পাঞ্জাবিটার কথা মনে করে দিয়েছিল। আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ, ভবতারণবাবু। তবে কয়েকটা ব্লাড টেস্ট আর একটা সি.টি স্ক্যান করিয়ে নিতে পারেন। যদিও আমার মনে হয় এসব দরকার নেই। রাত্রে ঘুম না এলে একটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি, খাবেন। তবে রোজ খাবেন না।”

ডঃ নন্দীর চেম্বার থেকে বেরিয়ে ভবতারণ একটা হসপিটালে ফোন করে ডঃ নন্দী যেসব টেস্ট করার কথা বলেছিলেন সেগুলি যাতে কালই করা যায় তার ব্যবস্থা করলেন। হসপিটালের একজন ডাক্তারের সঙ্গে ওঁর পরিচিতি আছে। কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু মনটা খচখচ করতে লাগল। ওঁর যে পার্সনালিটি আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে একথা কী করে ডঃ নন্দীকে বোঝাবেন।

পাঁচ

এরপর যে ঘটনা ঘটল, তাতে ভবতারণবাবুর কোনও সন্দেহ থাকল না যে ওঁর কোনও ডিমেনশিয়া হয়নি।

রাত্রে ঘুম আসছে না। ভাবলেন টিভিতে কোনও ইংরেজি থ্রিলার দেখবেন। কিন্তু হঠাৎ মনে হল, স্পোর্টস চ্যানেলগুলিতে কী দেখাচ্ছে দেখা যাক। একটা চ্যানেলে ম্যানচেস্টার সিটি ও তার চির প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার  ইউনাইটেডের ম্যাচ হচ্ছে। ভবতারণবাবু শৌভিকের কাছ থেকে ইংল্যান্ডের বড়ো ফুটবল টিমগুলির নাম শুনেছিলেন। শৌভিক ছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অন্ধ ভক্ত। ও বলত, পৃথিবীর তাবত বড়ো ফুটবলার কোনও না কোনও সময়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে খেলেছে। এইসব খেলোয়াড়দের সমস্ত রেকর্ড শৌভিকের মুখস্থ ছিল। তখন টিভিতে খেলা দেখার এত সুযোগ ছিল না। কিন্তু যখনই কোনও নামকরা বিদেশি টিমের খেলা হত, শৌভিক রাত জেগে দেখত।

ভবতারণবাবু ফুটবলের অন্ধ ভক্ত নন। কিন্তু উনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো খেলা দেখতে লাগলেন।

হঠাৎ দেয়ালে ঝোলা ক্যালেন্ডারের দিকে ওঁর চোখ যায়। আজকের দিনটা লাল কালিতে দাগ দেওয়া। বহুবছর আগে ঠিক এই দিনেই হাজারিবাগের ট্রেন দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। ক্যালেন্ডার থেকে আবার টিভির উপরে চোখ ফেরান। হাফ-টাইমের ঠিক একমিনিট আগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একজন মিড-ফিল্ডার ফ্রি-কিকে একটা অসাধারণ গোল করল। উত্তেজনায় ভবতারণবাবু সোফা থেকে লাফিয়ে উঠলেন। ঠিক শৌভিক যেভাবে লাফাত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড গোল দিলে।

ছয়

বৃষ্টির সম্পর্কে এক পিসতুতো ভাই হল সমরেশ। সমরেশকে ও বলেছিল সময় পেলে ভবতারণবাবুর খোঁজ নিতে। যদিও ও রোজই প্রায় বাবাকে ফোন করে। তবে ইদানীং বৃষ্টি লক্ষ করেছে, বাবা বেশি কথা বলেন না। হুঁ হ্যাঁ করে সেরে দেন, আর বাড়িতে আর কোনও ব্যক্তির উপস্থিতির কথাও আর বলেন না। বৃষ্টির মনে হল, হয়তো ডঃ নন্দীর চিকিৎসা ফল দিয়েছে। কিন্তু ওর মনে একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। বাবা কেমন যেন পালটে যাচ্ছে। বৃষ্টির কেন যেন মনে হচ্ছে, নিজের মেয়েকেও বোধহয় চিনতে পারছেন না। সমরেশকে তাই তাড়া দেয় সে শিগগিরি যেন বাবার সঙ্গে দেখা করে।

সমরেশ রবিবার সকাল দশটায় চলে এসেছে। ওর বাড়ি থেকে বাসে ভবতারণবাবুর বাড়ি পনেরো মিনিটের পথ। বাড়িতে এসে সমরেশ বেল টেপে। ভবতাবরণবাবু নিজেই দরজা খোলেন। সমরেশ প্রথমে গাবুমামাকে দেখে চিনতে পারে না। গাবু ভবতারণের ডাকনাম। বলল, “মামা তুমি কি গোঁফ একেবারে ছেঁটেই ফেললে?”

“গোঁফ?” ভবতারণবাবু নাকের নিচে হাত বোলান। “ও হ্যাঁ, ছেঁটে ফেলেছি।”

মামার হাবভাব সমরেশের কীরকম যেন মনে হল। “মামা, আমি সমরেশ। চিনতে পারছ তো? মামা তুমি ঠিক আছ তো?”

“ঠিকই আছি। কোনও সমস্যা নেই। আচ্ছা, তুমি কি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের খেলা দেখো?”

সমরেশ অবাক হয়। গাবুমামার ফুটবলে খুব একটা আগ্রহ কোনও দিন দেখেনি।

“মাঝে মাঝে দেখি। তবে বার্সিলোনার সব খেলা দেখি শুধু মেসির খেলা দেখার জন্য। কিন্তু মামা, তুমি কি এখন রেগুলার ফুটবল খেলা দেখো? বৃষ্টির মুখে শুনেছি তোমার এক মামাতো ভাই শৌভিককাকু খুব ভালো ফুটবল খেলতেন।”

সমরেশের কথা শুনে ভবতারণবাবু চুপ করে থাকেন। ভাবগতিক দেখে ‘পরে আসব’ বলে সমরেশ কেটে পড়ে। তিনি যে আর ভবতারণ নন, একথা বললে সমরেশ কি বিশ্বাস করত? আর এই ছেলেটাই যে সমরেশ তিনি কী করে জানবেন? একে তো জীবনে কোনও দিন দেখেননি।

অলঙ্করণঃ মৌসুমী