গল্প শাস্তি দোলা ভট্টাচার্য বসন্ত ২০২০

শাস্তি

দোলা ভট্টাচার্য

এক

ওরা মনে হচ্ছে ক্ষমা করবে না আমাকে। কী শাস্তি দেবে আমায়? ওই লোকটাকে আমি যেভাবে শাস্তি দিয়েছি, ঠিক সেইভাবে! কী জানি। আচ্ছা, লোকটাকে ওরা সবাই মিলে কোথায় নিয়ে গেল? এখন কি ফিরে এসেছে? তাহলে সামনে আসছে না কেন? যখন তখন এসে তো আমাকে জ্বালায়। আসলে বাবুর সব বীরত্ব উবে গেছে। দিয়েছি মাথায় এমন কামড়, একেবারে ঘিলু বার করে ছেড়ে দিয়েছি। ইশ! কী বিশ্রী স্বাদ!

এখন ওরা আমাকে একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছে। আসলে ওরা ভয় পেয়েছে খুব। আমাকে এভাবে রেগে যেতে তো কখনও দেখেনি। কী করব! ও আমাকে এমন রাগিয়ে দিল, নিজেকে সামলাতে পারিনি। ওই একটা কালো রঙের জামা পরে সবসময় আমাকে ভয় দেখাবে। কতবার আপত্তি করেছি। ফালা ফালা করে ছিঁড়ে দিয়েছি জামাটা। দু’দিন বাদেই আবার একটা কালো জামা। জামা কালো, বন্দুক কালো। কী পেয়েছে আমাকে! ওর কথা আমাকে শুনতে হয়। ওর কথায় আমাকে উঠতে হয়, বসতে হয়। এটা আমার ডিউটি। তা বলে ভয় দেখাবে আমাকে! এবারে দ্যাখ, আমি ভয় দেখালে কী হয়।

এখন চারদিক খুব চুপচাপ। কেউ বাইরে নেই মনে হচ্ছে। গেল কোথায় সব! আজ আমাকে কেউ খেতেও দেবে না নাকি? বড়ো খিদে পেয়েছে যে। ওরা সবাই বোধহয় পরামর্শ করছে, কীভাবে আমাকে শাস্তি দেওয়া হবে। অবশ্য ভালো মানুষটা এসে পড়লে ওরা আমাকে আর শাস্তি দিতে পারবে না। কোথায় আছ গো তুমি ভালো মানুষ? আমার যে তোমাকে বড়ো দেখতে ইচ্ছে করছে। তুমি তো এখানেই রয়েছ, অথচ আমার কাছে আসছ না। কেন? কী করেছি আমি? ওই লোকটাকে আজ সবাই যখন আমার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তখনও তোমাকে দেখেছি আমি। সবার মতো ওই লোকটাকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলে তুমি। আমি কত কাঁদছিলাম সে সময়ে। একবারের জন্যও ফিরে তাকালে না আমার দিকে। তারপর কারা যেন এসে আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। একজনের হাতে বন্দুক রয়েছে। ওই বন্দুক থেকে গুলি ছুড়ল লোকটা। রাগের চোটে ইচ্ছে হচ্ছিল, ওর মাথাটাও অমন চিবিয়ে দিই। কিন্তু ওরা আমাকে চেন দিয়ে বেঁধে রেখেছিল। আমি নড়তে পারছিলাম না। তারপর! তারপর কী হল, আর কিছু আমার মনে নেই।

উহ্‌! এখন যে বড্ড খিদে পেয়েছে। আরে! ওই তো লালি আসছে। ওর হাতে খাবারের থালা। এদিকেই আসছে ও। ওকেও আমি খুব একটা পছন্দ করি না। মাঝেমধ্যেই খাঁচার মধ্যে লাঠি ঢুকিয়ে দিয়ে আমাকে খোঁচা মারে ও। আমি রেগে যাই। আর তাতেই ওর আনন্দ। কিন্তু ওকে আমি কিছু বলি না। ও যে আমার ভালো মানুষের বন্ধু। তাই ওর সাত খুন মাফ।

হ্যাঁ। এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি, লালির হাতের খাবারটা আমারই জন্যে আনা। ‘ঘেঁয়াও’ করে একটা আনন্দের ডাক ছাড়লাম। ভয় পেয়ে গেছে লালি। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এই রে! ও যদি খাবারটা না দিয়েই পালায়! না, না। থালা হাতে ও এগিয়েই আসছে। কোনওরকমে খাঁচার ভেতর খাবারটা ঢুকিয়ে দিয়েই পালাল লালি।

বাব্বা! যা খিদে পেয়েছিল! এইবারে শান্তি। বেশ ঘুম ঘুম পাচ্ছে এখন। কিন্তু কোনওদিনই আমার খাওয়ার পরে সঙ্গে সঙ্গে ঘুম পায় না। তাহলে আজ এরকম হচ্ছে কেন?

দুই

মালহোত্রা সাহেবের সার্কাসে বাঘিনী জিরানের খেলাটা ছিল বেশ চমকপ্রদ। সব খেলার শেষে এই খেলাটা দেখাত রিং মাস্টার আবদুল। জিরানের সঙ্গে খেলতে খেলতে একসময়ে নিজের মাথাটা ওর মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিত আবদুল। রুদ্ধশ্বাসে সময় গুনত দর্শক। ঠিক দশ সেকেন্ড পরে মুখ খুলত জিরান। হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াত আবদুল। হাততালিতে ফেটে পড়ত অডিয়েন্স।

কয়েক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে গেল আবদুল। সেই জায়গায় এল জাভেদ। সার্কাসের পশুপাখিগুলোকে বড়ো ভালোবাসত আবদুল। হাতে লাঠি বা চাবুক থাকলেও সেগুলোর প্রয়োগ করতে হত না ওকে। না-মানুষের দলও ওকে ভালোবেসেই ওর সকল কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত।

জাভেদ ছিল অন্য প্রকৃতির। লাঠির ব্যবহারটা ও একটু বেশিই করতে ভালোবাসত। পশুপাখিগুলো ভয় পেত, বিরক্ত হত ওকে দেখে। এই ভয় আর বিরক্তি থেকেই ঘটে গেল অমন একটা সাংঘাতিক ঘটনা।

সেদিন দুপুরের শোয়ের আগে থেকেই জিরানকে বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। জাভেদের সেদিনই ছিল শেষ শো। ছুটির মেয়াদ শেষে আবদুলও ফিরেছিল সেদিন। পরের দিনই আবার কাজে যোগ দেবে ও। ফেরার পর জিরানের সঙ্গে আর দেখা করেনি আবদুল। কারণ, ওকে দেখলে আর জাভেদের সঙ্গে খেলতে চাইবে না জিরান।

জিরান কিন্তু কোনও এক ফাঁকে দেখেই নিয়েছিল আবদুলকে। তারপর থেকেই ওর মন খারাপ। ভালোমানুষটা কেন এল না আমার কাছে! জাভেদকে ও আর সহ্যই করতে পারছে না। খেলার সময়ে জাভেদও বুঝতে পারছিল, জিরান আজ খেলতে চাইছে না। কিন্তু ওর হাতের চাবুককে অস্বীকারও করতে পারছে না। তারপর এল সেই ভয়ংকর মুহূর্ত, খেলার অন্তিম পর্যায়। জিরানের সামনে এসে দাঁড়াল জাভেদ। জাভেদের কাঁধের ওপর সামনের দুটো পা তুলে দিয়ে দাঁড়াল জিরান। জাভেদের মুখের সামনে জিরানের মস্ত হাঁ করা মুখ। নিজের মাথাটা ওর মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল জাভেদ। মুখ বন্ধ করল জিরান। দশ সেকেন্ড কেটে গেল। মুখ খুলল না জিরান। আরও পাঁচ সেকেন্ড কাটল। দর্শকাসনে বিরাজ করছে মৃত্যুপুরীর নৈঃশব্দ্য। ছুটে এল আবদুল। নাহ্‌, দেরি হয়ে গেল বড়ো। কড়মড় করে হাড় চিবানোর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে তখন। জিরানের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত।

জাভেদের হাত থেকে খসে পড়া চাবুকটা তুলে নিয়ে পাগলের মতো ওকে মারতে থাকে আবদুল। তবুও মুখ খোলেনি জিরান। বিষম ত্রাসে দিশাহারা দর্শক, ছোটাছুটি ধাক্কাধাক্কিতে অনেকেই আহত হন। সার্কাস কর্তৃপক্ষের তৎপরতায় সকলেই বেরিয়ে আসেন বাইরে।

চাবুকের আঘাত খেতে খেতে একটা সময়ে জাভেদকে ছেড়ে দিয়ে আবদুলের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে জিরান। ঘুমপাড়ানি গুলির সাহায্যে আগে ঘুম পাড়ানো হয় ওকে। তারপর লোহার চেন দিয়ে বেঁধে খাঁচায় ঢোকানো হয়।

তিন

আবদুল বুঝতে পারছে, জিরানের কী পরিণাম হতে চলেছে। কোনোভাবেই ওকে বাঁচতে দেবে না এই সার্কাসের মালিক সুজন মালহোত্রা। একটু আগেই মালহোত্রা সাহেবের তাঁবুতে ডাক পড়েছিল ওর। ভেতরে তখন একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। ওকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি চলে যাবার উদ্দেশ্যে। যাবার আগে মালহোত্রা সাহেবের সঙ্গে আরেকবার করমর্দন করে বললেন, “তাহলে ওই কথাই রইল। আপনার সুবিধামতোই কাজ করবেন আপনি, আর বাইরের ব্যাপারটা আমি সামলে নেব।”

অফিসারের বুক পকেটে একটা সাদা রঙের পুরুষ্টু খাম আবদুলের নজর এড়াতে পারেনি। ওর দিকে তাকিয়ে মালহোত্রা সাহেব বললেন, “দশ মিনিটের মধ্যে সকল স্টাফকে নিয়ে এখানে এসো, আবদুল। কথা আছে।”

যন্ত্রের মতো আদেশ পালন করে আবদুল।

সকলের সামনে নিজের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন মালহোত্রা সাহেব। জিরানের মৃত্যুদণ্ড বহাল হল। আবদুল দুর্বল কন্ঠে বলার চেষ্টা করেছিল, “স্যার! ওকে ক্ষমা করা যায় না?”

অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন সুজন মালহোত্রা। “তুমি কি আর কিছু বলবে?”

“হ্যাঁ, বলব স্যার। অনুমতি দিন।”

“বেশ। বলো।”

আবদুল বলে, “মানুষ যদি খুন করে, তাহলেও সবক্ষেত্রে তাকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয় না। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও দেওয়া হয় তাকে। ওই প্রাণীটার কথা আরেকবার কি ভাবা যায় না, স্যার!”

চারপাশ থেকে গুঞ্জন উঠল, “ওই বাঘ এখন মানুষখেকো হয়ে গেছে। ওকে মেরে ফেলাই ভালো।”

এবার একটু নরম সুরেই বললেন সুজন মালহোত্রা, “তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি, আবদুল। এতদিন ধরে তুমি ওর সঙ্গে ছিলে। সেজন্য তোমার খুবই কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমার অবস্থাটা একবার ভাবো, কতখানি লোকসান হল আমার। এখানে একমাস খেলা দেখানোর কথা ছিল। দেখালাম মোটে চারদিন। কালই আমাদের এখানকার পাট চুকিয়ে চলে যেতে হবে। আর এই যে একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া, এতজন কর্মী, পশুপাখি, লটবহর নিয়ে, তারও রয়েছে একটা বিশাল ব্যায়ভার। এগুলো ভাবছ না?”

“অন্য কারও কাছে ওকে বিক্রি করে দিন না, স্যার।” শেষ চেষ্টা করে আবদুল।

অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন সুজন মালহোত্রা। “বিক্রি! কে নেবে ওই মানুষখেকোকে!”

আবদুল জানে জিরানের মতো নিখুঁত একটা বাঘিনীকে বিক্রি করলে অনেক দাম পাওয়া যায়। কিন্তু ওর গায়ে যে মানুষখেকোর কলঙ্ক লেগেছে। তাই মনোমতো দাম পাওয়া যাবে না। সুজন মালহোত্রা লোকটা ভয়ংকর অর্থপিশাচ। যা ভেবেছে, সেটাই করবে ও।

তাঁবুর বাইরে অন্ধকারের মধ্যে খোলা মাঠে বসে ছিল আবদুল। জিরানের কথাই ভাবছিল ও। বছর আষ্টেক আগে মালহোত্রা সাহেবের দল মধ্যপ্রদেশে গিয়েছিল খেলা দেখাতে। খেলা দেখে খুশি হয়ে রেওয়ার রাজপরিবার ছোট্ট জিরানকে তুলে দিয়েছিল সুজন মালহোত্রার হাতে। জিরান নামটাও রেওয়ার রাজকুমারের দেওয়া। জিরানের সঙ্গে এসেছিল আবদুল, ওকে দেখাশোনা করার জন্য। আবদুলের হাতেই একটু একটু করে বড়ো হয়ে উঠেছে জিরান। অবোধ প্রাণীটার জন্যে ব্যথায় ভরে উঠেছে ওর মনটা। শুধু মনে হচ্ছে, এ ঠিক নয়, ঠিক বিচার হচ্ছে না। জিরানকে মানুষখেকো বলতেও ওর মন চাইছে না। কারণ, যে সময়টা ও পেয়েছিল, তাতে জাভেদের মাথাটা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে খেয়েও নিতে পারত। তা করেনি জিরান। ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি জাভেদের মাথা।

অন্ধকারে নিঃশব্দে ওর পাশে এসে বসল লালি। “কী ভাবছিস, আবদুল? জিরানের কথা নিশ্চয়ই?”

“হুঁ।”

“আমরা কি ওকে কোনওভাবেই বাঁচাতে পারব না?”

অসহায়ভাবে মাথা ঝাঁকায় আবদুল। “কী করে! কী করে সম্ভব!”

দু’জনেই নিঃশব্দে বসে থাকে অন্ধকারের মধ্যে। জিরানের গর্জন শোনা যাচ্ছে। খিদেয় চিৎকার করছে প্রাণীটা। এবেলায় ওকে খেতেই দেয়নি কেউ। হঠাৎ আবদুলের হাতটা আঁকড়ে ধরে লালি। “আবদুল! ওঠ। একটা উপায় এখনও আছে। চল আমার সঙ্গে। যেতে যেতে বলছি।”

“কী! কী উপায়?”

লালি বলে, “এখানকার চিড়িয়াখানার একজন কর্মীর সাথে আমার পরিচয় আছে। ওর সঙ্গে আবার পশু কল্যাণ দপ্তরে কাজ করে এমন একটা লোকের যোগাযোগ আছে। আমরা ওদের সাহায্য নিতে পারি।”

এতক্ষণে একটু হলেও আশার আলো দেখতে পায় আবদুল।

চার

ভোর পাঁচটা। শৃঙ্খলিত জিরানকে নিয়ে আসা হয়ছে বধ্যভূমিতে। সার্কাসের তাঁবুর পেছনদিক এই জায়গাটা। দিগন্ত প্রসারিত মাঠ। একটু পরেই সূর্য উঠবে। তারই আভাস রয়েছে আকাশের লালিমায়। খুব অসহায় দেখতে লাগছে জিরানকে। মাঝেমধ্যে ডেকে উঠছে। ওর চোখ খুঁজে চলেছে আবদুলকে। কোথায় তুমি ভালো মানুষ? আমাকে বাঁচাতে আসবে না? এত রাগ করেছ আমার ওপর!

সার্কাসের গেটের বাইরে তখন অস্থিরভাবে পায়চারি করে চলেছে আবদুল। সঙ্গে রয়েছে লালি। সংশয়ের দোলায় দুলছে আবদুলের মন। “ওরা ঠিক সময়ে আসবে তো, লালি! জিরান ডাকছে। বড়ো করুণ শোনাচ্ছে ওর ডাকটা।”

আবদুলকে শান্ত হতে বলে লালি।

ম্যানেজার ভার্গবের হাত থেকে বন্দুকটা নিজের হাতে তুলে নিলেন সুজন মালহোত্রা। নিশানা ঠিক করে লক্ষ্যে আঘাত হানার অপেক্ষা শুধু।

দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে রাস্তার ধুলোর ওপরেই বসে পড়েছে আবদুল। আশার শেষ শিখাটুকু জ্বালিয়ে রেখে লালি তখনও অপেক্ষা করছে।

গাড়িগুলো বিসর্পিল গতিতে এগিয়ে আসছিল এদিকে। দেখেই চিৎকার করে ওঠে লালি, “ওরা আসছে। ওঠ আবদুল! উঠে দাঁড়া। আমাদের জিরান বাঁচবে।”

গাড়িগুলো একে একে এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। পশু কল্যাণ দপ্তরের গাড়ি, সঙ্গে রয়েছে পুলিশের গাড়ি আর বনদপ্তরের গাড়ি। প্রথম গাড়িটা থেকে একজন নেমে এসে ওদের জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারাই কি অভিযোগ করেছিলেন এই সার্কাসের মালিকের বিরুদ্ধে?”

“হ্যাঁ স্যার, শিগগিরি চলুন। আর দেরি করলে মারা পড়বে প্রাণীটা।” উদ্বেগ ঝরে পড়ছে আবদুলের গলা থেকে।

ওদের পেছন পেছন পুরো দলটা এগোতে থাকে বধ্যভূমির দিকে। আবদুল আর লালি এবার ছুটতে শুরু করেছে।

ওই তো এসেছে ভালো মানুষ। আবদুলকে দেখেই বন্দুকের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল জিরান। ও ভালো মানুষ, আমাকে বাঁচাতে এসেছ তুমি! দেখো তো, কীরকম শক্ত করে আমাকে বেঁধে রেখেছে ওরা। কাল রাতে আমাকে কেউ খেতেও দেয়নি। খিদে পেয়েছে বড্ড। ওর সোহাগ মেশানো গরগরে স্বরের মধ্যে দিয়ে কত অভিযোগ ঝরে পড়ছে। কিন্তু সেদিকে মন দেবার একদম সময় নেই আবদুলের। ও চিৎকার করে ওঠে, “থামুন স্যার! মারবেন না ওকে।”

সুজন মালহোত্রার আঙুল তখন ট্রিগারের ওপর চেপে বসেছে। আবদুলের নিষেধ শুনতে পেয়েও শোনার প্রয়োজন মনে করলেন না। গুলি চলল শেষপর্যন্ত। কিন্তু নিশানা নড়ে গিয়েছিল। তাই গুলিটা বুকে না লেগে গলায় লাগল জিরানের।

পাগলের মতো ছুটে গিয়ে জিরানের পাশে বসে পড়ল আবদুল। “এত চেষ্টা করেও তোকে বাঁচাতে পারলাম না আমি।”

ঝরঝর করে দু’চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে আবদুলের। জিরানের দুটি চোখে তখন ভোরের সূর্যের রং জমাট বেঁধেছে। আবদুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই আস্তে আস্তে নিষ্প্রভ হয়ে আসা চোখদুটো বন্ধ করল জিরান।

দু’বছর পর

জিরান এখন একেবারে সুস্থ। বনদপ্তরের অধীনে জঙ্গলের মধ্যে স্বাধীন চলাফেরা ওর। মানুষ খায় না জিরান। দুয়েকটা হরিণ-টরিন মেরে খায়। এখন আবার মাছের নেশা হয়েছে বাবুর। নদী থেকে মাছ ধরেও বেশ খাওয়া চলে। বনদপ্তরের চাকরি নিয়ে আবদুলও এখানেই রয়েছে। লালির সঙ্গে ঘর বেঁধে ভালোই আছে ও।

সার্কাসের সেই দল কিন্তু ভেঙে গিয়েছে। সুজন মালহোত্রাও জেলে।

জিরানের সঙ্গে আবদুলের দেখা হয় মাঝে মাঝে। কাছে আসে না জিরান। কিছুদিন আগেই ও মা হয়েছে। বাচ্চাদের নিয়ে কোথায় ও লুকিয়ে থাকে, দেখতে পায় না আবদুল। জিরান ওর বাচ্চাদের দেখাতে চায় না। আবদুল মনে মনে ভাবে, থাক ও ওর নিজের মতো করে। একটা সুন্দর জীবন যে ওকে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি, তাতেই আমি খুশি।

আর জিরান? চোখের দৃষ্টিতে ওকে বার্তা পাঠায়, দূরেই থাকো ভালোমানুষ। জঙ্গলের নিয়ম তোমাদের থেকে আলাদা। তাই তোমার কাছে যাই না। কিন্তু আজও আমি ভালোবাসি তোমাকে।

(যে সময়ে সার্কাসে বাঘ-সিংহের খেলা দেখানো হত, এ গল্প সেই সময়ের।)

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s