গল্প শিংওয়ালা মানূষ অরিন্দম দেবনাথ শীত ২০১৯

 অরিন্দম দেবনাথ-এর সমস্ত লেখা

অরিন্দম দেবনাথ

“টুকুভাই, ও টুকুভাই, তোমার অঙ্ক আর ইংরেজির অবস্থা তো খুবই খারাপ। পরীক্ষায় এত কম নম্বর পেতে লজ্জা করে না?”

বাড়ির বাইরের গেট বন্ধ করে গ্যারেজে সাইকেলটা রাখতে গিয়ে চাপা গলার কথাগুলো শুনে টুকুর মেজাজ গেল আরও বিগড়ে। একেই তো খানিক আগে স্বপন স্যারের কোচিং ক্লাস থেকে কানমলা খেয়ে এসেছে, তারপর আবার কানের কাছে এই ফিসফিসানি।

টিমটিম করে জ্বলতে থাকা বাল্বের লালচে আলোয় টুকু দেখল, পাঁচিলের ধার ঘেঁষা বোগেনভেলিয়ার ঝোপের পেছনে দাঁড়ানো একটা কালো রঙের কোট প্যান্ট পরা খুব ফর্সা লোক তার দিকে তাকিয়ে। অন্যদিন হলে এই সন্ধেবেলা বাড়ির ভেতর লোকটাকে দেখলে ভয়ে চিৎকার করে ফেলত টুকু। কিন্তু খানিক আগে স্যারের কানমলা খাওয়া আর অঙ্ক-ইংরেজি নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা শুনে আসা টুকু তেড়ে গেল লোকটার দিকে।

“দেখি তোমার অঙ্ক কত ভালো। বলো তো একটা তিনশো গ্রাম ওজনের ইঁদুর একটা এক কিলো ওজনের লাড্ডু খেলে ইঁদুরটার ওজন কত হবে?”
“সে কী, এটাও জানো না?”
“তুমি বলো দেখি।”
“এক কেজি তিনশো গ্রাম!”
“ভুল! একটা তিনশো গ্রাম ওজনের ইঁদুর একটা এক কেজি ওজনের লাড্ডু খাবে কী করে? তাছাড়া এক কেজি ওজনের লাড্ডু কোন দোকান বানায় শুনি?”
“যে দোকানই বানাক, আমি যেই স্যারকে বললাম, স্যার ইঁদুরটার ওজন একটুও বাড়বে না, উলটে ইঁদুরটা অত বড়ো লাড্ডু দেখলে ভয়ে পালিয়ে যাবে, শুনে স্যার আমার কান মলে দিল!”

টুকুর কথা শুনে লোকটা টুপি খুলে মাথা চুলকোতে শুরু করল। লোকটার মাথার দিকে নজর যেতেই টুকু চমকে উঠল। লোকটার মাথায় একটাও চুল নেই, উলটে মাথার সামনে দুটো ইয়া বড়ো শিং!

লোকটার মাথার শিং দেখে টুকু চমকে উঠলেও একটুও ঘাবড়াল না। উলটে বলল “কী হল, আমার কথার উত্তর দিলে না যে বড়ো! আমি কি ভুল বলেছিলাম?”

লোকটা আবার খানিক মাথা চুলকে বলল “না, মানে তোমার যুক্তিটা ঠিকই আছে, কিন্তু অঙ্কের উত্তর ওই এক কেজি তিনশো গ্রামই হবে।”

“আবার বাজে কথা বলছ? উলটে তো ওর ওজন কমে যাবে!”

“অ্যাঁ!”

“একটা তিনশো গ্রাম ওজনের ইঁদুর একটা এক কেজি ওজনের লাড্ডু খেলে ওর পেট ফেটে সব নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গিয়ে ওর ওজন কমে যাবে না?”

“তুমি যাই বলো না কেন, ওই এক কেজি তিনশো গ্রাম ওজন না লিখলে পরীক্ষায় লাড্ডুই পাবে।”

“পাই পাব, কিন্তু ওইসব ভুল অঙ্কের হিসাব করতে পারব না।”

“ভেবে দেখেছ কি, ওই লাড্ডু পাওয়া রেজাল্ট বাড়িতে দেখালে কী হবে?”

এবার একটু দমে গেল টুকু। গতবার ক্লাস সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষায় অঙ্কে পঁয়তাল্লিশ পেয়েছিল আর ইংরেজিতে আটচল্লিশ। কিন্তু বাকি সব বিষয়ে নব্বইয়ের ওপর নম্বর ছিল। বাবার কাছে বেধড়ক বকা খেয়েছিল টুকু, তবুও শুধরোয়নি। মুখে মুখে ঝটাপট অঙ্ক করতে পারে টুকু। শুধু খাতায় কলমে করতে গিয়ে নাইনকে সিক্স আর সিক্সকে নাইন লিখেই যত গড়বড়। ইংরজিতেও ঠিক তাই। ইংরেজিতে দারুণ গল্প বলতে পারে। কিন্তু লেখার সময় ছোটো হাতের ‘বি’ আর ‘ডি’তে গণ্ডগোল হয়ে যায়। ফলে ডগ হয়ে যায় বগ, আর বাটা হয়ে যায় ডাটা। তারপর হাতের লেখার যা ছিরি! বহুবার স্কুল থেকে হাতের লেখা শুধরানোর জন্য বড়ো বড়ো নোট পাঠিয়েছে টিচাররা।

হঠাৎ টুকুর মনে হল, আরে! লোকটা কে? বাড়িতে ঢুকলই বা কী করে? আর ওর এত কথাও বা জানল কী করে? “আচ্ছা, তুমি কে বলো তো? মাথায় শিং পরে আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? ডাকব নাকি মাকে?”

মার কথা শুনে নিমেষে লোকটা উধাও হয়ে গেল। বোগেনভেলিয়া গাছটার আশপাশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও লোকটার কোনও হদিস পেল না টুকু। ভূত-টুত নাকি? গা শিউরে করে উঠল টুকুর।

ঠিক তখনি বাড়ির দরজা টুক করে খুলে মা বেরিয়ে এল। “ব্যালকানি থেকে দেখেছি অনেকক্ষণ হল বাড়িতে এসেছিস, এতক্ষণ লাগে গ্যারাজে সাইকেল রাখতে? একা একা কী বকবক করছিলি? মনটা থাকে কোথায় শুনি? রাতেও কাঠবিড়ালি খুঁজিস নাকি আজকাল? স্বপন স্যার ফোন করেছিলেন। উনি তোকে আর পড়াতে পারবেন না। বাবা ফিরুন চেম্বার থেকে, তারপর উনিই ঠিক করবেন তোকে নিয়ে কী করবেন। এই নিয়ে চারটে মাস্টার হাত তুলে দিল দু’বছরে।”

তার মানে মা লোকটাকে দেখেনি! গুটি গুটি পায়ে মার পেছন পেছন বাড়িতে ঢুকে দাদুর ঘরে চলে গেল টুকু। ওই ঘরে সবাই জব্দ।

বাবা আসার পর দাদুর ঘরে মিটিংয়ে দাদু নিদান দিলেন, টুকুকে আর কোনও মাস্টারের কাছে পাঠানো হবে না। এবার থেকে দাদুই টুকুকে অঙ্ক আর ইংরেজি পড়াবেন। দাদুর কাছে পড়তে হবে শুনে টুকুর মনটা ভালো হয়ে গেল। তবে একটাই সমস্যা, দাদু আজকাল একটু কানে কম শোনেন আর চোখে কম দেখেন।

টুকুর দাদু এই অঞ্চলের নামজাদা শল্যচিকিৎসক ছিলেন, সাথে কবিরাজি চিকিৎসাও করতেন। কিন্তু চোখের সমস্যা শুরু হবার পর ডাক্তারি ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু বন্ধ করেননি শখের কবিরাজি। আজকেই টুকুকে শোবার আগে চুপিচুপি একটা কবিরাজি ওষুধের গুলি খাইয়েছেন। অসম্ভব টক ওই ওষুধের গুলি তিরিশ দিন টানা খেলেই নাকি ওর নাইন আর সিক্স এবং ‘বি’-‘ডি’ উলটো লেখার ব্যারাম ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বার বার করে দাদু টুকুকে সাবধান করে দিয়েছেন যে ভুলেও টুকু যেন এই ওষুধের কথা কাউকে না বলে। আসলে টুকুর বাবা আলোপ্যাথ ডাক্তার। কবিরাজি চিকিৎসা টুকুর বাবা একদম সহ্য করতে পারেন না।

কিছুদিন হল টুকু দোতলায় নিজের ঘর পেয়েছে। আগে মা-বাবার সাথে একঘরে ঘুমোত। বিছানায় শুয়ে খালি এপাশ ওপাশ করছে টুকু, ঘুম আর আসছে না কিছুতেই। কবিরাজি গুলিটা খাবার পর থেকেই মাথাটা কেমন যেন বনবন করছে ওর। জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে টুকুর চোখদুটো ব্যথা হয়ে গেছে।

“টুকুভাই, ঘুম আসছে না বুঝি?”

চমকে উঠল টুকু। জানালার গ্রিল জুড়ে একটা আধখানা কালো শরীর। আবছা আলোতেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, শরীরটার মাথার ওপর দুটো শিং।

“আবার তুমি এসেছ? তখন তো মার নাম শুনে পালিয়ে গেছিলে? তা পালিয়ে গেছিলে কোথায় শুনি? এখন রাত্তির বেলা এসেছ মাথায় সেই শিং দুটো লাগিয়ে ভয় দেখাতে? মাকে ডাকব নাকি?”
“রাগ করছ কেন, টুকুভাই? আমি তো তোমাকে হেল্প করতে চাইছি।”
“কীসের হেল্প শুনি?”
“না, মানে তোমার ওই নাইন আর সিক্সের প্রবলেম আমি ঠিক করে দিতে পারি।”
“কী করে? তুমিও কি আমার মাস্টার হতে চাও নাকি?”
“কী যে বলো টুকুভাই!”
“আচ্ছা, তুমি কে বলো তো? মাথায় শিং লাগিয়েই বা কেন ঘুরে বেড়াও?”
“আমি তোমারই মতো মানুষ। কিন্তু আমি এই পৃথিবীতে থাকি না। তোমাদের ভাষায় আমি একজন এলিয়েন।”
“মাথায় নকল শিং লাগিয়ে আমাকে ভয় দেখাতে পারোনি বলে এখন নিজেকে এলিয়েন বলে মাঝরাতে আমাকে ভয় দেখাতে চাইছ? তুমি চোর-টোর নও তো? দাঁড়াও, মাকে ডাকি।”

টুকুর মাকে সবাই ভয় পায়। টুকুর মা স্কুলে সংস্কৃত পড়ায়। আর রেগে গেলে সংস্কৃতেই কথা বলে। মার নাম শুনেই জানালা থেকে ভ্যানিশ হয়ে গেল লোকটা।

টুকু ছুটে গেল জানালার ধারে। রাত্তিরে বাইরে জ্বলতে থাকা টিমটিমে বাল্বের আলোয় কাউকে দেখতে পেল না। বাগানে টুকুদের অ্যালসেশিয়ান কুকুর ‘টাইগার’ ছুটে বেড়াচ্ছে। কোন ইঁদুর-টিদুর দেখতে পেয়েছে হয়তো। কিন্তু টাইগারও তো কোনও আওয়াজ করেনি! টাইগার বাঁধা না থাকলে পাড়াপ্রতিবেশীরাও সহজে টুকুদের বাড়িতে ঢোকে না। তাছাড়া লোকটা দোতলার জানালায় উঠলই বা কী করে? তাহলে কি… আর ভাবতে পারছে না টুকু। চাদরে আপাদমস্তক ঢেকে শুয়ে পড়ল সে।

অঙ্কের স্যার তপনবাবু আজ আসেননি। ওঁর জায়গায় আজ ক্লাস নিতে এসেছিলেন ইংরেজির স্যার রণেনবাবু। রণেনবাবু অন্য কোনও স্যারের ক্লাসে এলে গল্প শোনান। আজকেও ফেঁদে বসেছিলেন কল্পবিজ্ঞানের গল্প—অন্য গ্রহের প্রাণী হানা দিয়েছে পৃথিবীতে। মহাকাশ থেকে নেমে আসা তিনটে গোল চাকতি চার ঠ্যাঙের ওপর স্থির হয়ে পুকুরপাড়ের পাশের ফাঁকা জমিতে দাঁড়িয়ে। হাজারো চেনা অচেনা রঙের আলো জ্বলছে নিভছে মহাকাশযানগুলো থেকে। দরজা খুলে গেছে। কী যেন একটা নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। টিভি, রেডিও, মোবাইলের বিভিন্ন সোশ্যাল সাইটে ছড়িয়ে পড়েছে একটা খবর। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একই সময়ে অজানা গোল চাকতি উড়ে বেড়াতে দেখা গেছে। ক্ল্যাইম্যাক্সের চূড়ান্ত। আর তখনই গল্প বলতে বলতে জিজ্ঞেস করেছিলেন রণেন স্যার, “আচ্ছা, কে বলবে অন্যগ্রহের প্রাণীর চেহারাটা কেমন দেখতে হওয়া উচিত।”

শোনার সাথে সাথে হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল টুকু। “স্যার, এলিয়েনদের দেখতে একদম মানুষের মতো। ওরা মানুষের মতো কোট-প্যান্ট-টুপি পরে ঘুরে বেড়ায়। শুধু মাথা থেকে টুপি খুললে ওদের মাথার দু’পাশে দুটো শিং দেখা যায়।”

টুকুর কথা শুনে হেসে উঠল সমস্ত ক্লাস। রণেন স্যার টেবিলে ডাস্টার ঠুকে সবাইকে চুপ করালেন। বললেন, “ও ওর মতো বলেছে। আর কেউ কিছু আইডিয়া করে বলবে?”

এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু গণ্ডগোলটা পাকাল স্বয়ং টুকু। আবার দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার, ওরা কেউ কী করে বলবে! ওরা কি কেউ এলিয়েন দেখেছে? আমি গতকাল দেখেছি, দু’বার। আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল।”

কেন জানি না একথা শুনে খুব খেপে গেলেন রণেন স্যার। “এদিকে আয় হতচ্ছাড়া উলটো বি অ্যান্ড উলটো ডি, এই ডাস্টারের এক টোকায় তোর মাথার দু’পাশে দুটো শিং গজিয়ে তোকেই একটা এলিয়েন বানিয়ে পাঠিয়ে দিই তোর এলিয়েন বন্ধুর কাছে।”

ক্লাসের সবাই একথা শুনে আবার হো হো করে হেসে উঠল। তখনি বাজল ক্লাস-শেষের ঘণ্টা। টেবিল থেকে চক আর ডাস্টার তুলে বেরিয়ে গেলেন রণেন স্যার।

আজ আর বন্ধুদের সঙ্গে কম্পিটিশন করে নয়, একা একা অতি ঢিমেতালে সাইকেল চালিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল টুকু। আর কাঁহাতক সহ্য হয়! বন্ধুদের হো হো করে হাসার কথা মনে হলেই ওর কানদুটো রাগে লাল হয়ে উঠছে। ও যে বি আর ডি উলটো লেখে সেটা সবাই জানে, কিন্তু সেটা কি স্যার সবার সামনে আবার বলে ঠিক করল? নাহ্‌, আজ থেকে বিচ্ছিরি খেতে হলেও দাদুর কাছ থেকে নিয়ে একসাথে দুটো করে ওষুধ খেতে হবে। নাইন, সিক্স, বি আর ডি উলটো লেখা ওকে ঠিক করতেই হবে। তারপর ওই শিংওয়ালা লোকটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে একদিন স্কুলে নিয়ে যাবে। সবাইকে দেখাতেই হবে যে এলিয়েন ওর কাছে এসেছিল।

“টুকুভাই! ও টুকুভাই!”

চমকে উঠল টুকু। তার সাইকেলের ক্যারিয়ারের ওপর বসে আছে শিংওয়ালা লোকটা, অথচ টুকু কিছুই টের পায়নি! রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল টুকু।

“দেখলে তো, ক্লাসে বন্ধুদের মাঝে কীরকম বেইজ্জত হলে!”
“তুমি কী চাইছ বলো তো?”
“বললাম তো, তোমাকে হেল্প করতে চাইছি।”
“মানে আমার মাস্টার হতে চাইছ তো?”
“না না, কী যে বলো! তোমার মাস্টার হতে চাইব কেন? আমি তো আগেই বলেছি…”
“তুমি তো কালকেই বললে আমার সিক্স আর নাইন, ছোটো হাতের মানে স্মল বি-ডির গণ্ডগোল তুমি ঠিক করে দেবে।”
“দেবই তো। ওটা কোনও একটা সমস্যা নাকি?”
“তাহলে এখনই ঠিক করে দাও!”
“দেব দেব, ঠিক করে দেব। কিন্তু তার বদলে তোমাকে একটা ছোটো কাজ করে দিতে হবে।”
“তোমার কী কাজ আবার করে দিতে হবে, তুমি তো এলিয়েন!”
“আমি খুব মুশকিলে পড়ে গেছি। আমার এই মাথার শিংদুটোর জন্য আমি আমার গ্রহে ফিরে যেতে পারছি না। কেন যে পৃথিবীতে নামতে গেছিলাম!”
“দেখো, তুমি আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছ না তো? ভয় পেলেই কিন্তু আমি মাকে…”
“এই টুকু, এখনও বাড়ি যাসনি? রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কী একমনে বকবক করছিস?”

টুকু দেখল ওর ক্লাসের স্যমন্তক উলটোদিক থেকে হাতে ফুটবল নিয়ে আসছে। স্যমন্তককে টুকু একেবারে সহ্য করতে পারে না। অঙ্কেতে একশোতে একশো পায় বলে ওর ভারি দেমাক।

টুকু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল শিংওয়ালা মানুষটা উধাও। টুকুর গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল। তার মানে সে ছাড়া আর কেউ শিংওয়ালা মানুষটাকে দেখতে পায় না! লোকটা কি সত্যিই এলিয়েন, না কোনও ম্যাজিশিয়ান!

টুকু স্যমন্তকের কথার কোনও উত্তর না দিয়ে সাইকেলে উঠে প্যাডেল করতে শুরু করল।

বাড়িতে ফিরে টুকু দেখল মা অনেক আগেই ফিরে এসেছে। টুকু ঘরে ঢুকতেই মা উত্তেজিত হয়ে বলল, “জানিস টুকু, একটু আগে টিভিতে বলছে অজানা আকাশযান দেখা গেছে! কিন্তু বস্তুটা যে কী, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কোনও র‍্যাডারে ধরা পড়ছে না এই আকাশযান। এমনকি স্যাটিলাইটেও কোনও ছবি ধরা পড়েনি। কিন্তু বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকেই খালি চোখে একটা চকচকে বস্তুকে আকাশে দ্রুত উড়ে যেতে দেখেছে বলে দাবি করেছে। ইশ, আমরাও যদি দেখতে পেতাম! চল আমরা ছাদে গিয়ে বসি।”

টুকুর মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে এসেছিল যে, সে জানে, ওটা আসলে অন্য গ্রহ থেকে আসা আকাশযান, আর ওই আকাশযানে চেপে আসা একটা প্রাণী টুকুর কাছে হেল্প চাইছে, আর বদলে ওর উলটো স্মল ডি আর বি ও উলটো নাইন আর সিক্স লেখার প্রবলেম সলভ করে দেবে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল টুকু। এলিয়েনের কথা শুনে রণেন স্যারের ডাস্টার তুলে তেড়ে মারতে আসার দৃশ্যটা ভুলতে পারছে না। মাকে বলল ওর শরীর ভালো লাগছে না। ও এখন ঘুমোবে।

মা তাড়াতাড়ি এসে ওর কপালে হাত দিল। “হ্যাঁ, গাটা ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে। তোর বাবা আসুক, বলছি। সাবধানের মার নেই। একটা ব্লাড টেস্ট করিয়ে নিতে হবে। চারপাশে খুব ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়া হচ্ছে।”

টুকু কিছু না বলে চুপচাপ ঘরে গিয়ে স্কুলের পোশাক পালটিয়ে হাতমুখ ধুয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। ‘আরেকবার আসুক শিংওয়ালা লোকটা, এবার দেখাব মজা কাকে বলে। এলিয়েন না হাতি! লোকটা নিশ্চয়ই ম্যাজিশিয়ান। ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে।’ মনে মনে ভাবল টুকু।

চাদর মুড়ি দিয়ে টুকু ভাবতে লাগল কী করে শিংওয়ালা লোকটাকে বন্দী করা যায়। লোকটা এলে চাদর চাপা দিলে কীরকম হয়? আইডিয়া! একটু প্র্যাকটিস করে নিই।

চাদরটাকে গা থেকে ছুড়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল টুকু।

“টুকুভাই, ও টুকুভাই।” জানালার গ্রিলে দেখা গেল শিংওয়ালা মাথাটা। “আমার ভারি বিপদ টুকুভাই, তুমি না সাহায্য করলে আমাকে এই পৃথিবীতেই রেখে আমাদের আকাশযান ফিরে যাবে।”

“আবার এসেছ? মাকে ডাকব নাকি?”
“আহা, করো কী! আমার কথাটা তো শোনো!”
“তুমি যদি সত্যিকারের এলিয়েন হও, তাহলে নিজের স্পেস-শিপে করে ফিরে যাচ্ছ না কেন? টিভিতে বলছে যে আকাশে একটা অজানা বস্তু দেখা গেছে। ওটা নিশ্চয়ই তোমার স্পেস-শিপ!”
“পারছি না এই শিংয়ের জন্য!”
“কেন? আমি তো ছবিতে দেখেছি যে এলিয়েনদের মাথায় শিং থাকে।”
“এই শিং আমার নয়।”

“তাহলে তুমি নিশ্চয়ই কোনও এলিয়েন নও। কোনও ম্যাজিশিয়ান! আমি ম্যাজিক শোতে দেখেছি, ম্যাজিশিয়ানরা ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে। এই শিংটা কি মেলা থেকে কিনে এনে লাগিয়েছ? আর মাকেই বা এত ভয় পাও কেন?”

“বিশ্বাস করো, আমি এই গ্রহের বাসিন্দা নই। আমাদের গ্রহের মানুষদের দেখতে ঠিক তোমাদের মতো। আমরাও তোমাদের মতো ভাষায় কথা বলি। আসলে আমাদের গ্রহে অনেক মানুষ হয়ে যাওয়ায় থাকার জায়গা কমে গেছে, তাই আমরা নতুন গ্রহ খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমাদের পাঁচটা স্পেস-শিপ একসাথে পৃথিবীকে চক্কর দিয়ে চলেছে। আর আমার মতো পাঁচটা ‘মানুষ’ এখন পৃথিবীর মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

“তাদের সবার মাথায় নিশ্চয়ই শিং আছে?”

“আরে না! তাড়াহুড়ো করে স্পেস-শিপ থেকে নামার সময় দরজায় গুঁতো খেয়ে মাথা ফুলে এই শিংদুটো গজায়। এটা কিছুতেই মিলিয়ে যাচ্ছে না। আমার আসল চেহারা স্ক্যান করে না পেলে আমার স্পেস-শিপের দরজা খুলবে না। আমাকে এখানে রেখেই স্পেস-শিপ ফিরে যাবে। টুকুভাই প্লিজ, হেল্প করো!”

“আমাকে ছোটো পেয়ে উলটোপালটা বলে ভয় দেখাতে চেষ্টা করছ, না? তুমি এলিয়েন-টেলিয়েন কিছু নও। আমি জানি, তুমি আসলে একটা ভূত। তোমাকে দেখে কেউ ভয় পায় না বলে তোমাকে অন্য ভূতেরা তাড়িয়ে দিয়েছে। তুমি নিশ্চয়ই ওই সাহেবদের পুরনো কবরখানাটায় থাকো। আমি বন্ধুদের কাছে শুনেছি, ওই পুরনো কবরখানায় অনেক সাহেব ভূত আছে। আর ওরা মাঝে মাঝে মানুষের রূপ ধরে আমাদের স্কুলের মাঠে ক্রিকেট খেলা দেখতে আসে।”

“না না টুকুভাই, আমি সত্যিই এলিয়েন। তোমাকে ভয় দেখাচ্ছি না। কাউকে বিনা কারণে ভয় দেখালে আমাদের গ্রহে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়। বিশ্বাস হচ্ছে না আমি এলিয়েন? এই দেখো, আমার সাথে আসা অন্য এক এলিয়েনকে দেখাচ্ছি।”

মাথায় শিংওয়ালা লোকটা তার হাতটা গ্রিলের ফাঁকে তুলে এনে হাতটা গুলি করার মতো ভঙ্গি করল। তার তর্জনী থেকে একটা আলোকরশ্মি বেরিয়ে এসে পড়ল সামনের দেওয়ালে। দেওয়ালটা যেন একটা টিভির পর্দা। তাতে দেখা গেল কোট-প্যান্ট পরা, টুপি মাথায় দেওয়া একটা লোক সমুদ্রের তলায় একটা গুহার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশ দিয়ে মাছের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে।

“যাও যাও, এরকম লাইট আমি আগে দেখেছি। এগুলোকে বলে লেজার টর্চ। তবে তোমারটা অনেক ভালো। এতে সিনেমা দেখা যায়। জাপানি নিশ্চয়ই!”

“টুকুভাই, যা দেখলে সব সত্যি। তোমাদের গ্রহে জলের নিচে এখনও মানুষ বাস করে না। অথচ তোমাদের গ্রহের চার ভাগের তিনভাগই জল। আমাদের গ্রহের মানুষরা এসে জলের নিচে থাকতে পারবে। কিন্তু তোমরা পারবে না। কারণ, আমরা হলাম তোমাদের গ্রহের উভচর প্রাণীর মতো। জলের নিচে বা ডাঙায় যেকোনও জায়গায় আমরা বেঁচে থাকতে পারি।”

“বললেই হল! আমি তোমাদের কথা পুলিশকে বলে দেব। ওরা তোমাদের জেলে ভরে দেবে।”

“টুকুভাই প্লিজ, আমার কথা শোনো, আমাকে একটু হেল্প করো। আমরা দেখা না দিলে আমাদের কেউ দেখতে পাবে না। তুমি ছাড়া কেউ কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে? আমি আমার স্পেস-শিপে ফিরে যাওয়ার আগে তোমার ওই স্মল বি-এর জায়গায় ডি ও ডি-এর জায়গায় বি এবং সিক্সের জায়গায় নাইন ও নাইনের জায়গায় সিক্স লেখার প্রবলেম ফিক্স করে দেব।”

“ফিক্স করে দেবে মানে? কুইক-ফিক্স আঠা লাগাবে বুঝি! আমি কি খেলনা? নাহ্‌, মাকেই ডাকতে হচ্ছে। আচ্ছা, তুমি মাকে এত ভয় পাও কেন বলো তো?”
“আরে, তোমার মার ওই সংস্কৃত উচ্চারণ শুনলেই আমার শরীর কাঁপতে থাকে। তাই তোমার মার থেকে দূরে থাকি।”
“তুমি যদি এত কিছুই পারো, তাহলে নিজের মাথার শিং ঠিক করতে পারছ না?”
“ওটা ঠিক করতে হলে তো আমাকে স্পেস-শিপে ঢুকতে হবে! কিন্তু সেটা তো করতে পারছি না ওই শিংয়ের জন্য। আমার আসল চেহারা স্ক্যান করে না পেয়ে স্পেস-শিপের দরজা খুলছে না।”
“তাহলে কী করবে?”
“টুকুভাই, তুমি একটু হেল্প করলেই আমার মাথার শিংদুটো চলে যায়।”
“আমি ছোট্ট মানুষ, আমি তোমাকে কী হেল্প করব? আমি কি ডাক্তার যে শিংদুটো কেটে দেব?”

“আমাকে আমার গ্রহ থেকে জানানো হয়েছে যে, তোমার দাদু যে তাঁর তৈরি করা কবিরাজি ওষুধের বড়িগুলো তোমাকে খাওয়াচ্ছে, সেটা আমি একসঙ্গে দুটো খেলে আমার এই শিংদুটো মাথা থেকে খুলে পড়ে যাবে।”
“তাহলে তুমি নিজেই দাদুর ঘর থেকে নিয়ে খেয়ে নিচ্ছ না কেন? তোমাকে তো আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না।”
“সেটি হবার যো নেই। আমি নিজে নিয়ে খেলে হবে না। অন্য কাউকে খাইয়ে দিতে হবে।”
“তাহলে তুমি দাদুকে বলো, তিনিই তোমাকে খাইয়ে দেবেন। আমার দাদুর মতো ভালো মানুষ আর পাবে না।”
“তোমার দাদুর ঘরে ঢোকার কি উপায় আছে? সে ঘরে যা হিংয়ের গন্ধ! আমার হিংয়ের গন্ধ একদম সহ্য হয় না।”
“হুম, বুঝলাম। তুমি আসলে একটা ভূত। আমি শুনেছি ভূতেদের হিংয়ের গন্ধ একদম সহ্য হয় না।”

“টুকুভাই, বিশ্বাস করো, আমি অন্য গ্রহের প্রাণী। আমাদের স্পেস-শিপ কালকে সকালেই তোমাদের পৃথিবীর সীমানা ছেড়ে আমাদের গ্রহের দিকে পাড়ি দেবে। আজ রাতের মধ্যে আমার শিংদুটো উঠিয়ে ফেলে দিতে না পারলে আমাকে ছেড়েই স্পেস-শিপ রওনা দেবে। তখন আমাকে পড়ে থাকতে হবে এই পৃথিবীতে।” বলে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করল শিংওয়ালা লোকটা।

“টুকু, এই টুকু, তুই এখনও জেগে আছিস!” বলতে বলতে দরজা ঠেলে মা ঘরে ঢুকল।

টুকু আড়চোখে দেখল, শিংওয়ালা লোকটা জানালা থেকে উধাও হয়ে গেছে।

“শিগগিরি ছাদে চল। ঝুমামাসি ফোন করেছিল। ওরা নাকি আকাশে কী একটা চকচকে জিনিস দেখতে পেয়েছে।”

রাতে খাবার টেবিলে বসে জোর আলোচনা চলছে আকাশের অজানা বস্তুটাকে নিয়ে।

“যাই বলুন বাবা, আমার মনে হয় ওটা কোনও চকচকে বেলুন হবে। কোনও সেলস গিমিক হয়তো, বিজ্ঞাপনের নতুন স্টাইল। দু’দিন পর জানা যাবে।” টুকুর মা বলল।

“এত লোক আকাশে চকচকে জিনিসটাকে দেখল, অথচ একটা ছবি কেউ তুলতে পারল না?” বললেন টুকুর দাদু।
“মিডিয়াও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।” বললেন টুকুর বাবা।

“আমি ঝুমাদিকে ফোন করেছিলাম। ওর ছেলে তো খুব ভালো ফটোগ্রাফার। ও অনেকগুলো ছবি নাকি তুলেছিল। কিন্তু কোনও ছবিতেই নাকি ওই চকচকে বস্তুটা ওঠেনি!” বলল টুকুর মা।

“তাজ্জব ব্যাপার!” বললেন টুকুর দাদু।
“কোনও ইউএফও নয়তো!” বলল টুকুর বাবা।
“ইউএফও!” ঝাঁজিয়ে উঠল টুকুর মা। তারপরই শুরু হল সংস্কৃতে বক্তৃতা।

টুকুর মার সংস্কৃত বলা শুরু হতেই তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে টুকুর বাবা আর দাদু উঠে পড়লেন। বেসিনে হাত ধুতে ধুতে দাদু হাঁক পাড়লেন, “দাদুভাই, ঘুমোতে যাবার আগে আমার ঘরে একবার এসো।”

শোবার আগে খাবে বলে দাদুর ঘর থেকে কবিরাজি ওষুধের দুটো বড়ি নিয়ে এসে প্লেটের ওপর রেখে দিয়েছে টুকু। নাহ্‌, একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। আসুক আবার শিংওয়ালা লোকটা। আচ্ছা, শিংওয়ালা লোকটা যদি সত্যি এলিয়েন হয়, আর ওদের গ্রহের প্রাণীরা যদি সত্যি সত্যি মানুষের মতো হয়, তাহলে ওদের গ্রহেও কি ছোটোদের স্কুলে যেতে হয়? ওদের গ্রহে কি আইসক্রিম পাওয়া যায়? এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল টুকু। ঘুম ভাঙল শিংওয়ালা মানুষটার ডাকে। “জাগো, টুকুভাই জাগো।”

“ওহ্‌, তুমি এসেছ?”

“আমাদের স্পেস-শিপটা তো দেখলে। আমাকে তুলে নেবার জন্য ওটা ঘুরছে। এবার আমাকে ফিরতে সাহায্য করো প্লিজ।”

“ও, ওটা তোমাদের স্পেস-শিপ ছিল? মা বলছিল ওটা কোনও চকচকে বেলুন হবে।”

“টুকুভাই, প্লিজ। আমাদের স্পেস-শিপটা আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই এখানে আসবে শেষবারের মতো। এবার শিংটা না ঝরিয়ে ফেলতে পারলে আমার চিরনির্বাসন ঘটবে তোমাদের গ্রহে।” টুকু স্পষ্ট দেখল চোখ দিয়ে জল ঝরছে লোকটার।

“তোমার ওষুধ তো আমি এনে রেখেছি। কিন্তু আমার ব্যাপারটা কী হবে?”
“তুমি ওষুধটা আমার মুখে ফেলার সাথে সাথে তোমার প্রবলেমও আমি ঠিক করে দেব। তাড়াতাড়ি করো। আমাদের স্পেস-শিপ এসে গেছে।”
“ঠিক করে দেবে তো? প্রমিস?”
“প্রমিস।”

প্লেট থেকে দাদুর দেওয়া কবিরাজি ওষুধের গুলিদুটো নিয়ে জানালার গ্রিলের বাইরে হাত গলাতেই টুকুর মাথায় পড়ল এক মোক্ষম আঘাত। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল টুকু।

“মেঝেতে শুয়ে ঘুমোচ্ছিস কেন টুকু?” মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল টুকুর। মাথাটা ঝনঝন করছে। “দেখেছ! জানালার গ্রিলে দুটো ছাগলের শিং এনে ফেলে রেখেছে কাকে!” টুকুর মা এগিয়ে গেল জানালার দিকে।

টুকুর পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে দাদু বেজায় খুশি। তাঁর ওষুধ দারুণ কাজ দিয়েছে। টুকু অঙ্কে ও ইংরেজিতে একশোতে একশো পেয়েছে।

অলঙ্করণঃ মৌসুমী

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s