গল্প শুধু কথা কল্যাণ সেনগুপ্ত বসন্ত ২০২০

কল্যাণ সেনগুপ্তের আগের গল্প বংশীধরের বিপদ

শুধু কথা

কল্যাণ সেনগুপ্ত

টানা তিরিশ মিনিট বলে থামলেন উৎপল। হল হাততালিতে ফেটে পড়ল। হলে আগুন ছড়িয়ে গেল। এমন করে কে আর ভেবেছে ওদের জন্যে? আরও দুয়েকজন বললেন। সরকার কী কী করেছে, করছে, সমাজের মূল স্রোতে আনতে কী কী করতে হবে। হলভর্তি মানুষ আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। গ্রিনরুমে কাগজের সাংবাদিক এসে ফটোগ্রাফার নিয়ে বসে পড়ে। “আজ স্যার একটু সময় দিতেই হবে। আজ আপনাকে ছাড়া যাবে না।”

উৎপলের আজ বাড়ি ফেরার তাড়া আছে। বাড়িতে মাধুরীর শরীরটা ভালো নেই। কিছুটা অসহায় বোধ করেন। কিন্তু সাংবাদিকরা কোনও কিছু শুনতে নারাজ। উৎপলের ভালোই লাগে ইন্টারভিউ দিতে। কাউকে বলা যাবে না, একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব বোধ তো হয়। সরকারি চাকরির ক্ষমতা এখন না থাকার শূন্যতা কিছুটা এতে পুষিয়ে যায়।

“স্যার, আপনি ‘সামাজিক সুরক্ষা’র সরকারি পুরস্কার পাওয়ার পরে মনে হয় এটাই আপনার প্রথম এই মঞ্চে রূপান্তরকামীদের নিয়ে বলা।”

উৎপল নীরবে মাথা নাড়লেন।

“এই রূপান্তরকামীদের নিয়ে ভাবনা-চিন্তা কবে থেকে?”

“হবে বেশ কিছুদিন। ছোটোবেলায় বাড়িতে নানা অনুষ্ঠানে ওদের দেখে নানা প্রশ্ন জাগত মনে। হয়তো তখন থেকেই চিন্তাভাবনা শুরু। ওদের নিয়ে পড়াশোনা অনেক পরে।”

“ভারতবর্ষের নানা জায়গার রূপান্তরকামীদের নিয়ে আপনি লিখেছেন। এসব তথ্য আপনি কি নিজে গিয়ে সংগ্রহ করেছেন?”

“কিছুটা। কিছুটা সরকারি তথ্যর সাহায্যে।”

“আপনার আগামী কোনও পরিকল্পনা?”

একটু উদাস মুখে উৎপল বলেন, “ওঁদের মূল স্রোতে ফেরানোই আমার প্রধান কাজ। একটু সময় লাগবে। আসলে কী জানেন তো, মানুষ মানে আমরাই প্রস্তুত নই ওঁদের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে নিতে।”

“আমরা শুনেছি রামায়ণ-মহাভারতে এঁদের কথা বারংবার বলা হয়েছে। মানে এঁরা আছেন, এঁরা থাকবেন, কিন্তু আমাদের সংবিধান দেখুন স্বীকৃতি দিতে ২০১৪ লাগিয়ে দিল। এটা আপনি কী বলবেন?”

“এটা আমাকে খুব নাড়িয়ে দিয়েছে। কোথায় যাবেন বলুন তো? স্কুল-কলেজে জায়গা নেই, রাস্তাঘাটে টিটকিরি, সরকারি কোটাও নেই। রাস্তাঘাটে পুলিশের তাড়া।”

“তাহলে বেঁচে থাকার অবলম্বন কী?”

“স্রেফ ভিক্ষে। আর পরিত্যক্ত ক্লেদাক্ত অসুস্থ্ পরিবেশে জীবনের বাকি সময় কাটানো। তারপর একদিন ম্যালেরিয়া, ফ্লু, এইচ.আই.ভি, আরও কত আঘাতে অকালে প্রাণ চলে যাওয়া, এই তো জীবন।”

“স্যার, আপনি কীভাবে ভাবছেন এখান থেকে বেরোতে?”

“প্রচার চাই। আরও সভা-সমিতিতে ওঁদের আনতে হবে। সবচেয়ে বড়ো দরকার শিক্ষার আলোতে আনা। কাগজে ওঁদের নিয়ে আরও লেখালেখি বাড়ানো।”

“অর্থনৈতিকভাবে কী করা উচিত বলে মনে হয়?”

“স্বনির্ভর ব্যাবসা করতে উৎসাহিত করা, ব্যাঙ্ক লোনের ব্যবস্থা করা। আর সরকারি ক্ষেত্রে আপাতত ওদের জন্যে কোটার ব্যবস্থা করা। কিছু বেসরকারি সংস্থা এর চেষ্টা করছে, কিন্তু সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।”

“স্যার, আপনি যে যেসব এন.জি.ও-র সঙ্গে জড়িত, তারা তো এদেশি বিদেশি সাহায্য পান। তাঁরা কতটুকু সত্যি এদের নিয়ে ভাবেন বা খরচ করেন?”

উৎপল একটু ধৈর্য হারান। “দেখুন, আমি যতদূর জানি এঁরা যথেষ্ট চেষ্টা করছেন। প্রচুর টাকাপয়সা খরচ হচ্ছে।”

“রূপান্তরকামীদের নিয়ে ক’টা বই আছে আপনার?”

“যেটা শীঘ্রই বেরোবে সেটা বাদ দিলে আরও তিনটে।”

“ওঁদের শিক্ষা সম্বন্ধে কিছু ভেবেছেন?”

“আমি একা কীই বা করতে পারি? পুলিশ কমিশনারকে আর হোম সেক্রেটারিকে আবেদন করেছি ওদের সাধারণ স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ করে দিতে হবে। এবার আমাকে যেতে হবে। আমাকে ছেড়ে দিন। অনেক দূর ফিরতে হবে। সেই সাউথে।”

“স্যার, শেষ প্রশ্ন।”

“আমার ড্রাইভার এসে গেছে, বলুন বলুন।”

“স্যার, শহরের কোন এলাকায় কাজ করেছেন বেশি? কলকাতার কোনদিকে ওঁদের বেশি অবস্থান?”

উৎপল আর দাঁড়ালেন না। জোর পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। ওরা কিছুদূর এসে থেমে গেল।

উৎপল রায় কলকাতার এক নাম। একদিকে লেখক, সমাজসেবী, ইউনিভার্সিটিতে বহুবছর পড়িয়েছেন। দেশ জুড়ে অনেক ছাত্রছাত্রী। একদিকে ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিদ্যা বিভাগের দায়, অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া নানা প্রান্তিক মানুষের কথা লেখালেখির মাধ্যমে তুলে ধরা। আজকাল বিভিন্ন সভায়, টিভিতে, রেডিও আলোচনাতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। ইদানীং সরকারের পুরস্কার পাওয়ার পরে প্রথম শ্রেণীর কাগজে ওঁর ছবি বেরিয়েছে। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ভালো পাত্র দেখে। ছোটো জামাই আমেরিকাতে একটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। অন্যজন বেঙ্গালুরুতে আই.টি.তে। এখন স্ত্রী এবং উনি থাকেন দক্ষিণ কলকাতার রাজা বসন্ত রায় রোডে একটি ফ্ল্যাটে। বছরের কয়েকমাস ওঁরা আমেরিকা ও বেঙ্গালুরুতে কাটান মেয়েদের কাছে। পূর্ণ সুখী জীবন বলা যায়। দুয়েকটা এন.জি.ওতে ওঁকে প্রায়ই যেতে হয়। ওখানেই মিস্টার মজুমদারের সঙ্গে আলাপ। উনিই প্রথম রূপান্তরকামীদের নিয়ে লিখতে উৎসাহ দেন। উনিই বাংলার প্রথম শ্রেণীর কাগজে লেখা ছাপানোর ব্যবস্থা করে দেন। সেই লেখা ছাপা হয়ে বেরোনোর পরে প্রচুর প্রশংসা ও চিঠিপত্র পেয়েছেন এবং এখনও পাচ্ছেন। রূপান্তরকামীদের নিয়ে তাই উৎসাহিত হয়ে সমাজ সচেতন মানুষজনকে এঁদের কথা আরও বেশি করে লেখালেখির মাধ্যমে তুলে ধরতে আরও লেখালেখি আর পড়াশুনোতে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। সরকারি পদ থেকে অবসর নেবার পর সময় দ্রুত কেটে যাচ্ছে। একটা পিঠ চাপড়ানো প্রশংসা অবসর জীবনকে অপ্রয়োজনীয় হবার হাত থেকে সন্তর্পণে বাঁচিয়ে রেখেছে। নিজের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে রোজ হাঁটাহাঁটি করেন। মাধুরী এতেই খুশি।

সাদার্ন অ্যাভিনিউ আর ল্যান্সডাউন মোড়ের কাছে গাড়ি দাঁড়াতেই উৎপল ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। “কাচ তোলো, কাচ তোলো!”

মাধুরী বলেন, “এত হুড়োহুড়ি করে কাচ তুলছ কেন?”

কাচ তোলার আগেই ওরা চলে আসে। জানালার মধ্যে দিয়ে হাত গলিয়ে কর্কশ ছেলেদের গলায় বলে, “দিদি, কিছু দেবেন না? আমি বলছি, ভগবান আপনাদের ভালো করবেন। সুখে রাখবেন।”

স্বরের মধ্যে একটা নিঃশব্দ আদেশ মাখা। উৎপল উত্তেজিত ওঠেন। “দেখেছ? দেখো এইবার।”

মাধুরী হালকা হেসে হাত দেখান। “চিন্তা কোরো না।” ব্যাগ থেকে একটা দশ টাকা বার করে ওদের হাতে দিয়ে গাড়ির কাচটা তুলে দেন। গাড়ি ছেড়ে দেয়। কিছুটা অবাক হয়ে বলেন, “তুমি এরকম হঠাৎ গুটিয়ে যাও কেন? ওদের দেখে কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলে। এত চারদিকে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াও আর তাদের দেখলেই এরকম গুটিয়ে যাও? বুঝি না বাপু তোমার এই দ্বিচারিতা।”

গাড়ি মোড় ছাড়িয়ে চলে এসেছে। উৎপল বাইরের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বলেন, “জানি না। আমার এরকম হওয়া উচিত নয় আমি জানি। সত্যি বলতে কী, ওদের দেখলেই আমার একটা অব্যক্ত অপরাধবোধ কাজ করে, আর আমি কেমন গুটিয়ে যাই। বলছি অনেক কিছু, কিন্তু করছি না কিছুই।”

মাধুরী হালকা হাসেন, “আমি দেখেছি আগেও।”

উৎপল বলেন, “ওরা সামনে এলে নিজেকে খুব ছোটো মনে হয়। সাজগোজে মেয়ে আর চেহারায়, গলায় ছেলে। বুঝতে পারি না কেমন হওয়া উচিত ওদের সঙ্গে আমাদের ব্যবহার।”

মাধুরী হাসেন। “তুমি একেকটা সভায় এদের নিয়ে কত কিছু বলো। যারা হাততালি দেয় তারা তোমাকে এমন দেখলে কী বলবে কে জানে।”

“হ্যাঁ, ছোটোবেলা থেকে বাড়িতে নানা অনুষ্ঠানে এরা আসত। মা কখনও শাড়ি, কখনও টাকা দিত। তখন অকারণে শক্ত হাতের তালি, কোমর দুলিয়ে হাঁটা, পুরুষালি গলায় ঠাট্টা-ইয়ার্কি কেমন ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। বুঝতে পারতাম, এরা অন্য জগতের মানুষ। কেউ বলেছিল ওরা বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যায়, বেঁচে দেয়। ওরা আমাদের মতো নয়। ওদের জগত সম্পূর্ণ আলাদা। কেন সেটা জানতাম না।”

“হ্যাঁ, আমারও একটা অস্বস্তি ছিল আগে। এখন দেখে দেখে অতটা নেই। বুঝি, ওরা আমাদের মতো নয়। কিন্তু দেখো ওদের নিয়ে কত হইচই, সভা, ওয়ার্কশপ তোমরা করছ। ওদের মানুষের মূল স্রোতে ফেরাতে।”

উৎপল বাইরের দিকে তাকিয়েই বলেন, “আমি জানি ওরা পয়সার জন্যে অনেক বাজে কাজে যুক্ত হয়ে যায়। পড়াশুনো প্রায় নেই বললেই চলে।”

“তোমরা তো এগোতে দেবে না। দেবে তোমার ছেলেমেয়ের স্কুলে ভর্তি হতে ওদের ছেলেমেয়েকে?”

উৎপল কোনও জবাব দেন না। দিতে পারেন না।

***

নার্সিং হোমে আজ উৎপলকে দেখে মাধুরীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। “বাহ্‌! এই তো উঠে বসেছ। কেমন আছ আজ?”

“আগের চেয়ে অনেক ভালো। তবে মাথার ব্যথাটা আছে। পায়ের পাতায়ও ক্র্যাক আছে বলছে। প্লাস্টার করতে হবে। হাঁটুর জন্যে ফিজিও করতে হবে। নাহলে ঠিকমতো হাঁটা মুশকিল হবে।”

মাধুরী বলেন, “এ-যাত্রা ভগবান বাঁচিয়েছেন। এসব দু’দিনে ঠিক হয়ে যাবে।”

“আবার ওঁকে ডাকছ কেন?”

“কী হতে পারত তুমি জানো?”

উৎপল জিজ্ঞাসা করেন, “কিছু খোঁজ পেলে, কে আমাকে নিয়ে এসেছিল?”

“না, পাইনি। নার্সিং হোমের গেটে অনেককে জিজ্ঞাসা করেছি। কেউ সঠিক বলতে পারছে না। রাস্তার লোকজন হবে। পুলিশও এই কথাই জিজ্ঞাসা করছিল।”

“আমারও সেন্স ছিল না, তাই দেখতে পাইনি। অনেকে পুলিশের জেরার ভয়ে নাম বলতে চায় না।”

ডাঃ সেন জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় হয়েছিল মনে আছে?”

“হ্যাঁ। আমি সাইকেল চালিয়ে আসছিলাম। এটা হয়েছে সাদার্ন অ্যাভিনিউ আর ল্যান্সডাউন মোড়ের কাছে। আমি রেড লাইট দেখে দাঁড়িয়েছি, আর পিছন থেকে একটা মনে হয় কোনও গাড়ি ধাক্কা মারল। তারপর আর কিছু মনে নেই।”

ডাঃ সেন বললেন, “সম্ভবত রাস্তার লোকজন ধরাধরি করে নিয়ে এসেছিল। আমরা আপনার পকেট থেকে মোবাইল বার করে ফোন করি আপনার বাড়িতে।”

মন পড়ে আছে নার্সিং হোমে, তবুও মাধুরী দু-তিন দিন খেয়াল করেছেন, সেই রাস্তার মোড়ে এসে গাড়ি থামলেই আজকাল মেয়েগুলো হামলে পড়ে গাড়ির কাচের ওপর। পেয়ে পেয়ে মেয়েগুলো চিনে গেছে মাধুরীকে। তাই আজকাল আর জানালা ধাক্কালেও কাচ নামান না। একটু বিরক্তই হন। উৎপলের ঠিকই বিরক্ত হওয়ার কারণ আছে। কেউ কিছু এদের জন্যে করেও না। রোজ যেন সংখ্যায় বাড়ছে। আজ আবার ধাক্কাধাক্কি দেখে বিরক্ত হয়ে একটা দশ টাকার নোট নিয়ে অগত্যা কাচ নামান।

মেয়েদুটি জিভ কাটে। “ছি ছি, টাকার জন্যে নয় বৌদি। দাদা কেমন আছে?”

মাধুরী বিস্মিত হন। “তোমরা চেনো দাদাকে!”

“দিদি কী বলছেন? খুব চিনি। দু’দিন আগে এইখানেই তো দাদার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল গাড়ির ধাক্কা লেগে। আপনারা তো সামনের রাস্তার বাঁদিকের গলিতে থাকেন।”

মাধুরীর মনে পড়ে, তাই তো। এখানেই হয়েছিল। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “তোমরা জানো ঠিক কী হয়েছিল ওর?”

একটি মেয়ে অন্য আরেকজনকে বলে, “বিনীতা, তুই বল। তুই বল।”

বিনীতা বলে মেয়েটি সামনে আসে। “গাড়িটা দাদার সাইকেলটা মেরে চলে গেল আর দাদা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।”

“তারপর?”

“কী বলব বৌদি, একটা মানুষও এগিয়ে এল না হাসপাতালে নিয়ে যেতে। শুধু কেউ কেউ এগিয়ে এসে ধরাধরি করে ফুটপাথের ধারে রাখে দাদাকে, ব্যস। বুঝলেন না, হাসপাতালে নিয়ে গেলে পুলিশ কেস। কে আর জড়ায়? শেষে আমরা কয়েকজন ধরাধরি করে তুলে সামনের নার্সিং হোমে নিয়ে যাই। ভাঙা কুলো আছে। কিন্তু আমাদের তো জানেন লোকে কোথাও ঢ়ুকতে দেয় না।”

মাধুরী উদ্বিগ্ন গলায় বলেন, “তোমাদের ঢ়ুকতে দেয়নি? ছি ছি! আশ্চর্য! তোমরা কিছু বলোনি?”

মেয়ে দুটি ম্লান হাসে। “কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, কিন্তু ভিতরে যেতে দেয়নি। ঝামেলা করতে পারতাম, কিন্তু ইচ্ছে হয়নি। উদ্বিগ্ন ছিলাম, কারণ জ্ঞান ফেরেনি যখন নিয়ে যাই।”

“তোমরা বলেছিলে যে তোমরাই ওঁকে এনেছে?”

ভাঙা গলায় একজন বলে, “দিদি, একটা কথা বলি? নিজেদের এই জীবনের ওপরই ঘৃণা ধরে গেল এই দেখে দেখে।”

বিনীতা বলে, “অথচ দেখুন, এই জীবনের জন্যে আমরা কেউই দায়ী নই। সেদিন থেকেই তাকিয়ে থাকি কখন আপনার গাড়ি যাবে আর আপনার কাছ থেকে জানতে পারব দাদা কেমন আছে।”

মাধুরী ম্লান হাসে। “জ্ঞান ফিরেছে। মাথায় চোট লেগেছে, হাতে আর পায়ের আঙুলে ক্র্যাক হয়েছে। ডাক্তার ওয়াচে রেখেছে কিছুদিন।”

“ইস! কী বিচ্ছিরি ব্যাপার দেখুন দেখি? খুবই কষ্ট পাছেন তো দাদা? আজকাল কেমন করে ছেলেমেয়েরা গাড়ি চালায় দেখুন। আমরা ধরতে গেছিলাম, কিন্তু গাড়ি ছেড়ে দিল, আর ধরা গেল না।”

মাধুরী কী বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না। বলেন, “তোমরা অনেক করেছ। আমি কী বলে যে তোমাদের ধন্যবাদ জানাব জানি না।”

আরেকটি মেয়ে এগিয়ে আসে এবার। পুরুষালি গলায় বলে, “আসলে নিজের হাতে রেখে এলাম তো, তাই চিন্তা হচ্ছিল। আমাদের তো মানুষই মনে করে না কেউ।”

মাধুরী লজ্জায় বলে ওঠেন, “না না, ওরকম সবাইকে ভেব না। দেখো, সবাই তো সমান নয়। আমি তো জানি তোমরা কী সাংঘাতিক উপকার আমার করেছ। যখন কেউ নিয়ে যেতে চায়নি সেই সময় দাদাকে নিয়ে গেছ। তোমরা ঠিক সময় নিয়ে গেছ বলে দাদা বেঁচে গেল। নাহলে কী হত জানি না। তোমাদের এই ঋণ আমি কোনওদিন ভুলতে পারব না।”

বিনীতা বলে মেয়েটি এগিয়ে আসে কিছু বলবে বলে, কিন্তু এমন সময় লাল আলো সবুজ হয়। গাড়ি ছেড়ে দেয়। মুখ বাড়িয়ে মাধুরী কিছু বলবার চেষ্টা করেন। কিন্তু দানবীয় মিলিত হর্ন আর অন্যান্য শব্দের ভিড়ে চাপা পড়ে যায়। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে আঁচলে মুখ চাপা দেন উদ্গত কান্না চাপা দিতে। ওদের সামনে নিজেকে ভীষণ ছোটো লাগে। ওদের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও লজ্জা লাগছিল। গাড়ির আলো সবুজ হতে মাধুরী বেঁচে যান। উৎপলরা, সরকার, সামাজিক সংগঠন—সবার চেষ্টা কি শুধু কথাতেই থেকে যাচ্ছে? আসলে পালটাতে হবে আমাদের, আর আমরা ওদের আমাদের মতো করার চেষ্টা করছি। কেমন মানুষ আমরা? কত জন্ম লাগবে ওদের বুকে টেনে নিতে? জানালার বাইরের চলমান ইট-কাঠের জগতটা আর তার এই ভেদাভেদ রক্তাক্ত করে দেয় মনকে। চেয়ে-চেয়েই দু’চোখের বাঁধভাঙা জল গাল বেয়ে ঝরতে থাকে। চাপতে পারেন না।

অলঙ্করণঃ মৌসুমী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে