গল্প অদ্ভুত ভূত অমিতাভ সাহা বসন্ত ২০১৮

golpoadvhut_vhut (Large)

গোবিন্দবাবুর কাপড়ের ব্যাবসা। মফঃস্বলে তাঁর কাপড়ের দোকান। প্রচুর কাস্টমার। সব সময়ের সঙ্গী কর্মচারী মদন। মদনকে যেমন ভালবাসেন তেমনি পান থেকে চুন খসলে বকাবকির সীমা থাকে না। মদন বাধ্য ছেলের মত সব কথা শোনে, কারণ জানে বকাবকি করলেও তাকে ছাড়া বাবুর একদণ্ড চলবে না। সবসময় ফাইফরমাস লেগেই আছে, “এই মদনা! এটা নিয়ে আয়। ওটা নিয়ে আয়।”

সেদিন মদন বলছিল, “বাবু! তিন বছর ধরে ১০০০ টাকা মাইনেয় কাজ করে যাচ্ছি। এবার একটু বাড়ান। সংসার যে আর চলছে না।”

বাবু বললেন, “আর যখন তখন ছুতোয়নাতায় একে ওকে দেওয়ার নাম করে যে শাড়ি, ধুতি, গামছা, লুঙ্গি নিয়ে যাচ্ছিস, সেগুলো কে দিচ্ছে রে নচ্ছার ব্যাটা! ফের যদি বেতন বাড়াবার নাম করবি তো চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেব।”

গোবিন্দবাবুর বাড়ি পাড়া গাঁয়ে। বাড়িতে বউ পার্বতী আর ছেলে খোকা। বাড়ির পেছনে পুকুরপাড়ে যে সজনেগাছটা ছিল, ওখানে একটা ভূত থাকত। বাড়ির কাজের মেয়ে বাসন্তী ভূতটাকে প্রথম দেখে। একদিন রাত্রিবেলা বাড়ির জঞ্জাল ফেলতে পুকুরপাড়ে যাচ্ছিল। আবছা আলোয় দেখে গাছের ডাল সমানে নড়ছে। ভয় পেয়ে গেল, কি ওটা? বড়সড় কিছু মনে হচ্ছে। ঘরে এসে টর্চলাইট নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল। তারপর কিছুটা দূর থেকে সজনেগাছে লাইট মারল। দেখে একটা কঙ্কাল হাপুসহুপুস করে কি যেন খাচ্ছে। লাইট পড়তেই নাকী সুরে বলে উঠল, “কিঁরেঁ বাঁসঁন্তীঁ, খাঁবিঁ নাঁকিঁ?”

বাসন্তী তৎক্ষণাৎ চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। গোবিন্দবাবুর ছেলে খোকা পড়তে বসে ফাঁকি মারার ফন্দিফিকির খুঁজছিল আর পার্বতী আরাম করে চায়ের পেয়ালা হাতে টিভি সিরিয়াল দেখছিলেন।

খোকা বলল “মা, কী যেন একটা আওয়াজ হল?”

“খালি ফাঁকি মারার ধান্দা। পড় মন দিয়ে”- মা বললেন।

খোকা বলল, “সত্যি বলছি, বাসন্তীর গলা মনে হল।”

মা-খোকাতে মিলে এদিক ওদিক খুঁজে পুকুরপাড়ে এসে দেখে বাসন্তী ভির্মি খেয়ে পড়ে আছে। দুজনে মিলে বাসন্তীকে তুলে এনে চোখেমুখে জলের ছিটে দিলেন। বাসন্তী সম্বিৎ ফিরে পেল আর বলল, “ও মা গো! ভূতের খপ্পরে পড়লুম যে!” 

খোকার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আর যাব না পুকুরপাড়ে! আমি স্বচক্ষে ভূত দেখেছি গো!” বলে কাঁদতে লাগল।

পার্বতীর তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না। বাসন্তী অনেক করে বলার পর পুকুরপাড়ে গিয়ে গাছে টর্চ মেরে দেখলেন। কিছুই দেখতে পেলেন না। শুধু দেখার মধ্যে গাছের গোড়ায় অনেকগুলো মাছের কাঁটা। এত মাছের কাঁটা জড়ো করা তো বিড়ালের কম্ম নয়। তাহলে এল কোথা থেকে? মনে খটকা লেগে রইল।

গোবিন্দবাবু রাত দশটায় বাড়ি ফিরলেন। বাড়ি এসে এই কাণ্ড শুনলেন। এতবছর এ অঞ্চলে আছেন, কোনদিন বাড়িতে ভূতের উপদ্রব হয়নি। পরদিন সকালে পাড়ায় চাউর হতে বাকি রইল না। মালতির মা এসে বললেন, “জান গো পার্বতী, কাল সন্ধেবেলা মালতির বাপ বাজার থেকে অনেক দিন পর একটা বড় রুইমাছ এনেছিল। মাছভাজার পর গেছিলাম টুনিদের বাড়িতে পান আনতে। এসে দেখি এক খাবলা মাছ নেই। ভূতে নির্ঘাত আমার বাড়ির মাছ চুরি করে এখানে এসে খেয়েছে।”

পার্বতীঃ “সত্যি কি ভূত? আমার কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না। বাসন্তী বলছিল বটে ও স্বচক্ষে দেখেছে। তাই তো বলি গাছের গোড়ায় এত মাছের কাঁটা এলো কোত্থেকে? ভূতে শেষমেশ মাছ চুরি করল।”

পাশ থেকে একজন বলল, “কদিন আগে ও’পাড়ার ষষ্ঠীর বাপ মারা গেল না? শুনেছি ছেলে ঠিকঠাক খেতে পরতে দিত না। শেষে অযত্নে মারা গেল। ঐ বুড়ো মাছ খেতে খুব ভালবাসত শুনেছি। আমার মনে হয় ঐ বুড়োই মরার পর মেছো ভূত হয়েছে।” শুনে সবার হাত-পা ঠাণ্ডা।

ক’দিন পর সবাই ঘটনাটা ভুলে গেলেন। একদিন রাত্রিবেলা পার্বতী রান্নাঘরে মাংস রান্না করছিলেন। শীতের জ্যোৎস্না রাত ছিল। রান্নাঘরের জানলা খুললে পুকুরপাড় পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। গাছের পাতার খসখস আওয়াজ শুনে সজনেগাছটার দিকে তাকালেন পার্বতী। দেখলেন একটা কঙ্কাল গাছের ডালে বসে নাকি সুরে বলছে, “কিঁ বৌঁদিঁ!মাঁঙসঁ রাঁন্নাঁ কঁরছঁ বুঁজিঁ? খাঁসাঁ খোঁশবোঁ বেঁরিঁইয়েছেঁ তোঁ?” পার্বতী চিৎকার দিয়ে ফিট হয়ে গেলেন।

টিভির ঘর থেকে বাসন্তী ছুটে এল। বউদিকে নিয়ে গিয়ে মাথায় জল ঢেলে পাখার বাতাস করার পর জ্ঞান এল। গোবিন্দবাবু বাড়ি ফেরার পর বউ বললেন “ও গো, তুমি কালই আমাকে বাপের বাড়ি দিয়ে এস গো! আমি এই ভূতুড়ে বাড়িতে থাকব না।” গোবিন্দবাবু ভুতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বললেন, “তুমি আমাকে ক’টা দিন সময় দাও বাপু। আমি ভূত তাড়ানোর বন্দোবস্ত করছি।”

ক’দিন পর সন্ধেবেলা বাজার থেকে পাক্কা এক কেজির একটা ইলিশ কিনে আনলেন। বউকে বললেন, “ভালো করে রাঁধো, অনেকদিন ইলিশ খাইনি।” পার্বতী মাছ কেটে ধুয়ে যখন কড়াইতে ভাজতে লাগলেন, চতুর্দিক গন্ধে মঁ মঁ করতে লাগল। গোবিন্দবাবু স্ত্রীকে বললেন, “তুমি ক’টা মাছভাজা বাটিতে করে রান্নাঘরের জানলার কাছে রেখে এস।” রান্নাঘরের আলো নিভিয়ে দুজনে ঘরের কোণায় বসে রইলেন। গোবিন্দবাবু থাকাতে পার্বতীর একটু সাহস হল। কিছুক্ষণ পরে কঙ্কাল এল, আবছা আলোয় দেখা গেল। তারপর মাছের বাটিটা তুলে নিয়ে বাড়ির পেছনের সজনেগাছে উঠে পড়ল। গোবিন্দবাবু টর্চলাইট নিয়ে সজনেগাছে লাইট মারলেন। কঙ্কাল আবার নাকি সুরে বলে উঠল, “খুঁব চঁমঁৎকাঁর হঁইয়েঁচেঁ সোঁয়াঁদ! এঁমঁন ইঁলিঁশ অঁনেঁকদিঁন খাঁইনিঁ।”

“এই কোথায় গেলি তোরা সবাই”-গোবিন্দবাবু হাঁক লাগালেন।

ওমনি ৮-১০ জন ছেলেছোকরা কেউ লাঠি কেউ বাঁশ নিয়ে হৈহৈ করতে করতে ছুটে এল। ভূতবাবাজীর আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়! উনি ভাবতে পারেননি এত লোক একসাথে তেড়ে আসবে। কঙ্কাল ঝুপ করে গাছ থেকে পড়ে দৌড়াতে লাগল। সবাই পিছু ধাওয়া করল। জ্যোৎস্না রাত তাই পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। শেষে একটা জমির আলের উপর হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল কঙ্কাল। ছেলেছোকরা সবাই মিলে ঘিরে ধরল আর সঙ্গে চলল এলোপাথাড়ি উত্তমমধ্যম আর লাথি। গোবিন্দবাবু সামনে এগিয়ে এলেন। কঙ্কাল তার পায়ে গিয়ে পড়ল। “এবারের মতন ছেড়ে দিন বাবু! আমি মদনা” বলে কেঁদে উঠল কঙ্কাল।

“হারামজাদা মদনা তুই! এতদিন ভূত সেজে ইয়ারকি মারা হচ্ছিল” বলে লাথি মারতে উদ্যত হলেন।

“বিশ্বাস করুন বাবু। আমার অভাবের সংসার। হাজার টাকা বেতনে আজকাল সংসার চলে? কতদিন ভালমন্দ খাইনি। আমার শখ হয় না বুঝি? এবার কালীপূজোর সময় ঐ যে বহুরূপীর দল “ভূতের মুখে রামনাম” পালা করতে এয়েছিল, ওদের কাছ থেকেই এই পোশাকটা ধার করেছিলুম।”

গোবিন্দবাবু দেখলেন, মাথা থেকে পা অব্দি একটা কালো পোশাক, শুধু মাথার খুলি, হাত-পা, বুকের পাঁজরগুলো চকমাটি দিয়ে সাদা করে দেওয়া যাতে অন্ধকারে শুধু হাড়গুলোই দেখা যায়। এবার তিনি বলে উঠলেন, “এসো তোমাকে জামাই আদর করে ইলিশ মাছ খাওয়াচ্ছি। কান ধর। ১০০ বার উঠবস কর।”

কঙ্কাল কান ধরে উঠবস করতে লাগল আর সবাই হোহো করে হাসতে লাগল।

ছবি জয়ন্ত বিশ্বাস

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s