মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের আরো গল্প কালাচাঁদ হাইলাকান্দির হুডিনি, ভূত জোলাকিয়া রংঝুরি রহস্য, ভয় আমাদের বিচিত্র অনুষ্ঠান
অশৈলী কান্ড জোড়াকদমে
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
এক
পিচ-রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুটো কদমগাছ। গাছদুটোর নামে এই ছোটো জনপদের নাম—জোড়াকদম। গ্রীষ্মকাল ফুরোতে না ফুরোতেই দুটো গাছের পাতা ঢেকে যায় কদমফুলে। ফুলের মিষ্টি গন্ধ দূর থেকে নাকে আসে। আজ জোড়াকদমের সামনেই ঘটল ঘটনাটা। দুপুরবেলা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল সুমেরু আর কুমেরু। ড্রেনের কিনারে দাঁড়ানো একটা ছোটো কুকুরছানা পা পিছলে পড়ে গেল গভীর ড্রেনের মধ্যে।
দু’জনে যমজ ভাই হলেও সুমেরু বয়সে কয়েক মিনিটের বড়ো। তার ওপরই দায়িত্ব বর্তায় বেশি। পিঠের ব্যাগ রাস্তায় নামিয়ে সুমেরু উবু হয়ে বসল ড্রেনের সামনে। ড্রেনের ভেতর থেকে কুকুরছানাটা কাতর স্বরে ডাকছে। নিচু হয়ে সুমেরু ড্রেন থেকে টেনে তুলল কুকুরটাকে। আলতো করে ধরে নিয়ে এল জলের ট্যাপের কাছে। ভাইকে হুকুম দিল, “হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিস কী? জলের ট্যাপটা ঘোরা শিগগির!”
কুমেরু ট্যাপ ঘুরিয়ে দিতেই হু হু জল পড়তে শুরু করল। তার মধ্যে ধরতেই ছানাটার গা থেকে নোংরা ধুয়ে মুছে গেল। পরিষ্কার ধোপদুরস্ত চেহারা হয়ে গেল দিব্যি। কুকুরটার পেছনের একটা পা জখম হয়েছে। পাঁজরের কাছটাও ফুলে রয়েছে চোট লেগে। সুমেরু বলল, “এখন এটাকে নিয়ে কী করি? রাস্তায় এ অবস্থায় ফেলে রাখলে ঠাকুর পাপ দেবে।”
কুমেরু একটু ভেবে বলল, “বাড়ি নিয়ে চল। চিলেকোঠার পেছনদিকটায় ডাঁই করে রাখা পুরনো খবরের কাগজ, পুরনো জুতোর বাক্স এসবের স্তূপ। ওখানে আপাতত রাখব। একটু ফিট হয়ে গেলেই ছেড়ে দেব। এখন রাস্তায় নামিয়ে দিলে বেচারি মারা পড়বে।”
পা টিপে টিপে বাড়িতে ঢুকল সুমেরু। পেছন পেছন কুমেরু, তার হাতে ধরা পাটকিলে রঙের কুকুরছানাটা। মা রান্নাঘরে থাকায় সুবিধে হল। শব্দ না করে দোতলার চিলেকোঠায় উঠে গেল কুমেরু। সেখানে কুকুরটাকে রাখল ঢাকাঢাকি দিয়ে।
দুই ভাইয়ের মর্নিং স্কুল। দুপুরবেলা স্কুল থেকে ফিরে ভাত খায় দু’জন। আজ নাকেমুখে গুঁজেই সুমেরু আর কুমেরু উঠল চিলেকোঠায়। একটা বাটির মধ্যে খানিকটা ভাত আর দু-তিনটে মাংসের টুকরো নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে করে। প্রথমে একটু গন্ধ শুঁকল, তারপর দিব্যি খেতে শুরু করল কুকুরছানাটা। দুই ভাই কোমরে হাত দিয়ে খাওয়া দেখছিল। সুমেরু বলল, “একটু প্রোটিন ভিটামিন পেল। এবার দেখবি সুস্থ হয়ে উঠবে।”
কুমেরু কুকুরছানাটার গা মুছিয়ে ভালো করে মলম লাগিয়ে আবার রেখে দিল যথাস্থানে। মায়ের নজর এড়িয়ে দুই ভাই একটুক্ষণ পরপর পালা করে গিয়ে দেখাশোনা করতে লাগল কুরকুরটাকে। সুমেরু বলল, “এর একটা নাম দিতে হয়। কী নাম দেওয়া যায় বল তো?”
কুমেরু সদ্য ছেলেদের মহাভারত বইটা শেষ করেছে। সোৎসাহে বলল, “একটা ওজনদার নাম দে। আচ্ছা, এটার নাম অলম্বুষ দিলে কেমন হয়?”
সুমেরু মাথা নেড়ে বলল, “অলম্বুষ তো রাক্ষস! তার চাইতে বরং ওর নাম দেওয়া যাক লুব্ধক। কালপুরুষের শিকারি কুকুরের নাম লুব্ধক।”
দাদার যেকোনও আজ্ঞাই কুমেরুর শিরোধার্য। কুমেরু ঘাড় হেলিয়ে বলল, “বাহ্, বেশ নাম।”
দুই ভাইয়ের মধ্যে যখন কুকুরের নাম নিয়ে শলাপরামর্শ হচ্ছিল তখন নিচ থেকে ডাক দিলেন মা। করালীস্যার পড়াতে এসেছেন। সুমেরু আর কুমেরু ভালো মানুষের মতো বইপত্তর গুছিয়ে চলে এল পড়ার ঘরে।
নাম শুনে রাগী মনে হলেও করালীস্যার মোটেই তেমন মানুষ নন। ফর্সা, রোগাপানা চেহারা, মাথায় মেয়েদের মতো বড়ো বড়ো চুল। কথা বলেন হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। বিয়ে-থা করেননি। মানুষটার একটাই নেশা। সেটা হল অভিনয়। জোড়াকদম যুব সংঘ ফি-বছর দুর্গাপুজোর পর পাড়ার চণ্ডীতলায় তিনদিক খোলা মঞ্চে যাত্রা মঞ্চস্থ করে। ক্লাবের সদস্যরাই অভিনয় করেন সেখানে। সেখানে প্রতিবারই মহিলার চরিত্রে মাতিয়ে দেন করালীস্যার। গতবছর রানি রাসমণি পালায় লিড রোল করেছিলেন। দর্শকরা কেঁদে ভাসিয়েছিল করালীস্যারের অভিনয় দেখে।
এবার জোড়াকদম যুব সংঘ কপালকুণ্ডলা পালা নামাচ্ছে। রিহার্সাল শুরু হয়েছে সন্ধেবেলা করে। নবকুমারের পার্ট করছেন দুঁদে মোক্তার ইমদাদুল খন্দকার। কপালকুণ্ডলার পার্ট করছেন করালীস্যার। বাকিদের প্রায় হয়ে এলেও তাঁর এখনও পার্ট মুখস্থ হয়নি। সংলাপ বলতে গেলে মাঝেমধ্যে খেই হারিয়ে যাচ্ছে। যাত্রার সংলাপটা আরেকবার ঝালিয়ে নেবেন ভেবে অন্যমনস্ক স্বরে বললেন, “কপালকুণ্ডলা থেকে একটা অংশ দিচ্ছি। নবকুমার যেখানে বলছেন, দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বীতমালি বনরাজিনীলা আভাতিবেলা লবনাম্বুরাশি ধারানিবদ্ধেব কলঙ্করেখা। সেটা ইংরেজিতে তর্জমা করো।”
চিলেকোঠা থেকে মায়ের হাঁকডাক কানে এসেছে। করালীস্যারকে বসিয়ে রেখে দুই ভাই ছুটল ঘটনাস্থলে। মা দাঁড়িয়ে আছেন কোমরে হাত দিয়ে। সুমেরুকে দেখে চোখ পাকিয়ে বললেন, “কোত্থেকে তুলে নিয়ে এসেছিস কুকুরছানাটাকে? পড়াশোনার বারোটা বাজবে দুটোরই। এক্ষুনি বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আয়। তোদের বাবা ফিরলে কী কাণ্ড হবে বুঝতে পারছিস?”
সুমেরু আমতা আমতা করে বলল, “লুব্ধক কেমন কাঁপছে দেখছ? ওকে এখন বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেললে বেচারি আর বাঁচবেই না।”
মা নড়া ধরে কুকুরছানাটাকে তুলে নিয়ে এলেন। চোখ পাকিয়ে বললেন, “রাস্তার কুকুর তুলে এনে তার আবার নাম দেওয়াও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে? আর নামকরণেরও বলিহারি! এই হাড়জিরজিরে কুকুরছানার নাম কিনা লুব্ধক?”
দুই ভাই দাঁড়িয়েছিল অপরাধী অপরাধী মুখ করে। মায়ের মনটা নরম হয়ে গেল ছানাটাকে দেখে। মৃদু স্বরে বললেন, “ইস, বেচারি তো ছাগলছানার মতো কাঁপছে! তোদের শিকারি কুকুর তো নিজেই শিকার হয়ে যাবে রাস্তায় দিয়ে এলে! গন্ধগোকুল আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে দেবে এটাকে। দাঁড়া, কী করা যায় দেখি।”
মা নিজেই গিয়ে জল গরম করে আনলেন। তাতে ডেটল মিশিয়ে, সেঁক দিয়ে, নিওস্পোরিনের গুঁড়ো লাগিয়ে বললে, “দু’দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবে এটা। যা, তোরা এবার পড়তে যা।”
কখন যেন লুব্ধক এসে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে করালীস্যারের পা চাটতে শুরু করেছে। লাফ দিয়ে উঠলেন করালীস্যার। আঁতকে উঠে বললেন, “এ-বাড়িতে কুকুরছানা কোথা থেকে এল?”
বলতে না বলতেই পায়ের চেটো দিয়ে ছোট্ট একটা শট। তাতে লুব্ধক গড়িয়ে গেল দু’হাত। ল্যাজ গুটিয়ে পালাল পরিত্রাহী। কুমেরু হাউমাউ করে প্রতিবাদ করে উঠল, “ওকে ওরকম করে মারলেন কেন স্যার?”
কুকুরছানাটাকে আলতো করে মারলেও করালীস্যারের অপরাধবোধ হচ্ছিল। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠলেন কুকুরটাকে খুঁজতে। তাঁর পেছন পেছন সুমেরু-কুমেরু। সকলে খোঁজাখুঁজি করছিল খাটের তলে আর আলমারির পেছনে। লুব্ধককে পাওয়া গেল না কোথাও। সুমেরু কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, “কুকুর হলেও মান-অপমানের বোধ আছে ওর। লুব্ধক চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। এই বাড়িতে আর ফিরে আসবে না।”
কিন্তু সুমেরুর ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে লুব্ধক উঁকি দিল দরজার ওপাশ থেকে। করালীস্যারকে এগিয়ে আসতে দেখেই সে আবার দে ছুট। সিঁড়ি দিয়ে সোজা চিলেকোঠার ঘরে উঠে গেল চোখের নিমেষে।
মা চা-বিস্কুট দিয়ে গেলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে করালীস্যার ঘড়ি দেখলেন। সাতটার সময় চণ্ডীমণ্ডপে রিহার্সাল আছে। মনটা মহড়ার দিকে চলে যাচ্ছিল বারবার। ছাত্ররা পারছে না দেখে নিজেই ট্রান্সলেশনটা করে দিতে গিয়ে থমকে গেলেন। আকাশপাতাল ভেবেও কুলকিনারা পেলেন না। ঝোঁকের মাথায় ট্রান্সলেশনটা করতে দিয়ে নিজেই এখন বেকুব হয়ে গেছেন। এমন সময় কুঁই কুঁই শব্দ। লুব্ধক কখন যেন চিলেকোঠা থেকে নেমে এসেছে। দরজার ফাঁক দিয়ে চোখ পিটপিট করে মনোযোগ দিয়ে তাঁকেই দেখছে। নাহ্, আজ আর হবে না। হতাশ হয়ে উঠে পড়লেন করালীস্যার। একহাতে টর্চ, অন্য হাতে ছাতাটা নিয়ে গুটিগুটি এগোলেন দরজার দিকে। তাঁকে আসতে দেখে লুব্ধক আবার দৌড়ে পালাল।
স্কুলজীবনে ভূগোল ছিল বিষুববাবুর ধ্যানজ্ঞান। বরাবর ভূগোলে হায়েস্ট নম্বর পেতেন। ইচ্ছে ছিল ভূগোলের মাস্টারমশাই হবেন। তা হয়নি। তিনি হয়েছেন স্টেশন মাস্টার। সেই খেদ মেটাতে তাঁর দুই যমজ ছেলের নাম রেখেছেন সুমেরু আর কুমেরু। বিষুববাবুর যখন বাড়ি ফিরছিলেন তখন করালীস্যারের সঙ্গে দেখা। ছেলেদের পড়াশোনা কেমন হচ্ছে জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর বললেন, “খবর শুনেছেন তো? পঞ্চানন জলাতঙ্কে মারা গেল আজ।”
পঞ্চানন অপঘাতে মারা যাওয়ায় করালীস্যার যে খুব দুঃখিত হলেন তা নয়। সবজায়গাতেই কিছু মারকুটে জোয়ান থাকে। পঞ্চানন তেমন ধাঁচের লোক। হোঁৎকা চেহারা। গায়ে অসুরের শক্তি। গলার আওয়াজ ফাটা বাঁশের মতো। জোড়াকদম হাটে পাঁঠার মাংসের দোকান। স্বভাব সুবিধের নয়। দিনেদুপুরে ওজনে চুরি করে। খদ্দের প্রতিবাদ করতে গেলে উলটে পঞ্চাননই হম্বিতম্বি করে। দুর্গাপুজো, কালীপুজোর সময় পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে চাঁদা তুলতে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে গোল বাধায়। হাতাহাতি আর মারামারি করার ব্যাপারে পঞ্চাননের জুড়ি নেই। করালীস্যার মুখটাকে করুণ করার চেষ্টা করতে করতে বললেন, “আহা, পঞ্চানন আর নেই শুনে বড্ড ইয়ে, মানে দুঃখ হল।”
সুমেরুদের বাড়ির গেটের দু’দিকে দুটো শ্যাওড়াগাছ। একা একা অন্ধকারে শ্যাওড়াগাছের পাশ দিয়ে যেতে গা ছমছম করে। ভূতে ভয় পাওয়ার ব্যাপারে ছাত্রের বাবার কাছে অনুযোগ জানানো একজন শিক্ষকের পক্ষে মোটেই গৌরবজনক নয়। তবুও লজ্জার মাথা খেয়ে করালীস্যার কথাটা বিষুববাবুকে বলেই ফেলেছিলেন একদিন। বলেছিলেন শ্যাওড়া গাছদুটো কাটিয়ে দিতে। সেই অনুরোধ রাখেননি বিষুববাবু। সমস্যার অন্য একটা সুরাহা করেছিলেন। সেদিনের পর থেকে সন্ধেবেলা পড়া হয়ে গেলে সুমেরু-কুমেরু হাটখোলার মাঠ পার করে করালীস্যারকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসে।
আজও করালীস্যারকে চণ্ডীমণ্ডপ অবধি পৌঁছে দিয়ে ফিরেছে দুই ভাই। সুমেরু-কুমেরু ভেবেছিল লুব্ধককে দেখে বাবা রেগে যাবেন। তা হল না। বিষুববাবু অবাক হয়ে বললেন, “কোত্থেকে জোটালি এটাকে!”
স্কুল থেকে ফেরার পথে যা ঘটেছিল সব বলল সুমেরু। এও বলল যে, দু’দিন পর ছেড়ে দেবে লুব্ধককে। বাবা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, “মনে থাকে যেন। দু’দিন মানে কিন্তু দু’দিন। রাস্তার কুকুরকে বাড়িতে তুলে এনে অযত্ন করে কষ্ট দেবার কোনও মানে হয় না। পশুকল্যাণ সমিতির লোকজন জানতে পারলে কিন্তু মামলার নোটিস ধরাবে তোদের দুই ভাইকে।”
দুই
দু’দিন নয়, লুব্ধক থেকেই গেল এ-বাড়িতে। বর্ষা গিয়ে শরৎ এল। এবারও থোকা থোকা ফুলে সেজে উঠল সুমেরুদের উঠোনের শিউলিগাছটা। এদিকে লুব্ধক একটু বড়ো হয়েছে। চর্বচোষ্য খেয়ে গত্তি লেগেছে শরীরে। সকলের পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে সবসময়। সুমেরু আর কুমেরু স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলে তাদের ঘিরে একপাক নেচে নেয় আনন্দে। মুখ তুলে চকচকে চোখে তাকিয়ে দেখে দুই ভাইকে। ভৌ ভৌ করে উচ্ছ্বাস জানায়। পেপারওয়ালা গোপালদা, গরুর দুধ বিক্রি করতে আসা মোক্ষদামাসি, সবজি বিক্রেতা হরিপদ সবাই চিনে গেছে তাকে। লুব্ধক তাদের দেখে আদুরে গলায় হাঁক ছাড়ে। বোধহয় কুশল বিনিময় করতে চায়। একমাত্র করালীস্যারের সঙ্গেই তার সম্পর্ক এখনও মধুর হয়নি। লুব্ধককে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তার তরফ থেকে ভাব করার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। করালীস্যার পড়াতে এলে দরজার ফাঁক দিয়ে তাঁকে দেখে সে। কিন্তু তিনি লুব্ধককে একেবারেই পছন্দ করেন না। কুকুরটা কাছে এলেই তিনি ছোট্ট করে একটা শট মারেন তাকে। কুঁই কুঁই করে ল্যাজ গুটিয়ে দৌড়ে পালায় লুব্ধক।
পুজো পুজো গন্ধ আকাশে বাতাসে। আশ্বিন মাস ফুরিয়ে আসছে। বর্ষা পুরোপুরি বিদায় নেয়নি। হঠাৎ হঠাৎ ছাগল তাড়ানো বৃষ্টি আসে। কৃষ্ণপক্ষের নিশুত রাত। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ছড়িয়ে আছে কালো আকাশ জুড়ে। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে জ্বলজ্বল করছে কয়েকটা রুপোলি তারা। হাওয়া দিচ্ছে মৃদু মৃদু। সুমেরুদের শিউলিগাছটায় ঝেঁপে ফুল এসেছে। বাতাসে ম ম করছে শিউলি ফুলের সুগন্ধ।
দুই ভাইকে পড়ানোর পর বেরোলেন করালীস্যার। একহাতে টর্চ, আর অন্য হাতে ছাতা। গেটের দু’দিকে দুটো বিশাল শ্যাওড়াগাছ। তাঁকে গেট অবধি এগিয়ে দিল সুমেরু আর কুমেরু।
করালীস্যার থমকে দাঁড়ালেন। জুলজুল করে তাকিয়ে থাকলেন শ্যাওড়াগাছদুটোর দিকে। প্রচণ্ড জ্বর এলে রোগী যেমন ঠকঠক করে কাঁপে তেমন করে কাঁপতে কাঁপতে দাঁত কিড়মিড় করলেন একটুক্ষণ। পিছন ফিরে চোখ গোল গোল করে তাকালেন দু’ভাইয়ের দিকে। করালীস্যারের দুই চোখ লাল। খসখসে অচেনা গলায় বললেন, “হোমওয়ার্কগুলো করে রেখো। কাল সন্ধেবেলা যদি এসে দেখি যে হোমওয়ার্ক হয়নি তাহলে বেতিয়ে দু’জনের পিঠের ছাল তুলে দেব। কথাটা মনে থাকে যেন।” এটুকু বলেই মুখ ঘুরিয়ে হনহন করে করালীস্যার হাঁটা দিলেন চণ্ডীমণ্ডপের দিকে।
এ কী অশৈলী কাণ্ড! গায়ে কাঁটা দিচ্ছে সুমেরু আর কুমেরুর। এ যে একদম পুরুষালি গলা! শান্তশিষ্ট মানুষটা যে এমন উগ্র ভঙ্গিতে কথা বলতে পারেন সেটা দুই ভাইয়ের বিশ্বাস হচ্ছিল না। সুমেরু তাজ্জব হয়ে বলল, “করালীস্যার আমাদের মারা তো দূরের কথা, বকুনিও দেননি কখনও। তিনি আজ এমন অদ্ভুত আচরণ করলেন কেন?”
কুমেরু কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “সেটাই তো ভাবছি। কী হল বল তো দাদা?”
হোমটাস্ক নিয়ে বসেছে দু’জনে। খাতায় এক লাইনও লেখা হয়নি। করালীস্যারের ব্যাপারটা ঘুরছে মাথায়। ওঁর এমন অদ্ভুত আচরণের অর্থ কী? সদর দরজায় শব্দ হল। অফিস থেকে বাবা ফিরেছেন। অন্যদিন যেমন ঘরে ঢুকে ধীরে সুস্থে পোশাক বদলে ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসে চা খান, আজ তেমন করলেন না। শশব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকেই মাকে প্রশ্ন করলেন, “আজ করালী এসেছিল পড়াতে?”
মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “একটু আগেই তো পড়িয়ে গেল। কেন, কী হয়েছে?”
বিষুববাবু চিন্তিত গলায় বললেন, “করালীকে শুনলাম ভূতে ধরেছে। জলাতঙ্কে মারা যাওয়া পঞ্চাননের ভূত। অবিকল পঞ্চাননের মতো গলায় কথা বলছে করালী!”
সুমেরু আর কুমেরু পড়ার ঘর থেকে কান খাড়া করে শুনছিল বাবার কথাগুলো। দু’জনে তড়াক করে লাফ দিয়ে বৈঠকখানার ঘরে চলে এল। মা পর্যন্ত হতবাক। ভুলে গেছেন রান্নার কথা। বিস্মিত হয়ে বললেন, “তার মানে!”
বাবা বললেন, “আজ অফিস থেকে ফেরার সময় চণ্ডীমণ্ডপে লোকজনের ভিড় দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। সেখানেই শুনলাম ঘটনা। যুব সংঘের যাত্রার মহড়া হচ্ছিল। পুজো এসে গেছে। আর দেরি নেই। আজ মহড়ায় করালী নাকি ডায়ালগ বলছিল পঞ্চাননের গলায়। ব্যাপার দেখে সকলের চোখ ছানাবড়া। যাত্রার রিহার্সাল লাটে উঠেছে। পাড়ার ছেলেরা দু’দলে ভাগ হয়ে একটা দল করালীকে নিয়ে গেছে বাড়িতে। অন্য দল ছুটেছে বকুলতলা, সেখান থেকে যজ্ঞেশ্বর ওঝাকে নিয়ে আসবে তারা।”
এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি জোড়াকদমে। বাবা-মাকে ভজিয়ে-টজিয়ে করালীস্যারের বাড়িতে চলে এসেছে সুমেরু আর কুমেরু। তাদের পেছন পেছন এসেছে লুব্ধক।
করালীস্যারের বাড়ির সামনে মস্ত ভিড়। দালানবাড়ির বারান্দায় পর্যন্ত বিস্তর লোক। করালীস্যার আছেন নিজের ছোটো ঘরে। দরজা বন্ধ। তবে বাইরের দিকের জানালাটা খোলা। সেই জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, একটা তক্তপোষের ওপর কালো বারমুডা আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে শুয়ে আছেন করালীস্যার। মুখচোখ অস্বাভাবিক। ভীষণ হাঁফাচ্ছেন। মাথায় পাখা দিয়ে বাতাস দিচ্ছেন থান পরা এক মহিলা। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন দু’জন বৃদ্ধ। তাঁরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কী যেন পরামর্শ করছেন। এদিকে তক্তপোষের ওপর বসে করালীস্যারের ওপর ঝুঁকে পড়েছেন কৌপিন পরা যজ্ঞেশ্বর ওঝা।
থান পরা বিধবা মহিলা করালীস্যারের মা। বয়স্ক মানুষগুলো আত্মীস্বজন হবেন। ওঁদের কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল, করালীস্যারকে ভূতে ধরেছে। তবে করালীস্যার দুর্বল স্বাস্থ্যের মানুষ হওয়াতে কাহিল দেখাচ্ছে তাঁকে। বাইরে ভিড় ক্রমে বাড়তে থাকায় ঘরের ভেতর থেকে বয়স্ক একজন বাইরে বেরিয়ে এসে হাত জড়ো করে বললেন, “এত কথা বলবেন না। আপনারা চুপ করুন একটু। ভিড় হালকা করুন।”
ভিড় তো হালকা হলই না, উলটে নানারকম পরামর্শ ভেসে আসতে লাগল এদিক থেকে। একজন মন্তব্য করল, “সর্ষে ছেটাও গায়ে। ভূত ভেগে যাবে।”
আরেকজন বলল, “উঁহু, সর্ষে নয়, পঞ্চানন মারা গিয়েছিল জলাতঙ্কে। ওর সামনে একটা জলের পাত্র নিয়ে এসো। তাতেই কাজ হবে।”
করালীস্যারকে জরিপ করছিল সুমেরু আর কুমেরু। মানুষটা এমন কী করে হয়ে গেল সেটা মাথায় ঢুকছিল না। হঠাৎ ঘরের ভিতর থেকে একটা বিকট শব্দ এল। সেই ভয়ংকর শব্দে থেমে গেল উপদেশ বর্ষণ। কেউ দড়াম করে খুলে দিল বন্ধ দরজাটা। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল অদ্ভুত সেই দৃশ্য। বাঘছালের ওপর বসে আছেন রাশভারী চেহারার যজ্ঞেশ্বর ওঝা। কপালে সিঁদুর দিয়ে ত্রিশূল আঁকা। মাথায় বটের ঝুরির মতো বিশাল জট নেমেছে। পরনে একখণ্ড রক্তলাল কাপড়। গায়েও লাল উড়নি। হাতে বাঁকানো একটা শিকড়।
ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন বলল, ওটা পদ্মযোনির শিকড়। ভূতের বাপ অবধি পালায় এর গন্ধ নাকে গেলে। যজ্ঞেশ্বর ওঝা সেই জিনিস ধরলেন আগুনে। ধোঁয়া বেরোতে শুরু করেছে শিকড় থেকে। যজ্ঞেশ্বর গব্বর সিংয়ের মতো কায়দা করে হাসছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে, “দ্যাখ ব্যাটা এখন কেমন লাগে!”
গন্ধটা নাকে যেতেই ছটফট করে উঠলেন করালীস্যার। বাজখাঁই গলায় বললেন, “যাও তো বাপু, সরো এখান থেকে।”
ভূতে ধরা মানুষ মানে একদিকে যেমন গা ছমছমে ব্যাপার তেমনি বেশ মজারও বটে।
করালীস্যারের মায়ের মুখ শুকিয়ে গেছে ভয়ে। তিনি ঘাবড়ে গিয়ে নেমে এসেছেন তক্তপোষ থেকে। এতক্ষণে দেখা গেল করালীস্যারকে। বোধহয় একটু আগে স্নান করানো হয়েছে। তাই মাথার চুল আঁচড়ানো পাট পাট করে। সেই চুল কাঁধ ছাপিয়ে পড়েছে পিঠ পর্যন্ত। কপালে পরানো হয়েছে সিঁদুরের বড়ো ফোঁটা। তাতে করালীস্যারকে মনে হচ্ছে সদ্য বিয়ে হওয়া কোনও মেয়ে। যজ্ঞেশ্বর ওঝা এক গ্লাস জল এনে রাখলেন করালীস্যারের সামনে। কুটিল মুখ করে বললেন, “পঞ্চানন, এবার তোর খেলা শেষ।”
করালীস্যার জলের গ্লাসটা হাতে নিলেন। চোঁ চোঁ করে পুরো জলটা শেষ করে মুখ দিয়ে আরামের একটা শব্দ করলেন। ওঝাকে দেখে তড়পে উঠে বললেন, “অ্যাই ব্যাটাচ্ছেলে, ঘর ফাঁকা কর। আমি এখন ঘুমোব।”
যজ্ঞেশ্বর ওঝা মুখ ভেঙিয়ে বললেন, “ওরে আমার মানিকচাঁদ! বলে কিনা ঘুমোবে! ঘুম পাড়াচ্ছি তোকে আমি! পঞ্চানন, ভালো চাস তো করালীর দেহ ছেড়ে দে। ছাড় বলছি!”
যঞ্চেশ্বর ওঝার হাতে লম্বা একটা চামর। সেই চামর দিয়ে ঝাপট দিচ্ছেন করালীস্যারের পিঠে। করালীস্যার ছটফট করছেন। সেই ছটফটানি চামরের ঝাপটানিতে নাকি শিকড়ের বীভৎস গন্ধে সেটা বলা মুশকিল। চোখ পাকিয়ে করালীস্যার বাঘের মতো গলায় বলছেন, “খবরদার বলছি। আমাকে তাড়াবার চেষ্টা করিস না। তা হলে তোরও বাড়ির চালে গিয়ে বসে থাকব।”
সেই কথা শুনে যজ্ঞেশ্বর সপাং সপাং করে চামড়ের ঝাপট দিতে দিতে বললেন, “লাভ হবে না। আসার সময় বাড়িবন্ধন মন্ত্র পড়ে বাড়ি বেঁধে এসেছি।”
চোখ জবাফুলের মতো। করালীস্যার ফুঁসছেন। এমন চোখে তাকাচ্ছেন যেন ওঝাকে ভস্মই করে দেবেন এক্ষুনি। গাঁয়ের লোক হাঁ করে দেখছে ওঝার সঙ্গে ভূতের দ্বৈরথ। ঠিক তখনই একেবারে আচমকা করালীস্যার লাফ দিয়ে পড়লেন যজ্ঞেশ্বর ওঝার ওপর। চুলের জটা ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়েই খামচে দিলেন ওঝার দুই গালে। এমন কাণ্ডের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না যজ্ঞেশ্বর। সেই সুযোগে ওঝার হাত থেকে চামর কেড়ে নিয়ে করালীস্যার উলটে নিজেই ঝাপট দিতে লাগলেন ওঝার গায়ে।
“বাঁচাও, বাঁচাও” করতে করতে যঞ্চেশ্বর ওঝা তিরবেগে বেরোলেন দরজা দিয়ে। বাড়ির উঠোন অবধি ধাওয়া করে ওঝাকে খেদিয়ে করালীস্যার ফিরে এলেন নিজের ঘরে। নিমেষে ভিড় পাতলা হয়ে গেল উঠোন থেকে। করালীস্যার মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করে বললেন, “যান তো মশাইরা, নিজের নিজের কাজে যান। আমাকে বিশ্রাম করতে দিন।”
সকলে কী করবে ভাবছে। এ ওর দিকে তাকাচ্ছে ভোম্বল ভোম্বল মুখে। সামনের দিকে এগোতে সাহস পাচ্ছে না কেউ। আর ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। কথা নেই, বার্তা নেই লুব্ধক ঝাঁপিয়ে পড়ল করালীস্যারের ওপর। বাবা গো, মা গো বলে চিল-চিৎকার দিয়ে করালীস্যার বসে পড়লেন মাটিতে। জ্বরজ্বারি এলে মানুষ যেমন কাঁপে তেমন কাঁপতে লাগলেন। কয়েক সেকেন্ড বসে থাকতে না থাকতেই ধড়াম করে শব্দ। দাঁতে দাঁত চেপে অঞ্চান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন করালীস্যার।
বোমকে গেছে উপস্থিত মানুষজন। অপদেবতায় পাওয়া লোক বলে কেউ এগিয়ে আসতে সাহস পাচ্ছে না। যদি করালীস্যার আঁচড়ে কামড়ে দেন! ভূতে পাওয়া মানুষের আঁচড় বা কামড় থেকে ক্ষত হলে তা কোনও ওষুধে সারে কি না কে জানে!
কিছুক্ষণ এভাবে কাটল। করালীস্যার চোখ খুললেন পিটপিট করে। এদিক ওদিক তাকালেন। পঞ্চাননসুলভ দাপুটে হাবভাব নেই। পুরনো জড়তা আর সংকোচ ফিরে এসেছে চোখেমুখে। এদিক ওদিক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে মিহি গলায় বলে উঠলেন, “এত লোক কী করছে এখানে? কী হয়েছে?”
সুমেরু আর কুমেরুর পাশে দাঁড়িয়ে জিভ বের করে হাঁফাচ্ছিল লুব্ধক। কানদুটো খাড়া করে সতর্ক চোখে তাকাচ্ছিল করালীস্যারের দিকে। করালীস্যার সুমেরু আর কুমেরুর দিকে তাকিয়ে স্বভাবসিদ্ধ মেয়েলি গলায় বললেন, “এত রাতে তোমরা এখানে কী করছ? যাও, বাড়ি গিয়ে হোমটাস্কগুলো করে নাও চটপট। আমি কাল গিয়ে দেখব।”
উল্লসিত হয়ে চিৎকার করে উঠল জনতা। ‘হুর-রে’ বলে ভিড়ের মধ্যে থেকে সিটি দিয়ে বসল কে যেন। নিজস্ব মেয়েলি স্বর ফিরে এসেছে করালীস্যারের গলায়। সকলের মুখে চওড়া হাসি। নিশ্চিন্ত হয়েছে প্রত্যেকে। যজ্ঞেশ্বরের মতো বাঘা ওঝা যে কাজ করতে পারেনি সেই কাজ লুব্ধক করে দিয়েছে। ডাকাবুকো পঞ্চাননের ভূত বাঘ-ভাল্লুক কিংবা পুলিশ দেখেও হয়তো ডরাত না। লুব্ধক কুকুর বলেই ব্যাটা ভয় পেয়ে করালীস্যারের দেহ ছেড়ে পগারপার হয়েছে। জলাতঙ্কে মরেছে বলে একমাত্র কুকুরকেই ভয় খায় পঞ্চানন।
সুমেরু কোলে তুলে নিল পাটকিলে রঙের কুকুরটাকে। কুমেরু তার মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিল। উপস্থিত জনগণের মধ্যে যাদের কাছে মোবাইল ফোন ছিল তারা এসে সেলফি তুলতে লাগল লুব্ধকের সঙ্গে। উপস্থিত জনতার মুখে সব শুনে করালীস্যার নিজেও লজ্জা লজ্জা মুখে একটা ছবি তুললেন লুব্ধকের সঙ্গে। রাতারাতি হিরো হয়ে যাওয়া লুব্ধক ল্যাজ নাড়তে নাড়তে আহ্লাদি আহ্লাদি গলায় ডেকে উঠল ভৌ ভৌ করে।
অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস
হাহাহা…এরকম গল্প আমি সবসময় পড়তে পারি…দারুণ লাগল
LikeLike
দারুণ
LikeLike
পড়লাম।
LikeLike