অনন্যা দাশ -এর সমস্ত লেখা একত্রে
আমার ভাই পাঁচুকে কুম্ভকর্ণ বললেও কম বলা হবে। পাঁচু আসলে কুম্ভকর্ণকে পাঁচবার ঘুম দিয়ে গুণ করলে যা হয় তাই। ওর কানের কাছে বেদম জোরে টিউবা বাজালেও ওর ঘুম ভাঙে না। টিউবা দেখেছ? ভেঁপুকে দশগুণ করলে যেরকম আওয়াজ বেরোবে সেইরকম। সেবার যখন বাবার বন্ধু শুভঙ্করকাকুর বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন পাঁচু ছাড়া আমরা কেউ ঘুমোতে পারিনি। কারণ হল শুভঙ্করকাকুর বাড়ির একপাশে একটা রাইফেল ক্লাব আর অন্যদিকে কুকুরদের কেনেল। বাবা বলেছিলেন, “হ্যাঁ রে শুভঙ্কর, তুই কী বলে এইরকম জায়গায় বাড়ি কিনলি!”
শুভঙ্করকাকু লজ্জায় মুখ নীচু করে বললেন, “আরে জলের দরে দিয়ে দিল জানিস এত সুন্দর বাড়িটা।”
বাবা দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “তা তো দেবেই। এই বাড়ি জলের দরে দেবে না তো কি তাজমহল দেবে?”
“আমি সেই জন্যে লোভ সামলাতে পারলাম না। আর আমাদের এখন অভ্যেস হয়ে গেছে, কানে তুলো গুঁজে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ি।”
বাবা শুনে বললেন, “হুঁ!”
বাবার আবার কানে তুল গুঁজলে নাকি কান সুড়সুড় করে, তাই সেটা চলবে না। রাতেরবেলা, দিনেরবেলা কোনও সময় শান্তি নেই। হয় দুমদাম রাইফেল চালানো চলছে, নয় কুকুরদের তুমুল চিৎকার। রাইফেল যদিও বা রাত এগারোটার সময় ক্লাব বন্ধ হওয়ার পর বন্ধ হয়, কুকুরদের চিৎকার মোটামুটি হোল নাইট চলে। আমাদের চারদিন থাকার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু দু’দিন পরই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম আমরা কারণ ওই যে বললাম পাঁচু ছাড়া কারও ঘুম-টুম হচ্ছিল না।
তা সেই হেন পাঁচুকেও ঘোল খাইয়ে ছাড়ল জেরি।
পাঁচু এসে যেদিন বলল যে ওর বন্ধু মাইকের পোষ্য জেরি আমাদের বাড়িতে থাকতে আসবে, তখন থেকেই বাড়িতে হুলুস্থুল। পাঁচু অবশ্য বেশ খুশি কারণ, সে মাকে বলে বলে হন্যে হয়ে গিয়েছিল, তাও মা কোনও পোষ্য কিনে দেননি ওকে। কেবল বলেন, “বাড়িতে দুটো যা রয়েছে তাদের সামলাতেই আমার হাড়মাস কয়লা হয়ে যাচ্ছে, আর কুকুর-বিড়াল সামলাতে পারব না বাপু!”
তা এ তো মেঘ না চাইতেই জল। মা চান বা না চান জেরি আসছে আমাদের বাড়িতে।
মা তো শুনেই আঁতকে উঠলেন, “জেরি? জেরি আবার কে?”
আমি আর পাঁচু তো হেসেই খুন। “ওমা, তুমি জেরিকে চেনো না? জেরি মাইকের সাদা ইঁদুর!”
তাই শুনে মা একেবারে রেগে টং যাকে বলে। ওই ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের মা মোটেই ভালো চোখে দেখেন না। বললেন, “ইঁদুর! ইঁদুর আবার কেউ পোষে নাকি? তারা তো এমনিতেই উদয় হয় আর সবকিছু কেটেকুটে দেয়! তাদের আবার পোষবার কী আছে?”
“এটা সাদা ইঁদুর, সাদা ভাল্লুকের মতন!” পাঁচু বলল।
ওর কথায় চিঁড়ে ভিজল না। “সাদা ইঁদুর তো কী? ইঁদুর ইঁদুরই। সাদা ইঁদুর বলে কি অ্যান্টার্কটিকাতে থাকে নাকি? সে থাকে থাক, আমার বাড়িতে থাকবে না।”
পাঁচু কাকুতি মিনতি করতে লাগল, “মা, আমি মাইককে কথা দিয়েছি। ওর খাঁচা আছে। সেটাতে থাকবে। তোমাকে একদম বিরক্ত করবে না। যা করার আমি আর দিদি মিলে সামলে নেব।”
মা শুধু বললেন, “মনে থাকে যেন।”
যথাসময়ে জেরি আমাদের বাড়িতে চলে এল খাঁচায় করে। সঙ্গে একগাদা জিনিসপত্র—খাবারদাবার, খেলনা ইত্যাদি। মা দেখেই নাক সিঁটকোলেন। বাবা নির্লিপ্ত। কম্পিউটার বা ফোনে বসলে পৃথিবী এদিক থেকে ওদিক হয়ে গেলেও কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, আর ইঁদুর ছোঃ!
আমি তখন স্রেফ নারদের ভূমিকায়। মাকে বললাম, “জানো মা, আমাদের টিচার একটা গল্প বললেন। অবশ্য গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। এক বয়স্ক মহিলা ইঁদুরকে খুব ভয় পেতেন। কতকটা তোমারই মতন। আর যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়, এটা কে না জানে? একদিন উনি ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন। হঠাৎ দেখলেন উনি যেখানে বসে রয়েছেন সেখান থেকে কিছুটা দূরেই একটা নেংটি ইঁদুর! সেটাকে দেখে উনি তো ভয়ে মুখ হাঁ করে বেদম চিৎকার করতে লাগলেন। ওইরকম বিকট চিৎকার শুনে ইঁদুরটাও ভয় পেয়ে মারল এক লাফ। আর পড়বি তো পড় একেবারে মহিলার মুখের ভিতর! আর মহিলা কোঁক করে সেটাকে গিলে ফেললেন।”
আমার বিদঘুটে গল্প শুনে মা নাক সিঁটকে বললেন, “ওয়াক! আমি হলে তো হার্ট ফেল করেই মরে যেতাম। গিলতে-টিলতে আর হত না। পাঁচু, তোর ওই জেরি যেন কোনোমতেই খাঁচা থেকে বেরোতে না পারে! তাহলে তোকে আমি একমাস ধরে রোজ লাঞ্চে রুটি আর বেগুনের ঘ্যাঁট দেব।”
পাঁচুর বেগুন একেবারে অপছন্দ। বেগুন খেতে হবে শুনলেই ওর বমি আসে। তাছাড়া স্কুলে ওই রুটি আর ঘ্যাঁট নিয়ে গেলে ওর মার্কিন বন্ধুরা প্রচণ্ড খ্যাপায় ওকে।
দিন পনেরো সব ঠিকঠাক চলল। আমি তক্কে তক্কে থাকি। পাঁচু কবে খাবার দিতে গিয়ে খাঁচার দরজা বন্ধ করতে ভুলে যাবে। তা একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি খাঁচার দরজা ঠিক করে বন্ধ হয়নি আর জেরি দিব্যি খাঁচা থেকে বেরিয়ে টেবিলের ওপর উঠে থালা থেকে ভাত খাচ্ছে। পাঁচুও বাড়ি ঢুকেছে আমার সঙ্গে, কিন্তু সে প্রথমে খেয়াল করেনি। আমি আঙুল দিয়ে দেখাতে দেখতে পেল। ব্যাগ রেখেই এক ঝাঁপ জেরিকে ধরার জন্যে। কিন্তু ইঁদুর ধরা যদি অত সহজ হয়, তাহলে আর বেড়ালদের এত প্রতিপত্তি হত নাকি? পাঁচু দমাস করে টেবিলের ওপর গিয়ে পড়ল। ওর মুখটা খাবার থালার ওপর আর জেরি ফুড়ুৎ। ঠিক তখনই মা ঘরে এসে ঢুকলেন। পাঁচুকে ওই অবস্থায় দেখে বললেন, “ছি পাঁচু! কী বিশ্রী স্বভাব হয়েছে! স্কুল থেকে ফিরে হাত-মুখ না ধুয়েই খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছ! লাঞ্চ খাওনি নাকি আজকে?”
পাঁচু ভয়ে মাকে বলতে পারল না। আমাকে ফিসফিস করে বলল, “জেরিকে ধরতে সাহায্য কর, নাহলে মা বেগুন খেতে দেবে একমাস! আর আমি যদি বেগুন পাই, তোকেও পেতে হবে।”
সত্যি বলতে কী, বেগুনের ঘ্যাঁট যে আমারও খুব প্রিয় তা বলতে পারব না। অগত্যা রাজি হলাম জেরিকে ধরতে। সে ব্যাটাও হাড় বজ্জাত। ধরা কি আর দেয়! পাঁচু কাঁদো কাঁদো। আমিও বেশ বুঝতে পারছি, আমাদের ভাগ্যে ওই বেগুনের ঘ্যাঁটই নাচছে। এমন সময় পাশের বাড়ি থেকে পাঁচুর বন্ধু কুপার এসে হাজির। পোষ্য নিয়ে কুপারের অগাধ জ্ঞান। সে এসেছিল পাঁচুর সঙ্গে অঙ্কের হোমওয়ার্কটা করবে বলে, অঙ্কে বেজায় কাঁচা বলে। পাঁচু সেই সুযোগে বলল, “জেরি পালিয়েছে, তাকে কী করে ধরব?”
কুপার তো পাঁচুকে সাহায্য করার সুযোগ পেয়ে মহা খুশি। সে বলল, “আরে ইঁদুর কী ভালোবাসে আমি জানি। ওর খাঁচাটায় হানি রোস্টেড বাদাম রেখে দাও বেশ কয়েকটা। তারপর দেখো ঠিক খাঁচায় ফিরে আসবে গুটিসুটি, আর কিছুটি করতে হবে না।”
পাঁচু বলল, “মা ফোনে কথা বলছে, এই সু্যোগ!”
আমরা তিনজন রান্নাঘরে ঢুকলাম। আমরা যাতে হাত না পেতে পারি তাই হানি রোস্টেড চিনেবাদাম একেবারে সবচাইতে উঁচু তাকে রেখেছে মা। কুপারের চেহারা ভালো। সে বলল, “আমি দাঁড়াচ্ছি, তুই আমার কাঁধে উঠে নাগাল পেয়ে যাবি।”
পাঁচু রোগা লিকলিকে। সে দিব্যি কুপারের কাঁধে উঠে পড়ল। কিন্তু কাঁধে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ানো অত সোজা তো নয়! বাদামের কৌটোটা নিয়ে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল পাঁচু তাই পাশের বড়ো টিনটাকে খামচে ধরল। তাতে আবার মা বাড়তি আটাটা রেখেছিলেন। সেই টিনের ঢাকনা খুলে ঝরঝর করে সব আটা পড়ল পাঁচু আর কুপারের গায়ে। বেশ হ্যালোইনের পাউডার মাখা সাদা ভূতের মতন দেখাচ্ছিল দু’জনকে। পাঁচুর হাত থেকে বাদামের কৌটাও মাটিতে পড়ে খুলে গিয়ে সব বাদাম পড়ে একাকার। পাঁচু মাটিতে গড়াগড়ি, সঙ্গে কুপার। সে এক দৃশ্য। আমার প্রবল হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু হাসি চাপার চেষ্টা করছিলাম। মা এসে ঢুকেছে রান্নাঘরে। প্রবল বকুনি দিচ্ছে দু’জনকে। তার মধ্যে আমি দেখলাম জেরি ব্যাটা কোথা থেকে গন্ধ পেয়ে এসে কুট কুট করে মাটি থেকে ময়দা আর বাদাম খাচ্ছে।
মা খালি খালি বলছে, “এখানে ঝাঁটা নেই, নাহলে তোর ওই জেরিকে ঝাঁটার বাড়ি মেরে বিদায় করতাম বাড়ি থেকে! ইঁদুর পোষা বের করব!”
কুপার মার কথা বুঝতে না পেরে বারবার জিজ্ঞেস করছে, “তোর মা কী বলছে?”
এর মধ্যে বাবা চলে এসে সব দেখে বলল, “মাটিতে আটা মাখা হচ্ছে কেন? এতরকম বাসনকোসন আছে তো জানতাম! আর অতটা আটা মাখার কী দরকার আছে? আমরা তো ভাতই বেশি খাই! তবে পাঁচু আর কুপার, আমি খুব খুশি হয়েছি তোমরা মাকে আটা মাখতে সাহায্য করছ দেখে।”
মা তো বাবার কথা শুনে আরও রেগে কাঁই! আমি খুব মজা পেয়ে লাফালাফি করছিলাম, তাই শাস্তিটা আমাকেই পেতে হল। কুপার আর পাঁচু স্নান করতে গেল, আর রান্নাঘরের মেঝেটা আমি আর মা মিলে পরিষ্কার করলাম। উফ্, আটার গুঁড়ো যেন যায়ই না! কত কষ্ট করে যে তুলতে হল। কুপার চলে গেল বই নিয়ে।
আমরা রাতে খেতে বসেছি, ওমা, কাচের আলমারির মাথার ওপর থেকে ‘চিপ চিপ’ শব্দ! তাকিয়ে দেখি জেরি হাসি হাসি মুখে আমাদের খাওয়াদাওয়া দেখছে। ওকে দেখেই মার মনে হয় মাথায় রক্ত চড়ে গেল। “দাঁড়া তো!” বলে একটা লম্বা ঝুল ঝাড়ি নিয়ে ওর পিছনে তাড়া করলেন। জেরি তো ধরা দিল না। একটু পরেই মা ধরাশায়ী হলেন। খরচের খাতায় উঠল একটা ফুলদানি, একটা কাচের ফটো ফ্রেম, দুটো বালব আর বাবার কম্পিটারের একটা স্পিকার।
জেরিকে বাড়িতে আনার জন্যে মার কাছে প্রচণ্ড বকুনি খেয়ে যে পাঁচুকে কুম্ভকর্ণের অবতার বলতাম আমরা, সেই পাঁচু দু’রাত জেগে জেরিকে ধরার প্রবল চেষ্টা করল। কতরকম টোপ দিয়ে চেষ্টা করা হল তাকে ধরার, কিন্তু তিনি ধরা দিলেন না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসে একটু ঘুমিয়ে পড়েছে যেই না, অমনি জেরি পায়ের কাছে রাখা হানি রোস্টেড পিনাটগুলো খেতে হাজির। এই জেরি বিখ্যাত জেরি আর স্টুয়ার্ট লিটিলের বংশধর, তায় আবার এখনকার জেনারেশান। কত তাবড়-তাবড়দের ঘোল খাইয়ে ছেড়েছে সে, পাঁচু তার সঙ্গে পেরে ওঠে কখনও?
এমনি ইঁদুর ধরা কলে তো ভুলেও পা মাড়ায় না জেরি। কী করে বুঝেছে কে জানে। ওইসব খাঁচা জাতীয় জিনিসের প্রতি ওর অ্যালার্জি বলেই বোধহয়। মার কোন এক বন্ধু গ্লু ট্র্যাপের কথা বললেন। চ্যাটচ্যাটে আঠার ওপর হানি রোস্টেড বাদাম দিয়ে রাখলেই জেরি পতন অবধারিত। সেইটাতে কিন্তু বাবা বাধ সাধল। বলল, “নাহ্! ওটা ভয়ংকর বাজে জিনিস। ওর পা আটকে যাবে, তখন পা কেটে ছাড়াতে হবে। খুব অমানবিক। ওসব আমার বাড়িতে আসবে না। এমনি ধরতে পারো তো ধরো।”
এরপর মা জেরিকে শত্রু হিসেবে ঘোষণা করল। মার একদিন কি জেরির একদিন! আগে বলা সবকথা ভুলে গিয়ে মা কোথা থেকে জানি না টমকে নিয়ে এল। বলল, “ও ব্যাটা জেরি যখন টমই ওকে শায়েস্তা করবে।”
টম একটা তুলতুলে বেড়ালছানা। এক সপ্তা বয়স তার। দেখা গেল সে শুধু বোতলে করে দুধ খায় আর পড়ে পড়ে ঘুমোয়। ইঁদুর ধরার কোনও ইচ্ছেই তার নেই।
টমের বয়স তিনমাস হয়ে গেছে। আর ওর প্রাণের বন্ধু হচ্ছে জেরি। ওর আর জেরির একসঙ্গে ঘুমোনোর একটা ছবি মা হোয়াটস অ্যাপে দিয়েছ আর সেটা বাজারে খুব ঘুরছে। রিডার্স ডাইজেস্টের ‘আনলাইকলি ফ্রেন্ডশিপ’ সিরিজের জন্যে মার নিমন্ত্রণ আসে আসে।
আমার আর পাঁচুর তো খুব ফুর্তি। একটাও ছিল না, আর এখন দু-দুটো পোষ্য। এতদিনে মাও ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে যে জেরি আমাদের বাড়িতেই থাকতে চায়। কিন্তু ওর জন্যে বরাদ্দ ওই খাঁচায় সে থাকবে না মোটেই, সে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়।
ছবি: জয়ন্ত বিশ্বাস
দারুন মজার
LikeLike
Misti golpo
LikeLike
Hilarious
LikeLike