জয়দীপ চক্রবর্তীর আগের লেখাঃ নিবারণ চক্কোত্তির হাতঘড়ি, গোলমেলে গন্ধ
জয়দীপ চক্রবর্তী
যাওয়ার কথা ছিল মুম্বাই মেলে। কিন্তু রওনা দেবার দিন দুই আগে দুম করে ট্রেনটা বাতিল হয়ে গেল। অরুণাংশু বেশ আপসেট হয়েই পড়েছিলেন। হতাশ হয়ে তিনি সুছন্দাকে বলছিলেন, “এই অল্প সময়ের মধ্যে অন্য কোনো ট্রেনে টিকিট পাওয়া অসম্ভব। কাজেই এবারের মতন বেড়াতে যাওয়া ক্যানসেল।”
শাওনের মন খারাপ লাগছিল। এতদিনের মানসিক প্রস্তুতি। সেই কবে থেকে টিকিট কাটা রয়েছে ট্রেনের। বন্ধুদের সব্বাইকে গল্প করা হয়ে গেছে এবার পরিদাদুর সঙ্গে নর্মদা তীরের জবলপুর শহর ঘুরতে যাচ্ছে সে। সঙ্গে পান্না রিজার্ভ ফরেস্ট, পাঁচমারি, খাজুরাহো, আরো কত কী জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। পুরো প্ল্যানটাই বরবাদ হয়ে গেল এক্কেবারে। মনে মনে খুব রাগ হচ্ছিল যখন, পরিদাদুই হঠাত আশার আলো দেখালেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “তোমরা বড্ড সহজে হাল ছেড়ে দাও অরুণ। আগে তো দেখা যাক বিকল্প কোনো পথ বের করা যায় কিনা…”
“এই দু’দিনের মধ্যে অন্য কী বিকল্প উপায় বের করবে পরিকাকু”, সুছন্দা বলেন, “তুমি কি আর ম্যাজিক জানো?”
“হাতে পাঁজি মঙ্গলবার তোদের খুকু”, পরিদাদু বিরক্ত হয়ে বললেন, “দাঁড়া মোবাইলেই দেখে নিচ্ছি অন্য কী ট্রেন আছে ওইদিন আর তাতে আমাদের চারজনের চারটে টিকিট ম্যানেজ করা যায় কিনা, অন্তত আর এ সি-ও যদি পেয়ে যাই…”
তখনই শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেসের নামটা জানা গেল। ট্রেনটা প্রায় সারাটা রাস্তাই ঝোলাতে ঝোলাতে যায়। ভাগ্যিস অমন বদনাম ট্রেনটার, তাই বোধহয় আরামসে রিজার্ভেশন হয়ে গেল। প্রায় চব্বিশ ঘন্টার জার্নি। হাওড়া থেকে একটার খানিক পরে ছেড়ে জবলপুর পৌঁছতে পরদিন আড়াইটে হয়ে যাবে। তবু যাওয়া যে হবে তাইতেই মনের মধ্যেটা আলো হয়ে উঠল শাওনের। মা বাবার মুখের দিকে চেয়ে তার মনে হল সুছন্দা আর অরুণাংশুর আনন্দও তার চেয়ে কিছু কম হয়নি।
পৌঁছনোর কথা ছিল বেলা আড়াইটেয়। কিন্তু জবলপুর পৌঁছতে শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস সন্ধে পার করে ফেলল। হাওড়া থেকে আসানসোল পর্যন্ত দুর্দান্ত ছুটেই এক্কেবারে যেন হাঁফিয়ে গেল। তারপর থেকে পুরো রাস্তাটাই একেবারে ঢিকির ঢিকির করে চলল গাড়িটা। হোটেল নর্মদা ভিউ-এ শাওনদের জন্যে দু’খানা ঘর বুক করে রাখা ছিল আগে থেকেই। একটা ঘর মা বাবা ও শাওনের, আর একটা পরিদাদুর একার। হোটেলটা স্টেশন থেকে দূরে। ট্রেন থেকে নেমে অটো নিয়ে আসতে হয় হোটেলে। কিন্তু হোটেলে পৌঁছেই মনটা ভালো হয়ে গেল শাওনের। হোটেলের একেবারে প্রায় গা দিয়েই নর্মদা নদী বয়ে চলেছে। তাদের ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই পঞ্চবটি ঘাট। একটু দূরের সরস্বতী ঘাটও দেখা যাচ্ছে এখান থেকেই। সন্ধের সময় থেকেই এই ঘাটে এসে অনেকে মা নর্মদার জলে বিভিন্ন মনস্কামনায় প্রদীপ ভাসান। আজও ভাসিয়েছেন নিশ্চিত। সেই প্রদীপগুলোর অধিকাংশ নিভে গেলেও কিছু কিছু এখনও জ্বলছে। শালপাতার ডোঙার ওপরে বসানো বসানো প্রদীপগুলো নদীর জলে ভাসতে ভাসতে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। সুছন্দা সেদিকে তাকিয়ে দু হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে মা নর্মদাকে প্রণাম জানাতে জানাতে বললেন, “এর আগে নর্মদা মা-কে দেখেছিলাম ওঙ্কারেশ্বরে গিয়ে, সেবারে যে ঝামেলা হয়েছিল সে কথা ভাবলে এখনও যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এবারে আবার দেখা হয়ে গেল তাঁর সঙ্গে। এবারে অন্তত যেন নর্মদা মা আমাদের বিপদ আপদে না ফেলেন আর।”
“বলছ বটে, কিন্তু পরির সঙ্গে যেখানেই গেছি কিছু না কিছু একটা সমস্যা ঠিক কোথা থেকে এসে যেন জুটে গেছে আমাদের সঙ্গে…” অরুণাংশু পরিদাদুর দিকে একবার আড়চোখে ইচেয়ে নিয়ে বললেন হাসি হাসি মুখ করে।
“আমাকে ঘুরিয়ে অপয়া বলছ এই তো?” পরিদাদুও হাসেন, “কী বলিস খুকু, আমাকে কি এবার থেকে তাহলে বেড়াতে বেরনোর সময় বাদ দিয়ে দিতে চাইছিস তোরা?”
“কক্ষনও না”, প্রতিবাদ করে উঠে পরিদাদুকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে শাওন, “তুমি সঙ্গে না থাকলে বেড়াতে বেরিয়ে একটুও ভালো লাগে না আমাদের। তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবেই…”
অরুনাংশু আর সুছন্দা দুজনেই হেসে উঠলেন শাওনের কান্ড দেখে।
একটু জিরিয়ে টিরিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে পরিদাদু বললেন, “হোটেলের ঘরে চুপটি করে বসে না থেকে চলো বাইরে থেকে খানিক ঘুরে আসি বরং। বাইরে বিউটিফুল জ্যোৎস্না উঠেছে। হাঁটতে হাঁটতে ধুঁয়াধার ফলস অব্দি ঘুরে এলে মন্দ হয় না।”
“সে তো অনেক দূর। কম করেও এক দেড় কিলোমিটারের পথ…” অরুনাংশু দু’হাত মাথার ওপরে তুলে আড়মোড়া ভেঙে বললেন।
পরিদাদু হাসলেন, “তার মানে তুমি যাচ্ছ না এই তো?”
“তোমরাই ঘুরে টুরে এসো। আমি কাল দিনের আলোয় দেখব।”
“আর তুই? তোর কী মতলব খুকু?” পরিদাদু সুছন্দার দিকে চাইলেন।
“এই রাত্তিরে ফাঁকা অচেনা জায়গায় তোমাদেরই বা বেরনোর কী দরকার পরিকাকু?” সুছন্দা বললেন।
“তোরা দুজনে বরং তাহলে হোটেলের বারান্দায় বসে রাতের নর্মদা দর্শন কর। আমরা দুজনেই ঘুরে আসি”, বলে শাওনের দিকে চাইলেন পরিদাদু, “কী শানুবাবু, তোমার কী মতলব? আমার সঙ্গে যাবে, নাকি মা বাবার সঙ্গে অলসের মতন বসে থাকবে এইখানে?”
“আমি যাব।”
“গুড, চল তবে। আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই…”
২
রাত বেশি হয়নি, কিন্তু দোকানপাট এর মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। হোটেল থেকে বেরিয়ে দু’চার পা এগোতেই রাস্তার ডানদিকে পাঁচমাথা মন্দির। মন্দিরে মূল গর্ভগৃহের আশেপাশে আর কয়েকটি ছোট ছোট মন্দির রয়েছে। ঘিয়ের প্রদীপের আলো জ্বলছে মন্দিরগুলিতে। শাওন মন্দিরের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়তেই পরিদাদু তাড়া দিলেন, “এখানে এখন গিয়ে কাজ নেই। কাল সক্কালবেলা আসব এখানে। আমরা বরং আর একটু পা চালিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখি চৌষট্টি যোগিনী মন্দির খোলা আছে কিনা…”
“সেটা আবার কী রকম মন্দির পরিদাদু?” অবাক হয়ে জিগ্যেস করে শাওন।
“প্রত্নতাত্বিক দিক থেকে খুবই ইমপর্ট্যান্ট মন্দির এটা”, পরিদাদু হাঁটতে হাঁটতেই জবাব দেন, “এ মন্দির নাকি প্রায় হাজার দুয়েক বছরের পুরনো…”
“দু’হাজার?” চোখ গোল গোল করে বলে শাওন।
“হুঁ”, পরিদাদু বলেন, “পাহাড়ের মাথার ওপরে অনেকখানি চ্যাটালো সমতলের ওপরে এই পাথরের মন্দির। মূল গর্ভগৃহে শিব পার্বতীর অপূর্ব মূর্তি আছে। ষাঁড়ের পিঠে বসা… আর সেই মূল গর্ভগৃহের দু পাশ দিয়ে সারি দেওয়া আরো অনেকগুলি মূর্তি। সেগুলো ভাঙা বা কাটা…”
“কেন?”
“আর কেন?” পরিদাদু দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন, “সারা পৃথিবীতে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের ওপরে এমন করেই তো আঘাত হেনে এসেছে শয়ে শয়ে বছর ধরে…পড়বি, ইতিহাসের পাতায় তার অনেক কিছুই লেখা আছে এখনও…”
পরিদাদু থেমে যান। চৌষট্টি যোগিনী মন্দির এসে গেছে। রাস্তার প্রায় গা দিয়েই খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে অনেক ওপর পর্যন্ত। সিঁড়িগুলো বেশ প্রশস্ত। সিঁড়ির দু’পাশ ও মাঝখানে সুদৃশ্য রেলিং। সুন্দর করে বাঁধানো সিঁড়ির দু’পাশ দিয়ে ঢালু পাথরের রাস্তাও আছে। তবে সে পথ মারাত্মক খাড়াই। বিশেষত নেমে আসার সময় ও পথ অসম্ভব ঝুঁকির।
পরিদাদু শাওনের দিকে চাইলেন, “কী রে শানু, এতগুলো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে খুব কষ্ট হবে না তো?”
“না, না”, হাসে শাওন, “তুমি তো সঙ্গে আছ। তুমি সঙ্গে থাকলে আমার কোনো কিছুই কষ্টকর বলে মনে হয় না।”
শাওনের কথা শুনে পরিদাদু তার মাথায় হাত রাখেন, “চল তবে।”
পরিদাদু আর শাওন সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়াতেই একজন স্থানীয় লোক তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। লোকটা লম্বা চওড়া। খালি গা, পরনে হাঁটু পর্যন্ত পাট করে পরা ধুতি। এক হাত খালি। অন্য হাতে মোবাইল।
লোকটা পরিদাদুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে ভরাট গলায় হিন্দিতে জিগ্যেস করল, “কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?”
“মন্দিরে।” লোকটাকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে ছোট্ট উত্তর দিলেন পরিদাদু।
“মন্দির বন্ধ হয়ে গেছে”, স্থির ঠান্ডা গলায় বলল লোকটা, “এখন যাওয়া যাবে না ওপরে। আপনারা ফিরে যান এখন।”
“মন্দির বন্ধ ঠিকই, তবু সিঁড়ি বেয়ে উঠি খানিক ওপর দিকে, মানে যতটা যাওয়া যায় আর কী…” খুবই বিনীতভাবে বললেন পরিদাদু।
“রাত্রিবেলা এই পাহাড়ে খুবই সাপের উপদ্রব। বেশীরভাগ সাপই বিষধর…” লোকটা আবার বলল, “সন্ধের পরে এলাকার মানুষজনই এদিকে আসার কথা ভাবে না পর্যন্ত। আর আপনারা তো টুরিস্ট। দেখুন মশাই, আপনাদের ভালোর জন্যেই বলছি, সঙ্গে বাচ্ছা নিয়ে এই সময় ওপরে না যাওয়াই ভালো…”
“আমরা সাবধান থাকব”, বলে একটু হাসলেন পরিদাদু। তারপর শাওনের দিকে চেয়ে বললেন, “চল শানু, এগোই আমরা…”
“লোকটা আর কথা বলল না একটাও। শাওনরা সিঁড়ি বেয়ে বেশ কিছুটা ওপরে উঠে যেতেই সে তার মোবাইল ফোনটা চোখের সামনে তুলে ধরে একটা নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করল।
জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে পুরো পাহাড়টা। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে কোথাও বা আবার সেই জ্যোৎস্না লুকিয়েও পড়ছিল মাঝেমাঝে। তিরতির করে হাওয়া বইছিল। সিঁড়ি দিয়ে একটু ঝুঁকে ওপরদিকে উঠছিলেন পরিদাদু। শাওন দু তিন ধাপ পিছনে। হঠাত মাথা তুলে ওপরের দিকে চাইতেই অবাক হয়ে গেল শাওন। একটা লোক অমন তিরবেগে দৌড়ে নীচে নামছে কেন? কে লোকটা? তবে যে নীচের লোকটা বলছিল রাতে এদিকে কেউ আসে না। সাপের উপদ্রবে এ জায়গাটা জনবিহীন হয়ে যায় সন্ধের পরে! ওপর থেকে যে লোকটা নীচে নেমে আসছে, সে অমন দৌড়েই বা নামছে কেন? এমন খাড়াই সিঁড়িতে দৌড়ে নেমে আসা যে কত বিপজ্জনক ও লোকটা কি জানে না!
ভাবতে ভাবতেই লোকটা একেবারে যেন পরিদাদুর গায়ের ওপরে এসে পড়ল হুমড়ি খেয়ে। পরিদাদুর গায়ে জোরসে ধাক্কা দিয়েই কোনোক্রমে টাল সামলে নিয়ে সে আরো দ্রুত নেমে গেল নীচের দিকে। কিন্তু পরিদাদু এই আকস্মিক ধাক্কায় ভারসাম্য হারিয়ে সিঁড়ির ওপরে পড়লেন আছাড় খেয়ে। গড়িয়ে আরো নীচে নামতে নামতেই সিঁড়ির পাশের রেলিং ধরে নিয়ে নিজেকে আটকালেন তিনি। তারপর একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন।
শাওন দ্রুত এগিয়ে গিয়ে পরিদাদুর হাত ধরল, “পরিদাদু, ঠিক আছো তো তুমি?”
“ঠিক আছি”, বলে হাসার চেষ্টা করলেন পরিদাদু। কিন্তু শাওন বেশ বুঝল তিনি মোটেই ঠিক নেই। তাঁর কপালে কেটে গিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল। দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যাচ্ছে পায়েও বেশ লেগেছে তাঁর।
চোয়াল শক্ত করে নীচের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পরিদাদু। দৌড়ে নেমে যাওয়া লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না আর।
“চলো পরিদাদু, আমরা ফিরে যাই”, শাওন বলল তাঁর দিকে চেয়ে, “তোমার ফার্স্ট এইড দরকার এক্ষুনি।”
“পরিদাদু হাসলেন, “চিন্তা করিস না। তেমন কিছু হয়নি। তবে যেভাবে লোকটা আমাকে ধাক্কাটা মেরেছিল তাতে হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল।”
“কিন্তু লোকটা তোমাকে অমন ধাক্কা মারতে গেলই বা কেন?”
“সেইটাই তো বোঝার চেষ্টা করছি শানুবাবু…”, বলেই সিঁড়ির একধারে রেলিং-এর গা ঘেঁষে পড়ে থাকা একটা চশমার খাপের দিকে হাত দিয়ে দেখালেন পরিদাদু, “শানু ওইটে তুলে নে দেখি নীচু হয়ে…”
শাওন চশমার খাপটা তুলে নিতেই পরিদাদু হাত বাড়ালেন, “দে আমাকে।”
শাওনের হাত থেকে নিয়ে খাপসহ চশমাটা নিজের প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন পরিদাদু। তারপর শাওনকে বললেন, “চল, আমরা হোটেলে ফিরে যাই এইবার। কাল সকাল সকাল বেরিয়ে বরং সবাই মিলে দেখে নেওয়া যাবে মন্দিরটা।”
চারদিকটা একদম নিস্তব্ধ। থমথম করছে চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের পিছনদিকের পুরো জঙ্গলটা। তারমধ্যেই একটা খুব ক্ষীন ঠুক ঠুক শব্দ ভেসে আসছে কানে। পরিদাদু সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেও একবার থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর দু চোখের ভুরু কুঁচকে উঠল। চোয়াল শক্ত উঠল হঠাৎ করেই। শাওন অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, “শব্দটা কিসের পরিদাদু?
পরিদাদুর সে কথার উত্তর না দিয়ে শাওনের পিঠে হাত রেখে বললেন, “কিছু না। চল। নেমে যাই এখান থেকে।”
৩
পরিদাদুর ভালোই চোট লেগেছিল, তবু সকালে সকলের আগে তিনিই উঠেছিলেন যথারীতি। শাওন ঘুম থেকে উঠেই পরিদাদুর সঙ্গে দেখা করতে তাঁর ঘরের দিকে দৌড়েছিল, কিন্তু গিয়ে দেখল পরিদাদু ঘরে নেই। তাঁর ঘর বাইরে থেকে তালাবন্ধ। রিসেপশনে জিগ্যেস করে জানা গেল সকলের আগে ঘুম থেকে উঠে তিনি একা একাই বাইরে বেরিয়ে গেছেন। সুছন্দা বললেন, “পরিকাকু কিছুতেই শুধরোবে না। কালই অমন একটা কান্ড ঘটালো। শরীরের ওপরে কম ধকল তো যায়নি। বয়েস হচ্ছে, এই সরল সত্যি কথাটা কেন যে পরিকাকুর মনে থাকে না কে জানে! কাল যে ভাবে হোটেলে ফিরল তা দেখে আমাদেরই তো শয্যাশায়ী হবার অবস্থা হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে মানুষ তো শুয়ে বসে খানিক বিশ্রাম নেয়… তা নয়। পরিকাকু সেই একইরকম ডানপিটে আর একগুঁয়ে থেকে গেল চিরকাল।”
“ওর সঙ্গে কী একটা গ্রহের লিখন আছে বুঝলে তো”, অরুণাংশু বললেন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে, “আজ অব্দি একবারও দেখলাম না, পরির সঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেছি, অথচ কোনো ঝামেলা ঝঞ্ঝাটে জড়াতে হয়নি…”
“যা বলে”, সুছন্দা সায় দিলেন তাঁর কথায়।
শাওন চুপ করে ছিল। মনে মনে বেশ উত্তেজনা বোধ করছিল সে। তার নিশ্চিত মনে হচ্ছে, কালকের ঘটনাটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পিছনে একটা কিছু রহস্য আছেই আছে। আর সে রহস্য যে কী সে বিষয়ে অনুসন্ধান করতেই পরিদাদু কাউকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন একা একা। পরিদাদুর সঙ্গে থেকে থেকে তাঁর গতিবিধি কিছুটা সে এখন আঁচ করতে পারে। শাওন বুঝতে পারছিল এখানে কিছু একটা ঘটছে। আর সেই রহস্য সম্পর্কে অবশ্যই পরিদাদু কিছু আঁচ করতে পেরেছেন মনে মনে।
পরিদাদু অবশ্য আধ ঘন্টা পরেই ফিরে এলেন। ফিরেই হাঁক ডাক করতে শুরু করলেন তিনি, “কী ব্যাপার অরুণ, কী রে শানু তোরা রেডি হোসনি এখনও?”
“তুমিই তো সাত সকালে হাওয়া হয়ে গেলে কাউকে কিছু না জানিয়ে। কী করে রেডি হব?” সুছন্দা বললেন অনুযোগের সুরে।
“তাতে কী?” পরিদাদু হাসলেন, “তুই তো জানিসই, ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে খানিক হেঁটে চলে বেড়ানো আমার পুরনো স্বভাব…”
“তাই বলে এই শরীরে?” সুছন্দা আবার বলেন।
“আরে ঠিক আছি আমি। তোফা আছি”, পরিদাদু বলেন আশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে।
“তা আজ হাঁটাচলা করতে কদ্দুর গিয়েছিলে সে খবরটুকু কি জানতে পারি?” অরুণাংশু জিগ্যেস করলেন পরিদাদুর দিকে চেয়ে।
“খুব বেশি দূর নয় হুজুর”, পরিদাদু হেসে অরুণাংশুর কাঁধে হাত রাখলেন, “চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির, ধুঁয়াধার জলপ্রপাত আর এদিকে পঞ্চবটী আর সরস্বতী ঘাট…”
“উরিব্বাস এ তো দীর্ঘ পথ।” অরুণাংশু হাঁ করে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ পরিদাদুর দিকে, “ঠিক করে বলো তো কখন বেরিয়েছিলে?”
“তা আজ খানিক সকাল সকালই বেরিয়েছিলাম বটে। তা ধরো সূর্য ওঠার ঠিক আগে আগেই…” পরিদাদুর মুখে কৌতূক।
“এত সকালে হঠাৎ?”
“দরকার ছিল। দেরি হলে ব্যাপারস্যাপার অন্যরকম হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল হে।”
“কী ব্যাপার?”
“আছে এক ব্যাপার।”
“বলা যাবে না?”
“উঁহু, এখন না।”
“বড্ড হেঁয়ালি করো বাপু তুমি”, সুছন্দা বলেন এইবার।
সুছন্দার এই কথার উত্তর না দিয়ে পরিদাদু তাড়া লাগান, “তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে সবাই খুকু। বেরোবি না বাইরে? বেড়াতে এসে কি হোটেলেই সময় কাটাবি নাকি?”
“আমরা এখন কোথায় যাব প্রথমে পরিদাদু?” শাওন জিগ্যেস করে।
“প্রথমেই আমরা যাব আমাদের নিয়ারেস্ট মন্দিরে।”
“পাঁচমাথা মন্দির?” শাওন জিজ্ঞেস করে আবার।
“হ্যাঁ”, মাথা নাড়েন পরিদাদু, “সকালে ওখানে গিয়ে শুনে এলাম একটু পরেই বিখ্যাত একজন মানুষ আসবেন ওখানে। মস্ত ভক্ত এবং যোগী। বড় ইচ্ছে তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করি।”
“ওমা তাই নাকি?” সুছন্দা আগ্রহের সঙ্গে বলেন, “তাহলে তো দেখা করতেই হবে। ভাগ্য সহায় না হলে কি আর মহাপুরুষ দর্শন হয়…”
“ঠিক”, তাঁর কথায় মাথা নেড়ে সায় দেন পরিদাদু।
৪
পাঁচমাথা মন্দিরের মূল গর্ভগৃহের মধ্যে বিরাজ করছেন সিদ্ধেশ্বর মহাদেব। প্রায় এগারোশ বছরের পুরনো। এই মূল মন্দিরের পাশাপাশি একটু নীচে আরো তিনটি গর্ভগৃহ। প্রতিটি গর্ভগৃহেই শিবলিঙ্গ। প্রতিটি অত্যন্ত প্রাচীন বাণলিঙ্গ। মূল মন্দিরে ওঠার পথে ডানদিকে অপেক্ষাকৃত যে ছোট্ট মন্দির সেখানে শিবলিঙ্গের সঙ্গে রয়েছে গণেশের মূর্তিও। এই মূর্তিটি সাদা পাথরের। কিন্তু শিবলিঙ্গগুলি সাদা, পিঙ্গল, ধূসর নানান বর্ণের। শিবলিঙ্গগুলির কোনোটিই মসৃণ নয়, এরা সকলেই অমসৃণ, খসখসে, কিন্তু শীতল ও সুখস্পর্শী।
মন্দিরের চাতাল থেকে নীচে মা নর্মদাকে দেখা যাচ্ছে।
শাওনরা মন্দিরের সেই চাতালে গিয়ে বসতেই মন্দিরের পুরোহিত তাদের বললেন, “মা নর্মদা ভগবান শিবের ঘাম থেকে উৎপন্ন। ইনি শিবের মানসকন্যা। এই নদীগর্ভ ও নদীসংলগ্ন সমস্ত পাথরই শিব…”
সুছন্দা হাঁ করে তাঁর কথা শুনছিলেন নিঃশব্দে। পুরোহিত তাঁর মুখের ওপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবার বললেন, “মা-কে দু’হাত জোড় করে প্রণাম সকলে। বলো হে শঙ্কর স্বেদসম্ভূতা, হে সনাতনী, তুমি আমাদের প্রণাম গ্রহন করো।”
শাওন, সুছন্দা, অরুণাংশু, সকলেই প্রণাম করলেন মা নর্মদাকে। পরিদাদু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নর্মদা নদীর দিকে চেয়ে অনুচ্চ গলায় বলে উঠলেন, “হে নর্মদা, হে প্রাচীন রেবা, তোমারই বুকের কাছে থেকে যে বা যারা অহেতুক লোভ ও অন্যায়ে ডুবে থাকে, তুমি তাদের যেন আড়াল করে রেখো না। তাদের অপকীর্তি জনসম্মুখে এনো তুমি।”
পুরোহিতমশাই একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন পরিদাদুর দিকে। সম্ভবত পরিদাদু কী বলছেন তা বোঝার চেষ্টা করছিলেন তিনি।
পরিদাদু শাওনদের পাশের চাতালে এসে বসতেই তিনি জিগ্যেস করলেন, “বাঙালি?”
“হ্যাঁ।”
“কলকাতা?”
“হুঁ।” আবার উপর নীচ মাথা নাড়লেন পরিদাদু।
তিনিও আমাদের পাশে বসলেন। তারপর ভাঙ্গা বাংলায় বলতে শুরু করলেন, “আমি বাংলা বুঝি। বাঙালিরা খুব বেড়াতে আসেন এখানে। তবে তাদের মধ্যে ধর্মভাব খানিক কমই দেখি আজকাল…”
“নাস্তিকতা এখন একটা আধুনিক ফ্যাশনেবল পোশাকের মতন। অনেকেই ওটা যত্ন করে গায়ে গলিয়ে রাখতে চান।” অরুণাংশু হাসলেন।
“হয়ত”, পুরোহিত হাসলেন, “কিন্তু নাস্তিকতাও একটা বিশ্বাস। তীব্র বিশ্বাস যে তিনি নেই। এই নাস্তিকতাও খুব সহজে অর্জন করা যায় না…”
“ঠিকই”, পরিদাদু সমর্থন জানালেন তাঁর কথায়।
এই সময়েই আর একজন, যিনি সম্ভবত এই মন্দিরের সহকারী পুরোহিত, এসে পরিদাদুর দিকে তাকিয়ে হাল্কা হাসলেন। তারপর পুরোহিতমশাইয়ের দিকে চেয়ে প্রণাম করে বললেন, “উনি আসছেন।”
শাওন লোকটিকে দেখিয়ে পরিদাদুকে জিগ্যেস করল, “উনি তোমাকে চেনেন?”
“সকালে আলাপ হয়েছে,” বলেই সুছন্দার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তিনি আসছেন। এঁর কথাই বলছিলাম সকালে। খুব ভক্ত…”
“বড়িয়া ভক্ত। খুব বড় ভক্ত আছেন ইনি। এনারও বাঙালি শরীর। মহান যোগী। নাম শংকরজি। মাঝেমধ্যেই নর্মদা তীরে আসেন। দিন কয়েক থেকে সাধন ভজন করেন। আবার ফিরে যান। এখানে সকলেই খুব শ্রদ্ধা করে শংকরজিকে। তাঁর জন্যে সর্বত্রই অবারিত দ্বার…”
“তাই?” পরিদাদু জিগ্যেস করলেন।
“হ্যাঁ।” এবার বলেন ছোট পুরোহিত।
“এইরকম আর কোনো বিশেষ ভক্তের কথা জানেন?” আবার জিগ্যেস করেন পরিদাদু।
“না তো”, মাথা নাড়েন দুজন পুরোহিতই।
পরিদাদু আরো কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে উঠে আসছেন একজন বলিষ্ঠ মানুষ। পাট করে চুল আঁচড়ানো। পরনে সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ফাঁক দিয়ে দু’ছড়া মালা দেখা যাচ্ছে তাঁর গলায়। একটা স্ফটিকের। অন্যটা সম্ভবত পদ্মবীজ।
দুই পুরোহিতই সাদর অভ্যর্থনা জানালেন তাঁকে, “প্রণাম শংকর মহারাজ।”
শাওন মনে মনে অবাক হয়ে গেল। শংকর মহারাজের কথা শুনে সে ভেবেছিল গেরুয়া টেরুয়া পরা মাথায় জটা, গলায় রুদ্রাক্ষ কোনো দশাসই সন্ন্যাসীকে দেখবে সে।
শংকর মহারাজ শাওনের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আমি তো সন্ন্যাসী নই বাবা। আমি তো গৃহী।”
শাওন চমকে উঠল। শংকরবাবা তার মনের কথা কী করে জানতে পারলেন?”
শংকরবাবা আবার তাকে চমকে দিয়ে বললেন, “এ পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু হয় না বাবা। আর এই রেবাক্ষেত্রে তো অসম্ভব শব্দটি একেবারেই অচল। এই নর্মদা নদীর উভয় তটই অতি পবিত্র। এখানে মানুষ অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার তপস্যা করতে আসে। সেই তপস্যায় সততা আর নিষ্ঠা থাকলে সিদ্ধিলাভ অনিবার্য…”
“কিন্তু এই রেবাক্ষেত্রেই তো কেউ বা কিছু মানুষ অসৎ কাজেও মেতে উঠেছে মহারাজ। আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি সেই ষড়যন্ত্র”, পরিদাদু শংকরবাবার চোখের দিকে চেয়ে বলে ওঠেন শান্ত কন্ঠে।
শংকরবাবা পরিদাদুর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন এখন। তাঁর চোখে তীব্র কৌতুক। হঠাতই তিনি পরিদাদুর কাঁধের ওপরে একটা হাত রেখে বলে ওঠেন, “সত্যিকে জানা কি এতই সহজ? এই কথা আপনার চেয়ে বেশী ভালো কে জানে বলুন?”
পরিদাদু তাঁর দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলেন, “সে কাজ সহজ নয় বলেই তো সত্যিকে খুঁজে বের করতে গিয়ে বার বার বিপদে পড়তে হয়েছে আমাকে…”
“সে বিপদ থেকে কোনো একটা পজিটিভ শক্তি বার বার আপনাকে বাঁচিয়েও তো দিয়েছে মিস্টার চ্যাটার্জী…”
পরিদাদু চমকে উঠলেন। অবাক গলায় বললেন, “এর মধ্যেই আপনি আমার সম্পর্কে খবর নিয়েছেন কোনো বিশেষ সূত্র থেকে!”
শংকরবাবা হাসলেন, “আপনিও তো নিয়েছেন। আমার ফেলে যাওয়া চশমার খাপে থাকা প্রেসকিপশন থেকে…”
পরিদাদুর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, “তাহলে স্বীকার করছেন আপনিই কাল আমাকে চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরে ওঠার সিঁড়িতে ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছিলেন।”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“ওই সময় আপনার যে ওখানে যাওয়া উচিৎ হত না। আমি তো তখন পূর্ণদৃষ্টিতে আপনার দিকে চাইনি। বুঝব কেমন করে আপনি আলোকিত না অন্ধকারাচ্ছন্ন?”
“মানে?”
“আপনি যা ভাবছেন তা নয়…”
“আমি কী ভাবছি আপনি তা জানেন?”
“জানি হে জানি”, শংকরবাবা যেন খুব মজা পেয়েছেন এমন মুখ করে হাসতে লাগলেন দুলে দুলে। তার উত্তর আমি দেব না। সে উত্তর আপনি নিজেই এক্ষুনি পেয়ে যাবেন। তারা এখানেই আসছে।”
“কারা?”
“আপনি যাদের ষড়যন্ত্র রুখতে চাইছেন মনেপ্রাণে। যাদের খোঁজে বা ভালো যে জিনিসের খোঁজে আপনি সরস্বতী ঘাটে গিয়ে নৌকো খুঁজছিলেন ওপারের পাহাড়ে চড়বেন বলে…”
“আপনি এসবও জানেন?”
“জানি।”
“তার মানে আপনি এ-ও জানেন আমাকে বলা হয়েছে হড়পা বানের পনেরোই জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এখানে বোটিং বন্ধ থাকে।”
“সত্যিই থাকে।”
“কিন্তু কাল গভীর রাতে আমি এই নদীতে নৌকো চলতে দেখেছি। সেই নৌকোয় এক আরোহী ছিলেন। দীর্ঘ দেহ তাঁর। পরনের ধুতি এবং পাঞ্জাবি। আপনারই মতন। চাঁদের আলোতেও বোঝা যাচ্ছিল…তিনি উল্টোদিকের পাহাড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এলেন আবার…”
“ঠিকই দেখেছেন।”
“আপনি এটাও স্বীকার করে নিচ্ছেন?”
“হ্যাঁ। আমি তো অসত্য বলি না…”
“আপনি এ কথা স্বীকার করতে কুন্ঠিত হচ্ছেন না? ধরা পড়ার ভয় হচ্ছে না আপনার?”
“না তো?”
“আপনি কে?” থতমত খাওয়া গলায় জিগ্যেস করলেন পরিদাদু।
“আমি একজন ভারতীয় যোগী। এ দেশের লুপ্তপ্রায় একটা বিজ্ঞানকে আমি মন দিয়ে চর্চা করার চেষ্টা করছি…”
“কী সেই বিজ্ঞান?”
“আত্মশক্তি জাগরণের কতকগুলো গুহ্যসংকেত আর বিশেষ কিছু মন্ত্রের সঠিক উচ্চারণের দ্বারা সৃষ্ট ভাইব্রেশনের সাহায্যে আমি বিশ্বপ্রকৃতিকে জানার চেষ্টা করছি…”
“একে আপনি বিজ্ঞান বলেন?”
“অবশ্যই।”
পরিদাদু কিছু জিগ্যেস করতে যাচ্ছিলেন আবার। কিন্তু অনেকগুলো পায়ের শব্দে তিনি থামলেন। তিনজন পুলিশ দুটো লোককে বেঁধে নিয়ে এসেছে পাঁচমাথা মন্দিরে। জুতো খুলে মন্দিরের চাতালে পৌঁছলেন সকলে। পুলিশের লোকেরা মাথা নীচু করে অভিবাদন জানালেন শংকরবাবাকে। তারপর তাঁরা চাইলেন পরিদাদুর দিকে, “আপনিই পরিমলবাবু?”
“হ্যাঁ”, থতমত খেয়ে বলে ওঠেন পরিদাদু।
“আপনাকে ধন্যবাদ।”
“কেন?”
“আপনার সততা, সাহস, পর্যবেক্ষণ এবং চেষ্টার জন্যেই এই দুই মূর্তিচোরকে সনাক্ত করা সম্ভব হল।”
“কিন্তু আমি তো…”
“আপনি পর্যটক। এখানে নতুন। আমাদের সঠিক খবর দেওয়া হয়ত সম্ভব হয়নি আপনার পক্ষে। কিন্তু শংকর মহারাজ সঠিক সময়েই আমাদের সতর্ক করেছিলেন। তিনিই আপনার কথা আমাদের বলেন। প্রথম যেদিন আপনি মন্দিরে উঠছিলেন আমি নীচে আপনাকে বারণ করি। আপনি আমার কথা না শুনে ওপরে উঠতে গেলেন। ওইদিন শংকরবাবার সঙ্গে আপনার ধাক্কা লেগেছিল…”
“আপনারা সব জানেন?”
“হ্যাঁ।
“কিন্তু আপনি ওইদিন ওখানে আমাকে বাধা দিলেন কেন? শংকরবাবাই বা কী করছিলেন ওখানে?”
“মূল মূর্তিটা চুরি যেতে পারে বুঝে উনি আসল মূর্তিটাকে দু’দিনের জন্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন পাহাড়ে। সেদিন তিনি একটা নকল মূর্তি রাখতে গিয়েছিলেন ওখানে। সরস্বতীঘাটের যে মূর্তিওলা আপনাকে বলেছিল তাদের তৈরি শিবলিঙ্গ প্রতি বছর আপনে আপ বেড়ে যায়, তারাই তৈরি করেছিল নকল মূর্তিটা। আসল মূর্তি ওরাই নৌকো করে পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছিল। কাল আবার তা ফিরিয়েও আনা হয়েছে।”
“তাহলে?”
“কিন্তু এই মূর্তিটিও নকল।”
“মানে?”
“আজ আপনি মন্দিরে গিয়ে যখন খুঁটিয়ে দেখে নকল মূর্তির ব্যাপারটা বুঝে ছুটোছুটি করছিলেন পঞ্চবটি ঘাট আর সরস্বতী ঘাটে তখনই বিষয়টা আমাদের নজরে পড়ে। শংকরবাবাকে খবর দিতে তিনিও বলেন ওটা নকল মূর্তি। এই দুই চোর আসল মূর্তি ওই পাহাড় থেকেই হাতিয়ে নিয়েছিল। আজ পালাবার মতলব করছিল সক্কালবেলা। কিন্তু কপাল খারাপ। এ যে রেবাক্ষেত্র। এখানে অপরাধী পার পায় না কক্ষনো…”
সকলে শংকর মহারাজের দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টে। কী অদ্ভুত নির্লিপ্তি তাঁর দু’চোখ।
এমনকি মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা চোর দুজনও তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে।
পুলিশের একজন অফিসার জিগ্যেস করলেন, “এদের তাহলে কি চালান করে দেব বাবা?”
“কোথায়?” শংকরবাবার দৃষ্টি উদাসীন।
“ফাটকে।”
“কী দরকার?”
“সে কী বাবা!” সকলেই অবাক, “ওরা তো তাহলে আবার অপরাধ করবে?”
“না না, একবার ঠিকঠাক আলোর সন্ধান পেলে কেউ কি আর অন্ধকারে ফিরে যেতে চায়?” বলে শংকরবাবা লোকদুটির গায়ে তাঁর হাতের আঙুল ঠেকালেন আলতো করে। আর অমনি কী আশ্চর্য, স্কুলের বেয়াড়া ছাত্রের মতন এতক্ষণ মাথা গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদুটো হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। চোখের জলে দু’গাল ভেসে যেতে লাগল তাদের।
শংকরবাবা স্নেহের সুরে বললেন, “আর চিন্তা নেই। বাঁধন খুলে দাও ওদের। চোখের জলে সব কালো ধুয়ে গেছে ওদের। ওরা বরং নর্মদার জলে ডুব মেরে আসুক এইবার…”
শংকরবাবা মন্দির ছেড়ে যেতে উদ্যোগ করলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মৃদু স্বরে বললেন, এইবার তাঁর অন্তরালে যাবার সময় এসেছে।
হোটেলে ফিরে গুম হয়ে বসে ছিলেন পরিদাদু। কথা বলছিলেন না।
অনেকক্ষন পরে নিজে থেকেই বললেন, “এমন বেইজ্জতি কখনও হইনি আগে। এই শংকর মহারাজকেই প্রথম থেকে মূর্তি চোর ভেবে এসেছি আমি। আর পুরো ঘটনাটায় আমি হেরে ভূত হয়ে গেছি এক্কেবারে।”
“ধুস হার জিতের কী আছে? এখানে সকলে আসে আলোর সন্ধানে। শংকরবাবা তো বললেন শুনলে। আমরা খানিক হলেও সে আলোর সন্ধান কি পেলাম না পুরো ঘটনাটায়?” সুছন্দা বললেন তৃপ্তির সুরে।
“তা ঠিক”, পরিদাদুর মুখে হাসি ফুটে উঠল।
শাওনের মনে হল এইবারেই ঠিক আলো জ্বলে উঠল। সত্যি সত্যিই আলোর কাছে ফেরা হল তাদের।
অলঙ্করণঃ মৌসুমী
অপূর্ব লাগল
LikeLike