শিবানী রায়চৌধুরীর আগের গল্প খোক্কস, বাড়ি থেকে পালিয়ে(গল্প), ফুলঝাড়ু
পুরনো ঝরঝরে বাড়িটার চিলেকোঠার ঘরে চরকি মা-বাবা আর পাঁচ ভাইবোনের সঙ্গে গাদাগাদি করে ছিল। ওদের মা-বাবা সারাদিন খাবারের খোঁজে বাড়ির বাইরে ঘুরত। খাবার নিয়ে বাড়ি ফিরলে চরকিরা খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কাড়াকাড়ি করে খেত। খাবার বলতে জুটত শুকনো রুটির টুকরো, ছাতাপড়া চিজ আর বাসি কেক। তাই ওরা পাঁচ ভাইবোন সোনামুখ করে চেটেপুটে খেয়ে ফেলত। চরকি যেদিন বাড়ির বাইরে যেতে পারত সেদিন দোকান-বাজার ঘুরে চিনে বাদাম, তিলের তক্তি, আধ-খাওয়া আপেল আর ভাঙা চকোলেট-বিস্কুট জোগাড় করে আনত। চিনি, মিনি, টুনি, কচি ছোটো চার ভাইবোনের সেদিন কী আনন্দ!
চরকির খুব মন খারাপ হয়েছিল। ও একদিন চিলেকোঠার জানলার ফাঁক দিয়ে দেখেছিল তিনজন সুটবুটপরা লোক ঝরঝরে বাড়িটায় আনাগোনা করছে। চরকি কান খাড়া করে শুনেছিল লোকগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, “খুব শিগ্গিরি বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু হবে। দশতলা ফ্ল্যাটবাড়ি হবে। গরম কালে দশতলার ছাদের ওপর সবুজ প্ল্যাস্টিকের ঘাসের বাগানে লাল, হলুদ টিউলিপ ফুল ফুটবে। সেখানে গরম জলের চৌবাচ্চায় লোক সাঁতারের জামা পরে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে ঠান্ডা শরবৎ খাবে।” গলায় লাল টাইবাঁধা কোঁকড়াচুলো ঢ্যাঙা লোকটা ফটো তুলছিল। বেঁটে ভুঁড়িওয়ালা লোকটা একটা ছোটো ক্যামেরার মতো জিনিস দিয়ে ক্লিক্ ক্লিক্ কর বাড়ির মাপ নিচ্ছিল। ছাইরঙা সুটপরা কালো চশমা নাকে লোকটা সবচেয়ে স্মার্ট। সে দুজনকে হুকুম করছিল আর মোবাইল কানে বকবক করে যাচ্ছিল। চরকি বুঝতে পেরেছিল এই চিলেকোঠার ঘর থেকে এবার ওদের আস্তানা গোটাতে হবে। আবার কোন পুরনো ভাঙা বাড়ি খুঁজতে হবে।
চরকিরা থাকত লন্ডন শহরের মধ্যে একটা ঘিঞ্জি পাড়ায়। রাস্তাটার নাম সার্কাস লেন। অনেক অনেক বছর আগে রাস্তাটার কোন নাম ছিল না। রাস্তার শেষে যে বড়ো মাঠটা আছে সেখানে একবার শীতকালে রাশিয়ান সার্কাস দল এসে তাঁবু ফেলেছিল। তারা দু মাস ধরে সার্কাস দেখিয়ে চলে গেল। তারপর থেকে রাস্তাটার নাম হয়ে গেল সার্কাস লেন। সার্কাস লেনে অনেক দোকানপাট। মুদিখানা, ওষুধের ফার্মেসি, দর্জির দোকান আর জুতো-সারাইয়ের দোকান। সেগুলো দেখতে চরকির একটুও ভাল লাগত না। ওর চোখ পড়ে থাকত “প্যাতিসেরি ভ্যালেরি” বলে কেক-রুটির দোকানে। দোকানের বড়ো কাচের জানলার ওপারে থরে থরে সাজানো সাদা, হলুদ, গোলাপি রঙের কাপকেক, ক্রিম ভরা কোন আর জিঞ্জারম্যান বিস্কুট। জিঞ্জারম্যান বিস্কুট আদার গন্ধে ভরা পুতুল বিস্কুট। একদিন একটা বেয়াড়া ছেলে তার মার ওপর রাগ করে আধখাওয়া বিস্কুটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। চরকি সেটা কটকট করে চিবিয়ে খেয়েছিল। মচমচে চিনি কিচকিচে বিস্কুট।
শহরটা ইংল্যান্ডের রাজধানী। শহরটার বয়স দু’হাজার বছরেরও বেশি। অনেক কালের পুরনো শহর বলে ভাঙাচোরা বাড়ির অভাব ছিল না। চরকি দেখেছিল এই পাড়ায় অনেক ঝাঁ-চকমকে চোখধাঁধানো নতুন বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আবার অনেক ত্যারাবাঁকা ভাঙা বাড়ি ঘাড় কাত করে পড়ে আছে। যাদের কোন মাথা গোঁজার জায়গা নেই তারা অনেকে এইসব বাড়ি জবরদখল করে থাকত। চরকিদের ভাঙা ঝরঝরে বাড়িটাতে অনেক রকমের লোক থাকত। চরকিরাও মা-বাপ মিলে সাতজন চিলেকোঠার ঘরটা দখল করে ছিল। ঘরটাকে একটা গুদামঘর বলা যেত। বাক্স বাক্স বই, হ্যান্ডেল-ভাঙা সুটকেস, ছেঁড়া বুটজুতো, শিশি-বোতল আরো অনেক হাবিজাবি জিনিসে ভর্তি ছিল। বইয়ের বাক্সের কোনটাতে শক্ত মলাটের মোটা মোটা বই, কোনটাতে পাতলা মলাটের চটি বই। একটা ছোটো বাক্সে ছিল কতগুলো বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা মলাটছেঁড়া কিছু বই ছিল। বইগুলোতে লেখার সঙ্গে অনেক ছবি। চরকি বইগুলো চিবিয়ে খেয়ে একটু লেখা-পড়া শিখেছিল। চরকি কোনদিন ইস্কুলে পড়ে নি। শুনেছিল ওদের জন্যে কোন ইস্কুল নেই। এইসব জিনিসের মধ্যে চরকি একটা মিনি টাইপ-রাইটারও খুঁজে পেয়েছিল। বোধহয় এক সময় কোন পয়সাওয়ালা লোকের আদুরে ছেলের খেলার জিনিস ছিল। সেই ছেলেটা বড়ো হয়ে এটা বাতিল করে দিয়ে পুরনো বাড়ি ছেড়ে হয়তো হোটেলের মতো চকচকে ফ্ল্যাটে চলে গিয়েছিল। খেলনাটা অকেজো হয়ে পড়ে আছে দেখে চরকি নিজের কাছে রেখেছিল। টাইপ রাইটারটা দেখে চরকির আঙুলগুলো সুরসুর করত। ও অক্ষরগুলো একটা একটা করে টিপে দেখল দিব্যি টাইপ হচ্ছে। চরকি নিজের নাম আর ভাইবোনদের নাম একে একে টাইপ করল – চিনি, মিনি, টুনি, কচি, চরকি। চরকিদের অভাবের সংসার। ওদের সাতজনের খাবার জোগাতে ওর বাবা-মার ঘরে বসে থাকার সময় হত না। ওদের বাবা-মা সারাদিন চাল-গমের গুদামে, মুদিখানায়, ফলের দোকানে লুকোচুরি খেলত।
চিলেকোঠার গুদামঘরে কোন টেলিভিশন ছিল না। একতলায় পিছন দিকের ঘুপচি ঘরটায় জুডি বলে একটা ছোটো মেয়ে তার মার সঙ্গে থাকত। ওদের ঘরে টেলিভিশন ছিল। জুডির মা নতুন ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে ঠিকে কাজ করতেন। সোমবার ছুটির পর জুডি ইস্কুলের ড্রামা ক্লাবে অভিনয় শিখতে যেত। সপ্তাহের অন্য চার দিন মেয়েটা ইস্কুল থেকে ফিরে একা ঘরে টেলিভিশন খুলে মার ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকত।
জুডি যখন টেলিভিশন দেখত চরকিও তখন জানলা দিয়ে উঁকি মেরে টেলিভিশনে সিনেমা দেখত। ও দেখেছিল মিকি, মিনি, মাইটি, জেরি এরা ওর মতো দেখতে কিন্তু সিনেমায় ভালো ভালো অভিনয় করার কাজ পেয়েছে। মিকি আর জেরিকে তো সারা পৃথিবীর লোক চেনে। এছাড়া চরকি স্পিডি গঞ্জালেস আর দেসপারু বলে আরো দুজনকে দেখেছিল। এদের দেখে চরকি সিনেমায় অভিনয় করার স্বপ্ন দেখছিল। চরকি ভাবত সিনেমা করে অনেক টাকা আনবে আর “প্যাতিসেরি ভ্যালেরি” থেকে চার ভাইবোনকে গোলাপি রঙের চিনিমাখা কাপকেক কিনে দেবে। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে চরকির মনে হত ও দেখতে খুব খারাপ না। টেলিভিশনে দেখেছিল ওর মতো চেহারার অনেকেই সিনেমায় নেমে খুব নাম করেছে।
সন্ধের পর জুডির মা কাজ সেরে ঘরে ফিরতেন। তারপর দুজনে পাউরুটি, ডিমভাজা আর টিনের টম্যাটো খেতেন। রোজ রোজ একঘেয়ে খাবার খেতে জুডির একটুও ভাল লাগত না, জুডি রাগ করে জানলা দিয়ে রুটির টুকরো ফেলে দিত। চরকি লুফে নিত। এক এক দিন ওর মা গলির মোড়ের দোকান থেকে গরম গরম মাছভাজা আর আলুভাজা নিয়ে আসতেন। সেদিন জুডি খুব খুশি হয়ে সব খেয়ে ফেলত। চরকির কপালে কিছুই জুটত না। জুডির মা জুডিকে ঘুমানোর আগে গল্প বলতেন। চরকি এই সময়টার জন্যে অপেক্ষা করে থাকত। ও জানলার বাইরে অন্ধকারে বসে গল্প শুনত। ওর চেহারাটা খুব ছোটো বলে জুডিরা ওকে দেখতে পেত না।
চরকি জুডির মার মুখেই শুনেছিল মিকি, মাইটি, জেরি, স্পিডি, দেসপারু এদের সকলের জন্ম আমেরিকায়। ওরা আমেরিকায় সিনেমায় নেমেছে। আমেরিকা দেশটা নাকি বিশাল। জুডিদের দেশটার চেয়ে অনেক বড়ো। জুডিদের দেশটাকে একটা বড়ো দ্বীপ বললেই হয়। আর এ রকম চল্লিশটা দ্বীপ জোড়া লাগালে আমেরিকা। জুডিদের লন্ডন থেকে আমেরিকার খুব বড়ো শহর নিউ ইয়র্ক প্রায় সাড় তিন হাজার মাইল দূরে। মাঝখানে রাশি রাশি জল। তার নাম অতলান্তিক মহাসাগর। একশো বছর আগে লোক জাহাজে করে আমেরিকা যেত। এখন লোক এরোপ্লেনে করে জলের ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে আমেরিকা যায়।
চরকির স্পিডি গঞ্জালেসকে সবচেয়ে ভাল লাগত। স্পিডি দৌড়ে সবাইকে হারিয়ে দিতে পারত। ওর বাপ-ঠাকুর্দা বোধহয় দক্ষিন আমেরিকার মেক্সিকোর লোক ছিল। স্প্যানিশ ভাষা জানত। তবে ও মেক্সিকানদের মতো স্প্যানিশ বলত বলে লোকে অনেক সময় স্পিডির কথা শুনে হাসত। দেসপারুর বাপ-ঠাকুর্দা বোধহয় ফরাসি ছিল। চরকি ভাবত এরা তো আমার মতো, এরা কী করে কাজ পেল। সব দেখেশুনে চরকির এক সময় আমেরিকা যাবার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু চরকি জানত ও আমেরিকা যেতে পারবে না। অতলান্তিকের রাশি রাশি জল পার হয়ে ও কী করে যাবে। রাস্তার গর্তে জল জমলেই চরকি হাবুডুবু খেত।
চরকি ভাবল ও লন্ডনেই সিনেমায় বা টেলিভিশনে কাজ খুঁজবে। চরকি টাইপ রাইটারটা নিয়ে বসল। ও যা যা করতে পারে তার একটা লিস্ট করল। লিস্টটার নাম দিল চরকির কেরামতি।
চরকির কেরামতিঃ আমার নাম চরকি আমি লাফাতে পারি, ঝাঁপাতে পারি, লম্বা দেয়াল বেয়ে উঠতে পারি, দৌড়তে পারি, ধারালো দাঁতে কামড়াতে পারি, আনাচকানাচে হারানো জিনিস খুঁজতে পারি, কানে খুব ভালো শুনতে পাই তবে চোখে খুব ভাল দেখতে পাই না। আমি সিনেমা বা টেলিভিশনে অভিনয় করতে চাই।
চরকি, চিলেকোঠার ঘর, ভাঙা বাড়ি, ৮ নম্বর সার্কাস লেন, লন্ডন।
সার্কাস লেনের মুদিখানার বাইেরর দেয়ালজুড়ে একটা বড়ো নেটিশ বোর্ড। যার ওপর বড়ো বড়ো করে লেখা “সার্কাস লেন নোটিশপত্র”। কারো কিছু হারিয়ে গেলে, কেউ কিছু খুঁজে পেলে কাগজে লিখে নোটিশ বোর্ডে আটকে দেয়। আবার অনেকে নোটিশ বোর্ডে লিখে চাকরির খোঁজ করে। চাকরির বিজ্ঞাপনও থাকে। চরকি ঠিক করল ওর লেখাটা নোটিশ বোর্ডে আটকে দেবে। ও নোটিশ বোর্ডের লেখাগুলো পড়ে দেখছিল।
আমার আদরের সোনালী মাছ কাচের গামলা থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। নাম লাকি। তাকে রাস্তাঘাটে বা নর্দমার জলে দেখতে পেলে পিটারকে অবশ্যই জানাবেন। ২২ নম্বর সার্কাস লেন।
আমার চশমা অদৃশ্য হয়ে গেছে। ডাক্তাখানায় রুগী দেখছিলাম। খুঁজে পেলে দয়া করে ফেরত দেবেন। ডঃ টুথ, ১৭ নম্বর সার্কাস লেন।
মিসেস মরিসনের কালো চামরার মানিব্যাগ উধাও। এই মাসের প্রথম দিন মুদিখানায় কেনাকাটা করছিলেন। মাইনের সব টাকা মানিব্যাগে ছিল। টেলিফোনঃ ০২০ ৮৪৫৯ ৩৩৩৭।
গাবলুকে ফেরত চাই। মাছ খেতে ভালবাসে। মাছের দোকানের আসেপাশে মিঁয়াও মিঁয়াও করে ঘুরে বেড়ায়। ছাইরঙা গায়ের লোম। ১১ নম্বরের চার্লি।
শেষ লেখাটা পড়ে চরকি ভয়ে পেল। ঠিক করল ও কিছুতেই মাছের দোকানের কাছে যাবে না। চটপট ওর নিজের লেখাটা বোর্ডে আটকে দিয়ে চলে এল।
পরের দিন চরকি চিলেকোঠার ঘরে অপেক্ষা করছিল। ভেবেছিল ওর লেখাটা পড়ে কোন সিনেমা, থিয়েটার কি টেলিভিশনের লোক ওর খোঁজ করতে আসবে। একদিন গেল, দু”দিন গেল, কেউ এল না। চরকির খুব মন খারাপ হল।
এদিকে জুডি ইস্কুল থেকে ফেরার পথে নোটিশ বোর্ডের লেখাগুলো পড়েছিল। ও পড়ে দেখছিল চার্লির গাবলু আর পিটারের লাকিকে পাওয়া গেল কিনা। পিটার আর চার্লি ওদের ইস্কুলে পড়ে। চরকির লেখাটা চোখে পড়তেই জুডি অবাক হয়ে গেল। ঠিকানাটা ওদের ভাঙা বাড়ির। ও জানতই না যে চিলেকোঠার ঘরে কেউ থাকে। লেখাটা পড়ে ওর মনে হয়েছিল বোধহয় কোন ছোটোছেলে মজা করে লিখেছে। ছেলেটা আবার ওর মতোই অভিনয় করতে চায়। জুডি ওর মা কাজ থেকে ফিরতেই চরকির বিজ্ঞাপনের কথা বলল। জুডির মা বললেন, “একবার ছাদে উঠে আলাপ করে এস। আমাদের এখানে এক দিন আসতে বল। ছাদে ওঠার সিঁড়িটা অনেক কালের পুরনো। অনেক ধাপে ফাটল ধরেছে। খুব সাবধানে উঠবে।”
পরের দিনই ইস্কুলের ছুটির পর জুডি বাড়ি ফিরে সোজা ছাদে গেল। জুডি ওদের একতলার দমবন্ধকরা অন্ধকার ঘর থেকে কোন দিন আকাশের মুখ দেখে নি। জানলা দিয়ে শুধু দেখেছে কতগুলো জুতো-মোজাপরা পা তাড়াতাড়ি হেঁটে যাচ্ছে । তাই ছাদের খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিয়ে আর আকাশে মেঘের খেলা দেখে ওর মনটা খুশিতে ভরে উঠল। চিলেকোঠার ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে জুডির সব আশা উবে গেল। ঘরের নড়বড়ে কাঠের দরজায় একটা ইয়া বড়ো মরচে ধরা লোহার তালা। এমন তালা জুডি কোনদিন দেখেনি। জুডির মনে হল তালাটা অনেক দিন বোধহয় কেউ খোলে নি। জুডি ছাদের চারদিকে কয়েক বার ঘুরে দেখল কিন্তু চরকিকে দেখতে পেল না। জুডি হতাশ হয়ে ভাবল চরকি বোধহয় বাড়ির নম্বর লিখতে ভুল করেছে। সার্কাস লেনে অনেক ভাঙা বাড়ি আছে। চরকি হয়ত অন্য কোন ভাঙা বাড়িতে থাকে। চরকি চিলেকোঠার ভিতরে জানলায় বসেছিল। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে ইস্কুলের নীল ইউনিফর্ম পরা জুডিকে দেখে চিনতে পেরেছিল। কিন্তু জানলা দিয়ে বেরিয়ে এসে দেখা করার সাহস হয় নি। জুডি চলে যেতে চরকিও হতাশ হয়েছিল।
জুডি বাড়ি ফিরে ওর মাকে বলল, “চিলেকোঠার ভাঙা দরজায় বড়ো তালা ঝুলছে। ওখানে কেউ থাকে না।” জুডির মা বললেন, “তুমি নোটিশ বোর্ডে চরকির লেখার নিচে ওকে আমাদের এখানে আসার জন্যে নেমতন্ন করে এস।” জুডি লিখল,
“ভাই চরকি, চিলেকোঠার ঘরে তালা বন্ধ ছিল। তোমাকে খুঁজে পেলাম না। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমাদের ইস্কুলে সোমবার ছুটির পর ড্রামা ক্লাব হয়। আমি সেখানে অভিনয় শিখতে যাই। সামনের বুধবার বিকেল চারটের সময় আমাদের ঘরে এস। একতলায় কোনার দিকের ছোটো ঘর। ভাঙা বাড়ি, ৮ নম্বর সার্কাস লেন।”
বুধবার বিকেলে জুডি ইস্কুল থেকে ফিরে চরকির জন্যে অপেক্ষা করছিল। ওদের জন্যে মা বাদাম আর চকোলেট বিস্কুট রেখেছিলেন। সাড়ে চারটে বাজল, পাঁচটা বাজল। জুডি অনেক আশা করে বসেছিল কিন্তু চরকির দেখা মিলল না। চরকি কিন্তু এসেছিল। ও জানলা দিয়ে ঘরের মেঝেতে নামতেই জুডি লাফিয়ে উঠেছিল। “এই, তুই কোথা থেকে এলি? বের হয়ে যা।” বলে জুডি রুলকাঠ নিয়ে চরকিকে তাড়া করছিল। চরকি মনের দুঃখে চিলেকোঠায় ফিরে এসেছিল। চরকির মাথায় অনেক বুদ্ধি। ও ঘাবড়ালো না। পরের দিন ওর আগের লেখাটার নিচে আর একটা কগজে লিখল –
“আমি মিকি, জেরি, স্পিডির মতো অভিনয় করতে চাই। আমি ওদের মতোই ভালো দেখতে।”
জুডির মা কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। ভাবলেন বোর্ডে কোন নতুন নোটিশ আছে কিনা পড়ে দেখি। চরকির লেখাটা পড়েই বুঝতে পারলেন জুডি কেন চরকিকে খুঁজে পাচ্ছে না। জুডি একটা ছোটো ছেলেকে খুঁজছিল। কিন্তু চরকি তো ছোটো ছেলে নয়।
বাড়ি ফিরে মা জুডিকে বললেন, “জুডি, তুমি একটা ছোটো ছেলেকে খুঁজছ। চরকি বোধহয় ছোটো ছেলে নয়।”
জুডি জিজ্ঞেস করল, “চরকি তাহলে কী?” মা বললেন, “চরকি নোটিশবোর্ডে লিখেছে যে ওকে মিকি, জেরি, স্পিডিদের মতো ভালো দেখতে।” জুডি তাও বুঝতে পারল না দেখে মা বললেন, “তুমি নাম শুনে এদের চিনতে পারছ না? মিকি মাউস, টম এন্ড জেরির জেরি, স্পিডি গঞ্জালেস।”
শুনে জুডি বলল, “মা, বুধবার একটা ইঁদুর জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। তার মানে চরকি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আমি ত ওকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলাম। এখন কী হবে?”
মা বললেন, “এবার ক্ষমা চেয়ে ডেকে আন।” জুডি মাকে বলল, “চরকিকে সোমবার বিকেলে আসতে বলব। তারপর ওকে নিয়ে ড্রামা ক্লাবে যাব। ও নিশ্চয় খুব খুশি হবে।”
জুডি নোটিশবোর্ডে চরকির জন্যে লিখে এল,
“ভাই চরকি, তুমি বুধবার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে। তোমাকে চিনতে পারিনি বলে আমার খুব খারাপ লাগছে। সামনের সোমবার বিকেলে এস। তোমাকে আমাদের ইস্কুলের ড্রামা ক্লাবে নিয়ে যাব।”
জুডিদের ভাঙাবাড়ি থেকে হেঁটে ইস্কুলে যেতে দশ মিনিট লাগে। রবিবার সারা দিন ধরে জুডি ভাবল কী করে চরকিকে ইস্কুলে নিয়ে যাবে। চরকি একা একা গেলে খুঁজে পাবে না। জুডি চরকির সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে পারবে না। চরকি হয়তো বড়ো রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়বে। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করল চরকিকে সাদা প্ল্যাস্টিকের কৌটো করে নিয়ে যাবে। বন্ধুদের বলবে ওর পোষা ইঁদুর। ওর বন্ধুরা অনেক সময় ড্রামা ক্লাবে ওদের পোষা কুকুরকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। এক বছর আগে গরমকালে ওদের ইস্কুলে ছেলেমেয়েরা একটা ছোটোদের চিড়িয়াখানা করেছিল। তাতে যার যা পোষা জন্তু আছে নিয়ে এসেছিল। কুকুর, বিড়াল, খরগোশ, সাদা ইঁদুর, কচ্ছপ, লাল মাছ, ছোটো বাঁদর, বেঁটে ছাগল, মাইক্রো শুয়োর, ব্যাঙ আর শামুক এনেছিল। বাইরের লোক পয়সা দিয়ে দেখতে এসেছিল। যা পয়সা উঠেছিল তা ওরা পশুকল্যাণ সমিতিকে দান করেছিল। সোমবার ইস্কুল থেকে ফিরে জুডি একটা সাদা প্ল্যাস্টিকের কৌটোতে চিনেবাদাম আর কয়েক টুকরো চিজ রাখল। একটা টিনের ঢাকনায় একটু দুধ। চরকির কোন ঘড়ি ছিল না। তাই দুপুর থেকে জানলার পাশে অপেক্ষা করছিল। জুডিকে দেখতে পেয়ে জানলা দিয়ে ঘরে এল। জুডি কৌটোটা চরকির কাছে আনতেই চরকি ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। চরকি ভাবল জুডি ওকে জাঁতিকলে ধরার চেষ্টা করছে। ছোটোবেলায় ওর মা বলেছিল জাঁতিকল থেকে দূরে থাকবি। ও ভাইবোনদেরও সব সময় জাঁতিকল থেকে সাবধান হতে বলে। জুডি যখন ওর পিঠে পাউডার লাগিয়ে গলায় হলুদ ফিতে বেঁধে দিল, তখন চরকির ভয় ভেঙে গেল। ও লাফ দিয়ে কৌটোতে বসল। জুডি ওর ইস্কুলের ব্যাগে করে কৌটোটা নিয়ে ড্রামা ক্লাবে গেল। ক্লাবে পৌঁছে জুডি ব্যাগ থেকে কৌটোটা বের করতেই ওর বন্ধুরা চরকিকে ঘিরে ধরল। জুডি সবাইকে বলল যে চরকি ওর পোষা ইঁদুর। চরকি সিনেমা কী টেলিভিশনে অভিনয় করতে চায়। শুনে সবাই হো হো হেসে উঠল। ওদের ড্রামা টিচার মিস কুক এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, “ছেলেমেয়েরা, এত হট্টগোল কেন?”
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, “মিস, জুডির পোষা ইঁদুর অভিনয় করতে চায়। ইঁদুররা অনিষ্ট করা ছাড়া কিছু করতে পারে না।”
চরকি সব শুনছিল আর রাগে কিচমিচ করছিল। জুডিরও রাগ হচ্ছিল। মিস কুক এসে ওদের বাঁচালেন। চরকিকে ভালো করে দেখে ইঁদুরদের বিষয়ে একটা বক্তৃতা দিলেন। বললেন, “ইঁদুরদের সঙ্গে মানুষের অনেক মিল আছে। ওরা খুব মিশুকে আর লোকজন ভালবাসে। খেলতে ভালবাসে। ইঁদুররা খুব চালাক আর কৌতূহলী বলে সহজেই অনেক ছলচাতুরির খেলা শিখতে পারে। কোন ঘোরানোপ্যাঁচানো জায়গায় ছেড়ে দিলে ঠিক বেরিয়ে আসতে পারে। ওদের শরীরের সঙ্গে আমাদের শরীরের অনেক মিল আছে বলে ডাক্তার আর বিজ্ঞানীরা ওদের ওপর ওষুধ পরীক্ষা করে আমাদের দেন। মনে রেখ ইঁদুর আমাদের অনেক উপকার করে।”
মিস কুকের কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। ক্লাবের শেষে মিস কুক বললেন, “দু মাস পরে খ্রিস্টমাস। প্রত্যেক বছর আমরা খ্রিস্টমাসে একটা ভাল কিছু অভিনয় করি। এবারের জন্যে কিছু ঠিক করতে হবে।”
সেদিনকার মতো জুডি চরকিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। চরকি কৌটো থেকে ঝাঁপ দিয়ে বেরিয়ে এসে জুডির পায়ের কাছে বসল। জুডির মা বললেন, “দেখ, চরকি তোমার বন্ধু হয়ে গেছে।”
জুডি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “চরকি, এবার ঘরে যা।” চরকি জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। তারপর থেকে চরকি রোজ বিকেলবেলা জুডির পাশে বসে টেলিভিশন দেখত আর সোমবার ড্রামা ক্লাবে যেত।
এক সোমবার ড্রামা ক্লাবে মিস কুক বললেন, “আমি ঠিক করেছি এবার খ্রিস্টমাসে আমরা সিন্ডেরেলার গল্পটা অভিনয় করে দেখাব। সবাই সিন্ডেরেলার গল্পটা জান নিশ্চয়?”
সবাই এক সঙ্গে “জানি জানি” বলে উঠল শুধু জুডিদের ক্লাসের তালেয়া ছাড়া। তালেয়া কয়েক মাস হল বাংলাদেশ থেকে এসেছিল। ইংরিজি ভালো জানত না। গল্পটা বাংলায় পড়েনি। তাই মিস কুক ওকে খুব ছোটো করে গল্পটা বললেন, “সিন্ডেরেলার গল্পটা অনেক দিনের পুরনো রূপকথা। সিন্ডেরেলার নিজের মা ছিল না। সৎমার কাছে থাকত। সৎমা আর দুই সৎবোন সিন্ডেরেলাকে খুব কষ্ট দিত। ও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাড়ির সব কাজ করত। ঘর ঝাঁট দিত, ঘর মুছত, রান্না করত, বাসন মাজত। অনেক রাত্তিরে ক্লান্ত হয়ে রান্নাঘরে পাথরের ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে পড়ত। সিন্ডেরেলাকে ওর সৎমা পেটভরে খেতে দিত না। জামাকাপড় বলতে সৎবোনদের ফেলে দেওয়া ছেঁড়া জামা-জুতো ছাড়া কিছু জুটত না।
“এক সময় ওদের দেশের রাজা রাজপুত্রের বিয়ের জন্যে সুন্দরী মেয়ে খুঁজছিলেন। একটা বড়ো নাচগানের পার্টি দিলেন। বিয়ের বয়স হয়েছে যেসব মেয়েদের তাদের পার্টিতে নেমতন্ন করলেন। সিন্ডেরেলার দুই সৎবোন ছিল দেখতে কুৎসিত কিন্তু সিন্ডেরেলা ছিল খুব রূপসী। দুই সৎবোন পার্টিতে যাবার জন্যে সাজগোজ করল। সিল্কের লম্বা জামা, ভেলভেটের জুতো আর এক গা গয়না পরে সিন্ডেরেলাকে দেখাল। সিন্ডেরেলা যখন পার্টিতে যেতে চাইল, সৎমা আর সৎবোনরা ওকে বকল, ‘তুই কী করে নাচের পার্টিতে যাবি? তোর ছাইমাখা হাত-পা, ছেঁড়া ময়লা জামা-কাপড়। তুই রান্নাঘর ঝাঁট দে।’
তারপর ওরা পার্টিতে চলে গেল। সিন্ডেরেলা মনের দুঃখে রান্নাঘরে বসে কাঁদছিল। সিন্ডেরেলার ধর্মমা ছিলেন একজন পরী আর ম্যাজিক জানতেন। সিন্ডেরেলাকে খুব ভালবাসতেন। সিন্ডেরেলার দুঃখে ওঁর খুব কষ্ট হল। পরী এসে সিন্ডেরেলাকে নাচের পোষাকে সাজিয়ে দিল। বাগান থেকে একটা বিশাল কুমড়ো এনে ম্যাজিকে সেটাকে ঘোড়াগাড়ি করে ফেলল। ছ’টা ইঁদুর ধরে এনে ঘোড়া বানাল। তারপর সিন্ডেরেলা নাচের ঝলমলে পোশাক পরে সেই ঘোড়াগাড়ি চড়ে রাজবাড়ির নাচের পার্টিতে গেল। পরী সিন্ডেরেলাকে রাত বারোটার আগে ফিরে আসতে বলেছিল। আর বলেছিল রাত বারোটার বাজলেই ও আগের মতো ছেঁড়া জামাপরা, ছাইমাখা সিন্ডেরেলা হয়ে যাবে। পার্টিতে সিন্ডেরেলাকে দেখে রাজপুত্র আর চোখ ফেরাতে পারছিল না। দুজনে অনেকক্ষণ নাচল। বারোটা বাজতেই সিন্ডেরেলা তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এল আর সেই সঙ্গে এক পাটি জুতো ফেলে এল। রাজপুত্র সিন্ডেরেলাকে খুঁজতে লাগল কিন্তু কোথাও দেখতে পেল না। শুধু দেখল সিন্ডেরেলার একপাটি জুতো পড়ে আছে। রাজপুত্র তখন তার পাহারাদারকে আদেশ দিল সারা রাজ্য ঘুরে খুঁজে দেখতে কোন মেয়ে এই জুতো পরে এসেছিল। পাহারাদার বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখল। কারও পায়ে জুতোটা ঠিক হল না। সিন্ডেরেলার দুই সৎবোন জুতোটা টেনে হিঁচড়ে পায়ে ঢোকানোর চেষ্টা করল কিন্তু জুতো ঢুকল না। সিন্ডেরেলা পা দিতেই জুতোটা ঠিক হল। তারপর রাজপুত্র এসে সিন্ডেরেলাকে রাজবাড়ি নিয়ে গেল। সেখানে ওদের ধুমধাম করে বিয়ে হল।”
মিস কুক এক নিঃশ্বাসে গল্পটা শেষ করে বললেন, “চরকি এখানে ইঁদুর হতে পারবে।”
একজন বলল, “মিস, আমাদের ছটা ইঁদুর লাগবে।”
মিস কুক বললেন, “আমরা যদি এক্কাগাড়ি– একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ি করি তাহলে একটা ইঁদুরেই চলবে।” ড্রামা ক্লাবের সবাই সিন্ডেরেলা অভিনয় করতে রাজি হল। পুরোদমে রিহার্সাল চলল। চরকি জুডির সঙ্গে প্ল্যাস্টিকের কৌটো করে ক্লাবে এল। সবাইকে দেখে নকল করে অনেক কিছু শিখে ফেলল। মিস কুক বললেন, “চরকি ইঁদুর থেকে ঘোড়া হবার আগে ওর কেরামতি দেখিয়ে দর্শকদের আনন্দ দেবে। চরকি ডিগবাজি খাবে,দড়ি বেয়ে উঠবে, লুকানো জিনিস খুঁজে বের করবে…।”
জুডি আর ওর কয়েকজন বন্ধু “সার্কাস লেন নোটশপত্রে” চরকির ছবি ও নাম দিয়ে একটা বড়ো বিজ্ঞাপন দিল।
খ্রিস্টমাসের বিশেষ আকর্ষণ সার্কাস লেন প্রাইমারি স্কুলের “সিন্ডেরেলা”। ইঁদুরের অভিনয় আগে দেখেছেন কি? চরকির অভিনয় দেখুন শনিবার, ১৯শে ডিসেম্বর সন্ধে ছটায়, স্থানঃ সার্কাস লেন প্রাইমারি স্কুল। আজই টিকিট কিনুন।
বিজ্ঞাপন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেল। ড্রামা ক্লাবের সবাই দারুণ খুশি। আর সেই সঙ্গে চিরকিরও আদর বেড়ে গেল। ১৯শে ডিসেম্বর ইস্কুলের বড়ো হলঘরটা লোকের ভিড়ে ফেটে পড়ছিল। যারা টিকিট পায় নি তারা পিছনে দাঁড়িয়ে দেখল। চরকি যখন টেবিলের ওপর সিন্ডারেলার কুমড়োগাড়ি গাড়ি টানছিল চারদিক থেকে লোক হাততালি দিয়ে চরকিকে উৎসাহ দিচ্ছিল। চরকিও মনের আনন্দে তার কেরামতি দেখাল। যারা দেখতে এসেছিল তারা সিন্ডেরেলার চেয়ে চরকিকেই বেশি করে দেখেছিল। তারা বলেছিল এ রকম মজার ‘সিন্ডেরেলা’ আগে কখনো দেখেনি।
মিস কুক চরকিকে অনেক বাদাম, চিজ, চকোলেট বিস্কুট, কুকি উপহার দিলেন। ‘প্যাতিসেরি ভ্যালেরি’-র মালিকও এসেছিলেন। উনি ভীষণ খুশি হয়ে চরকিকে এক বাক্স চিনিমাখা কাপকেক উপহার দিলেন। চরকি জুডিদের সঙ্গে সব উপহার নিয়ে রাত নটায় ভাঙাবাড়িতে ফিরে এল। জুডি উপহারগুলো নিয়ে চরকিকে চিলেকোঠার জানলায় পৌঁছে দিয়ে বলল, “এই খাবারে তোদের অনেক দিন চলবে।”
সোমবার দিন ইস্কুলে সকলের মুখে চরকির প্রসংশা। সকালেই মিস কুকের কাছে তিনটে ফোন এল। তিনজনই চরকির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলেন। সার্কাস লেনের ডক্টর টুথ বললেন, “ওষুধের কোম্পানি চরকিকে লুফে নেবে। আর আমার এক বন্ধু মনের ডাক্তার। মানুষের বুদ্ধি পরীক্ষা করে। তারও গবেষণার কাজে বুদ্ধিমান ইঁদুর দরকার।”
‘প্যাতিসেরি ভ্যালেরি’-র মালিক বললেন, “চরকিকে আমার মেয়ের চাই-ই চাই। আমার বড়ো আদরের আহ্লাদি মেয়ে। যা দাম দিতে হয় দেব।”
সার্কাস লেনের কোন নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে একজন ফটোগ্রাফার ফোন করে বললেন, “আমি চরকির কেরামতি দেখে তাজ্জব! টেলিভিশনের জন্যে একটা ছোটোদের ছবি তৈরি করছি। আমি ‘পাতালে ইঁদুরের অভিযান’ ছবির জন্যে চরকির মতো কাউকে খুঁজছি।” মিস কুক তিনজনকেই বললেন পরে জানাবেন।
মিস কুক জুডিকে টেলিফোনের কথা জানালেন। জুডি বলল, “আমি চরকির মালিক নই। চরকি আমাদের বাড়ির চিলেকোঠায় থাকে। আমাদের ঘরে আসে। আমার বন্ধু হয়ে গেছে।”
জুডি বাড়ি ফিরে ওর মাকে সব বলল। ওর মা বললেন, “তুমি ভেবে দেখ কী করবে।”
ছ’বছরের জুডি বলল, “মাম, বন্ধুকে কী কেউ বিক্রি করে?”
জুডির মা বললেন, “চরকিকে বিক্রি করতে হবে না। ওর কিসে ভালো হবে ভেবে দেখ।”
জুডি অনেক ভেবে বলল, “মিস কুক বলেছেন যে ওষুধের কোম্পানি আর মনের ডাক্তার ওর ওপর পরীক্ষা করবে। তাতে ওর কষ্ট হবে। ‘প্যাতিসেরি ভ্যালেরি’তে চরকি রোজ ভালো ভালো খাবার খেতে পাবে, তবে ওই আহ্লাদি মেয়েটা আমাদের ইস্কুলে পড়ে। আমি চাই না চরকি ওর পোষা ইঁদুর হয়ে আমার চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
ওর মা বললেন, “মনে আছে চরকির ইচ্ছে টেলিভিশনে কী সিনেমায় অভিনয় করার।”
জুডি বলল, “তাহলে চরকিকে ফটোগ্রাফার এসে নিয়ে যাক। তবে আমরা চরকিকে বিক্রি করব না। বলব কাজ শেষ হলে চরকিকে ফেরত দিয়ে যেতে।”
জুডির মা বললেন, “এটাই ভালো হল।”
ফটোগ্রাফার এসে চরকিকে নিয়ে গেলেন। চরকি বোধহয় বুঝতে পেরেছিল যে ওকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ও কিচমিচ করছিল দেখে জুডির চোখে জল এসেছিল। জুডি ফটোগ্রাফারের কাছ থেকে টাকা নিতে রাজি হল না। বলল ছবির কাজ শেষ হলে আমরা চরকিকে ফেরত চাই। উনি তাতেই রাজি হলেন। জুডিকে অনেক গল্পের বই, একটা কম্পিউটার গেম, চার বাক্স চকোলেট আর বিস্কুট দিলেন। জুডি তার থেকে কিছু খাবার চিলেকোঠার জানলায় চরকির ভাইবোনদের জন্যে রেখে এল।
অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর