শিশির বিশ্বাস-এর সমস্ত গল্প
উত্তরণ
শিশির বিশ্বাস
রাতের মধ্য যাম তখন উত্তীর্ণ। শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ পশ্চিম আকাশে পাহাড় শীর্যের দিকে ঢলে পড়তে চলেছে। রাজা সোমদেব তার প্রাসাদশীর্ষে নিজস্ব ইন্দ্রকোষে (ওয়াচ টাওয়ার) একা বসে ছিলেন। প্রায় প্রতি রাতেই তিনি এখানে গভীর রাত পর্যন্ত অবস্থান করেন। প্রাসাদ বেষ্টন করে সুরক্ষিত প্রাকারের স্থানে স্থানে রয়েছে আরও ইন্দ্রকোষ। সেগুলিতে মোতায়েন রয়েছে প্রহরী। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তারা নজর রেখে চলেছে চারপাশে। সামান্য সন্দেহের কারণ ঘটলেই টঙ্কার উঠবে ধনুকে। নিক্ষিপ্ত হবে ঝাঁকে ঝাঁকে তির। নয়তো ভল্ল। তবু এই রাতে তিনি চলে আসেন তার এই নিজস্ব ইন্দ্রকোষে। যতক্ষণ থাকেন, নিজেই নজর রাখেন চারপাশে। সোমদেব জানেন, এই রাতে প্রহরাকার্যে রাজা স্বয়ং উপস্থিত রয়েছেন জেনে, প্রহরীদের আরও সতর্ক হবার তাগিদ থাকে।
রাজা সোমদেবের সুরক্ষিত এই প্রাসাদ দুর্গবিশেষ। তবু কোথাও সামান্যতম ত্রুটি তিনি রাখেননি। দেশের অবস্থা মোটেই ভাল নয়। শত্রু চারপাশে। এত বড় দেশ। অথচ নন্দ আর মৌর্য সম্রাজ্যের গৌরব অস্তমিত হবার পর তেমন কেউ আর দেশের হাল ধরতে এগিয়ে আসেনি। ফল যা হবার তাই হয়েছে। পশ্চিম দিক থেকে যবন (গ্রিক) আক্রমণ তো ছিলই। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বহিরাগত কম্বোজ জাতির আক্রমণ। বহুদিন হল মথুরা তাদের অধিকারে। অথচ এদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাসকেরা নিজেদের মধ্যে কলহে ব্যস্ত। সমগ্র উত্তরাপথ জুড়ে তাই প্রায় মাৎস্যন্যায়। সামান্য অসতর্ক হলেই ঝাপিয়ে পড়বে শত্রু। নগর তথা রাজ্য জুড়ে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভিন রাজ্যের পূঢ়পুরুষ (গুপ্তচর) আর ঘাতকের দল। একটি দিনের জন্যও কেউ নিরাপদ নয়। ব্যতিক্রম নয় রাজা সোমদেবও। সেজন্য সর্বদা প্রস্তুতও রয়েছেন। তবে সেজন্য খুব একটা চিন্তিত নয় তিনি। তার চিন্তা শুধু পুত্র সাগরকে নিয়ে। বেশি বয়সে ওই একটিই তার পুত্র সন্তান। আর পাঁচজন রাজার মতো তিনিও অনেক আশা করেছিলেন তার এই পুত্রকে নিয়ে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। পুত্র হিসেবে সাগর যথেষ্টই উপযুক্ত বলা যায়। বিদ্যাচর্চায় তার গভীর অনুরাগ। তার মেধার সুখ্যাতি ভট্টারক বশিষ্টাচার্যর মুখে সর্বদা। শুধু তাই নয়, সঙ্গীতেও তার সমান আকর্ষণ। এই বয়সে বীণা তার হাতে কথা বলে। লেখাপড়ার সময়টুকু ছাড়া প্রায় সারাদিন কাটে বীণাযন্ত্র নিয়ে। স্নান-আহারের হুঁশ তাকে না। শুধু অস্ত্রচালনা, অস্ত্রশিক্ষাতেই সাগর সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কুমারের অস্ত্র শিক্ষার জন্য সেরা মানের আচার্য তিনি পুত্রের জন্য নিয়োগ করেছেন। শুধু তাই নয় নিজেও চেষ্টার ত্রুটি করেননি। কিন্তু কোনও উন্নতিই হয়নি। যে কোনও ব্যাপারে অত্যন্ত মনোযোগী সাগর যে এ ব্যাপারে অনাগ্রহী, এমন নয়। কিন্তু ধনুর্বিদ্যা, ভল্ল বা অসিচালনা, কিছুতেই উল্লেখ করার মতো কিছু করে উঠতে পারেনি।
আজ পুত্রের কথা ভেবেই ধনুর্বিদ্যায় লক্ষ্যভেদের এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। এমন কিছু কঠিন লক্ষ্যভেদ নয়। রাজ্যের কিশোর বয়েসিরাই যোগ দিয়েছিল সেই প্রতিযোগিতায়। প্রতি লক্ষ্যভেদের জন্য ধার্য হয়েছিল একটি করে স্বর্ণমুদ্রা। রাজা স্বয়ং উত্তীর্ণ প্রতিযোগিদের হাতে সেই পুরস্কার তুলে দেবেন। তাই উৎসাহের অভাব ছিল না। তার উপর প্রতিযোগিতায় রাজপুত্র যোগ দেবে শুনে ভেঙে পড়েছিল মানুষ। সব জেনে বুঝেও ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন। রাজ্যের সবাই জানে, রাজপুত্র গুণবান। শাস্ত্র চর্চায় অসীম আগ্রহ। আগ্রহ সঙ্গীত চর্চায়। তাই রাজপুত্রের শস্ত্র চালনা দেখতে মানুষ যে ভেঙে পড়বে জানতেন। পুত্রকে সতর্কও করেছিলেন। এজন্য গত কয়েক দিন অনেকটা সময় তিনি ব্যয় করেছেন পুত্রের জন্য। কিন্তু সবই বৃথা গেছে। ধনুর্বাণ হাতে একটি লক্ষ্যভেদেও কুমার সাগর আজ সফল হতে পারেনি।
প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নির্বাচিত হয়েছিল নগর থেকে সামান্য দূরে এক পাহাড় ঘেরা উপত্যকায়। প্রতিযোগিতা অন্তে পুত্রকে নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে প্রাসাদে ফিরছিলেন সোমদেব। পাহাড়ের ওধারে সূর্য অস্তমিত। নির্জন পাহাড়ি পথে ম্লান আলোয় জনকোলাহলের বাইরে এক অন্য পরিবেশ। পড়ন্ত বেলায় বৃক্ষ শাখায় পাখির কলরব। সোমদেব জানেন, এই পরিবেশ পুত্র সাগরের বড় পছন্দ। এ পর্যন্ত কারো মুখই কোনও কথা নেই। নির্জন পথে শুধু অশ্বের পদশব্দ। সোমদেব তির্যক দৃষ্টিতে পুত্রের দিকে তাকালেন। অশ্বপৃষ্ঠে লাগাম হাতে নিঃশব্দে বসে রয়েছে সাগর। স্থির ওষ্ঠপ্রান্তে সামান্য কুঞ্চন রেখা। দুজনের চারপাশে অশ্বপৃষ্ঠে অঙ্গরক্ষীবৃন্দ। সোমদেব ইশারায় রক্ষীপ্রধানকে তার বাহিনি নিয়ে খানিক তফাতে সরে যেতে ইঙ্গিত করলেন। নির্দেশ পালিত হতে বিলম্ব হল না।।
সোমদেবের অনুমানে ভুল হয়নি। রক্ষীবৃন্দ সরে যেতেই মৃদু ভারাক্রান্ত কণ্ঠে সাগর বলল, “আমি লজ্জিত পিতা। আপনার সম্মান রক্ষা করতে পারিনি।”
“পুত্র,” মৃদু অথচ দৃঢ় স্বর সোমদেবের কণ্ঠে, “আমি সামান্য এক যুদ্ধ ব্যবসায়ীর পুত্র। প্রায় শূন্য থেকে এখানে এসে পৌঁছিয়েছি। সম্মানের পরোয়া আমি করি না। আর এতে লজ্জারও কিছু নেই। মনে রেখো, পরাজয় উদ্যমী পুরুষকে জয়ের প্রেরণা যোগায়।”
“কিন্তু অস্ত্ৰচালনা আমার যে ভাল লাগে না পিতা। চেষ্টা করেও ধনুকে শর যোজনা, লক্ষ্যভেদে একেবারেই একাগ্র হতে পারি না।”
“পুত্র, আচার্যের কাছে উপনিষদ চর্চায় তোমার আগ্রহের কথা শুনেছি। তুমি বিদ্বান, বিচক্ষণ। তোমার অনুমান সঠিক। একাগ্র হতে না পারলে কোনও কিছুই লাভ হয় না পুত্র। না বিদ্যা, না সংগীত, না ধনুকে লক্ষ্যভেদ।”
“আমাকে পথ নির্দেশ করুন পিতা।” সোমদেব আগ্রহে পিতার মুখের দিকে তাকাল।
কয়েক মুহুর্ত নীরব হয়ে রইলেন সোমদেব। তারপর বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “পুত্র তোমার ইচ্ছেয় আমি বাধা হয়ে দাঁড়াব না। শুধু মনে রেখো, আমার আবর্তমানে এই রাজ্যের গৌরব অক্ষুন্ন রাখার জন্য অস্ত্র চালনাতেও তোমাকে দক্ষ হতে হবে। আমার স্থির বিশ্বাস, যে হাতের আঙুল বীণার তারে অমন সুরের মূর্চ্ছনা তুলতে পারে, সেই হাত ধনুকের তারে ব্যর্থ হতে পারে না।”
সোমদেব থামলেন। তাকিয়ে দেখলেন দু’চোখ বন্ধ করে সাগর মগ্ন হয়ে রয়েছে। সময় নষ্ট না করে সোমদেব বললেন, “পুত্র, তুমি রাজকুমার। আমার মতো সামান্য যুদ্ধ ব্যবসায়ীর পুত্র নও। পিতার সিংহাসন রক্ষা করতে হলে শুধু শাস্ত্র আর সঙ্গীত নয়, শস্ত্র চর্চাও একান্ত প্রয়োজন। আর তুমি তো জানো, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন এই দেশকে এক সুতোয় গাঁথার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। সেজন্য একটু একটু করে প্রস্তুতিও নিয়ে চলেছি। প্রতিবেশী রাজন্যবৃন্দ কেউই তাই আমাকে ভাল চোখে দেখে না। সবার ভয়, তাদের রাজ্য আমি অধিকার করে নেব। তা ঠিক হয়ত। কিন্তু উপায় কী? এদেশে যোগ্য যোদ্ধার অভাব নেই। আজ নিজের চোখেই দেখলে, একেবারে সাধারণ ঘরের কিশোরও ধনুর্বিদ্যায় কী ভীষণ দক্ষ! অথচ এদেশের এক বিস্তীর্ণ ভূভাগে ভিনদেশি যবন রাজত্ব। মথুরা এখনও কম্বোজ জাতির অধিকারে। পুত্র, আমার স্বপ্ন এদেশকে ভিনজাতির হাত থেকে মুক্ত করা। নন্দ আর মৌর্য সম্রাটদের সেই উজ্জ্বল দিনগুলো আবার ফিরিয়ে দেওয়া। আর তাই আমার চারপাশে শত্রু। তারা বেশ জানে, সম্মুখ সমরে কেউ রাজা সোমদেবের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না। তাই নিয়োগ করা হয়েছে গুপ্ত ঘাতক। সারা রাজ্য আর নগর পথে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। সামান্য সুযোগেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। মনে রেখ, সুরক্ষিত রাজ প্রাসাদও কিছুমাত্র নিরাপদ নয়। এই অবস্থায় মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে হলে, শুধু সংগীত নয়, অস্ত্র চালনাতেও দক্ষ হওয়া প্রয়োজন।”
এসব সেই বিকেলের কথা। সারা পথ সাগর এরপর কথা বলেনি। পুত্রের সেই মুখের দিকে তাকিয়ে সোমদেবও মৌনই থেকেছেন। শুধু প্রাসাদে ফিরে অশ্ব থেকে অবতরণ করার আগে পুত্রে পিঠে একবার হাত রেখেছিলেন মাত্র।
প্রাণাধিক পুত্রকে আজ একটু বেশিই বলে ফেলেছেন তিনি। রাজা সোমদেবের মনের ভিতর তাই কিছুটা উদবেগ ছিলই। তাই রাত বাড়তে প্রাসাদশীর্ষে তার ইন্দ্রকোষে এসে বসার সামান্য পরেই যখন কুমারের বীণায় তান উঠল, বুক থেকে যেন পাথর নেমে গিয়েছিল। প্রতি রাতে এই সময় কুমার তার ঘরে একান্তে বসে বীণায় তান তোলে। রাত যত গভীর হয়, সুরের মুছনা আরও নিবিড় হয়ে ওঠে। কেউ জানে না, ইন্দ্রকোষে বসে রাজা সোমদেব প্রতিদিন পুত্রের সেই সুরমূর্চ্ছনা প্রাণ ভরে উপভোগ করেন। বুক ভরে ওঠে। সামান্য এক যুদ্ধ ব্যবসায়ীর পুত্র তিনি। সঙ্গীত চর্চা দূরের কথা, তেমন ভাবে শোনার অবকাশও হয়নি। সঙ্গীতের রূপ রস গন্ধ পুত্রের সঙ্গীত চর্চার মধ্যেই তিনি অনুভব করেছেন। নিয়মিত শ্রবণের কারণে সঙ্গীতের বিভিন্ন রাগ, লয়, তান এখন বেশ চিনতে পারেন। যদিও নাম জানেন না কোনোটারই। কিন্তু আজ পুত্রের বীণাবাদন তাকে মাঝে মধ্যেই পীড়া দিচ্ছিল। বাজনার লয় তান আজ বারে বারেই কেটে যাচ্ছে। কুমারের নিপুণ আঙুল বারে বারেই যেন বীণার তার নয় খুঁজে বেড়াচ্ছে অন্য কিছু। সোমদেব নীচে অবতরণিকার দ্বারপথের দিকে তাকালেন। ভল্ল আর ধনুর্বাণ হাতে দুই অঙ্গরক্ষী অতন্দ্র প্রহরায়। ইশারায় তিনি তাদের বিদায় নিতে আদেশ করলেন।
রাতে রাজা এমন আদেশ কখনও করেননি। বিস্মিত হলেও কেউ প্রশ্ন করল না। সামান্য ইতস্তত করে স্থানত্যাগ করল। অল্প সময় অতিবাহিত হবার পর রাজা সোমদেব নিজেও উঠে পড়লেন এরপর। অন্য দিনের তুলনায় কিছু আগেই।
বীণার তন্ত্রীতে সুর তুলতে আজ বারে বারেই ভুল হয়ে যাচ্ছিল কুমারের। সেই থেকে ভিতরে একটা অস্বস্তি তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। বারে বারেই মাথার ভিতর উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল মধ্যাহ্নের সেই দৃশ্য। লক্ষ্যভেদে ব্যর্থতার সেই মুহূর্তগুলো। উপস্থিত দর্শক গোড়ায় কিছু সংযত থাকলেও পরের দিকে বিদ্রুপ আর চাপা থাকেনি। পিতার কথা ভেবে ক্রমশ মাথা নুয়ে আসছিল। পরের দিকে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল, অন্তত একবারও যাতে লক্ষ্যভেদ করতে পারে। কিন্তু সম্ভব হয়নি। কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে গেছে।
সাগর বরাবরই ভিন্ন চরিত্রের। রাজপুত্র হয়েও অস্ত্রচালনা, মৃগয়া কোনও কিছুতেই তেমন উৎসাহ ছিল না। ভাল লাগেনি। বরং উৎসাহ পেয়েছে সঙ্গীত চর্চায়। আচার্য ভট্টারকের কাছে উপনিষদ পাঠে। পিতা কখনওই নিরুৎসাহী করেননি। তবে সমান উৎসাহ দিয়েছেন শস্ত্রচর্চার জন্যও। কিন্তু পিতার সেই প্রচেষ্টা কখনই তেমন সাড়া জাগায়নি ভিতরে। কিন্তু আজকের এই ঘটনার পর সব কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে। প্রতিযোগিতার সময় বাবার মলিন মুখটা কেবলই চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বড় অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। সুরের তাল বারবার কেটে যাচ্ছে। অনেক দিন আগে পিতার সেই কথাগুলো আজ হঠাৎই মনে পড়ে যাচ্ছে, “পুত্র, যে বংশে তোমার জন্ম, সেখানে খ্যাতিমান তিরন্দাজের অভাব নেই। তোমার ধমনীতে সেই রক্তই বইছে। তাই চিন্তা কোরো না, বীণার তন্ত্রীও তো সেই ধনুকেরই গুণ। আরও সূক্ষ্ম। তাই আরও কঠিন। সেই বীণার তন্ত্রীতে তোমার আঙুল যদি অমন সুর তুলতে পারে, আমার স্থির বিশ্বাস, ধনুর্বাণে সে ব্যর্থ হতে পারে না। তুমি পারবে পুত্র,পারবে।”
সময়ের অনেক আগেই আজ বীণা নামিয়ে উঠে পড়ল সাগর। রাতের এই সময় বীণা বাজাতে বসে এমন কবে হয়েছে, মনে করতে পারল না। তবে তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু খানিক পরেই বুঝতে পারল, সহজে আজ রাতে আর ঘুম আসবে না। শুধু আজকের ব্যাপার নয়, অনেক পুরোনো কথাও ক্রমাগত উঁকি দিয়ে যাচ্ছে মাথার ভিতরে। এভাবে এপাশ-ওপাশ করতে করতে কখন সামান্য তন্দ্ৰামতো এসেছে, হঠাৎ হালকা একটা শব্দে ভেঙে গেল। খাড়া হয়ে উঠল কান দুটো। প্রথমে মনে হয়েছিল ইঁদুর। অন্ধকার ঘরে জানলা দিয়ে শুক্লা দ্বাদশীর সামান্য আলো এসে পড়েছে। যথা সম্ভব নজর করেও কিছু নজরে এল না। ওই সময় ফের সেই চাপা আওয়াজ। দেরি না করে নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল সাগর। শব্দটা ঘরের ভিতরে নয়, বাইরে থেকে আসছে।
দিনভর সঙ্গীত নিয়ে থাকলেও পিতার কাছে সবই শুনেছে। অন্য ভাবেও কানে আসে অনেক কথা। দেশের অবস্থা মোটেই স্থিতিশীল নয়। চারপাশে শত্রর চর, গুপ্তঘাতক। পা টিপে নিঃশব্দে ও পূব দিকের সঙ্কীর্ণ বাতায়নের পাশে এসে দাঁড়াল। সন্তর্পণে বাইরে উঁকি দিল। জ্যোৎস্নার আলোয় বাইরে অন্ধকার তেমন গাঢ় নয়। প্রাসাদ প্রকারের বাইরে ঝিম ধরা ঘুমন্ত নগর। সরণীর বাতিগুলো নিবে গেছে অনেকক্ষণ। জ্যোৎস্না পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ায় এদিকের দেওয়ালে চাদের আলো পড়েনি। যথেষ্টই অন্ধকার বর্তমান। সতর্ক দৃষ্টি ফেলেও গোড়ায় তেমন কিছু নজরে পড়েনি। কিন্তু তারপরেই সারা শরীর স্থির হয়ে গেল। বিশাল আকারের প্রাসাদ দুর্গে ওর নীচের তলায় খানিক দূরে পিতার শয়নকক্ষ। সঙ্কীর্ণ বাতায়ন পথে এক টুকরো আলোর রেখা। ইন্দ্রকোষ থেকে পিতা তার শয়নকক্ষে ফিরে এসেছেন। কিন্তু ও কী! শরীরের প্রতিটি রোমকূপ মুহুর্তে খাড়া হয়ে উঠল সাগরের। বাতায়নে ধূপ আচ্ছাদনের সরু চাতালের উপর অন্ধকারে এক ছায়ামূর্তি। সন্দেহ নেই, একটু আগেই আগন্তুক কোনও উপায়ে ওখানে উপস্থিত হয়েছে। লক্ষ্য পিতার শয়নকক্ষ।
রাতে এই প্রাসাদ দুর্গের বহির্ভাগের প্রতিটি অংশে নিযুক্ত রয়েছে বাছাই রক্ষী। তাদের চোখ এড়িয়ে মানুষটি কখন এসে হাজির হয়েছে ওখানে। ভাবতে গিয়ে মাথাটা ঘুরে উঠল। একবার মনে হল, চিৎকার করে রক্ষীদের সতর্ক করে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই বাতিল করে দিল সেই চিন্তা। যে আততায়ী সবার নজর এড়িয়ে ওইখানে পৌঁছে যেতে পেরেছে, সে রক্ষীদের সতর্ক হবার আগেই তার কাজ নির্বিঘ্নে শেষ করে ফেলবে। যা করবার করতে হবে ওকেই। আর সেটা এখনই। ভাবতে গিয়ে মাথাটা ফের ঝিমঝিম করে উঠল। হাত-পা’গুলোও কেমন দুর্বল হয়ে আসতে লাগল। গত দুপুরে প্রতিযোগিতায় তির ছোঁড়ার সময় ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। ধনুকে শর যোজনাকালে আঙুলগুলো একেবারেই নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তবু সে ছিল। দিনের আলোয়। এই রাতের অন্ধকারে নিশানা ভেদ যে আরও কঠিন! আরও দুরূহ!
আর ভাবতে পারল না সাগর। সময় নেই। মাথা থেকে সব ঝেড়ে নামিয়ে দিয়ে ও দ্রুত এগিয়ে গেল ঘরের কোণে নিজের ধনুর্বাণের দিকে। পিঠে শর ভরতি তুণ ঝুলিয়ে ধনুক হাতে নিঃশব্দে এসে দাড়াল বাতায়নের কাছে। অন্ধকারেও বেশ বুঝতে পারল, আততায়ী ইতিমধ্যে আরও ঝুঁকে পড়েছে পিতার ঘরের বাতায়নের দিকে। আঘাত হানার জন্য তৈরি হচ্ছে। এক মুহূর্ত দেরি করল না সাগর। ধনুকে শর যোজনার পর লক্ষ্য স্থির করে নিক্ষেপ করল আততায়ীর দিকে। মুহূর্তে ধনুকে দ্বিতীয় শর যোজনার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। কিন্তু দেখতে পেল, অন্ধকারে আততায়ীর শরীরটা টলে উঠল হঠাৎ। বাতায়ন আচ্ছাদনের কানা ধরে টাল সামলাবার যথাসাধ্য চেষ্টা করে শেষে পড়ে গেল নীচে।
এক মূহর্ত দেরি না করে সাগর ধনুর্বাণ হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে অবতরণিকার দিকে ছুটতে শুরু করল। প্রায়ান্ধকার মস্ত প্রাসাদ দুর্গ। নীচের তলায় পিতার ঘরের সামনে যখন পৌঁছোল, ততক্ষণে কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। রাজা সোমদেবের কক্ষের বাইরে দুই প্রহরী ইতিমধ্যে পদশব্দে সতর্ক হয়ে হাতের অস্ত্র তুলে ধরেছে। তারপর আগন্তুক মানুষটিকে দেখেই অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কুমার! আপনি এই রাতে এভাবে?”
“এক আততায়ী পিতাকে হত্যা করতে এসেছিল। তিরবিদ্ধ হয়ে নীচে পড়ে গেলেও সম্ভবত আঘাত তেমন গুরুতর নয়। তোমরা এখনই নীচে গিয়ে তার অনুসন্ধান করো। দেখো যেন পালিয়ে না যায়।”
আদেশ পালন হতে বিলম্ব হল না। দারুণ উৎকণ্ঠায় সাগর এরপর পিতার ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করল। বুক থেকে বড় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বের হয়ে এল। পিতা জেগেই রয়েছেন। খোলা তলোয়ার হাতে জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরে। কুমারের সাড়া পেয়ে পিছন ফিরে তাকালেন তিনি। বললেন, “দারুণ, দারুণ কাজ করেছ কুমার! অন্ধকারে এমন নিপুণ লক্ষ্যভেদ অনেক কুশলী তিরন্দাজেরও নেই।”
“আপনি, আপনি দেখেছেন পিতা!” থতমত খেয়ে সাগর বলল।
“একেবারে শেষ মুহূর্তে। মুখে তৃপ্তির হাসি রাজা সোমদেবের। আততায়ী যখন আমার নজরে পড়ে, ঠিক সেই মুহূর্তেই তোমার নিক্ষিপ্ত তিরে আহত হয়ে নীচে পড়ে যায়। সন্দেহ নেই, আজ তুমিই আমার প্রাণ রক্ষা করেছ।”
“পিতা আমি আততায়ীকে খুঁজতে পাঠিয়েছি। কোনও মতেই তাকে পালিয়ে যেতে দেওয়া যায় না।”
“তা আর বোধ হয় সম্ভব নয় পুত্র। রাজা সোমদেব বললেন, “আততায়ী একা নয়। নীচে আরও কয়েকজন ছিল। প্রহরীরা সজাগ হবার আগেই আহত মানুষটাকে তুলে নিয়ে তাদের প্রাচীরের দিকে ছুটে যেতে দেখেছি। হয়ত এতক্ষণে প্রাচীর টপকে সরেও পড়েছে।”
“আপনার… আপনার প্রহরীরা একেবারেই কাজের নয় পিতা,” থমথমে গলায় সাগর বলল, “আপনি বরং আমার জন্য একটা অসির ব্যবস্থা করুন। এবার থেকে সঙ্গে রাখব। কথা দিচ্ছি, পরের বার আততায়ী এভাবে পালিয়ে যাবার সুযোগ পাবে না।”
পুত্রের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত নীরবে তাকিয়ে রইলেন সোমদেব। এতটা আশা করেননি তিনি। ভিতরের উত্তেজনা দমন করার জন্য হাতের অসি কোষবদ্ধ করতে যাবেন, প্রহরী দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। পদশব্দে ঘাড় ফিরিয়ে পিতার আগেই সাগর প্রশ্ন করল, “কী খবর প্রহরী? আততায়ীকে বন্দি করা গেছে?”
“না কুমার,” থতমত খেয়ে প্রহরী বলল। দিনরাত বীণা নিয়ে পড়ে থাকা কুমারের কাছে এমন কথা শুনতে অভ্যস্ত নয় তারা।
“আমার নিক্ষিপ্ত তিরের সন্ধান?”
“না কুমার। সম্ভবত সেটা আততায়ীর দেহে বিঁধে রয়েছে। সেই অবস্থায় পালিয়ে গেছে ওরা।”
সাগর কোনও কথা না বলে নিঃশব্দে পিতার দিকে তাকাল। পুত্রের সেই দৃষ্টি পড়ে নিতে অসুবিধা হল না সোমদেবের। কঠিন গলায় প্রহরীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “গাফিলতির জন্য যথোপযুক্ত সাজা পাবে তোমরা। যাও এখন।”
আদেশ পেয়ে প্রহরী তৎক্ষণাৎ স্থানত্যাগ করল। রাজা সোমদেব বললেন, “ব্যস্ত হোয়ো না পুত্ৰ, বরং অস্ত্রাগারে চল। শুধু অসি নয়, একজন তিরন্দাজের অঙ্গত্রাণও (বর্ম) আবশ্যক। দুটোই আজ পাবে তুমি।”
শয়নকক্ষের পাশেই সোমদেবের নিজস্ব অস্ত্রাগার। পুত্রকে নিয়ে এরপর তিনি সেই ঘরে এলেন। বড় আকারের
কক্ষের দেয়ালে নানা আকার ও আকৃতির অস্ত্রের সমারোহ। তারই একপাশে তার ছেলেবেলায় ব্যবহৃত অস্ত্রগুলিও রয়েছে। সেখানে এসে সোমদেব একটি চমৎকার অঙ্গাত্ৰাণ হাতে নিয়ে বললেন, “পুত্র, এটি আমার ছেলেবেলায় ব্যবহার করা জিনিস। মনে হয়, তোমার উপযুক্ত হবে।”
বৃষচর্মের অঙ্গত্রাণটি যথেষ্টই মজবুত। কিন্তু সাগরের চোখ তখন কাছেই আরও উন্নত একটা অঙ্গাত্রাণের দিকে। সোমদেব থামতেই মাথা নেড়ে সেদিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “পিতা, ওটা আমার জন্য ছোটো হবে। বরং এটি আরও উন্নতমানের।”
সোমদেব বাধা দেবার জন্য হাত বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই সাগর সেটা টেনে নিয়েছে। খঙ্গীচর্মের অঙ্গত্রাণটি যথেষ্ট মজবুত হলেও আকারে বড়। নিরাশ হয়ে সাগর সেটি যথাস্থানে রাখতে যাবে, হঠাৎ নজরে পড়ল, অঙ্গাত্রাণের এক পাশে একটি তিরের ফলা বিঁধে রয়েছে। কক্ষের আলো যথেষ্টই মৃদু। তবু চিনতে ভুল হল না, ফলাটি অল্প আগে তারই নিক্ষিপ্ত শরের। অবাক হয়ে পাশে পিতার দিকে তাকাল ও।
পুত্রের কাছে এভাবে ধরা পড়ে যাবেন, ভাবতে পারেননি সোমদেব। ম্লান হেসে বললেন, “তুমি ঠিকই অনুমান করেছ পুত্র। একটু আগের সেই আততায়ী আমি নিজেই। তুমি এত দ্রুত চলে আসবে, ভাবিনি। তাই তাড়াতাড়ি নিজ কক্ষে ফিরে অঙ্গত্রাণটা খুলতে পারলেও তিরের ফলাটা তোলা যায়নি। ভেঙে রয়ে গেছে।”
সেই কথায় সাগর কয়েক মুহূর্ত নির্বাক হয়ে পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “ক-কিন্তু কেন?”
“পুত্র, তুমি শাস্ত্রজ্ঞ। শুধু বলি, আমার এই রাজ্যের ভবিষ্যতের কথা ভেবে যে ঝুঁকি আজ নিয়েছিলাম, তাতে আমি উত্তীর্ণ।”
“ক-কিন্তু আপনার মৃত্যুও তো হতে পারত পিতা!”
“তাতে কিছু মাত্র ক্ষতি হত না পুত্র। মৃত্যুর আগে এটা তো জেনে যেতাম, আমার প্রতিষ্ঠা করা এই রাজ্য এমন একজন বীণাবাদকের হাতে সুরক্ষিত থাকবে যে, প্রয়োজনে অস্ত্র হাতেও সমান কুশলী।” পরম তৃপ্তিতে রাজা সোমদেব পুত্রের পিঠে স্নেহের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
এই কাহিনির সামান্য মাত্র ইঙ্গিত পাওয়া যায় ভগ্ন এক শিলাফলকে। গুপ্তকালিন ব্রাহ্মী হরফে প্রাকৃত ভাষায় লেখা শিলালিপিতে বলা হয়েছে, রাজা সোমদেব তাঁর সঙ্গীতপ্রেমী পুত্র সাগরকে অস্ত্র শিক্ষাতেও সমান পারদর্শী করে তুলেছিলেন। তাৎপর্যপূর্ণ হল, গুপ্তকালীন শিলালিপির বেশিরভাগই সংস্কৃত ভাষায় লেখা। এটি একেবারেই ব্যতিক্রম।
দুর্ভাগ্য, এদেশের পুরোনো ইতিহাস, শিলা, স্তম্ভ ও তাম্রপত্রে লেখা কিছু লিপি, সিলমোহর, মুদ্রা, আর গোটাকয়েক শাস্ত্র গ্রন্থের সামান্য কয়েকটি পাতা মাত্র। তাই রাজা সোমদেব আর তার পুত্র সাগরের কথা কিছু আর জানা যায় না। সোমদেবের স্বপ্ন কি পূর্ণ হয়েছিল? আর পুত্র সাগর? জানার উপায় নেই। তবে পাওয়া যায় রাজা প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পুত্র সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের কথা। বিদেশের ঐতিহাসিকেরা যাকে প্রাচ্যের নেপোলিয়ন আখ্যায় ভূষিত করেছেন। আখ্যাটি অবশ্যই সঠিক নয়। পরাজিত নেপোলিয়নের মৃত্যু কারাগারের অন্তরালে। আর সমুদ্রগুপ্ত একের পর এক যুদ্ধ জয় করে পিতার রেখে যাওয়া ক্ষুদ্র এক রাজ্যকে সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যকে তিনি যে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছিলেন, তা টিকে ছিল বহুদিন পর্যন্ত। বীণাযন্ত্রেও তার দক্ষতা ছিল। আর সাগর তো সমুদ্রেরই আর এক নাম। তেমনই সোমের অন্য নাম চাঁদ। তবে কি রাজা সোমদেবের আর এক নাম চন্দ্রগুপ্ত? লিপিটি যিনি আপন খেয়ালে খোদাই করেছিলেন, তিনি কি সেই রাতের কোনও এক প্রত্যক্ষদর্শী প্রহরী? সংস্কৃত তার জানা ছিল না। তাই প্রচলিত প্রাকৃতে লিপিটি খোদাই করেছিলেন। আমরা অনুমান করতে পারি মাত্র। ইতিহাসের পাতায় শুধুই অন্ধকার।
অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
এই একটা কলম. যেখানে চোখ বুজে ভরসা করতে পারি…দারুণ লাগল
LikeLike
অসাধারণ একটা গল্প
LikeLike
durdanto! asadharan.apnakr lekhoni satyi nirbhor jogyo….ekhono porjonto kokhono hotash hoini
LikeLike
খুব ভাল লাগল। ইতিহাস কল্পনা এবং যুক্তির মিশেলে খুবই উপভোগ্য একটি গল্প।
LikeLike
এককথায় অনবদ্য
LikeLike