অরিন্দম দেবনাথ-এর সমস্ত লেখা
এক ঘন্টা
অরিন্দম দেবনাথ
হেলমেটের গায়ে লাগানো একটা বোতামে চাপ দিল রাকেশ। ফিড সেন্টারের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
“হ্যালো ফিড সেন্টার, রকেট-৪ বলছি।”
কোনও সাড়া নেই। উত্তর পেতে খানিক সময় লাগে। তবুও দ্বিতীয়বার বোতামটা চেপে বোকার মতো আবারও বলল রাকেশ, “হ্যালো ফিড সেন্টার, রকেট-৪ বলছি।”
হেলমেটের মধ্যে লাগানো স্পিকারটি নিশ্চুপ। খানিক আগেই তো এই হেলমেট মাথায় পরে রকেট ছেড়ে চাঁদে নামার আগে ফিড সেন্টারে বাবার সঙ্গে কথা বলেছে রাকেশ। খারাপ হয়ে গেল নাকি হেলমেটটা?
ঘাবড়াল না রাকেশ। মুন রোভারে চাঁদের বুকে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কন্ট্রোল প্যানেলে বসে চ্যাট করা যাবে ফিড সেন্টারের সঙ্গে। মুন রোভারের দিকে এগোতে লাগল রাকেশ।
কীরকম একটা অস্বস্তি হচ্ছে। দাঁড়িয়ে পড়ল রাকেশ। দূরে বালি-পাথরের স্তূপের কাছে কিছু একটা যেন নড়ছে। তবে কি অন্য কোনও রাষ্ট্র গোপনে চাঁদে কোনও কার্যকলাপ চালাচ্ছে?
কিন্তু তাই বা কী করে সম্ভব? এতগুলো স্যাটেলাইট চাঁদকে ঘিরে নজরদারি করছে। প্রতিমুহূর্তে ছবিগুলো পৃথিবীর কোনও না কোনও মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে রেকর্ড হচ্ছে। চাঁদের মাটিতে বেড়ে ওঠা গমগাছগুলোর ছবি ওই অতি শক্তিশালী মহাকাশ ক্যামেরা তুলে নির্দিষ্ট সময় পরপর পাঠিয়ে দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে। সেখান থেকে ছবিগুলো চলে যাচ্ছে পৃথিবীর সব ক’টা মহাকাশ কেন্দ্রে।
হেলমেটে লাগানো বোতামটা চাপ দিয়ে প্রায় চিৎকার করতে শুরু করল রাকেশ, “ফিড সেন্টার, শুনতে পাচ্ছ? ফিড সেন্টার, উত্তর দাও। দূরে কিছু একটা নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। চেক করে জানাও।”
কোনও উত্তর এল না। ঘাম ছাড়তে শুরু করেছে রাকেশের শরীর থেকে। নার্ভগুলোকে যথাসাধ্য কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করছে রাকেশ।
***
“স্যার, উই আর ট্রাইয়িং আওয়ার বেস্ট টু কমিউনিকেট, বাট…”
“আই নো।”
২০৫৬, ১ অক্টোবর। লেহ শহরের ‘ফিড সেন্টার রকেট কন্ট্রোল রুম’ এ উপস্থিত প্রায় সকলের নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। চাঁদের বুকে উপস্থিত পাঁচটা রকেটের মধ্যে একটা রকেটের সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে আচমকা। ফিড সেন্টারের ডিরেক্টর সোনাম নামগিয়াল ক্রমাগত রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে চলেছেন। প্রত্যেকটা রকেট নিখুঁত অবতরণ করে ঠিক ঠিক কাজ করছিল। হঠাৎ করেই রকেট-৪ কন্ট্রোল রুমের র্যাডারের পর্দা থেকে একদম উধাও! খানিক আগেও রকেট-৪-এর একমাত্র আরোহী রাকেশ নামগিয়াল জানিয়েছিল যে, সে চাঁদের মাটিতে নামবে কয়েক মিনিটের মধ্যে। পাঁচটা রকেটের মধ্যে শুধু ওই একটা রকেটেই মানুষ-যাত্রী ছিল, বাকিগুলোতে সব রোবট।
চাঁদের মাটিতে পৃথিবীর উপনিবেশ গড়ে তোলার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে পৃথিবীর সবক’টি শক্তিশালী রাষ্ট্র। পৃথিবীতে প্রচণ্ড স্থানসংকুলানের অভাব। খাবারের অভাব দেখা দিয়েছে ভীষণ। চাষযোগ্য জমি আর নেই। খরা, নয় অতিবৃষ্টিতে ভুগছে একেকটি অঞ্চল। জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে দলে দলে মানুষ। বিগত কয়েক যুগ ধরে অতিরিক্ত যন্ত্র নির্ভর হয়ে সাধারণ মানুষ হারিয়ে ফেলেছে স্বাভাবিক মেধা ও কর্মক্ষমতা। পরিবেশবিদদের হুঁশিয়ারি না শোনার ফল এখন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে সম্পূর্ণ মানবজাতি।
মেরু-বলয়ে জমে থাকা বরফ গলে সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে ডুবে গেছে অনেক জনপদ। গাছপালা কেটে জঙ্গল সাফা করে নতুন জনবসতি গড়ার ফলে বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক অংশে। সুন্দরবনের বাদা বনে কয়েকটা বাঘ ছাড়া পৃথিবী থেকে সব বাঘ নিঃশেষ। হিমালয়ে বাচ্চা সহ চার সদস্যের ইয়েতি পরিবারের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু স্নো লাইন চলে গেছে কুড়ি হাজার ফিটে! আল্পসে দু’বছরে তুষারপাত হয়েছে নামমাত্র। অতি জনবহুল দেশগুলো গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, সাইবেরিয়ার মতো চির বরফের দেশে লোকবসতি বানিয়েছে। বাদ পড়েনি মরু অঞ্চলও। অতি ঠাণ্ডা ও গরম সহ্য করতে না পেরে মারা গেছে বহু মানুষ। প্রথম প্রথম এই নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল পৃথিবী জুড়ে। কারণ ওইসব অঞ্চলে ওই পরিবেশের অনভ্যস্ত মানুষদের পাঠানো মানে হত্যা করার সামিল। কিন্তু জননেতারা কোনও প্রতিবাদে কান দেননি। উলটে প্রতিবাদীদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ওই অঞ্চলে। এতে করে কয়েক কোটি মানুষ মারা গেলেও এক হাজার কোটির পৃথিবীতে তার কোনও প্রভাব পড়েনি।
ফিড সেন্টারের ডিরেক্টর সোনাম নামগিয়াল শুধু নামকরা রকেট বিশেষজ্ঞ ও নভশ্চরই নন, ঠাণ্ডা মাথার লোক। তবুও তিনি অসহিষ্ণুর মতো পায়চারি করে চলেছেন। কারণ, পাঁচটা রকেটের মধ্যে মাত্র একটা রকেটের একমাত্র মানুষ-যাত্রীটি হল তাঁর সন্তান রাকেশ নামগিয়াল। এর আগে রাকেশ বেশ কয়েকবার মহাকাশের আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে কাটিয়েছে। বাবার মতো রাকেশও একজন রকেট বিশেষজ্ঞ ও বিশ্বের অভিজ্ঞ নভশ্চারীদের মধ্যে অন্যতম। এহেন রাকেশের রকেট সহ অস্তিত্ব হঠাৎ করে কন্ট্রোল প্যানেল থেকে উধাও হয়ে যাওয়ায় ফিড সেন্টারের রকেট কন্ট্রোল রুমের সবাই অবাক।
১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই নেল আর্মস্ট্রং ও বাজ অল্ড্রিনের প্রথম চাঁদে পা রাখার পর রাকেশ চাঁদের মাটিতে পদার্পণ করা শততম মানুষ হতে যাচ্ছিল।
***
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি চাঁদের মাটিতে নামিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার কাঁধে সিঁড়ি বেয়ে চাঁদের বুকে নেমে এল রাকেশ। ছোটবেলা থেকে দেখা স্বপ্ন পূরণ হল। বেশ কয়েক পা হেঁটে হাত দুটো দু’পাশে ছড়িয়ে একপাক ঘুরে নিল রাকেশ। মাথায় পরে থাকা হেলমেটটা ভীষণ অস্বস্তিকর। কালচে আকাশের বুকে পৃথিবীটাকে একটা ছোপ ছোপ বিশাল বড়ো গোল বেলুনের মতো দেখাচ্ছে। ছোটবেলা থেকে কবিতা লেখা রাকেশের মাথায় অনেক শব্দের রাশ ভিড় করে এল। মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিল রাকেশ। এসব কাব্যিক ভাবনার সময় এটা নয়। সময় বড়ো কম। পৃথিবী থেকে তার প্রতিটি পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে রকেটের গায়ে লাগানো ক্যামেরায়। ক্যামেরা কোথায় নেই? হেলমেটের সামনে, পেছনে, চাঁদের বুকে চলার উপযুক্ত গাড়ি মুন রোভারের চারদিকে। এছাড়াও চাঁদকে প্রদক্ষিণরত কয়েকশো উপগ্রহ নজর রেখে চলেছে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ।
রাকেশ মরু অঞ্চলে জন্মায় এরকম কিছু ঘাসের বীজ নিয়ে এসেছে। সেগুলোকে চাঁদের মাটিতে ছড়াতে হবে। এর আগে অন্য এক মিশনের চাঁদে রেখে যাওয়া বড়ো কাচের বদ্ধ জারে খানিক মাটি বিছিয়ে তাতে জল ছড়িয়ে পোঁতা জংলা গাছ স্পাইডারওটস থেকে গাছ বেরিয়েছে এবং সে গাছ বদ্ধ জায়গায় নিজের বাস্তুতন্ত্র গড়ে বেড়ে চলেছে বদ্ধ জারের ভেতর। হুলুস্থুলু পড়ে গেছে পৃথিবী জুড়ে। এর আগে মার্কিন পরিবেশপ্রেমী ডেভিড লাটিম পৃথিবীর বুকে এই পরীক্ষাটা চালিয়ে ছিলেন। শুধুমাত্র সূর্যের আলো গ্রহণ করে বদ্ধ কাচের জারে বছরের পর বছর বেঁচে বিশাল ঝাড়ে পরিণত হয়েছে সে গাছ। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রগুলো ডেভিডের পরীক্ষার পরিণতিটা চাঁদের বুকে প্রয়োগ করে চূড়ান্ত সফল হয়েছে। সম্ভব, খুবই সম্ভব চাঁদের মাটিতে মানুষের উপনিবেশ গড়ে তোলা। এখন শুধু বাকি আরও অনেক অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো।
ইতিমধ্যেই চাঁদকে সাতটা ভাগে ভাগ করে ফেলেছেন পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়করা। এখনও পর্যন্ত তথ্য বিনিময় করে কাজ করলেও আর কয়েক বছরের মধ্যেই তথ্য বিনিময় বন্ধ হয়ে যাবে বিভিন্ন স্পেস সেন্টারের মধ্যে। একেক মহাদেশের জন্য চাঁদের একেকটি অংশ নির্দিষ্ট হয়ে যাবে। একেকটি মহাদেশ তাদের মতো করে উপনিবেশ স্থাপন করতে পারবে চাঁদে তাদের জন্য নির্দিষ্ট অংশে। এখনও চাঁদ ভাগ হয়নি পদ্ধতিগত কারণে। অধিকাংশ রাষ্ট্রনায়কই চাইছেন চাঁদ ভাগ হোক লটারির মাধ্যমে। চাঁদ দখলের মহাযুদ্ধ এড়াতে এটাই একমাত্র পথ।
***
“ভয় পেও না দাদুভাই।” একটা ফ্যাসফ্যাসে জড়ানো গলা শুনে চমকে গেল রাকেশ। সে নিশ্চিন্ত এটা ফিড সেন্টারের কারও গলা নয়। তবে কি…
“ভয় পেও না দাদুভাই।” আবার ভেসে এল শব্দটা। “তুমি এখুনি আমাকে দেখতে পাবে।”
শরীরের প্রতিটি পেশী শক্ত হয়ে উঠল রাকেশের। কিন্তু ভয় পেল না রাকেশ। আওয়াজটা যারই হোক না কেন, ভেসে আসা শব্দগুলোর মধ্যে এমন কিছু ছিল যে রাকেশ নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে রইল।
খানিক দূরে এবড়ো-খেবড়ো লালচে মোটা বালি-পাথরের দানা সরে যাচ্ছে। বালির স্তূপ থেকে জেগে উঠছে একটা জলজ্যান্ত মানুষ। সামনের দিকে ঝুঁকে প্রায় ভাসতে ভাসতে রাকেশের দিকে আসছে মানুষটা। রাকেশের সমস্ত শরীরটা আড়ষ্ট হয়ে গেছে। হাত-পা নাড়াতেও পারছে না রাকেশ। ধীরে ধীরে রাকেশের সামনে এসে দাঁড়াল মনুষ্যমূর্তি। হাত-পা না নাড়াতে পারলেও রাকেশের মাথা কাজ করছিল পুরোপুরি। সে দেখল এক মুখ লম্বা সাদা দাড়ির মনুষ্য শরীরটা সাদা কাপড়ের আলখাল্লায় ঢাকা। মাথায় একটিও চুল ণেই। চোখ প্রায় ঢাকা পড়ে আছে ভুরুর লম্বা চুলে। মুখের আকৃতিটা অনেকটা বাঁদরের মতো। লম্বা হাত দুটো প্রায় হাঁটু ছুঁয়ে আছে। গায়ের চামড়া কোঁচকানো। হালকা বাদামি বর্ণ। ঠিক যেন ছবিতে দেখা প্রাগৈতিহাসিক চরিত্র।
রাকেশের সামনে দাঁড়িয়ে রাকেশের বুকে হাত ছোঁয়াল প্রায় মানুষ আকৃতির প্রাণীটি। সাদা আলখাল্লার তলা থেকে বেরিয়ে আসা লম্বা লম্বা পাঁচ আঙুলের হাতের কবজির ওপর একটা জড়ুল। কালো রঙের আধখানা চাঁদের আকার কবজির ওপর। চমকে উঠল রাকেশ। ওঁর হাতের কবজির ওপরেও ঠিক একইরকম জন্মদাগ আছে।
প্রাণীটির হাতের ছোঁয়া পেতেই রাকেশের আড়ষ্টতা চলে গেল। রাকেশের হাতটি হাতে তুলে নিল প্রাগৈতিহাসিক চেহারার মানুষটি। হাত বোলাতে লাগল তার কবজির পোশাকের ওপর, ঠিক যেখানে জড়ুলটা আছে। গা শিরশির করে উঠল রাকেশের।
“ভয় পেও না দাদুভাই।” হেলমেটের ভেতরে গমগম করে উঠল শব্দগুলো। “আমি তোমার অতিবৃদ্ধ পিতামহ। আমরা জানতাম আমাদের বংশধর একদিন আসবে। মা চ্যাং, আর পরমপিতা হো-ইয়ু তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
হেলমেট পরা মাথাটা কয়েকবার ঝাঁকাল রাকেশ। জেগে জেগে কী উলটোপালটা স্বপ্ন দেখছে সে! হেলমেটের বোতামে চাপ দিল সে। “হ্যালো ফিড সেন্টার, রকেট-৪ বলছি।”
কোনও সাড়া এল না।
“কেউ তোমার কথা শুনতে পাবে না দাদুভাই। তোমার সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা সাময়িকভাবে অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। তোমার যন্ত্রযান এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে।”
“আপনি কে?”
“আমি তোমার অতিবৃদ্ধ পিতামহ। তুমি যে আমাদেরই বংশধর তার প্রমাণ তোমার হাতের ওই জড়ুল। আমাদের প্রয়োজনে আমাদের চিহ্ন নিয়ে আমাদের বংশধর জন্ম নেয় পৃথিবীর বুকে। সময়মতো আমরা তাকে নিয়ে নিই আমাদের নিয়ন্ত্রণে।”
আবার মাথাটা ঝাঁকাল রাকেশ। স্বপ্ন দেখছে সে?
“তুমি কোনও স্বপ্ন দেখছ না দাদুভাই।” হেলমেটের ভেতর গমগম করে উঠল শব্দগুলো।
“আমরাও তোমাদের মতো মানুষ। বহু হাজার বছর আগে আমরা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে এসেছি চাঁদের বুকে। পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও আমরা আমাদের নিয়ন্ত্রণ পন্থা রেখে দিয়েছি পৃথিবীর বুকে। তার ফলশ্রুতি তুমি। হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ না চালালেও এখন সময় হয়েছে পৃথিবীকে আবার নিয়ন্ত্রণ করার। এর এই নিয়ন্ত্রণ আমরা করব তোমার মধ্যে দিয়ে। না হলে পৃথিবীতে আমাদের উত্তরসূরিরা ধ্বংস করে দেবে আমাদের বাসস্থান এই চাঁদকে।”
***
আমার মাথা নিশ্চয়ই খারাপ হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবল রাকেশ। হাজার হাজার বছর ধরে চাঁদের বুকে মানুষ বাস করছে, এটা কি সম্ভব? কয়েকশো স্যাটেলাইট চাঁদকে ঘিরে পাক খাচ্ছে অনবরত। অন্তত দু’হাজার অভিযান চালানো হয়েছে চাঁদের বুকে। রাকেশের আগে নিরানব্বই জন মানুষ পা দিয়েছে চাঁদের মাটিতে। আর দশ বছরের মধ্যেই পঞ্চাশ জনের বসতি স্থাপিত হতে চলেছে চাঁদের বুকে। এই মুহূর্তে চাঁদের মাটিতে বেশ কয়েকটি দূর নিয়ন্ত্রিত রোবট খোঁড়াখুঁড়ি করে চলেছে বিভিন্ন স্পেস স্টেশনের তত্ত্বাবধানে। চাঁদের আনাচ-কানাচের তথ্য এখন পৃথিবীর হাতের মুঠোয়। চাঁদের মাটির আস্তরণের তলায় বরফ পাওয়া গেছে। চাঁদের কয়েক জায়গার বাতাসে সামান্য অক্সিজেনের আভাস মিলেছে। আর সেখানে ছড়ানো হয়েছে গমের বীজ, গাছ গজায় কি না দেখার জন্য। আর সেই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে ঘাসের বীজ নিয়ে এসেছে রাকেশ। এত নজরদারি এড়িয়ে চাঁদের মাটিতে মানুষের অনাবিষ্কৃত উপস্থিতি? হতেই পারে না! পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ার মানসিক চাপে নিশ্চয়ই ভুল দেখছে সে। রাকেশ ভাবল।
বৃদ্ধ লোকটি হাত রাখলেন রাকেশের কাঁধে। “চলো দাদুভাই, তোমাকে আমাদের চাঁদের একটা বসতিতে নিয়ে যাই।”
রাকেশের শরীরের ঊর্ধ্বাংশ আবার আড়ষ্ট হয়ে গেছে। শরীরের ওপর ওর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু ওর মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ সজাগ।
বৃদ্ধ ওর হাত ধরে অতি ধীরে ধীরে এগোতে লাগলেন সামনের ঢিপি হয়ে থাকা বালি পাথরের দিকে। মন থেকে বাধা দিতে চেষ্টা করেও কোনোকিছু করতে পারছে না রাকেশ। যন্ত্রচালিতের মতো সে এগিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে বৃদ্ধের হাত-বন্দি হয়ে।
“আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? যদি আপনারা চাঁদের মানুষও হন তবে কি আমি আপনাদের হাতে বন্দি?”
“ভয় পেও না দাদুভাই।” সেই একই শব্দ গমগম করে উঠল হেলমেটের ভেতর।
“যদি আপনি মানুষও হন তা হলে প্রায় অক্সিজেনহীন একটি গ্রহে আপনারা বেঁচে আছেন কী করে? আপনি আমার সঙ্গে কথাই বা বলছেন কী করে? সম্পূর্ণ বায়ুনিরোধক এই হেলমেটের ভেতরে আপনার কোনও শব্দই আসার কথা নয়।”
“ধীরে দাদুভাই, ধীরে। তোমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর শীঘ্রই পাবে। তোমার শরীরকে আমরা আমাদের বশে নিলেও তোমার মনের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ আমরা নেইনি। তোমার মনের কোনও ক্ষতি আমরা চাই না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, পৃথিবীর মানুষ চাঁদের মানুষের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে।”
বৃদ্ধের হাত-বন্দি হয়ে বালি-পাথরের ঢিপির সামনে পৌঁছতে আচমকা রাকেশের পায়ের তলার বালি সরে গেল। ভুস করে বৃদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে রাকেশ ডুবে গেল বালির ভেতর।
***
ফিড সেন্টারের ডিরেক্টর সোনাম নামগিয়ালের তলবে সব বিভাগের প্রধান ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা দ্রুত জড়ো হয়েছেন কনফারেন্স কক্ষে। সমস্ত সিস্টেম ভালো করে চেক করা হয়েছে, কোথাও কোনও ত্রুটি ধরা পড়েনি। কিন্তু কন্ট্রোল রুম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে রকেট-৪। অথচ এই মুহূর্তে ফিড সেন্টারের তত্ত্বাবধানে চাঁদের বুকে উপস্থিত বাকি চারটে রোবট চালিত চন্দ্রযান থেকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর একের পর এক তথ্য এসে জমা হচ্ছে কন্ট্রোল রুমের কম্পিউটারগুলোতে। কোনও গোলযোগ নেই।
মিস্টার সোনাম নামগিয়াল ফিড সেন্টার থেকে রকেট-৪ অন্তর্ধানের খবর জানিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রগুলোকে জরুরি বার্তা পাঠাতে বললেন। সব মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রকে অনুরোধ করতে বললেন যে চাঁদের চারপাশে ঘুরতে থাকা তাদের কৃত্রিম উপগ্রহগুলোকে রকেট-৪-এর সন্ধানে কাজে লাগাতে।
এক তরুণ প্রকৌশলী বলল, “স্যার, এখুনি অন্যান্য মহাকাশ কেন্দ্রে অনুরোধ না পাঠিয়ে আর একটু অপেক্ষা করলে হত না? মানে আমরা তো সবরকম চেষ্টা করে চলেছি রকেট-৪-এর সঙ্গে যোগাযোগ চালু করতে। তাছাড়া আমাদের আরও চারটে চন্দ্রযান যেগুলো এখন চাঁদের বুকে আছে সেগুলোকে রকেট-৪কে খোঁজার জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে।”
“ওই চারটে চন্দ্রযান অন্য কাজ করছে, ওদের সরানো যাবে না। তাহলে পুরো মিশন ব্যর্থ হয়ে যাবে। বুঝতে পেরেছি তুমি চাইছ না এখুনি বাকি সবাই জেনে যাক আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কথা। কিন্তু এটা ভেবে দেখো, একজন মহাকাশচারী এই মুহূর্তে চাঁদের মাটিতে উধাও, এটা কি অন্য মহাকাশ কেন্দ্রগুলো এতক্ষণ জেনে যায়নি? ওদের উপগ্রহগুলো শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আমাদের চন্দ্রযানগুলোর দিকে। রকেট-৪ চাঁদের মাটিতে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে কত শুভেচ্ছা বার্তা এসেছে দেখেছ? আর কিছুদিন পর যখন চাঁদ ভাগ হয়ে যাবে, প্রতিটি মহাদেশ তার নিজ নিজ উপনিবেশ স্থাপন করবে তার নির্দিষ্ট জায়গায় তখন আর চাঁদের মাটিতে আমাদের পছন্দমতো জায়গায় অভিযান চালানোর কোনও অধিকার থাকবে না।”
“জানি স্যার। রাকেশ আমার প্রিয় বন্ধু। স্যার, একটু সময় দিন। আমাদের অন্য স্যাটেলাইট থেকে ওই অঞ্চলের ছবি এসেছে, কিন্তু রকেটের জায়গাটা ব্লার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা চাপা দিয়ে রেখেছে রকেটটাকে। স্যার, পুরো ব্যাপারটাই কেমন রহস্যজনক লাগছে। হতে পারে ওখানে চন্দ্রঝড় হচ্ছে, কিন্তু স্যার, আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, কোনও না কোনও মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র গোপনে কোনও শক্তি তরঙ্গ ব্যবহার করে আমাদের রকেট-৪-এর যোগাযোগ ব্যবস্থা অকেজো করে দিয়েছে। হয়তো ওখানে এমন কিছু গোপন ব্যাপার ঘটছে যেটা প্রকাশ পাক সেটা কোনও শক্তি চায় না।” বলে উঠল তরুণ প্রকৌশলী।
“ধরে নিলাম তোমার আশঙ্কা সত্যি। তাহলে তো ওরা রকেট-৪কে দূরনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করেও দিতে পারে। ঠিক একবছর আগেই তো ওই জায়গায় ফ্লেক্সো মহাকাশ কেন্দ্রের চন্দ্রযান নেমেছিল। ফ্লেক্সো তো চাঁদের বুকে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলেছে চাঁদের বুকের খনিজ, বিশেষত সোনা খুঁজে বের করতে… কথাটা মন্দ বলোনি। ওরা ওখানে কোনও বিস্ফোরক ছেড়ে আসেনি তো? ফ্লেক্সোকে সবাই সন্দেহের চোখে দেখে। ওরা নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারে। কিন্তু এখন কোনও বিস্ফোরণ ঘটালে ধরা পড়ে যাবে। এতগুলো স্যাটেলাইটের দৃষ্টি এড়িয়ে কিছু করা মুশকিল। কিন্তু আমার ধারণা আমাদের সিস্টেমে কিছু গড়বড় হয়েছে। রকেট-৪-এর কিছু হলে এতক্ষণ অনেক সান্ত্বনা দেওয়া বার্তা এসে যেত।”
“সেই জন্যেই বলছিলাম স্যার, অন্য কারও সাহায্য চাইবার আগে আমাদের একটু চেষ্টা করতে দিন।”
চেয়ার থেকে উঠে ঘরের ভেতর পায়চারি করতে শুরু করলেন মিস্টার নামগিয়াল। ঘরের ভেতর বড়ো বড়ো পাঁচটা স্ক্রিনে ফুটে রয়েছে পাঁচটা ভিন্ন ভিন্ন ছবি। চারটে স্ক্রিনে ক্রমাগত ছবি বদলে চলেছে। চাঁদের বুকে রোবট চালিত চার চন্দ্রযান থেকে আসা বিভিন্ন ছবি। শুধু একটা স্ক্রিনে কোনও ছবি নেই। ঝাপসা হয়ে আছে স্ক্রিনটা।
“ঠিক আছে। আপনারা সমস্ত সিস্টেম চেক করুন, একঘণ্টা পরে আমরা পর্যালোচনায় বসব।”
***
সরসর করে পায়ের তলায় বালি সরে যেতে রাকেশ বুঝতে পারল, সে বৃদ্ধের হাত ধরে ঢালু পথ ধরে গড়িয়ে চলেছে ঝুরঝুরে বালির অতলে। মুহূর্ত পরেই রাকেশ টের পেল সে শুয়ে আছে শক্ত জমির ওপর। বৃদ্ধ তাকে যত্ন করে দু’হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তার শরীর এখনও আগের মতোই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বৃদ্ধের হাত তার হাতের সঙ্গে চুম্বকের মতো লেগে আছে। সে চেষ্টা করলেও বৃদ্ধের হাত ছাড়াতে পারছে না। মন তার অধীনে থাকলেও শরীর কোনোভাবেই তার কথা শুনছে না। রাকেশ বুঝতে পারছে হাতের স্পর্শে বৃদ্ধ তার স্নায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।
অন্ধকারে খানিক চোখ সইতেই রাকেশ বুঝতে পারল তারা দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল গুহার ভেতরে। একটা হালকা আলোয় আলোকিত গুহার ভেতরটা। আবছা আলোয় রাকেশ দেখতে পেল একটা চওড়া রাস্তা সোজা চলে গেছে, আর তার দু’ধারে পিরামিড সদৃশ সার সার স্থাপত্য।
মনে মনে চমকে উঠল রাকেশ। তার মানে সে যা দেখছে সেটা স্বপ্ন নয়, সত্যি! এতদিন বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রগুলো যা ছবি তুলেছে সেগুলো সব চাঁদ-পৃষ্ঠের ছবি। চাঁদের পেটের ভেতরে ঢুকে থাকা চাঁদে বসবাসকারী প্রাণের অস্তিত্ব তাই অধরা থেকে গেছে।
“ঠিক ধরেছ দাদুভাই!”
চমকে উঠল রাকেশ। সে তো কোনও কথা বলেনি, তবে?
“আগেই বলেছি, আমরা মনের কথা বুঝতে পারি দাদুভাই। শুধু তাই নয়, এই চাঁদে বসবাসকারী মানুষেরা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগও করি মনসংযোগ করে। পৃথিবীর বর্তমান বাসিন্দাদের মতো আমাদের কোনও যান্ত্রিক সাহায্য লাগে না অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে। অতি যন্ত্র নির্ভর হয়ে তোমরা তোমাদের শেষ করে দিয়েছ। পরিবেশের বিরুদ্ধাচারণ করে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে এখন বসতি গড়তে পা বাড়িয়েছ অন্য গ্রহে। কিন্তু সেটা হবে না দাদুভাই। আমরা এখানে বর্তমান পৃথিবীর লোভী মানুষকে বসতি গড়তে দেব না। পৃথিবীর অনেকটাই ধ্বংস করব আমরা। আর সেই ধ্বংস হবে তোমার মধ্যে দিয়ে। তোমার হাতের ওই জড়ুল চিহ্ন আমাদের চিনিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর নিয়ন্তাকে।”
“না। তা হতে পারে না। আমি পৃথিবীকে ধ্বংস হতে দেব না।” চিৎকার করে উঠল রাকেশ।
রাকেশের চিৎকারে চোখ বন্ধ করলেন বৃদ্ধ। রাকেশ দেখতে পেল ওঁর ঠোঁট দুটো নড়ছে। তারপর বৃদ্ধ একদম স্থির হয়ে গেলেন।
বৃদ্ধের না ধরা অন্য হাতে রাকেশ একটা ছোঁয়া পেল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল নিঃশব্দে লাল আলখাল্লা পরা আরেক বৃদ্ধ এসে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার আরেকটি হাত ধরেছেন। অপর বৃদ্ধ কখন কীভাবে এলেন দেখতেই পায়নি রাকেশ। অপর বৃদ্ধ তার হাতে হাত রাখতেই রাকেশের মনে হল তার শরীরে যেন বিদ্যুতের ছোঁয়া লাগল। কেঁপে উঠল তার সমস্ত শরীর। নতুন বৃদ্ধের চোখে চোখ পড়তেই রাকেশ টের পেল দু’জন বৃদ্ধের চেহারা প্রায় একইরকম হলেও এর চোখের দৃষ্টি কঠোর। প্রথম দেখা হওয়া বৃদ্ধের মতো কোমল স্নেহময় নয়। যদিও এঁর ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি লেগে আছে।
প্রথম বৃদ্ধ চোখ খুললেন। বললেন, “দাদুভাই, ভয় পেও না। আমরা তোমাকে প্রতিমূর্তি কক্ষে নিয়ে যাব। ওখানে তোমার শরীর মন সবকিছুর অতিমাত্রিক মূর্তি তৈরি হবে। তুমি থেকে যাবে চাঁদে আর তোমার অতিমাত্রিক মূর্তিটা রকেটে চেপে ফেরত যাবে পৃথিবীর বুকে। না, পৃথিবীবাসী ধরতে পারবে না যে তুমি ফেরনি, চাঁদ থেকে ফেরত এসেছে নকল রাকেশ নামগিয়াল। আর তোমাকে আমরা রেখে দেব চাঁদের বুকে। তুমি হবে চাঁদের নবতম বাসিন্দা। চাঁদের মানুষ দেখবে পৃথিবীর মানুষ দেখতে কেমন। চাঁদ-বুড়ি তোমার জন্য ওখানে অপেক্ষা করছেন। একদম সময় নেই। তোমার চন্দ্রযানের ওপর থেকে আমাদের তরঙ্গ রহিত আবরণ দ্রুত তুলে নিয়ে তোমার চন্দ্রযানের সঙ্গে পৃথিবীর যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দিতে হবে।”
ছটফট করে উঠল রাকেশ। এঁরা ওর নকল বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে পৃথিবীকে ধ্বংস করবেন? সে এটা কিছুতেই হতে দেবে না। তাহলে এই বৃদ্ধও কি একসময় পৃথিবীর বাসিন্দা ছিলেন? কোনও অজানা উপায়ে এঁকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে পৃথিবী থেকে চাঁদে?
“না দাদুভাই, আমি চাঁদেই সৃষ্ট। চাঁদে এখন আমরা প্রাণ সৃষ্টি করি অন্য পদ্ধতিতে। সেই পদ্ধতির খানিক তুমি এখনই দেখতে পাবে।”
রাকেশের হেলমেটে দুই বৃদ্ধের একসঙ্গে ‘ওঁ’ উচ্চারণ গমগম করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে রাকেশ টের পেল, তার শরীরটা ভার শূন্য হয়ে দুই বৃদ্ধের হাত ধরে ভূমি ছেড়ে খানিক ওপরে উঠে গেল। তারপর রাকেশ একটা হালকা টান অনুভব করল। রাকেশ যা ঘটছে তাকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। দুই বৃদ্ধ তাকে শূন্যে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন। দুই বৃদ্ধের পা দুটো সাঁতার কাটার মতো হালকা নড়ছে। আর তারা এগিয়ে চলেছে।
তারা উড়ছে ভূপৃষ্ঠের সামান্য ওপর দিয়ে। গুহার ছাদ অনেক ওপরে। তার থেকে নেমে এসেছে পাথরের ঝুরি। সার সার পিরামিড সদৃশ স্থাপত্যের ফাঁকে ফাঁকে অজস্র পাথরের স্তম্ভ। স্ট্যালেগমাইট আর স্ট্যালেগমাইট। তার মানে চাঁদের মাটিতে প্রচুর জল আছে। না হলে পাথরের এই গঠন সম্ভব নয়। এই গুহা তৈরি করেছে প্রকৃতি নিজে।
হেলেমেটের ভেতর ভেসে এল বৃদ্ধের কথা। “একদম ঠিক ধরেছ দাদুভাই। চাঁদের মাটির তলায় অনেক জল আছে। কিন্তু প্রকৃতি চাঁদের উপরিভাগ করে রেখেছে জলশূন্য।”
“তার মানে আমরা এতদিন যা জেনেছি সব ভুল?” প্রবল শক্তিতে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে রাকেশ বলল।
“না। সব ভুল নয় দাদুভাই। এই যে দু’দিকে পিরামিডগুলো দেখছ এগুলো হল আমাদের সাধনা কক্ষ। এখানে বসে আমরা ব্রহ্মাণ্ডের সব খবরাখবর প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করি। আমাদের সাধকরা দৃষ্টিক্ষেপণ করে অনবরত অনুসন্ধান করে চলেছেন ব্রহ্মাণ্ডের নানা পদক্ষেপ। এই কক্ষের অভ্যন্তর থেকেই আমরা পৃথিবীর ওপর নজর রাখি। তোমার আমাদের সাধনাক্ষেত্রে আগমন আমাদের এই সাধকদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। পৃথিবীতেও আমাদের সাধকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত চন্দ্রমানুষ আছে। প্রকৃতি-মা তাদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর সৃষ্টি করেন পৃথিবীর বুকে আর তাদের চিহ্ন হল তাদের কবজিতে এই অর্ধাকৃতি চাঁদ-জড়ুল।”
শিউরে উঠল রাকেশ। তার মানে সেও একধরনের নিয়ন্ত্রিত রোবট?
“ঠিক ধরেছ দাদুভাই। আমরা সবাই প্রকৃতি মায়ের সৃষ্ট রোবট। আমাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ড জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নির্ধারিত। যাকে তোমরা বলো নিয়তি। হাতের রেখা হল প্রতিটি মানুষের জীবদ্দশার সূচি। ওই নির্দিষ্ট সূচির বাইরে যাবার উপায় নেই।”
“কী বলছেন আপনি? যদি তাই হয় তাহলে পৃথিবীকে আপনারা ধ্বংস করতে চাইছেন কেন? সেটা তো প্রকৃতি-মা নিজেই করতে পারেন।”
“ধীরে দাদুভাই। এটাও প্রকৃতি-মায়ের ইচ্ছে। উনি ওঁর সৃষ্টিকে প্রতিনিয়ত গড়েন ও ভাঙেন। ব্রহ্মাণ্ড হল ওঁর পরীক্ষাগার।”
“আপনি খানিক আগে বললেন চাঁদে মানুষ আছে, তাহলে তারা কোথায়? আপনাদের দু’জন ছাড়া আর কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না। আপনার কী খেয়ে বেঁচে আছেন? চাঁদে কি মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণী নেই?”
“আছে চাঁদে অনেক মানুষ আছে। আছে অন্য অনেক প্রাণী। তারা আছে চাঁদের পেটের আরও ভেতরে। পাতাল রাজ্যে। তোমরা একরকম আরশোলারূপী প্রাণীর কল্পনা করেছ। সে কল্পনা মিথ্যে নয়। আছে, তারা আছে। তারা আছে ব্রহ্মাণ্ডের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে।”
“গুহা মানেই তো পাতাল। তাহলে তাদের দেখা পাচ্ছি না কেন?”
“চাঁদে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত। মৃত্যুর স্থান নেই এখানে। যদি না মা চ্যাং চান। প্রতি পাঁচ হাজার বছর পরপর চাঁদের প্রতিটি মানুষের সাধনার মূল্যায়ন হয়। চ্যাং মা আর হো-ইয়ু বাবা ঠিক করেন আগামীতে কারা চাঁদে থাকবে আর কারা থাকবে না। কিংবা কে আর বেঁচে থাকবে না। যারা এই মূল্যায়নে নিচের দিকে থাকে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ব্রহ্মাণ্ডের কোনও না কোনও অংশে, না হয় চিরঘুমে চলে যায় তারা। যাদের অন্য ব্রহ্মাণ্ডে পাঠানো হয়, সেখানে তাদের গড়ে তুলতে হয় নতুন উপনিবেশ। আর সেই শূন্যস্থান পূরণ করা হয় নতুন চাঁদ-মানুষের জন্ম দিয়ে। আমি হলাম চাঁদের সবচাইতে নবীনদের একজন। আর পাঁচশো বছর পর আমাদের মূল্যায়ন হবে।”
“তার মানে আপনার বয়স সাড়ে চার হাজার বছর?”
“ঠিক তাই দাদুভাই।”
“আপনারা আমার নকল নিয়ে কী করতে চান?”
“সেটা চ্যাং মা ঠিক করবেন।”
“চ্যাং মা কে?”
“তুমি চ্যাং-এর গল্প শোনোনি দাদুভাই?”
রাকেশের মনে পড়ল, ছোটবেলায় মায়ের কাছে শোনা চাঁদ-বুড়ির এক গল্প। সেই বুড়ি নাকি চাঁদে বসে একটা খরগোশ কোলে চরকা কাটে। ‘অনেক-অনেকদিন আগে চিনদেশে চ্যাং নামে এক সুন্দরী মহিলা বাস করতেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন এক তিরন্দাজ হো-ইয়ুকে। দু’জনে মিলে পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করার জন্য অনেক কাজ করতেন। তার মধ্যে একটা ছিল পৃথিবীকে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করা। তাঁরা একটা বিশাল পাথরের প্রাসাদ বানিয়েছিলেন সে দেশের রানিমার জন্য। রানিমা হো-ইয়ুর পারদর্শিতায় খুশি হয়ে ওঁকে দুটো খাবারের গুলি দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই জাদুবড়ি দুটো খেলে তোমাদের মৃত্যু হবে না। কিন্তু এখনই এগুলো খেতে যেও না। এগুলো গ্রহণ করার জন্য তোমাদের শরীরকে প্রস্তুত করতে হবে। তার জন্য একবছর ধরে তোমাদের উপবাস ও ধ্যান করে নিশ্চল হয়ে বসে থাকতে হবে।’
হো-ইয়ু বাড়িতে এসে চ্যাংকে জাদুবড়ির কথা বলে একটা গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখে নিজেদের সেই বড়ি খাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে বললেন। তিন-চারদিন পর চ্যাং-এর ইচ্ছে হল বড়িগুলোকে একবার ভালো করে দেখার। গোপন জায়গা থেকে বের করে তিনি একটা বড়ি হাতে নিয়ে দেখতে লাগলেন। মুক্তোর দানার মতো দেখতে বড়িটা থেকে দ্যুতি ঠিকরে বেরোচ্ছিল। রামধনুর আভা লেগে তাতে।
ঠিক সে সময় হো-ইয়ু সেখানে এলেন। চ্যাং তাড়াতাড়ি হাতের ফাঁকে বড়িটা লুকিয়ে ফেললেন। হো-ইয়ু জিজ্ঞেস করলেন, “কী করছ?”
চ্যাং উত্তর দিলেন, “কই, কিছু না।”
“তুমি জাদুবড়ি দেখছ না তো? তোমাকে বলিনি, রানিমা বলে দিয়েছেন একবছরের আগে আমাদের শরীর কিন্তু ওগুলো গ্রহণের জন্য তৈরি হবে না।”
“না না, আমি কিছু করছি না।”
“তোমার হাত দেখাও।” হো-ইয়ু বললেন।
পেছনে লুকনো একটা হাত সামনে এনে মেলে ধরে চ্যাং বললেন, “দ্যাখো, কিছু নেই।”
“আরেকটা হাত দেখাও।”
চ্যাং সামনে আনা হাতটা পিছনে করে আরেকটা হাত বের করে আনেন।
“এবার দুটো হাত একসঙ্গে দেখাও।”
জাদুবড়িটা কোথায় লুকোবেন বুঝতে না পেরে তিনি মুখের ভেতর লুকিয়ে ফেলেন। তারপর দুটো হাত সামনে এনে বলেন, “দ্যাখো, কিছু নেই।”
শুধু তাই নয়, হো-ইয়ুর গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে ভয়ে ঘরের মাঝে ছোটাছুটি শুরু করে দেন চ্যাং। পিছন পিছন ছুটতে থাকেন হো-ইয়ু। কিন্তু ছোটাছুটিতে যা হবার তাই হল, গিলে ফেলেন জাদুবড়িটা চ্যাং।
গেলার সঙ্গে সঙ্গে হালকা হয়ে যায় চ্যাং-এর শরীর। তাঁর শরীর থেকে ঝকঝকে দ্যুতি বেরোতে শুরু করে। আর হাওয়ায় ভেসে ক্রমশ আকাশের পানে উঠতে থাকেন তিনি।
“যাচ্ছ কোথায়? নেমে এসো।” চিৎকার করে ওঠেন হো-ইয়ু।
“আমি জাদুবড়িটা খেতে চাইনি, শুধু হাতে নিয়ে দেখছিলাম। তোমাকে লুকোতে যেই মুখে পুরেছি পেটে চলে গেছে ওটা।” ডুকরে ওঠেন চ্যাং।
খোলা জানালা দিয়ে বেরিয়ে চ্যাং আকাশের দিকে উড়তে থাকেন। হো-ইয়ু লাফ দিয়েও নাগাল পান না চ্যাং-এর। সামনে চ্যাং-এর পোষা খরগোশটা দেখে হো-ইয়ু চ্যাং-এর দিকে ছুড়ে দেন খরগোশটা। লুফে নেন চ্যাং খরগোশটা। খানিক নিশ্চিন্ত হন হো-ইয়ু, যেখানেই যান একা থাকবেন না চ্যাং।
“গল্পটা একদম ঠিক দাদুভাই। শুধু পরের ঘটনাটার কথা কোথাও বলা হয়নি। মনের দুঃখে একটা থলেতে খানিক শস্যের দানা ভরে হো-ইয়ুও অন্য জাদুবড়িটা খেয়ে কাঁধে তির-ধনুক ও থলি ঝুলিয়ে, কোলে পোষা কুকুরটাকে নিয়ে চ্যাং-এর পিছন পিছন ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছেছিলেন চাঁদের বুকে। জাদুবড়ির কল্যাণে মারা যাননি তাঁরা। চাঁদের বুকে এখনও বেঁচে আছেন। আমরা তাঁদেরই সন্তান। আমরাও বেঁচে আছি ওই জাদুবড়ির কল্যাণে। চাঁদের অভ্যন্তরে মানুষ ছাড়াও আরও অনেক প্রাণ আছে। হো-ইয়ুর আনা শস্যের দানা থেকে শস্য ফলেছে এখানে। দানার ভেতর থাকা পোকারা বংশবৃদ্ধি করেছে এখানে। কাজেই পৃথিবীর মাধুর্য থেকে বঞ্চিত নই আমরা। আমরা অমর, আমাদের সাধারণ মৃত্যু নেই। তাই আমাদের জনসংখ্যা অতি সন্তর্পণে নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু মানুষ অমর নয়। তোমরা তোমাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারনি। ফলে বেঁচে থাকার তাগিদে তোমরা দখল নিতে চাইছ এই গোলকের। সেটা আমরা হতে দিতে পারি না। জানবে, সবকিছুই জানবে। কারণ, এখন থেকে তোমার বাসস্থান এই চাঁদ।”
আর ভাবতে পারছে না রাকেশ। এও কি সম্ভব? রূপকথা কি কখনও সত্যি হতে পারে?
***
ফিড সেন্টারে চরম ব্যস্ততা। বেশ কয়েকটা মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে জানতে চাওয়া হচ্ছে রকেট-৪ সম্বন্ধে। তাদের স্যাটেলাইটগুলো থেকে ল্যান্ডিং-এর খানিক পর থেকে রকেট-৪-এর কোনও ছবি ধরা পড়ছে না। হঠাৎ করে খানিক জায়গা জুড়ে কোনও ছবি আসছে না। তাঁরাও আশঙ্কা করছেন কোনও অজানা চন্দ্রঝড়ে ঢাকা পড়ে গেছে রকেট-৪। আর ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে রকেট-৪। এটা কী ধরনের ঝড় জানার জন্য অন্য মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রগুলো স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবিগুলো বিশ্লেষণ করছে।
সোনাম নামগিয়াল রকেট-৪-এর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কথা আর গোপন রাখতে বারণ করে দিলেন। নির্দেশ দিলেন অন্য মহাকাশ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে যদি ওই অঞ্চল সম্পর্কে কোনও তথ্য পাওয়া যায় তা চেয়ে নিতে।
তিনি নিশ্চিত, ধ্বংস হয়ে গেছে রকেট-৪। আর তার সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে রাকেশ। যদিও রকেট ধ্বংস হয়ে গেছে এই তথ্য প্রচার করতে বারণ করলেন উনি। আরও কোনও তথ্য পাওয়া যায় কি না দেখা যাক। রকেট যে চাঁদের বুকে নির্বিঘ্নে নেমেছিল এতে কোনও দ্বিমত নেই। রকেট নামার পর কী হয়েছে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।
ঠাণ্ডা মাথার মানুষ সোনাম নামগিয়াল। নিজে দুঁদে নভশ্চর। নিজের ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে ভাবতে বসলেন। চন্দ্রঝড় উঠলেও এত অত্যাধুনিক যন্ত্রে রকেটের অস্তিত্ব ধরা পড়বে না, এটা অসম্ভব। তবে কি রাকেশের বন্ধুর কথাই ঠিক? ওখানে কোনও মহাকাশ কেন্দ্র গোপনে এমন যন্ত্র বসিয়েছে যাতে করে অন্য কোনও যন্ত্রের সংকেতকে স্তব্ধ করে দেওয়া যায়?
টেবিলের ওপর রাখা ফোনটা হাতে উঠিয়ে নিলেন উনি। লাসার টপ-অরবিটরি মহাকাশ কেন্দ্রের প্রধান তিয়াং সাং ওঁর বিশেষ বন্ধু। অনেক গোপন খবর রাখেন উনি। তিয়াং সাং বিশ্বাস করেন চাঁদে উন্নত ধরনের প্রাণী আছে, যাদের বাঁচতে মানুষের মতো অক্সিজেন লাগে না। এমনকি ওদের খাবারেরও প্রয়োজন নেই। কিন্তু মানুষ এখনও তাঁর সন্ধান পায়নি। তিয়াংকে নিয়ে পেছনে অনেক হাসিঠাট্টা চলে মহাকাশ গবেষকদের মধ্যে।
আচ্ছা, এরকম তো নয় যে তিয়াং-এর ভাবনা সত্যি। চাঁদের কোনও প্রাণীর খপ্পরে পড়েনি তো রাকেশ?
উদ্ভট চিন্তাটা দূর করে দিতে চাইলেও পারছেন না সোনাম নামগিয়াল। তিয়াং-এর সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলাটা কি ঠিক হবে? তিয়াং রাকেশকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসে। তিয়াং-এর সঙ্গে রাকেশের একটা অদ্ভুত মিল আছে। দু’জনেরই হাতের কবজিতে আধখানা চাঁদের মতো জড়ুল আছে। রাকেশের দক্ষ নভশ্চর হওয়ার পেছনে তিয়াং-এর ভূমিকা কিছু কম নয়। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে তিয়াং-এর সঙ্গে অনেকদিন কাটিয়েছে রাকেশ।
তিয়াংকে ফোন করতেই ফোনের পর্দায় ভেসে উঠল একটা বার্তা, ‘কল মি আফটার অ্যান আওয়ার। ট্রাইয়িং টু ট্রেস রকেট-৪।’
একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন সোনাম নামগিয়াল। তিয়াং হয়তো কোনও আলোকপাত করবে। একঘণ্টা অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি চললেন কন্ট্রোল রুমের দিকে।
***
দুই বুড়োর হাতে বন্দি হয়ে উড়ে যেতে যেতে রাকেশ দেখল পিরামিড আকৃতির ঘরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে সোনালি গমের ঝাড়। হালকা আলোয় উদ্ভাসিত চারপাশ। শুধু আলোর উৎসটা কী সেটাই বুঝতে পারল না।
একটা স্বচ্ছ পিরামিডের সামনে গিয়ে আস্তে করে ভূমি ছুঁল ওদের পা। দুই বুড়োর ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে। বেশ জোরে একটু দীর্ঘ সময় ধরে ‘ওম’ শব্দ রাকেশ তার হেলমেটের ভেতর প্রতিধ্বনিত হতে শুনল। মনে হল স্বচ্ছ দেওয়ালের একটা অংশ ফাঁক হয়ে গেল। কিন্তু দেওয়ালটা এত স্বচ্ছ যে রাকেশ বুঝতে পারল না সত্যি কোনও দরজা খুলল, নাকি তার দৃষ্টিভ্রম।
দুই বৃদ্ধ রাকেশকে দু’পাশে ধরে এগিয়ে চললেন।
“দাদুভাই ঠিকই ধরেছ, আমরা একটা দরজা পেরিয়ে এলাম। এই দরজাগুলো ‘স্বর-স্বীকৃতি’ পদ্ধতিতে খোলে। তোমরা কিছুদিন হল এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে শিখেছ। আরব্য রজনীর কাহিনির আলিবাবা চল্লিশ চোরের গল্প মনে আছে? সেই যে গুহার সামনে দাঁড়িয়ে ‘চিচিং ফাঁক’ বললে গুহা-মুখ খুলে যেত! মানুষেরা এসবকে অলীক কল্পনা বলে উপেক্ষা করেছে বহুকাল। দাদুভাই, মানুষ এক মুর্খ প্রাণী। অবিশ্বাসে ভরা। যদি তোমরা তোমাদের অতীতকে বিশ্বাস করে শিক্ষা নিতে, তবে অনেক আগেই তোমরা হয়তো বসতি গড়তে চাঁদের বুকে।”
খানিক এগোতেই রাকেশরা পৌঁছল চোখ ঝলসে দেওয়া দুটো ঝকঝকে উঁচু বেদির সামনে। উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল রাকেশের।
রাকেশরা পৌঁছতেই রাকেশদের মাথার ওপর দিয়ে দুটো মানুষের শরীর ভেসে এসে নামল বেদিগুলোর কাছে। ধপধপে সাদা আলখাল্লা পরা এক পুরুষ ও এক মহিলা। পুরুষটির কাঁধে তির-ধনুক ও মহিলাটির কোলে একটি খরগোশ। মহিলা ও পুরুষটি দু’জনেই থুত্থুড়ে। দু’জনকেই চিন-দেশিয়দের মতো দেখতে। পুরুষটির থুঁতনি থেকে খানিক লম্বা দাড়ি নেমে এসেছে। মহিলাটির মাথার চুলগুলো ধবধবে সাদা। আলখাল্লার ফাঁক দিয়ে শুধু মাথা ও হাতের আঙুল ক’খানা বেরিয়ে আছে।
রাকেশ বুঝতে পারছে না সে স্বপ্ন দেখছে কি না। বার কয়েক মাথা ঝাঁকাবার চেষ্টা করল সে।
“কী ভাবছ দাদুভাই, স্বপ্ন দেখছ?” রিনরিনে মহিলা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল রাকেশ।
“কাছে এসো, তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখি।”
রাকেশকে দু’পাশ থেকে ধরে বেদির সামনে নিয়ে গেলেন দুই বৃদ্ধ। একতাল কাদার মতো কী যেন একটা বস্তু একটা বেদির ওপর রাখা। একটা তীক্ষ্ণ লালচে আলোর রশ্মি নেমে আসছে ওপর থেকে। সরু লিকলিকে একটি হাত বেরিয়ে এল মহিলার আলখাল্লার আস্তিনের ভেতর থেকে। রাকেশ চমকে উঠল কবজির ওপর জড়ুল চিহ্ন দেখে। ভুল নেই, ঠিক ওর হাতের মতো। আঙুলগুলো ঘুরতে লাগল হেলমেটের ওপর। ঠিক যেন বুড়ো ঠাকুমা আদর করছেন নাতিকে। একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল রাকেশ। শিরশির করে উঠল রাকেশের শরীর। এই কি চাঁদের বুড়ি? যার বয়স কয়েক হাজার বা কয়েক লক্ষ বছর!
“দাদুভাই, তোমাকে একটা মহান দায়িত্ব নিতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে চাঁদকে রক্ষা করার। শুধু তাই নয়, সৌর বলয়ের যেসব জায়গায় প্রাণ আছে তাকে বাঁচাবার। মানুষ ভীষণ বোকা। বোকা না হলে কি আর আমার চাঁদে ঠাঁই হত? আমি চ্যাং, ভুল করে জাদুবড়ি খেয়ে ফেলেছিলাম। আমরাও তো তোমার মতো মানুষ। আবার কিছু মানুষ অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে বিপদে পড়ে। যেমন আমার স্বামী, তোমার দাদু হো-ইয়ু। আমাকে বাঁচাতেই অসময়ে জাদুবড়ি খেয়ে উনিও চাঁদে পৌঁছেছিলেন।” খানিক দম নিতে থামেন বৃদ্ধা।
“চাঁদকে বাঁচাতে হবে দাদুভাই, লোভী মানুষের দল আর কয়েক বছরের মধ্যেই চাঁদে বসতি গড়বে। মানুষের মধ্যেও জাদুবড়ির প্রভাব খানিক পড়তে শুরু করছে। মানুষ আর সহজে মরছে না। জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি তাই অন্য গ্রহে ঠাঁই বানাতে চাইছে। আর তাই সবচেয়ে কাছের আশ্রয়কে বেছে নিয়েছে, পৃথিবীর উপগ্রহটিকে।”
“নিজেদের অস্তিত্ব আমরাও আর বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারব না। তাই চাঁদকে বাঁচাতে পৃথিবীর জনসংখ্যা কমাতে হবে আমাদের। আর আমরা পৃথিবীর জনসংখ্যা কমাব তোমার মধ্যে দিয়ে। পৃথিবীর জনসংখ্যা কমে গেলে মানুষ আর চাঁদে বসতি গড়তে চাইবে না।” ঝিমিয়ে আসে বৃদ্ধার স্বর।
ছটফটিয়ে চিৎকার করে ওঠে রাকেশ, “না! আমি পৃথিবীকে ধ্বংস করতে পারব না।”
দুই বৃদ্ধ শক্ত করে ধরে রাকেশকে শুইয়ে দেন খালি বেদিটার ওপর। ওপর থেকে নেমে আসা তীক্ষ্ণ লাল আলোর রশ্মিটা রাকেশের শরীরের ওপর খেলা করতে থাকে। ধীরে ধীরে বেদির কাছে গিয়ে পিঠের ঝোলা থেকে তির বের করে রাকেশের হাতের দস্তানার ওপর চেপে ধরেন হো-ইয়ু। জড়ুলের ওপর ছুঁচ ফোটার মতো ব্যথা অনুভব করে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে রাকেশ।
রাকেশের ওপর থেকে লাল আলোর রশ্মিটা সরে গিয়ে রং পালটে নীল হয়ে পাশের খালি বেদির ওপর রাখা কাদার তালের মতো বস্তুটার ওপর পড়ল। হো-ইয়ু তিরের ফলাটা চেপে ধরলেন কাদার তালের ওপর। পাশের বেদির ওপর রাখা কাদার তালের মতো বস্তুটা দ্রুত মানুষের রূপ পেতে থাকে। শুধু রাকেশের চেহারাই নয়, রাকেশের পরে থাকা পোশাক সহ সবকিছুই রূপ পেতে থাকে ধীরে ধীরে। নতুন রাকেশ উঠে বসে বেদির ওপর। রাকেশকে ধরে নিয়ে আসা দুই বৃদ্ধ এগিয়ে যান সংজ্ঞাহীন রাকেশের শরীরের দিকে।
মা চ্যাং ও পিতা হো-ইয়ু ঝুঁকে পড়েন সদ্য রাকেশের রূপ পাওয়া মূর্তিটার ওপর।
কোনও কথা না বলে রাকেশের মূর্তির হেলমেটের ওপর হাত ছুঁইয়ে যেভাবে এসেছিলেন ঠিক সেভাবেই ভাসতে ভাসতে রাকেশের পেছনে মিলিয়ে গেলেন চ্যাং ও হো-ইয়ু।
রাকেশের শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়ে দুই বৃদ্ধ বলে ওঠেন, “যাই দাদুভাই, তোমার নকলকে তোমার আকাশ যানে পৌঁছে দিয়ে আসি। তুমি খানিক ঘুমোও। আমাদের শক্তি বলয়ের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। তোমার রকেটের সঙ্গে পৃথিবীর সংযোগ ফিরে আসবে খানিক সময়ের মধ্যে।”
দুই বুড়োর হাতে ধরা রাকেশের প্রতিমূর্তি উড়ে চলে।
***
রাকেশ ফিরে আসার ঠিক ছয় মাসের মাথায় চিনের উহান শহরে লাসার টপ-অরবিটরি মহাকাশ কেন্দ্রের প্রধান তিয়াং সাং আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক মহাকাশ সম্মেলনের প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ পায় রাকেশ। হান ও ইয়াংসিকিয়াং নদী বয়ে গেছে শহরের প্রান্ত দিয়ে।
চাঁদের বুকে চৌম্বকীয় ঝড়ের সম্মুখীন হয়ে রাকেশ সাময়িক জ্ঞান হারিয়েছিল। কাউকে সে বলতে পারেনি ঠিক কী ঘটেছিল সে সময়। এমনকি সে সময়কার কোনও ছবিও ওঠেনি। মূলত সেই সময়টার কথাই রাকেশের মুখ থেকে শুনতে আগ্রহী সবাই।
এই সেই উহান শহর যেখানে ২০১৯ সালের শেষাশেষি করোনা ভাইরাস নামে একটি ভাইরাসের উদ্ভব হয়েছিল। তারপর মহামারী রূপে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল সেই ভাইরাস।
হঠাৎ করেই ঠাণ্ডা পড়েছে উহান শহরে। সম্মেলনের দিন সকাল থেকে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা লেগে হাঁচি শুরু হয়েছে রাকেশের। রাকেশকে হাঁচতে দেখে আর দেরি করেনি সংগঠকরা। সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে স্থানান্তরিত হয়েছে সে। উহানে করোনা ভাইরাস আক্রমণের পর থেকে এই শহরে কারও হাঁচি বা কাশি দেখা দিলেই সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তির আইন হয়েছে। ডাক্তার পরীক্ষা করে রাকেশের হাঁচিকে সাধারণ ঠাণ্ডা লেগেছে বলেই রায় দিয়েছেন।
যে মহিলা ডাক্তার রাকেশকে পরীক্ষা করছিলেন তাঁর ডানহাতের কবজিতেও আছে ঠিক রাকেশের হাতের মতো জড়ুল। রাকেশ নিজের অজান্তেই সেই জড়ুলের ওপর নিজের জড়ুল ছুঁইয়ে দিয়েছিল। দু’জনেই হেসে উঠেছিল জড়ুলের ওপর জড়ুলের ছোঁয়ায়।
সারা পৃথিবী থেকে প্রায় পাঁচ হাজার লোক এসেছিল সম্মেলনে যোগ দিতে। সম্মেলনে বক্তৃতা দেবার পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়ে রাকেশ। হঠাৎ করেই প্রবল জ্বর আর হাঁচি শুরু হয় রাকেশের। প্রশ্নোত্তর পর্ব বন্ধ রেখে রাকেশকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধ্য হন সংগঠকরা।
দশদিন পর সুস্থ হলে রাকেশ ফিরে আসে নিজ দেশে।
উহান আবার ছেয়ে গেছে অজানা ভাইরাসের আক্রমণে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে হাঁচি আর জ্বরের প্রকোপ। কোটি কোটি লোক মারা যাচ্ছে অজানা জ্বরে। না, রাকেশের রক্তের নমুনায় পাওয়া যায়নি কোনও অজানা ভাইরাসের খোঁজ।
ছবি:অংশুমান