কেন্নো আর শুঁয়োপোকা
শংকর দেবনাথ
“ও শুঁয়ো, অমন চুপচাপ পড়ে আছিস কেন ভাই? একদম নড়াচড়া করছিস নে আজ!”
“ভালো লাগছে না। সারা গতরে খুব ব্যথা করছে রে।”
“কাল সারাবেলা আমাদের একটু বেশিই ঘোরাঘুরি করা হয়েছে। তাই বোধহয়…”
কেন্নো আর শুঁয়ো। ওরা দুই বন্ধু। গলায় গলায় ভাব ওদের। রাতে একজায়গায় ঘুমোয় দু’জনে। দিনে একসাথে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। খেলা করে। গল্প করে। একজনের কষ্টে আরেকজন ব্যথা পায়।
কাল সারাদিন ঘোরাঘুরির পর সন্ধেয় ওরা ঠাঁই নিয়েছিল একটা ভাঙা ঘরের আবর্জনার মধ্যে। ক্লান্তির ঘুমে সারারাত কখন পার হয়ে গেছে ওরা টেরই পায়নি। সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল কেন্নো। কিন্তু শুঁয়োর কোনও নড়নচড়ন নেই। চুপ মেরে পড়ে আছে মড়ার মতো।
কেন্নো আবার বলে, “কেমন লাগছে রে তো…”
কথাটা শেষ করার আগেই একটা অদ্ভুত শব্দ করে মোচড় খেতে লাগল শুঁয়ো। একবার সোজা হয় তো আবার কুঁকড়ে যায়। একবার চিৎ হয় তো আবার মোচড় খায়।
ভয় পেয়ে গেল কেন্নো। বন্ধুর যন্ত্রণায় সে কিছু না করতে পারার কষ্টে কেঁদেই ফেলল।
হঠাৎ কেন্নো দেখল, শুঁয়ো একেবারে নিথর হয়ে গেছে। মরে গেল নাকি তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু! অজানা আতঙ্কে তার বুকের ভিতরে কেমন করে উঠল। নির্নিমেষ চোখে সে তাকিয়ে রইল বন্ধু শুঁয়োর নিস্পন্দ দেহের দিকে।
সহসা একটা ঝাড়া দিয়ে উঠল শুঁয়ো। আর কেন্নো অবাক হয়ে দেখল, তার লোমশ খোলসের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে কী যেন একটা রঙিন ডানাওয়ালা অদ্ভুত প্রাণী। ভড়কে গেল।
বিচিত্র প্রাণীটি বেরিয়ে এসেই ডানা ঝাপটাতে লাগল। নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল কেন্নো। বন্ধুর এ কী দশা!
“তুই কে রে?” প্রাণীটি কেন্নোকে বলে।
“আমি তোর বন্ধু, শুঁয়ো। কিন্তু তোর এ কী হল ভাই?”
“বন্ধু?” উচ্চেস্বরে হেসে ওঠে প্রাণীটি। “আমি তোর বন্ধু? কী বিশ্রী দেখতে তোকে!”
শুঁয়োর কথায় খুব কষ্ট পেল কেন্নো। “তুই আমাকে ভুলে গেলি, ভাই?”
“মানে? ভোলাভুলির কী আছে? তুই আমার কোনওদিনই বন্ধু ছিলি না। দেখ, আমার কী সুন্দর নকশা করা রঙিন পাখা! আমি উড়তে পারি। তোর মতো একটা কুৎসিত পোকার আমি বন্ধু হতেই পারি না।”
“সব ভুলে গেলি, শুঁয়ো?” বিমর্ষ ধরা গলায় বলল কেন্নো।
“কী শুঁয়ো শুঁয়ো করছিস?” রেগে গিয়ে বলে, “আমি প্রজাপতি। ফুল আমার বন্ধু।”
কেন্নো অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল প্রজাপতির দিকে। সত্যিই তো, সে আর শুঁয়ো নয়। প্রজাপতি। শুঁয়ো তার বন্ধু ছিল। কিন্তু কীভাবে এই পরিবর্তন হল কিছুই বুঝে উঠতে পারল না কেন্নো।
“আমি যাই, ওই ফুল আমাকে ডাকছে।” রঙিন পাখা মেলে উড়ে গেল প্রজাপতি।
কেন্নো বন্ধু হারানোর ব্যথায় কুঁকড়ে গোল হয়ে পড়ে রইল।
অলঙ্করণঃ স্বীকৃতি ব্যানার্জি
জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস