গল্প গলাকাটা সাগরেদ সুব্রত রুজ বসন্ত ২০১৭

golpogolakata-sakred-mediumপ্রত্যেক বছর চব্বিশ আর পঁচিশে ডিসেম্বর আমাদের শহরের  রবীন্দ্রভবনে একটা  ক্লাসিক্যালের প্রোগ্রাম  হয়। প্রোগ্রামটা নেহাত খারাপ হয় না। প্রচুর লোকজন হয়।  কলকাতার কোন বড় শিল্পী আসেন। প্রতিবছর স্যারের ভজন দিয়ে প্রোগ্রাম শুরু হয়। তারপর অন্য শিল্পীদের গান কিম্বা বাজনা শুরু হয়। স্যার ছাড়াও আরও কয়েকজন নামকরা শিল্পী আছেন। ব্রজকিশোর  লাহিড়ি  সেতার  বাজান, সমর্পণ  ঘোষ  স্বরোদ, অভয় চ্যাটার্জি বাঁশি। এছাড়াও সীমন্তিনী ভট্টাচার্য খেয়াল গান, আর শাশ্বতী প্রামাণিক বাজান  গিটার। 

প্রথম দিকটায় উঠতি শিল্পীরা থাকে। তাছাড়া সুনন্দা ঘোষালের  কত্থক , সীমা লখতিয়ার ওড়িশি নাচও হয়। পরের  দিন  স্যার খেয়াল গান। অতিথি শিল্পীর গান অথবা বাজনা দিয়ে আসর শেষ হয়। এবারেও জমাটি হবে। কলকাতা থেকে খেয়াল গাইয়ে বাবা সোহনলাল আসছেন, সঙ্গে তবলায় পণ্ডিত আনন্দগোপাল। উনি আবার স্যারের বন্ধু বিক্রম স্যার, মানে বিক্রমজিতের গুরু। বিক্রম স্যার এখানকার নামকরা তবলচি। উনি ছাড়াও তবলায় স্বপন বসাক আছেন, আর আছেন অনিমেষ ভট্টাচার্য।

স্যার মানে আমার গানের স্যার অনিল মুখোপাধ্যায়। ওঁর কাছে বছরপাঁচেক  হল গান শিখছি। প্রথমে মা’র কাছে হাতেখড়ি হয়েছিল, তারপর মা স্যারের কাছে ভর্তি করে দিয়েছে। আমাদের গানের স্কুলটার নামটা খুব সুন্দর,  “সারস্বত সাধনা” ।

প্রথমদিন স্যারের সাথে আমাকেও স্টেজে  বসতে হবে। স্যার একটা টিম নিয়ে গাইতে ওঠেন। এ’বছর স্যারের সঙ্গে অতনুদা আর মিমিদি বসবে। ওরা স্যারের সঙ্গে গাইবে। বিক্রমস্যার তবলায় থাকবেন , আমি ভজনের সময় মন্দিরা বাজাব। এখন আমার ফোর্থ  ইয়ার  চলছে। সামনের বছর ফিফথ ইয়ারে উঠব। স্যার বলেছেন তখন স্টেজে গাইতে হবে; এখন থেকে স্টেজে না উঠলে নাকি স্টেজ ফ্রি হব না।

 বাস থেকে নামলাম। মা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছে। রোজ এখান থেকে মা-ই আমাকে নিয়ে যায়। মা কে দেখে এগিয়ে গেলাম। মা আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিতে নিতে বলল, “মাস্টারমশাই ফোন করেছিলেন একটু আগে।”

বললাম, “জানি তো। স্যার আগের ক্লাসেই তো বলে দিয়েছেন চারটের মধ্যে ওঁর বাড়িতে চলে যেতে। চারটে থেকে পাঁচটা রিহার্সাল করে একটু রেস্ট  নিয়ে আমরা বেরোব।”

মা বলল, “ঠিক আছে। বাড়ি চ, ড্রেস ট্রেস ছাড়, ভাত টাত খা, তারপর অটো ধরে দুজনে চলে যাব’খন।”         

স্যারের বাড়ির সামনে যখন এসে দাঁড়ালাম তখন প্রায় চারটে বাজে। উঠোন পেরিয়ে হলঘরে, মানে যে ঘরটায় আমাদের ক্লাস হয়, পা দিয়েই আমার চক্ষু চড়কগাছ। স্যার মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। স্বরমণ্ডল পায়ের কাছে গড়াগড়ি যাচ্ছে। অতনু দা স্যারের ডানপাশে যেমন বসে, বসে আছে। হাত গালে। সামনে হারমোনিয়াম। একপাশে তবলায় হাত রেখে  কচু বসে আছে। বাঁদিকটায়  মিমিদি কিম্বা অলকাদি বসে।ওখানটা ফাঁকা, কেবল তানপুরা শুয়ে  আছে। দরজার দিকে পিঠ করে স্যরের মুখোমুখি বিক্রম স্যার বসে। গায়ে চাদর জড়ানো। 

আমি ঘরে ঢুকেছি স্যার খেয়ালই করলেন না। অতনুদা স্যারের দিকে তাকিয়ে ছিল, ও ও দেখেনি। কচু শুধু দেখে মুচকি হাসল। ওকে ইশারায় বললাম, “কী হয়েছে রে?”

কচু স্লিঙে হাত ঝোলাবার  ভঙ্গি করল, তারপর চোখের ইশারায় বিক্রমস্যারকে দেখিয়ে দিল। তার মানে বিক্রমস্যারের হাত ভেঙেছে।

বুঝতে পারলাম আমার চোখগুলো আস্তে  আস্তে গোল  হয়ে যাছে আর চোয়ালটা  নিচের দিকে আপনিই নেমে  যাচ্ছে। সব্বনাশের মাথায় বাড়ি! আর একটু পরেই যে প্রোগ্রাম! বিক্রম স্যার তো কেবল স্যারের সঙ্গেই  বাজাবেন না, সমর্পণ  ঘোষের সঙ্গেও বাজাবেন। অন্যরা যে যার তবলচি নিয়ে আসেন। কিন্তু এই  দুজনের কী হবে? ঘরের হাওয়া দেখে মা-ও হকচকিয়ে  গেছে, “কী হল মাস্টারমশাই?”

মার গলা পেয়ে স্যার মুখ তুললেন, “ও আপনি?  আর বলেন কেন, সব গ্রহ তারা নক্ষত্র একসঙ্গে ঠিক করেছে আমায় আজ ডুবিয়ে ছাড়বে।  এদিকে সকালবেলা খবর এল কাল রাত থেকে মিমির তেড়ে জ্বর এসেছে, কাকে তানপুরায় বসাই সেই চিন্তায় মরছি,  সিনিয়র স্টুডেন্ট বলতে তো আর তেমন কেউ নেই।  তমোনাশ অলকানন্দা ছিল, ওরা দুজনে ছেলেকে নিয়ে অজন্তা ইলোরা দেখতে গেছে। ওদিকে বিজুর অবস্থা দেখুন। আজ সকালে স্কুটার সুদ্ধু পিছলে পড়েছে, নিয়ে হাত ভেঙে বসে আছে। এখন তবলায় কে বসবে?”

মা কার্পেটের ওপরে বসতে বসতে বলল, “তানপুরা  নিয়ে এত ভাবছেন কেন মাস্টারমশাই ? আমি তো আছি। ওদের মত ভাল করে আপনার সঙ্গে গলা দিতে পারব না ঠিকই, কিন্তু  তানপুরাটা তো আমি ধরে দিতে পারব।”   স্যার পুরো এক মিনিট মার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর  আস্তে আস্তে বললেন, “তানপুরাটা ধরে দেবেন বলছেন?”

 মা বলল, “দেব, ধরে দেব। আপনি তানপুরা নিয়ে টেনশন করবেন না। তবলার ব্যাপারটা ভাবুন। আচ্ছা মাস্টারমশাই বিক্রমবাবু নয় বাজাতে পারবেন না; ওঁর ওই ছাত্র আছে তো, ওই যে কী নাম যেন,মেঘ না কী?”

“মেঘ শ্রাবণ? সে থাকলে তো বখেড়া মিটেই যেত। সে তো নেই। কোম্পানির কাজে বম্বে গেছে। বলছি না আজ শনি মঙ্গল রাহু কেতু  সবাই মিলে পিছনে পড়েছে! ” 

মা এবার হেসে ফেলল, “বেশ। কেউ নেই আপনার মেয়ে  তো আছে। ও তো বাড়িতে আপনার সাথে  বাজায়, স্টেজে পারবে না? “

স্যার কচুর দিকে তাকিয়ে  বললেন, ”সেটাই ভাবছি।”

কচু স্যারের একমাত্র মেয়ে। ওর ভাল নাম কস্তুরী।  ও জন্ম থেকেই ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব। মেশিন ছাড়া কানে শুনতে পায় না, কথাও বলতে পারে না। স্যারের  কাছেই শুনেছি ও তখন এই এতটুকু, স্যার  ওকে নিয়ে  ভেলোরে  গেছিলেন। দুই কানে কীসব অপারেশন হয়েছে, তারপর ডাক্তাররা মেশিন লাগিয়ে দিয়েছেন। এখন কানে শুনতে পায়, কিন্তু কথা প্রায় বলতেই পারেনা। দু একটা লাইন  যা বলে সে  এমন জড়ানো, স্যার আর কাকিমা  ছাড়া কারও বোঝবার  ক্ষমতা নেই।  আমাদের সঙ্গে ইশারায় কথা বলে।

কথা না বলতে পারলে কী হয়, কচুর তবলার হাত একদম ফাটাফাটি। মিমিদি একদিন ওর তবলা শেখার গল্প বলেছিল।  কচু তখন  ছোট । ওদের ক্লাস চলার সময় একপাশে চুপটি করে বসে শুনত, আর পায়ে তাল দিত। তাই দেখে ওর যখন পাঁচ বছর বয়েস, বিক্রমস্যার ওকে একটু একটু করে তবলা শেখাতে শুরু করেন। এই বছরসাতেকের মধ্যে কচু ভাল বাজাতে শিখে গেছে। ও আর আমি  একসঙ্গেই আরম্ভ করেছি। আমিও পাঁচ বছরে হারমোনিয়াম ধরেছি।  দু বছর পরে যখন স্যারের কাছে আসি, কচু আমাদের সঙ্গে বসত। আমরা তখন সবে তবলার সাথে  গাইতে শিখেছি। আমরা গাইতাম, ও ঠেকা দিত। এখন তো অতনুদা, মিমিদিদের ব্যাচে বাজায়। শুনেছি স্যার যখন রেয়াজ করেন বিক্রম স্যার এক আধদিন না এলে কচু দিব্যি চালিয়ে দেয়।

 তবে স্টেজে ও তো তেমন ভাবে বাজায়নি। স্টেজে যে ক’বার উঠেছে  সে’সব স্কুলের  ফাংশনে। হঠাৎ করে ওকে এত বড়ো জায়গায় স্টেজে তুলতে স্যার যে ভরসা পাবেন না সেটা তো আমিই বুঝতে পারছি।

কিন্তু কচুকেই বা স্টেজে তোলার দরকার কী? এত বড় প্রোগ্রাম হচ্ছে, আমাদের শহরের তো প্রায়  সব ক’জন  নামকরা তবলচি  থাকবেন। অন্য কেউও তো স্যারের সঙ্গে বাজিয়ে দিতে পারেন!

আমার মনের কথাটাই মা বলে দিল, “আচ্ছা মাস্টারমশাই, আরও তো তবলচি থাকবে। শুনলাম অনিমেষবাবু আসবেন, স্বপন বসাক থাকবেন। ওঁরাও তো কেউ আপনার সঙ্গে বসতে পারেন।”

স্যার কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “কাল তখন তো প্রব্লেম নেই। বাবুদার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে, উনি খেয়ালের সময় আমার সঙ্গে বসবেন। প্রব্লেম তো ভজনের বেলায়। ছটায় প্রোগ্রাম আরম্ভ হবে। উদ্বোধন  বক্তৃতা এইসব হয়ে আমার বসতে বসতে  সাতটা ধরুন। বাবুদা আজকে শাশ্বতীর সঙ্গে বাজাবেন। ওঁদের  টাইম  নটায়। সাড়ে আটটার  আগে কেউ ঢুকবে না। রিহার্সাল টিহারসালের ব্যাপার আছে তো। “

বিক্রমস্যার বললেন, “কথাটা সেটা নয়। কেউ যদি নাও থাকত, গুরুজিই তো বসতে পারতেন। কচুই বসুক আজ। বড় আসরে আজ নয় কাল তো বসতেই হবে। আর রানা,  তুই এত টেনশন করছিস কেন বল তো? ভজন তো সোজা গান। ঠেকা ধরে থাকবে, মুখে এসে ছোট ছোট কাজ করবে। ওটুকু কচু পারবে। ওর ওপর ভরসা না থাকলে আমি গুরুজির সামনে ওকে বসাতাম? আমাদেরও তো মান সম্মানের  ব্যাপার আছে।”

স্যার একটা নিশ্বাস ফেললেন , “ বেশ, রিহার্সালটা তো করে নিই । রেডি হও সবাই।ঐশী, মন্দিরা নাও । “

মা উঠে গিয়ে স্যারের বাঁদিকে বসে তানপুরা ধরল। আমি হাতে মন্দিরা তুলে নিলাম।  স্যার স্বরমণ্ডলে একটা টান দিয়ে গান ধরলেন ‘ওঁ নম: ভগবতে বাসুদেবায়’।

আমরা যখন রবীন্দ্র ভবনে ঢুকলাম তখন ছটা বেজে গেছে। গ্রিনরুমে হারমোনিয়াম তবলা রেখে আমরা  হলে গিয়ে বসলাম। একটু পরেই প্রোগ্রাম শুরু হল। আজকের প্রোগ্রামটা এই রকম : প্রথমে উদ্বোধন, বক্তৃতা, তারপর স্যারের ভজন। তারপর সীমা ম্যাডামের ওড়িশি, তারপর তথাগত বর্মণ বলে সমর্পণ ঘোষের একজন স্টুডেন্টের সরোদ। তারপর শাশ্বতী প্রামাণিকের গিটার, শেষে পণ্ডিত আনন্দগোপালের তবলা লহরা।

প্রথমে পণ্ডিতজি, আর  মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান  প্রদীপ  জ্বালিয়ে উদ্বোধন করলেন। তারপর ভাষণ শুরু হলে আমরা ভেতরে চলে এলাম। স্যার  আর অতনুদা তানপুরা হারমোনিয়াম মেলাতে শুরু করলেন। পন্ডিতজিকে আগে টিভিতে কিম্বা দূর থেকে স্টেজে দেখেছি। আজ সামনাসামনি দেখলাম। প্রোগ্রাম শুরুর আগে বিক্রম স্যার ওঁকে গ্রিনরুমে নিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমরা ওঁকে প্রণাম করলাম। টি ভিতে দেখেছি কেমন গম্ভীর গম্ভীর মুখ করে বাজান। আসলে কিন্তু বেশ হাসিখুশি।

শুনতে পাচ্ছি স্টেজের চেয়ার টেবিল সরান হচ্ছে। এবার আমাদের বসার পালা। মা চট করে আমার আর কচুর চুল টুল ঠিক করে  ফেস পাউডার  আর লিপস্টিকটা আর একবার বুলিয়ে দিল।

পাঁচ  মিনিট পরেই একজন ভলান্টিয়ার উঁকি মারল , “ রানাদা রেডি? “

স্যার বললেন , “রেডি।”

“ তাহলে হারমোনিয়াম তবলা স্টেজে লাগিয়ে দিচ্ছি । কইরে আয় তোরা, এগুলো স্টেজে তোল। “

প্রথমে স্যার, পিছন পিছন আমরা গিয়ে স্টেজে গোল হয়ে বসলাম। স্টেজে এখন পরদা ফেলা। মাঝে স্যার বসলেন, ওঁর  বাঁদিকে মা, মার পাশে কচু। ডান পাশে  অতনু দা তার পাশে আমি।

অতনুদা মাইক সেট করতে শুরু করল। তার মাঝেই ফিসফিস করে বলা হয়ে গেল, “দুই ধারে দুই কলাগাছ।”

আমি ইশারায় কচুকে কথাটা রিলে করলাম। মা একবার কটমট করে আমার দিকে তাকাল।

পরদা উঠল। স্যার অডিয়েন্সকে প্রণাম করে ‘ভগবতে বাসুদেবায়’ শুরু করলেন। সোজা গান। কচু সুন্দর উতরে দিল। মাঝে একটা কাজ করতে হাততালিও পড়ল। বিক্রম স্যার ফার্স্ট রোতে পণ্ডিতজির পাশে বসেছিলেন। উনি হাত নাড়লেন।

তারপর ‘ ঠুমক চলত রামচন্দ্র’ তারপর ‘প্রভুজি তুম চন্দন হাম পানি ‘। স্যার  ব্যাপক ভজন করেন। যাকে বলে একবারে মনপ্রাণ ঢেলে। আজও গাইলেন। প্রচুর হাততালি পড়ল। নমস্কার করে স্যার উঠতে যাবেন, হইহই শুরু হল, “ রং দে চুনরিয়া, রং দে চুনরিয়া”। ভজনে স্যারের সেরা হল ‘ রং দে চুনরিয়া ‘। কিন্তু গানটা একটু শক্ত। কটা ভাঙা মাত্রার কাজ আছে। তবলায় কচু বসেছে বলে স্যার আজ বাদ দিয়েছেন।

হইচই শুরু হতেই স্যারের মুখ শুকিয়ে গেল। মাইক বাঁচিয়ে বললেন, “ এই রে।”     

কচুর কিন্তু হেলদোল নেই। পাশ থেকে হাতুড়িটা তুলে নিয়ে বাঁয়াটা একবার ভাল করে ঠুকে নিল। স্যার ওর দিকে তাকিয়ে বোধহয় সাহস পেলেন। একটু হেসে সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে স্বরমণ্ডলে টান দিলেন।

দুটো চরণ গাওয়া হয়ে গেল। স্যার গানের মধ্যে একবারে ডুবে গেছেন। চোখ বুজে গাইছেন  ‘বিনা রঙ্গায়ে ম্যায় তো ঘর নাহি জাউঙ্গি ‘। হারমোনিয়ামে অতনুদার আঙুল খেলে বেড়াচ্ছে।  হল গমগম করছে।  অডিয়েন্স যেন নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে গেছে। ।

ওদিকে আমারও দম বন্ধ হয়ে আসছে। এর পরই সেই শক্ত জায়গাটা। একটা সরগম করে তারপর সম আসবে। এইখানটার মাত্রার ক্যালকুলেশনটা খুব টাফ। অতনুদারা এতদিন ধরে শিখছে, ওরাও দেখেছি এই জায়গাটা হাতে কিম্বা পায়ে তাল রেখে গায়।

স্যার সারগম করছেন। কচু স্রেফ ঠেকা ধরে আছে। আমার বুক ধড়াস ধড়াস করছে। সমটা কচু যদি না ধরতে পারে?

 স্যার যেই সমে পড়বেন, কচু আচমকা চাবুকের মত একটা তেহাই দিল। তারপর স্যারের সঙ্গে সমে পড়ল। হাততালির ঝড় বয়ে গেল। বিক্রমস্যার দেখলাম একবারে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। 

গান শেষ হয়ে পরদা পড়তে আমরা উঠে পড়লাম। এত ঠাণ্ডাতেও কচুর কপালে ঘাম বিনবিন করছে। গ্রিনরুমে ঢুকে মা ব্যাগ থেকে টিসু পেপার বার করে ওর কপালে গালে বোলাতে লাগল।

বিক্রমস্যার হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন, “ এই কচু, রানা, আয়। গুরুজি ডাকছেন।”

ওঁর সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই গেলাম। কচু গিয়েই প্রথমে পণ্ডিতজি, তারপর স্যার আর বিক্রমস্যারকে প্রণাম করল। পণ্ডিতজি ওর  গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, “সাবাস বেটি। খুব সুন্দর বাজিয়েছ। শেখ, মন দিয়ে শেখ। তুমি আমাদের ঘরের নাম রাখতে পারবে। “

          স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বেটির আমার বুদ্ধি আছে। কে বলবে ওর সবে ফোর্থ  ইয়ার। পাকা বাজিয়ের মত এমন লাগসই করে ঠেকার ওপর তেহাইটা ফিট করে দিল, পাবলিককে বুঝতেই দিলনা ও আজ প্রথমদিন বড় আসরে বসেছে। চমৎকার। ও অনেক ওপরে যাবে অনিল।”

 স্যার ধরা গলায় বললেন, “ আপনাদের আশীর্বাদ।”

বিক্রমস্যার বললেন, “কচু কথা বলতে পারে না বলে মেয়ের নামে কত কী বলেছে রানা। কচু, গলাকাটা সাগরেদ,আরও কত কী। আজ কি বলবি?”

স্যার দু কানে হাত দিলেন, “আমি মাপ চাইছি।”

পণ্ডিতজি হাসছেন, কিন্তু কেমন ধমকে বললেন, “তোমার মাপ চাওয়াই উচিত। একটা মাত্র মেয়ে, তার নাম রেখেছ কচু। ছ্যা ছ্যা, আর নাম পাওনি?  তার মানে তুমি ধরেই নিলে ও যখন কথা বলতে  পারবে না,তখন আর অন্য কিছু ওকে দিয়ে হবে না। হোয়াই সো? কলাশ্রীকে দেখনি তুমি? একটা পা নেই, তাতে নকল পা লাগিয়ে নাচছে। তোমার মেয়েই বা পারবে না কেন? ওকে ওই নামে কেউ ডাকবে না। দিস ইজ মাই অর্ডার।” 

ইতিমধ্যে আশপাশে আরও লোকজন জড়ো হয়েছে। স্যারের বকা খাওয়া দেখে সবাই হাসছে। স্যারও  হাসছেন। ডানহাত কচুর কাঁধে। চোখে  জল। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে পাঞ্জাবি ভিজিয়ে দিয়েছে।

ছবিঃ শিমুল

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s