সৌমেন শেখর
সে অনেককাল আগের কথা। সুদূর চিনদেশে তখন জিজং রাজার রাজত্ব চলছে। জিজং খুব দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা ছিলেন। তার আমলে বাঘে আর গরুতে এক ঘাটে জল খেত। সে যাই হোক, সেই রাজার এক সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে ছিল। নাম তার মিয়াং। জন্মের সময়ই মিয়াং তার মাকে হারায়। মা মরা মেয়ে দেখতে দেখতে রাজার চোখের মণি হয়ে উঠল। রাজা কখনও তার মেয়েকে চোখের আড়াল হতে দেন না। রাজকার্যের শত ব্যস্ততার মধ্যে মেয়ের খেয়াল রাখেন। কিন্তু রাজকন্যা মিয়াং যখন বড়ো হল, সে তার বাবার কাছে বায়না ধরল সে দেশ ঘুরতে বেরোবে। রাজা পড়লেন মহাবিপদে। কিন্তু আদরের মেয়ের কথা আর ফেলেন কী করে? তাই অনেক সিপাহি, লস্কর, দাস আর দাসী সঙ্গে দিয়ে রাজা মেয়েকে পাঠালেন দেশভ্রমণে।
সারাদেশ ঘুরতে ঘুরতে রাজকন্যা এসে পৌঁছাল এক ছবির মতন সুন্দর পাহাড়ঘেরা গ্রামে। গ্রামের নাম তিংশন। সেই গ্রামে বাস করত এক বিখ্যাত চিত্রকর, উনঝাও। সে এক অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী ছিল। তার হাতের ছোঁয়ায় ছবি যেন জীবন্ত হয়ে উঠত। দর্শকের মনে হত এক্ষুনি যেন সব পাখি, প্রজাপতি, গাছগাছালি, ঝরনা, বাড়িঘর, মানুষজন সব জীবন্ত হয়ে উঠবে এক অদৃশ্য জাদুবলে। তো সেই গ্রামে থাকার সময় রাজকন্যের কানে এসে পৌঁছাল চিত্রকরের আশ্চর্য ক্ষমতার কথা। রাজকন্যা ঠিক করলেন, তিনি এইসব নিজের চোখে দেখবেন। কেননা, অনেকসময়ই এইসব গল্পের বেশিরভাগটাই মিথ্যে হয়। মানুষের মুখে ফিরতে ফিরতে এইসব কাহিনির ভেতর আর সত্যি বলে কিছুই থাকে না।
তাই যেমন কথা তেমনি কাজ। একদিন সুন্দর সকালে মাত্র দু’জন দেহরক্ষী নিয়ে রাজকন্যা বেরিয়ে পড়লেন চিত্রকরের কুটিরের উদ্দেশ্যে। পাহাড়ঘেরা বনের একপ্রান্তে এক অপূর্ব পাহাড়ি ঝরনার পাশে ছায়াঘেরা চিত্রকরের কুটির। কুটিরের কাছে পৌঁছে রাজকন্যা তার দেহরক্ষীদের নির্দেশ দিলেন বনের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে। তিনি যতক্ষণ না ডাকেন ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ যেন কুটিরের ভেতর না ঢোকে। দেহরক্ষীরা ‘যথা আজ্ঞা’ বলে গাছের আড়ালে মিলিয়ে যাওয়ার পর রাজকন্যা একাই এগিয়ে চললেন কুটিরের উদ্দেশ্যে। গুটি গুটি পায়ে কুটিরের ভেতর প্রবেশ করে দেখলেন, এক বলিষ্ঠ রূপবান যুবক খোলা জানালার সামনে বসে একমনে তুলির আঁচড় কেটে চলেছে সামনে রাখা ক্যানভাসের ওপর। বিস্ময়াহত রাজকন্যা অপলক চেয়ে দেখলেন, এক অপার্থিব আলো এসে পড়েছে যুবকের মুখের উপর। মাঝে মাঝে হাওয়ায় তার লম্বা কালো চুল উড়ে এসে পড়ছে তার প্রশস্ত কপালের উপর আর তার তুলির ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠছে সাদা ক্যানভাসের পাতা। তারপর হঠাৎ সে যুবক ফিরে তাকাল রাজকন্যার দিকে। চোখে চোখ পড়ল দু’জনের। সময় থেমে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। দূরে কোথাও এক অচেনা পাখি ডেকে উঠল সুরেলা কন্ঠে। তারপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দু’জনেই বুঝতে পারলেন যে তারা একে অপরের প্রেমে পড়েছেন।
তারপর আস্তে আস্তে পরিচয় হল তাদের। রাজকন্যা জানালেন চিত্রকরের ছবির প্রতি তার মুগ্ধতার কথা, আর চিত্রকার জানালেন রাজকন্যার প্রতি তার অনুভূতির কথা। তারপর কথায়, গল্পে কেটে গেল সারাটা দিন। দিনের শেষে রাজকন্যা ফিরে এলেন তার নিজের আস্তানায়। কিন্তু ফেরার আগে জানিয়ে এলেন তিনি আবার আসবেন কাল সকালে।
পরদিন সকালে রাজকন্যা আবার ফিরে এলেন চিত্রকরের কাছে। গল্পে, ছবিতে দু’জনের দিন কাটতে লাগল মহা আনন্দে। ইতিমধ্যে একে অপরকে মনের কথা জানানো হয়ে গেছে। দু’জনেই দু’জনের প্রেমে বিভোর। এরকমভাবে কেটে গেল আরও কিছুদিন।
কিন্তু সুখের সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়। রাজকন্যার ডাক পড়ল রাজপ্রাসাদে ফিরে যাওয়ার জন্য। চোখের জলে তিনি বিদায় নিলেন চিত্রকরের কাছে। কথা দিলেন, প্রাসাদে ফিরে গিয়ে তিনি তার বাবাকে রাজী করিয়ে আবার ফিরে আসবেন চিত্রকরের কাছে। বিবাহ-প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু মানুষ যা ভাবে ঠিক তার উলটোটাই হয়। রাজা এই প্রস্তাবে কিছুতেই রাজী হলেন না। তিনি রাজকন্যার সব আবদার মেনে নেবেন, কিন্তু এটা নয়। তাঁর রাজবংশের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় এমন কাজ কখনওই হতে দিতে পারেন না। কিন্তু রাজকন্যা এদিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না এই বিচ্ছেদ। অনাহারে, অনিদ্রায় ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছেন তিনি। একদিন রাজকন্যা সত্যি-সত্যিই অসুখে পড়লেন। রাজা পড়লেন মহাবিপদে। ডেকে পাঠালেন রাজমন্ত্রীকে। শলাপরামর্শ চলল সারাদিন ধরে।
মন্ত্রীমহাশয় রাজাকে বললেন, “এরকম অবস্থায় যদি ওই চিত্রকরকে নির্বাসন বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। এমনকি রাজকন্যার প্রাণসংশয় হতে পারে।”
রাজা জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে উপায়?”
মন্ত্রী বললেন, “চিন্তা করবেন না, মহারাজ। আমার মাথায় এক জব্বর বুদ্ধি এসেছে। আপনি রাজকন্যার কথায় রাজী হয়ে যান। ডেকে পাঠান সেই চিত্রকরকে, আর বিবাহের আয়োজন শুরু করুন।”
“এসব কী বলছেন, মন্ত্রীমশাই!”
“আমি ঠিকই বলছি, মহারাজ। ধৈর্য ধরে বাকিটা শুনুন।”
“বলুন তাহলে।”
“বিবাহের আয়োজন যখন সম্পূর্ণ হয়ে যাবে, তারপর বিবাহের ঠিক আগের দিন রাতে চিত্রকর নিহত হবে গুপ্ত ঘাতকের হাতে। পরদিন সকালে আমরা রটিয়ে দেব যে চিত্রকর ছিল লোভী তাই সোনাদানা সব চুরি করে পালিয়েছে রাতের অন্ধকারে। আর এদিকে রাজকন্যার সেটা বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।”
রাজা এই পরিকল্পনা শুনে মন্ত্রীর প্রশংসা না করে পারলেন না। বললেন, “তাহলে আর কী, ঘোড়া সাজিয়ে লোক পাঠান চিত্রকরকে আনার জন্য আর রাজকন্যাকে খবর দিন যে আমি তার প্রস্তাবে সম্মত হয়েছি।”
পরদিন সকালে ঘোড়া সাজিয়ে একদল চাকর আর সিপাহি বেরিয়ে পড়ল চিত্রকরের কুটিরের উদ্দেশ্যে। আর এদিকে রাজকন্যে তো আনন্দে আত্মহারা এই খবর শুনে। কিন্তু তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলেন না কী কুটিল ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে এই খুশির আড়ালে।
দুইদিন পর চিত্রকর এসে পৌঁছালেন রাজার প্রাসাদে। রাজা সাড়ম্বরে বরণ করলেন চিত্রকরকে। আসল ভাব গোপন করে রাখলেন মনের গভীরে যাতে চিত্রকরের মনে কোনও সন্ধেহের উদ্রেক না ঘটে। এদিকে রাজকন্যার আনন্দের আর কোনও সীমা পরিসীমা রইল না। তার সারাদিনই কাটতে লাগল চিত্রকরের সাথে গল্প করে। এদিকে পুরোহিত এলেন। গণনা করলেন। বিয়ের দিন ঠিক হল এক পক্ষকাল পরে পূর্ণিমার দিন। রাজা মনে মনে ভাবলেন, আর মাত্র ক’টা দিন, তারপর সব ঝামেলা শেষ।
এদিকে চিত্রকরের কেমন যেন সন্দেহ হতে শুরু করল। রাজার মেয়ের বিয়ে বলে কথা অথচ সবাই কেমন যেন সন্ত্রস্ত, সাবধানী। তেমন কোনও উচ্ছ্বাস নেই কারুর মধ্যে রাজকন্যে ছাড়া। রাজকন্যেকে ডেকে উনঝাও জেনে নিলেন ঠিক কী ঘটেছিল তাদের এই বিবাহ স্থির হওয়ার আগে। সব ঘটনা শোনার পর উনঝাও বুঝতে পারলেন, মৃত্যুদণ্ডই ধার্য হয়েছে তার জন্য। কিন্তু রাজকন্যাকে কিছুই বললেন না। চিত্রকর সারাদিন বসে ভাবতে লাগলেন কীভাবে এই অনিবার্য মৃত্যুকে ঠেকানো যায়, কীভাবে এই হিংস্র রাজদণ্ডের হাত থেকে বাঁচানো যায় তাদের এই পবিত্র ভালোবাসা। উনঝাও ভাবতে লাগলেন, ভাবতেই থাকলেন।
পরদিন সকালে মহারাজের সঙ্গে দেখা করে উনঝাও বললেন, “মহারাজ, এখনও তো বিয়ের প্রায় দশদিন বাকি, আর আমার তো আর তেমন কোনও কাজ নেই, তাই আমি আপনার প্রাসাদের যে বিশাল বড়ো জলসাঘর আছে তার দেওয়ালে একটি ছবি আঁকতে চাই।”
রাজা বললেন, “তা আঁকো, কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু কীসের ছবি আঁকবে?”
চিত্রকর বললেন, “মহারাজ, আমি অনেকদিন হল আমার বাড়ি ছেড়ে এসেছি। আমার গ্রাম ছেড়ে এসেছি। তাই আমার গ্রামের কথা খুব মনে পড়ছে। আমি আমার গ্রামের ছবি আঁকব। কিন্তু মহারাজ, আমার একটি শর্ত আছে।”
“কী শর্ত, বলো।”
“যতদিন না পর্যন্ত আমার ছবি সম্পূর্ণ হয় ততদিন পর্যন্ত কেউই এমনকি আপনিও এই ছবি দেখার অধিকার পাবেন না।”
রাজা বললেন, “ঠিক আছে, তাই হবে।”
অতঃপর চিত্রকর ছবি আঁকতে শুরু করলেন। এটাই হয়তো তার শেষ ছবি। দিনরাত এক করে চিত্রকর জলসাঘরের দেওয়ালে ফুটিয়ে তুলতে লাগলেন নদী, পাহাড়, পাখি, গাছ আর পাহাড়ি পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষজন। চিত্রকরের মাথায় তখন ছবি আর হৃদয়ে রাজকন্যে আর তার অমলিন ভালোবাসা।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন উপস্থিত হল। চিত্রকরের ছবিও শেষ। সন্ধেবেলায় চিত্রকর মহারাজকে আমন্ত্রণ জানালেন তার আঁকা ছবি দেখার জন্য আর বললেন রাজকন্যাও যেন সঙ্গে থাকে। বিশাল হলঘরের মধ্যে জ্বলে উঠল ঝাড়বাতি, আর সেই আলোয় রাজা দেখলেন দেওয়াল আর দেওয়াল নেই। তার বদলে ফুটে উঠেছে এক আশ্চর্য পাহাড়ঘেরা মনোরম গ্রাম। পাখি উড়ছে দিগন্তরেখায়। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে শান্ত ঝরনা স্নিগ্ধ ধারায়। পাহাড়ি পথ বেয়ে নেমে আসছে কয়েকজন চাষি জোয়াল কাঁধে। এক অনাবিল শান্তি ছড়িয়ে পড়ছে শিরায় শিরায়।
চিত্রকর বললেন, “বলুন মহারাজ, কী দেখতে পাচ্ছেন?”
মহারাজ বললেন, “গ্রাম, পাহাড়, নদী, ঝর্না আর মানুষ।”
চিত্রকর মুচকি হেসে বললেন, “কোনও গুহা দেখতে পাচ্ছেন না?”
মহারাজ অবাক হয়ে বললেন, “না! কোথায় গুহা?”
চিত্রকর বললেন, “এই দেখুন।”
বলেই চিত্রকর ছবির সাথে মিশে থাকা এক পর্দা খুলে ফেললেন। বিষ্ময়াবিষ্ট রাজার চোখের সামনে বেরিয়ে এল এক বন্ধ মুখ গুহা। তারপর চিত্রকরের মৃদু ছোঁয়ায় খুলে গেল গুহার বন্ধ দরজা। রাজা দেখলেন, এক অপূর্ব মায়াবী আলোয় ভরে আছে গুহার ভেতর। সে এক এমন আলো যার থেকে সহজে চোখ ফেরানো যায় না। রাজা ঘোর লাগা চোখে চেয়ে রইলেন গুহার দিকে।
চিত্রকর হেসে বললেন, “চলুন মহারাজ, গুহার ভেতরে যাওয়া যাক। আসুন, আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাই।”
তারপর চিত্রকর হাত বাড়ালেন রাজকন্যার দিকে। রাজকন্যাও মৃদু পায়ে এগিয়ে এসে চিত্রকরের হাত ধরলেন। দু’জনে এগিয়ে চললেন গুহা-মুখের দিকে, পেছনে মোহাবিষ্ট রাজা। চিত্রকর আর রাজকন্যা ঢুকলেন গুহার ভেতর আর চোখের পলকে বন্ধ হয়ে গেল গুহার দরজা। রাজা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ঘরের ভেতর। অবাক হওয়ার পালা তখনও শেষ হয়নি। তার চোখের সামনেই আস্তে আস্তে অদৃশ্য হতে লাগল পুরো ছবিটা। শেষপর্যন্ত মিলিয়ে গেল শূন্যে। রাজা দেখলেন, সাদা দেওয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই তার সামনে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তিনি চেঁচিয়ে ডাকলেন সবাইকে। ছুটে এল সান্ত্রী-মন্ত্রী সব। সারারাত ধরে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল সারা রাজপ্রাসাদ। কিন্তু কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না চিত্রকর উনঝাও ও রাজকন্যা মিয়াংয়ের। তারা যেন চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে ভালোবাসার পবিত্র গুহায় যেখানে কোনও রাজদণ্ড পৌঁছায় না তার দণ্ডাজ্ঞা নিয়ে। তারপর সেই কোন এক অজানা দেশে উনঝাও আর মিয়াং সুখে বাস করতে লাগল সারাজীবন। কোন সে দেশ? কী তার নাম জানো নাকি কেউ?
অলঙ্করণঃ শিমুল