মৃত্যুঞ্জয় দেবনাথের আগের গল্প–ঝোলাগুড়ের হাঁড়ি, ঝিনুকনদীর চর
ছানাভূত
মৃত্যুঞ্জয় দেবনাথ
ভূতটা পিছু নিয়েছে আমার আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। বুঝতে দিইনি যদিও। গুনগুন গান গাইতে গাইতে ঠিকঠাক পথ হাঁটছিলাম। কখনও ডাইনে, কখনও বাঁয়ে, কখনও পুবদিকের গলিপথে, কখনও বা পশ্চিমের বাঁশপাতা জমে স্তূপীকৃত হওয়া এবড়ো-খেবড়ো পথে। কিন্তু ঘোষপুকুরের সজিনাগাছটার নিচে এসে দাঁড়াতেই ও আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
“কে?” আমি চমকে ওঠার ভান করে বললাম।
“আমি জগা।” ও নাকি সুরে বলল।
“জগা কে?” আমি প্রশ্ন করলাম।
ও দারুণ আহ্লাদিত হয়ে খটখটিয়ে হাসল। “হেঁ হেঁ। আমি ভূত। এখন তোমার ঘাড় মটকাব।”
“অ্যাঁ! ভূত! আমার ঘাড় মটকাবে! বলো কী?”
ও দ্বিগুণ হাসতে লাগল। “হ্যাঁ তো। কেন, সন্দেহ হচ্ছে নাকি?”
“আরে না না। তা কেন?” বলি আমি। “যথেষ্ট বুঝেছি যে তুমি আস্ত ভূত একটি। তবে তুমি ছানাভূত। বয়েস খুবই সামান্য। ঠিক বলছি কি না?”
“তাতে কী? ভূত তো ভূতই। ছোটো হলে সে তো আর অন্য কিছু হয়ে যায় না। যেমন তোমরা। কী ছোটো কী বড়ো, সকলেই মানুষ।”
আমি মাথা নাড়ি। “তা ঠিক। কিন্তু আমি বলছিলাম অন্য কথা ছানাভূত।”
“কী কথা?”
“নাহয় খাবেই আমার কলজে উপড়ে। ঘাড় মটকাবে। তাতে দুঃখ নেই। বয়েস হয়ে গেছে ঢের। তার ওপরে হাঁপের টান ওঠে মাঝে-মধ্যেই। বেঁচে থেকেই বা আর কোন কচুপোড়া হবে। কিন্তু বলছিলাম, একটা গল্প মনে আসছে খুব। শুনবে নাকি? গল্প বলতে আমার বেশ লাগে। মরার আগে শেষ গল্পটি নাহয় তোমাকেই শুনিয়ে যেতাম।”
ভূতছানাটি কিঞ্চিৎ আনমনা হয়ে তাকাল। “এই দ্যাখো, এখানে আবার গল্প-টল্পের ব্যাপার আসছে কোথা থেকে? যদিও গল্প শুনতে আমারও বেশ লাগে। মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবার কালে কত্ত গল্প শুনেছি মা-ঠাকমার কাছে। সেসব মনে পড়লে এখনও মন কেমন করে ওঠে।”
“তবে শোনোই একটি। ক্ষতি কী?”
ভূতছানা কিঞ্চিৎ বিরক্তভরা চাউনি মেলে তাকাল আমার দিকে। বলল, “ধুৎ! আমার যে খিদেয় পেটে ছুঁচো ডন মারছে বাপু। তা কখন খাব কলজেটা তোমার বলো?”
“আরে, খাবে খাবে। এত উতলা হওয়ার কী আছে? আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না! এই যে দিব্যি তোমার সামনেই রয়েছি। এখন একটা গল্প শোনাব, এই মাত্র। গল্প যেই শেষ হবে, অমনি…”
খটখটিয়ে হেসে উঠল ছানাভূত। “বেশ বেশ। তাই হবে। তুমি গল্পটা তাড়াতাড়ি শুরু করো দেখি। খামোখা আর বকর বকর করে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। যাই বলো, কলজে আমার খুব প্রিয়। ইশ! কদ্দিন যে মানুষের কলজে খাইনি।”
“কিন্তু একটি কথা।”
“ওই দ্যাখো। আবার কী কথা?” ছানাভূতের গলায় বিরক্তি।
“আমার বলা গল্পটি যদি ভালো লেগে যায় তোমার, তবে কী হবে?”
“কী হবে আবার? যেমন খাবার কথা ছিল, তেমনই খাব তোমায়।”
“যাচ্চলে, কোনও পুরস্কার দেবে না?”
“কী পুরস্কার?”
“সে তুমি ঠিক করবে। তোমার মন যা চাইবে, তাই দেবে।”
ছানাভূত চিন্তান্বিত তাকাল। “এ তো ভারি মুশকিলে ফেললে হে। কী পুরস্কার দেব তোমায়? এর চেয়ে তুমিই বলো, কী চাই তোমার।”
“আমি যা চাই, দেবে তা, ছানাভূত? ওরা তো দিয়েছিল।”
“ওরা কারা?” ছানাভূত হাঁ করে তাকাল।
“কেন, সেই যে সত্যজিৎ রায়ের ‘ভূতের রাজা দিল বর… এক নম্বর, দুই নম্বর, তিন নম্বর’, সিনেমাটা দ্যাখোনি তুমি?”
“ধ্যাত্তেরি! ছাড়ো ওইসব সিনেমার গুলগপ্পের কথা। সিনেমা কি আর সত্যি কিছু? কক্ষনও না। গল্পের গরু গাছে ওঠে ওখানে। ভেবে দ্যাখো একবার।”
“তা ঠিক। তবুও ভূতের রাজা বলে তো কেউ ছিল! দয়ালুও ছিল সে। ছিল কি না, বলো?”
ছানাভূত চিন্তায় পড়ল আমার কথায় খুব। গালে হাত দিয়ে, চোখ পিটপিট করে কী যেন ভাবল দু’বার। তারপর নরম সুরে বলল, “তা তুমি কী বলতে চাও, সহজ করে বলো দেখি। তোমার গল্পটি শুনতে চেয়ে যে গেরোয় পড়লাম দেখছি।”
আমি এপাশ ওপাশ মাথা ঝাঁকালাম। “আহা ছানাভূত, তা কেন? আমি তো তোমায় ভালো গল্পই শোনাব। সে গল্প শুনে তুমি একেবারে মোহিত হয়ে যাবে, যাকে বলে। তো পুরস্কার জুটবে না তার জন্যে কিছু? কেন, আমাদের এই মনুষ্য সমাজে তো এসবের ঢের ব্যবস্থা-ট্যবস্থা আছে। কত্ত গল্প-টল্প এমন ছেড়ে দেখেছি ফেসবুকে। মিনিটে মিনিটে হাজারখানা লাইক, কমেন্ট। সে কী প্রশংসার ছড়াছড়ি ছানাভূত, তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। তারপর একটি বই বানিয়ে তাকে তেমন জায়গায় পৌঁছ করে দিতে পারলেই সুকুমার-উপেন্দ্রকিশোর-সুনির্মল পুরস্কার!”
“ওহ্, বহুত ভাট বকো হে তুমি!” ছানাভূতটা মেজাজ খাট্টা করে বলল এবং ধড়মড়িয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। “ঝটপট তোমার গল্পটি শোনাবে কি না তাই বলো। নয় এক্ষুনি তোমার কলজেটি উপড়াব, এই বললাম।” বলেই ওর হাড্ডির হাত বাড়াল আমার দিকে ছানাভূত।
সেদিকে তাকিয়ে আমি আঁতকে উঠলাম। কঁকিয়ে উঠে বললাম, “আরে থামো থামো ছানাভূত। অধীর হয়ো না। এক্ষুনি শোনাচ্ছি তোমাকে গল্পটি।” বলেই গল্পটি শুরু করতে চাইলাম। কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগ ঘটল অমনি। মেমরি ডিসকানেক্ট। কিচ্ছু মনে পড়ছে না। একেই বুঝি বলে বিপদকালে বুদ্ধিনাশ।
ছানাভূত ততক্ষণে তিড়িং-বিড়িং লাফাচ্ছে বিরক্ত হয়ে। রাগে রি রি করে জ্বলছে। একবার অস্থির হয়ে বলে উঠল, “ওহে, গল্পটা শুরু করবে, নাকি কলজে ধরে টানটি দেব?”
আমি আঁতকে উঠে বললাম, “আরো রোকো রোকো। মনে এসেছে। বলছি এক্ষুনি। কী যেন গল্পটার নাম। ধুৎ! আবার ভুললাম।” বলে নিরাশ হয়ে মাথা চুলকোতে থাকলাম।
ততই চোখ টাটিয়ে তাকাচ্ছে আমার দিকে ছানাভূত। কী বলব, আমার শরীরে তখন ভূমিকম্পের কাঁপন। তবুও একটি বুদ্ধি এল মাথায়। অমনি লাফিয়ে উঠে বললাম, “আচ্ছা ছানাভূত, তবে একটা ছড়া শোনাই? আমার লেখা। ভালোই ছড়া লিখিয়ে আমি। সবাই তাই বলে। সত্যি বলছি।”
ছানাভূত চুপ। কিছুই বলছে না উত্তরে। আসলে আমার ধানাই-পানাই দেখে একেবারেই মুড অফ ওর।
আমার কাকুতি-মিনতি ভরা বক্তিমে থামালাম না তবুও। “প্লিজ ছানাভূত, একটা অন্তত সুযোগ দাও!”
ছানাভূতটা প্যাঁচা-মুখ করে বলল, “তাই করো ঝটপট। আমার কিন্তু খিদেয়…”
ছানাভূতের কথা শেষ করতে দিলাম না। গড়গড়িয়ে ছড়া পড়া শুরু করলাম একটি। কিন্তু কপাল মন্দ। শেষ করতে পারলাম না। একটি দুটি লাইন বলে তোতলাতে থাকলাম। অগত্যা লাইন বদলানোর কথা ভাবলাম। আবারও কাঁচুমাচু দৃষ্টিতে তাকালাম ছানাভূতটার দিকে। “তবে একটা গানই শোনো ছানাভূত? দেখছ তো, সব কেমন গুবলেট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গানটা আমার গোলায় না কখনও। ভুলি-টুলিও না। বিশ্বাস করো। ওটা আমি মন থেকে গাইতে পারি। শোনাই?”
ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে আমার দিকে ছানাভূত। কিন্তু নিরুত্তর সে। আমার বহুত ত্যাঁদরামি দেখে মেজাজ খাপ্পা হয়ে উঠছে ভেতরে ভেতরে। অথবা বিরক্তি আর বিস্ময়ে কথা হারিয়েছে।
সে যাক গে। আমি গান গাইতে শুরু করলাম। অমনি একটা মিরাক্যাল ঘটে গেল। ছানাভূতের চোখমুখের রুক্ষতা উধাও। পেটে ছুঁচোর ছুটোছুটিও বন্ধ বুঝি বা। ভারি মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে। মুখটি দেখে আমার কেবলই সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার সেই হল্লারাজার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। গুবি-বাঘার গানবাজনা শুনে সেও তো এমনই মুগ্ধ চাউনি মেলে তাকিয়ে ছিল। বশ হয়েছিল। আরও উৎসাহিত হয়ে গানের সুর-লয়-ভলিউম বাড়ালাম আমি। ছানাভূত এবারে মাথা দোলাচ্ছে আমার গানের তালে তালে। আশ্চর্য! চোখ বুজে আসছে ওর। যাকে বলে, গানের জাদুতে ঝিমুনি। মনে মনে বললাম, এই সুযোগ।
তারপর শোনো পাঠক বন্ধুরা, অভূতপূর্ব কাণ্ডটি ঘটল এরপরই।
ছানাভূতটা আমার গানের সুরে তালে মৌজ হয়ে দুলতে দুলতে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ল। আমিও দেরি করলাম না আর। ওকে বাঁশবনে ফেলে তৎক্ষণাৎ চম্পট দিলাম। একছুট্টে ঘরে এসে দরজা আঁটলাম। আমায় আর পায় কে?
ধুৎ! বিশ্বাস করি না এ।
জানি পাঠকবন্ধুরা, তোমরা ঠিক একথাই বলছ এখন মনে মনে। কেননা, ভূত বিশ্বাস করো না কিনা তোমরা এ-যুগের ছেলেছোকরারা। কিন্তু ঘটনাটি যে একশো শতাংশ সত্যি, তা তোমাদের কেমন করে বোঝাই? তবে হ্যাঁ, একটা কথা বলতে পারি তোমাদের।
এক্ষুনি জিজ্ঞাসা করবে নিশ্চয়ই, কী কথা শুনি?
শোনো তবে। ভূতছানাটি সত্য। সত্যিই ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল গতরাতে। আমাদের ঘরের পেছন দিককার রাজেদের বাঁশবাগানে। তা না হলে একজন শ্মশানযাত্রীর আর কে পিছু নেবে বলো, ভূতপ্রেত ছাড়া? গিয়েছিলাম তো হরিপদদাদুর মৃতদেহ নিয়ে পোলেরহাট শ্মশানে। তারপর ফিরতি পথে যে যার বাড়িরে দিকে চলে গেল, আমি এদিকে। বেশ বুঝতে পারছিলাম, অনেকক্ষণ আগেই ও আমার পিছু নিয়েছিল। এত্ত এত্ত সঙ্গী থাকার কারণেই বোবা হয়ে ছিল। আমাদের বাঁশবনের গলিটায় পা রাখতেই স্বমহিমায় হাজির হল ব্যাটা।
জেনে রাখো বন্ধুরা, ভূত কিন্তু আছে। যতই অবিশ্বাস করো, বস্তুটি গুলগপ্প বা উড়োকথা মাত্র নয় মোটেও। কিন্তু ভূতের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার এই একটাই মন্ত্র, যা আমি অ্যাপ্লাই করে দেখালাম।
ও হো, মন্ত্রটা বুঝলে না, তাই তো?
শোনো তবে, মন্ত্রটা অং-বং-চং জাতীয় কিছুই নয়। জাস্ট একটা পলিসি মাত্র। রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে, কোথাও ভূত-টুতের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলেও বিন্দুমাত্র ভয় পাওয়া চলবে না। মনটাকে এতটাই শক্ত রাখবে যে, যেন তোমার একজন মানুষের সঙ্গেই দেখা হয়ে গেল। ধরো দুষ্টু মানুষই। তারপর তেমনই তার সঙ্গে কথাবার্তা বলবে। পারলে ছড়া কাটবে, গল্প করবে, গান শোনাবে। আমি যেমনটি করলাম। যদি তা পারো, ও বশ। দ্যাখো, গান-কবিতা-গল্প ভালোবাসে না এমন জীবও জগতে আছে? কক্ষনও না। যেকোনও প্রাণীর সামনে বসেই একবার ট্রাই করে দেখো।
তাই বলছি, মন দিয়ে শুনে রাখো বন্ধুরা। ভূত যেহেতু আছে, যখন তখন যেকোনও জায়গায় পড়তেই পারো যেহেতু তার খপ্পরে, তখন ঠিক এই কাজটিই করবে। ব্যাপারটা এমন, ধরো পাগলা কুকুরের খপ্পরে পড়েছ। কিন্তু ভয় পেয়ে ছুটলেই মরেছ। সাহস করে ঘুরে দাঁড়াতে যদি পারো, আর ভয় নেই। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, যেই রোগের যে ওষুধ আর কী। ভূতেদের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হবে কেন! সবেরই মূল উৎস একটাই, ভয়। ওইটিকে জয় করো, দ্যাখো, আর কোথাও কিচ্ছু নেই।
নয় তোমরাই বলো, ছানাভূতটা যে যথেষ্ট পাকড়ে ধরেছিল আমায়। পারলে তক্ষুনি কলজেটা উপড়ে কচমচিয়ে খায়। তোমাদের শুভেচ্ছায় ভাগ্যিস ভয় পাইনি, তাই রক্ষা!
ছবি:অংশুমান