গল্প ছায়াকল্প– সূর্যনাথ ভট্টাচার্য বর্ষা ২০২০

ছায়াকল্প

সূর্যনাথ ভট্টাচার্য

ব্যোমকেশ একদৃষ্টে কড়িকাঠের দিকে চাহিয়া ছিল। একটা টিকটিকি সেইখানে অনেকক্ষণ নিথর হইয়া থাকিবার পর অকস্মাৎ তাহাতে প্রাণের লক্ষণ দেখা দিল। তড়িৎ গতিতে ক্ষুদ্রাকৃতি সরীসৃপটি দেওয়াল বাহিয়া আলমারির পিছনে অদৃশ্য হইয়া গেল। ব্যোমকেশও একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া দৃষ্টি নামাইল, চারপাইয়ের উপর দৈনিক কালকেতুখানা যেখানে পড়িয়া ছিল।

কলিকাতার গ্রীষ্মে যাহারা পরিচিত নয়, তাহারা ভাগ্যবান। আমরা তাহাদের দলে পড়ি না। কিন্তু এমনই আমাদের দগ্ধ ললাট, কলিকাতা ছাড়িয়া অন্য কোথাও যাইবার কথাও ভাবিতে পারি না। স্বেদ-শব্দ-দূষণে এই শহর যত অত্যাচার করে, ততই কী জানি কী মোহে তাহাকে আরও বেশি আঁকড়াইয়া ধরি।

বয়স হইয়া ব্যোমকেশ রহস্য সন্ধানে আর তেমন মাথা ঘামায় না, সত্যান্বেষণ প্রায় ছাড়িয়া অলস জীবনযাপন করিতেছে। আমি কোনোদিনই করিৎকর্মা ছিলাম না, ব্যোমকেশের কীর্তি প্রচার করিয়া এতকাল দিব্য চলিয়া গিয়াছে। এখন তাহা বন্ধ হওয়াতে আমারও কোনও কাজকর্ম নাই। ব্যোমকেশের পুত্র বাহিরেই থাকে। বর্তমানে সত্যবতীও পাটনা গিয়াছে, তাহার দাদা সুকুমারের দৌহিত্রের অন্নপ্রাশনে। আমাদের এখন তাই অখণ্ড অবসর। বইয়ের ব্যবসায়ে আমদানি মন্দ হইতে ছিল না, সুতরাং অন্নবস্ত্রের চিন্তা বিশেষ ছিল না। কড়িকাঠ গোনা ও দৈনিক কালকেতুর সপিণ্ডকরণই এখন আমাদের প্রধান অবসর বিনোদনে পরিণত হইয়াছিল।

মাথার উপর পাখা ঘুরিতেছিল ও তাহার নিচে আমরা দুই নিষ্কর্মা বসিয়া গলদঘর্ম হইতেছিলাম। মনে পড়িতেছে, এইরকমই এক নিরালা নিদাঘে ‘চিড়িয়াখানা’ রহস্য আমাদের নিকট আসিয়া হাজির হইয়াছিল। বর্তমানে অবশ্য আর সেরকম কোনও সম্ভাবনা ছিল না। পুরাতন স্মৃতির চর্বিতচর্বণে কিছু সময় কাটানো যাক ভাবিয়া মুখ খুলিতে যাইতেছিলাম, হঠাৎ ব্যোমকেশ বলিল, “তোমার মনে পড়ে অজিত, মুঙ্গেরে আমাদের সেই দিনগুলোর কথা?”

ব্যোমকেশেরও দশা দেখা যাইতেছে আমারই মতো। বহুদিন হইল আমরা উত্তর বিহারের শহরটিতে বারকয়েক গিয়াছিলাম। একবার অসুস্থ ব্যোমকেশের স্বাস্থ্যোদ্ধার নিমিত্ত, যখন ‘চিত্রচোর’ কাণ্ডে তাহাকে জড়িত হইতে হইয়াছিল। আর একবার ‘বহ্নি-পতঙ্গ’ ঘটনার সূত্রে। আরও একবার ভূতান্বেষী বরদাবাবুর সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হইয়াছিল ঐ মুঙ্গের শহরেই। সেই অধ্যাপক সোম, মালতীদেবী, রজনী, অশ্বিনী ডাক্তার, দীপনারায়ণ, পাণ্ডেজী, বরদা, অমূল্য… কত বিচিত্র চরিত্র, কত রোমাঞ্চকর স্মৃতি! কালের ব্যবধানে তাহাতে যুক্ত হইয়াছে এক স্মৃতিমেদুর বিচ্ছেদ ব্যঞ্জনা, সেসব কথা কি ভুলিবার? বলিলাম, “কেন হে, হঠাৎ মুঙ্গেরে গিয়ে পড়লে কেন?”

“আজ কালকেতু জানিয়েছে মুঙ্গেরের শহরতলিতে এক ডাকাতি হয়েছে, এক হপ্তা আগে। তাই পাণ্ডেজীর কথা হঠাৎ মনে হল।”

বুঝিলাম, পুরাতন দিনের স্মৃতিতে ব্যোমকেশ ভারাক্রান্ত হইয়াছে। তাহাকে স্মরণ করাইয়া বলিলাম, “কী মুশকিল, পাণ্ডেজী কি এখনও পুলিশ সার্ভিসে আছেন নাকি? তোমার আমার বয়স বেড়েছে আর তাঁরটা থেমে আছে? তাই কি হয়?”

“জানি পাণ্ডেজী রিটায়ার করেছেন। কিন্তু মুঙ্গেরে অপরাধের কথা শুনে তাঁর কথা মনে পড়ে গেল। বিচক্ষণ পুলিশ অফিসার অনেকটা সোনার পাথরবাটির মতোই। এখন তাঁর জায়গায়… আরে দ্যাখো তো অজিত, নিচে পাতিরাম এত সশব্দে কার সঙ্গে কথা কইছে।”

আমাদের বাসার ঠিক নিচেই পাতিরামের চায়ের দোকান। উঠিয়া জানালায় গিয়া দেখি একটি ভদ্রলোককে আমাদের বাসার দিকনির্দেশ করিয়া পাতিরাম কিছু বলিতেছে। আমাকে জানালায় দেখিয়া সে বলিল, “এই যে অজিতবাবু, এই ভদ্দরলোকটি ব্যোমকেশবাবুর সঙ্গে দেখা কত্তে চান।”

ভদ্রলোকের পরনে সিল্কের পাঞ্জাবী। মাথাজোড়া টাক, নাকের নিচে সুপুষ্ট গুম্ফ যুগল চেহারায় বেশ একটা বিশিষ্টতা দিয়াছে। গোলাকার মুখমণ্ডলে স্বচ্ছলতার চাকচিক্য। উদ্বিগ্ন দুই চোখে যে দীপ্তি তাহাকে অবশ্য বুদ্ধিজনিত বলিয়া মনে হইল না। গলির মুখে বাহিরের বড়ো রাস্তায় একটি সবুজ রঙের অ্যাম্বাসেডর গাড়ির পশ্চাদ্ভাগ দেখা যাইতেছে। সন্দেহ নাই উহাতেই ভদ্রলোকের আগমন।

জানালা হইতে ফিরিয়া ব্যোমকেশকে বলিলাম, “বহুকাল বাদে তোমার ফের ভাগ্যোদয় হয়েছে মনে হচ্ছে। শাঁসালো মক্কেল হে। গাড়ি হাঁকিয়ে এসেছেন।”

“আমি সত্যান্বেষণ ছেড়ে দিয়েছি, অজিত।” ব্যোমকেশ বিরসবদনে বলিল, “তবে মক্কেল না হলেও শাঁসটা দেখার কৌতূহল হচ্ছে।”

ইতিমধ্যে সেই ভদ্রলোক দোতলায় উঠিয়া আমাদের দরজায় ঘা দিয়াছেন। পুঁটিরাম তাঁহাকে লইয়া আমাদের কামরায় উপস্থিত করিল। পুনরায় নিকট হইতে তাঁহাকে দেখিয়া বুঝিলাম তিনি শুধু সচ্ছলই নন, রীতিমতো ধনী। তাঁহার দক্ষিণ হস্তের অনামিকাতে স্বর্ণমণ্ডিত অত্যুজ্জ্বল প্রস্তরখণ্ডটি যে হীরা, তাহাতে সন্দেহ নাই। শুধু মুখের অমায়িক হাসিটি অতীব সরল, তাঁহার অবয়বের আভিজাত্যের সঙ্গে যেন কিঞ্চিৎ বেমানান।

যথাবিহিত শিষ্টতা বিনিময়ের পর একটু জিজ্ঞাসুভাবে তিনি শুধাইলেন, “আপনাদের মধ্যে ব্যোমকেশবাবু…”

“আপনি বসুন লালমোহনবাবু, আমিই ব্যোমকেশ।” এই বলিয়া ব্যোমকেশ আমার পানে চাহিয়া বলিল, “তোমার অন্তত স্বনামধন্য লালমোহন গাঙ্গুলিকে চেনা উচিত ছিল অজিত। ইনি যে তোমাদেরই লাইনের লোক, জটায়ু এঁর ছদ্মনাম। গতবার বইমেলায় এঁকে দর্শনলাভের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।”

“হেঁ হেঁ, কী যে বলেন স্যার, আপনার তুলনায় আমি আর কী? আপনি হলেন গিয়ে…ইয়ে…”

দেখিলাম ভদ্রলোক সত্যই খুশি হইয়াছেন, কিন্তু ব্যোমকেশের প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধাও অকপট। অতি বিনয় করিতে গিয়া তাঁহার কথা যোগাইতে ছিল না। জটায়ুর আচরণে এমন একটি নিখাদ অন্তরঙ্গতা আছে যেন মনে হয় এঁকে কতকাল ধরিয়া চিনি। অবশ্য তিনি আমার অপরিচিত হইলেও তাঁহার নাম বিলক্ষণ জানিতাম। পুস্তক ব্যবসায় যুক্ত আছি অথচ জনপ্রিয় রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনির লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুর নাম জানিব না, তাহা কী হয়? তাই ব্যোমকেশকে খোঁচা মারিবার এই সুযোগ ছাড়িতে পারিলাম না। বলিলাম, “লালমোহনবাবু কলম ব্যবসায়ী ঠিকই, কিন্তু আমার সঙ্গে তাঁর তুলনা করা কি তোমার উচিত হল ব্যোমকেশ? আমি যে শুধু তোমারই কীর্তি প্রচার করে মরলাম। আর তুমি তো প্রখর রুদ্র নও যে…”

লালমোহনবাবুর দন্তবিকাশ প্রায় কর্ণচুম্বী হইবার উপক্রম। বিনয়ে বিগলিত হইলেও বুঝিতে অসুবিধা হয় না, আত্মপ্রশংসা তাঁহার খুব একটা অরুচিকর নয়। হাত কচলাইতে কচলাইতে বলিলেন, “ওসব কথা থাক না হয়। আপনার কাছে যে জন্যে আসা সেটাই এবার বলি, ব্যোমকেশবাবু।”

এই বলিয়া বুকপকেট হইতে তিনি একটি কাগজ বাহির করিলেন। লাল রঙের বিবাহের পদ্য লেখা হয় যেমন কাগজে তেমনই দেখিতে এই কাগজটিতে পরিচ্ছন্ন হস্তাক্ষরে লেখা, ‘উটকো ঝামেলায় যদি জড়িয়ে না পড়তে চান, তাহলে যাত্রা স্থগিত করুন।’

কাগজের নিচের দিকে বড়বাজারের একটি ঠিকানা লেখা। শুষ্ক মুখে লালমোহনবাবু বলিলেন, “কাল মানিকতলা গিয়েছিলাম একটু ট্যাংরা মাছের খোঁজে। বাড়ি ফিরে দেখি কখন এটা আমার পকেটে কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে। এর কী মানে বলুন তো, ব্যোমকেশবাবু!”

ব্যোমকেশ হাত বাড়াইয়া কাগজটি লইল। পড়িয়া দেখিয়া বলিল, “এ তো কোনও জ্যোতিষীর প্রচারের ইস্তেহার মনে হচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি আপনার কোথাও বেড়াতে যাবার প্ল্যান আছে নাকি?”

“আছে বৈকি! একেবারে শিরেসংক্রান্তি। তাই জন্যেই তো সাততাড়াতাড়ি আপনার কাছে আসা। আচ্ছা ব্যোমকেশবাবু, আপনি জ্যোতিষে বিশ্বাস করেন?”

ব্যোমকেশের মধ্যে সেই অতীতের অনুসন্ধিৎসা যেন দেখিতে পাইলাম। সে বলিল, “আমি জ্যোতিষ বিশ্বাস করি কি না সেটা বোধহয় খুব প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু আপনার যাত্রার কথা জানে এমন কোনও লোক কি এই কাজ করতে পারে?”

“উঁহু। আমার যাত্রা পণ্ড করে কারুর লাভ আছে বলে তো মনে হয় না। আমার আজ রাতেই কলকাতার বাইরে যাবার কথা। আসলে পুজোর উপন্যাসটা এবার রাজস্থানের পটভূমিকায় রেখেছি। তাই ভাবলাম, একবার অকুস্থলটা ঘুরে স্বচক্ষে যদি দেখে আসা যায়, তাহলে ঐ কী বলে, বেশ একটা ইয়ে হয় আর কী।”

লালমোহনবাবু রুমাল বাহির করিয়া একবার ঘাড়ে-গলায় বুলাইয়া লইলেন। তারপর পুনরায় বলিলেন, “আপনার মতো আমিও ভেবেছিলাম এ কোনও জ্যোতিষীর কাজ। কী জানেন, আমার আবার জ্যোতিষে অগাধ বিশ্বাস। আজ পর্যন্ত সর্বদাই দিনক্ষণ দেখে উপন্যাস লেখা শুরু করি। আর বলতে নেই তাতে উপকারও পেয়েছি। সেইখানেই হয়েছে মুশকিল। সত্যিই আমার যাত্রায় দুর্ভোগ আছে কি না…”

জটায়ুর সমস্যাটি সম্পূর্ণ শুনিবার পূর্বেই দরজায় শব্দ হইল। চাহিয়া দেখি আরেক অপরিচিত ব্যক্তি ভিতরে আসিবার নিমিত্ত কিঞ্চিৎ ইতস্তত করিতেছেন। এই নবাগত ভদ্রলোকটি প্রায় আমাদেরই বয়সী। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, শরীর বেশ সুগঠিত। বুঝিতে অসুবিধা হয় না যে যৌবনে তিনি রীতিমতো স্বাস্থ্যচর্চা করিয়াছেন। আমরা ইঙ্গিত করিতে কক্ষে প্রবেশ করিয়া আসন গ্রহণপূর্বক বলিলেন, “ব্যোমকেশবাবু, আপনাদের আলোচনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য মাপ চাইছি। কিন্তু একটু তাড়া আছে বলে… আমার নাম কুমার, আমাকে হয়তো আপনারা চিনবেন না। কিন্তু আমার বন্ধু বিমলের নাম নিশ্চয়ই আপনারা শুনে থাকবেন।”

আমরা কিছু বলিবার পূর্বেই লালমোহনবাবু সোল্লাসে বলিয়া উঠিলেন, “আপনিই কুমারবাবু! বিমলবাবুর হরিহর আত্মা? আপনাদের চিনবে না এমন পাষণ্ড কি কেউ আছে নাকি? হেমেনবাবু যে আপনাদের কীর্তি অমর করে দিয়েছেন। আরে ঐগুলোই তো আমার অনুপ্রেরণা!”

আমরাও কম বিস্মিত হই নাই। লালমোহনবাবুর উচ্ছ্বাস কিছু কম হইলে পরে ব্যোমকেশ বলিল, “সত্যিই আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি, কুমারবাবু।”

অতঃপর লালমোহনবাবুর পরিচয় কুমারবাবুকে দিয়া সে বলিল, “অধমের কাছে আপনাদের প্রয়োজন আগে তো কখনও পড়েনি, কুমারবাবু। বলুন দেখি, কী ব্যাপার। আর বিমলবাবুকেই বা কোথায় রেখে এলেন?”

“সব বলছি, ব্যোমকেশবাবু। আপনাকে একটু কষ্ট দেব বলেই এসেছি কিন্তু। আপনি শুনেছেন কি না জানি না, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে রামগোপাল শেঠের গুদামে একটা বিশ্রী হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। সেই ব্যাপারেই আপনার সাহায্য দরকার।”

“তাই নাকি? তা বিমলবাবু থাকতে আবার ব্যোমকেশ কেন?”

আমিবলিলাম, “আপনি বোধহয় জানেন না ব্যোমকেশ আজকাল সত্যান্বেষণ, মানে গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দিয়েছে।”

“বিমল থাকলে আর চিন্তা কী ছিল, অজিতবাবু। কিন্তু বয়স বেড়ে তারও মন আর গোয়েন্দাগিরিতে নেই। এখন তাকে পাখির নেশায় ধরেছে। কী এক লুপ্তপ্রায় প্রজাতির সন্ধানে সে আজ পনেরো দিন হল দক্ষিণ ভারতে। কালই তো ব্যাঙ্গালোর থেকে ফোন এসেছিল, এখনও তার ফিরতে বেশ কিছুদিন দেরি হবে। কিন্তু সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী সত্যান্বেষণ পরিত্যাগ করেছেন, এ তো আমার জানা ছিল না!” কুমারবাবু অকৃত্রিম বিস্ময়ে প্রশ্ন করিলেন, “তাহলে উপায়?”

ব্যোমকেশ মুচকি হাসিয়া জানাইল, “কী আর করি কুমারবাবু, বয়েস হয়েছে তো! আর মাথা তেমন খ্যালে না। তা আপনি এককাজ করুন না। এখান থেকে সর্দার শঙ্কর রোড হয়ে যান। ওখানে প্রদোষ মিত্রকে পাবেন, তাকেই সঙ্গে করে নিন। আজকাল গোয়েন্দাগিরিতে বেশ নাম করেছে।”

“তা আর জানি না? কিন্তু সে গুড়ে যে বালি।” কুমারবাবু হতাশার স্বরে বলিলেন, “আমি আগেই খোঁজ করেছি। তিনি এখন কলকাতায় নেই। কাল সকালেই বেরিয়ে গেছেন রাজস্থানের পথে। কী একটা পুরনো কেল্লার সন্ধানে।”

“ঐ যে সেই মুকুল ধরের কেসটা কি—জাতিস্মর?” আমি সাগ্রহে বলি, “কাগজে দেখেছিলাম বটে ক’দিন আগে। তাকে নিয়েই গেছেন বোধহয়?”

“ঠিকই ধরেছেন। ফেলুবাবুকে এখন পাওয়া যাবে না। এই সময়ে কলকাতায় আর কাকে পাই বলুন তো। আসলে বিমলের সঙ্গে অনেক ঘোরাঘুরি করেছি বটে, কিন্তু গোয়েন্দাগিরি আমার ঠিক আসে না। অথচ সুন্দরবাবু এত করে ধরেছেন…”

সুন্দরবাবুর নাম শুনিয়া লালমোহনবাবু পুনরায় উৎসাহিত হইয়া বলিলেন, “বলেন কী ময়াই, সুন্দরবাবু এখনও পুলিশে আছেন?”

“না, তিনি রিটায়ার করেছেন বেশ কিছু বছর আগেই।” কুমারবাবু জানাইলেন, “কিন্তু অপরাধ জগতের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা এখনও কমেনি। গতবছর পর্যন্ত এক্সটেনশনে ছিলেন। বর্তমানে তাও নেই, তবুও স্পেশাল অ্যাডভাইসার হিসেবে এখনও মাঝেমধ্যে তাঁর ডাক পড়ে ডিপার্টমেন্ট থেকে। যতই হোক বিমলের সঙ্গে তিনি বহু রহস্যের কিনারা করেছেন কিনা।”

“আর তাঁর খাওয়াদাওয়া?” আমিও না জিজ্ঞাসা করিয়া পারিলাম না।

“তাও আছে বহাল তবিয়তে।” কুমারবাবু সহাস্যে বলিলেন, “বলাই বাহুল্য, তাঁর কোমরের মাপেরও কোনও হেরফের হয়নি।”

আরও অনেক পুরাতন কথা আসিয়া পড়িল। তাঁহাদের নানান অভিযানের কথা, রামহরির কথা, বাঘার মৃত্যুর করুণ কাহিনি। পুরাতন অতীতের সরণীতে সে এক স্মৃতিবিধুর পথচারণা। অল্প পরেই অবশ্য কুমারবাবু গাত্রোত্থান করিলেন। তাঁহাকে দরজা অবধি আগাইয়া দিবার পথে ব্যোমকেশ পরামর্শ দিল, “জয়ন্তবাবু শুনেছি লেক টাউনে বাড়ি করেছেন। ওঁর সঙ্গেই একবার দেখা করে নিন না হয়।”

“আমিও সেইরকমটাই ভেবেছি। আচ্ছা, নমস্কার।”

কুমারবাবু বিদায় লইলেন। লালমোহনবাবুর সহিত আমাদের আলাপ মধ্যপথেই ব্যাহত হইয়াছিল, কিন্তু তাহাতে অবশ্য তিনি বিন্দুমাত্র আহত হন নাই। বরং বলিলেন, “আজ আপনার এখানে আসাটা আমার কী যে সৌভাগ্য বলে বোঝাতে পারব না, ব্যোমকেশবাবু। আপনাদের সঙ্গে কথা কয়ে আমার সমস্যাটা এখন আর তেমন কোনও সমস্যা বলেই মনে হচ্ছে না।”

“আপনার সমস্যাটা কিন্তু ঠিক করে শোনাই হল না, লালমোহনবাবু।” ব্যোমকেশ পুরাতন কথোপকথনের সূত্র আবার ধরাইয়া দিয়া বলিল, “কী যেন বলছিলেন আপনি? আপনার রাজস্থান যাত্রার প্রাক্কালে কোনও জ্যোতিষী ভয় দেখিয়ে বাগড়া দেবার চেষ্টা করছে, এইটাই কি আপনার সমস্যা?”

“আপনি ঠিক ধরেছেন, স্যার। কিন্তু কেন বাগড়া দেবার চেষ্টা করছে সেইটেই ঠিক…ইয়ে, ধত্তে পারছি না। আপনার কী মত?”

আমি বেশ একটা হাসির বেগ কোনওক্রমে দমন করিলাম। ব্যোমকেশ গোয়েন্দাগিরি ছাড়িয়া দিয়াছে ঠিকই, কিন্তু তাহার নিকট এধরনের প্রশ্ন লইয়া কেহ আসিবে তাহা কি ভাবা যায়? পঙ্ক-মগ্ন হস্তীর দুর্দশাসংক্রান্ত প্রবাদটি দেখা যাইতেছে মিথ্যা নয়। কিন্তু পঙ্কে মগ্ন হাতি কি ব্যোমকেশের ন্যায় মুচকি মুচকি হাসিবে?

ঠিক এই সময়ে এক বিকট শব্দে সারা পাড়া চমকিত হইয়া গেল। লালমোহনবাবু তো তাঁহার আসন হইতে প্রায় লাফাইয়া উঠিলেন। তাঁহাকে আশ্বস্ত করিয়া ব্যোমকেশ বলিল, “দ্যাখো তো অজিত, সেই কিম্ভুতটাই বোধহয় এবার এই পাড়ায় ঢুকেছে।”

আমি জানালায় গিয়া একটি কুমড়োপটাশের পুচ্ছ গলির বাঁকে অদৃশ্য হইয়া যাইতে দেখিলাম। এমনিতে নিরীহ, কিন্তু অদ্ভুতদর্শন এই জন্তুটির আবির্ভাব শহরের এই প্রান্তে খুব প্রাচীন নয়। একবার গড়িয়াহাটার মোড়েও নাকি দেখা গিয়াছিল। ফিরিয়া আসিয়া লালমোহনবাবুকে বলিলাম, “ও কিছু নয়, একটা কুমড়োপটাশ।”

লালমোহনবাবু খাস গড়পারের মানুষ, দেখিলাম তাঁহার ভয় পুরোপুরি কাটে নাই। ব্যোমকেশ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করিবার জন্য বলিল, “ভয় পাবার কিছু নেই লালমোহনবাবু, ওরা কিচ্ছু করে না। হ্যাঁ, যে কথা হচ্ছিল। আমার মতে আপনার রাজস্থানে যাওয়ার প্ল্যানটা বানচাল করা ঠিক হবে না। প্রথমত, নোটিসটা সত্যিই কোনও জেনুইন জ্যোতিষীর কি না জানা নেই। পরে হয়তো দেখা যাবে সবই ভুয়ো। দ্বিতীয়ত, আপনার পুজোর উপন্যাসের শুরু তো ইতিমধ্যেই আপনি করে ফেলেছেন, দিনক্ষণ দেখে। তার মালমশলা যোগাড় করার এই তো সময়। রাজস্থানে ভালো করে কেল্লাগুলো দেখে আসুন, আপনার লেখার কাজে লাগবে। সাবধানে যাবেন, তাহলেই হবে। আর বলা যায় না, হয়তো জাতিস্মরের দেখাও পেয়ে যেতে পারেন। তাহলে তো কথাই নেই। শুনলেনই তো, মুকুল ধর এখন রাজস্থানের কেল্লা দেখে বেড়াচ্ছে।”

“বলছেন? ব্যাপারটা কিন্তু বেশ থ্রিলিং, ময়াই। পূর্বজন্মের সবকথা গড়গড় করে বলে দিচ্ছে। বাপ রে!” লালমোহনবাবুর কণ্ঠস্বরে প্রফুল্লতা আবার ফিরিয়া আসিল। বলিলেন, “তাহলে আপনারও তাই মত? দুগ্গা বলে বেরিয়েই পড়ি, কী বলেন? বড়ো আশ্বাস পেলাম, স্যার। আচ্ছা, আজ তাহলে উঠি।” এই বলিয়া আসন হইতে উঠিতেই পুনরায় তাঁহার মুখ গম্ভীর হইয়া আসিল। শুষ্ক কণ্ঠে বলিলেন, “আপনাদের ঐ কুমড়োর ঘ্যাঁট না কী যেন, ও কি এখনও বসে আছে? আবার কামড়ায়-টামড়ায় না তো?”

প্রখর রুদ্রের স্রষ্টার তখন করুণ অবস্থা। তাঁহাকে সান্ত্বনা দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, “কামড়ায় বলে তো কখনও শুনিনি। তাছাড়া আপনার গাড়ি তো আছেই গলির মুখে।”

ভদ্রলোক কতটা স্বস্তি পাইলেন জানি না। আমাদের উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটি নমস্কার জানাইয়া তড়িঘড়ি বিদায় লইলেন। জানালা দিয়া দেখিলাম, তাঁহাকে লইয়া নিরাপদে তাঁহার সবুজ অ্যাম্বাসেডর চলিয়া গেল। একই সঙ্গে গলির মুখে যে লোকটিকে আমাদের পাড়ায় প্রবেশ করিতে দেখিলাম, তাহাকে যেন পূর্বপরিচিত বোধ হইল। কিন্তু কে তাহা সহসা মনে করিতে পারিলাম না। ব্যোমকেশ ইতিমধ্যে ইজি-চেয়ারখানায় গা এলাইয়া কড়িকাঠের দিকে দৃষ্টি স্থির করিয়া রাখিয়া ছিল। তাহার মনে যাহা চলিতেছিল পরের প্রশ্নেই তাহা প্রকট হইল, “তুমি জাতিস্মরে বিশ্বাস করো, অজিত?”

আমি জানালাতেই ছিলাম। ব্যোমকেশের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিলাম না। কেননা রাস্তার সেই লোকটি ততক্ষণে আমাদের দোরগোড়ায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে এবং তাহার পূর্বপরিচয় তখন বিদ্যুচ্চমকের মতো আমার মস্তিষ্কে উদয় হইয়াছে। আমি জানালা হইতে ফিরিয়া উত্তেজিত হইয়া বলিলাম, “জাতিস্মর জানি না ব্যোমকেশ, কিন্তু টেলিপ্যাথি বিলক্ষণ আছে। দ্যাখো দেখি আমাদের এই নতুন অতিথিটি কে।”

অতিথি ততক্ষণে দোতলায় আমাদের কক্ষের সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছেন। ব্যোমকেশ এক মুহূর্ত তাঁহাকে পর্যবেক্ষণ করিয়াই ত্বরিতে উঠিয়া গিয়া জড়াইয়া ধরিল, “আরে, পাণ্ডেজী! আপনি এই কলকাতায়? এমন অসময়ে?”

আমাদের পুরাতন পরিচিত মুঙ্গেরের পুলিশ অফিসার সেই পুরন্দর পাণ্ডে! আজ কিছু পূর্বেই যাঁহাকে লইয়া আমাদের আলোচনা হইয়াছিল। মানস জগতের সূক্ষ্ম তরঙ্গ এত শীঘ্র প্রবাহিত হইয়া পাণ্ডেজীকে যে স্থূল শরীরে একবারে কলিকাতায় টানিয়া আনিবে, এ যেন বিশ্বাসের অতীত!

পাক্কা পাঁচ মিনিট লাগিল আকস্মিক বিস্ময়ের সেই ধাক্কা কাটাইয়া উঠিতে। বিস্ময় প্রকাশের বিবিধ শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে আমরা ক্রমাগত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হইতে লাগিলাম। অতঃপর আবেগ কিছু স্তিমিত হইলে ব্যোমকেশ পুঁটিরামকে ডাকিয়া পত্রপাঠ একপ্রস্থ চায়ের ফরমাস করিয়া দিল। তারপর আমরা কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হইয়া নিজ নিজ চেয়ার দখল করিয়া উপবেশন করিলাম। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, “এ যেন এক অলৌকিক সংযোগ। আজই খানিক আগে আপনার কথা হচ্ছিল। তারপর বলুন পাণ্ডেজী, আপনার হঠাৎ কলকাতায় আগমনের কারণ। বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়নি তো?”

পাণ্ডেজী দিব্যি বাংলা বোঝেন। বলিলেন, “কিছুমাত্র না। আপনি এই পাড়ায় যথেষ্টই বিখ্যাত।”

অতঃপর তিনি ব্যক্ত করিলেন তাঁহার কলিকাতায় আসিবার প্রকৃত উদ্দেশ্য। আজ সকালেই ব্যোমকেশ মুঙ্গেরে যে ডাকাতির কথা বলিয়াছিল, পাণ্ডেজী তাহারই তদন্ত করিতে এখানে আসিয়াছেন। কেন কে জানে, তিনি এখনও বিহার পুলিশে বহাল আছেন, নাকি সুন্দরবাবুর মতো গৃহের অন্নে বন্য মহিষের সন্ধান করিয়া ফিরিতেছেন, তাহা আর জানিবার ইচ্ছা হইল না।

পাণ্ডেজী বলিলেন, “ডাকাতির প্রধান আরোপীটি কলকাতায় এসে লুকিয়ে ছিল জানা গেছে। কলকাতা পুলিশের সূত্রে আরও জানা গেছে সে খুন হয়েছে। শুনেছেন নাকি, বড়বাজারের রামগোপাল শেঠের গদিতে সেই খুনের খবর?”

ব্যোমকেশ আমার দিকে একটি অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করিয়া বলিল, “বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, ঐ বড়বাজার, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের জংশনে। জানেন দেখছি।”

“এটা কী ধরনের তদন্ত হচ্ছে?”

আলোচনায় মশগুল ছিলাম, হঠাৎ কারোর ঐ খসখসে গলার আওয়াজে আমরা তিনজনেই চমকিয়া উঠিলাম। চাহিয়া দেখি, শীর্ণকায় একটি লোক কখন আসিয়া দাঁড়াইয়াছে আমাদেরই পাশে। নিঃশব্দে সে কীভাবে কক্ষে প্রবেশ করিল কিছুই জানিতে পারি নাই। লোকটির মাথায় বুটিদার একটি রুমাল বাঁধা, উপরিভাগে তাহার ফাঁক হইতে ঝাঁকড়া চুলের কিছু বাহির হইয়া আছে। স্কন্ধে এক শান্তিনিকেতনি ঝোলা, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা। মুখে সে কিছু চিবাইতেছিল, বামহাতে ধরা ছিল একটি অর্ধভুক্ত ডাঁসা পেয়ারা।

ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণ স্বরে তাহাকে প্রশ্ন করিল, “আপনি কে, মশায়? আর এখানে এলেনই বা কীভাবে? দরজা দিয়ে তো ঢুকতে দেখিনি।”

“আপাতত দরজা দিয়ে যাতায়াত করছি না।” লোকটি অম্লানবদনে বলিল, “আমার গুরুর বারণ—শুক্লা ষষ্ঠী পর্যন্ত। তাই রেন পাইপ বেয়ে জানালা দিয়ে এলাম।”

আমরা একে অপরের মুখের পানে হতবুদ্ধি হইয়া চাহিতেছি। লোকটি পুনরায় বলিল, “আমি নিঃশব্দেই চলাফেরা করে থাকি। জানলায় টোকা দিয়ে আর আপনাদের ডিস্টার্ব করতে চাইনি। যাক গে, আমি কে সেটা বড়ো কথা নয়, গোয়েন্দা বরদাচরণকে সবাই জানে। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনারা কে?”

এই মহাত্মার সঙ্গেও এই প্রথম পরিচয়। তবে শুনিয়াছিলাম তাঁহার কীর্তিকলাপের কিছু বৃত্তান্ত। ব্যোমকেশ চোখ ও হাতের সংক্ষিপ্ত ইশারায় পাণ্ডেজীর কৌতূহল সাময়িক নিরসন করিয়া বলিল, “তা বাবা বরদাচরণ, মুঙ্গেরে এক ভূতান্বেষী বরদাচরণের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আপনারও কাজ কি ভূতান্বেষণ?”

বরদাচরণ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার ব্যোমকেশকে জরিপ করিয়া লইল। ব্যোমকেশের বাক্যে যে প্রচ্ছন্ন লঘুতা ছিল, যেকোনও কারণেই হোক তাহাকে উপেক্ষা করিয়া সে গুরুগম্ভীর স্বরে বলিল, “দরকার পড়লে তাও করতে হয়।”

তারপর আমাদের সকলকে একবার পরীক্ষা করিয়া সে কক্ষের অন্যান্য দিকে দৃষ্টি বুলাইতে লাগিল। ব্যোমকেশ ঈষৎ বিরক্তির স্বরে বলিল, “আপনি কেন এই অসময়ে অপরিচিত বাড়িতে বিনা খবরে অবতীর্ণ হলেন বলুন তো!”

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়া বরদাচরণ বলিল, “গত একমাস ধরে এই পাড়ায় যাতায়াত করছি, এ বাড়ি আর আমার অপরিচিত কোথায়? কিন্তু কোনও কৈফিয়ত দেবার আগে আমার জানা দরকার আমি কার সঙ্গে কথা বলছি। নিন ধরুন।” এই বলিয়া বরদা তাহার ঝোলার ভিতর হইতে আর একটি ডাঁসা পেয়ারা বাহির করিয়া ব্যোমকেশের উদ্দেশ্যে বাড়াইয়া ধরিল।

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া তাহা প্রত্যাখান করিয়া বলিল, “আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী। সত্যান্বেষী বলে এককালে আমারও কিছু পরিচিতি ছিল। তবে বর্তমানে মস্তিষ্ক আর তেমন সবল নেই, তাই গোয়েন্দাগিরি করি না। আর দাঁতও দুর্বল, শক্ত ফল খেতে পারি না।”

“অ। আপনার গোয়েন্দাগিরি তো অতীতকালের কথা।” বলিয়া বরদাচরণ পেয়ারাটি আমার দিকে বাড়াইয়া বলিল, “আপনি তাহলে অজিতবাবু। আপনিই নিন, আপনার দাঁত আশা করি এখনও সবল আছে। তারপর, কী করা হচ্ছে এখন?”

কী করিব ভাবিয়া পাইলাম না। তাহারই মধ্যে পেয়ারাটি আমাকে ধরাইয়া বরদাচরণ বলিল, “আরে খান খান, ওতে ক্লোরোফিল আছে, মাথা খোলে। তা বললেন না তো কী করেন!”

ব্যোমকেশ বলিল, “আপনি এত বড়ো গোয়েন্দা আর এটা জানেন না অজিত লেখক?”

“সেটা তো জানি। আমার জিজ্ঞাস্য ছিল কাজের কাজটা কী করেন। তা যাক গে। আপাতত আমি একটা বিশেষ অনুসন্ধানে এসেছি। তার জন্যে জানতে চাই আপনাদের এখানে কী গুলতানি করা হচ্ছে।”

আমি তাহার শ্লেষ বাক্য উপেক্ষা করিয়া পেয়ারায় কচাৎ শব্দে এক কামড় দিলাম। দেখিলাম পেয়ারাটি শুধু দেখিতেই নয়, স্বাদেও বড়ো মধুর। ওদিকে পাণ্ডেজী বরদাচরণকে চিনিতেন না, হতবাক হইয়া এতক্ষণ তাহার কথা শুনিতে ছিলেন। এখন তাঁহার মুখ ফসকাইয়া বাহির হইল, “আপনিও কি বড়বাজার হত্যা মামলার তদন্তে…”

“না না, ওসব ফালতু কাজে আমি সময় নষ্ট করি না।”

পরক্ষণেই ঝোলা হইতে মস্ত এক আতস কাচ বাহির করিয়া তাহার মধ্য দিয়া এক চক্ষু নিমীলিত ভ্রূভঙ্গি সহ পাণ্ডেজীকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল বরদাচরণ।

“আপনাকে পুলিশের লোক বলে মনে হচ্ছে।” পর্যবেক্ষণ সমাপ্ত করিয়া বরদাচরণ বলিল, “ওসব ছোটোখাটো ব্যাপারে আর আমাকে জড়াবেন না। আমার কেসটা আর একটু জটিল। খিদিরপুরে রামপেয়ারীর মুরগি চুরি—রামপেয়ারীর বড়ছেলে লোটনের আবার আফিংয়ের নেশা। এখন মুশকিলটা হল… যাক গে, সে অনেক কথা, অতসব আপনি বুঝবেন না।”

উত্তরোত্ত রবরদাচরণের স্পর্ধার বৃদ্ধি আর সহ্য হইতেছিল না। অবশেষে আর থাকিতে না পারিয়া বলিলাম, “অনেক হল। বরদাচরণ, জানালা খোলা আছে। এবার আপনি আসুন।”

আমার কথায় বরদা রুষ্ট হইল কি না জানি না, কিন্তু বিশাল ম্যাগনিফাইং গ্লাসখানা বাগাইয়া এবার আমাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। ক্রমশ যেন সে অল্পে অল্পে আগাইয়া আসিতেছিল। আর কোথা হইতে সূর্যরশ্মি সেই আতস কাচে পড়িয়া আমার চক্ষু ধাঁধাইয়া দিল। উজ্জ্বল আলোকে আর কিছুই দেখিতে পাইতেছিলাম না। এ কি, বরদাচরণ আমাকে পুড়াইয়া মারিবে নাকি? আমি দুই চোখে হাতের আড়াল করিবার প্রয়াস করিলাম, কিন্তু পারিলাম না। তখন আতঙ্কিত হইয়া চিৎকার করিয়া বলিলাম, “এ কী করছেন, বরদাচরণ? বন্ধ করুন আপনার এই খেলা! বন্ধ করুন!”

***

চমকে উঠে ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখি পশ্চিমের খোলা জানালায় খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে পড়ন্ত সূর্যের আলো আমার চোখে এসে পড়ছে। তারই আতঙ্কে এতক্ষণ দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু এ কি শুধু স্বপ্নই ছিল? এত জীবন্ত স্বপ্ন তো আমি সচরাচর দেখি না। মুখের মধ্যে বেশ স্পষ্ট অনুভব করছি চনমনে ডাঁসা পেয়ারার স্বাদ। এখনও যেন মনে হচ্ছে মাথা ফেরালেই দেখতে পাব ব্যোমকেশের মুচকি হাসি। আর বরদাচরণ আতস কাচ ঝোলায় ফেলে জানালা গলে পালাচ্ছে!

ধীরে ধীরে মাথাটা সাফ হল। দুপুরের খাওয়াটা হয়েছিল জব্বর। গুরুভোজন হয়ে যাচ্ছে বুঝেও কিছু করতে পারিনি, পিসিমার হাতের আলু-পোস্ত আর ইলিশের ঝাল আমার সব প্রতিরোধ শেষ করে দিয়েছিল। খেয়ে আর বেশিক্ষণ চোখ খুলে রাখা সম্ভব হয়নি। শহর থেকে দূরে পিসিমাদের এই পুরনো বিশাল বাড়িটায় এসে ইস্তক আমার ছেলেবেলাটায় হারিয়ে গিয়েছিলাম যেন। এখানে অবসর প্রচুর আর বইয়ের মেলা। পিসেমশাইর শখের সংগ্রহে ছিল যাবতীয় গোয়েন্দা কাহিনি। এই ক’দিন ভালোই কেটেছে হেমেন্দ্রকুমার, শরদিন্দু, সত্যজিৎ, শীর্ষেন্দুর সঙ্গে। গোয়েন্দা গল্পের স্বাদ বদলাতে আজ খাওয়ার পরে বসেছিলাম আবোলতাবোলখানা নিয়ে। তাইতেই এই বিপত্তি।

হ্যাঁ, স্বপ্ন বটে একখানা! একথা সবাই জানে গল্পের মতো স্বপ্নেরও গরু গাছে চড়ে। তাই বলে একসঙ্গে ব্যোমকেশ, কুমার, জটায়ু, ফেলুদা, বরদাচরণ! সেই সঙ্গে আবার কুমড়োপটাশ? গরমের দাপটে শুধু সোনার কেল্লার অভিযানটা শীতকাল থেকে গরমকালে এসে গিয়েছিল। মনে মনে হাসিও পেল, আবার বেশ অবাকও লাগল—আমিও ওরই মাঝে দিব্যি অজিতত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলাম!

সমস্ত ব্যাপারটা তাহলে স্বপ্ন—এই বলেই উড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে গোল টেনিস বলের মতো কী যেন একটা আমার কোল থেকে মাটিতে পড়ে গড়িয়ে খানিক দূরে গিয়ে থেমে গেল। কাছে গিয়ে দেখি কচি কলাপাতা রঙের একটা তাজা ডাঁসা পেয়ারা। এপ্রিলের এই ভরা গরমে পেয়ারা! তার একদিকে দাঁতের কামড়ের টাটকা দাগটাও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

ছবিঃ শিমুল

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s