কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ে আগের গল্প টুইটি, সে-রাত ভয়ঙ্কর
জাতিস্মর
কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
কী আশ্চর্য! এই দোকানটা তো আগে কোনোদিন চোখে পড়েনি! অথচ এই অঞ্চলের সমস্ত দোকানগুলো আমার চেনা। ছোটো থেকে মাঝারি সমস্ত বইয়ের দোকান, যেগুলো কলেজ স্ট্রিটের আশেপাশের সব রাস্তায়, গলিঘুঁজিতে, ফুটপাথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এইসব অজস্র বইয়ের দোকানে মেলে ধরা নানান বইয়ের সম্ভারে হারিয়ে যাওয়া আমার প্রায় নিত্যকারের অভ্যেস। পুরনো, ছেঁড়া, বিবর্ণ বইগুলোকে উলটেপালটে, গন্ধ শুঁকে, চোখ বুলিয়ে আমি এক অদ্ভুত মায়াময় আনন্দ পাই।
কিন্তু এই দোকানটা! এটা এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল? আর এই দোকানের অনেক বইয়ের মধ্যে তিন নম্বর তাকের একপাশে রাখা ঐ ফ্যাকাশে সবুজ মলাটের বাঁধানো বইটার দিকে চোখ পড়তেই বুকটা অমন ছ্যাঁৎ করে উঠল কেন? আর তারপরেই, যেন কী এক অমোঘ, দুর্বোধ্য আকর্ষণে ঐ বইটা আমাকে টানতে লাগল। আমি জোর করে অবহেলায় চোখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করলেও আমাকে তা করতে দিল না। আবার সে আমার নজর ফিরিয়ে নিতে লাগল।
বারবার বইটার দিকে তাকাচ্ছি আর আমার বুকের মধ্যে প্রতিবারই রক্ত ছলাৎ করে উঠছে। এরকম বারকয়েক হবার পরই আর থাকা গেল না। এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে আমাকে হাত বাড়িয়ে বইটা টেনে নামাতেই হল।
আর বইটা হাতে নেবার সঙ্গে-সঙ্গেই, কী আশ্চর্য, বইটা যেন একটা জীবন্ত বেড়ালছানার মতো আমার হাতের মধ্যে খেলা করতে লাগল। আমার হাতের মধ্যেই তার মলাটটা খুলে গেল আপনা থেকেই। তারপরেই ফরফর ফরফর করে সব পাতাগুলো উলটোতে পালটাতে লাগলো। তারপর আবার নিজে থেকেই পাতাগুলো বন্ধ হতে হতে একেবারে প্রথম পাতায় স্থির হয়ে যেতেই…
এ কী! এ তো বই নয়! এটা তো একটা খাতা! সুন্দর করে বাঁধানো একটা সবুজ মলাটের খাতা আমার হাতে। যার প্রথম পাতার মাঝখানে বড়ো বড়ো অক্ষরে শুধু লেখা আছে একটা নাম—সুবললাল বসু। ব্যস, প্রথম পাতায় শুধু এই। এরপর শুধুই ফাঁকা পাতা। আর কিছুই কি নেই নাকি? পাতা উলটে যাই। পরপর তিনটে ফাঁকা পাতার পর চতুর্থ পাতায় গিয়ে চোখ আটকে গেল। ছোটো ছোটো গোটা গোটা অক্ষরে ডায়েরির মতো করে কী যেন লেখা।
অদম্য কৌতূহলে পড়তে শুরু করি। আর মাত্র কয়েকটা লাইন পড়েই বিস্ময়ে, কৌতূহলে আমার প্রায় বাকরোধ হয়ে যায়। গোটা খাতাটা উলটেপালটে দেখতে হয়। আর তখনই হঠাৎ অনুভব করি, এক রত্নের খনি আবিষ্কার করে ফেলেছি আমি। এ কোনও ডায়েরি নয়, কোনও গল্প নয়, সুবল বসু নামে এক জাতিস্মরের অসংখ্য জীবনের কাহিনি। একের পর এক তার বিভিন্ন জন্মের কথা মনে পড়েছে, আর সেইসব ঘটনা সে পরের পর লিপিবদ্ধ করে গেছে তার এই খাতায়।
তখনই দরদাম করে খাতাটি নিয়ে চটপট বাড়ি ফিরে এসেছি আর নাওয়া-খাওয়া ভুলে পড়তে শুরু করেছি সে খাতার আদ্যোপান্ত। সে যে কী আশ্চর্য অভিজ্ঞতা! যেন এক অলৌকিক ঝাঁপি, যার একটার পর একটা ঢাকনা খুলে সুবল বসু অতিক্রম করে গেছে ইতিহাসের একেকটা স্তর।
পড়তে পড়তেই মনে মনে স্থির করেছি যে, না, এ শুধু আমার পড়াতেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। সারা পৃথিবীকে জানানো দরকার এ-খাতার পরিচয়। ইতিহাসের সেইসব অজ্ঞাত অধ্যায় উঠে আসুক গোটা পৃথিবীর পাঠকের কাছে। তাই সে খাতার প্রথম কাহিনিটি আজ সকলের সামনে তুলে আনছি তার খাতা থেকে, তারই ভাষায়।
সুবললাল বসুর খাতা থেকে
এ কী? অকস্মাৎ এ কী হল আমার? আমি কি সহসা নূতন জীবনপ্রাপ্ত হলাম, নাকি এই একই জীবনের মধ্যে থেকেও অপর এক জীবনের প্রান্তে উপনীত হলাম? কী জানি, কিছুই তো বোধগম্য হচ্ছে না। কেবল গত ভোররাত্রি হতে এক অসাড় অনুভূতি যেন সমস্ত চেতনা অবশ করে রেখেছে। আমি যেন কেবল সেই বিহ্বল চেতনা সহকারে এক স্বপ্নলোকে বিচরণ করে বেড়াচ্ছি।
মনে পড়ে, গতরাত্রে প্রচণ্ড এক ঝড় উঠেছিল। দিগন্ত আচ্ছন্ন করে সেই বিপুল ঝঞ্ঝাবাত্যা ও থেকে থেকে আলোকময় বিদ্যুৎবহ্নি যেন পৃথিবীর সঙ্গে এক মহা সমরে উদ্যত হয়েছিল।
আমার গৃহের দ্বিতলে টানা অলিন্দে কতিপয় বেশভূষা ঝুলছিল, সেগুলি দ্রুত নামাবার উদ্যোগ করছি, ঠিক এমন সময় কী যে হল তা আর স্পষ্ট করে বলতে পারি না। শুধু এইটুকু স্মরণ হয় যে, এক তীব্র আলোকচ্ছটায় সহসা আমার দৃষ্টি যেন অন্ধকার হয়ে গেল, আর আমি যেন কোন এক অবর্ণনীয় আঘাতে ভূপাতিত হলাম। সেই মুহূর্ত হতে আমার সমস্ত জ্ঞান যেন লুপ্ত হয়ে গেল। তারপর…
সহসা এক ভীমনাদে সচকিত হয়ে জেগে উঠলাম। যেন কী ভীষণ এক শব্দজাল আমাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে! কীসের শব্দ? ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন অবস্থার ঘোর কাটলে বিস্মিত নয়নে দেখি, এ কী? এ আমি কোথায়? আমি তো সেই পূর্বাবস্থায় নেই! কোথায় আমার সেই কড়িবরগা-চিহ্নিত অলিন্দ, এ যে প্রস্তরময় ভূমিখণ্ড! যেন সহসাই কোনও মন্ত্রবলে আমার নির্জন ভবনের পরিবর্তে আমি উপস্থিত হয়েছি এক বিশাল প্রান্তরে, কয়েক সহস্র মানুষের সমাগমে। অদূরেই তিন-তিনটি নদীর এক মোহনা। স্পষ্টই প্রতীয়মান যে এই তিন নদীর বারিধারা তিন বর্ণের। অথচ এই মহা সঙ্গমে এসে তারা একসঙ্গে মিলে গিয়ে সৃষ্টি করেছে একটাই বর্ণ। যেন তিনটি বাদ্যযন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন শব্দতরঙ্গ মিলিয়ে মিশিয়ে সৃষ্টি করে চলেছে একই ঐকতান, একই সুরমূর্চ্ছনা।
আর তার তীরে, এই প্রান্তরে এ কীসের মহা সমাগম? আমার পরনের বেশভূষাই বা কোন মন্ত্রবলে এমনভাবে পরিবর্তিত হল? এ যে ইতিহাস পুস্তকের সচিত্র বর্ণনার মতো রক্ষীর পোশাক আমার পরিধানে! বহিরঙ্গে লৌহজালিক, মস্তকে শিরস্ত্রাণ। হস্তে তীক্ষ্ণধার বর্শা ধারণ করে আমি আরও অনেক রক্ষীর সঙ্গে জনাকীর্ণ প্রান্তরের একস্থানে দণ্ডায়মান। আমার সম্মুখে পদস্থ রাজকর্মচারীদের দ্রুত পদচারণা। হস্তীর বৃংহিত, অশ্বের হ্রেষা আর মানুষের কলরবে চারিদিক মুখরিত। ক্ষণে ক্ষণে বেজে উঠছে তূরী ও ভেরী। দামামার শব্দে চারিদিক সচকিত। উপস্থিত অসংখ্য রাজ অনুচর, সৈন্য ও সামন্ত রাজার দল। আর তারই মধ্যে সাধারণ জনগণের বিস্মিত জমায়েত, যাদের মধ্যে নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ থেকে নানা ধর্মাবলম্বী সাধু-সন্ন্যাসী, সংসারী বা সহায়-সম্বলহীন ভিক্ষুক, কেউ বাদ নেই।
ধীরে, খুব ধীরে আমার মধ্যে যেন চেতনার সঞ্চার হতে লাগল। ক্রমে ক্রমে স্মৃতির ধূসর আবরণ সরে গিয়ে উন্মোচিত হতে লাগল আমার বর্তমান পরিচয়। এই আমি তো সেই, যে কিছুকাল আগেও ছিল আর্যাবর্তের কান্যকুব্জ নগরীর এক সাধারণ নাগরিক। সামান্য এক পর্ণকুটিরে অতি নগণ্য এক কৃষক পরিবারে ছিল তার নিত্য কালাতিপাত। আজ সে উত্তীর্ণ হয়েছে রাজরক্ষীরূপে। আর সেই রাজা, পুষ্যভূতি বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট, রাজা প্রভাকরবর্ধনের সুযোগ্য পুত্র সম্রাট হর্ষবর্ধন। তিনি তাঁর রাজধানী স্থানেশ্বর থেকে কান্যকুব্জে স্থানান্তরিত করার ফলেই জীবনে এই অভাবিত সু্যোগ এসেছে আমার। তুচ্ছ আর অবহেলিত জীবনে লাভ করেছি গর্বের প্রতাপ।
আর সেই পরাক্রমশালী রাজা মহারাজাধিরাজ শ্রীহর্ষ, তাঁরই তো জীবনের সর্বোত্তম উৎসব এটি। প্রয়াগের তীরে প্রতি পাঁচ বৎসরে একবার করে আয়োজিত এই মেলার তিনিই তো স্থপতি! এ যে এক মহা মেলা! দানধ্যানের এক পুণ্য উৎসব। এক ঐতিহাসিক মহা সঙ্গম। পৃথিবীর আর কোনও দেশের কোনও রাজার শাসনকালেই এ ঘটনা ঘটেনি।
হ্যাঁ। একে একে সবকিছু এখন আমার কাছে স্পষ্ট। খুলে যাচ্ছে স্মৃতির আবরণ। বিগত আড়াই যুগ ধরে এ ঘটনা ঘটে আসছে ভারতবর্ষের বুকে। সম্রাট হর্ষবর্ধনের এই দানের মেলা আড়ম্বরে আর জাঁকজমকে ভারতের বুকে এক নব উন্মাদনার সৃষ্টি করেছে বিগত ত্রিশ বৎসর ধরে। গোটা আর্যাবর্তের মানুষ এখন জেনে গেছেন যে, প্রয়াগের তীরে এই পুণ্যভূমিতে তিনি আসবেন প্রতি পাঁচ বৎসরে একবার, আয়োজন হবে এই বিশাল উৎসবের, আর সেই পাঁচ বৎসরে অর্জিত তাঁর যাবতীয় নিজস্ব সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নিঃস্ব আর কপর্দকশূন্য হয়ে তিনি ফিরে যাবেন তাঁর রাজধানী কনৌজে, শুরু করবেন আবার তাঁর রাজার ভূমিকা, একেবারে শূন্য থেকে। কেবলমাত্র রাজ্যচালনার জন্য তাঁর নিকট থেকে যাবে সৈন্যসামন্তের দল, তাদের সামরিক সাজসজ্জা আর হস্তী ও অশ্বের বাহিনীটুকু।
আর এই আমি, রক্ষী বীরভদ্র, আমিও সেই দলেরই একজন, যে এই সর্বশক্তিমান রাজার বেতনভুক রক্ষী। প্রতি পাঁচ বৎসরে একবার সকলের সঙ্গে আমাকেও এই মহোৎসবের সঙ্গী হতে হয়।
এবারেও তাই হয়েছে। দায়িত্বশীল রক্ষকের ভূমিকায় আমি অবতীর্ণ হয়েছি এই প্রয়াগ সঙ্গমে, রাজা হর্ষবর্ধনের এই পুণ্য দান-মেলায়। গত পঁচাত্তর দিবস ধরে চলছে এই মহা মেলা। আজ তার অন্তিম দিবস। এই বত্সরের মতো দান-মেলার সমাপ্তি। আবার এই উৎসবের জন্য অপেক্ষা করতে হবে পাঁচ বৎসর।
ইতিমধ্যেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ তাঁদের আকাঙ্ক্ষার পাত্র পূর্ণ করে ফিরে গেছেন যে যার দেশে। হিন্দু সন্ন্যাসী, সাধারণ গৃহস্থ, বৌদ্ধ শ্রমণ, এমনকি জৈন ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা এবং অনাথ পঙ্গু ও ভিক্ষুকের দল নদীর স্রোতের মতো এসে দান গ্রহণ করেছেন।
আজ এই অন্তিম দিবসে শুধু অবশিষ্ট আছেন আরও কিছু মানুষ, যাঁরা ঐ দারুনির্মিত দান-মঞ্চের অদূরে রজ্জুর সীমানার বাইরে প্রতীক্ষারত। এই মাত্র কয়েকশত মানুষের দানপ্রাপ্তির মধ্য দিয়েই এবারের মতো শেষ হবে এই দানের উৎসব। সমাপ্তি ঘটবে দীর্ঘ আড়াই মাস ব্যাপী এই পঞ্চবার্ষিকী মেলার।
সেই আয়োজনই চলছে এখন। সঙ্গমের তীরে সাময়িকভাবে তৈরি করা বিশাল গৃহগুলির অভ্যন্তরে স্তূপীকৃত ছিল যে রাশি রাশি স্বর্ণ, রৌপ্য, মহার্ঘ্য পোশাক-পরিচ্ছদ আর খাদ্যসামগ্রী, তা এখন প্রায় নিঃশেষিত। সামান্য কিছু যা অবশিষ্ট আছে, সেগুলি এই মুহূর্তে জমায়েত করা চলছে ঐ দান-মঞ্চের উপর। আজ স্বহস্তে সেগুলি বিতরণ করে নিঃস্ব আর রিক্ত হবেন রাজা। তারপর ফেরার পালা। নিঃস্ব রাজার সঙ্গে আমরা আবার ফিরে যাব কান্যকুব্জে, আগামী পাঁচ বৎসরের প্রস্তুতি নেবার জন্য।
সহসা উচ্চনাদে বেজে উঠল ভেরী। আমরা সারিবদ্ধভাবে মঞ্চের ধারে দাঁড়িয়ে গেলাম দুইভাগে বিভক্ত হয়ে। অদূরে স্কন্ধাবারের সামনে যেন সহসা জেগে উঠল চাঞ্চল্য। সম্রাট হর্ষবর্ধন অবিচলিত পদক্ষেপে স্কন্ধাবার থেকে বেরিয়ে এলেন। হর্ষধ্বনি জেগে উঠল জনতার মধ্যে। সম্রাট এগিয়ে এলেন মঞ্চের দিকে। সঙ্গে রয়েছেন রাজমহিষী ও রাজভগিনী। আছেন সভাকবি বাণভট্ট ও অন্যান্য পণ্ডিতেরা। তাঁদের অনুগমন করছেন সম্রাটের অনুগত বিভিন্ন প্রদেশের রাজারা। এছাড়াও আর একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত এবারে সঙ্গী হয়েছেন রাজার। তিনি হলেন চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ। গত কয়েক বছর যাবত ভারতের বুকে পদার্পণ করেছেন তিনি। আর ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ পরিক্রমা করতে করতে এসে উপস্থিত হয়েছেন কনৌজে, গ্রহণ করেছেন রাজার আতিথ্য। সেই মহা পণ্ডিত হিউয়েন সাঙও মেলা সমাপ্তির এই ক্ষণে মহারাজের পাশে অবস্থান করছেন।
দানসামগ্রী প্রস্তুত। মঞ্চে আরোহণ করে সম্রাট তাকালেন পার্শ্ববর্তী ময়দানের দিকে। সেখানে পাশাপাশি তিনটি অস্থায়ী পর্ণকুটির, যেখানে তিনটি স্বর্ণমূর্তি স্থাপন করা হয়েছে মেলা উপলক্ষে। সেগুলি হল বুদ্ধমূর্তি, সূর্যমূর্তি ও মহাদেবের মূর্তি। সম্রাটের আরাধ্য তিন দেবতা। মেলার প্রথম তিন দিবস পর্যায়ক্রমে ঐ তিন মূর্তিপূজার মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল উৎসবের প্রস্তুতি।
প্রতিদিনের মতো আজও তাই নতমস্তকে সেই দেবতাদের চরণে প্রণতি জানালেন সম্রাট। তারপর তাকালেন হিউয়েন সাঙের দিকে। তাঁকে সম্বোধন করে বলে উঠলেন, “কেমন দেখছেন, পরিব্রাজক? আমার এই পুরুষানুক্রমে পালন করা রীতি, এই দান-মেলার আয়োজন কি আপনাকে তৃপ্তি দিতে পারছে?”
হিউয়েন সাঙ বললেন, “হে সম্রাট, আমার আরাধ্য ধর্ম হল বৌদ্ধধর্ম। কেবলমাত্র বুদ্ধের নীতিকেই আমি আদর্শ বলে জেনে এসেছি আজীবন। আর সেই ভগবান বুদ্ধের একমাত্র লক্ষ্য ছিল মানবসেবা। আপনি নিজেও বুদ্ধদেবের সেই মতাদর্শকেই মাথায় রেখে এই পুণ্য মানবসেবার কাজে ব্রতী হয়েছেন। কাজেই একাজে আমার তো পূর্ণ সমর্থন থাকবেই। আপনি জয়ী হোন, রাজা। যুগে যুগে কালে কালে আপনার নাম স্বর্ণের অক্ষরে লেখা থাক ভারতের ইতিহাসে।”
“সেই আশীর্বাদই করুন ভগবন।” রাজা হর্ষবর্ধন নতমস্তকে প্রণতি জানালেন হিউয়েন সাঙকে। বেজে উঠল শঙ্খধ্বনি। শুরু হল ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী মেলার সমাপ্তি উৎসব।
বেলা দ্বিপ্রহর। শ্রান্ত, ক্লান্ত সম্রাটের ভাণ্ডার অবশেষে শূন্য হল। শেষ প্রার্থীর হাতে সম্রাট তুলে দিলেন তাঁর শেষ দান—একটি স্বর্ণদণ্ড। এটি হাতে নিয়েই সম্রাট বিচারসভা পরিচালনা করতেন। শুধু দণ্ড নয়, এটি তাঁর মনোবল ও বীরত্বের পরিচায়কও বটে। অথচ কী আশ্চর্য, তাঁর প্রতিনিধিস্বরূপ সেই রাজদণ্ড এক সম্পূর্ণ অপরিচিতের হাতে তুলে দিয়েও তাঁর চিত্ত অকুন্ঠ, হাসি অমলিন! তাকালেন পার্শ্বে দণ্ডায়মান রানি দুর্গাবতীর দিকে। তাঁর মুখেও খেলা করে যায় এক রহস্যময় হাসি। উজ্জ্বল দুটি চোখের ভাষা যেন কথা বলে ওঠে। তিনি যে বহুদিন ধরে তাঁকে চেনেন! সম্রাটের এই সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হবার আনন্দের তিনিও যে এক অংশীদার।
এই আনন্দের ভাগীদার হয়ে আমরাও উপভোগ করছিলাম রাজার এই মানসিক তৃপ্তিকে। সেইসঙ্গে একটা নিশ্চিন্ত অনুভূতি খেলা করছিল মনের মধ্যে। যাক, আমরা আমাদের কর্তব্য সুচারুভাবে সমাধান করতে পেরেছি। প্রায় নির্বিঘ্নেই মেলা সমাপ্ত হয়েছে এবছরের মতো।
সহসা অদূর প্রান্তরে একটা আচম্বিত কোলাহল। চমকে দৃষ্টি প্রসারিত করে দেখি, আমার সম্মুখে রক্ষী-প্রহরার অন্তিম প্রান্তে এক সংক্ষিপ্ত জটলা। কী ব্যাপার? নিমেষে সচকিত হয়ে উঠি। বর্শাদণ্ড ধরা হাতের মুষ্টি কঠিন হয়ে ওঠে।
প্রার্থী জনতার দল এখন আর নেই। শুধু রজ্জু সীমানা পেরিয়ে এগিয়ে আসতে চায় এক অশীতিপর বৃদ্ধা, কিন্তু প্রান্ত-রক্ষীদের বাধা পেরিয়ে একবিন্দুও অগ্রসর হতে পারে না। আমরা জানি, দানধ্যানের পালা সমাপ্ত, তাই সেনাধ্যক্ষের নির্দেশে আমরা এখন আর কাউকে রজ্জু সীমানায় প্রবেশ করতে দেব না।
কিন্তু এ কী? সম্রাট নিজেই যে ইঙ্গিত করছেন বাধা সরিয়ে নিতে! কোলাহল শুনে তিনিও কৌতূহলী হয়ে দৃষ্টিনিক্ষেপ করেছিলেন প্রান্তরের দিকে, আর তারপরেই তাঁর এই ইঙ্গিত।
সরিয়ে নেওয়া হল বাধা। অতিকষ্টে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন বৃদ্ধা। কিন্তু লোলচর্ম সেই বৃদ্ধার আকুতি শুনে সম্রাট বিব্রত, বিপর্যস্ত। সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসেছে এই দীনদরিদ্র, অসহায় নারী, সার্বভৌম সম্রাটের কাছ থেকে সামান্য কিছু পাবার আশায়। পথে বহু দুর্যোগ ও অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়েছিল তাকে, তবুও দুর্মর আশায় বুক বেঁধে সব বাধা কাটিয়ে সে এসে পৌঁছেছে রাজার পদপ্রান্তে। এখন এই বিলম্বের জন্য রাজা কি তাকে ফিরিয়ে দেবেন?
কী করবেন এখন সম্রাট? তাঁর যে আর দান করার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই।
কুন্ঠিত নতমুখে রাজা চিন্তা করেন কিছু সময়। তারপর সহসা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর চোখ। ভগিনী রাজ্যশ্রীর দিকে ফিরে অনুচ্চস্বরে কিছু বললেন। তৎক্ষণাৎ রাজভগিনী রাজ্যশ্রীর আদেশে এক রাজ অনুচর দ্রুত গিয়ে নিয়ে এল একটি সাধারণ তুলার বস্ত্র।
আর কী আশ্চর্য! এরপর আমরা যা দেখলাম, তা যেন কল্পনাতেও আনা যায় না। সেই অতি সাধারণ বস্ত্রটি ভগিনীর হাত থেকে নিয়ে পরিধান করে সম্রাট তাঁর নিজের স্বর্ণখচিত রাজবেশ ও উত্তরীয় সযত্নে তুলে দিলেন সেই হতভাগ্য বৃদ্ধার হাতে।
মুহূর্তে বেজে উঠল তূরী-ভেরী-দামামা। আকাশ বাতাস মুখরিত হল সমবেত প্রজাদের জয়ধ্বনিতে—‘জয়তু সম্রাট! চিরং জীবতু সম্রাট! জয় সম্রাট হর্ষবর্ধনের জয়!’
সেই জয়ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছিল প্রয়াগের দিগ্বিদিকে। দামামার গম্ভীর শব্দ প্রকম্পিত করছিল ভূমি। আর সেই বিপুল ধ্বনি যেন দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে আমার সত্ত্বাকে বিবশ করে তুলছিল, নিয়ে যাচ্ছিল এক অচেতনের অন্ধকারে। ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে আসছিল আমার চেতনা।
[জাতিস্মর সুবললাল বসুর প্রথম কাহিনি এখানেই শেষ। পাতার বাকি অংশ ফাঁকা। এরপর আবার একটা পাতা বাদ দিয়ে শুরু হয়েছে লেখা। কিন্তু সে অন্য আরেক কাহিনি, ইতিহাসের অন্য একটা সময়ে দাঁড়িয়ে বলা অন্য আরেক জীবনের কথা। সুযোগ সুবিধে পেলে সে গল্প আবার না হয় শোনাব, অন্য কোনোদিন, অন্য কোনও অবসরে।]
ছবিঃ শিমুল
Very nice.
LikeLike
খুব ভাল লাগল। আরও গল্প শুনতে চাই। পড়তে চাই।
LikeLike