গল্প- জিকোর একটি রাত -সাগরিকা রায় -শরৎ ২০২০

সাগরিকা রায়ের আগের গল্পগুলোঃ যে কোনও দিন, ওরা ভূতপুরোহিতমশাই, ছবি তুলতে গিয়ে, নব মন্ডলের গল্প

মা কপালে চুমু খেয়ে বলল, “এবারে ঘুমোও।”

ঘুমোও বললেই কি ঘুম আসে? বরং তখন কতরকম ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পুরো ক্লাসটা দেখতে পায় তখন জিকো। সারাদিন ক্লাসে কত মজা হয়। ক্লাসের রিকি, প্রত্যাশা, অলীক এক্কেবারে ছাগল! একটু মজা করতে জানে না। কিছু আইডিয়া শেয়ার করতে গেলেই বলবে, “ম্যাম বকবে।” জিকো কি আর এমনি এমনি ওদের ছাগল বলে? সবক’টাই ছাগল। গোট। ওদের আবাসনের সামনের রাস্তায় থাকে একটি ছাগল। আসলে কিন্তু সত্যি করে ছাগল নয়। সে আসলে কুকুর। কিন্তু সে এত ভিতু, এত বোকা যে ওকে বিস্কুট দিলে বুঝতে পারে না ওকেই দেওয়া হয়েছে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। ততক্ষণে কাক বা অন্য কুকুর এসে খাবারটা খেয়ে যায়। বনিদের একটা হুমদো বেড়াল আছে। তার কাজই হল যখন খুশি এসে ছাগলকে পট করে চড় মারা। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দুলে দুলে ল্যাজ খাড়া করে হাঁটবে। মুখোমুখি ছাগলকে দেখলে ফ্যাঁস করে গা ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে। তারপর একটা চড় মেরেই উলটোদিকের বাড়িটিতে ঢুকে পড়ে। সেই বাড়ির বুড়িপিসির আদরের বেড়াল। বনি পর্যন্ত ওকে কিচ্ছু বলতে পারে না। পিসি ওকে খাইয়ে খাইয়ে হুমদো করে তুলেছে। জিকোর মাঝে মাঝে ক্লাসের রিকি-প্রত্যাশাকে ওই ছাগলটার মতো মনে হয়।

ঘুমটা আসব আসব করছিল। কিন্তু একটা অস্বস্তি চুরমুরের মতো মনের মধ্যে গেম খেলছে। জিকো চাদর সরিয়ে উঠে বসল। ঘরের দেওয়াল জুড়ে অরণ্যদেবের বিরাট পোস্টার। আবছা আলোয় অরণ্যদেবকে ফিক করে হাসতে দেখল জিকো। দেখাদেখি ও হাসতে গিয়ে হাসতে পারল না। চোয়ালটা কেমন যেন… অরণ্যদেবকে ‘হাই অরণ্যদেব!’ বলতে গিয়ে ভয়ংকর চমকে গেল জিকো। ‘হাই অরণ্যদেব’ না বেরিয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “ব্যা ব্যা!” মানে? তাড়াতাড়ি করে লাফিয়ে খাট থেকে নামতে যেতেই পরিবর্তনটা চোখে পড়ল। চোখে পড়তেই সেকেন্ড ফ্লোরের রিয়ার ঠাম্মির মতো “কী সর্বনাশ!” বলে উঠেছে জিকো। ওর ফর্সা পা দুটো নেই! না, আছে। দুটো নয়, চারটে পা। সেই পায়ে আঙুল কোথায়? খুরওলা লোমে ভরা কালো কালো চারটে পা! চার পায়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিকো দেখল, ওরই শোবার ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ও নয়, একটা ছাগল দাঁড়িয়ে আছে। লম্বাটে মুখে বোকাটে ফ্যালফেলে চোখ! লম্বা লম্বা কান। গায়ের বিদঘুটে গন্ধটা কি আয়নার ভেতর থেকে আসছে? নাকি জিকো নিজের গা থেকেই গন্ধটা পাচ্ছে? ভয়ে কেঁদে ফেলল জিকো। আর তক্ষুনি আয়নার ভেতরের ছাগলটাও কেঁদে উঠল, “হ্যা ব্যা ব্যা হ্যা, হ্যা ব্যা ব্যা হ্যা!”

জিকো অরণ্যদেবের পোস্টারের দিকে তাকিয়ে দেখল, অরণ্যদেব মুখটা ফিরিয়ে রেখেছে। জিকোর এই দশা তাঁর সহ্য হচ্ছে না। আবার এমনও হতে পারে জিকোর ছাগল হয়ে যাওয়ার থেকে ওর ছাগুলে গায়ের গন্ধটা সহ্য হচ্ছে না বলে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে অরণ্যদেব।

জিকো বিশ্বাস করতে পারছিল না। ও স্বপ্ন দেখছে না তো? ওর ঘরে এখন নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। টিউব লাইট  জ্বালিয়ে দেখবে আসলে সত্যি ও কেমন হয়ে গিয়েছে? আলোর সুইচ অন করতে গিয়ে করতে পারলই না। খুর দিয়ে সুইচ অন করা যায় না। এদিকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। আলো জ্বেলে ভালো করে নিজেকে দেখলে হত। ও কি সত্যি জিকো? নাকি সত্যি ছাগল! কাল স্কুলে যাবে কী করে? স্কুলের গেটেই তো আটকে দেবে ওকে। আর ও যতই বলবে, ‘আমি কুষাণ বসু,’ কেউ কি মেনে নেবে? আচ্ছা, কুষাণ নামটাই বা বলবে কী করে? আয়নার সামনে ফের গিয়ে দাঁড়াল জিকো। মুখ খুলে ভালো করে উচ্চারণ করল, “কুষাণ বসু।” ছাগলটা মানে জিকো বলে উঠেছে, “ব্যা, ব্যা, ব্যা হ্যা হ্যা!”

সারারাত ঘরের মধ্যে হেঁটে হেঁটে বেড়ালো জিকো। সকাল হলেই মা ওকে জাগিয়ে দিতে এই ঘরে আসবে। বেডে একটা ছাগল শুয়ে আছে দেখলে মা কী বলবে? আর সমস্ত বাড়ি, পাড়া খুঁজেও কেউ জিকোকে পাবে না, তখন? মা কি বুঝবে ছাগলটাই আসলে জিকো? এরকমই একটা গল্প পড়েছিল জিকো। সত্যি সত্যি গল্পের ছেলেটা শুয়োরছানা হয়ে গিয়েছিল মনে হচ্ছে। অনেকদিন আগের পড়া গল্প। নাকি মৃদুলদা বলেছিল গল্পটা? ইস, মৃদুলদা যদি জানতে পারে যে জিকো ছাগল হয়ে গিয়েছে, প্রচণ্ড রেগে যাবে। কারণ মৃদুলদা বলেছে, যারা দুষ্টু, তারাই এরকম শাস্তি পায়। জিকো তো তেমন কোনও দুষ্টুমি করেনি। হ্যাঁ, অলীক, রিকি আর প্রত্যাশাকে ছাগল বলে বলে খ্যাপাতে খুব ভালো লাগে। অলীক ছাগল শুনে বলেছে, “আমার কি ল্যাজ আছে যে আমাকে ছাগল বলছিস?”

জিকো গম্ভীর হয়ে বলেছে, “হবে রে। ল্যাজ হবে। রাতের বেলায়।”

শুনে অলীকের মুখটা বেকারির চ্যাপ্টা কুকির মতো হয়ে গিয়েছিল। অথচ এখন জিকো ল্যাজ নিয়ে বসে আছে, আর অলীক মজা করে ঘুমোচ্ছে।

সত্যি সত্যি ছাগল হয়ে গিয়ে জিকো রিকি, প্রত্যাশা, অলীকের কথা ভাবল। ভগবান কি জিকোকে পাপ দিয়েছেন? রোজ রোজ ওদের ছাগল বলাটা মনে হয় ভালো কাজ হয়নি। দুষ্টুমি করতে চায়নি মানেই কি ওরা ছাগল?

রাতভর কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলে গিয়েছে জিকোর। একটু ঘুমোতে পারেনি। কখন সকাল হল, সেটাও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল জিকো। রাস্তা দিয়ে গুচ্ছের ছাগলকে এই সময়ে বাজারের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। জিকো কাঁদছিল। ব্যা ব্যা করেই কাঁদছিল।

দরজায় শব্দ হতেই জিকো বুঝে ফেলল মা এসেছে। এখনই দরজা খুলে ওকে ডাকবে মা। তারপর? ওই যে, দরজাটা খুলে যাচ্ছে। মায়ের গলা পাচ্ছে জিকো।

দরজা খুলে ওকে খাটের নিচে বসে থাকতে দেখে মা অবাক প্রায়, “এ কি! খাটের নিচে কী করছ? সারারাত ঘুমোওনি? জেগে ছিলে নাকি?” বলতে বলতে মা জিকোকে খাটের তলা থেকে টেনে টেনে বের করেছে। “চোখ লাল কেন? সারারাত শব্দ করে করে হাঁটছিলে কেন? পায়ে কি কিছু আটকে গিয়েছিল? আমি দেখতে আসতুম, কিন্তু পরে আর শব্দ পাইনি। তাই ভেবেছি তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ। খট খট শব্দ করে হাঁটছিলে। স্কুলে কি ফ্যান্সি ড্রেস কম্পিটিশন আছে? কী সাজতে হবে?”

“ছাগল…”

“ছাগল? সে কি? ছাগল সাজবে? বেশ, আমি ড্রেস বানিয়ে দেব যেখান থেকে প্রত্যেকবার বানিয়ে আনি, সেখান থেকে। কিন্তু ওরা কি ছাগলের ড্রেস বানাতে পারবে?” মা চিন্তিত।

জিকো মায়ের কথা শুনে অবাক। কী বলছে মা? ছাগল হয়ে যাওয়া জিকোকে চিনতে পেরেছে মা? তাহলে আর “ছাগল সাজবে?” বলবে কেন? জিকো কি ছাগল নেই এখন? প্রায় ছুটে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। ওই যে! ওটা জিকোই তো! সত্যি সত্যি জিকো। মানুষ জিকো। ছাগল তো নয়! তাহলে ছাগলটা কোথায় গেল? চলে গিয়েছে? ওই দরজা দিয়ে পালিয়েছে? মাকে দেখেই কি পালিয়ে গেল?

মাকে ছুটে গিয়ে জাপটে ধরেছে জিকো, “লাভ ইউ মা।”

স্কুলে যাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে থেকে পাড়ার ছাগল মানে নেড়ি কুকুরটিকে বিস্কুট খাওয়াল জিকো। অন্যদিনের মতোই কাক, কুকুর ভিড় করে এসেছিল। ভয় দেখিয়ে ছাগলকে তাড়িয়ে বিস্কুট খাওয়ার একটা চেষ্টাও চালিয়েছিল ওরা।

কিন্তু জিকো এমনভাবে তেড়ে গেল যে ছাগল পর্যন্ত অবাক। জিকোকে দেখল খানিকক্ষণ। তারপরে বীর বিক্রমে কাক আর কুকুরদের দিকে এমনভাবে দাঁত খিঁচিয়ে তাকাল, এমন করে সরু গলায় ‘হৌ-হো-ও-ও-ঔ,’ করে উঠল, ভয়ে কাকগুলো উড়ে গিয়ে মজুমদারদের জুতোর দোকানের সাইনবোর্ডের ওপর বসে পড়ল। আর কুকুরগুলো শান্তনুদের আবাসনের দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকল। কাছে এগিয়ে আসার সাহসই পেল না।

জিকোর খুব আনন্দ হল। ও ছাগলের মাথায় হাত রেখে বলল, “আজ থেকে তুই বাঘু। আর ছাগল নোস। মনে থাকবে? কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার নয়। তাহলেই আর ভয় থাকবে না। ব্যা ব্যা নয়, ঘেউ ঘেউ।”

ছাগল মানে বাঘু সরু টিকটিকে ল্যাজটা নাড়িয়ে চলল। কিছু বুঝতে পারল কি না কে জানে।

আজ ক্লাসে অলীক, রিকি, প্রত্যাশাকে দেখে হাত নাড়ল জিকো, “হাই ফ্রেন্ডস!”

ওরা তো অবাক জিকোর মিষ্টি ব্যবহার দেখে। কিন্তু জিকো জানে গতরাতটা কী ভয়ংকর ছিল।

ছবি:সায়ন মজুমদার

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

1 thought on “গল্প- জিকোর একটি রাত -সাগরিকা রায় -শরৎ ২০২০

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s