গল্প টুসকি মলয় সরকার বর্ষা ২০১৯

টুসকি

মলয় সরকার

হঠাৎ কোথা থেকে কে জানে একদিন ভোরে দেখি আমাদের বাগানের এক কোণে একটি লাল রঙের কুকুর এসে কুকুর কুণ্ডলী হয়ে শুয়ে আছে। চেহারা যে খুব ভাল বা সুদৃশ্য এমন নয়। যেমন আর পাঁচটা রাস্তার কুকুর হয় আর কি। হঠাৎ আমাদের বাগানের কোণটা তার পছন্দ হওয়ার কারণটা বুঝছিলাম না। বাড়িতে তো এক বিড়ালের উৎপাতেই টেকা দায়। তেনারা আবার গৃহিণীর অতিরিক্ত আদরের , অতএব আমিই সেখানে একঘরে। বিশাল মার্জার বাহিনীকে জায়গা ছাড়তে ছাড়তে কোনক্রমে  ঘরের এককোণে জায়গা হয়েছে আমার। আবার কোনক্রমে এই সারমেয় গোষ্ঠীকে যদি জায়গা ছাড়তে হয়, তাহলে শেষ বয়সে যে পিতৃপুরুষের  ভিটেমাটি হাতছাড়া হয়ে আমায় পথেই আস্তানা গাড়তে হবে এই আশঙ্কায় আশঙ্কিত হই। তবু, ভগবানের নাম করে গৃহিণীকে ডেকে দেখাই, যা থাকে কপালে। কপাল বোধ হয় আমার ভাল ছিল না।

গৃহিণী বললেন, “বুঝছ না? কুকুরটার বাচ্চা হবে। অন্য কুকুররা মেরে দিতে পারে, তাই ও লুকানোর জন্য এই নিরাপদ আশ্রয়টা বেছেছে।”

আমি রাগ করে বললাম, “আর জায়গা পেল না, এখানেই আসতে হল? আমি ওকে অন্য জায়গায়  সরাচ্ছি।”

গিন্নী রাগ করে বললেন, “এই সময় কেউ কুকুর বেড়ালকে তাড়ায়? থাক ক’দিন পরে ও নিজেই চলে যাবে।” অগত্যা ভবিষ্যৎ আশঙ্কায় আশঙ্কিত হওয়া সত্বেও তর্কে ক্ষান্ত দিলাম।

লাভ কী হল! আমার কাজ বাড়ল। বাড়িতে প্রায় কুড়িটা বেড়ালের আস্তানা। কাজেই, আগে শুধু বেড়ালের খাবার ব্যবস্থা করতে হত আর এখন তাদের সাথে কুকুরের খাবার যোগাড়ও করতে হবে। এটা সম্যক বুঝতে পারলাম। গিন্নী এটাও বুঝিয়ে দিলেন যে, এই সময় সবায়েরই একটু বেশি ভালমন্দ খাবার দরকার হয়। অতএব…

যথাসময়ে তিনটি কুতকুতে ছোট উলের বলের মত বাচ্চা হল। সারমেয় জননী তাই নিয়ে সগর্বে আরও দৃঢ়ভাবে আস্তানা পাকা করলেন। এরপর বেশ কিছুদিন গেল তাদের দুধ খাওয়ানো, যত্ন করা এই সবের ব্যস্ততায়। আমাকেও যথারীতি নতুন জননীর তোয়াজে ব্যস্ত হতে হল।

এদিকে আমি মনেপ্রাণে চাইছি কবে তারা আমার ‘সাধের বাগান’ ত্যাগ করে। কিন্তু আমার সমস্ত আশায় ঠাণ্ডা জল ঢেলে সার্থক মাতার প্রতিমূর্তি হয়ে  তিনি সার্থক ‘ম্যাডোনা’ হয়ে বাচ্চাদের যত্ন, তাদের খেলাধূলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।আমি যতই গিন্নীকে বলি, “কবে যাবে ওরা?”

তিনি দু’একবার শান্তভাবে উত্তর দিলেন, “যাবে বৈকি, কদিন পরে নিজেই চলে যাবে। ওরা এক জায়গায় বেশিদিন রাখে না। আমিও আশ্বস্ত হই।”

কিন্তু আমার তো ধৈর্য ধরে না। কদিন পর আবার জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে প্রচণ্ড ঝড়ের সামনে পড়তে হল, “ওরা কত পয়সার খাচ্ছে তোমার? সব আমি দিয়ে দেব। কী কর তুমি ওদের জন্য? খাওয়ার দেখার ব্যবস্থা তো আমি করি। তবু তোমার এত গায়ের জ্বালা?”  ইত্যাদি ইত্যাদি।

ছিটকে ভয়ে ভয়ে পিছিয়ে আসি। পাশ ফিরে দেখি বাচ্চা গুলো যেন খুব মজা হয়েছে এমনভাবে পুটপুট করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। মনে মনে ওদের ওপর গজরাতে গজরাতে সরে আসি মাথা নীচু করে।

এরপর সত্যিই এক সকালে দেখি সদলবলে তারা জায়গা ছেড়ে চলে গেছে বেদের দলের মত আস্তানা খালি করে। ভাবলাম বাঁচা গেল। কিন্তু গেল কোথায়? একটু খোঁজাখুঁজি করতেই দেখি, বেশি দূর যায়নি। বাড়ির পাশের গলিতেই আস্তানা গেড়েছে। বেশিদূর না যাওয়ায় গিন্নী নিশ্চিন্ত হলেন যে, ঠিক সময়ে খাবারটাবারগুলো দেওয়া যাবে।

এরপর দিন চলে যাচ্ছিল যথা নিয়মে। 

ক’দিন পরের ঘটনা।  সকালে উঠে দেখি একটি বাচ্চা নিয়ে কুকুরটি আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। আর দুটো বোধ হয় প্রকৃতির নিয়মে  শৈশবেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছে।

এবার কিন্তু মনে হল ওরা মায়ে পোয়ে থেকে যাবারই মতলব এঁটেছে। এই সময় আমার গৃহিণীর বেড়াল বাহিনীর একটি বেড়ালের তিনটি বাচ্চা হয়েছিল, তা বয়সে ওই কুকুর বাচ্চাটির মতই হবে আর কি। ফলে কী হল, বেড়াল বাচ্চা তিনটির সাথে কুকুর বাচ্চাটিও একসাথে দৌড়ঝাঁপ খেলাধুলা করতে লাগল। ইতিমধ্যে বাচ্চাটা একটু বড় হওয়ায় মা’টি বাচ্চাকে রেখে এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি খাবার যোগাড় করতে যেত। আর বাচ্চাটি সারাক্ষণ বেড়াল বাচ্চাগুলোর সাথে খেলায় মেতে থাকত। তখনও তো ওদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদের বুদ্ধি ঢোকেনি। আর বেড়ালের বাচ্চাগুলোর সাথে খেলছে দেখে, আশ্চর্য, বড় বেড়ালগুলোও ওকে বিশেষ কিছু বলত না, যেন, বিজাতীয় হলেও শিশু বলে একটা সন্তানস্নেহ কাজ করত।

মা যখন থাকত না, কুকুর বাচ্চাটা অন্য বেড়াল বাচ্চাদের সাথে খেলত আর মা এলেই সব ফেলে সোজা মায়ের কোলে। মা’টা ধীরে ধীরে অল্পস্বল্প ওর পাকযোগ্য বাইরের খাবার আনতে শুরু করল। কখনও দেখি একটা রুটি মুখে করে এনেছে। আবার কখনও দেখি একটু মাংসের টুকরো, হয়ত রাস্তার হোটেল থেকে ফেলে দেওয়া, তাই এনেছে বাচ্চার জন্য।

আমাদের বাড়িতে বেড়ালদের খাওয়ার একটা জায়গা আছে। সেখানে খাবার দিলে সবাই একসঙ্গেই খায়। সব বেড়ালই,  ছোট বড় নির্বিশেষে, একসঙ্গে এক থালাতেই ভাত মাছ ইত্যাদি খেত। কুকুরবাচ্চাটাও এই দেখে ওদের সাথে একসাথেই খাওয়া শুরু করল। এ এক আশ্চর্য সহাবস্থান। তার বাচ্চাকে বেড়াল মায়েদের যত্ন দেখে কুকুর মা-ও অন্য বেড়ালদের কিছু বলত না। অথচ অন্য বাইরের কুকুরেরা এই বেড়ালদের দেখলেই তাড়া করত বা মারার ফিকির খুঁজত।

এই বেড়াল মা এবং কুকুর মায়ের যত্নে এবং আদরে কুকুর বাচ্চাটা যে কবে বড় হয়েছে, বা আদৌ বড় হয়েছে কিনা সেটাই ভুলে গিয়েছিল। ও বোধ হয় মনে করত, ও ছোট্টটিই আছে। এমন অনেক সময় হয়েছে, যখন বেড়াল মা ওকে ফ্যাঁস করে বা থাপ্পড় মেরে শাসন করেছে। ও তখন চেহারাতে যথেষ্ট বড়, বেশ পূর্ণবয়স্কদের মত হওয়া সত্বেও বেড়ালমায়ের মার বা বকুনি খেয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদত। ওর নিজের মা-ও এ-জন্য প্রতিবেশী বেড়াল মাকে কিছু বলত না। আমার ওদের বেশ একান্নবর্তী পরিবার মনে হত। কুকুরমায়ের ভাব দেখে মনে হত, যেন বলছে, বেশ হয়েছে, দোষ নিশ্চয়ই করেছিস, তাই মেরেছে।

কুকুর ছানাটার এই আদুরে ভাবটা রয়েই গেল। ওর মা এখান ওখান থেকে জোগাড় করে খাবার আনত আর ও বাড়িতে খেত। অনেক বড় বয়স পর্যন্ত ওর মা ওকে এভাবে খাওয়াত। ও নিজে কোথাও কিছু খাবার খুঁজতে যেত না।

ফলত যেটা হল, ও সেই ‘ধেড়ে খোকা’ হয়ে রয়ে গেল। বেড়ালের চড় খেলে কঁদে, মা খাবার আনলে তবে খায়, মা অন্য কুকুরের হাত থেকে বাঁচায়, আর  ও নিজে, অন্য কুকুর তেড়ে এলেই, মায়ের পিছনে লুকিয়ে পড়ে। এমনি ব্যাপার।আমি মানুষদের বাচ্চাকে , বিশেষ করে আজকালের একমাত্র সন্তানদের মধ্যে এই প্রবণতা খুব লক্ষ করেছি। তাদের মা -বাবা রাও, ‘আহা ছেলে ছোট, ও পারবে না’ এই ধারণায় তাদের অকর্মণ্য ‘ধেড়ে খোকা’য় পরিণত করেন, যার ফলভোগ করতে হয় তাদের সারা জীবন। তারা না পারে কোনদিন কোন সুস্পষ্ট মত দিতে, না পারে নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবে কোন কাজ করতে বা যে কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে। ফলে তারা এক-একটি পরনির্ভরশীল  জড়দ্গবে পরিণত হয়। এবং সারা দেশ, সারা জাতি তার ফল ভোগ করে।

এটা মানুষের মধ্যে হয়ত সম্ভব, কিন্তু পশু বা প্রাণীকুল , যারা প্রকৃতির নিয়মে চলে তাদের মধ্যেও যে এরকম হতে পারে, এটা ঠিক দেখি নি। আর অল্প কিছু হল কি না হল , ও ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে। আমার মেয়ে বলল, “বাবা, এ কী কুকুর গো, এ তো বেড়ালের চড় খেয়ে কাঁদে! একটা টুসকি দিলেই কাঁদে! এ তো কুকুরকূলের কলঙ্ক!” 

সত্যিই তাই, ওকে অন্য কুকুররা , ও বড় হলেও, দলে নিল না। ও কারো সঙ্গে মিশতে পারল না। সেই থেকে মজা করে ডাকতে ডাকতে ওর নাম হয়ে গেল ‘টুসকি’।

বেশ চলছিল। আমাদের কুড়িটা বেড়ালের দলে মিশে ও – ও আর একটা বেড়াল হয়ে গেল। দিনের বেশির ভাগ সময়  ও আমাদের বাগানের মধ্যে অন্য বেড়ালদের সাথে খেলত। বড় কুকুর হয়ে ওঠার কোন লক্ষণই দেখা গেল না । ওকে বাগানের বাইরে বের করে দিলেও যেত না। এখানে বাগানের মধ্যে অন্য কুকুরদের ভয় বাঁচিয়ে আনন্দেই থাকত। পাড়ার অন্য কুকুররাও টুসকিকে বাইরে দেখতে পেলেই দৌড়ে আসত কামড়াতে। সঙ্গে সঙ্গে ওর মা-ও বীরাঙ্গনার বিক্রমে বাঘের মত লাফিয়ে কামড়ে তাড়া করে তাদের তাড়াত আর টুসকি সোজা দৌড়ে আমাদের বাগানের নিরাপদ জায়গায়।

আমাদের বাড়ির সামনে বড় রাস্তায় বড় গাড়ি মোটরের ভিড়। এবং সেগুলো চলেও বড় বেয়াড়ার মত খুব স্পিডে। আমাদেরই রাস্তা চলতে ভয় হত। আমরা ভয়ে  ভয়ে থাকতাম , কবে না আমাদের কোন দুর্ঘটনায় পড়তে হয়। আর বেড়াল কুকুররা তো যখন তখন রাস্তা পার হয়। ওরাও কোন সময় চাপা পড়তে পারে। এ নিয়ে রাস্তায় লোকজনের সাথে আমাদের অনেকবার কথা কাটাকাটি , ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে। কিন্তু আজকাল মানুষকে বলে কিছু কাজ হয় না। ঐ ভয়ে ভয়েই থাকতাম।

একদিন সকাল তখন আটটা কি ন’টা হবে। কুকুরের প্রচণ্ড চিৎকারে আমাদের গলির সবাই বাইরে বেরিয়ে এল। এসে দৃশ্য দেখে সকলেই স্তম্ভিত। মা কুকুরটাকে একটা বাইকে পিছন দিকটাতে ধাক্কা দিয়েছে। রক্তাক্ত পিছন পা’টা টেনে টেনে কাঁদতে কাঁদতে কোনরকমে পাড়ার সবাইকে খবরটা জানিয়ে ও চলে এসেছে আমার বাড়ির দরজায়।

এই অবস্থা দেখে গলির সবাই রাগে উত্তেজনায়, কুকুরটার প্রতি মায়ায় বা আগামী দিনের নিজেদের ভবিষ্যত আশঙ্কায় ‘রে রে’ করে দৌড়াল রাস্তায় আততায়ীর উদ্দেশ্যে। সে তখন বিপদ বুঝে গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। এবার তার কোপে পড়ল অন্য চালকেরা। রাস্তা অবরোধ থেকে পুলিশ পর্যন্ত গড়াল সেই ঘটনা। কাগজ পর্যন্ত হয়ত যেতে পারত কিন্তু শেষ পর্যন্ত যায়নি অন্য কোন কারণে। অত ভাবার আমার তখন সময় ছিল না। এদিকে তখন মা কুকুরটাকে নিয়ে চলছে টানাপোড়েন।মুখে জল দেওয়া ইত্যাদি প্রাথমিক চিকিৎসা করে ডাক্তার আনার আগেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।

আর তখন থেকে শুরু হল মাতৃহারা শিশুর কান্না। সে যে কি মর্মন্তুদ কান্না বলে বোঝানো যাবে না। মায়ের মুখে মুখ ঠেকায়, শোঁকে আর কাঁদে মাকে ঘিরে ঘিরে। মানুষও বোধ হয় এমন করে কষ্ট পায় না। সবার চোখই অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল। সবচেয়ে সমস্যা হল, ওর মা যে খাবার এনে খাওয়াত, সেটা তো আর রইল না , ওকে যে সুরক্ষা দিত অন্য কুকুর বা বিপদের হাত থেকে সেটাও  তো আর রইল না। টুসকি প্রকৃতপক্ষেই অনাথ মাতৃহারা হয়ে পড়ল।

আমার বাড়িতে টুসকি, বেড়ালদের সঙ্গে কিছু খেত ঠিকই কিন্তু তাতে তো আর কুকুরের খাওয়া হয় না! যে অভাবটা ওর মা পূরণ করত। কাজেই দুদিন ও না  খেয়ে আর কেঁদেই কাটাল। আমার গিন্নী বললেন, আমাদের আর সব বেড়ালের সাথে ও -ও থাকুক। কাজেই টুসকি থেকে গেল।

ও কিন্তু কখনও আমাদের বাড়িতে ভেতরে ঢুকত না। বাড়ির বাইরে খেত, দরজার মুখেই শুয়ে থাকত ভীতু ভীতু মুখে,  নির্বিরোধী শান্ত শিষ্ট টুসকি।

রাতে মাঝে মাঝে ডেকে উঠে বা আমাদের বাড়িতে কেউ এলে আমাদের ঘেউ ঘেউ করে জানান দেওয়াই ওর কাজ হয়ে দাঁড়াল। যখন বেড়ালদের খেতে দেওয়া হত , ওরও সেটা খাবার সময় স্থির হল। ও ঠিক ওর নির্দিষ্ট পাত্রে গিয়ে খেত।

ও কিন্তু সব বেড়ালদের এমনকি ওর বন্ধু বেড়ালবাচ্ছাদেরও ভয় পেত। আর বেড়াল বাচ্ছাগুলোও, অন্য কুকুরকে ভয় পেত কিন্তু ওকে আদৌ ভয় পেত না; কখনও টুসকির খাবার খেয়ে নিত আর টুসকি দূরে দাঁড়িয়ে দেখত, কখনও ওর ঘাড়ে উঠত, কখনও ওকে এসে ওদের ছোট্ট থাবা দিয়ে  চড় থাপ্পড় লাগাত। আর টুসকি ওই বাচ্চাদের মার খেয়ে ভেউ ভেউ করত।

একদিন  হঠাৎ  দেখি অন্য কুকুররা কখন ওকে একলা পেয়ে কামড়ে পিঠের অনেকখানি খুবলে তুলে নিয়েছে। বেশ ঘায়ের মত হয়ে গেছে।কিছু পোকাও হয়েছে। আগে খেয়াল করিনি। ও -ও , এত যে যন্ত্রণা হচ্ছে কিছুই বলেনি সেটার ব্যাপারে। নির্বিবাদে কষ্ট সহ্য করছে। সেই দেখে তাড়াতাড়ি আবার ওষুধ এনে নিয়মিত দিতে  ঘা টা সারল। ওষুধ দেওয়ার সময় টুসকি ঠিক বুঝত; ও চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ত। গিন্নি একদিন বললেন, “হ্যাঁগো তোমার টুসকি এত রোগা হয়ে যাচ্ছে কেন?”

আমি বললাম, “ওর মা তো আর নেই যে ভাল মন্দ এনে এনে খাওয়াবে, তাই হয়ত।”

গিন্নি বললেন, “ঠিক আছে, তুমি মাংসের দোকান থেকে রোজ ছাঁট আনার বন্দোবস্ত কর।”

অগত্যা তাই করা হল।

গিন্নী টুসকির ব্যাপারে কথা বলার সময় বলেন, ‘তোমার টুসকি’। যদিও আমারও একটু মায়া পড়ে যাচ্ছিল, তবু আমি তর্ক করি , না আমার টুসকি নয়।

মাংসের ছাঁট নিত্য সেবনে ফল হল বৈকি। চেহারা একটু ফিরল। কিন্তু ওর ঐ বেড়াল আর কুকুরদের ভয় আর যাচ্ছে না। ও যেন দিন দিন আরো ভীতু হয়ে পড়ল। আর পৃথিবীর নিয়মই এই যে, তুমি যাকে ভয় পাবে, সে তোমাকে  আক্রমণ করবেই, নিজে কমজোরী হলেও। আর যদি তুমি দুর্বল হয়েও রুখে দাঁড়াও, অনেক সবলই পিছু হটবে।

সেদিন প্রাতঃভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ দেখি, চারটে কুকুর আমার বাড়ির সামনে একযোগে ওকে বাঘের মত

আক্রমণ করেছে, কামড় বসায় আর কি। ও বেচারী গলির মুখে সকাল বেলায় নিশ্চিন্ত মনে চোখ বুজে শুয়ে ছিল। এই দেখে টুসকি চিতপাত হয়ে শুয়ে প্রাণভয়ে পরিত্রাহি চিৎকার করে কাঁদছে ।দেখে তো আর স্থির থাকতে পারি না। হাতে একটা লাঠি ছিল, তাই দিয়ে তাড়া করলাম। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হঠাৎ পা পিছলে আমিই পড়ে গেলাম। আমি পড়ে গেছি আর চোখের সামনে টুসকিকে ওরা মেরে ফেলছে – এই  বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে আমিও জুড়লাম প্রাণপণ চিৎকার। এই চেঁচামেচিতে অনেক লোক, আমার বাড়ির সবাই বেরিয়ে পড়ল। তার ফলে সে-যাত্রা উদ্ধার পাওয়া গেল।

এরপর বেশ কিছুদিন নতুন আর কোন খবর নেই। যেমন চলছিল তেমনই চলছে শুধু টুসকির আমার প্রতি আনুগত্য কেমন যেন একটু বেড়ে গেল- সেটা ওর প্রাণ বাঁচানোর প্রতিক্রিয়ায় কি না  জানি না। ও আমাকে দেখতে পেলেই ছুটে আমার কাছে এসে গায়ে গা দিয়ে ঘষে ভীষণ লেজ নেড়ে আর মুখের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ওর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চেষ্টা করত।

এই চারটে কুকুর একটা দল করেছিল এই এলাকায়। আমি ওদের ‘ফোর মাস্কেটিয়ারস’ বলতাম। এলাকাটা ওরা দাপিয়ে রাখত। অন্য বেপাড়ার কোন কুকুরকে ওদের এলাকায় ঢুকতে দিত না। রাত হলেই ওদের টহলদারি বাড়ত। আর পাড়ার বেড়াল, মুরগী, দুর্বল কুকুর, এইসবের ওপর ওরা চালাত পাড়ার মস্তানের মত গুণ্ডামী।

হঠাৎ একদিন, সকাল তখন প্রায় দশটা হবে, রাস্তায় তখন ব্যস্ত মানুষের ভিড়, গাড়ি মোটরের হর্ণের আওয়াজ। তার মাঝে  ভীষণ ঘেউ ঘেউ।

গিন্নী বললেন, “দেখ তো কী ব্যাপার , টুসকি চেঁচাচ্ছে কেন?”

দরজা খুলে বেরিয়ে যা দেখলাম, তাতে আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না ।

দেখি, সেই চারটে কুকুরের দল, যাদের আমি  ফোর মাস্কেটিয়ারস বলতাম, তারা তাড়া করেছে, আমাদের বাড়ির সেই বেড়ালটাকে যে টুসকিকে বেশি মারত। সেটা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে, বোধ হয় প্রাণভয়ে অর্ধমৃত হয়ে পড়েছে।

টুসকির তখন, বন্ধুর ওপর আক্রমণ দেখে্, হঠাত শিভালরি জেগে উঠেছে। ও ভুলে গেছে যে, এই বেড়ালটাই  ওকে বেশি মারত, ওর খাবার খেয়ে নিত। যে কুকুরের দলকে ও চিরকাল ভয় পেয়ে এসেছে, তাদেরকে ভয় করতেও ও ভুলে গেছে। অবস্থার প্রয়োজন ওকে সমস্ত ভীরুতা থেকে বীর  করে তুলেছে। জাগিয়ে তুলেছে ওর সুপ্ত বীরত্ব।

টুসকি সেই কুকুরগুলোর হাত থেকে বেড়ালটাকে বাঁচাতে বাঘের মত বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কুকুরগুলোর ওপর। আর ‘ফোর মাস্কেটিয়ার্স’ হঠাত এটা দেখে ভ্যাবাচাকা খেয়ে বেড়ালটাকে ছেড়ে লেজ তুলে পালাচ্ছে। ক্ষণিকের জন্য আমার মনে হল, আমার জীবন ধন্য হল। টুসকি ভীতু নাম ছেড়ে বীর হয়েছে।  ওদের তাড়া করে টুসকি রাস্তার উপরে চলে গিয়েছিল। ও যখন দেখল , ওর শত্রুরা ওর চেয়ে ভীতু, কিংবা, নিজেকে চিনতে পারল, এত কালের লুকানো বা জমানো তেজ বজ্র হয়ে বেরিয়ে এসে ওকে বীর করে তুলল।

আর ঠিক তখনই, রাস্তার উপর একটা বাইক তীব্র গতিতে এসে, আমি কিছু করে ওঠবার আগেই, ওর ঠিক পাঁজরে এসে ঘা দিল। আর টুসকি, একবার ,আমার মনে হল বোধ হয়, ‘মা গো’ বলে আর্তনাদ করল।তারপরই  তিন হাত মাটির উপরে উঠে ছিটকে পড়ল।আর আওয়াজ করেনি।

ও যে বীরের জাত, দুর্বলকে বা বন্ধুকে রক্ষা করা যে ওর ধর্ম , সেটা শেষবারের মত প্রমাণ করে টুসকি চলে গেল পরলোকে বীরের জন্য যে নির্দিষ্ট স্থান সেই অমৃতলোকে।

আমার মুখের আতঙ্কিত আওয়াজ গলার মাঝপথে এসে আটকে গেল।

অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s