গল্প তপনানন্দ সেন ও পাখির পালক অরিন্দম দেবনাথ শরৎ ২০১৯

 অরিন্দম দেবনাথ-এর সমস্ত লেখা

অরিন্দম দেবনাথ

গত দু’দিন ধরে রাত দুটোর সময় ছাদের ওপর কিছু একটা আছড়ে পড়ার  শব্দে ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে। আমাদের পাশের বাড়িতে একটা দেয়ালঘড়ি আছে। প্রতি ঘণ্টায় ওই ঘড়িটা থেকে একটা পাখি বেরিয়ে এসে, যতটা বেজেছে ততবার কোঁ কোঁ করে ডেকে, আবার ভেতরে ঢুকে যায়। পাখিটার থেমে থেমে দু’বার কোঁ কোঁ করে ডেকে ওঠার আওয়াজে বুঝতে পারি শব্দটা হচ্ছে রাত দুটোর সময়। 

শব্দের রেশ থামতে না থামতে, একটা পা টেনে টেনে চলার হালকা আওয়াজ টের পাই। মনে হয়, কী যেন একটা অতি সন্তর্পণে হেঁটে বেড়াচ্ছে ছাদের ওপর।তারপর খনিক সময় পরে আশপাশের গাছের কাক শালিকের দল একসঙ্গে ডানা ঝটপটিয়ে ডেকে ওঠে আর আওয়াজটা থেমে যায়।

প্রথম দিন আওয়াজটা পাওয়ার পর ভেবেছিলাম ভামবেড়াল হবে। কারণ মাঝে মাঝে রাত্রিবেলা ভামবেড়ালের দল এসে উৎপাত করে। লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ছাদের কার্নিশে রাখা টব ফেলে, একেবারে নাজেহাল করে ছেড়ে দেয়।

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ছাদে গিয়ে ভামবেড়াল আসার কোন চিহ্ন দেখতে পেলাম না। ভাবলাম আমার শোনার ভুল হবে হয়ত।

দ্বিতীয় দিন রাতে আবার শব্দটা শুনতে পেলাম। ভারী আওয়াজ করে একটা কিছু পড়ল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাশের বাড়ির দেওয়াল ঘড়ির পাখি কোঁ কোঁ করে দু’বার ডেকে জানান দিল দুটো বাজে। বুঝতে পারছি একটা কিছু পা ঘষটে ঘষটে  ছাদময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিছানায় উঠে বসলাম। তবে কি চোর? অন্ধকার ঘরে নাইট ল্যাম্পটা হঠাৎ জ্বলে উঠল। তার মানে এতক্ষণ লোডশেডিং ছিল। একসঙ্গে অনেক কাক শালিক ডেকে উঠল আর পা টেনে টেনে চলার আওয়াজটা থেমে গেল। মনে পড়ল গতকালও এভাবে আলোটা জ্বলে উঠেছিল আর তারপর পাখিগুলো ডানা ঝাপটিয়ে ডেকে উঠেছিল।

পাশে স্ত্রী ও ছেলে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। নভেম্বরের শেষ। হালকা শীত পড়ে গেছে। স্ত্রীকে ডাকতে গিয়েও ডাকলাম না। ভাবলাম একবার ছাদে যাই। চুপ করে বসে রইলাম। মনে পড়ল কাল রাতেও পাখির দল এভাবে ডেকে উঠেছিল আর তারপর আওয়াজটা থেমে গেছিল। শুয়ে পড়লাম।

সকালে উঠে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম-“কাল রাতে কোন শব্দ শুনেছ?”

আমার স্ত্রী উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ শুনেছি তোমার নাক ডাকার! কেন কী হয়েছে?”

বললাম, “না কিছু না।”

ছাদে গিয়ে অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পেলাম না। সব কিছু একদম নর্মাল। কোন টব ভাঙেনি। কোন ফুল ভেঙে পড়ে নেই।

সারাদিন অফিসে বসে কোন কাজ করতে পারলাম না। শুধু থেকে থেকে মাথার মধ্যে একটা কিছু পড়ার শব্দ, আর পা টিপে টিপে চলার আওয়াজ ঘুরতে থাকল। মাথাটা ঝিম মেরে রয়েছে। না একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে।

অফিশ থেকে বাড়ি ফেরার সময় একটা চার ব্যাটারির টর্চ আর ব্যাটারি কিনলাম। অত বড়ো টর্চ দেখে আমার স্ত্রী বললেন –“এত বড়ো টর্চ দিয়ে কী হবে? আজকাল তো সবাই মোবাইলের টর্চ ব্যবহার করে।”

বললাম –“জঙ্গলে বেড়াতে যাবার প্ল্যান করছি। কাজে লাগবে।”

সাধারনত ছাদের দরজাটায় রাতে তালা দেওয়া থাকে। সন্ধেবেলা গিয়ে তালাটা খুলে রেখে এলাম। টর্চটা রেখে দিলাম দরজার পাশে। আজ রাতে ছাদে উঠে দেখতেই হবে!

মাঝরাতে আবার ঘুম ভেঙে গেল। সেই একইরকম কিছু একটা পড়ার শব্দ, তারপর পা ঘষটে ঘষটে চলার হালকা আওয়াজ। পাশের বাড়ির দেওয়াল ঘড়িতে কোঁ কোঁ করে রাত দুটোর ঘোষণা। খানিক পর নাইটল্যাম্পের আচমকা জ্বলে ওঠা, কাক শালিকের দলের চিৎকার করে ডানা ঝাপটানোর শব্দ। আর তারপর পা ঘষটানোর আওয়াজ থেমে যাওয়া… সব ঠিক আগের রাতগুলোর মতো!

ছাদে যাব কিনা ভাবছি। ওমনি একরাশ ঘুম এসে ভিড় করল চোখে। শুয়ে পড়লাম।

খুব ভোর বেলা ঘুম ভাঙল। মাঝে মাঝে সকালে রাস্তায় দৌড়োই। চোখে মুখে জল দিয়ে ট্রাকসুট পরে, পায়ে জগিং-শু গলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। আলো ফোটেনি ভাল করে এখনো। ফিরে এসে ছাদে যাব।

আমাদের পাড়াটা খুব নিরিবিলি। অধিকাংশই বাগান বাড়ি ধরনের। প্রচুর গাছপালা। পাড়াটা ছাড়িয়ে গেলে একটা বিশাল ঝিল। তার পাশে সারি সারি নারিকেল  গাছ। বক আর শামুকখোল পাখির বাসা গাছের মাথায়। গাছের তলাগুলো সবসময় সাদা হয়ে থাকে পাখির বিষ্ঠায়। আমাদের দোতলা বাড়িতে একটা বড়ো পেয়ারা গাছ ছাড়া আর কোন গাছ নেই। তবে হ্যাঁ, ছাদভর্তি ফুল টবের গাছে। আমার পুকুরের খুব শখ। যে হেতু নিজেদের কোন পুকুর নেই, তাই একটা বিশাল বড়ো চৌবাচ্চা করিয়েছি ছাদে। রীতিমত মাছ পুষি সেখানে। অনেক পরিশ্রম করতে হয় গাছ আর মাছের পেছনে।

আমাদের বাড়ি থেকে খানিক এগোলেই প্রথম যে বিশাল প্রাচীর ঘেরা বাড়িটা পরে, সেটা বৈজ্ঞানিক তপনানন্দ সেনের। তিন বিঘা জমির উপর উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিশাল লোহার দরজাওয়ালা পুরনো দিনের দোতলা বাড়ি। বাড়ির দরজায় সবসময় একজন দারোয়ান আর দুটো ভয়ঙ্কর চেহারার কুকুর বসে থাকে। বাড়ির মালিক পাড়ার কারো সঙ্গে মেলামেশা করেন না। একবার ঘটনাচক্রে  আমার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেছিল। আমাকে উনি ওনার বাড়িতে নিয়ে গেছিলেন। বাড়ি ভর্তি হরেক রকম ফল আর মরশুমি ফুলের গাছ। কয়েকটা মালি বাড়িতে থেকে সবসময় বাগানের  দেখাশোনা করে।

তপনানন্দ সেনের বাড়ির পাঁচিলের ধার ধরে জগিং করতে করতে যাচ্ছি, দেখি উনি বড়ো লোহার দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছেন। ওনাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

“গুডমর্নিং মিস্টার সেন, ভাল আছেন?”

ভদ্রলোক খানিক ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন,“ওঃ হ্যাঁ, আপনাকে মনে পড়েছে, সব ভাল তো?”

আরে এই লোকটার সঙ্গে তো রাতের ঘটনাটা আলোচনা করা যেতে পারে! খানিক কুণ্ঠা নিয়ে বললাম, “ইয়ে মানে একটা অদ্ভুত ঘটনা কয়েক রাত ধরে ঘটছে, কিন্তু কী যে হচ্ছে বুঝতে পারছি না?”

“তাই নাকি? আসুন শোনা যাক।” উনি আমাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে চললেন। একটা বড়ো কুকুর আমাদের পেছন পেছন চলল।

নুড়ি পাথর বিছানো খানিকটা পথ পেরিয়ে, পেল্লাই পুরনো আমলের বড়ো কাঠের ফ্রেমের কাচ দেওয়া দরজা ঠেলে ঢুকলাম ওঁর বিশাল বড়ো হলঘরে। দরজা ঠেলে ঢুকতেই, হালকা আলো আপনা থেকে জ্বলে উঠল। ঘরভর্তি অজস্র বইয়ে  ঠাসা আলমারি। ফ্রেমে বাঁধানো বেশ কয়েকটা অয়েল পেন্টিং ঝুলছে দেওয়ালে। সবগুলোই ফুলের ছবি। একটা কালো রঙের টেবিল ঘরটার মাঝখানে। তাকে ঘিরে বেশকিছু কালো চকচকে হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার। উঁচু ছাদ থেকে একটা শেকল নেমে এসেছে টেবিলটার খানিক উপরে। একটা শেড দেওয়া জোরালো আলো জ্বলছে শেকলটার শেষপ্রান্তে। আমরা গিয়ে বসলাম টেবিলটাকে ঘিরে থাকা চেয়ারে। কুকুরটা ঘরের এক কোনায় গিয়ে শুয়ে রইল।

একজন সাদা হাফহাতা জামা ও ধুতি পরা লোক ঘরের ভেতরকার একটা দরজা ঠেলে টেবিলের কাছে এসে চুপ করে দাঁড়াল। মিস্টার সেন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী নেবেন? ফলের রস? চা? কফি?”

আমি বললাম “চা।”

“শোনান আপনার অদ্ভুত ঘটনা,” বললেন মিস্টার সেন।

“ইয়ে মানে কীভাবে বলব … গত তিনদিন ধরে রাতের বেলা ঘটনাটা ঘটছে। রাত দুটো নাগাদ।” ঘরের দরজা ঠেলে নিঃশব্দে এসে, টেবিলে দুকাপ চা নামিয়ে রেখে গেলেন ধুতি আর হাফহাতা জামা পরা ভদ্রলোক। হালকা লাল, দুধ ছাড়া চা। সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে  কাপ থেকে ওঠা হালকা ধোঁয়ার সঙ্গে। চা থেকে এরকম গন্ধও বেরোয়?

মিস্টার সেন বোধহয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। বললেন, “আমাদের পারিবারিক চা বাগান আছে উত্তরবঙ্গে। এই বিশেষ চা, বাগানের খানিক জায়গা নিয়ে শুধুমাত্র আমার জন্যেই তৈরি হয়। আর কোথাও পাওয়া যাবে না এই চা।”

চায়ের কাপে চুমুক দিতে জিভটা একটা অন্যরকম স্বাদ পেল। এই স্বাদ আগে কোনদিন পাইনি। বলতে শুরু করলাম।

“গত তিনদিন ধরে, মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে ছাদে একটা কিছু পড়ার শব্দে। তার খানিক পর পাশের বাড়ির পাখিওয়ালা দেওয়াল ঘড়িটা থেকে একটা পাখি বেরিয়ে এসে দুবার কোঁ কোঁ শব্দ করে। ঘড়ির শব্দে বুঝি রাত দুটো বাজে। তারপর একটা কিছু পা ঘষটে ঘষটে ছাদে ঘুরে বেড়ায়। খানিক পরে আলো জ্বলে ওঠে।”

খানিক দম নিয়ে বললাম, “মানে গত কয়েকদিন ধরে রাতে লোডশেডিং হচ্ছে। আর ঠিক দুটোর পরে আবার কারেন্ট এসে যাচ্ছে। কারেন্ট আসার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কাক শালিক একসঙ্গে পাখা ঝাপটিয়ে ডেকে ওঠে। আর সঙ্গে সঙ্গে পা ঘষটে চলার শব্দটা আপনা থেকে বন্ধ হয়ে যায়।”

“পরপর তিনদিন ধরে একই সময় একই ঘটনা ঘটছে। সকালে ছাদে উঠে দেখছি সবকিছু নর্মাল। আমি ছাড়া বাড়ির আর কেউ কোন শব্দ শুনতে পায় না। আমি ভুতটুতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু সারাদিন ধরে অস্বস্তিতে ভুগছি। কোন কাজ করতে পারছি না। খালি মাথার মধ্যে একটা পা ঘষটানোর হালকা শব্দ ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

তপনানন্দ সেন চুপ করে আমার কথা শুনছিলেন।আমার কথা শেষ হতে  বলে উঠলেন “ইন্টারেস্টিং। আপনার ছাদটা একটু ঘুরে দেখা যেতে পারে?”

“অবশ্যই, আপনাকে কী বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাব! যাকেই ঘটনাটা বলি, সে-ই হেসে উড়িয়ে দেয়। নতুবা বলে, তোমার ছাদে ভুত আছে, রোজা ডাকো। শুধু আপনিই…”

“এতে কৃতজ্ঞতা জানাবার কী আছে? রহস্যের তো এখনও কোন কিনার হয়নি!”

টেবিলের ওপর পড়ে থাকা একটা সাইড ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নিলেন উনি। কাচের দরজা ঠেলে আমরা বেরোতেই আলোগুলো নিভে গেল। কেউ কি নিভিয়ে দিল না আপনা থেকে নিভে গেল বুঝতে পারলাম না। গাটা ছমছম করে উঠল।

কুকুরটা ঘর থেকে আমাদের পিছু নিয়ে, মেন গেটের সামনে এসে শুয়ে পড়ল।

তপনানন্দ সেনের বাড়ি থেকে আমার বাড়ি মিনিটসাতেকের হাঁটাপথ। ওঁর বাড়ির পাঁচিলের পাশ দিয়ে বাড়ির ঠিক পেছনে এলে খানিক ফাঁকা জায়গা। সেটা ছাড়িয়ে একটু এগোলে গোটাদশেক একতলা, দোতলা বাড়ি। তারই একটা আমাদের। জায়গাটা ফাঁকা হলে হবে কী? রাস্তাঘাট শক্তপোক্ত, পিচঢালা।

নিঃশব্দে আমার পেছন পেছন হাঁটছিলেন মিস্টার সেন। বাড়িগুলোর কাছাকাছি আসতে বললেন, “এদিকে আগে কোনোদিন আসিনি।”

বাড়ির দরজায় পৌঁছে ডোরবেল বাজাতে দরজা খুলে দিলেন আমার স্ত্রী।

মিস্টার সেনকে দেখিয়ে বললাম “ইনি বৈজ্ঞানিক তপনানন্দ সেন, ওঁকে আমাদের ছাদের ফুল দেখাতে নিয়ে এসেছি।”

তপনানন্দ সেনের নাম শুনে আমার স্ত্রী কেমন যেন ঘাবড়ে গিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। বৈজ্ঞানিক তপনানন্দ সেন বোর্ড লাগানো প্রাচীর ঘেরা বিশাল বাড়িটা সবাই চেনে। কিন্তু তপনানন্দ সেনকে খুব কম লোকেই দেখেছে। আমার স্ত্রীও কোনোদিন দেখেননি, তাই চেনেনও না। আমি ইচ্ছে করেই ফুল দেখাবার কথা বলেছি। রাতের কথা বললে, পরে দশটা কথা শুনিয়ে আমাকে পাগল প্রমাণ করে ছাড়বে!

সিঁড়ি বেয়ে সোজা তিন তলার ছাদে চলে এলাম। ছাদ ভর্তি ফুলের গাছ। গাঁদা, ডালিয়া আর বিভিন্ন ধরনের চন্দ্রমল্লিকা ফুল ছাদময়। আর আছে অনেক ধরনের গোলাপ। ছাদের খানিকটা অংশের ওপরে টিনের শেড দেওয়া। শেডের নিচে আমার সখের বড়ো সিমেন্টের চৌবাচ্চা, তাতে লাল কালো হলুদ নীল বাহারি মাছ ভর্তি। দশ ফুট লম্বা, দু’ফুট চওড়া ও দু’ফুট উঁচু চৌবাচ্চাটা। সামনের দিকটায় কাচ বসানো। আমার নিজের ডিজাইনে তৈরি। সবাই কাচের অ্যাকুয়ারিয়ামে মাছ পোষে আর আমি আমার নিজের মতো তৈরি অ্যাকুয়ারিয়ামে।

মিস্টার সেন সমস্ত ছাদ ঘুরে ঘুরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব ফুল গাছ দেখলেন। ফুলের প্রশংসা করলেন খুব। তারপর এলেন আমার সবচাইতে প্রিয় অ্যাকুয়ারিয়ামের কাছে। অ্যাকুয়ারিয়ামের ওপরটা খোলা, কিন্তু কয়েকটা  টুকরো টুকরো হালকা নেট দিয়ে ঢাকা। একদম শেষের নেটটা  নীচে পড়েছিল। নেটটা ঢাকা দিতে ভুলে গেছিলাম নিশ্চই! আজকাল ভুলে যাচ্ছি খুব।  

মিস্টার সেন নেটটা তুলে চৌবাচ্চাটার ওপর চাপা দিলেন। নেটটা মাপে অনেক বড়ো। মাপ মত কাটব কাটব করেও কাটা হয়ে ওঠেনি। একদিকে ঝুলে থাকে অনেকটা। হালকা হবার দরুন একদিকে ঝুলে থাকা দিকটায় একটু চাপ পড়লেই, চৌবাচ্চার ওপর থেকে নেটটা নিচে পড়ে যায়। মিস্টার সেন সেটা লক্ষ করেছিলেন। বারবার উনি নেটটা চৌবাচ্চায় বসাচ্ছিলেন আর এককোনায় চাপ দিয়ে নিচে ফেলে দিচ্ছিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে খানিক হেসে বললেন, “নেটটাকে মাপ মত কেটে বসান আজই। দেখুন রাতে আর কিছু হয় কি না! কাল সকালে পারলে একবার আমার বাড়িতে আসুন।”

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললাম, “একটু চা খেয়ে যান না। প্রথম এলেন আমাদের বাড়ি!”

উনি বললেন আর একদিন আসবেন।

মিস্টার সেনের সঙ্গে নিচে নেমে এসে ওঁকে ওনার বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসতে চাইলাম। উনি বললেন, উনি একাই চলে যেতে পারবেন। আমি যেন অবশ্যই নেটটা ঠিক করার ব্যবস্থা করি।

একটা বড়ো কাঁচি দিয়ে হালকা অ্যালুমিনিয়ামের নেটটা মাপ মত কেটে বসিয়ে দিলাম চৌবাচ্চাটার ওপর। তারপর স্নানখাওয়া সেরে অফিস ছুটলাম।

সারাদিন অফিসে কাজে মন বসল না। মাথায় খালি ঘুরে ফিরে আসছে, মিস্টার সেন নেটটা ছোটো করে কেটে বসাতে এত জোর দিলেন কেন? উনি কি অন্য সবার মত আমারও মনের ভুল ভেবেছেন? ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলেননি? আজ রাতে কি আবার শোনা যাবে শব্দটা? নাঃ আজ রাতে কোন আওয়াজ শুনলে আমি ছাদে যাবই যাব।

অফিস থেকে ফিরে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম।

কাকের ডাকে যখন ঘুম ভাঙল, তখন সকাল হয়ে গেছে। প্রায় ছ’টা বাজে। তার মানে রাতটা নিঃসাড়ে ঘুমিয়েছি? রাতে কিছু হয়নি! 

হাত মুখ ধুয়ে ছুটলাম মিস্টার সেনের বাড়িতে। দারোয়ানকে নিশ্চই কিছু বলা ছিল। আমাকে দেখে গেটটা খুলে ধরে দারোয়ান বলল, “সোজা ভেতরে চলে যান, বাবু বাড়িতেই আছেন।”

কালকের মত আজকেও সেই বড়ো কুকুরটা আমার পাশে পাশে নুড়ি পাথর বিছানো পথটা ধরে এল। তারপর দরজাটার পাশে পৌঁছে থাবা  দিয়ে দরজার নিচের কোণার একটা বোতাম টিপল। খুলে গেল দরজাটা। কুকুরটার সঙ্গে সঙ্গে আমিও ঘরে ঢুকলাম। মিস্টার সেন টেবিলের পাশের চেয়ারে বসে একটা পাখির বড়ো পালক নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। মুখ না তুলেই বললেন, “গুডমর্নিং, ভাল ঘুম হয়েছিল তো? আশা করি আর কোন আওয়াজ শুনতে পাননি?”

“নাঃ,কাল রাতে আর কোন আওয়াজ হয়নি। এমনকি আমার ঘুমও ভাঙেনি!”

চা এসে গিয়েছিল। কালকের সেই মনভোলানো চা। টেবিলে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখতে সমস্ত ঘরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল চায়ের গন্ধ।

মিস্টার সেন বললেন, “নিন চা নিন। আর এই নিন আপনার রহস্য।” বলে একটা পাখির বড়ো পালক  আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।

আমি পাখির পালকটা হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। পাখির পালক! এটা আবার কী রহস্য?

আমার মুখের ভাব লক্ষ করে মিস্টার সেন টেবিলের ড্রয়ার থেকে ছোটো একটা সিল করা প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করলেন। তার ভেতর একটা আধখাওয়া কমলা হলুদ রঙের গোল্ডফিশ মাছ আর আরও একটা পাখির পালক!

“কিছু বুঝতে পারলেন?”

“নাহ!”

“এটা কোন পাখির পালক জানেন? শামুকখোল।”

“একটা বড়ো ঝিল আছে খানিক আগে। ওর পাশের নারিকেল গাছগুলোতে অনেক বক আর শামুকখোল পাখির বাসা। আপনাকে আগে যে পালকটা দিলাম, সেটা গতকাল আমি ওই ঝিলের ধার থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছি।”

আমার মাথা বোঁ বোঁ করছে। আধখাওয়া গোল্ডফিশ, শামুকখোল পাখির পালক! এর সঙ্গে  আমার ছাদের আওয়াজের কী সম্পর্ক?

“ওই প্যাকেটের মধ্যে যে আধ খাওয়া মাছ আর পালকটা আছে সেটা আপনার বাড়ির ছাদ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া। আপনাকে না দেখিয়ে আমি ওগুলো আমার সাইড ব্যাগে ভরে নিয়েছিলাম।”

“এবার কিছু বুঝতে পারলেন?”

“আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না!”

“নিন চা টা আগে শেষ করুন।” বললেন মিস্টার সেন।

“ ‘কিছু পড়ার’ আওয়াজের রহস্যটা হল আপনার চৌবাচ্চার বড়ো নেটটা। ওই নেটগুলো সম্ভবত আপনি আগে ভারী কিছু দিয়ে চাপা দিয়ে রাখতেন।”

ঢোঁক গিললাম। লোকটা তো একজন বৈজ্ঞানিক। ম্যাজিকও জানেন নাকি? আগে একটা লম্বা বাঁশ আড়াআড়ি করে দিয়ে রাখতাম নেটগুলোর ওপর। বেশ কিছুদিন ধরে আর বাঁশটা চাপাই না।

“বুঝলেন পাখিটা খুব চালাক,” বললেন মিস্টার সেন, “আপানার মাছের চৌবাচ্চার সন্ধান ও পেয়ে গিয়েছিল।

“নাহ, একটু খুলেই বলি। একটা শামুকখোল ঘুরতে ঘুরতে কোন ভাবে আপনার মাছ ভর্তি চৌবাচ্চার খোঁজ পায়। আগে নেটগুলো বাঁশ দিয়ে চাপা থাকার ফলে ও জলে পৌঁছতে পারেনি। তারপর ওই দিনচারেক আগে রাতে কোন কারণে উড়তে উড়তে আপনার ছাদে আসে। তারপর বসবি তো বস ওই লম্বা নেটটার এক কোনায়। নেটগুলো বাঁশ দিয়ে চাপা দেওয়া ছিল না। একপাশে ভার পড়তে নেটটা চৌবাচ্চা থেকে উল্টে পড়ে যায়। আর পাখিটা আপনার একটা গোল্ডফিশ ঠোঁটে তুলে নেয়। ওই নেট পড়ার আওয়াজটাই আপনি পাচ্ছিলেন। কাল রাতে আওয়াজটা পাননি কারণ, আপনি নেটটা কেটে ঠিক করে দেওয়াতে পাখিটা আর নেটটা খুলে ফেলতে পারেনি।”

“সে তো বুঝলাম, কিন্তু ওই পা টেনে টেনে চলার আওয়াজটা? আর পাখিগুলোই বা সবগুলো একসঙ্গে ডানা ঝাপ্টিয়ে ডেকে উঠবে কেন? আমি ছাড়া আর কেনই বা কেউ কোন শব্দ পেল না?” আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম।

“আর এককাপ চা খাবেন? আপনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।” মিস্টার সেন বললেন।

“সরি সরি আমার চিৎকার করে ওঠা উচিৎ হয়নি। না না, চা চাই না। আপনি বলুন ঠিক কী ঘটেছিল?” আমি বললাম।

“আপনি বক জাতীয় পাখির হাঁটা দেখেছেন? দেখবেন ওরা ওদের লম্বা লম্বা পা দুটো কেমন টেনে টেনে চলে। জলের মধ্যে কেমন এক পা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে?”

“মাছটা মুখে পুরে ও ছাদের মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। সেই আওয়াজটাই আপনার কোন কিছুর পা ঘষটে ঘষটে চলার আওয়াজ বলে মনে হয়েছে। হয়ত এক এক দিন একাধিক মাছ খেয়েছে পাখিটা। একটা আধখাওয়া মাছ পেয়েছি আপনার ছাদের ফুল গাছের একটা টবের পাশে।”

“আপনি ছাড়া আর কেউ কিছু টের পায়নি কারণ, আপনার ঘুম সম্ভবত খুব পাতলা। তাছাড়া যেহেতু শীত পড়ে গেছে, তাই ফ্যান, এসি সব বন্ধ,  তাই আওয়াজটা খুব প্রমিনেন্ট হয়ে ধরা পড়েছে আপনার কানে। এবং আপনার কানে খুব লো-ফ্রিকোয়েন্সি  আওয়াজ ধরা পড়ে। আপনার শ্রবণশক্তি খুব ভালো।”

“আর একসঙ্গে অতগুলো পাখির আওয়াজ আর ডানা ঝাপটানো নেহাতই কাকতালিয়!” বললেন মিস্টার সেন।

“লোডশেডিং এর পরে হঠাৎ মাঝরাতে রাস্তার আলোগুলো জ্বলে ওঠাতে বিরক্ত হয়ে ওরা চিৎকার করে উঠছিল। আমি খবর নিয়েছি গতকাল রাতে লোডশেডিং হয়নি। তাই পাখিগুলোও ডাকেনি।”

আমি মিস্টার সেনের হাতটা জড়িয়ে ধরলাম। “এতদিন আপনাকে বৈজ্ঞানিক বলে জানতাম। এখন দেখি আপনি একজন গোয়েন্দাও!”

অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

1 thought on “গল্প তপনানন্দ সেন ও পাখির পালক অরিন্দম দেবনাথ শরৎ ২০১৯

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s