আগের অংশ – একেকজনের পুষ্যি হরেক না-মানুষ বন্ধুরা- গোবিন্দ রুবাই, মদন আর জলবাসীরা
আমার এ পর্যন্ত জীবনকালে যেসব না-মানুষ পশুপাখিদের সংস্পর্শে এসেছি, তারা সকলেই বন্ধুস্থানীয় একথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। নেহাত সত্য রক্ষার খাতিরে তাদের কারও কারও সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করাও বাঞ্ছনীয়।
কলকাতায় এসে ইস্তক যে স্কুলে পড়েছি তা ছিল হাঁটা-পথের। বাঙালি জাতির ট্র্যাডিশন মাথায় রেখে প্রায়ই শেষমুহূর্তে বেরোতাম। ফলে পনেরো মিনিটের হাঁটা-পথ দশ মিনিটে নামিয়ে আনতে হত—বিশেষত পরীক্ষার দিন হলে। এরকমই এক পরীক্ষার দিন জনাকীর্ণ ফুটপাথ দিয়ে চলেছি দ্রুতপদে। এমন সময় বাঁকানো শিঙের এক পথচারী ষাঁড় আমার প্রতি আকৃষ্ট হলেন। তিনি শান্ত হয়ে আমার দ্রুত ধাবন দেখতে লাগলেন। তাঁর প্রশান্তি দেখে যে কারোরই মনে হবে তিনি সবরমতী থেকে সদ্য প্রত্যাগত। আমার অবশ্য তত লক্ষ করবার সময় ছিল না। আসন্ন প্রশ্নপত্রের সম্ভাব্য দুরূহতাই বোধ হয় আমার মনকে সম্পূর্ণ অধিকার করে ছিল। যাই হোক, তাঁর প্রায় মুখোমুখি হতেই (প্রায় কারণ আমি ফুটপাথ-প্রান্তচারী আর তিনি পথপ্রান্তে অবস্থিত) তিনি সেই অটল গাম্ভীর্য বজায় রেখেই আমার ধাবমান দু-পায়ের ফাঁকে তাঁর শিং-জোড়া আলতোভাবে ঢুকিয়ে দিলেন। গতি ও স্থিতিজাড্যের সমাপতনের অনিবার্য নিয়মে আমি দু’জন পথচারীর ফাঁক দিয়ে শূন্যে কিছুটা উড়ে গিয়ে চিত হয়ে পড়লাম। পিঠে আড়াই-সেরি একটা ব্যাগ থাকায় সেটা পিঠের গদির কাজ করল। আমিও অচিরেই খাড়া হলাম। এদিকে ষাঁড় বাবাজিও তাঁর কাজটি মিটে যেতেই ষণ্ডেন্দ্র দুলকির চালে অন্যদিকে হাঁটা দিয়েছিলেন। তাই তাঁর এহেন আকস্মিক কর্মের কারণ জেনে নেওয়ার সুযোগ ঘটেনি। তখন আঘাতজনিত ব্যথার দিকে লক্ষ করবারও সুযোগ ছিল না। পরীক্ষা শেষে দেহে এবং মনে কালশিটে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম।
এই গল্পের একটি উপসংহার আছে। অনেকদিন অবধি আমার মনে একটা দুঃখভরা প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল যে এত পথচারীর মধ্যে থেকে ষাঁড় বাবাজি আমাকেই বাছলেন কেন। কেন আমার সঙ্গেই এমন হয়, আধুনিক রাজভাষায় বলতে গেলে why me? একবার মুখ ফসকে আমার বন্ধু দেবজ্যোতিকে বলেছিলাম এই প্রশ্ন সহযোগে কাহিনি। শুনে সে তার জীবনের একটি ঘটনা বলে আমাকে সান্ত্বনা দিল। সে একদিন বাজারে ছাতাহীন অবস্থায় প্রবল বর্ষায় আক্রান্ত হয়েছিল। তখন আশ্রয় নেয় এক বন্ধ দোকানের শেডের নিচে। একটু পরেই এক হোমড়া-চোমড়া ষাঁড়ের আবির্ভাব। স্বাভাবিকভাবেই তার মাথাতেও ছাতা ছিল না। সে সোজা গিয়ে দেবজ্যোতির পেটে একটি অহিংস গুঁতো মেরে ওকে শেড-চ্যুত করে নিজে সেখানে দাঁড়াল। দেবজ্যোতি অগত্যা ষাঁড়ের ঠিক পাশে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকল। অহিংস গুঁতো বলছি কারণ ওর আমার মতো কালশিটে পড়েনি। গল্পটা শুনে আমি বললাম, “এ হতেই পারে না। আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এটা বানানো।”
সে বলল, “সেটা হলে আমিই সবচেয়ে খুশি হতাম।”
আমাকে নিঃশঙ্ক করতে দেবজ্যোতি আরেকটি গল্পও বলেছিল। ও তখন লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করে। একদিন যেতে যেতে জানালা দিয়ে দেখতে পেল সামনে খালের ধারে এক প্রৌঢ় প্রাকৃতিক বেগ সামলাতে না পেরে বসে পড়েছেন। তাঁর ধুতির পশ্চাদ্ভাগ পিঠের ওপর তোলা। একটি খোলা ছাতা তাঁর পৃষ্ঠদেশে মেলে ধরে ট্রেনযাত্রীদের কাছ থেকে তিনি লজ্জা নিবারণ করছেন। এই সময় এক কৌতূহলী বকের আবির্ভাব। সে প্রৌঢ়ের সামনে কৌতূহলী চোখ মেলে বসে পড়ল। তিনি বিরক্ত হয়ে পিঠের ছাতাটিকে সামনে এনে তাকে তাড়ান, আবার পিঠ বে-আব্রু হয়ে গেছে খেয়াল হওয়ায় সেটিকে যথাস্থানে সন্নিবেশিত করেন। তখন কৌতূহলী বকের পুনরাবির্ভাব। এইভাবেই পর্যায়ক্রমে চলতে থাকল, যতক্ষণ না ভদ্রলোক চলন্ত ট্রেনের দৃষ্টিপথের আড়ালে সরে গেলেন।
ষণ্ডেতর প্রাণীরও অ-স্নেহস্পর্শ যে একেবারে পাইনি তা নয়। একবার সন্ধেয় কালীঘাটে এক পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা করতে চলেছি। যখন মন্দিরের উলটোদিকের ফুটপাত ধরে চলেছি তখন হঠাৎ মন্দির ঘেঁষে শুয়ে থাকা কুকুরের পালের মধ্যে থেকে একটা কুকুর এসে আমার প্যান্ট কামড়ে ধরল। তারপর মায়াময় চোখদুটি মেলে দিয়ে চুপ করে বসে থাকল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমিও থেমে গেলাম। চেয়ে দেখি শান্ত স্থির কুকুরটির মুখের কবলে আমার প্যান্টের অংশ। আমি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চিৎকার করে ধমক দিয়ে উঠলাম। কুকুরটিও বাধ্যভাবে আমাকে মুক্তি দিয়ে তার সঙ্গীদের দিকে ফিরে গেল। তাকিয়ে দেখলাম প্যান্টের ছেঁড়া টুকরোটা ঝুলছে, কিন্তু রক্তপাতের চিহ্ন নেই। বাড়ি ফিরে জায়গাটা ডেটল জলে ধুয়ে নিলাম। প্যান্টটা ছিল মোটা কর্ডুরয়ের কাপড়ের। সেটাকে দোকানে রিফু সেলাই করিয়ে নিয়ে অনেকদিন পরেছিলাম। তখন আর নিয়মমাফিক ইঞ্জেকশন নেওয়া হয়নি। যারা এই ঘটনাটা জানে এবং আমাকে চেনে তারা প্রায়ই বলে থাকে, আমার মধ্যে মাঝে মাঝে যে একটু অপ্রকৃতিস্থতার লক্ষণ দেখা যায়, সেটা ঐ কুকুরটির কামড়েরই ফল।
সম্পাদকীয় সংযোজনঃ
বলা বাহুল্য, এ-কাহিনির দেবজ্যোতি মানে এই অধম সম্পাদক। অতএব শেষপাতে একখণ্ড মধুরেণ জুড়ে দেবার সুযোগ ছাড়ি কেমন করে? ভাটপাড়ায় গঙ্গার ধারে যে কালীবাড়ি আছে, মাঝে মাঝে সাইকেল চালিয়ে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখবার বাতিকে তার ধাপিতে বসতাম। আর আমাকে দেখলেই কোথা থেকে এক দুর্বিনীত ষাঁড় সেখানে এসে হাজির হয়ে আমার পাশে সূর্যাস্ত দেখতে দাঁড়াত। তার বড়ো বড়ো শিং। গলায় বিরাট গলকম্বল। সে দাঁড়ানোর ফলে আমার আশেপাশে ভিড় থাকত না। বেশ ডিল্যুক্স সিটে বসে সিনেমা দেখবার মতো সূর্যাস্ত দেখা যেত। তবে এহেন প্রোটেকশনের বদলে ষণ্ড একটা ট্যাক্স নিত আমার থেকে। সূর্যাস্ত দেখতে-দেখতেই খুব মোহিত ভঙ্গীতে সে তার গন্ধে ভরা গলকম্বলটি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরত এবং ‘গ্রাম’ করে শব্দ করত। তখন, যতক্ষণ তার প্রয়োজন ততক্ষণ আমাকে সেই গলকম্বলে হাত বুলিয়ে চলতে হত। এই সময় কোনও কারণে আমি উঠে দাঁড়াতে চাইলে সে তার সুবিশাল মুণ্ডুর আদরের চাপে আমাকে ফের ধাপিতে চেপে বসিয়ে দিত ও আমাদের হেডস্যারের বেতের মতো ভঙ্গীতে তার শিঙদুটো আমার মুখের সামনে নাড়িয়ে দিত। তার কাছে সুদীর্ঘ প্রশিক্ষণের ফলস্বরূপ আজও আমি পেশাদারি দক্ষতায় সুড়সুড়ি দিতে পারি।
ছবিঃ জয়ন্ত বিশ্বাস