গল্প পথের পথিক অরূপ দাস বর্ষা ২০১৯

পথের পথিক

অরূপ দাস

শ্যামলা নদীর ধাঁর ঘেষে দিগন্ত মাঠ পেরিয়ে ভিক্ষু একটা জামরুল গাছের নিচে গিয়ে বসল। সেই কোন ভোর থেকে সে হাঁটছে। তাই সে দুপুরে একটু জিরিয়ে নিতে চায়।

ভিক্ষু চোখ বন্ধ করে জিরিয়ে নিচ্ছে, ঠিক এমন সময় জামরুল গাছ থেকে একটা টিয়া পাখি ভিক্ষুর কোলে এসে পড়ল। তন্দ্রা কেটে যায় ভিক্ষুর। চোখ খুলে ভিক্ষু দেখে ফুটফুটে একটা টিয়া।

এদিকে টিয়ার সে কী ভয়! টিয়া পাখনা দিয়ে নিজেকে কোনও রকম আড়াল করে রেখেছে। টিয়া যাতে ভয় না পায়, তাই টিয়াকে কিছুক্ষণ ভিক্ষু নিজের কোলে পড়ে থাকতে দিল।

টিয়া ডানা হালকা করে। এরপর আড় চোখে ভিক্ষুর দিকে দেখল। টিয়া দেখে ভিক্ষু তার দিকে মিষ্টি মুখে চেয়ে রয়েছে। এরপর ভিক্ষু ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কী হয়েছে ? তা বুঝতে পেরে টিয়ার চোখ ভিজে গেল। ভেজা চোখ দিয়ে টিয়া নিজের পায়ের দিকে দেখার জন্য ইশারা করল।

ভিক্ষু দেখে আঁতকে ওঠে। টিয়ার পা”দুটি পুড়ে লাল হয়ে রয়েছে। দেরি না করে ভিক্ষু করল কী, পাশের ঝোপ-ঝাড় থেকে কিছু লতাপাতা নিয়ে এল। সেগুলো হাতের তালুতে ভাল করে ডলে তা দিয়ে টিয়ার পা”দুটির উপর প্রলেপ দিল। তার উপর নিজের ধুতি ছিঁড়ে ভাল করে পট্টি বেঁধে দিল।

টিয়ার চোখে মুখে আর ভয় নেই। বরং আড়ষ্টতা কাটিয়ে সে যেন নিজেকে তুলে দিয়েছে ভিক্ষুর হাতে। শুশ্রূষার কোনও ত্রুটি রাখছে না ভিক্ষু। টিয়ার যাতে দুপায়ে ভর দিতে না হয় তাই ভিক্ষু ঝোলাটিকে ঢাল করে, ওর উপরে টিয়াকে শুয়ে দিল।

টিয়া কিছুক্ষণ করুণ দৃষ্টিতে ভিক্ষুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি কত ভাল। দয়ালু।”

টিয়ার মুখে কথা শুনে ভিক্ষু অবাক বনে গেল। ভিক্ষু সেই ঘোরের মধ্যে থেকে বলে উঠল, “তোমাকে আমাদের মতো কথা বলা কে শিখিয়েছে?”

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে টিয়া। এরপর সে মুখ কাচুমাচু করে বলে, “সে অনেক কথা। তোমাকে সব বলব। তার আগে এই ঝোলাতে ভরে তুমি আমাকে অনেক দূরে নিয়ে চলো। এখান থেকে অনেক দূর। অনেক দূর।”

তাই করল ভিক্ষু। টিয়াকে ঝোলাতে ভরে ভিক্ষু হাঁটা ধরল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল; বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ভিক্ষুর আর পা থামে না। অবশেষে সন্ধ্যা প্রায় শেষ হতে যায়, ভিক্ষু পা থামাল।

কিছুটা দূরে এক বাড়িতে সন্ধ্যা প্রদীপের আলো জ্বলছে। সেই বাড়ি থেকেই শুরু হচ্ছে শিমুল গ্রাম। সেই গ্রাম ভারী সুন্দর। দিনের আলোয় সেই গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে হাঁটা ধরলে দেখা যায় চাষি ক্ষেত্রে গরু দিয়ে লাঙল টানছে। ঝিলে মাছ ধরবে বলে জেলে জাল ফেলছে। মাটির ঘরের সামনে বড় উঠোনে বসে গৃহিনীরা নানা কাজে ব্যস্ত। কেউ ঘুটে দিচ্ছে; কেউ বড়ি শুকাচ্ছে; কেউ বা ধান ভাঙছে, আরও কত কাজে মত্ত। প্রত্যেক বাড়িতেই আম – জাম – কাঠাল প্রভৃতি গাছ রয়েছে। পথের দুধারে কত চেনা – অচেনা ফুল হাওয়াতে দোল খেতে দেখা যায়। গাছে গাছে পাখিরা নিভৃতে গান ধরে, কল-কাকলিতে মাতে। ছোট – ছোট ছেলে মেয়েরা কত রকম খেলা খেলে। কিতকিত, তালাচাবি, ডাংগুলি, লেংচা …

শিমুল গ্রামে ভিক্ষুর একটা কুঁড়ে ঘর রয়েছে। ভিক্ষু সেই ঘরে এসে প্রথমেই ঝোলা থেকে টিয়াকে বের করল। টিয়া ঘরের চার পাশ দেখে মুগ্ধ হয়ে বলে উঠল, “খুব সুন্দর ঘর।”

এই কথা শুনে ভিক্ষুর সেই কি হাসি। হাসি বজায় রেখে সে বলে ওঠে, “কুঁড়ে ঘর তোমার সুন্দর দেখাচ্ছে।” এই বলে ভিক্ষু আরও জোরে হাসতে থাকে।

আবেগ জড়ানো স্বরে টিয়া বলল, “ঘর মানে যে ভালোবাসায় ভরা, বিশ্বাস দিয়ে গড়া। এই দুটি না থাকলে রাজপ্রাসাদের ঘর গুলোরও কোনও মূল্য থাকে না।”

টিয়ার কথা শুনে ভিক্ষুর হাসি মুহূর্তের মধ্যে উবে গেল। টিয়ার দিকে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থেকে ভিক্ষু বলল, “তুমি ত সাধারণ পাখি নও! কে তুমি? কীভাবে আঘাত পেলে? সব জানতে চাই।”

টিয়া এবার নিজের পরিচয় দিল। বলল, “আমি উদায়গড়ের জমিদার বিক্রম রায়ের পোষ্য। ছোটবেলা থেকে সেই জমিদারের কাছেই গড়েপিটে বড় হয়েছি। কে জানত, তিনি  স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আমায় নিজের কাছে যত্ন সহকারে রেখেছিলেন।

“একদিন জমিদার বিক্রম রায় আমাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন, ‘তুমি আমার ছেলেকে বাঁচাও, আমার ছেলে মরতে বসেছে। ছেলের বুকে ব্যামো ধরা পড়েছে।’

“জমিদারের ছেলের নাম, কৌশিক। আদর করে সবাই বাবুসোনা বলে ডাকে। বাবুসোনা আর আমার সম্পর্ক বন্ধুর মতো। বাবুসোনা সময় পেলেই আমার কাছে ছুটে আসে। কিন্তু সেদিন সত্যি বাবুসোনার সকাল থেকে দেখা সাক্ষাৎ নেই। আমি তাই জমিদারের কথা বিশ্বাস করে নিলাম। জমিদারকে বলে উঠলাম, ‘বাবুসোনার ব্যামো সারানোর জন্য আমি সব কিছু করতে রাজি। আমাকে কী করতে হবে?’

“জমিদার বলে উঠলেন, ‘স্বপনগড় মন্দিরে গোপাল ঠাকুরের মুকুটের মাঝামাঝি বহুমূল্য হিরে বসানো। সেই হিরে চোবানো জল দিয়ে বাবুসোনাকে স্নান করালে সব ব্যামো সেরে যাবে। সেই হিরে স্বপনগড়ের জমিদার একদিনের জন্যেও দিতে রাজি হচ্ছে না। তাই হিরে চুরি করে আনতে হবে।’

“কথা শেষ হতে না হতেই প্রশ্ন করলাম, ‘সেই হিরে কীভাবে ছুরি করে নিয়ে আসা যাবে?’

“জমিদার উপায় বললেন, ‘স্বপনগড় মন্দিরে সকালবেলায় গোপালের পুজো চলার সময় ধুনো দিয়ে ছোবড়া জ্বালানো হয়। তাই ধোঁয়ার কারণে সেই সময় মন্দিরের জানলা খোলা থাকে। গোপালকে খাওয়ার চড়িয়ে কিছুক্ষণের জন্য সবাই মন্দিরের দরজা ভিজিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। ঠিক সেই সময় জানলা দিয়ে ঢুকে হিরে চুরি করে আনতে হবে।’

“জমিদারের কথা মতো সেই ভাবেই হিরে চুরি করে নিয়ে এলাম। নিয়ে এসে জানলাম, বাবুসোনার কিছু হয়নি। আসলে জমিদার সেই হিরে এক ব্যাপারীকে বিক্রি করবে।”

টিয়া চুপ হয়ে যাওয়াতে ভিক্ষু কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। ভিক্ষু বলল, “জমিদারকে হিরে দিয়েছিলে?”

অভিমান জড়ানো স্বরে টিয়া বলে, “না। জমিদারকে বলেছি হিরে চুরি করতে পারিনি। কিন্তু কিছুক্ষণ পড়েই খবর ছড়িয়ে গেল, স্বপনগড় মন্দির থেকে কেউ হিরে অদ্ভুত ভাবে চুরি করেছে। জমিদারের কানে এই কথা আসতেই আমাকে চেপে ধরলেন। হিরে কোথায় লুকিয়ে রেখেছি তিনি তা জানার জন্য আমার দুটি পা গরম জলে চুবিয়ে রাখলেন। ভাগ্য ভাল, বাবুসোনা আমাকে উদ্ধার করল। এরপর আমাকে নিয়ে গিয়ে সে জামরুল গাছের ডালে ছেড়ে আসে।” এই বলে টিয়া আবারও চুপ হয়ে গেল।

টিয়া তো হিরের কথা উল্লেখ করল না! কী হল সেই হিরের? ভিক্ষু ভাবল একবার প্রশ্ন করে দেখতে পারে! কিন্তু সময় পাওয়া গেল কোথায়। তার আগেই টিয়া চোখ বন্ধ করে ঝিমতে শুরু করেছে। সারাদিন টিয়ার উপর যা ধকল গেল, তাই ভিক্ষু আর বিরক্ত করল না।

টিয়া গভীর ঘুম দিয়েছে। কিন্তু এদিকে ভিক্ষুর ঘুম আসছে না। ভিক্ষুর মাথায় বারবার হিরের প্রসঙ্গ নাড়া দিচ্ছে। টিয়া নিশ্চয় হিরে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে! টিয়াকে তো আর সামান্য হিরে চুরি করতে পাঠানো হয়নি! নিশ্চয় সেই হিরে বহু মূল্যের। সেই হিরে বিক্রি করে অনেক কিছু হয় তাই না! এই গ্রামও কিনে নেওয়া যেতে পারে! সেই হিরে ভিক্ষু পেলে আগে এই গ্রাম কিনবে। তখন এই গ্রামের প্রকৃতির মসস্ত সুন্দর্যের অধীশ্বর হয়ে উঠবে ভিক্ষু। গাছ – পালা, মাঠ – ঘাট, ঝিল – বিল ইত্যাদি নিজের হাতে সাজিয়ে তুলবে।    

ভিক্ষু যেন নিজের কল্পনা শক্তি দিয়ে গ্রামকে সাজাতে লাগল। মেঠো পথের ধারে চেনা – অচেনা ফুলেদের ভিক্ষু বলে ওঠে, “শোনো ফুল, আজ থেকে যেন তোমরা আর হাওয়ার তালে ডানে – বাঁয়ে দুলবে না। পেছন আর সামনে ঝুঁকে দুলবে।”

কাচুমাচু মুখে ফুলেরা বলল, “ঠিক আছে।”

ভিক্ষু এবার পাখিদের বলে ওঠে “শোনো পাখি, আজ থেকে আমি যে সুরে তোমাদের গাইতে বলব, সেই সুরে গাইবে।”

কাচুমাচু মুখে পাখিরা বলল, “ঠিক আছে।”

“শোনো ঝিলের ঢেউ …”

ভিক্ষু নিজের কল্পনা শক্তি দারা একের পর এক কল্পনা জাল বুনতে বুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল।

ভোরের নরম আলো জানলা দিয়ে প্রবেশ করে ভিক্ষুর মুখে পড়ল। আর তা পড়তেই ভিক্ষুর ঘুম ভেঙে গেল। সে উঠে বসল। এরপর একটা দীর্ঘ হাই তুলে ঝোলার দিকে তাকাল। টিয়া কোথায় ? কোনও রকম বিছানা ছেড়ে সে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল।

বাইরে ততক্ষণে ভোরের নরম আলোয় প্রকৃতির অপরূপ সুন্দর্য অতুলনীয় হয়ে উঠেছে। হালকা শীতল বাতাসের স্পর্শে ফুরফুরে হয়ে উঠছে ভিক্ষু। এই মুহূর্তে ভিক্ষু যে আর কিছু ভাবতে চায় না। হারিয়ে যেতে চায় প্রকৃতির এই অপরূপ সুন্দর্যে ; হারিয়ে যেতে চায় শিশির ভেজা গাছের পাতা অথবা ঘাসে ; হারিয়ে যেতে চায় পাখির ভৈরাই গানে ; সেই প্রজাপতি গঙ্গাফড়িংদের সঙ্গেও হারিয়ে যেতে চায় সদ্য ফুটে ওঠা ফুলেদের বাগিচাতে। হারিয়ে যেতে চায় …     

এমন সময় টিয়া এসে ভিক্ষুকে বলল, “ঘুম ভেঙে গেছে তোমার।”

পিছনে ঘুরে ভিক্ষু দেখল, কাঠাল গাছের ডালে টিয়া বসে। টিয়ার পায়ে পোট্টি নেই। নেই কোনও ক্ষত স্থান। অবাক হয়ে ভিক্ষু বলে ওঠে, “তোমার পায়ের ক্ষত কোথায় ?”

“তোমার ওষুধে তা সেরে গেছে। আচ্ছা, তোমার হিরের কথা জানতে ইচ্ছে করছে না? তোমার চাই সেই হিরে?”

অপস্তুত ভিক্ষুর কথা তোতলে যায়, “না মানে…”

টিয়া উড়ে এসে বলল, “হাত পাতো।” ভিক্ষু হাত পাতলে টিয়া মুখ থেকে হিরে বের করে, ভিক্ষুকের হাতে হিরে দিয়ে আবার কাঁঠাল গাছের ডালে গিয়ে বসল।

ভিক্ষুর হাতে হিরে জ্বলজ্বল করেছে। ভিক্ষু হিরেকে ভাল করে নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ ভিক্ষুর চোখে ধরা দিল, হিরের গায়ে অবিশ্বাসের আঘাত। রক্তের দাগ। হিরেতে ফুটে উঠছে, পাখিদের – ফুলেদের কাচুমাচু মুখ। ফুটে উঠছে …

হিরে হাতে নিয়ে ভীক্ষু বুঝতে পারল, হিরে তাকে কখনই প্রকৃত সুন্দর্য পাইয়ে দিতে পারবে না। এই হিরের স্পশে ভালোবাসা নেই, বিশ্বাস নেই। তাই ভিক্ষুর কাছে এই হিরে মূল্যহীন। এই হিরের স্পর্শে ভিক্ষুর মধ্যে কেমন যেন একটা অস্থিরতা বেড়ে উঠছে। টিয়ার উদ্দেশ্যে ভিক্ষু বলে ওঠে, “এই হিরে তুমি নিয়ে নাও। হিরে আমার চাই না।”

টিয়া উড়ে এসে ভিক্ষুর হাত থেকে হিরে নিয়ে আবার কাঠাল গাছের ডালে গিয়ে বসল। টিয়া বলে ওঠে, “আমি জানতাম তুমি হিরে নেবে না। তাই ভেবে রেখেছি, যাওয়ার পথে পশু চিকিৎসালয়-এর দানপেটিতে হিরে ফেলে দিয়ে যাব।”

ভিক্ষু জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কোথায় যাবে?”                                       

টিয়া উত্তর দিল, “যত দূর এই ডানা উড়িয়ে নিয়ে যাবে।” এই বলে টিয়া উড়ে গেল।

ভিক্ষু আপন মনে বলে ওঠে, সত্যি তুমি সাধারণ পাখি নও। হয়ত তুমি আমার মন!”

ভিক্ষুও ঘর থেকে ঝোলা নিয়ে অন্য দিকে বেড়িয়ে পড়ল। ভিক্ষু আর পাখির দিক হয়ত আলাদা, কিন্তু তারা একই পথের পথিক।

অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে