অনন্যা দাশ -এর সমস্ত লেখা একত্রে
সারাদিনের প্রচণ্ড ক্লান্তির পর একটু বসেছি, এমন সময় দরজায় জোরে জোরে টোকা পড়ল।
আজকেই আমরা আমাদের মার্কিন মুলুকের নিউ জার্সি রাজ্যের বাড়ি ছেড়ে ফ্লোরিডা রাজ্যে এসে পৌঁছেছি। মানে, গতকাল রওনা হয়েছিলাম। মাঝে একটা রাত হোটেলে থেকে আজকে এখানে এসে পৌঁছেছি। তেরো ঘন্টা গাড়ি চালিয়েছেন বাবা। তাই রাতের ঘুমটা দরকার ছিল। সেই জন্যে রাতটা হোটেলে ছিলাম। ইতিমধ্যে ট্রাকে করে আমাদের মালপত্রও এখানে এসে হাজির হয়েছে। বাবি এখানকার ইউনিভার্সিটিতে বেশ বড়ো পদে এসেছেন, তাই আমাদের বাড়িটা বেশ বড়ো। আমার আর আমার ভাই সিডের নিজেদের আলাদা আলাদা ঘর হয়েছে। আমার নিজের ঘরেই রয়েছি আমি এখন। ঘরের এককোণে এখনও একগাদা বাক্স পড়ে রয়েছে যেগুলো খোলা হয়নি। সবই আমার জিনিস। এই মুহূর্তে আমার আর বাক্স খুলে আনপ্যাক করতে ইচ্ছে করছে না। কাল দেখা যাবে। বিছানাটা পাতা হয়ে গেছে। সেই বিছানাতেই আরাম করে বসে ল্যাপটপটা সবে খুলে পাসওয়ার্ডটা এন্টার করেছি, এমন সময় দরজায় টোকা আর সিডের গলা শোনা গেল, “দিদি, শিগগির দরজা খোল!”
মা-বাবি দোকানে গেছেন খাবার কিনতে রান্নাঘর এখনও পুরোপুরি গোছানো হয়নি বলে। বাড়িতে শুধু আমি আর আমার বারো বছরের ভাই সিড। এখন সন্ধে সাতটা বাজে, কিন্তু বাইরে এখনও আলো রয়েছে।
সিড আমার ভাই বলে বলছি না, ও সত্যিই খুব ভালো ছেলে। এমনিতে কথা-টথা শোনে। তবে ছোটোবেলা থেকেই ও খুব রোগা আর একটু বেশি ভোগে, তাই ওর খেলাধুলোর দিকে বিশেষ মন নেই। চোখে চশমা আর সবসময় বই আর কম্পিউটার নিয়ে মেতে থাকে। ও হল পুরোপুরি যাকে এখানে ‘নার্ড’ বলে। তবে জন্তুজানোয়ার খুব ভালোবাসে সিড। তারা সবাই নাকি ওর বন্ধু।
আমি দরজা খুলছি না দেখে সিড ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল। “দিদি, দরজা খোল বলছি! ভীষণ দরকারি ব্যাপার!”
উফ্, সিডকে নিয়ে আর পারা যায় না ভেবে আমি ল্যাপটপ খাটে নামিয়ে রেখে উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। “কী হয়েছে? এত চেঁচামেচি করছিস কেন?”
“লুসিকে পাওয়া যাচ্ছে না রে দিদি! ওর ট্যাঙ্কটা খালি! আমি সারা বাড়ি খুঁজে ফেলেছি, কিন্তু ও কোথাও নেই!” সিড কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল।
আমি রাগী রাগী মুখ করে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “তোর ওই বীভৎস জন্তু হারিয়েছে তো আমি কী করব? মা-বাবি জানতে পারলে শাস্তি পাবি আবার কী! আমি ওসবের মধ্যে নেই! নিজের পোষ্য হারিয়েছিস, এবার নিজেই খোঁজ বাপু!”
সিড আমাকে ঠেলেঠুলে জোর করে ঘরে ঢুকে এল। “প্লিজ দিদি! এবারটা হেল্প কর! বেচারা লুসি নিশ্চয়ই খুব ভয় পেয়েছে, ঘাবড়ে গেছে নতুন জায়গা দেখে। কোথায় গেছে বেচারা কে জানে! ওর চোটও লেগে থাকতে পারে!”
তাও আমি নড়ছি না দেখে সিড কাকুতি মিনতি করতে লাগল, “প্লিজ, প্লিজ! এইবারটা ওকে খুঁজতে সাহায্য কর, দিদি! তোকে আমি আমার একমাসের পকেট মানি দিয়ে দেব। মা-বাবি ফিরে আসার আগে ওকে খুঁজে পেতেই হবে।”
আমি ভেবে দেখলাম, হুঁ, এইবার তো ব্যাপারটা অন্য মোড় নিচ্ছে। পকেট মানি পেলে কিছুটা লাভ হবে বৈকি। কয়েকটা দরকারি জিনিস কেনার আছে। “ঠিক আছে আমি সাহায্য করব, তবে দু’মাসের পকেট মানি দিতে হবে কিন্তু।”
সিড মাথা চুলকে বলল, “ঠিক আছে, তুই যদি খুঁজে পাস তাহলে দু’মাসের। আমি খুঁজে পেলে এক মাসের।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু ওকে ধরব কী করে? কোনও বড়ো শিশি বা বাক্স জাতীয় কিছু আছে তোর কাছে?”
সিড বলল, “দিদি, ও খুবই নিরীহ, কিছুই করে না। তুই ওকে টুক করে হাতে তুলে নিলেই হবে। তারপর আমাকে ডাক দিবি…” তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল, “মানে, তুই ইয়ে, চাইলে পিচবোর্ডের একটা বাক্স ব্যবহার করতে পারিস। বাইরের ঘরে অনেকগুলো পড়ে রয়েছে খালি।”
একটা খালি জুতোর বাক্স নিয়ে শিকারে নামলাম আমি। ঘরের সব জিনিস (মানে প্রধানত বাক্স) সরিয়ে সরিয়ে দেখতে লাগলাম। কোথায় সে ঢুকে বসে আছে তার ঠিক নেই। কোণে, ঘুপচিতে, দেওয়ালে, চারদিকে দেখলাম। হঠাৎ বাইরে যাওয়ার দরজাটার দিকে চোখ পড়তে দেখি বারান্দায় যে কয়েকটা ফুলের টব রয়েছে, মানে আগে যারা থাকত তারা রেখে গেছে, সেই একটা টবের তলায় গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন তিনি। উফ্, কী বিশ্রীই না দেখতে! গায়ে কাঁটা কাঁটা মাথায় কাঁটার ঝুঁটি, চোখগুলো ঢুলু ঢুলু। দেখতে তো একেবারে ড্রাগনের ছোটোভাই, এর নাকি আবার বিপদ হতে পারে!
যাক, সিডের গিরগিটিকে খুঁজে পেয়েছি আমি। এখন কেবল ওকে ধরে বাক্সে পুরে সিডের কাছে পৌঁছে দিতে পারলেই হল। সিডকে ডাকলেও হত, কিন্তু তাহলে যদি পকেট মানি ও দু’মাস থেকে একমাস করে দেয়? না বাবা দরকার নেই, যা করার আমিই করব।
বাইরে যাওয়ার দরজাটা খুলে বেরোলাম আমি। এখানে নিউ জার্সির মতন ঠাণ্ডা নেই, সেটা একটা ভালো। বেশ গরমই বলা যায়। পা টিপে টিপে এগোলাম হতচ্ছাড়া গিরিগিটিটার দিকে। সে প্রথমে আমাকে তার দিকে আসতে দেখে একটু পিছিয়ে গেল, কিন্তু পালাল না। আমি বললাম, “লুসি, লুসি, গুড গার্ল!” বলে হাতের বাক্সটা ওর একদম কাছে নিয়ে গিয়ে এগিয়ে ধরলাম। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে আমার এগিয়ে দেওয়া জুতোর বাক্সের ঢাকনার ওপর উঠল বটে কিন্তু সেটা করতে গিয়ে ওর লম্বা কাঁটা কাঁটা লেজটা আমার হাতে ঠেকে গেল। আমার গাটা গুলিয়ে উঠল। ওয়াক! শিউরে উঠলাম আমি। তাও চোখের সামনে তখন সিডের পকেট মানি ভাসছে, তাই আমি কোনওরকমে ঝপাৎ করে ঢাকনাটা বাক্সের ওপর চেপে বসিয়ে দিলাম যাতে লুসি আর পালাতে না পারে। খুব আনন্দ হচ্ছিল। আমি পেরেছি! সিডের পেয়ারের গিরিগিটি এখন আমার হাতে ধরা জুতোর বাক্সে বন্দী। এবার আমি ঘরে ঢুকে বাইরে যাওয়ার কাচের দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।
সিডের ঘর অবধি গিয়ে এবার আমি ওর দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা দিলাম। সিড দরজা খুলতেই আমি কঠিন স্বরে বললাম, “তিনমাস! তিনমাসের পকেট মানি দিবি তুই আমাকে। তোর ওই বীভৎস গিরগিটি আমার হাতের ওপর দিয়ে হেঁটে গেছে। আমার শরীর খারাপ করছে, গা গুলোচ্ছে। এখুনি বমি হয়ে যেতে পারে। এই নে।” বলে আমি জুতোর বাক্সটা ওর দিকে এগিয়ে দিলাম।
সিড আমার কাছ থেকে বাক্সটা না নিয়ে মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু দিদি, লুসিকে তো আমি একটু আগেই ওর ট্যাঙ্কে ঢুকিয়ে রাখলাম! ওই যে ঘরের কোণে বড়ো বাক্সটা রয়েছে, সেটার পিছনে লুকিয়ে বসেছিল, তাই আগে দেখতে পাইনি।”
“অ্যাঁ!” আমি তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই তো, লুসি দিব্যি নিজের ট্যাঙ্কে বসে রয়েছে! আমি আমতা আমতা করে বললাম, “লুসিকে পেয়ে গেছিস? তাহলে আমার জুতোর বাক্সে কে?”
“কোথায় পেলি ওটাকে?”
আমি ভ্যাবলার মতন বললাম, “বাইরের গাছের টবগুলোর কাছে বসে ছিল।”
সিড কী একটু ভেবে হাত মুঠো করে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে বলল, “বুঝেছি! তুই যেটাকে ধরেছিস সেটা নির্ঘাত একটা জংলি গিরগিটি! এটা তো আর নিউ জার্সি নয়, এখন তো আমরা ফ্লোরিডায়। এখানে তো গিরিগিটি এমনিই বাগানে ঘুরে বেড়ায়।”
আর যাবে কোথায়! ওর কথা শুনে আমি জুতোর বাক্স-টাক্স ফেলে দিয়ে পড়ি কি মরি ছুট দিলাম পরিত্রাহী চিৎকার করতে করতে।
মা-বাবি যখন বাজার করে ফিরে এলেন, তখন দেখলেন সিডের কাচের ট্যাঙ্কে দুটো গিরগিটি—লুসি আর সুশি। সিড আসলে ততক্ষণে ইন্টারনেটে পড়াশোনা করে দেখে ফেলেছে যে ফ্লোরিডায় বাগান থেকে গিরগিটি ধরে পোষাতে নাকি কোনও দোষ নেই।
অলঙ্করণঃ মৌসুমী
ইরিব্বাবাগো…এমন পোষ্য হলে আমি ঘর ছেড়ে পালাতাম
LikeLike
বাঃ, কি মিষ্টি গল্প
LikeLike