ফটিকেরা গুয়াহাটি খ্রিস্টানবস্তির এই তপোবন আবাসনে এসেছে মাস চারেক হল। বছরখানেক হল আমরাও এখানকার একটি ফ্ল্যাটে রয়েছি। এই আবাসনে গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কৃষ্ণা ও কাবেরী—মোট পাঁচটি ব্লক রয়েছে। ওরা থাকে কাবেরী ব্লকের দোতলায়, আর আমরা যমুনা ব্লকের তিনতলায়।
ফটিক আর আমি দু’জনেই তারাসুন্দরী আদর্শ বিদ্যানিকেতনে ক্লাশ এইটে পড়ি। একই স্কুলে পড়ি বলে বছর পাঁচেক হল স্কুলে ফটিককে দেখছি, ভীষণ দুষ্টু আর ডানপিটে। রোগা পাতলা গড়ন, মাঝারি গায়ের রঙ, মাথাভর্তি অগোছালো এলোমেলো চুল, আর বড়ো বড়ো দুটো চোখ ওর। মাস্টারমশাইদের নজর এড়িয়ে ক্লাশের পড়ায় ফাঁকি দিতে একেবারে পেছনের বেঞ্চির কোণের দিকের সিটটাকে ও বেছে নিয়েছে। ক্লাশ টিচার ইংরেজির বরুণ মহাপাত্র স্যার থেকে শুরু করে অঙ্কের দেবেন্দ্র স্যার, বাংলার অম্বরীশ স্যার, ইতিহাসের ভবতোষ স্যার, প্রায় সকল স্যারেদেরই কুনজরে রয়েছে এই ফটিক। তবুও কোনওরকমে টেনেটুনে প্রতিবছরই সে ক্লাশের পরীক্ষায় পাশ করে যায়।
আমি এবং আমার সহপাঠীদের মধ্যে যারা পড়াশুনার ব্যাপারে একটু আধটু সিরিয়াস এবং ক্লাসে ভালো ছেলে বলে একটু সুনাম রয়েছে, সকলেই বরাবর ফটিককে অতি সাবধানে এড়িয়ে চলি। আমাদের সকলের মনে ভয় এবং ভাবখানা এই যে, ফটিকর সাথে মেলামেশাতে যদি আবার আমাদের ভালো ছেলে নামে কলঙ্কের দাগ পড়ে যায়!
ফটিক এসে আমাদের হাত ধরতে গেলেই ওকে সামনে রেখেই আমাদের বন্ধুদের মধ্যে চোখে চোখে কথা হয়ে যায়। আর আমরা এক ঝটকায় ওর রোগাপটকা হাতখানা ছাড়িয়ে নিই। ফটিক বুঝি সবই বুঝতে পারে। কিছুই বলে না, কেবল ম্লানমুখে সরে দাঁড়ায়।
ইংরেজির বরুণ স্যার এসে ক্লাশে ঢুকে রোল কল সেরে ফেললেই দু-তিন মিনিট না পেরোতেই ফটিক দাঁড়িয়ে পড়ে। “বাথরুম যাব, স্যার?”
স্যার জিজ্ঞাসা করেন, “কোন বাথরুম? বড়ো, না ছোটো?”
ফটিক বলে, “বড়ো বাথরুম, স্যার।”
সেটাও ফেল করলে, “জল খেতে যাব, স্যার?”
জল খাওয়াটাও ফেল করলে আবার প্রথম থেকে শুরু—বড়ো বাথরুম, খানিক বাদে ছোটো বাথরুম—অমনি সব চলতে থাকে। অমন একদিন না, রোজ রোজ। আর একবার বাইরে বেরোবার অনুমতি পেয়ে গেলে ফটিক আর ক্লাশে ফেরে না। ওটাই ওর নিয়ম। মনে মনে নিশ্চয়ই রাগ হতেন স্যার, কিন্তু তবুও রাগের বহিঃপ্রকাশ এই স্যারের তেমন নেই বলে আমরা সেটা বুঝতে পেতাম না।
একদিন পণ্ডিত স্যার রামদুলালবাবু ক্লাশে পড়াতে পড়াতে হঠাৎ করেই হাতের বইটা টেবিলে রেখে ডাস্টার তুলে টেবিলে দুটো জোর চাঁটি মেরে মাথা চুলকোতে চুলকোতে কাউকে কিছু না বলে তড়িৎ গতিতে ক্লাশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। দশ-পনেরো মিনিট বাদে ফের যখন ক্লাশে ফিরলেন, তখন একহাতে ফটিকের চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে টানতে টানতে ওকে সঙ্গে নিয়ে। আর নির্বাক আমরা ক্লাশের ছেলেরা সভয়ে পেছনের সারির কোণের বেঞ্চিটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ফটিক সেখানে নেই, ওর জায়গাটা খালি। তবে যে কালো রঙের স্কুল ব্যাগ পিঠে প্রথম পিরিয়ডে ওকে আমরা ক্লাশেও ঢুকতে দেখলাম! তার মানে কোন ফাঁকে সে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে পালিয়েছে! পরে জানতে পেরেছিলাম, ফটিক স্কুলের পাশের কালীপুকুরে লম্বা সুতোয় বড়শি বেঁধে টোপ ফেলে বসে ছিল। প্রথম পিরিয়ডে বরুণ স্যারের রোল কল হয়ে যাবার পর স্যার যখন কিছুক্ষণের জন্য ক্লাশের বাইরে গিয়েছিলেন, সবার অলক্ষ্যে সেই ফাঁকে সে পালায়। আর রামদুলাল স্যারের কানে ফটিকের সেই কুকর্মের খবর কোনও উপায়ে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। রামদুলাল স্যার তো কান ধরে টেনে টেনে এনে তাকে ক্লাশে বসিয়ে দিলেন, ফটিক তবুও নির্বিকার। তার যেন কোনও হেলদোল নেই!
ইতিহাসের ভবতোষ স্যার একদিন পড়াতে পড়াতে ডানদিকে পেছনের বেঞ্চির কোণের দিকে লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে গেলেন। আমরা সকলে তখন প্রমাদ গুনছি, নিশ্চয়ই স্যার এবারে ফটিককে কিছু বলবেন। আর ঠিক তাই। মুখে টুঁ শব্দটি না করে স্যার ফটিকের হাত ধরলেন। টানতে টানতে এনে ওকে একেবারে সামনের বেঞ্চির একটি ফাঁকা জায়গাতে বসিয়ে দিয়ে আবার দু-দু’বার ওর পিঠ চাপড়ে দিলেন। ইতিহাসের এই ভবতোষ স্যার সকল ছাত্রদের খুব কাছের মানুষ, খুব প্রিয়জন। কারণ, রাগধর্ম বলে কিছু যেন স্যারের স্বভাবে একেবারেই ছিল না। সামনের দিকে স্যারের টেবিল লাগোয়া বেঞ্চিটাতে বসে ফটিক যেন একেবারেই স্বস্তি পাচ্ছিল না। আমরা দেখছিলাম, ওর যেন দু’চোখে কেমন এক অস্বাভাবিক চাউনি, কেমন এক আড়ষ্টভাব। স্যার বললেন, “বসো ফটিক, ঠিক করে বসো। এখানে বসলে আমার পড়ানোটা ভালো করে শুনতে পাবে তুমি। কোনও চিন্তা নেই তোমার। খুব ভালো ছেলে তুমি।”
তবুও ফটিকের অস্বস্তি আর কাটে না। উদাস গলায় ফটিক বলে, “কোনওদিন তো বসিনি, স্যার। কেমন কেমন লাগছে। পড়া বলতে পারিনে, তারপর আবার…”
ফটিকের মুখের কথা মুখেই রইল। স্যার মুচকি হেসে আবার পড়ানোতে মন দিলেন, সিরাজউদ্দৌল্লা কী করে বাংলার মসনদে বসলেন। কিন্তু পরের পিরিয়ড থেকেই ফটিক আবার নিজের জায়গায়। আর তার পরদিন থেকে ভবতোষ স্যারের ইতিহাস ক্লাশে ফটিককে আর কেউ দেখতেই পেলে না।
তা এই হল আমাদের ফটিক।
এখানে এই আবাসনে ফটিক এসেছে, আমার আরও একটা বন্ধু হল। কিন্তু তা তো নয়। আমি ফটিকের ধার ঘেঁষি না, ওর সংশ্রব এড়িয়ে চলি সর্বদা। মনে মনে ভাবি, এত গেছো ছেলে বলে যার বদনাম, তার থেকে সরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। কখন কী ঝামেলায় ওর সঙ্গে আমার নামটিও জড়িয়ে যাবে, তা তো কেউ জানে না। এই তো মাস চারেক হয়েছে ও এখানে এসেছে। এরই মধ্যে আবাসনের লোকেরাও ডানপিটে স্বভাবের এই বীরের পরিচয় বেশ ভালোভাবে জেনে গেছে। কোথাও কোনও অনর্থের গন্ধ পেলেই এখানকার লোকেদের প্রথম জিজ্ঞাসা, কাবেরী ব্লকের এই নতুন ছেলেটির কম্ম নয়তো? ওই যে ফটিক না ফটকে কী নাম!
আবাসনের দারোয়ান নিধি থেকে কাজের মাসি মলিনা, সুবালা, বাবলার মা সকলেই একবাক্যে ফটিককে চেনে। আর ওকে ফটিক না বলে ফটকে বলে ডাকে।
সেদিন ভরদুপুরে গঙ্গা ব্লকে আমাদের আরেক বন্ধু তুষারদের বাড়ি যাচ্ছিলাম আমি আর গোপাল সত্যনারায়ণ পুজোর প্রসাদ খেতে। পথে দোতালায় তিন নম্বর ফ্ল্যাটের কাছে দেখি নন্দিতাকাকিমা দাঁড়িয়ে। আমাদের দেখতে পেয়ে বললেন, “এখানে বারান্দায় শখ করে ক’টা টব রেখেছি। তার একটাতে গাছভর্তি কালো লঙ্কা ধরেছিল। কে যেন একেবারে ন্যাড়া করে গাছের সবক’টা লঙ্কা পেড়ে নিয়ে চলে গেছে। আগে তো কখনও ওরকম হত না!”
আমি কিছু বলার আগেই গোপাল বলল, “ফটকের কাজ নয়তো? আগে কখনও হয়নি বলছেন তো মাসিমা! ওই তো এখানে নতুন ল্যান্ড করেছে।”
নন্দিতাকাকিমার শাশুড়ি-মা কাকিমার পেছনে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবারে সামনে এসে দাঁড়ালেন। “আমি তো তোমায় আগেই বলেছিলাম বৌমা, দু’দিন ধরে ঐ হতচ্ছাড়া নতুন ছোকরাটাকে একেনে ঘুরঘুর করতে দেকেচি। শ্যামলীদের বাড়ির ডোর বেল নাকি টিপে টিপে দিচ্ছিল বারবার। দরজা খুলতেই ধাঁ।”
তা ফটিক একদিন আমাকে বলেছিল, ও নাকি আগে আর কখনও ফ্ল্যাটবাড়ি দেখেনি, ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকেনি। এখানকার এই ডোর বেল ব্যাপারটা ওকে খুব আনন্দ দেয়। দরজা বন্ধ করে রাখো, আর ওটা বেজে ওঠলেই বুঝে নাও তোমার দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে, ওটা খোলার অপেক্ষায়। কে জানে, তাই হয়তো ও যখন তখন যার তার বাড়িতে ডোর বেল বাজিয়ে মজা করে বেড়ায়। আর দরজা খুলে যাবার আগেই চো-চো দৌড়!
এরই মধ্যে একদিন কৃষ্ণা ব্লকের ছাদঘরে বসে আমি আর বাদল ঘর থেকে লুকিয়ে কাগজে মুড়ে আনা কুলের আচার খাচ্ছিলাম। হঠাৎ সেখানে কোথা থেকে ফটিক এসে হাজির। বাঁহাতটা আমার কাঁধে রেখে ডানহাত পেতে একটু আচার চাইলে। আমি আমার কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওর বাঁহাতটা আগে কাঁধ থেকে ছাড়িয়ে নিলাম। তারপর মুখ থেকে দুটো কুলের বীচি ওর পাতানো হাতে ফেললাম। গাঢ় ব্যথায় ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মুখখানা থেকে ওর কেবল তিনটে শব্দ বেরোল, “এ তো চাটা বীচি!”
আর কিছু বলল না, ফটিক চলে গেল। কিন্তু হঠাৎ করে এইরকম একটা কুৎসিত কাজ করে ফেলার পরই ফটিক চলে যেতে আমার সম্বিৎ ফিরল। এ কেমন ব্যবহার আমার! বুকের ভেতর কেমন যেন এক মোচড়, রিনরিনে এক ব্যথার অনুভূতি। অমন চাটা বীচি হাতে ফেলার পরও কোনও প্রতিবাদ না, কিছু না! ওরকম একটা বাজে কাজ আমি কেনই বা করে বসলুম হঠাৎ করে!
এই দিন দশেক হলো আবাসনে আমরা ছোটোরা দশ-বারোজন ছেলে মিলে একটা ক্রিকেট টিম গড়েছি। বিকেল হলে আবাসনের মাঝখানের একচিলতে ফাঁকা জমিতে আমরা সবাই এসে হাজির হয়ে যাই। তুষার, গোপাল, রাখাল, বাদল, বিশু, রামু, অঙ্কিত, ভোলা, রোহিত আর এই আমি শক্তি। তারপর শুরু হয় হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড। চলতে থাকে ব্যাট-বল আর ছোটোখাটো কোনও বিষয়কে ঘিরে একের ওপর অন্যের আক্রমণ, বচসা, ঝগড়াঝাঁটি আর হই-হট্টগোল।
তবে এখানে এই আবাসনের ভেতরে খেলাধুলো করা কি আর চাট্টিখানি কথা! কারণ, খেলাধুলো করার মতো মাঠ অথবা জায়গাজমির বড়ো অভাব এখানে। আবাসনের বাঁপাশে কৃষ্ণা-কাবেরী ব্লক, ডান ধারে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র আর যমুনা ব্লক। এসবেরই মাঝখানে একফালি খালি জায়গা। একধারে আবার ছোট্ট একটি ফুলের বাগানও রয়েছে। বাগানের বেড়া ঘেঁষে সার সার কতগুলো গাড়ি, সাইকেল, স্কুটার। যানবাহন রাখার কোনও সুরক্ষিত জায়গাও এখানে নেই। তাই ঐটুকু খালি জায়গাকে ঘিরেই আমাদের আনন্দমেলা আর হুটোপুটির আসর।
এখানে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে যিনি ব্যাট করবেন আর যিনি বল করবেন দুই পক্ষেরই সর্বদা হুঁশিয়ার থাকতে হয়। কারণ একটু বেখেয়ালি আর এলোপাথাড়ি বল ছুটলেই অঘটন ঘটে যাবার সম্ভাবনা। হয় কারও জানালার কাচে, আবার হতে পারে সেটা বাগানে কাজ করা আবাসনের মালি সর্বানন্দকাকুর মাথায়। এরই মধ্যে সাদা রঙ স্কর্পিও গাড়িটার মালিক প্রসাদকাকু এসে দু’দিন সতর্ক করে দিয়ে গেছেন, “এখানে আবার খেলাধুলো করার সাহস হল কী করে! কে দিলে তোদের এই পারমিশান? বাড়িতে শাসন করার লোক নেই বুঝি? আমার নতুন গাড়িটার উপর বল পড়লে কাউকে আস্ত রাখব না, জানিয়ে দিলাম।”
এদিকে ব্রহ্মপুত্র ব্লকের শঙ্করকাকু তো ভারি বদরাগী মানুষ। খেলা শুরু হতে না হতে নিচে এসে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে শুরু করেন। সেদিন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিলেন, “তোদের কি মাথাখারাপ নাকি! এখানে ক্রিকেট পাতিয়েছিস? জানলা-টানলা ওসব ভেঙে কারও মাথায় যদি কাচ পড়ে? তাছাড়া গাড়ির কাচ-ফাচ ভাঙলে তখন? সোজা কথা ওগুলো সারানো! অত টাকা তখন কে ভরবে?”
মিলনকাকু, সুধীনজ্যাঠা, অর্ণবপিসে সবার মুখে সেই একই কথা, এখানে খেলা! কে দিলে তার অনুমতি?
ওদিকে খেলা শুরু হতে না হতে ফটিক এসে দাঁড়িয়ে থাকে। ওকে কেউই খেলতে বলে না, আমিও না। যা দুষ্টু, যা দুষ্টু! ওকে তো কোনও বিশ্বাস নেই। ওকে খেলায় নিলে কোন ঝামেলায় কখন জড়িয়ে পড়ব, কে বলতে পারে? হঠাৎ মাথা বিগড়ে গিয়ে হয়তো প্রসাদকাকুর স্কর্পিওটাকেই তাক করে বসল। তখন! তাই আমরা ওকে বলেছি, “তুই একস্ট্রা হিসেবেই রইলি। কেউ চোট পেলে, খেলতে আসেনি অথবা মা ডেকেছে হলে তখন তুই।”
ফটিক তাতেই মহাখুশি। শুরু হয়ে গেল তার লাফঝাঁপ। হুর-রে! ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে অপেক্ষায়। কখনও-সখনও ও খেলতে নামলে আমরা ওকে হাজারবার সাবধান করি, সতর্ক করে দিই। শঙ্করকাকুর কথার জবাবে ও বলে, “হবে না কাকু, হবে না। অমন কিছু হোক আমরা তা চাইবও না। আমরা কোথায় যাব, কাকু? আমাদের কথা তো কেউ ভাবে না। এখেনে আশেপাশে তো একটা মাঠও নেই।”
ফটিকের কথায় প্রবল দুঃখ আর ক্ষোভের আর্তি ঝরে পড়ে।
তা সেদিন আমরা খেলছিলাম। ছুটির দিন। বিকেল চারটে থেকে। খেলা বেশ জমেও ওঠেছিল। আমাদের টিম তিন উইকেটে নিরানব্বই রান। আমি তখনও ব্যাট করে যাচ্ছি। আমার প্রতিপক্ষের হয়ে বাদল বল করছে। এদিকে সূর্য তখন অস্তাচলে ঢলে পড়েছে। কারোরই বুঝি সে খেয়াল নেই। আমি ব্যাট হাতে বেহুঁশ। গায়ের রক্ত বুঝি ফুটছে টগবগ করে। ব্যাটটা দু’হাতে তুলে গায়ের জোরে একটা ছক্কা হাঁকালাম। ব্যাটের ডগায় লেগে বলটা ছুটে গেল দুরন্ত গতিতে। প্রসাদকাকুর দোতলার জানালায় লেগে ঝনঝন শব্দে একগাদা কাচ ভেঙে পড়ল। ক’টা পুরুষ এবং নারীকন্ঠের মিলিত চিৎকার কানে যেতেই ভয়ে আমি কেমন যেন হতবুদ্ধি হয়ে পড়লাম। দরদর করে ঘামছিলাম। দু’চোখে অন্ধকার দেখছিলাম।
প্রসাদকাকুকে সিঁড়ি ভেঙে তরতর করে নেমে আসতে দেখে আমার সঙ্গীসাথীরা সব দৌড়ে পালিয়ে গেল। কেবল আমিই পালাতে পারলাম না। মনে হচ্ছিল হাত-পা অবশ হয়ে আসছে বুঝি! শক্ত কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাদলের হাতের অমন স্লো একটা বলকে অত জোরে হাঁকাবার কী দরকারই বা ছিল! আর ক’টা রান হলে ওদের টিম হারত, এছাড়া আর কী। নিজেকেই নিজে দোষ দিচ্ছিলাম কেবল। অতসব সাবধানবাণী ফটিক খেলতে নামলে, আর নিজের বেলা এর সবটাই ভুলে গেলে কী করে শক্তি! হঠাৎ করে শক্তি দেখাবার এ কেমন প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠলে তুমি! কোথায় গেল তোমার মুখের অত বড়ো বড়ো কথা?
সম্বিৎ ফিরতে দেখছিলাম, প্রসাদকাকুর রক্তজবার মতো লালদুটো চোখ এখন কেবল আমাকেই দেখছে! গলা শুকিয়ে কাঠ, কান-মাথা ঝিমঝিম করছে। কাকু বলছিলেন, “এই দ্যাখো, ভাঙা কাচের টুকরোগুলো পড়েছে আবার আমার গাড়িটার ওপর! হে ভগবান! খুন করে ফেলব শক্তি আজ তোকে।”
সূর্য অস্ত গেছে কখন। অন্ধকার নেমে আসছে চরাচর ঘিরে। কোথায় যেন একটা ঝিঁঝিঁপোকা ডাকছে। কাদের বাড়ি শাঁখ বেজে উঠল। সাথে সাথে কতগুলো কুকুর ডাকতে শুরু করল গেটের ওধারে ঘেউ-উ-উ-উ ঘেউ-উ-উ-উ… আধো অন্ধকারে বাগানের বেড়া ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এই আমি ঘামছি আর কাঁপছি ঠকঠক করে।
হঠাৎই আমার বরফ ঠাণ্ডা ডানহাতের পাতাটা কারওশক্ত হাতের মুঠোর ভেতরে সেঁধিয়ে গেল। লক্ষ করিনি এতক্ষণ, এ তো ফটিক দাঁড়িয়ে আমার পাশে! ওর বড়ো বড়ো চোখদুটোতে যেন আমার প্রতি না বলা এক অভয়বাণী, আমি তো রয়েছি!
এখন এই মুহূর্তে ওর হাত আর আমি ঝাঁকুনিতে ছাড়িয়ে নিলাম না। উলটে আমিও ওকে ধরে থাকলাম শক্ত করে। প্রসাদকাকু বলছিলেন, “আমি ওপাশে জানালায় দাঁড়িয়ে সব দেখেছি শক্তি, এত বড়ো স্পর্ধা তোমার! গায়ের জোরে বলটাকে ছুড়ে দিলে! কোথায় পড়বে, কার কী সর্বনাশ হবে, তার কোনও হিসেব নেই তোমার! তোমায় কী শাস্তি দিলে যে আমি শান্তি পাব বুঝতে পারছি না। ভাঙা কাচগুলো আবার আমার অত দামি গাড়িটার ওপর পড়েছে। কে জানে কী হাল হয়েছে ওটার!”
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ঘামছি, ঘামছি, ঘেমেই যাচ্ছি। কী জবাব দেব এর? কী জবাব দেবার আছে এতে? তা হঠাৎই ফটিকের দৃপ্তকণ্ঠ কানে এল, “কেবল তো শক্তি নয় কাকু, আমরা তো সকলেই খেলছিলাম। বকতে হয় সবাইকে বকুন, আমাকেও। শাস্তি দেবেন তো সবাইকে দিন। একা ওকে নয়।”
ফটিকের মা শর্বাণীকাকিমা টর্চ হাতে ফটিককে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে এসে হাজির। এর খানিকটা শুনলেন আর বাকিটা বুঝি আন্দাজ করে নিলেন। ফটিকের হাত ধরে টানতে টানতে, “চল চল, বাড়ি চল ফটিক। ঘরে তোর বাবা-ঠাম্মা সবাই চিন্তা করছে। আর তোকে তো এখেনে কেউ খেলতে নেয় না, মিছিমিছি দাঁড়িয়ে থাকিস!”
ফটিকের দৃঢ়কন্ঠ, “এখন ঘরে যাব না মা, এখানে শক্তিকে একা রেখে। সবাই মিলে দোষ করেছি, তাতে একা শক্তি শাস্তি পাবে তা কী করে হয়!”
শর্বাণীকাকিমা বিড়বিড় করছিলেন, “মাঝে মাঝে এ তোর কেমন চেহারা দেখি বাবা! ভগবানকে ডাকি, ডেকেই যাই কেবল। বিপদের মুখে অমন করে বুক পেতে দাঁড়িয়ে যাস!”
ভাবছিলাম, এ কোন ফটিক! এ তো ডানপিটে আধপাগলা আমাদের চিরপরিচিত সেই ফটিক নয়! আজ ফটিকের হাতটাকে আরও শক্ত মুঠোয় ধরে থাকি আমি।
অলঙ্করণ সায়ন মজুমদার
জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস