ফেসবুক ফ্রেন্ড
স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
উমাশঙ্করবাবু এদিন ওঁর ফেসবুক খুলতেই চোখে পড়ল ঋষভ কুণ্ডু মেসেঞ্জারে আবার একটা মেসেজ পাঠিয়েছে… স্যার, শারদীয়া চিরসাথী পত্রিকায় আপনার উপন্যাস ‘জলতরঙ্গ’ আমার জাস্ট অসাধারণ লেগেছে। আপনাকে কী বলে অভিনন্দন জানাব জানি না। এখন অন্যান্য পত্রিকায় আপনার লেখাগুলো পড়তে শুরু করেছি।
উমাশঙ্করবাবু মনে মনে হাসলেন। একটা তৃপ্তিও বোধ করলেন। ঋষভ কুণ্ডু বছর সতেরো বয়সী এক কিশোর। কলকাতার এক নামজাদা ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ে। কিন্তু বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে এই বয়সে তার এই অসাধারণ কৌতূহল আর জ্ঞান উমাশঙ্করবাবুকে শুধু মুগ্ধই নয়, অবাক করেছে।
উমাশঙ্করবাবু ফেসবুকে ঋষভের প্রোফাইল পিকচারটা আরেকবার দেখলেন। দামী গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ধনীর দুলাল যেমন হয়। পরনে জমকালো পোশাক। ওর বাবা কলকাতার একজন নামী বিজনেসম্যান, তা ওর প্রোফাইল থেকেই উমাশঙ্করবাবু জেনেছেন।
উমাশঙ্করবাবু মেসেঞ্জারে ঋষভের লেখার নিচে লিখলেন, ‘আমার লেখা তোমার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগল। তোমার এই সাহিত্য প্রীতির আমি প্রশংসা করি।’ তারপর মেসেজটি পাঠিয়ে দিলেন ঋষভের উদ্দেশ্যে।
উমাশঙ্কর রায় একজন প্রবীণ সাহিত্যিক। বিশেষ করে শিশুকিশোর সাহিত্যে তাঁর দীর্ঘদিনের বিচরণ। বাংলা থেকে এ-সময়ে যতগুলো এ জাতীয় নামী পত্রিকা প্রকাশিত হয়, প্রায় সবগুলোতেই উনি লিখে থাকেন। পাঠক মহলে খুবই জনপ্রিয় তিনি।
উমাশঙ্করবাবুর বয়স ষাট পেরিয়েছে। কিন্তু তাঁর কলম এবং মন এখনও বেশ সজীব, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলারও এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। তিনি লেখেন ছোটোদের জন্যে এবং তাঁর অনুরাগী পাঠকরাও বেশি সংখ্যায় কিশোর-তরুণ। তাই বোধ করি এই বয়সেও মনটা তাঁর বুড়িয়ে যায়নি।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ারও শরণাপন্ন হয়েছেন উমাশঙ্করবাবু। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। সেখানে তাঁর প্রচুর বন্ধু। তারা মাঝেমাঝেই তাঁর বিভিন্ন লেখা সম্পর্কে তাদের ভালোলাগার কথা জানায়, লাইক দেয়। কিন্তু কিছুদিন যাবত এই ঋষভ নামের কিশোর ফেসবুক ফ্রেন্ডটি উমাশঙ্করবাবুর সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে।
ঋষভ প্রথম যখন ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিল উমাশঙ্করবাবু কোনও আলাদা গুরুত্ব দেননি। উমাশঙ্করবাবু কারও অনুরোধ রাখেন, কাউকে প্রত্যাখ্যান করেন। তবে ঋষভের অনুরোধ রেখে ফ্রেন্ড লিস্টে ঠাঁই দিয়েছিলেন।
কিন্তু তারপর ক’দিন যেতেই উমাশঙ্কর রায়ের অবাক হওয়ার পালা শুরু হল।
ঋষভ ছেলেটা এই বয়সেই শুধু কিশোর সাহিত্যই নয়, টোটাল বাংলা সাহিত্য সম্পর্কেই অনেকটা জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছে। তবে উমাশঙ্করবাবুর সবচেয়ে ভালো লাগল, ছেলেটি তাঁর লেখার অন্ধ ভক্ত।
শুধু কি তাই! এ বছর পুজোয় প্রকাশিত অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য গল্প-উপন্যাসেরই ঋষভ ফেসবুকে যা পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখল, সেগুলো পড়ে উমাশঙ্করবাবু অবাক হলেন ওর বিষয়জ্ঞান আর সমালোচনার ক্ষমতা দেখে। ভাবলেন, এ-ছেলের প্রতিভা এবং জ্ঞানের উপযুক্ত সমাদর করা তাঁর কর্তব্য।
উমাশঙ্করবাবু নিজে বহুবছর ধরে অনেক চেষ্টা, সাধনা, ঝড়ঝাপটা সামলে বড়ো হয়েছেন। সুতরাং উপযুক্ত প্রতিভাকে সমাদর করতে কসুর করেন না।
সে সুযোগ একটা মিলে গেল।
সে বছর পুজোর পর এক সাংস্কৃতিক সংস্থা কলকাতার এক বিখ্যাত মঞ্চে পুজোয় প্রকাশিত শিশুকিশোর সাহিত্যের এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। সেখানে শিশুকিশোর সাহিত্যের প্রথম সারির লেখকরা তো ছিলেনই, পাঠকরাও ছিলেন। উমাশঙ্করবাবুও সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন এবং তাঁর অনুরোধে অনুষ্ঠানের কর্মকর্তারা ঋষভকেও কিশোর পাঠক হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
অনুষ্ঠানের দিন নির্দিষ্ট সময়ে ঋষভ তার বাবা দীনবন্ধু কুণ্ডুকে সঙ্গে নিয়ে এসে হাজির হল। দীনবন্ধু কুণ্ডু কলকাতার এক নামি ব্যবসায়ী। অনুষ্ঠান সদনের সামনে তাঁর দামি বিদেশি গাড়িটা এসে দাঁড়াল। সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
দীনবন্ধুবাবু এবং ঋষভ গাড়ি থেকে নেমে এলেন। দু’জনেরই পরনে জমকালো পোশাক। সেদিন ঋষভ একটা দামী পাঞ্জাবি পরে এসেছিল। উমাশঙ্করবাবু তো প্রথমটায় ওকে চিনতেই পারেননি।
পিতাপুত্র দু’জনেই উমাশঙ্করবাবুর প্রায় সামনে দিয়েই প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে সামনের সারির দুটো সিটে বসে পড়ল। ঋষভের দৃষ্টিটা মনে হল একবার উমাশঙ্করবাবুর ওপরে পড়ল। কিন্তু ওর নির্বিকার ভাব দেখে ঠিক বোঝা গেল না ও উমাশঙ্করবাবুকে চিনতে পেরেছে কি না।
কিন্তু চেনার তো কথা। ফেসবুকে উমাশঙ্করবাবুর ছবি দেখে ঋষভ তো কতবার প্রশংসা করেছে। লাইক দিয়েছে। হয়তো এই মুহূর্তে ছেলেটি চাপে আছে। বয়সটা তো কম। ভাবলেন উমাশঙ্কর রায়।
অনুষ্ঠান শুরু হতে চলল। সঞ্চালক একে একে শিশুকিশোর সাহিত্যের কয়েকজন নামকরা লেখককে মঞ্চে ডেকে নিলেন। তাঁদের মধ্যে উমাশঙ্করবাবুও ছিলেন। এরপর কয়েকজন পাঠককেও মঞ্চে ডাকা হল। সবশেষে উমাশঙ্করবাবুর অনুরোধ মেনে কনিষ্ঠতম পাঠক ঋষভকে মঞ্চে ডেকে নেয়া হল। ঋষভ মনে হল কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে মঞ্চে উঠে এল।
ওকে দেখে সবাই স্নেহ প্রকাশ করলেন। সঞ্চালক মহাশয় বিশেষভাবে তার গুণপনা উপস্থিত দর্শকদের কাছে তুলে ধরলেন। জানালেন, এই সতেরো বছর বয়সেই ঋষভ কুণ্ডু কিশোর সাহিত্য তো বটেই বাংলা সাহিত্যের এক গুণগ্রাহী পাঠক হয়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি তার এই অনুরাগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। দর্শকরা সমবেতভাবে করতালি দিয়ে সঞ্চালক মহাশয়ের বক্তব্যকে সমর্থন জানালেন।
এরপর সংস্থার তরফে মঞ্চে উপস্থিত সকল সাহিত্যিক এবং পাঠকদের সঙ্গে ঋষভকেও ফুলের স্তবক এবং গলায় উত্তরীয় পরিয়ে সম্বর্ধনা জানান হল।
উমাশঙ্করবাবু লক্ষ করছিলেন এসবের মধ্যে ঋষভের কোনও তাপ উত্তাপ নেই। সে কেমন অন্যমনস্কভাবে বসে রয়েছে। উপস্থিত সাহিত্যিকদের প্রতি সাধারণ সৌজন্যটুকু পর্যন্ত প্রকাশ করল না। এসব তো হবার কথা নয়।
এরপর উপস্থাপক মহাশয় অনুষ্ঠান শুরু করলেন। উপস্থিত সাহিত্যিকরা তাঁদের বক্তব্য পেশ করলেন। এরপর উপস্থাপক মহাশয় উপস্থিত পাঠকদের অনুরোধ করলেন সাহিত্যিকদের প্রশ্ন করার জন্য।
উমাশঙ্করবাবু আশা করেছিলেন এবার অন্তত ঋষভ মুখ খুলবে, তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে কিছু বলবে। ফেসবুকে তো সে প্রায়ই তাঁর লেখা নিয়ে নানা প্রশ্ন পাঠায়।
কিন্তু সে-সব কিছুই হল না। উমাশঙ্করবাবু অবাক হয়ে দেখলেন, ঋষভ তাঁর সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, কারোর সঙ্গেই একটা বাক্যবিনিময় পর্যন্ত করল না। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, ও মঞ্চে বসে থাকলেও মনটা এখানে নেই। এটা কি সত্যিই অল্প বয়সজনিত কারণে ওর নার্ভাসনেস?
মঞ্চ থেকে নেমে ঋষভকে প্রশ্নটা করবেন ভেবেছিলেন উমাশঙ্করবাবু। কিন্তু সে সুযোগ পেলেন না। মঞ্চে অনুষ্ঠান শেষ হতেই ঋষভ তার বাবার সঙ্গে তড়িঘড়ি প্রেক্ষাগৃহ ত্যাগ করে চলে গেল। যাবার আগে তার প্রিয় সাহিত্যিক, ফেসবুক ফ্রেন্ড উমাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে একবার সৌজন্য সাক্ষাৎকারও করে গেল না।
পুরো ব্যাপারটা কেমন যেন দুর্বোধ্য মনে হল উমাশঙ্করবাবুর কাছে। এ কী রহস্য লুকিয়ে আছে ওই ঋষভ নামের কিশোরটির মধ্যে!
সেদিন সারারাত উমাশঙ্করবাবুর ঘুম হল না। শুধু ভেবেই চললেন। এ রহস্যের উৎস কোথায়? খুঁজে বার করতেই হবে। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব?
ভাবতে ভাবতে উমাশঙ্করবাবুর মাথায় একটা বুদ্ধি এল। তিনি ফেসবুক খুলে ঋষভ কুণ্ডুর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুঁজে বার করলেন। সেখানে সে কলকাতার কোন নামীদামী ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে তা লেখা আছে। উমাশঙ্করবাবু ভাবলেন, সেখানেই ছুটির পর গিয়ে তিনি ঋষভের সঙ্গে দেখা করবেন। তারপর সামনাসামনি ওর মনের কথাটা জানবেন।
বিকেল চারটের সময় ঋষভের স্কুল ছুটি হয়। তার একটু আগেই উমাশঙ্করবাবু পৌঁছে গেলেন স্কুল গেটের সামনে।
নির্দিষ্ট সময়ে স্কুল ছুটি হল। ছাত্ররা হইচই করতে করতে স্কুল বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল। উমাশঙ্করবাবু প্রতিটি ছাত্রকে লক্ষ করতে লাগলেন। একসময় ঋষভ বেরিয়ে এল। উমাশঙ্করবাবু ডাকলেন, “ঋষভ, শোনো।”
ডাক শুনে ঋষভ একবার তাকাল।
“শোনো ঋষভ, দাঁড়াও, কথা আছে।”
ঋষভ শুধু একবার থমকে দাঁড়িয়ে ওঁর দিকে তাকাল। কিন্তু দৃষ্টিতে কোনও পরিচয়ের ভাব ফুটল না। তারপরই কোনও কথা না বলে দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল স্কুলের সামনে দাঁড়ানো দামী গাড়িটায়। গাড়ি ছেড়ে দিল।
এবার দারুণ অপমান বোধ করলেন উমাশঙ্কর রায়। অসহায় অপমান বুকে চেপে বাড়ি ফিরে এলেন।
সেরাতেও ঘুমোতে পারলেন না উমাশঙ্করবাবু। বারবার মনে হতে লাগল, ওইটুকু একটা ছেলে ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে অপমান করেছে। শুধু একবার নয়, সেই অনুষ্ঠানের দিন থেকেই। তাঁকে যে ঋষভ চেনে, সেটুকু স্বীকৃতিও তার ব্যবহারে প্রকাশ করেনি।
কিন্তু কেন?
ভাবতে ভাবতে উমাশঙ্করবাবুর মাথা গরম হয়েছে। বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছে। বারবার মনে হয়েছে, এই বয়সে ওইটুকু একটা ছেলের কাছে এটাই কি তাঁর প্রাপ্য ছিল? ও কি তাঁকে নিয়ে কৌতুক করছে? কিন্তু এই নিষ্ঠুর তামাশা কেন? বড়োলোকের ছেলে বলে? কিন্তু ফেসবুক চ্যাটিংয়ে ওর এই মনোভাব তো কখনও প্রকাশ পায়নি! তাহলে? তাহলে কেন? উমাশঙ্করবাবু তো কখনও এতটুকু উপেক্ষা করেননি। বরং ওর প্রতিভার স্বীকৃতি দিতেই চেয়েছিলেন।
এসব ভাবতে-ভাবতেই একটা গোটা রাত নিদ্রাহীন কেটে গেল উমাশঙ্কর রায়ের। তারপর ভোরের দিকে বোধহয় দু’চোখের পাতা লেগে এসেছিল। তাই কখন সকাল হয়ে গেছে টের পাননি।
ঘুম ভাঙল ডোর বেলের শব্দে। উমাশঙ্করবাবুর বাড়ির কাজের ছেলেটি এসে বলল, এক ভদ্রলোক এসে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
এই সাতসকালে কে এল? উমাশঙ্করবাবু ব্যাজার মুখে বললেন, “তুই চিনিস ভদ্রলোককে?”
“না বাবু, আগে কোনোদিন দেখিনি।”
“ঠিক আছে, ডাইনিংয়ে বসা। আমি আসছি।”
বেশ কিছুটা অনিচ্ছা সহকারেই বিছানা ছেড়ে উঠে চোখেমুখে জল দিয়ে উমাশঙ্করবাবু ডাইনিংয়ে গিয়ে ঢুকলেন। দেখলেন, বছর ত্রিশ বয়সী এক শীর্ণকায় ব্যক্তি ডাইনিংয়ের সোফায় বসে রয়েছেন। পরনে একটা সাধারণ বিবর্ণ পাঞ্জাবি আর পায়জামা।
উমাশঙ্করবাবু ঘরে ঢুকলে আগন্তুক উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত জোড় করে বললেন, “আমি জগন্নাথ চক্রবর্তী। আপনার লেখার একজন ভক্ত বলতে পারেন।”
এবার রীতিমতো বিরক্তি বোধ করলেন উমাশঙ্করবাবু। বললেন, “শুধু এই কথাটা বলার জন্যে আপনি সাতসকালে আমার বাড়িতে এসে হানা দিয়েছেন?”
“না, স্যার।” ভদ্রলোক একটু কাঁচুমাচুভাবে বললেন, “আপনাকে একটা কথা জানাবার জন্যে এসেছি। মানে, না জানালে অপরাধ হয়ে যায়।”
“কী কথা?” এবার কৌতূহল বোধ করলেন উমাশঙ্করবাবু।
“হ্যাঁ মানে, ঋষভ আমার ছাত্র। আমি তার বাড়ি গিয়ে প্রাইভেটে বাংলা পড়াই।”
“হ্যাঁ, তাতে কী? আমাকে এসে একথা বলার মানে?”
“স্যার, আমি এসেছি আপনার একটা ভুল ভাঙিয়ে দিতে। জানি আপনি খুব কষ্ট পাচ্ছেন।” জগন্নাথ চক্রবর্তী দু’হাত কচলে বললেন।
“আমি আপনার কথার মানে ঠিক বুঝতে পারছি না।” উমাশঙ্করবাবুকে এবার বেশ অধৈর্য মনে হল।
“আসলে স্যার, ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ঋষভ কুণ্ডুর বকলমে আপনার উদ্দেশ্যে যা কিছু লেখা সব আমার। ঋষভ এসবের বিন্দুবিসর্গ জানে না।”
“হোয়াট!” উমাশঙ্করবাবু এবার রীতিমতো চমকে ওঠেন। “আপনার এসব কথার মানে কী?”
জগন্নাথ চক্রবর্তী এবার একটু হেঁ হেঁ করে হেসে বললেন, “স্যার, আপনি তো জানেনই আজকালকার গার্জেনদের ব্যাপার। তাঁরা নিজেদের ছেলেমেয়েকে সবকিছুতেই এক্সপার্ট দেখতে চান। স্কুলে ফার্স্ট তো হতেই হবে, একই সঙ্গে নাচ, গান, নাটক…”
“আহ্ জগন্নাথবাবু, আপনি আসল কথায় আসুন।” উমাশঙ্করবাবু এবার বেশ বিরক্তভাবে বললেন।
“হ্যাঁ স্যার, এবার সেটাই বলছি। দীনবন্ধুবাবু, মানে ঋষভের ধনী পিতা, তিনি চান তাঁর ছেলে সবকিছুর সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়াতেও যেন বাজিমাত করে।”
“বাজিমাত!”
“হ্যাঁ, স্যার। সেই জন্যেই তো ওঁর কথাতেই ঋষভের নামে একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় বিখ্যাত সব মানুষের কাছে রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে ফেসবুক ফ্রেন্ড করা হয়েছে ঋষভকে। কিন্তু স্যার, ও তো বাংলা কিছুই জানে না। ওর ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ইংরাজি, আর সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিন্দি। তাই দীনবন্ধুবাবু আমায় ঋষভের বাংলা টিউটর নিযুক্ত করেছেন। হেঁ হেঁ, বুঝতেই পারছেন, আমার আসল কাজ হল ঋষভের নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চালানো। আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা।”
উমাশঙ্করবাবু এবার উঠে দাঁড়ান। “বুঝেছি।”
“হেঁ হেঁ, আমায় স্যার ভুল বুঝবেন না। সেদিন ওই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমি ঋষভকে যেতে বারণ করেছিলাম, স্যার। কিন্তু দীনবন্ধুবাবু শুনলেন না। এটা উনি ওঁর সোশ্যাল স্ট্যাটাসের সঙ্গে জড়িয়ে ফেললেন।”
“আপনার কথা শেষ হয়েছে?” উমাশঙ্করবাবুর কণ্ঠস্বর এবার কঠিন।
“স্যার, বুঝতেই পারছেন, আমি, মানে পেটের দায়ে…”
“আমি সব বুঝেছি।”
“কিন্তু স্যার, বিশ্বাস করুন, আমি আপনার লেখার ভীষণ ভক্ত। আপনার প্রতিটি লেখা পড়ি।” জগন্নাথ চক্রবর্তী গদগদ কণ্ঠস্বরে বললেন, “এবার স্যার আমি আমার নিজের নামে ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট করে আপনার কাছে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাব।”
“না। পাঠাবেন না।” উমাশঙ্করবাবু ইতিমধ্যে পিছু ফিরেছেন। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, “আমি আর কোনও ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করব না।”
অলঙ্করণঃ মৌসুমী
হাহাহা..বেশ ভাল
LikeLike
ভালো লাগলো।
LikeLike
দারুন গল্প।লেখকের কলম জমজমাট।মন কেড়ে নিল।
LikeLike
দারুন লাগল গল্পটি।
LikeLike
সাধারণতঃ লেখক আর কবি রা খুব সহানুভূতিশীল আর দয়ালু হন। অসহায় জগন্নাথ বাবু দুটো পয়সা রোজগারের জন্য কোনো গর্হিত কাজ তো করেন নি আর উনি উমাশঙ্কর বাবুর লেখার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত পাঠক । উমাশঙ্কর বাবুর এই আচরন লেখকদের মতো নয় এমনটা যদি হত যে প্রথমে অণার রাগ হল একটু পরে রাগ পড়ে গেলে আবার উনি জগন্নাথ বাবুর খোজ করছেন একজন সহানুভূতিশীল হৃদয়ের লোকের সেই আচরণটাই স্বাভাবিক। আমি আমার নিজের জীবনে তাই দেখেছি অনেক খ্যাতনামা লেখক/ লেখিকদের আচরণে ।
LikeLike