সত্যজিত দাশগুপ্তর আগের গল্প মোতিবিবি, ক্লাইম্যাক্স, বোলতার চাক, বিশ্বনাথের চিত্রনাট্য, ফ্ল্যাট নম্বর ২০১
সেই মেয়েটা
সত্যজিৎ দাশগুপ্ত
সবেমাত্র বিশ্বকর্মা পুজো গেল। হাওয়ায় এখন পুজো পুজো গন্ধ। আসলে বাঙালির পুজো অনেক। শুধু ‘পুজো’ বললে লোকে কিন্তু দুর্গাপুজোই বোঝে। অন্য কোনও পুজোর ক্ষেত্রে তার নামটাও জুড়ে দিতে হয়। যেমন, বিশ্বকর্মা পুজো, কালী পুজো, সরস্বতী পুজো ইত্যাদি। তো যাই হোক, সামনে পুজো বলে কিডোদের মেজাজ এখন তুঙ্গে। বিকেল থেকেই ওরা সবাই লোকনাথদাদুর ফ্ল্যাটে। উদ্দেশ্য, অবশ্যই গল্প শোনা। এর লোভে ওরা যে কতদিন কাটিয়েছে এই ফ্ল্যাটে, তার হিসেব নেই। তাছাড়া প্রায় পঁয়ষট্টি ছুঁই ছুঁই এই মানুষটার তিনকুলেও তো কেউ নেই। বন্ধু বা সাথী বলতে চব্বিশ ঘণ্টার একটা কাজের লোক আর এই চার ক্ষুদে বন্ধুরা। সত্যি বলতে কী, ওদের সাথে গল্প করতে বেশ লাগে লোকনাথদাদুর। সারাজীবন হিল্লি-দিল্লি অনেক জায়গা করেছেন ভদ্রলোক। তার সাথে সঞ্চয় করেছেন এক সমুদ্র অভিজ্ঞতা। আর সেগুলোই গল্প হয়ে ওঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে কিডোদের সামনে।
কিডো, দ্যুতি, রিবাই বা রায়ান কারোর বাবা-মায়েদেরই কিন্তু তাঁদের ছেলেমেয়েদের লোকনাথদাদুর ফ্ল্যাটে আসা নিয়ে কোনওরকম আপত্তি নেই। ভদ্রলোকের নানান বিষয়ে জ্ঞান থাকার জন্য কেউ কেউ ওঁকে বলেন, গুগল দাদু। আবার দারুণ গল্প বলতে পারার জন্য কারও কারও কাছে উনি তো একালের তারিণীখুড়ো নামেও পরিচিত! তাই বাবা-মায়েরা জানেন, দাদুভাইয়ের সাথে থাকলে আর যাই হোক, ছেলেমেয়েরা খারাপ হবে না।
“আজ কীসের গল্প শুনব?” প্রশ্ন করল কিডো।
বসার ঘরে তাঁর অতি প্রিয় ইজি চেয়ারটাতে বসে ছিলেন লোকনাথদাদু। ক্ষুদে বন্ধুরা তখন ওঁর সামনে মেঝেতে শতরঞ্চির ওপর বসে।
“আজ কিন্তু একটা দারুণ গল্প বলতে হবে।” আবদার করে উঠল দ্যুতি।
“দারুণ কি না জানি না, তবে একটা গল্প আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।” মুচকি হেসে বললেন লোকনাথদাদু।
“কীসের? ভূতের, না হাসির?” জিজ্ঞাসা করল রিবাই।
“না, সেটা ঠিক হাসির নয়। তবে ভূতের কি না সেটাও বলতে পারব না।” বললেন লোকনাথদাদু।
“সে যাই হোক। তুমি শুরু করো তো!” বেশ বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব করে বলল রায়ান।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি শুরু করো।” প্রায় একসঙ্গে হামলে পড়ল সবাই।
আর নিস্তার নেই, বুঝতে পারলেন লোকনাথদাদু। গল্প এবারে ওঁকে বলতেই হবে। গোপাল এর মধ্যে কিডোদের জন্য জলখাবার দিয়ে গেছে। তার সঙ্গে লোকনাথদাদুর জন্য এসেছে পেল্লায় কাপে এক কাপ চা। এবার তাতে একটা আয়েশের চুমুক মেরে তাঁর নতুন গল্প শুরু করলেন লোকনাথদাদু।
বেশ অনেকদিন আগের কথা। বাদল তখন কলেজে। ক্লাস, ক্রিকেট, সিনেমা, পাড়ার মোড়ে আড্ডা, এই ছিল বাদলের জীবন। কলেজ থেকে পাড়া, সব জায়গাতেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল সে।
সময়টা বর্ষার শেষ। শরৎ প্রায় ঢুকে গেছে। ঘড়িতে ঘণ্টার কাঁটা দুপুর দুটো ছুঁয়েছে মিনিট পাঁচেক আগে। কলেজে ক্লাস চলছে। সবাই হাঁ করে গিলছে প্রফেসরের লেকচার। মুখে কারও টু শব্দ নেই। বাদলও ডুবে রয়েছে ক্লাসের পড়ায়। ঠিক এমন সময় আচমকা কে যেন ওর চোখজোড়া জোর করে ঘুরিয়ে দিল ক্লাস রুমের গায়ে বারান্দায় লাগোয়া জানালাটার দিকে। এমনিতে সেটা বন্ধই ছিল। কিন্তু ডানদিকের কপাটটা সামান্য ফাঁক হয়ে থাকাতে তার মধ্য দিয়ে বারান্দার যে অংশটা দেখা যাচ্ছিল সেখানেই বাদল আবিষ্কার করল একটা বাচ্চা মেয়েকে। বয়স খুব বেশী হলে পাঁচ। পরনে ফ্রক। গায়ের রং দুধে আলতায়। গোলপানা মুখ। টানা টানা চোখ। মাথাভর্তি ঝাঁকরা কালো চুল। মিষ্টি একটা মুচকি হাসি মুখে নিয়ে অপলকে মেয়েটা চেয়ে ছিল বাদলের দিকে। এমন মিষ্টি বাচ্চার মুখ থেকে চোখ ফেরানো যায় না। ওকে দেখে প্রথমে একবার মুচকি হাসল বাদল। তখন কেন জানি না, বাচ্চাটা ডানহাত তুলে বাদলকে ভিক্ট্রি সাইন দেখাল!
জিনিসটা রহস্যময় ঠেকল বাদলের কাছে। কে এই বাচ্চাটা? এখানে কী করছে? এই জায়গায় এল কোথা থেকে? কার সাথে এল? ও কি কলেজেরই কারও মেয়ে? হয়তো বাবা বা মায়ের সাথে এসেছে, তারপর ভুল করে পথ হারিয়ে এখানে এসে পড়েছে। কিন্তু মেয়েটা ওকে এইভাবে ভিক্ট্রি সাইন দেখাচ্ছে কেন? বাচ্চাটা ওকে এমনভাবে দেখছে, যেন ও বাচ্চাটার বহুদিনের চেনা! স্যারের লেকচার কানে ঢোকার বদলে এবার মাথায় এইসব ঘুরপাক খেতে শুরু করল বাদলের।
বাচ্চাটার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে চোখ নাচাল বাদল। তাতে বাচ্চাটার হাসিটা আরও চওড়া হল। এবার জিভ ভ্যাঙাল। আর তারপর চোখ ট্যাঁরা করল। তখন দাঁত বের করল বাচ্চা মেয়েটা। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠল। আর ক্লাসে বসে থাকতে পারছিল না বাদল। ইচ্ছে করছিল দৌড়ে বাইরে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়। শেষে ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা পড়তে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে ক্লাসের বাইরে বেরোল।
কিন্তু কোথায় সেই বাচ্চাটা? এদিক সেদিক অনেক খুঁজল। কিন্তু কোথাও দেখতে পেল না ওকে। একে তাকে অনেককে জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু কেউ বাচ্চাটার ব্যাপারে কিছু বলতে পারল না। অনেকে তো বিশ্বাসই করতে চাইল না যে কলেজে এই সময় কোনও বাচ্চা আসতে পারে। অগত্যা হতাশ হয়ে আবার ক্লাসের দিকে পা বাড়াল বাদল। এবার বাচ্চাটাকে যেখানে দেখেছিল, সেখানে মেঝেতে চোখ গেল ওর। কী যেন একটা পড়ে ছিল জায়গাটাতে। জিনিসটা দেখে সন্দেহ হল ওর। এবার সেদিকে এগিয়ে গেল ও। তারপর ঝুঁকে পড়ে মাটি থেকে যে জিনিসটা তুলল সেটা মেয়েটার একটা ছবি। সাথে সাথে কোঁচকানো কপাল সোজা হয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠল বাদলের। ছবিটা একবার ঝেড়ে নিয়ে তারপর সেটা আবার একে তাকে দেখিয়ে মেয়েটার খোঁজ শুরু করল ও। কিন্তু ছবি দেখেও কেউ বাচ্চাটাকে চিনতে পারল না।
দিনের শেষে বেশ মনমরা হয়েই কলেজ থেকে বেরোল বাদল। চোখের সামনে যেন সবসময় দেখতে পাচ্ছিল বাচ্চা মেয়েটার মুখটা। থেকে-থেকেই মনে হচ্ছিল, এই তো বাচ্চাটা ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। বুক পকেটেই রেখেছিল ছবিটা। বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে একবার পকেট থেকে ছবিটা বের করে দেখল ও। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাড়ি ফেরার একটা বাস এল। বেশ ভিড় ছিল বাসটায়। কিন্তু এটা ছাড়লে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যেতে পারে। তাই ভিড় বাসেই উঠে পড়তে হল। কিছুটা যেতে ভাগ্যক্রমে একটা সিটও পেয়ে গেল বাদল।
প্রায় মিনিট খানেক চলার পর বাসটা এবার একটা সিগন্যালে দাঁড়াতে বাদলের চোখ গেল রাস্তার ধারে ফুটপাথের ওপর। সাথে সাথে চমকে উঠল ও। আরে! ওই তো মেয়েটা! ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ওর দিকেই চেয়ে মিটিমিটি হাসছে। আর তার সাথে ডানহাত তুলে দেখাচ্ছে সেই ভিক্ট্রি সাইনটা! ঝট করে এবার মাথা ঘোরাল বাদল। সিগন্যাল তখনও লাল। এখনই সেটা সবুজ হলে বাসটা বাচ্চাটাকে ফেলে চলে যাবে অনেক দূর। আর বসে থাকতে পারল না ও। ভিড় ঠেলে প্রায় হুড়মুড়িয়ে বাস থেকে নামল। তারপর রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে রাস্তা পেরলো। কিন্তু উলটোদিকের ফুটপাথে উঠে আবার হতাশ হতে হল ওকে। কারণ, বাচ্চাটা আবার কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে!
পাশের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অন্যান্য দোকান, এমনকি তার খদ্দেরদেরও জিজ্ঞাসা করল বাচ্চাটার সম্পর্কে। কিন্তু কেউ বাচ্চাটার হদিশ দিতে পারল না। ছবি দেখিয়েও কোনও লাভ হল না। কেউ চিনতে পরল না বাচ্চাটাকে। কিছু কিছু লোক তো বলল যে ওখানে কোনও বাচ্চা ছিলই না! একজন তো ওকে ছেলেধরা বলতেও ছাড়ল না!
মনমরা হয়ে শেষে ফেরার জন্য পা বাড়াল বেচারা। চোখের সামনে ভাসছিল বাচ্চা মেয়েটার মুখটা। ভেতরের অস্বস্তিটা অসহ্য লাগছিল ওর। মনে হচ্ছিল, যেন তেন প্রকারে ওকে বাচ্চাটার সাথে দেখা করতেই হবে। কিন্তু সেটা কেন, তা ও জানে না। এর মধ্যে সিগন্যাল আবার লাল হয়ে সবুজ হয়েছে। গাড়িগুলো চলতে শুরু করেছে। তার মধ্যেই রাস্তা পার হবার জন্য পা বাড়াল বাদল। আর অন্যমনস্ক থাকার জন্য এবার একটা চলন্ত ট্যাক্সির সামনে চলে আসতে আরেকটু হলেই অন্যথা হয়ে যেতে পারত! কিন্তু সময়মতো ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়াল ট্যাক্সিটা। বলতে গেলে বরাত জোরে সেদিনের মতো প্রাণে বেঁচে গেল বাদল।
মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর এবার যে বাসটা এল সেটা বেশ ফাঁকা। তাতে উঠে আবার ওর নজর গেল সামনের ফুটপাথের দিকে। আশ্চর্য ব্যাপার, আবার ও দেখতে পেল বাচ্চা মেয়েটাকে। মুখে সেই মুচকি হাসি। হাতে চেনা ভিক্ট্রি সাইন! এবার আবার দৌড়ে বাস থেকে নামতে যাবে, কিন্তু কী মনে হতে ঝট করে ঘুরে আবার ফুটপাথের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। কারণ, বাচ্চাটা তখন ফুটপাথে নেই! কর্পূরের মতো কোথায় যেন উবে গেছে! এবার জানালার ধারের সিটটা খালি পেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেটা দখল করে বসল বাদল। মনের কোণে একটা মোচড় অনুভব করল ও। যেমন করেই হোক বাচ্চাটার সাথে ওকে দেখা করতেই হবে। যত সময় যাচ্ছে, তত ওর মনে একটা বিশ্বাস চেপে বসছে যে এই বাচ্চাটা নিশ্চয়ই ওর বহুদিনের চেনা। অনেকদিনের সম্পর্ক রয়েছে এই বাচ্চাটার সাথে। নিশ্চয়ই ও কিছু বলতে চাইছে ওকে। কিন্তু পারছে না। কী বলতে চাইছে, সেটা ওকে জানতেই হবে।
বাড়ি ফিরে সেই বিকেল থেকে একই কথা মাথায় ঘুরছিল বাদলের। সোফায় বসে চোখ বুজে বিশ্রাম করার সময়, টিভি দেখার সময় খালি বাচ্চাটার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। সন্ধেবেলা চায়ের কাপ নিয়ে আনমনা হয়ে বসে থাকতে দেখে বোন তো জিজ্ঞাসাই করে বসল, “কী রে দাদা, কী হয়েছে তোর?”
তাতে ও, “ও কিছু না।” বলে প্রথমটায় এড়িয়ে গেলেও কিছুক্ষণ পরে বইয়ের ফাঁক থেকে বাচ্চাটার ছবি বের করে বোনকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল যে ও ওই বাচ্চাটাকে চেনে কি না। ছবিটা হাতে নিয়ে নিচের ঠোঁটটা উলটে মাথাটা বার তিনেক ডাইনে বাঁয়ে নাড়ল বোন। এরপর এল মায়ের পালা। তারপর বাবার। কিন্তু কেউই বাচ্চাটাকে চিনতে পারল না।
রাত তখন ন’টা। বাইরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আবহাওয়াটা বেশ ঠাণ্ডা। বেশ কিছুক্ষণ পড়ার বইয়ে মুখ গুঁজে বাদল দেখল তেমন কোনও লাভ হচ্ছে না। টিভিতেও মন বসছে না। তাই এবার ঘরের আলো নিভিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসে একদৃষ্টে চেয়ে রইল বাইরের আকাশটার দিকে। বৃষ্টি হওয়ার জন্য কালো মেঘগুলো সরে গেছে। আকাশটা ঝলমলে হয়ে তারাগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। এমন পরিবেশে মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। ধীরে ধীরে শরীর ছেড়ে দিচ্ছিল বাদলের। খুব ঘুম পাচ্ছিল ওর।
কখন যে চোখদুটো বুজে এসেছিল, বুঝতে পারেনি। এবার ঘুমটা ভাঙল একটা শব্দে। ঝট করে চোখদুটো খুলল ও। সোফায় হেলান দেওয়া অবস্থাতেই শব্দটা বোঝার চেষ্টা করল। তারপর একটা হালকা হাসির শব্দ কানে আসতে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। এ তো কোনও বাচ্চা মেয়ের হাসি!
কোথায়? কোথায় মেয়েটা? পাগলের মতো ঘার ঘুরিয়ে ডাইনে বাঁয়ে মেয়েটাকে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ করে ওর চোখ আটকে গেল ঘরে কোণে আলমারিটার গায়ে বসানো আয়নাটার ওপর। সাথে সাথে চোখ কপালে উঠে গেল ওর। সর্বনাশ! আয়নার ভেতরে ও কে? এ তো সেই বাচ্চা মেয়েটা! ওর দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে। আর তার সঙ্গে ডানহাতে দেখাচ্ছে সেই ভিক্ট্রি সাইনটা!
দৃশ্যটা দেখে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল বাদল। তারপর দৌড়ে গেল আলমারির দিকে। একেবারে আয়নার কাছে এসে পড়েছে, ঠিক তখন যেন কর্পূরের মতো আবার উবে গেল বাচ্চাটা! আর সঙ্গে সঙ্গে বাদল প্রায় আছড়ে গিয়ে পড়ল আয়নাটার ওপর। বেশ কিছুক্ষণ অপলকে চেয়ে রইল আয়নার দিকে। এর মধ্যে সারা শরীর ঘেমে গেছে। মাথাটা যন্ত্রণায় ঢিপঢিপ করছিল। চোখে কি তাহলে সত্যিই ভুল দেখছে ও? কিন্তু এতটা ভুল? তাও বারবার? এও কী করে সম্ভব? তবে কি ওর হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? বেশি চিন্তা করছে বলে কি ওর এই অবস্থা? কে জানে? হবে হয়তো।
এরপর ঘরে তারপর থেকে আর কারও সঙ্গে কথা বলল না বাদল। মা একবার জিজ্ঞাসা করলেন যে শরীর ঠিক আছে কি না। তাতে দায়সারাভাবে একবার ঘাড় কাত করল।
শোবার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ঘুমে চোখ বুজে এল বাদলের। রাত তখন আন্দাজ দুটো কি আড়াইটে। শিরশিরে ঠাণ্ডা হাওয়াতে ঘুমের মধ্যেই শীত করছিল বাদলের। এবার ওই অবস্থাতেই গায়ের ওপর চাদরটা টেনে নিল ও। এভাবে কাটল আরও মিনিট দশেক। এমন সময় নাকে এল একটা মিষ্টি গন্ধ। আচমকাই এবার ঘুমটা ভেঙে গেল ওর। গভীর ঘুম ভাঙলে যে কারও কষ্ট হয়। তাই চোখ পিটপিট করতে করতে অন্ধকার ঘরের সঙ্গে দৃষ্টিটাকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল বাদল। প্রথমটায় বেশ কিছুটা সময় নিল। একতলায় রাস্তার ধারের যে ঘরে ও থাকে, তাতে তিনটে জানালা, আর তার সবক’টাই রাস্তার দিকে। ঘুম ভাঙার পর সবসময় মাথার কাছে জানালাটার দিকেই চোখ যেত বাদলের। এবারেও আস্তে আস্তে জানালার দিকে মাথা কাত করল। আর সঙ্গে সঙ্গে স্প্রিংয়ের মতো শরীরটাকে সোজা করে বিছানায় উঠে বসল। ঢোঁক গিলতে গিয়ে গলার কাছটা শুকনো পেল। অজান্তেই মুখ হাঁ হয়ে গেল বাদলের। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। চেঁচিয়ে ঠিক কাকে ডাকতে গেল তা ও জানে না। কিন্তু ডাকতে পারল না। শুধু গলা চিরে মিহি একটা শব্দ বেরোল মাত্র। ভয়ে কাঠ হয়ে জানালার দিকে চেয়ে বসে রইল ও। কারণ, সেই মেয়েটা তখন জানালার ওপারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখ করে ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে! আর সেই সঙ্গে দেখাচ্ছে তার অতি পরিচিত ঢংয়ে ডানহাতের সেই ভিক্ট্রি সাইনটা।
অনেক কষ্টে এবার মনের সব জোরকে একজোট করল বাদল। তারপর ‘কে?’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। সেই চিৎকার শুনে বাচ্চাটা তখন ঝট করে জানালার সামনে থেকে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে ছুটে গেল বাদল। বাচ্চাটা তখন সামনের পিচের রাস্তাটা ধরে মাথা নিচু করে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে। আর মাঝেমধ্যেই পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। সেই মুচকি হাসিটা কিন্তু তখনও লেগেই রয়েছে মেয়েটার মুখে।
আর অপেক্ষা করল না বাদল। আসল কথা, ও আর ঘরের ভেতর থাকতে পারল না। ছুট্টে বেরোল ঘর থেকে। তারপর দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে দৌড়ল বাচ্চাটার পেছন পেছন। সারা পাড়া তখন ঘুমিয়ে রয়েছে। নিকষ কালো আকাশে তারাগুলো ছাড়া রাস্তার পাশের ঝোপের ঝিঁঝিঁপোকাগুলো শুধুমাত্র ওর সঙ্গে রয়েছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে কানে আসছে কুকুরের ডাক। এর মধ্যেই ফাঁকা রাস্তা দিয়ে প্রাণপণে বাচ্চাটার পেছন পেছন ছুটতে লাগল বাদল। কিন্তু তবুও বাচ্চাটাকে হাতের নাগালে পেল না। বেশ কিছুক্ষণ একটানা দৌড়নোর পর শেষে হাঁফাতে শুরু করল ও। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। আশ্চর্য ব্যাপার, এতটা দৌড়েও বাচ্চাটার সঙ্গে এতটুকু দূরত্ব কমেনি ওর! আস্তে আস্তে শরীর অবশ হয়ে আসছিল বাদলের। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছিল। দূরে তখন মেয়েটাকে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। এমন সময় রাস্তার শেষপ্রান্তে তীব্র একটা আলো ফুটে উঠল। সেই আলো চোখে পড়তে দু’চোখ ধাঁধিয়ে গেল বাদলের। বাঁহাত চোখের ওপর দিয়ে প্রথমে আলোটাকে আড়াল করার চেষ্টা করল ও। কিন্তু কোনও লাভ হল না। আলোটা এবার বড়ো হতে হতে একটা থেকে দুটো হয়ে গেল। দেখতে দেখতে তীব্রতাও বাড়তে লাগল সেগুলোর। এবার খেই হারিয়ে ফেলল বাদল। আলোগুলো তখন ওর খুব কাছে এসে পড়েছে। এবার আরও কাছে এসে একেবারে ঘাড়ের ওপর উঠে আসতে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে ও ছিটকে গিয়ে পড়ল রাস্তার ধারে। আর বিশাল আকারের পাঞ্জাব লরিটা ঠিক সেই মুহূর্তে রাস্তার ধারে প্রচণ্ড শব্দ করে ব্রেক কষে দাঁড়াল।
বাদলের দেহটা তখন রাস্তার ওপর পড়ে কাটা ছাগলের মতো ছটফট করছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। এরপর কাটল প্রায় সেকেন্ড পনেরো। দেখতে দেখতে নিথর হয়ে গেল বাদল। লরির ড্রাইভার তখন লাফিয়ে নিচে নেমে পড়েছে। বার দুয়েক ডাইয়ে বাঁয়ে তাকাতে সে আবিষ্কার করল রাস্তার ধারে পড়ে থাকা বাদলকে। সঙ্গে সঙ্গে সে দৌড়ে গেল সেদিকে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ! অন্ধকারের মধ্যেই ড্রাইভার ঝুঁকে পড়ল বাদলের ওপর। নজরে পড়ল, ওর ডানহাতে কী যেন ধরা রয়েছে। অজানা একটা ছেলে আচমকা তার লরির তলায় এসে প্রাণ দিয়েছে। ভয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনটাও ভার হয়ে গেছিল ড্রাইভারের। হাতে ধরা জিনিসটা দেখে সে একবার ভাবল, হয়তো এর থেকে ছেলেটার পরিচয় পাওয়া গেলেও যেতে পারে। এবার হাত বাড়িয়ে সেটা নিতে দেখল সেটা একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি। এমন সময় একটা শব্দ কানে এল ড্রাইভারের। তখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথাটা ডানদিকে ঘোরাতে আবিষ্কার করল ওর প্রায় দশ গজ দূরে দাঁড়ানো একটা বাচ্চা মেয়েকে। ওর দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে মেয়েটা। ভালো করে এবার ওর মুখটা দেখে আশ্চর্য হল সে। কারণ এইমাত্র ছবিতে দেখা মেয়েটাই যে এ, তাতে ওর কোনও সন্দেহ নেই! কিন্তু আরও আশ্চর্য হল মেয়েটার হাতের দিকে দিকে তাকিয়ে। মেয়েটা ডানহাত তুলে ওকে কিছু একটা দেখাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারল না সেটা কী। শুধু দেখতে পেল, মেয়েটা ওর দিকে ডানহাত তুলে তর্জনী, মধ্যমা আর অনামিকা, এই তিনটে আঙুল তাক করে রয়েছে।
এতটা বলে থামলেন লোকনাথদাদু। গল্পের রহস্যটা ধরতে কিডোদের বেশ খানিকটা সময় লাগল। শেষে কিডোই প্রথমে কথা বলল। “তার মানে, বাচ্চা মেয়েটাই এক এক করে সবাইকে খুন করছিল?”
“আর বাদল ছিল তার দু’নম্বর শিকার?” বলল দ্যুতি।
“মেয়েটা কি ভূত ছিল, দাদুভাই?” জিজ্ঞাসা করল রায়ান।
তাতে হেসে লোকনাথদাদু বললেন, “সেটা তো জানা নেই, দাদুভাই।”
“ও কি শেষমেশ লরি ড্রাইভারটাকেও মেরে ফেলেছিল?” জিজ্ঞাসা করল রিবাই।
“তাও জানি না, দাদুভাই।” বললেন লোকনাথদাদু।
“সেই মেয়েটার নাম কী ছিল, দাদুভাই?” আবার প্রশ্ন করল কিডো।
উত্তরে এবার নিচের ঠোঁটটা ওলটালেন লোকনাথদাদু।
অলঙ্করণঃ মৌসুমী