বন্ধু ভূত
কৌশানী দেব
বাড়ির পাশের খেলার মাঠে মনমরা হয়ে বসেছিলাম। হঠাৎ বিপাশা মানে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এসে বলল, “কী রে ইত্তা, তোর কী হয়েছে বল তো? গত দু’বছর তুই এত ভালো রেজাল্ট করলি, ফার্স্ট হলি, তাহলে এবছর এত খারাপ করলি কী করে?”
আমি মাথা নীচু করে বললাম, “সে অনেক বড়ো গল্প।”
বিপাশা উত্তেজিত স্বরে জানতে চাইল, “কীরকম? বলবি না আমাকে?”
আমি বললাম, “বলতে পারি, তবে আগে তুই প্রমিস কর, এই কথাগুলো আর কাউকে বলবি না।”
ও বলল, “ঠিক আছে।”
আমি তখন বলতে শুরু করলাম, “তবে শোন। তুই তো জানিসই যে ভূত আমি কত ভালোবাসি। তুই তো আমার ঘরেও গেছিস। দেয়ালে ভয়ংকর ভূতের পোস্টারগুলোর কথা তোর নিশ্চয়ই মনে আছে? আর বুক শেলফটায় তো দেখেছিসই, শুধু ভূতেরই বই। দেশি, বিদেশি সবরকমের। আর জানিস, আমি মনে মনে রোজ রাতে শোওয়ার আগে ভূতেদের ডাকতাম।
“বছর তিনেক আগে একদিন গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ‘দ্য ভ্যাম্পায়ার প্রমিস’ পড়ছিলাম। এমন সময় কে যেন আমার কানের সামনে এসে বলল, ‘কী ইত্তা, তোমার নাকি খুব ভূত দেখার শখ?’
“আমি চমকে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি একটা লোক হাওয়ায় ভাসছে। তখন আমার মনের ভেতরে যে কী হচ্ছিল তোকে বোঝাতে পারব না। ভূতটা আমার এই বাকরুদ্ধ অবস্থা দেখে বলল, ‘তোমার ভূতচর্চা দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি।’
“আমি এবার একটু সাহস করে বললাম, ‘তুমি কে?’
“ভূতটা বলল, ‘আমার নাম জ্ঞানেন্দ্রমোহন চাকলাদার। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভূগোল পড়াতাম। রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর দেখা হল সুন্দরলাল বসুর সঙ্গে। উনি আবার আমার মাস্টারমশাই। খুব রাগী। মাস্টারমশাই আমাকে বললেন আমাজনের জঙ্গলে চলে যেতে। সেখানকার পশুপাখির ভূত নিয়ে গবেষণা করতে। ওঁর আদেশ অমান্য করার সাহস আমার ছিল না। তাই চলে গেলাম আমাজনে। দেখতে দেখতে তিরিশটা বছর কেটে গেল। কতরকম যে ভূত দেখলাম তার হিসেব নেই। তারপর কিছুদিন আগে মাস্টারমশাই আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, অনেকদিন তো এসব করলে, এবার সোজা কলকাতায় চলে যাও। দেখো ছেলেপুলেরা কেমন পড়াশোনা করছে। তাই কয়েকদিন হল এদিকে এসেছি। তুমি এত ভূত ভালোবাসো দেখে আজ তোমার কাছে চলে এলাম। তোমার তো পড়াশোনায় মন নেই। তা তুমি ভূতেদের ডেকে কী করবে বলো তো?’
“আমি এবার সোজা হয়ে বসে বললাম, ‘মোহনকাকু, আমি ভূতের কাছ থেকে কিছু সাহায্য চাইতাম। শুনেছি তোমরা অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারো।’
“ভূতটা সঙ্গে সঙ্গে ভুঁরু কুঁচকে বলল, ‘মোহন নয় জ্ঞানেন্দ্রমোহন।’
“আমি বললাম, ‘ধুত! অত কঠিন নাম আমি উচ্চারণ করতে পারব না।’
“ভূতটা তখন হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, মোহনকাকুই সই। তোমার কী সাহায্য দরকার বলো।’
“আমি বললাম, ‘আমার স্কুলের পড়া করতে মোটে ভালো লাগে না। তাই স্কুলে ম্যামরা যখন পড়া ধরবেন কানে কানে ঐ পড়াটা আমাকে বলে দিও। বিশেষত ছন্দিতা-ম্যামের ক্লাসে। উনি আমাদের ভৌতবিজ্ঞান পড়ান। খুব রাগী। পড়া না করে এলে ভীষণ বকেন। একেকদিন তো কানটাই মুলে দেন। আর কিছু হোম ওয়ার্কও করে দিও। দেবযানী-ম্যাম আমাদের বাংলা পড়ান। উনি রোজ প্রচুর হোম ওয়ার্ক দেন। সেগুলো আমার করাই হয় না। তাই এই নিয়ে তিনবার গার্জেন কল হয়ে গেছে। মা-বাবা ভীষণ রেগে আছে। তাই প্লিজ, প্রতিদিন আমার হোম টাস্কগুলো করে দিও। আর পরীক্ষার সময় প্রশ্নের উত্তরগুলো একটু বলে দিও। তাহলেই হবে।’
“মোহনকাকু আমার দিকে তাকিয়ে একটু ভেবে বলল, ‘ঠিক আছে। তবে তোমাকেও আমার কয়েকটা শর্ত মানতে হবে।’
“আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী শর্ত?’
“মোহনকাকু জবাবে বলল, ‘প্রথমত, তুমি ঘুণাক্ষরেও কাউকে আমার কথা বলতে পারবে না। মাথায় রেখো, তুমি ছাড়া কিন্তু কেউ কিন্তু আমাকে দেখতে পাবে না। দ্বিতীয়ত, ভূত হবার পর অনেকদিন ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া হয়নি। তাই মাঝে-মধ্যেই আমাকে ভালো খাবার খাওয়াতে হবে।’
“এরপর মোহনকাকু লাজুক হেসে আরও বলল, ‘তিরিশ বছর বাদে কলকাতায় ফিরে দেখছি এখানকার মানুষ খুব আধুনিক হয়ে গেছে। শহরটাও খুব উন্নত হয়েছে। সবার হাতে স্মার্ট ফোন। তা তুমি যদি আমাকে ওই ফোন ব্যবহার করা শিখিয়ে দিতে, তাহলে খুব খুশি হব।’
“আমি হেসে বললাম, ‘তুমি আমার এত উপকার করবে, আর আমি তোমার জন্য এইটুকু করতে পারব না? তোমার সব ইচ্ছা আমি পূরণ করব।’
“এরপর মোহনকাকু চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল পরদিন ঠিক সন্ধ্যা ছ’টার সময় আমার কাছে চলে আসবে।
“পরদিন স্কুল থেকে ফিরে গেম খেলছিলাম। হঠাৎ জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি মোহনকাকু হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আসছে। তা দেখে আমি ভীষণ খুশি। ডমিনোজ থেকে আনা চকলেট পিৎজার বাক্সটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম। মোহনকাকু এক নিমেষে সবক’টা পিৎজা খেয়ে ফেলল। তারপর হাত চাটতে চাটতে আমাকে বলল, ‘ফোনে কী করছ?’
“আমি জবাব দিলাম, ‘গেম খেলছি।’
“মোহনকাকু বলল, ‘তা আমাকে একটু শিখিয়ে দাও।’
“মুচকি হেসে বললাম, ‘আগে বাংলা হোম ওয়ার্কগুলো করে দাও।’
“মোহনকাকু অল্পক্ষণের মধ্যেই সব কাজ সেরে ফেলল। তা দেখে আমি ভীষণ অবাক হয়ে বললাম, ‘এত তাড়াতাড়ি করলে কী করে? আমার তো সারারাত লেগে যেত।’
“মোহনকাকু হেসে ফেলল। বলল, ‘এগুলো আবার কাজ নাকি?’
“এরপর আমি ওকে ফোনে দু-তিনরকমের গেম খেলতে শিখিয়ে দিলাম। মোহনকাকু মন দিয়ে গেম খেলতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ মায়ের পায়ের আওয়াজ পেয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল কে জানে। আমিও ওদিকে বই হাতে নিয়ে পড়ার ভান করলাম। সব হোম ওয়ার্ক হয়ে গেছে দেখে মা খুব খুশি হল। রাতে খাওয়ার সময় চিকেনের লেগ পিসটা আমাকেই দিল।
“পরেরদিন স্কুলে বাংলার সব কাজ করে আনার জন্য দেবযানী-মিসের কাছে বাহবা পেলাম। ছন্দিতা-মিস ক্লাসে যখন পড়া ধরছিলেন, মোহনকাকু কানে কানে আমাকে সব উত্তর বলে দিচ্ছিল। তাই আমি সব ঠিক জবাব দিলাম। ম্যাম খুব খুশি হয়ে আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। সুদীপ্তা-ম্যামের ক্লাসে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়াটা ঝরঝর করে বলে দেওয়ায় ম্যাম একটু অবাকই হলেন।
“এরপর ভালো ছাত্রী হিসেবে স্কুলে আমার একটা ইমেজ তৈরি হল। আর গার্জেন কল হয় না দেখে মা-বাবা ভীষণ খুশি। মোহনকাকুও বেশ ফূর্তিতেই ছিল। সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত আমার পাশে বসে গেম খেলত। মাঝে-মধ্যেই আমার সঙ্গে নতুন হিন্দি সিনেমা দেখত। কয়েকদিনের মধ্যেই ও সলমন, রণবীর, অনুষ্কা, ক্যাটরিনাদের চিনে ফেলেছিল। আমিও বেশ মজাতেই ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন মোহনকাকু এল না। সেদিন স্কুলে কোনও মিস হোম ওয়ার্ক না দেওয়ায় আমার তেমন চিন্তা ছিল না। কিন্তু আরও টানা পাঁচদিন মোহনকাকুর পাত্তা পাওয়া গেল না। আমার তো একেবারে নাজেহাল অবস্থা। একদিকে পড়া না করে আসার জন্য প্রতিদিনই ছন্দিতা-ম্যামের কাছে কানমলা খাচ্ছি। তিনদিন হোমওয়ার্ক করে না আনার জন্য দেবযানী-ম্যাম গার্জেন কল করেছেন। অন্যদিকে লতিকা-ম্যামের ভূগোল পড়া পারছি না বলে সবার সামনে ওঠবোস করাচ্ছেন।
“এসব থেকে বাঁচতে একটা প্ল্যান করলাম। স্কুল থেকে ফিরে নিজের পড়ার টেবিলে মোহনকাকুর প্রিয় নানা খাবার সাজিয়ে রাখলাম। তারপর ওকে স্মরণ করে কাঁদতে লাগলাম। মোহনকাকু আমার ডাকে সাড়া দিয়ে এল। তবে বেশ চিন্তিত হয়ে বলল, ‘তোমার এখানে এসে আমি যা যা করি তা সব আমার স্যার জেনে গেছেন। আমার ওপর রেগে গেছেন খুব। আমাকে কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। সামনের সপ্তা থেকে আমাকে রাঁচির পাগলা গারদে গিয়ে ওখানকার ভূতেদের নিয়ে গবেষণা করতে হবে।’
“আমি একথা শুনে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই দেখলাম একজন ধুতি-পাঞ্জাবি-চশমা পরা দশাসই চেহারার লোক এসে মোহনকাকুকে কান ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। আর মোহনকাকু, ‘স্যার, কান ছেড়ে দিন স্যার, খুব লাগছে!’ বলে চ্যাঁচাতে লাগল। উনি যে অধ্যাপক সুন্দরলাল বসু সেটা বুঝতে আমার অসুবিধা হল না।
“পুজোর আগে মোহনকাকুর সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। তারপর একবারের জন্যেও আসেনি। তাই এবার আর কেউ আমাকে পরীক্ষার সময় আর ক্লাসে পড়া বলে দেয়নি। ফলে রেজাল্টও ভালো হয়নি।”
বিপাশা এতক্ষণ গোল গোল চোখে মন দিয়ে সব শুনছিল। কিন্তু আমার কথা শেষ হতেই ও হেসে বলল, “প্রচুর গল্পের বই পড়ে তুই দেখছি এখন নিজেও ভালো গল্প বানাতে শিখে গেছিস! আমি চলি, বুঝলি। আবার একদিন আসব। আরেকটা গল্প বলবি।”
এই বলে ও চলে গেল। আমি যে এতক্ষণ বানিয়ে কিছু বলিনি, সব সত্যি বলেছি, সেটা বিশ্বাসই করল না।
ছবি: স্যমন্তক
কৌশানী, তোমার বাবা তো আমার গর্বের ভাই। আজ বেশ কয়েক বছর ধরে ওর বেশ কিছু গল্পঃ আমি পরে ফেলেছি। এবার আমার বুকটা আরো স্ফিত হয় ছে যেদিন সন্দেশে তোমার গল্পো পরে। আজ বন্ধু ভূত পাড়ে তোমার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে গেলো। তোমাকে আরও গল্পো লিখতে হবে। এছাড়া বর্তমানে সেভাবে ছোটদের গল্প পায়ও যায় না। তুমি লেখো অনেক অনেক নির্মল আনন্দে। আমার শুভকামনা রইলো। খুব তাড়াতা়িই দেখা হচ্ছে। মেজো জেঠু।
LikeLike
কৌশানী, তোমার বাবা তো আমার গর্বের ভাই। আজ বেশ কয়েক বছর ধরে ওর বেশ কিছু গল্পঃ আমি পরে ফেলেছি। এবার আমার বুকটা আরো স্ফিত হয় ছে যেদিন সন্দেশে তোমার গল্পো পরে। আজ বন্ধু ভূত পাড়ে তোমার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে গেলো। তোমাকে আরও গল্পো লিখতে হবে। এছাড়া বর্তমানে সেভাবে ছোটদের গল্প পায়ও যায় না। তুমি লেখো অনেক অনেক নির্মল আনন্দে। আমার শুভকামনা রইলো। খুব তাড়াতা়িই দেখা হচ্ছে। মেজো জেঠু।
LikeLike
অভিনব প্লটের উপর অসাধারণ ভৌতিক গল্প ! ভূত নিয়ে লেখা এত ভালো গল্প বহুদিন পরে পড়লাম মিস্টার দেব । আপনার কন্যারত্ন-কে আমার তরফে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা এক আকাশ । যেভাবে গল্পটা শেষ করেছে…ধোঁয়াশার যে বাতাবরণ তৈরি করেছে, তা সত্যিই অনবদ্য ! ওভাবে শেষ করার মধ্যে দিয়ে কৌশানী তার জাত চিনিয়েছে ! আমার তো মনে হয়, এই মুনশিয়ানা ও পেয়েছে উত্তরাধিকার -সূত্রে । আপনি কী বলেন মিস্টার দেব ? আমি বিশ্বাস করি, একদিন কৌশানী নামী সাহিত্যিক হবে ।
LikeLike