অরিন্দম দেবনাথ-এর সমস্ত লেখা
বরফে থাবার দাগ
অরিন্দম দেবনাথ
“নিচে নেমে চলুন দাদা, এ বরফ পড়া কবে কখন থামবে তার ঠিক নেই। তার থেকেও বড়ো কথা ওই বুড়ো লোকটার হাবভাব আমার ভালো ঠেকছে না।” তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলে উঠল আমার পোর্টার কাম কুক সোনম।
“সে কি, পাহাড়ের লোক হয়ে তুমি ক’দিন ধরে বরফ পড়া দেখে ভয় পেয়ে গেলে?” আমি বললাম।
“না দাদা, বছরের অর্ধেক সময় বরফের সঙ্গে আমরা ঘর করি, বরফকে আমরা ভয় পাই না। কিন্তু যে বুড়োটাকে বক্করথাজ থেকে জুটিয়ে এনেছেন, ওঁর সবসময় তাঁবুর মধ্যে বসে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে যাওয়াটা আমার ভালো লাগছে না। মনে হয় অসময়ের এই তুষারপাতের জন্য ওই লোকটাই দায়ী।”
‘অসময়’ কথাটা ঠিক। শুধু ওই ভেড়-ওয়ালার প্রসঙ্গ ছাড়া। আজ চারদিন ধরে আটকে পড়ে আছি বিয়াস কুণ্ড থেকে দু’হাজার ফুট উঁচুতে প্রায় পনেরো হাজার ফুট উচ্চতার পাহাড়ি ঢালের একচিলতে সমতলের ছোটো তাঁবুতে। এখানে পৌঁছনোর পর থেকেই শুরু হয়েছে তুষারপাত। এই অঞ্চলে সেপ্টেম্বরের এই সময় বিক্ষিপ্ত তুষারপাত কিছু অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অস্বাভাবিক হল চারদিন ধরে টানা তুষারপাত।
আমি তুকতাকে বিশ্বাস করি না। গত দু’বছর ধরে লাহুল-স্পিতির সুউচ্চ পাহাড়ি ঢালে কিছু ব্লু-শিপের ছবি তুলেছি ঠিকই, কিন্তু একটা ছবির বই ছাপানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়। বরং ওই ছবি দেখে আমার ছবি তোলার পৃষ্ঠপোষক সংস্থা বলেছে, ‘আরে এই ছবিগুলো তো ভেঙ্কটেশের শিপ-মাউণ্টেনের মতো হয়েছে। নতুন কিছু স্টোরি লাইন বানাও। রিয়েলিটির সঙ্গে মিথ ঢোকাও! না হলে এত টাকা দিয়ে লোকে তোমার বই কিনবে কেন? মনে রেখ, তোমার লাস্ট বই ‘বিয়ার অন দ্যা ক্লিফ’ পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি বিক্রি হয়েছে তোমার অসাধারণ ফটোগ্রাফি ও ট্রাডিশ্যানাল ওয়াইল্ড লাইফের বই লেখার ধরন থেকে বেরিয়ে এসে লিখেছ বলে।’
এই ‘অন্যরকম’ বই লেখার ভূত আমার মাথা থেকে কিছুতেই নামছে না। অবশ্য এর পেছনে কাজ করছে অর্থের টান। ‘বিয়ার অন দ্যা ক্লিফ’ আমাকে একবছরে দিয়েছে প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকা। এছাড়াও বিভিন্ন দেশে লেকচার দিয়ে আরও কুড়ি লাখের মতো টাকা কামিয়েছি।
মানালি থেকে সোলাং-নালা পেরিয়ে সোলাং ভ্যালির খাড়াই ঢালে বছর পাঁচেক আগে বিভিন্ন ঋতুতে মাসের পর মাস কাটিয়ে দুর্দান্ত সব ভালুকের ছবি তুলেছিলাম। সোলাং ভ্যালি সৌন্দর্যের রানি। এর ঘন সবুজ পাহাড়ি ঢাল ভালুকের আস্তানা। মানালি আমার অপরিচিত জায়গা নয়। মানালির পর্বতারোহণ তথা উইন্টার স্পোর্টস স্কুলের স্কি ট্রেনিং করার সময় এই সোলাং ভ্যালির বরফঢাকা ঢালে প্রথম আচমকা ভালুকের দলের মুখোমুখি পড়ে যাই। তুষারাবৃত পাইনের বনে, মায়ের সঙ্গে খেলা করছিল তার দুই ছানা। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ভালুক পরিবারের কীর্তিকলাপ দেখে অবাক হয়ে গেছিলাম। ভালুক বাচ্চাগুলো মানুষের মতো বরফের গোলা পাকিয়ে ছুড়ে মারছিল একে অপরের দিকে। ছোটো ভিডিও তুলেছিলাম দৃশ্যগুলোর। তারপর দিল্লিতে বসে সেই ভিডিওটা দেখিয়েছিলাম এক ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফারকে। তিনি ছবিগুলো দেখে একবারও ছবির লোকেশান জানতে চাননি। উলটে বলেছিলেন, “পেশাদার ফটোগ্রাফার হতে চাও?” তারপর একটি প্রকাশনা সংস্থার ডিরেক্টরের ইমেল অ্যাড্রেস দিয়ে ভালুকের এই ভিডিওটা মেল করে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন।
তারপরের তিনটি বছর আমার ঘোরের মধ্যে কেটেছিল। লেখালেখিতে আমি সেই স্কুলজীবন থেকেই স্বচ্ছন্দ ছিলাম। প্রকাশনা সংস্থার অর্থানুকূল্যে তিনবছর এই অঞ্চল ছানবিন করে ভালুকের অসাধারণ সব ছবি লেন্সবন্দী করে, কুলুভ্যালির আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা দুর্ধর্ষ সব পৌরাণিক কাহিনির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে সৃষ্টি করেছিলাম অন্যরকম ওয়াইল্ড লাইফের বই ‘বিয়ার অন দ্যা ক্লিফ’। বইটি উৎসর্গ করেছিলাম সেই ফটোগ্রাফারকে যিনি আমাকে অন্যপথ ধরে এগোনোর দিশা দেখিয়েছিলেন।
“দাদা, একটা জিনিস লক্ষ করেছেন?”
“কী বলো তো?”
“বুড়োটা যখন তাঁবুর বাইরে বরফ পরিষ্কার করতে বেরোয় তখন ও শিস দিতে থাকে!”
“এতে অবাক হওয়ার কী আছে! ওটা তো ভেড়-ওয়ালাদের স্বভাব। শিস দিয়ে ভেড়াদের ডাকা।”
“কিন্তু এখানে কোন ভেড়াকে ডাকবে, দাদা?”
“তুমি বুড়োটাকে নিয়ে বড্ড ভাবছ, সোনম।”
“যাই বলুন দাদা, বুড়োটাকে এনে ভালো করেননি। কাল তাঁবু থেকে খানিক দূরে টয়লেট করতে গিয়ে আমি বরফের ওপর কতগুলো থাবার দাগ দেখেছি। অনেকটা কুকুরের মতো।”
“ভেড়-ওয়ালার কুকুর হবে হয়তো। মনিবকে খুঁজতে খুঁজতে এসে পড়েছিল…”
“না দাদা, দাগগুলো কুকুরের পায়ের ছাপের থেকে একটু অন্যরকম।”
“দাদা, আপনি এই ভেড়-ওয়ালাটাকে হঠাৎ সঙ্গে নিতে গেলেন কেন বলুন তো?”
“আরে গতবছর ওর সঙ্গে বাতালে আলাপ হয়েছিল। ওর একটা ছবি তুলেছিলাম। ও জানে আমি ভেড়ার ছবি তুলে বেড়াচ্ছি। বক্করথাজে দেখা হতে সেই প্রিন্টটা ওকে দিতেই ও বলল ও আমার সঙ্গে আসতে চায়। ও এমন ভেড়ার কথা জানে, যা কেউ কল্পনা করতে পারবে না। ওই ভেড়ার কথা নাকি ও ওর দাদুর কাছে শুনেছে। ওই ভেড়ার দেখা দেবার নাকি সময় হয়ে এসেছে। আর ও সঙ্গে থাকলেই নাকি সেই ভেড়ার দেখা পাওয়া সম্ভব।”
“দাদা, ওই ভেড়ার গল্প তো এ-অঞ্চলে অনেকদিন ধরে চলে আসছে। কিন্তু কেউ চোখে দেখেছে বলে শুনিনি। বুঝেছি, আপনি ওই গল্প শুনেই এখানে এসেছেন।”
ভালুকের ছবি তোলার সময় আমার বর্তমান সঙ্গী সোনমকে জুটিয়ে দিয়েছিলেন মানালির পর্বতারোহণ স্কুলেরই এক শিক্ষক। বলেছিলেন, “সোনম এই অঞ্চলটা চেনে গুগল ম্যাপের মতো। আর ওর মত সাহসী আর কুশলী পাহাড় চড়িয়ে কুলি এই চত্বরে পাবে না। ওর আরেকটা গুণ, ও নিখুঁত লক্ষ্যে ছুরি ছুড়তে পারে। ভালুকের খপ্পরে পড়লে ওই তোমাকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসবে। তবে হ্যাঁ, এই অঞ্চলে জন্তুজানোয়ার নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে, সবকিছু বিশ্বাস করে তার পেছনে ছুটতে গিয়ে অযথা বিপদ ডেকে এনো না। তবে সঙ্গে সোনম থাকলে ও তোমাকে এদিক ওদিক ছুটতে দেবে না।”
কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। সঙ্গে যা খাবার ও কেরোসিন তেল আছে তাতে আরও দিন সাতেক চলে যাবে। কিন্তু সমস্যা একটাই, পাঁচদিন ধরে বরফ দেখে দেখে চোখে ঘোর লেগে গেছে। সারাদিন ধরে তাঁবুতে শুয়ে থেকে থেকে হাত-পায়ের গাঁটে গাঁটে ব্যথা হচ্ছে।
তিনজনকে পালা করে জেগে থাকতে হচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়লেই বরফ চাপা পড়ে মরে যেতে হবে। প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তাঁবু থেকে বেরিয়ে মেস্টিন দিয়ে বরফ ছেঁচে ফেলতে হচ্ছে তাঁবুর ওপর থেকে। তাঁবুর চারপাশ থেকে বরফ যতটা সম্ভব কেটে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি আমরা। চারপাশের স্তূপীকৃত বরফের উচ্চতা টেন্টের মাথা ছুঁয়ে ফেলেছে প্রায়।
শ্বাসকষ্ট না হলেও হাঁফ ধরছে একটু পরিশ্রম করলেই। পরিস্থিতি যা তাতে আলগা বরফে তাঁবু গুটিয়ে নিচে নামাটাও বিপদজনক। আমরা কোনও অভিযানে আসিনি। তাই দড়িদড়া বা অন্যান্য সরঞ্জাম সঙ্গে নেই। তবে নিরাপত্তার জন্য আমি প্রতি পাহাড়ি ট্রিপে একটা দড়ি, তুষার গাঁইতি, কয়েকটা পিটন ও একটা হাতুড়ি সঙ্গে রাখি। এবারও ওগুলো সঙ্গে আছে। ওই সামান্য সরঞ্জামের ভরসায় খাড়াই ঢালটা বেয়ে নামা যায় ঠিকই। কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না। কেন জানি না মনে হচ্ছে, কেউ চাইছে আমি যেন এ জায়গা থেকে না নড়ি।
সকালে থেকে বরফ পড়া বন্ধ। দমকা বাতাস উঠছে খানিক থেকে থেকে। আবহাওয়া ভালো হওয়ার লক্ষণ। সোনমের সঙ্গে মেস্টিন দিয়ে টেন্টের চারপাশ থেকে বরফ পরিষ্কার করছিলাম। তখনই সোনম ফিসফিস করে বলল, “দাদা চলুন, শুধু আপনার ক্যামেরাগুলো নিয়ে বিয়াসকুণ্ডে নেমে যাই। কতক্ষণ আর লাগবে! খুব বেশি হলে ঘণ্টা দুয়েক। সেখান থেকে সোলাং ফিরে যাই। মৌসম ভালো হয়ে গেলে আমি এসে সব গুছিয়ে নিয়ে যাব।”
“সোনম দেখো, বরফ পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। নিচে নামার কোনও মানে নেই।”
“দাদা, বরফ গলতে গলতে আমাদের রেশন শেষ হয়ে যাবে। ও ও… ওদিকে দেখুন।”
সোনমের আঙুল লক্ষ্য করে দেখি খানিক দূরে পাহাড়ের গায়ে খোঁচরের মতো বেরিয়ে থাকা অংশের নিচের একটা বড়ো পাথরের ওপর বসে আছে বুড়ো ভেড়-ওয়ালা, সমস্ত শরীরটা অদ্ভুতভাবে সামনে-পেছনে, ডানে-বাঁয়ে দুলছে। আশ্চর্যভাবে পাথরটার ওপর কোনও বরফ নেই।
ছবি তুলতে তুলতে চোখ এমন হয়ে গেছে যে সামান্যতম নড়াচড়াও চোখ এড়ায় না। তাহলে আমার চোখ এড়িয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এতটা পথ গেল কখন লোকটা?
“দাজু, দাজু…”
কোনও সাড়া নেই। অস্বাভাবিকভাবে দুলছে শরীরটা।
“দাদা, দেখুন!”
একটা কালচে ঘন মেঘ কুণ্ডলী পাকিয়ে এগিয়ে আসছে পাহাড়ের গা বেয়ে। এরকম মেঘ আমি কোনোদিন দেখিনি। খানিক আগে উজ্জল হয়ে যাওয়া চারপাশ আবার ধোঁয়াটে হয়ে উঠেছে। আবার তুষারপাত শুরু হল।
কোথায় যেন একটা ভেড়া ডাকছে। ঠিক ভেড়ার ডাক নয়, ভেড়ার স্বরে কোনও জন্তু যেন একটা গর্জন করছে। বুড়ো ভেড়-ওয়ালাকে আর দেখা যাচ্ছে না। মেঘ আড়াল করে দিয়েছে ওকে।
সিঁ সিঁ করে বাতাসে একটা শব্দ জেগে উঠছে। ঠিক যেন কেউ চাপা স্বরে শিস দিচ্ছে। অনবরত হয়ে চলেছে শব্দটা। ঠিক যেন কেউ তার পোষ্যকে শিস দিয়ে ডাকছে। ঠিক যেমন করে পাহাড়ে ভেড়-ওয়ালারা ভেড়াদের ডাকে। বড়ো বড়ো পাথর গড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটা অজানা ভয়ের স্রোত নামছে শিরদাঁড়া বেয়ে। এরকম অনুভূতি আগে কখনও হয়নি। তবে কি ধ্বস নামছে! তাহলেই তো শেষ। বরফের আর পাথরের স্রোত এখুনি আমাদের উপড়ে নিয়ে নামবে নিচের কুণ্ডে। বরফ সমাধি হবে আমাদের।
সোনম কোথায় গেল? ওকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
“সোনম!” চিৎকার করে উঠলাম আমি।
“দাদা, আমি আপনার পেছনেই আছি, কোনও শব্দ করবেন না। দেখুন।” চাপা স্বরে বলে উঠল সোনম।
দূর থেকে ছুটে আসা কালো মেঘের কুণ্ডলীটা প্রায় গা ঘেঁষে বেরিয়ে এগিয়ে গেল সামনের বড়ো পাথরটার দিকে, যেখানে বসে আছে বুড়ো ভেড়-ওয়ালা।
বরফের উপর ফুটে উঠল উঠল কতগুলো থাবার দাগ। এ-দাগ আমি চিনি। এ-দাগ চিতাবাঘের।
আচমকাই থেমে গেল সব শব্দ। আঁধার কেটে পরিষ্কার হয়ে গেল চারদিক।
শিসের শব্দ আর ভেড়ার ডাকে সামনে তাকিয়ে দেখি, পাথরের ওপর বসে থাকা ভেড়-ওয়ালার কাঁধের ওপর দু’পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত দু’শিংওয়ালা ধূসর রঙা একটা ভেড়া। ভেড়াটার নিচের অংশ অবিকল চিতাবাঘের।
অলঙ্করণ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়